ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় অনেক মানুষের অবদান রয়েছে: এম আযীযুল হক

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ০৬:২২
আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ০৬:২২

এম আযীযুল হক। ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম।

(প্রিয়.কম) এম আযীযুল হক- ফাদার অব ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড- ২০০৫ লাভ করেন। তিনি সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে দীর্ঘ ১২ বছর প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ১০ বছর শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স জগতের পুরোধা জনাব এম আযীযুল হক ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বর্তমানে তিনি ইসলামী ব্যাংকিং কনসালটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শরীআহ্ সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান এবং সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের সূচনা, পথচলা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে প্রিয়.কমের সাথে কথা বলেন এম আযীযুল হক।

প্রিয়.কম: বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সূচনা ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলুন।

এম. আযীযুল হক: ১৯৭৯ সালে ২২ নভেম্বর (১ মহররম ১৪০০ হিজরি), এদিন আমরা প্রথম ইসলামী ব্যাংকের কাজ শুরু করি। আমি তখন সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের প্রিন্সিপাল। সেসময় ৬ টা ন্যাশনালাইজড ব্যাংক ছিল- সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, উত্তরা, পূবালী। প্রাইভেট সেক্টরে এগুলো ছাড়া দেশি কোনো ব্যাংক ছিল না। বিদেশি কয়েকটি ব্যাংকের শাখা ছিল বাংলাদেশে। এখন প্রাইভেট যত ব্যাংক দেখছেন, এগুলো সব আরও পরে হয়েছে। আমি প্রথমে সেই ন্যাশনালাইজড ৬টি ব্যাংকের বিভিন্নজনের সাথে কয়েক সপ্তাহ ধরে আলাপ করে ২২ নভেম্বর ১৯৭৯ –এ একটা মিটিং অর্গানাইজ করেছিলাম। মিটিংয়ের বিষয় ছিল, বাংলাদেশে কীভাবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সূচনা করা যায়। বর্তমানে সেনাকল্যাণ সংস্থার যে ভবনটা রয়েছে- ওখানেই ছিল গ্লাক্সো ভবন। আমার অফিস অর্থাৎ সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের অফিসও ছিল সেখানেই। ওখানেই লেকচাররুমে আমরা মিটিংটা করলাম। সেই মিটিংটা প্রিজাইড করেছিলেন পূবালী ব্যাংকের তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর খালেদ সাহেব। তিনি খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলামী ব্যাংকের উপদেষ্টা হয়েছিলেন।

যাই হোক, আমাদের সেই মিটিংয়ে খুব বেশি জনসমাগম হয়নি। ২০ জনের মতো লোক উপস্থিত হয়েছিল। তখন পাশের রুমেই ভিন্ন একটা ক্লাস চলছিল যেখানে আমাদের অফিসার ছিলেন ৪০-৫০ জনের মতো। আমি ওখানকার টিচারকে বললাম—  ক্লাসে যারা আছেন, তারা তো সবাই ব্যাংকের এমপ্লয়ি, তাদেরকে আমাদের মিটিংয়ে পাঠিয়ে দিন। মিটিংটা যেন জমে। সুতরাং ২০ জনের সাথে ৪০ জন মিলে এবার ৬০ জন হয়ে গেল। সেইদিন আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সূচনা করার জন্য যত ধরনের কাজ করা দরকার— কর্মী তৈরি করা, স্পন্সর জোগাড় করা, গভর্নমেন্টের সঙ্গে নেগোশিয়েট করা, বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাপ্রুভাল সংগ্রহ করা ইত্যাদি সব বিষয়াবলী আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাব। এছাড়া আমরা একটা বডি অর্গানাইজ করার সিন্ধান্তও নিলাম, যা বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং স্টাবলিশড করার জন্যে যতকিছু করা দরকার, সব করবে। এটাই ঠিক হলো। প্রত্যেক ব্যাংক থেকে দুজন-দুজন করে মোট ১৪ জন ব্যাংকার নিয়ে খালিদ সাহেবকে চেয়ারম্যান ও আমাকে সেক্রেটারি জেনারেল করে আমরা একটা কমিটি করলাম এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে কাজ শুরু করলাম।

আমরা ১৯৭৯ সালে ২২ নভেম্বর এই কমিটি করেছি এবং এর ৩-৪ বছর পর ১৯৮৩ সালে ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এই ৩-৪ বছরের মধ্যে আমরা কারও থেকে ব্যাংক স্টাবলিশড করা বাবদ একটা পয়সাও নেইনি। কারও কাছে চাঁদা চাইনি। এমনকি নানান সময়ে স্পন্সরেরা যে আসছে, তারাও এই বাবদ কোনো টাকা দেয়নি।

তখন ব্যাংকের অফিস আওয়ার ছিল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ৪টা। সাড়ে ৪টার পরে আমাদের সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কমিটির মেম্বাররাসহ যারা যারা ইসলামি ব্যাংকিয়ের প্রতি আগ্রহী, তারা তারা চলে আসতো। আমরা সাড়ে ৪টা থেকে শুরু করে সাড়ে ৬টা বা সাড়ে ৭টা— দুই-তিন ঘণ্টা কাজ করতাম।

প্রিয়.কম: তখন আপনারা মূলত কী ধরনের কাজ করতেন?

এম. আযীযুল হক: কাজ মানে ধরুন, ব্যাংকের ম্যানুয়াল তৈরি করা, ফর্ম তৈরি করা, বই তৈরি করা ইত্যাদি এবং এরা সবাই ছিলেন ভলান্টিয়ার। কেউ তাদের একপয়সা দেয়নি এবং তারাও নেয়নি। আমি যে কাজ করতাম, আমাকেও কেউ পেমেন্ট করেনি এবং আমিও কাউকে কিছু দিতে পারিনি।

এইভাবে কাজ করতে করতেই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন বিষয়-কাজপত্র তৈরি হয়ে যাচ্ছিলো। এরপর দেখা গেল, যারাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে কোনো কিছু করতে চায়, শুনতে বা জানতে চায়, তারা আমার এখানে আসে। বিদেশ থেকে ডেলিগেট আসলে আমার এখানে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ইসলামী ব্যাংকিংকেন্দ্রিক কোনো আলোচনা হলেই বলে, সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে যান, আযীযুল হক সাহেবের কাছে যান, তিনি ইসলামি ব্যাংক অর্গানাইজ করছেন। অর্থাৎ এ সম্পর্কে কিছু হলেই আমার এখানে পাঠানো হতো। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের কাজে কথা ও চর্চার সুনাম চারিদিকে ছড়াতে শুরু করলো। তখন তো আমরা কল্পনাও করতে পারিনি যে, একসময় এটা অনেক বড় একটা প্রতিষ্ঠান হবে এবং সিস্টেমেটিক্যালি একটি ইসলামী ব্যাংক হবে। কাজ করে গেছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। হলে হলো, না হলে পরকালে পাওয়া যাবে। এইভাবে কাজ করেছি যে, কত বছর লাগবে তা-ও জানি না, তারপরও কাজ করে গেছি।

এরপর আমাদের হাতে যখন ইসলামী ব্যাংকিং সংক্রান্ত কিছু ম্যাটেরিয়াল তৈরি হলো তখন ভাবলাম, এবার আমরা কিছু ট্রেনিংয়ের কার্যক্রম শুরু করতে পারি এবং এর মাধ্যমে  কিছু আর্থিক সচ্ছলতাও অর্জন করতে সক্ষম হতে পারি। এভাবে আমরা কিছু ট্রেনিং করলাম। সেখান থেকে অর্জিত অর্থ ট্রেনিং পারপাস খরচ করে বাকি অর্থ বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিবা)- এর নামে ইসলামী ব্যাংকের সিএসআর ফান্ডে এখন কিছু টাকা জমা আছে। বিবার তৎকালীন শ্লোগান ছিল- বিবা টু ফাইট রিবা।

আমার মাধ্যমে যেহেতেু এই কাজের নেতৃত্ব প্রদান করা হয়েছে তাই সবাই আমার কথা জানে। কিন্তু আমি যখন পেছনে তাকাই তখন দেখি যে, এই কাজ স্ট্যাবলিশড হওয়ার নেপথ্যে অনেক মানুষের অনেক অবদান রয়েছে। অনেক মানুষ অনেকভাবে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্য আমাদের সহযোগিতা করেছেন। ১৯৮১ সালে জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে যখন ইসলামী ব্যাংক করার জন্য আবেদন করা হয়েছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা আমাদের কার্যক্রমের বিভিন্ন খবর আন্তরিকতার খাতিরে আমাকে জানাতো। এমনও হয়েছে যিনি খবর আমাকে জানাতেন আমি তাকে চিনতামও না।

আরো একটি সহযোগিতার কথা বলি। আমার সোনালী ব্যাংকের যিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন, তার নাম হলো কে.এ. রশিদ। তিনি স্টাফ কলেজে আমার পারফরমেন্সের জন্যে এতো কনভিন্স ছিলেন যে, আমি কোনো অ্যাপ্লিকেশন দিলে তার কোনো ব্যাখ্যা চাইতেন না। কোনো ইম্পর্টেন্ট ফাংশনে গেলে তিনি আমাকে নিয়ে যেতেন। একবার পুরো নর্থবেঙ্গল ট্যুরে তিনি আমাকে নিয়ে গেছেন, সর্কিট হাউসে একসঙ্গে ছিলাম। সে-সময় একদিন আমরা লবিতে বসেছিলাম। কারেন্ট চলে গেছে, অন্ধকার— এমন সময় তাকে বললাম, স্যার আমি তো একটা কাজ শুরু করেছি। আপনাকে জানানো হয় নাই। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কাজ।’ বললাম, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং স্টাবলিশ করার জন্যে আমরা একটা গ্রুপ কাজ করছি এবং সেই গ্রুপের লিডার আমি। এমডি সাহেব বেশ ধার্মিক লোক ছিলেন। সব শুনে আমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, ভালো কাজ করছেন। তবে কখন কী করছেন এবং কখন কী হলো তার আপডেট আমাকে জানাবেন। কারণ একটি ভালো কাজ করতে গিয়ে আপনি যেন বিপদে না পড়েন এবং আমাকেও যেন বিপদে না পড়তে হয় সেদিকে সর্তক থাকতে হবে।’ 

সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি এম আযীযুল হক। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. হায়দার আলী মিয়া ও একিউএম ছফিউল্লাহ আরিফ। ছবি: সংগৃহীত 

প্রিয়.কম: তখন এ-কাজ করতে গিয়ে সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কী না?

এম. আযীযুল হক: হুম। বাধা এসেছে। বহু বাধার সম্মুখীন হয়েছি। একেবারে সাকসেসফুল সিচুয়েশনে যখন এসে গেছি, তখন বাধা বেশি এসেছে। তখন আমার লেভেলে তখন যারা ছিলেন তারা অনেকে দেখলেন, স্টাফ কলেজের কার্যক্রমের কারণে আমি বেশ আলোচিত। আবার ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে আলোচনা হলে সেখানেও পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়। তারা ভাবলেন, ‘আমি একজন এজিএম, তিনিও একজন এজিএম। তার সঙ্গে এতো বড় বড় মানুষের সংযোগ, আর আমার সাথে নেই। তার নাম সাত দিন পরে পরে পত্রিকায় আসে, আমারটা আসে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং তারা খুঁজতে থাকলেন যে, আমার বিরুদ্ধে কিছু পাওয়া যায় কী না।

একটি ঘটনা বলি— একবার কায়রোর আল-আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে সারা পৃথিবীতে যেসব স্থানগুলোতে ইসলামী ব্যাংক হয় এবং যারা সেগুলোর লিডারশিপ দিচ্ছেন তাদেরকে দেড় মাসের জন্য একটি প্রশিক্ষণে ডাকলো। হোল ওয়ার্ল্ডের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিত্ব ড. আহমদ আল-নাজ্জার সেখানেও নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ড. নাজ্জার সাহেবের পক্ষ থেকে আমার কাছে দাওয়াত এলো, আমি যেন সেই কোর্সটাতে অংশগ্রহণ করি। একই সঙ্গে এটাও বলা হলো যে, ‘তোমার ওখানের গুরুত্বপূর্ণ যারা আছেন, চাইলে তাদেরকেও আনতে পারো।’ আমি তাকে টেলিগ্রাম করলাম, আমি কতজন আনতে পারি? তিনি বললেন, ‘তুমি যতজন পারো নিয়ে আসতে পারো, কোনো লিমিট নেই।’ আমি আমার ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের মধ্যে খোঁজ নিলাম যে, পাসপোর্ট আছে কার কার এবং ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে নয়, প্রাইভেট সিটিজেন হিসেবে পাসপোর্ট কার আছে। একজনকে পেলাম যার প্রাইভেট সিটিজেন হিসেবে পাসপোর্ট আছে। তার নাম ছিল আব্দুল মান্নান। কারণ ব্যাংকার পরিচয় পাসপোর্টে থাকলে বাইরে যেতে হলে সেই ব্যাংকের ও সরকারি অনুমোদন লাগে। আমি সেই একজনকে বললাম, তুমি সেখানে যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে পারো। যাই হোক, যাকে আমি সাথে নিয়েছিলাম সে দেড় মাসের ছুটি নিয়েছিল। কিন্তু কোর্স কমপ্লিট করে ফিরে আসার পর কর্তৃপক্ষ কীভাবে যেন তার বিদেশে যাওয়ার কথা জেনে গেলো এবং তার নামে একটা কমপ্লেইন দিলো যে, পার্সোনাল কাজের জন্যে ছুটি নিয়ে সে মূলত এই সময়ে সরকারি পারমিশন না নিয়েই দেশের বাইরে গিয়েছিল। তা ছাড়া সেই কোর্সে আমিও যোগদান করেছি। সুতরাং এটা একটা অপরাধই বটে। এখন সে-ছেলেটার যদি বিচার হয়, তাহলে আমারও হবে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে আমার নামে একটা চিঠিও এসেছিল। কিন্তু বিষয়টি আমার হাত হয়ে যখন এমডি সাহেবের কাছে গেল তখন তিনি বলেন, ‘একটা ছেলে পার্সোনাল ছুটি নিয়ে বাড়ির কাজ না করে অন্য কাজ করেছে কী করেনি, সেটা তোমরা খুঁজতে গেলে কেন?’ স্যার এভাবে বিষয়টিকে মিটমাট করে দিয়েছিলেন।

আগেই বলে রাখি, আামি ঐ কোর্স শুরু হওয়ার একদিন পর সেখানে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। ওখানে যাওয়ার জন্য আবেদন করলাম। আমার যাওয়ার জন্য গভর্নমেন্টের পারমিশন লাগবে। আর পরমিশন দেয় অর্থমন্ত্রণালয়। বাংলাদেশে ব্যাংক আমার আবেদনকে অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে কিন্তু অর্থমন্ত্রণালয় কোনো কিছু জানাচ্ছে না। তারা চুপ করে বসে আছে। আমি তখন আমার এমডি স্যারকে একটু সুপারিশ করার আবেদন করলাম। তখন স্যার নিজে গিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারিকে আমার ব্যাপারে বললেন যে, ‘সে একজন ভালো অফিসার। মেধাবী অফিসার। কোর্সটি কমপ্লিট করে আসলে এই সেক্টরে সে ভালো অবদান রাখতে পারবে।’ তখন অর্থমন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি স্যারকে বললেন, ‘না আমি অনুমতি দিতে পারবো না। কারণ এরা বিদেশে গিয়ে আর আসে না। ওখানে চাকরি করে থেকে যায়।’ তো এমন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম আরকি।

আমি সামনে বা নেতৃত্বে ছিলাম বাট বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় অনেক মানুষের অবদান রয়েছে। কনট্রিবিউশন রয়েছে। আমি একজন অফিসার ছিলাম। ইসলামী ব্যাংকিং শিখতে বিদেশে গিয়ে আমার কোর্সে যোগদান নিশ্চিত করতে একটি সরকারি ব্যাংকের এমডি সুপারিশ করতে অর্থমন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারির কাছে গিয়েছিলেন- এটা কিন্তু তখন খুব সামান্য কোনো বিষয় ছিল না।

এরপর রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এএফএম ইয়াহইয়া আমাকে অর্থমন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারির কাছে নিয়ে গেলেন। তার কথাও সেক্রেটারি রাখলেন না এবং কোর্সে উপস্থাপন করার জন্য আমি একটি পেপার তৈরি করেছিলাম সেটা আমার সামনে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলেন। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম এবং ভেবেছিলাম হয়তো যাওয়ার অনুমতি কোনোভাবেই আর পাবো না। তবু আমি থেমে রইলাম না। চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ছিলেন নুরুল ইসলাম সাহেব। তিনিও সরকারের সিএপি অফিসার। তিনিও খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। আমি শেষ চেষ্টা হিসেবে তার সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে চিনতেন। একদিন তার পিএসকে গিয়ে বলি, আমি একটু স্যারের সাথে দেখা করতে চাই। পিএস বলল, ‘স্যার তো আজ সারাদিনই বুকড।’ আমি তাকে বললাম একটু ট্রাই করেন প্লিজ। বসে ছিলাম। একজন সাক্ষাৎ শেষে বের হতেই পিএস স্যারকে নক করে আমার কথা বললো এবং স্যার আমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। ভেতরে গিয়ে গভর্নর সাহেবকে বিস্তারিত জানালাম এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে সেটাও বললাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখবো।’ তখন আমি মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে উঠে পড়লাম। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিসার্চ বিভাগের প্রধান ফখরুল আহসান সাহেবের কাছে গিয়ে বললাম, গভর্নর স্যারের সাথে দেখা করে আমার ইস্যুটা বললাম এবং স্যার বললেন, আমি দেখবো। কিছুই আমার থেকে জানলেন না। কিন্তু আমি আশ্বস্ত হতেও পারছি না। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘স্যার যখন বলেছেন, তখন দেখবেন। আপনি শান্ত থাকতে পারেন।’ এর পরেরদিন সকাল সাড়ে নয়টায় অফিসে আসলাম এবং সাড়ে দশটার দিকে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে একজন স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার এলো। তাকে দেখে ভাবলাম, আমাকে যে যেতে দেবে না সেটা হয়তো অফিসিয়ালি জানানোর জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে। চিঠিটা রিসিভ করে ম্যাসেঞ্জার বিদায় নেওয়ার আগেই চিঠিটা খুলে দেখলাম যে, কোর্সে অংশগ্রহণ করার জন্য আমাকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।

প্রিয়.কম: ইসলামী ব্যাংকের সরকারি অনুমোদন পাওয়ার ইতিহাসটা যদি বলেন?

এম. আযীযুল হক: গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে একটা ঘোষণা আসে যে, সরকারি বেসরকারি খাতে ব্যাংকের অনুমোদন দেবে। তো আমরা মানে আমাদের গ্রুপটি মিলে এপ্লিকেশন করলাম। কিন্তু এপ্লিকেশন অ্যাপ্রুভ হচ্ছিলো না। গভর্নর ফাইলে স্বাক্ষর করছেন না। কারণ তাদের প্রশ্ন ছিল, ইসলামী ব্যাংকিং বাংলাদেশে কারা করবে? হোয়্যার ইজ দ্যা ম্যান পাওয়ার? ‘ম্যান পাওয়ার নেই’ এ কথা বলে বলে বেশ কয়েকবার আমাদের ফাইলকে রিজেক্ট করা হয়েছিল এবং আমাকে এ ব্যাপারে ইনফর্ম করা হয়েছিল যে, ম্যান পাওয়ার নেই এমনটা বলে আপনাদের ফাইল অনুমোদন করা হচ্ছে না।

ততদিনে আমাদের বেশ কয়েকটা ট্রেনিং কোর্স হয়ে গেছে। সে-সময় এক একটা ট্রেনিং কোর্স ছিল এক মাসের। যা-হোক আমি ম্যান পাওয়ারের প্রশ্নে থেমে না গিয়ে তখন পর্যন্ত যে কয়টা বেজ ট্রেনিং নিয়েছে তাদের সবাইকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম এবং সেখানে গভর্নর সাহেবকে প্রধান অতিথি করা হলো। আমরা চেয়েছি, ম্যান পাওয়ার কোথায় নেই সেটা যেন তিনি নিজের চোখে দেখেন।

আমরা এই অনুষ্ঠানটা করেছিলাম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অডিটরিয়ামে। তখন এতো অ্যাভেলাবেল অডিটরিয়াম দেশে ছিল না। ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের অডিটরিয়াম ফ্রি দিলো। সেখানে গভর্নর সাহেব প্রধান অতিথি হিসেবে এলেন। আমি সূচনা বক্তব্যে বললাম, ‘আমরা গত দুই বছর পর্যন্ত ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালিয়ে গেছি এবং সেই ট্রেনিং প্রোগ্রামে এতো লোক অংশগ্রহণ করেছে। তারা সবাই এখানে এসেছেন। আমাদের ট্রেনিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা যাদের ট্রেনিং দিয়েছি তারা সবাই ব্যাংকার। বাইরের কোনো লোক নয়। এজিএম আছেন বা ম্যানেজার আছেন। তারা কনভেনশনাল ব্যাংকিং জানেন। আমরা কেবল তাদের ইসলামি ব্যাংকিং শিখিয়েছি।’ গভর্নর সাহেব তখন পরিচিতির জন্য কোন ব্যাংক থেকে কতজন ট্রেনিং নিয়েছেন, তাদেরকে দাঁড় করিয়ে করিয়ে দেখলেন। তাদের কার কী র‌্যাংক জিজ্ঞেস করলেন। কেউ বললো, ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, কেউ বললো রিজিওনাল অফিসার ইত্যাদি। এর পরদিন অফিসে গিয়ে স্যার ফাইলে সই করে দিয়েছিলেন।

প্রিয়.কমকে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে এম আযীযুল হকের সাথে মাওলানা মিরাজ রহমান। সঙ্গে ছিলেন মনযূরুল হক। ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম। 

প্রিয়.কম: অ্যাপ্লিকশনের সময় আমাদের জানা মতে, খুব সম্ভব আপনাদের আট কোটি টাকা ইনভেস্ট শর্ত ছিল? এই টাকাটা আপনারা কীভাবে সংগ্রহ করেছেন?

এম. আযীযুল হক : হ্যাঁ, ব্যাংক করার জন্যে যখন আবেদন করলাম, তখন বিভিন্ন খরচের একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে উপস্থিত হলো- অফিস খরচ দরকার। এ ছাড়াও পুঁজি এখন লাগবে।

আমাদের ইসলামি ব্যাংকের ফার্স্ট চেয়ারম্যান ছিলেন, আব্দুর রাজ্জাক লস্কর। ফান্ড কালেকশনে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমি কাজ করেছিলাম একাডেমিক বা প্রফেশনাল দিকটা নিয়ে। তিনি ছিলেন ফান্ডিং বা স্পন্সর নিয়ে। তখন আমি তাকে বললাম, আমরা এখন সোনালী ব্যাংকে অফিস করি। এখন তো আর এটাকে ব্যবহার করা যাবে না। এর জন্য প্রথমে একটা প্রজেক্ট অফিস খোলা দরকার। আমি তখন বললাম যে, যারা যারা ইসলামি ব্যাংকিং স্টাবলিশমেন্টের প্রতি আগ্রহী, তাদের প্রত্যেকে যেন ২৫ হাজার টাকা করে দেয়। এই টাকাটা দিয়ে আমরা আমাদের প্রাথমিক সব খরচ বহন করবো। তিনিও রাজি হলেন এবং এই প্রস্তাব নিয়ে একটি মিটিং কল করেন। এরপর লস্কর সাহেবের মতিঝিলের অফিসে সবাইকে মিটিংয়ের জন্যে দাওয়াত দিলাম। এর মধ্যে ৮-১০ জনের মতো মানুষ ২৫ হাজার টাকা করে দিতে রাজি হলেন। এ ছাড়া অনেকেই ছিলেন কিন্তু টাকার কথা শুনেই তাদের মধ্যে একটা মরা মরা ভাব চলে এলো এবং অনেকে কেটেও পড়লো।

এর কিছুদিন পর সালেহ জুমজুম নামের একজন সৌদি ডেলিগেট এলেন বাংলাদেশে। তিনি একসময় সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তখন সৌদি আরবের অ্যাম্বাসেডর আমাকে বললেন, ‘সালেহ জুমজুম আমার বন্ধু। তিনি ইসলামি ব্যাংকিংয়ে খুব আগহী। আপনি ইসলামী ব্যাংকিং করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনপত্রটি নিয়ে তার কাছে যান এবং তিনি যা কমিট করেন আমাকে জানাবেন। আমি সমপরিমাণ টাকা দিব।’ সে-সময় অ্যাম্বাসেডর ছিলেন ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিব। আমি ব্যাংকের সরকারি সব ক্লিয়ারেন্স পেপার নিয়ে হোটেল শেরাটনে জনাব সালেহ জুমজুমের সাথে দেখা করলাম। তিনি তখন এক লাখ ডলার (তৎকালীন বাংলা টাকা ১৫ লাখ) শেয়ার ক্রয় করার কমিট করলেন। অফিসে এসে আমি ফোন করলাম সৌদি অ্যাম্বাসেডরকে। তিনি এটা শুনে বললেন, আমিও এক লাখ ডলার দেব। অর্থাৎ আমার প্রাথমিক ক্যাপিটাল ৩০ লাখ টাকা হয়ে গেল। এই সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে সারা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লো। তখন দেখি, লোকের কোনো অভাব নেই। যারা ২৫ হাজার টাকা দিতে রাজি ছিল না, তারাও এসে ভিড় শুরু করলো। আমরা এরপর ইবনে সিনা ট্রাস্টের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ও বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে পীর সাহেব দিয়েছিলেন ১০ লাখ টাকা। এভাবে আমরা সরকারের ০৫ পার্সেন্ট সহযোগিতাসহ দেশ থেকে মোট ২০ পার্সেন্ট এবং বিদেশ থেকে প্রায় ৮০ পার্সেন্ট টাকা জমা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদেরকে লেটার অব ইনটেন্ট অর্থাৎ শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংক করার অনুমতি দিলেন। এই লেটারে উল্লেখিত শর্ত পূর্ণ করতে আমাদের প্রায় এক বছরের উপরে সময় লাগলো। এরপর ফাইনালি সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ডেকে বললো, ৩১ মার্চ ১৯৮৩ সালের মাঝে যদি ইসলামী ব্যাংক সব শর্ত পূরণ করে লাইসেন্স না নিতে পারে তাহলে আর লাইসেন্স দেওয়া হবে না। তখন গভর্নর সাহেব আমাকে নিজে কল করালেন। আমি উনার ফোন পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে গেলাম। ফোনে তিনি আমাকে সরকারের এই মেসেজ দিলেন এবং বললেন, ‘আমি এই অনুমতি মানতে বাধ্য। আমি আপনাকে পারসোনালি জানালাম।’ এই মেসেজ পাওয়ার পর আমি আমাদের সবাইকে জানালাম এবং সেদিন সন্ধ্যায় আমরা সবাই একসাথে বসে আলাপ আলোচনা করলাম। সময়টা ছিল ১৯৮৩ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহ। তখন আমরা সিন্ধান্ত নিলাম ৩০ মার্চ ব্যাংক খুলবো এবং পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দিব। কিছু কাজ বাকি রেখে সাইনবোর্ড তুলে একাউন্ট খোলার কাজ শুরু করে দিব। ১২ বা ১৩ মার্চ আমাদের কোম্পানি রেজিস্টেশন হলো। এর একদিন পর বিজনেস পারমিশনের সার্টিফিকেট পেলাম এবং ২৯ মার্চ আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পেলাম।

প্রিয়.কম: ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ’ নামটা নির্বাচিত হয়েছিল কীভাবে?

এম. আযীযুল হক: এইটা তো প্রথম নাম না। প্রথম আমরা এই নামটা ঠিক করিনি। যেদিন ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ শুরু করলাম তখন বিদেশ থেকে অনেক রেসপন্স আসছিল। বিদেশ থেকে অনেকে লস্কর সাহেবকে নক করে বলছিল, ‘আমরা ইসলামী ব্যাংকিংয়ে কনট্রিবিউট করতে চাই। আমাদেরকে নাম জানাও। কী নামে টাকা পাঠাবো আমাদেরকে জানাও।’ তখন তো আর এভাবে খুব সহজে যোগাযোগ করার উপায় ছিল না। উনি আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ইমারজেন্সিভাবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি ব্যাংক অব ঢাকা লিমিটেড’ নামে টাকা পাঠানোর টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলেন। এরপর আমি দুই/তিনদিন পরে এলাম। তখন তিনি আমাকে এ কথা বললেন এবং বিদেশ থেকে এই নামেই টাকা আসতে শুরু হয়েছিল।

এরপর লাইসেন্সের জন্য ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে যখন ফাইনালি মেমোরেন্ডাম আর্টিকেল যাচ্ছে, তখন তৎকালীন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ মুফিজুর রহমান সাহেব বলেন, ‘হক সাহেব! এটা কোনো নাম হলো বা এতো লম্বা নাম হবে কেন? ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামটা এভাবে দেন।’ আমি তাকে বললাম, নাম তো বোর্ডে অনুমোদন করাতে হবে। উনি বললেন, ‘বোর্ডে অনুমোদন করানোর দায়িত্ব আমার। আপনি এই নাম দেন।’ এভাবে আমি ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নাম দিয়ে আবেদন পাঠালাম এবং এই নামেই লাইসেন্স হলো। পরবর্তীতে রেজ্যুলেশন করে পূর্বের নামে আসা টাকাগুলো এই নামে ট্রান্সফার করেছি।

প্রিয়.কম: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড– এর প্রথম ম্যানেজার, প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে হয়েছিল এবং কীভাবে হয়েছিল?

এম. আযীযুল হক: আমরা যখন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড– এর ব্রাঞ্চ ওপেনিং করবো তখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রথম ম্যানেজার নির্বাচন নিয়ে একটু মুশকিলে পড়েছিলাম। আমি এবং লস্কর সাহেব মিলে বিভিন্ন ব্যাংকের বেশ কয়েকজনের কাছে গেলাম কিন্তু কেউই রাজি হচ্ছিলো না। অনেকে এভাবেও বললো- সুদ ছাড়া আবার ব্যাংক হয় কীভাবে? তখন আমি কাউকে না পেয়ে এই বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে জানালাম। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর সাহেবের পরামর্শে আমি ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে কাজ শুরু করলাম। আর প্রথম লোকাল অফিসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে দুই তিনজনের মধ্যে মতিন উদ্দিন বরোভুইঞা নামে একজন ছিল। আমি তাকে যোগ্য মনে করে বললাম, আপনার কী অবস্থা। তিনি বললেন, ‘স্যার আমি তো রিজাইন করিনি।’ তখন তিনি রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। আমি বললাম যে, আমি একাই তাহলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্লাস ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হই। তখন সবাই বললো, ‘বাংলাদেশে তো এমন কোনো ট্রেডিশন নাই। এটা হলে খারাপ একটা নজির হবে।’ তখন তিন উদ্দিন বরোভুইঞা বললো, ‘স্যার আমি একটু চেষ্টা করি।’ সে ঐদিন রাতে রূপালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার বাহালুল ইসলামের বাসায় গেল এবং তাকে সব খুলে বলে তার রেজিগনেশন লেটার গ্রহণ করা ও বোর্ডে অনুমোদন করার জন্য আবদার জানালো। আল্লাহর রহমতে তিনি রাজি হলেন। মতিন সাহের ওখান থেকে আমাকে ফোন করলেন এবং এই খবর জানালেন। আমি তখন ফোনে বাহালুল সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী উনাকে রেগুলার ওয়েতে রিলিজ করবেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, আমি তাহলে আপনার কথার ওপর ভিত্তি করে তাকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড- এর প্রথম ব্রাঞ্চ ম্যানেজার করলাম। আপনি আমাকে বিপদে ফেলবেন না প্লিজ। তিনি বললেন, ‘না, না। এটা ইসলামী ব্যাংক তো। আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন।’ এর পরদিন থেকে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কার্যত্রম শুরু হলো।

সম্পাদনা: ফারজানা রিংকী