
প্রতীকী ছবি।
কলিজা
আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৪৮
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর। ‘বেঙ্গল বইয়ের’ উঠোনে টেবিলে একা বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর ফেসবুকিং করছি, অলস সময় কাটানোর চেষ্টা বলা যায়। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ লোকজন বেশ কম। হাতে গোনা কয়েকজন টেবিলগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। কেউ গল্প করছে আবার কেউ প্রেমিকাকে কলিজা সিঙাড়া মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। প্রেমিকও তার প্রেমিকাকে একইভাবে খাওয়াচ্ছে। কী চমৎকার দৃশ্য! কেন জানি না আমার ভেতর এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করছে ওদের দেখে। আচ্ছা, মেয়েটা যদি বলে তুমি আমার জন্য কলিজা কেটে সিঙাড়া বানিয়ে খাওয়াতে পারবে; তখন ছেলেটা কী উত্তর দেবে? কিংবা ছেলেটা যদি একই কথা বলে তাহলে মেয়েটা কী খাওয়াবে? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। উত্তর পেলাম না। আমি ওদের দিক দেখে চোখ সরিয়ে ফেসবুকে নজর দিলাম। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিলাম।
ফেসবুক স্ক্রল করে নিচে নামতেই একটি ওয়েডিং ছবি দেখে ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে রইলাম অপলক। শাড়ি পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শেরওয়ানি পরা ছেলের পাশে। রাজ্যের ভালোলাগা নিয়ে মায়াবী হাসির দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে আমি চিনি। অনেক ভালো করে চিনি। কতোটা চিনি সেটা কোনো নিক্তি দিয়ে হয়তো পরিমাপ করা যাবে না। পৃথিবীর সব পুরনো প্রেমিকারা এভাবে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সম্পূর্ণ অচেনা এক মানুষের পাশে। তাকে শরীরের বৈধতা দেয়। ভালোবাসার চাষ হয়। ফসল ফলে। তখন তাদের সম্ভবত মনে থাকে না- অতীতে তার শরীর কেউ চাষ করেছিল, অবৈধভাবে। কিছু ভালোবাসা খুব ধীরে গোপনে মুছে যায়। আমারটাও গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশের টেবিলে চোখ পড়তেই দেখলাম সেই জুটি নেই। সম্ভবত চলে গিয়েছে। কখন উঠে গেল বুঝতে পারলাম না। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম। যদি পেয়ে যাই তাহলে ডাকব। সামনের চেয়ার দুটিতে বসিয়ে একটি কলিজা সিঙারা সামনে রেখে তখন নিজেকে করা প্রশ্নটি করে উত্তর জেনে নেব। কিন্তু কোথাও পেলাম না। উপরে স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে যতোদূর দেখা সেখানেও তারা নেই। অল্প কয়েকজন বই পড়ছে। কেউবা আবার সেলফি তুলছে।
হাতের ঘড়ি দেখলাম। অনেক সময় হল। রাত গভীর হচ্ছে। বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাব ঠিক এমন এক সময় একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। মেয়েলি কণ্ঠের চিৎকার। আমি কৌতুহল নিয়ে দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতেই দেখি অনেকে দৌড়ে বের হচ্ছে। আমার আগ্রহ বাড়ল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। কেউ একজন একটান দিয়ে হাত টেনে ধরে বললো-
‘উপরে যাবেন না ভাই, ভয়ানক ব্যাপার ঘটে গেছে।’
‘কী ব্যাপার ভাই?’
‘একটি ছেলে খুন হয়েছে।’
লোকটি বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। আমার হাত ছেড়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় আমাকে আরও কী যেন বলল। আমি সে দিকটায় খেয়াল না করে উপরে উঠলাম ধীর পায়ে। দ্বিতীয় তলা। কেউ নেই। তৃতীয় তলা। সেখানেও কেউ নেই। সাবধানী পায়ে সামনে এগোলাম। কাঠের মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে পায়ে এসে লাগল। জুতা রক্তে লাল হয়ে গেল। আমি সামনে এগোচ্ছি রক্তে লাইনকে অনুসরণ করে। একটি মেয়ে। বাম পাশটায় বসে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে কী যেন চাবাচ্ছে। মুখের উপর চুল পড়ায় চেনা যাচ্ছে না। মেয়েটা আমার পায়ের শব্দ পেয়ে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকালো। আঁতকে উঠলাম। মেয়েটা কলিজা চাবাচ্ছে। আরে এতো সেই মেয়ে। যাকে একটু আগে উঠোনে বসে সিঙারা খেতে দেখেছিলাম। তাহলে মেয়েটা কী তার প্রেমিকের কলিজা চাবাচ্ছে? ক্ষতবিক্ষত লাশের পাশে গিয়ে চেহার দিকে তাকাতেই আমি চূড়ান্ত রকমের আঁতকে উঠলাম। আমার ধারণা ঠিক হলো। মেয়েটি তার প্রেমিকের কলিজাই চাবাচ্ছে। আমি এক দৌড়ে বেরিয়ে যাব এমন সময় মেয়েটির আমাকে ডেকে পৈশাচিক এক হাসি দিয়ে বললো- ‘আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম ওর কলিজাটা কত বড়! আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সাথে রাতে শোবে, আর আমি মেনে নেবো-তা তো হয় না।’
কোনো উত্তর না দিয়ে, ডান বামে না তাকিয়ে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। ৩২ নম্বরের দিকে হাঁটা আরম্ভ করলাম। আমার মাথা ঝিম ধরে আছে। এমন সময় পকেটের ফোনটা বেঁজে উঠল। ওপাশ থেকে ছোট ভাই আশিকের ফোন,
‘ভাই, ফেসবুকে দেখছেন কিছু?’
‘দেখেছি।’
‘যার জন্য এতকিছু, কী করেননি আপনি তার জন্য! পারলে নিজের কলিজা কেটে খাওয়াতেন, সেই মেয়ে এখন অন্যের হয়ে গেল! আমি হলে ভাই প্রতিশোধ নিতাম। ওই মেয়ের কলিজা কেটে খেতাম।’
আশিকের কলিজা কেটে খাওয়ার কথা শুনে আবারও ধাক্কা খেলাম। ও তো ঠিকই বলেছে। কিনা করেছি মেয়েটার জন্য! আর এখন সে বলে, আমি শারীরিকভাবে অক্ষম-পৌরষত্বহীন। কোনো পুরুষের কাছে এমন অপবাদ অপমানজনক। আমার সক্ষমতা ছিল বিধায় চাষের ফসল জন্মেছিল। তবে অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেওয়া হয়, ওর ইচ্ছাতেই।
‘তুই সিঙারা বানাতে পারিস আশিক?’
‘কেন ভাই?’
‘না পারলে শিখে নে। কাল একসাথে কলিজার সিঙারা খাব।’
আমি আশিককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। একটা সিএনজি ডেকে রওয়ানা হলাম গুলিস্তানের দিকে। রাতের শেষ বাসটা ধরতে হবে। একটা মেসেজ করলাম পুরোনো প্রেমিকাকে, ‘আমি আসছি, কাল দেখা করো। তোমার জন্য প্রচুর গিফট এনেছি।’
আমি জানতাম ও দেখা করতে রাজি হবে না। মেসেজ রিপ্লাইয়ে জানালো দেখা করবে না। তারপর আমাদের প্রেমের ঘনিষ্ঠ ভিডিও বরকে পাঠানোর ভয় দেখিয়ে রাজি করালাম।
পরিশিষ্ট
আমার পুরোনো প্রেমিকা আমার সামনে বসে আছে। হটপট থেকে বিরিয়ানি বের করে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে।
‘তুমি কলিজার বিরিয়ানি পছন্দ কর বলে রান্না করে আনলাম। কেমন হয়েছে?’
‘তুমি কখনো মানুষের কলিজা খেয়েছো?’
‘কিসব বলছ! খেয়ে দ্রুত আমার গিফট দিয়ে বিদায় হও।’
আমি কয়েক লোকমা খাবার মুখে দেয়ার পর কেমন যেন ঝিমিয়ে যেতে লাগলাম। আশেপাশে সব ঝাঁপসা দেখাচ্ছে। একটা পর্যায়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। আমি সম্ভবত মারা যাচ্ছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পুরোনো প্রেমিকার ক্ষিপ্রতার সাথে বলা একটি কথা আমার কানে এসে আঘাত করল।
‘কত্তো বড় কলিজা তোর; আমার সেক্স ভিডিও আমার নতুন বরকে দিবি! কলিজার বিরিয়ানি তোর পছন্দ তাই না? আজ তোর কলিজা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করব। আর সেটা আমি আর বর খাব।’
আমি আর কিছু শুনতে পেলাম না। সম্ভবত ও এখন আমার বুক কেটে কলিজা বের করছে।