ছবি কৃতজ্ঞতা: ক্যামেলিয়া সুলতানা মিতা

লাভ ডায়েরি: ছোট্ট চিরকুটে মিষ্টি ভালোবাসার গল্প

কে এন দেয়া
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:৪৫
আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:৪৫

(প্রিয়.কম) পাঠকের জন্য, পাঠকেরই ভালোবাসার কাহিনী নিয়ে আমাদের আয়োজন "প্রিয় লাভ ডায়রি"। মিষ্টি একটা প্রেম বা বিয়ের গল্প সবার জীবনেই থাকে। আপনারও কি আছে এমনই একটি দুষ্টু-মিষ্টি ভালোবাসার কাহিনী? তাহলে দারুণ কিছু ছবি সহ যোগাযোগ করতে পারেন আমাদের সাথে। আপনার ভালোবাসার সেই মিষ্টি কাহিনী ছাপা হবে প্রিয়.কমের পাতায়, জানবে সারা বিশ্ব। নিজের ভালোবাসার কথা সকলকে জানাতে চাইলে ছবি সহ যোগাযোগ করুন আমাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। পেজ লিঙ্ক-https://www.facebook.com/priyolife

ভালোবাসার গল্পগুলো ইদানিং অন্যরকম হয়ে এসেছে। ফেসবুক থেকে ভালোবাসা, এরপর বিয়ে- এমন গল্পই বেশী। বেশিরভাগ মানুষ একাধিক প্রেমের পরেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অনেকে আবার সেই পথ না মাড়িয়ে পরিবারের পছন্দেই বিয়ে করছেন। 

পুরনো আমলে একটা ব্যাপার খুব দেখা যেত, তা হলো ছোট্ট চিরকুটে লেখা প্রেমপত্র। ছোট ভাই বা বোনের হাতে করে এই চিঠি চলে যেত প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে। এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে চলত প্রেম। এখন স্মার্টফোনের যুগে হারিয়ে গেছে সেই লজ্জামাখা গল্পগুলো। ক্যামেলিয়া সুলতানা মিতা স্মৃতির পাতা থেকে তেমনই এক গল্প নিয়ে এসেছেন আজ।

২০০৭ সালের কথা। ক্লাস এইটে পড়া ক্যামেলিয়ার স্কুলের পরীক্ষাগুলো শেষ হলো সবে। বাড়িতে বেড়াতে আসা এক দুষ্টু কাজিনকে নিয়ে আড্ডার মাঝে এক সময় ছাদে ঘুরতে গেলেন। সচরাচর ছাদে আসা হয় না তার। তবে ছাদে এসে বুঝলেন পাশের ছাদের কারো সাথে কাজিনের প্রেম প্রেম ভাব চলছে। বোনকে একটু প্রাইভেসি দিতেই ওদিক থেকে সরে এলেন তিনি। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে তাকেও যে কেউ দেখছে, এটা মোটেই বুঝতে পারেননি তিনি। 

ছাদ থেকে নেমে আসার সময়ে বুঝতে পারলেন সিঁড়িঘর দিয়ে কেউ তাকে ফলো করছে। দেখেও না দেখার ভান করে চলে এলেন। পরদিন আবারো কাজিনের সাথে ছাদে গেলে দেখেন পাশের ছাদে ক্যারম খেলছে দুজন ছেলে, আরিফ এবং সোহাগ। দুজনের মাথাই ন্যাড়া। দেখে হেসে কুটিকুটি হয়ে গেলেন ক্যামেলিয়া। টুকটাক কথা শুরু সেখান থেকেই। এরপর ক্যামেলিয়া প্রায়ই স্কুলে যাবার সময়ে খেয়াল করতেন সেই দুজন বাসার নিচে দাঁড়িয়ে। তেমন একটা পাত্তা দিতেন না তিনি।

01

২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চুপিসারে বিয়ে হয় তাদের।

কিছুদিন পর সাহস করে ক্যামেলিয়ার সাথে কথা বলতে এলেন সোহাগ। ক্যামেলিয়ার নাম, কোন স্কুলে পড়ে এসব জিজ্ঞাসা করার মাঝেই ইতস্তত করে তার হাতে দিলেন একটা চিরকুট। বুঝেও না বোঝার ভান করেন ক্যামেলিয়া।  বাসায় গিয়ে খুলে দেখেন ছোট্ট একটা প্রেমপত্র, আর একটা ফোন নাম্বার। 

ফোন নাম্বার পেয়েও ফোন না দেওয়ায় কিছুদিন পর আবারো বাসার সিঁড়িতে দেখা হলো, ক্যামেলিয়াকে আরেকটি চিরকুটে নিজের ফোন নাম্বার দিলেন তিনি। সামনে দাঁড়িয়েই তা ছিঁড়ে ফেলেন ক্যামেলিয়া। “লাগবে না,” বলে চলে যান। তখন সোহাগের মুখটা হয়েছিল দেখার মত। 

চিরকুটে কাজ হচ্ছে না দেখে একদিন সরাসরিই প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ফেলেন তিনি। ক্যামেলিয়া একে তো বয়সে ছোট, অন্যদিকে দারুণ দুষ্টু। “এসব কী বলছেন! আমি কিন্তু আব্বুকে বলে দিব!” বলে কোনোভাবে কাটানোর চেষ্টা করলেন ক্যামেলিয়া। তখন তার কাজিন এসে বলে, “ভাইয়া, ক্যামেলিয়া কিন্তু সিঙ্গেল না! আমি সিঙ্গেল আছি, আমার সাথে প্রেম করতে পারেন!”, বলে দুজনেই হেসে কুটিকুটি। 

“আসলে, যার চোখে যাকে ভালো লাগে,” হেসে দেন সোহাগ। “আর আমার চোখে ক্যামেলিয়াকেই ভালো লাগে।“

কাজিন চলে যাবার পর বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন ক্যামেলিয়া। তখন আর ছাদে যাওয়া বা দেখা হবার অন্য কোন উপায়ই ছিল না। বাড়িতে তখন ছিলেন ক্যামেলিয়ার ছোট কাকি, যে কিনা তখন ক্যামেলিয়ার সবচাইতে কাছের বান্ধবী। তার ফোন থেকেই সেই ফোন নাম্বারে কল দেওয়া হলো। প্রথমবার ক্যামেলিয়া নিজে কথা বলেননি, তবে সোগাহ বুঝে ফেলেন ক্যামেলিয়ার থেকেই আসে ফোন। কিছুদিন পর ক্যামেলিয়া নিজের বাবার ফোন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফোন করেন। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই বাবার ভয়ে আবার ফোন কেটেও দেন। 

তখনো পর্যন্ত তাদের সম্পর্কের কোন নাম না থাকলেও খুনসুটির কোন অভাব ছিল না। সোহাগের বন্ধু আরিফও ক্যামেলিয়ার প্রতি দুর্বল ছিলেন। একদিন ফোন দেবার পর আরিফ কেমন আছে, তা জানতে চাইলেন ক্যামেলিয়া। ভীষণ জেলাস হয়ে পড়েন সোহাগ। এমনভাবে একটু একটু করে ভালোবাসা বাড়তে থাকে। লুকোছাপার মাঝেই একদিন ক্যামেলিয়া বলে ফেলেন, ‘ভালোবাসি’।

প্রেম চলছে প্রেমের মতই। একদিন প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন দুজনে। তখনো নিজের ফোন নেই ক্যামেলিয়ার। বাবার ফোন থেকে মিস কল দিয়ে ফোন রেখে অন্য রুমে চলে গেলেন। সোহাগ কল দিলে তা রিসিভ করে ফেলেন ক্যামেলিয়ার মা। সোহাগ জিজ্ঞেস করেন, “কে আপনি?” জবাবে ক্যামেলিয়ার মা বলেন, “আমি একজন মা।” বুদ্ধি করে সোগাহ উত্তর দেন, “আপনি মা হলে আমি আপনার ছেলে।” এ কথা শুনে নিমিষেই গলে গেলেন ক্যামেলিয়ার মা। কারণ ক্যামেলিয়ার বোন থাকলেও ভাই ছিল না কোন। এরপর থেকে সোহাগ ফোন দিয়ে ক্যামেলিয়ার পাশাপাশি তার মায়ের সাথেও কথা বলতেন নিয়মিত। ক্যামেলিয়া ভাবেন, যাক এবারের মতো ফাঁড়া কাটলো। 

মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে তার এমনই প্রিয় পাত্র হয়ে পড়েন সোহাগ, যে একসময় তাকে বাড়িতে দাওয়াত দেওয়া শুরু হয়। সরল মনে ক্যামেলিয়াকে পড়ায় সাহায্য করার দায়িত্বটাও তাকে দিয়ে দেন। এরপর থেকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে ফোন দেওয়ার দরকার পড়ে না। পড়ার ছুতোয় ফোন দিয়ে চলে প্রেম। 

চিরকুটের কথা প্রায়ই মনে পড়ত ক্যামেলিয়ার। একদিন তার দরজার সামনে লুকিয়ে একটা চিঠি রেখে যান সোহাগ। বাসার সবার থেকে লুকিয়ে ছয় পাতার সেই চিঠি বাথরুমে বসে পড়ে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে পড়েন ক্যামেলিয়া। 

ভালোবাসায় যেমন মিষ্টি খুনসুটি ছিল, তেমনই ঝগড়াঝাঁটিও কম হয়নি। একটা সময় নিজে থেকেই মা’কে সব জানিয়ে দেন ক্যামেলিয়া। আর কত লুকোচুরি করা যায়? মা প্রথমে রাগ করলেও পরে তার আশীর্বাদেই আরো সহজ হয়ে ওঠে তাদের প্রেম। বিশেষ করে ক্যামেলিয়ার বাবার থেকে এ ব্যাপারটা লুকানো তো মায়ের সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিলই না। 

এ পর্যন্ত সবই চলছিল ভালো। কিন্তু সব সফল প্রেমের পেছনেই থাকে একটা যুদ্ধের কাহিনী। ক্যামেলিয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ক্যামেলিয়ার বাবা হার্ট অ্যাটাক করার পর তার বিজনেস পার্টনারের সাথে ক্যামেলিয়ার বিয়ে দেবার অঙ্গীকার করেন। তা জানার পর ভীষণ চিন্তায় পড়েন ক্যামেলিয়া ও তার মা। ক্যামেলিয়ার মা বলেন, “আমি তো ক্যামেলিয়ার জন্য ছেলে পেয়ে গেছি।“ 

তা জানার পর তার বাবা সেই ছেলেকে দেখতে চান। সোহাগ বাড়িতে এলেও তার বাবা মোটেই রাজি হতে চান না তার হাতে ক্যামেলিয়াকে তুলে দিতে। চুপচাপ কোন প্রতিবাদ না করেই সেদিন চলে যান সোহাগ। 

সেই বছরেই একদিন বাবাকে না জানিয়ে সোহাগের সাথে বাইরে বেড়াতে যান ক্যামেলিয়া। কিন্তু এক প্রতিবেশির থেকে বাবা তা জেনে ফেলে। ক্যামেলিয়ার মা ফোনে তা জানিয়ে দিলে দারুণ চিন্তায় পড়ে  যান তিনি। একটু মজার ছলেই তার মন ভালো করার জন্য সোহাগ বলেন “বাসায় গিয়ে তোমার আব্বুকে বলো, আমরা বিয়ে করে ফেলেছি”। সহজ সরল ক্যামেলিয়া আসলেই বাড়ি গিয়ে তা বলে দেন। 

02

২০১২ সালে ক্যামেলিয়ার কোলজুড়ে আসে সন্তান হৃদি।

সবার চোখ তো কপালে! ক্যামেলিয়ার মা অবাক, বাবা তো পারলে মারতে আসেন। মা জিজ্ঞেস করলেন দেনমোহর কত ছিল। ক্যামেলিয়া তো জানতেনও না সেটা কী! সব আত্মীয়রা জেনে গেল ইতোমধ্যেই। সবার বকাঝকায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ক্যামেলিয়া। সোহাগ ফোন করে যখন তার মা’কে বলেন আসলে তারা বিয়ে করেননি, তখন ভীষণ রেগে যান ক্যামেলিয়ার মা। 

এ সব কিছুর মাঝে সোহাগ ঠিক করে ফেলেন, আর দেরি নয়। ক্যামেলিয়াকে পরিবার থেকে তার বাবার বিজনেস পার্টনারের সাথে বিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। 

একদিন রাত্রে ক্যামেলিয়াকে ফোন করে সোহাগ প্রশ্ন করেন, তার সহায় সম্বল বলতে তেমন কিছু নেই, চাকরিও নেই। এই অবস্থায় তাকে বিয়ে করলে কি ক্যামেলিয়া সুখী হতে পারবে? ক্যামেলিয়া কোন চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে বলে দিলেন, “হ্যাঁ, আমি পারব।“

ঠিক তার পরের দিন খুব কম টাকা সম্বল করে ক্যামেলিয়ার মায়ের কাছে আসেন তিনি। বলেন, “মা, আমি ক্যামেলিয়াকে বিয়ে করতে এসেছি, আপনি কি রাজি?”

বাড়িতে কাজি ডাকিয়ে বিয়েটাও পড়িয়ে ফেলা হয় চুপিসারে। নেই কোন বাদ্য-বাজনা। হুট করে তার কিছুক্ষণ পরেই ক্যামেলিয়ার চাচা বাড়িতে এসে পড়ার ফলে অবশ্য ব্যাপারটা গোপন রাখার আর উপায় ছিল না। সন্ধ্যেবেলা ফোন করে ক্যামেলিয়ার বাবাকেও জানিয়ে দেওয়া হয়। 

শেষ হয়ে এলো তাদের ভালোবাসায় বাধা-বিপত্তির দিনগুলো। আগের মতোই ভালোবাসায় ভিজে ভিজে চলতে থাকে তাদের দিন। পড়াশোনা ঠিকমতোই চালিয়ে গেছেন ক্যামেলিয়া। ২০১২ সালে তাদের ঘরজুড়ে আসে কন্যা সন্তান হৃদি। ক্লাস এইটের সেই মেয়েটি কিছুদিন আগেই ২০১৭ সালে বিবিএ শেষ করেন।  তাদের ভালোবাসার ১০ বছর পূরণ হবে ২০১৮ সালেরই ১৬ জানুয়ারি। সারাজীবন যেন এই ভালোবাসা অমলীন থাকে, সেই কথাই ভাবেন ক্যামেলিয়া। 

প্রিয় লাইফ/ আর বি