বাসে উঠতে গিয়ে হেল্পারদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হন বেশিরভাগ নারী। ছবি: সংগৃহীত

থামছে না গণপরিবহনে যৌন হয়রানি

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:৩৮
আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:৩৮

(প্রিয়.কম) সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা এক তরুণী (২৬) রাজধানীর ফার্মগেটে একটি চাকরির কোচিং সেন্টারে ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় নিজ বাসা উত্তরা ফেরার পথে ফার্মগেটে বাসের অপেক্ষা করতে থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বঙ্গবন্ধু পরিবহনের সিটিং সার্ভিস লেখা বাসে উঠতে গেলে ভিড়ের মধ্যে বাসের এক হেলপার ওই তরুণীর স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়। তখন ওই তরুণী ভয় ও লজ্জায় মাথা নিচু করে ওই গাড়ি থেকে নেমে আসে। পরে আরেক গাড়ি দিয়ে বাসায় ফেরেন ওই তরুণী। পরদিন বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করলে সবাই ওই তরুণীর মান-সম্মানের কথা ভেবে ঘটনাটি কাউকে না জানিয়ে চেপে যেতে পরামর্শ দেন। এ জন্য তরুণীটি ওই ঘটনাটি কাউকে জানানোর চেষ্টা করেননি। 

গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় রাজধানীর ফার্মগেট বাসস্টেশনে এ ঘটনা ঘটে। 

এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে টঙ্গীর উদ্দেশে আসমানী পরিবহনের একটি বাসে ওঠে এক তরুণী (২৫)। যাত্রাপথে গাড়ির সিটে বসার পর সে তরুণী ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে কারও হাতের স্পর্শে ওই তরুণীর ঘুম ভাঙলে দেখতে পান বাসের চালক-হেলপারসহ আরও কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরেছে। তারা ওই তরুণীর ওড়না টেনে ছিঁড়ে ফেলে। এ সময় জীবন বাঁচাতে তরুণী বাসের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে আহত হন। পরে তরুণীকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই নারী এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনায় পুলিশ বাসচালক মো. রাসেল ভুইয়া (২০) ও হেলপার মো. মিরাজকে গ্রেফতার করেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। মাঝে-মধ্যে খুব সাহসী হয়ে অল্প কিছু সংখ্যাক মানুষ থানা-পুলিশের কাছে অভিযোগ জানায়। আর বেশির ভাগই নারীই মান-সম্মানের ভয়ে বাসে যৌন হয়রানির ঘটনা চেপে যান।

একের পর এক যৌন হয়রানির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটছে আরেকটি ঘটনা। এসব অপ্রীতিকর ঘটনার পুর্নাবৃত্তির ফলে নারীরা গণপরিবহণে কতটা নিরাপদ তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে তেমনি বিভিন্ন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে চলাফেরা করা নারীরাও দিন দিন আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন। 

পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে কাউন্সিলিং, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অনুভূতি জাগ্রতকরণ এবং ডিউটিরত অবস্থায় নারীদের যৌন হয়রানির মতো অভিযােগ উঠলে ওই পরিববহন প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযুক্তকে বহিষ্কার ও শাস্তির ভয় দেখিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। গণ পরিবহনে কোনোভাবেই থামছে না নারী লাঞ্ছনার ঘটনা। 

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আড়াই বছরে দেশের বিভিন্ন গণপরিবহণে ৫৩টি বড় ধরণের নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। শুধু গত বছরেই ১৭টি ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে আবার খোদ রাজধানীতেই ঘটেছে সাতটি। এসব ঘটনায় দুই একজন অপরাধী গ্রেফতার বা আটক হলেও বেশির ভাগই থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অনেকে আটক বা গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়ে আসছেন, আবারও জড়াচ্ছেন একই অপরাধে। তবে ছোটখাটো ঘটনা হলে বেশির ভাগ অপরাধীই থেকে যাচ্ছেন আড়ালে। 

পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব ঘটনা তাদেরকে লজ্জায় ফেলেছে। এ নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিক পক্ষের দফায় দফায় মিটিং ও কাউন্সিলিং চলছে। 

গত বছরের ২২ জানুয়ারি কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেসে ট্রেনে নদীয়ার রেল স্টেশনে বাংলাদেশি এক নারী যাত্রী শ্লীলতাহানির শিকার হয়। এই বিষয়ে ওই নারীর স্বামী জিআরপির সংশ্লিষ্ট শাখায় অভিযোগ করেন। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী জেলার শিবপুরের পুরানদিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসের ভেতরে এক নারীকে শ্লীলতাহানি করে বাসের চালক ইসমাইল হোসেন ও তার চার সহযোগী, ১০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় বাসে আটকে রেখে ১৩ বছরের এক কিশোরী পোশাক কর্মীকে ধর্ষণ করে বাসের হেলপার হাফিজুল ইসলাম। পরে পুলিশ অভিযুক্ত হেলপারকে আটক করে।

গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর বাসাবোর বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় লাব্বাইক বাসে দুই শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হন। পরে তারা বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশকে জানালেও কোনো সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার দুই দিনপরই ২১ এপ্রিল বাড্ডা এলাকা থেকে খিলগাঁও যাবার পথে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে যৌন হয়রানির শিকার হন উত্তরা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পরে পুলিশ বাসের চালক ও সহকারীকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনার মাত্র চারদিন পর ২৫ এপ্রিল রাতে রাজধানীতে চলাচলকারী ঠিকানা পরিবহনের একটি বাসে আসাদগেট থেকে আজিমপুর যাওয়ার পথে যৌন হয়রানির শিকার হন এক তরুণী। এ সময় ওই তরুণীর সঙ্গে তার মাও ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে মেয়েটি এক পুলিশের কনস্টেবলের কাছে সাহায্য চাইলেও সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেছিলেন ওই নারী।

৩ মে আশুলিয়ার বাস কাউন্টার থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বলে জানায়। ১৫ মে দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় দেওয়ান পরিবহনের একটি বাসের হেলপার ও চালকের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষার্থী। তবে এ ঘটনায় সম্মানের ভয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে রাজি হননি মেয়েটির পরিবার। এ ছাড়াও ১১ মে রাজধানীর অদূরে সোনারগাঁওয়ে বাসের মধ্যে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বাস চালক ও তার সহযোগী, ১৩ মে ময়মনসিংহের চুরখাই এলাকায় বাস চালক ও হেলপারের দ্বারা এক তরুণী, ২১ মে কুড়িল বিশ্বরোডে মাইক্রোবাসে গারো তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়।

পরের মাসে ২৬ জুলাই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর বাইপাসের বাওয়ার কুমারজানী এলাকায় শ্লীলতাহানি থেকে বাঁচতে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিলে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন শিউলী বেগম (২৮) নামে এক নারী পোশাক শ্রমিক।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গণপরিবহনে বিভিন্নভাবে ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ নারীই চলন্ত বাসে নামার সময় এবং ওঠার সময় হয়রানির শিকার হন। তবে ভয়ে তারা প্রতিবাদ করেন না। যদিও এসব ঘটনায় শতাধিক মামলা তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি জানায়, গত আড়াই বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাসে যৌন হয়রানির ৫৩টি ঘটনা ঘটেছে। যার বেশিরভাগই ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এমন ঘটনাগুলো আগে ঘটলে কেউ প্রতিবাদ করতো না। এমনকি থানায় অভিযোগ করতেও চাইতো না। কিন্তু সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। কিছু নারী সাহসী হয়ে উঠছেন। তারা এখন প্রতিবাদ করছেন। তবে বিষয়গুলোর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য বাসচালক, শ্রমিক ও মালিকদের সতর্ক থাকতে হবে।’

এ ধরনের ঘটনা রোধে প্রথমত বাস মালিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পাশাপাশি চালক ও হেলপারের বায়োডাটা একাধারে বাস মালিক, বিআরটিএ এবং পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে সংরক্ষিত থাকতে হবে। এ ছাড়াও অ্যাপসভিত্তিক গাড়ির মতো ডিজিটাল নম্বর ব্যবহার শুরু করতে হবে। সবশেষ গাড়ির অবস্থান সনাক্তকরণ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য সিসিটিভির আওতায় আনার পরামর্শ দেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

এদিকে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের শুধু মার্চ ও এপ্রিল মাসে বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত চলন্ত বাসে ৩২টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। 

ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘কেউ এমন অপরাধে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ারও কথা বলা হয়েছে। তবে নগরীতে এমন ঘটনার নজরদারি করার জন্য ভ্রাম্যমাণ টিম রয়েছে।’

গত ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরে চলন্ত মাসে যৌন হয়রানির ঘটনাটি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি রুস্তম আলী খানের অজানা ছিল বলে জানান তিনি। পরে ঘটনাটি শোনার পর তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এমন একটা ঘটনা পেপারে দেখলাম, তবে এমন হয়ে থাকলে তা দুঃখজনক। যে এই কাজটি করেছে তাকে ধরে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হোক।’

 রুস্তম আলী খান জানান, গত বছর চালক ও হেলপারদের কাউন্সিলিংয়ের উদ্যােগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই কাউন্সিলিং গত দেড় মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। তবে আবারও চালু করা হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে বাসে যৌন হয়রানির জন্য বাসের চালক ও হেলপারদের নেশাগ্রস্ত থাকাকে দায়ী করলেন রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন

তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ বাস শ্রমিক নেশায় আসক্ত। তারা নেশা করে গাড়িতে ডিউটি করার সময় কার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে তা বুঝতে পারেন না। ফলে এমন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।’

সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজে অস্থির করে তুলে বলেই এ ধরনের অপরাধীরা এমন কাজ করার সুযােগ নেয়। আর সেটার প্রথম ধাক্কাটা আসে নারীদের ওপর। তবে এসব ঘটনায় বেশির ভাগ সময়ই নারীরা নির্যাতিত হওয়ার পর মুখ খুলতে চায় না। আবার যারা মুখ খুলতে চান, আইনশৃঙখলা বাহিনী অনেক সময় সেই বিষয়টি লিপিবদ্ধ করতে চায় না। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ঘটনা মিডিয়াতেও আসে না।’

পরিবহন মালিকরা শ্রমিক ও চালকদের শুধু কাউন্সিলিং করিয়ে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব নয়, এসব ঘটনা প্রতিরোধে সামাজিক অস্থিরতাকে কমিয়ে এনে সমাজ ও জনগনকে সচেতন করতে হবে বলে মনে করেন নুর খান লিটন। 

প্রিয় সংবাদ/আজাদ/কামরুল