
হাই কোর্ট। ছবি: সংগৃহীত
আদালতের ভাষা: ভোকালতনামা নয়, ওকালতনামা
আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৮, ২০:৪৭
(প্রিয়.কম) দেশের নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে প্রায় ৫০ হাজার আইনজীবী আইন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন হাজার আইনজীবী সহকারী (ক্লার্ক)। এই আইনজীবী এবং সহকারীরা আদালত পাড়ায় এমন কতগুলো শব্দ ব্যবহার করেন, যেগুলো দেশের সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের বুঝতে অসুবিধা হয়। আদালতে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ হচ্ছে ওকালতনামা। কিন্তু এক সময় ওকালতনামাকেই বলা হতো ভোকালতনামা। ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর ভোকালতনামাকে পরিবর্তন করে ওকালতনামা করতে সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস ১৯৭৩ সংশোধন করা হয়।
শুধু ভোকালতনামা নয় এ রকম আরও কতগুলো শব্দ রয়েছে যা আজও আদালতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন বেঞ্চ অফিসার, পেশকার, কজ লিষ্ট, ওকালতনামা বা ভোকালতনামা, বেইলবন্ড, পুটআপ, কজলিষ্ট, মেনশন, মেনশন স্লিপ, সিপি, সিএমপি, স্ট্যানওভারসহ আরও বহু শব্দ।
এসব অপরিচিত শব্দের সঙ্গে আদালতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে যারা অনুশীলন করতে আসেন তাদের কাছেও সহজবোধ্য মনে হয় না। তাদেরকেও এগুলো বেশ কষ্ট করে রপ্ত (শেখা) করতে হয়।
আদালত পাড়ায় নবীন আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারীরা এসব শব্দ দেশ স্বাধীনের আগ থেকেই আদালতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও আদালত পাড়ার এ শব্দ বা ভাষাগুলো রয়েই গেছে। পরিবর্তন হচ্ছে না। পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে।
নবীন আইনজীবী (যারা আইন পেশায় বার কাউন্সিল থেকে সনদ নিয়ে মাত্র কাজ শুরু করেন সিনিয়রের সঙ্গে)। ক্লার্ক (আইনজীবী সহকারী) (নিম্ন আদালতে তাদেরকে বলা হয় মুহুরি), পেশকার (যিনি বিচারকের এজলাসে থেকে ফাইলগুলো বিচারকের কাছে পৌঁছে দেন এবং এগুলোর নোট রাখেন)। একইপদে নিয়োজিত হাইকোর্টের লোকদের বলা হয় বেঞ্চ অফিসার বা বিও)। কজ লিষ্ট (হাইকোর্টের মামলা পরিচালনা করতে বা শুনানি করতে যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়)। ওকালতনামা যেটি মামলা পরিচালনা করতে মক্কেল তার উকিলকে লেটার হিসেবে দেন) বা মক্কেলের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে অনুমতি দেন। যেটি ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে পরিবর্তন করা হয়। ওকালতনামার পূর্বের নাম ছিল ভোকালতনামা।
মেনশন (হাইকোর্টের কোনো মামলা শুনানি করতে আদালতের কার্য তালিকায় আনার জন্য আদালতে গিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করাকে মেনশন বলে। মেনশন হতে পারে মামলার শুনানি পেছানোর আবেদন, জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে, কোনো বিষয়ে আদালতের আদেশ স্থগিত করা ইত্যাদি)। মেনশন স্লিপ (আইনজীবী হাইকোর্টের কোনো মামলা কী উদ্দেশ্যে শুনানি করতে চান, সে উদ্দেশ্যটি আদালতকে চিরকুট দিয়ে বুঝানো)। বেইলবন্ড (কোনো আসামির জামিনের নিশ্চয়তা দেয়া। জামিনের নিশ্চয়তা দিয়ে আসামির পক্ষে জামিনদার হওয়া। বেইলবন্ড নামে একটি ফরম আসামির আইনজীবী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জমা দিবেন। এরপর আদালত থেকে চলে যাবে কারাগারে। কারাগারে যাওয়ার পর কারাকর্তৃপক্ষ এটি পরীক্ষা করে আসামিকে মুক্তি দেয়া হবে। পুটআপ (কোনো মামলার বিষয়ে সময় নিতে বা মামলা অন্য বিষয়ে আদালতে আবেদন করা)।
এ সময়ের ভোকালতনামা এখন ওকালতনামা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ছবি: প্রিয়.কম
ওকালতনামাকে ভোকালতনামায় পরিণত করতে সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস ১৯৭৩ সংশোধন করা হয় ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর। এরপর পরিবর্তন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের-১০৭(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে, হাইকোর্ট বিভাগের রীতি ও পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রচলিত সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস, ১৯৭৩ সংশোধনক্রমে এতে আনা সংযোজন, বিয়োজন, প্রতিস্থাপন ও পরিবর্তনসহ সমন্বিত আকারে সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস, ১৯৭৩ নামে প্রকাশ করা হয়।
ঢাকায় ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় হাইকোর্ট। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভোকালতনামায় সাক্ষর করেন মামলার বাদী-বিবাদীরা। ভোকালতনামায় বা ওকালতনামায় সাক্ষর করা হয় মূলত আইনজীবীদের লেটার হিসেবে।
দেশের নিম্ন আদালতে বা জেলা জজ আদালত সমুহে সেটি ব্যবহার করা হয় সেটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই ছিল। এখনো ঠিক আছে। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবেশগত ও ভাষাগত কারণে নামের পরিবর্তন আনা হয়েছে। হাইকোর্ট রুলস অনুযায়ী মামলা পরিচালনা করতে আইনজীবীদের মামলা পরিচালনা করতে উকিলদের অনুমতি দিতে নীল কাগজের একটি পৃষ্ঠায় সাক্ষর করেন। জেলা জজ আদালতে মামলা পরিচালনা করতে আইনজীবী সমিতির সদস্য অর্থাৎ উকিলদের নামের তালিকা দেয়া হয়। সে তালিকায় ওই আইনজীবীদের নামের তালিকা থাকে। হাইকোর্টে সাধারণ এটি দেখা যায় না। হাইকোর্টে যে কয়জন উকিল মামলার পরিচালনা করতে বাদী বা বিবাদীর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পেয়ে ওকালতনামায় সাক্ষর করেন। কিন্তু জজকোর্টের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত দেখা যায় না। ২০১২ সালের ২১ জুলাই ভোকালতনামা পরির্তন করে ওকালতনামা নামকরণ করা হয়।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবিএম নুরুল ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমি দেশ স্বাধীনের আগে থেকে উকালতি করি। সুপ্রিম কোর্টে আমরা কাজ করেছি। ভোকালতনামায় সাক্ষর নিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনে ব্রিটিশদের করা ভোকালতনামা পরিবর্তন করে এখন ওকালতনামা করা হয়েছে।’
নুরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার কাছে অনেক ক্লায়েন্ট হাইকোর্টের ভোকালতনামা নিয়ে প্রশ্ন করত, জানতে চাইতো যে জজকোর্টে ওকালতনামা হাইকোর্টে কেন ভোকালতনামা। এটি কেন? নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। তারা সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারত না। কিন্তু ভোকালতনামা পরিবর্তন করে ওকালতনামা করায় এখন অনেকেই বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারেন।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহম্মাদ ফারুক হোসেন বলেন, ‘হাইকোর্টে আমরা মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ভোকালতনামা ব্যবহার করতাম। এখানে আমাদের মক্কেলরা সাক্ষর করে আমাদেরকে তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে অনুমতি দিতেন। কিন্তু এটি ২০১২ সালের নভেম্বরে সরকার পরিবর্তন করে ওকালতনামা করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘ভোকালতনামা আমাদের কাছে স্বাচ্ছন্দ মনে হতো না। আমরা এ নামটি নিয়ে আন ইজি ফিল করতাম। ক্লায়েন্টদের বোঝাতে পারতাম না। সমস্যা হতো, সহজে বোঝানো যেত না। এখন ভোকালতনামা পরিবর্তন করে ওকালতনামা হওয়ায় আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। আমরা কাজ করতে অনেক স্বাচ্ছন্দবোধ করি।’
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী মাহজাবীন রব্বানী দীপা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আদালতের যে সব শব্দ ব্যবহার করা হতো সেগুলো আমরা আইন পেশার শুরুতে বুঝতাম না। এগুলো আয়ত্ব করতে অনেক কষ্ট হয়েছে।’
দীপা আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের জন্য আদালতের শব্দ ও ভাষাগুলো সহজভাবে ব্যবহার উপযোগী করা উচিত।’
প্রিয় সংবাদ/হিরা/কামরুল
- ট্যাগ:
- অন্যান্য সংবাদ
- আইনজীবী
- আইন
- ভাষা
- আদালত