
সম্মুখ যুদ্ধে ইরাকি সেনারা। ছবি: সংগৃহীত
যে যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ মরেছে, জেতেনি কোনো পক্ষ
আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:০৭
(প্রিয়.কম) ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরাকের ভেতরে জঙ্গি মদদ দেওয়ার অভিযোগে ইরানে সৈন্য পাঠান। সেই লড়াই বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম যুদ্ধগুলোর একটিতে রূপ নেয়।
যুদ্ধের তৃতীয় সপ্তাহে বড় ধরনের সাফল্য পায় ইরাক। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর খোররামশা দখল করে নেয় ইরাকি সৈন্যরা।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইরাকি চিকিৎসক ও কবি আহমেদ আল-মুশতাত বলেন, ‘প্রথম ক’সপ্তাহে ইরাকিরা কোনো প্রতিরোধের মুখেই পড়েনি। তারা ইরানের অনেক জায়গা দখল করে নেয়। ইরাকের সবাই তখন ভেবেছিল সাদ্দাম হোসেন যুদ্ধে জিতে গেছেন। সাদ্দাম হোসেন টিভিতে একদিন বললেন, ছয় দিনে তিনি যুদ্ধ শেষ করে দেবেন। কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন।’
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ১৯৮০ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, আহমেদ আল-মুশতাতের বয়স ছিল ১৮। বাগদাদে তিনি তখন একজন মেডিকেল ছাত্র ছিলেন। মুশতাতকে যুদ্ধের শেষ দিকে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। দক্ষিণে বসরা এবং পরে উত্তর আল-হাফজার রণাঙ্গনে পাঠানো হয়েছিল তাকে।
আট বছর পর যখন ইরান-ইরাক যুদ্ধ যখন শেষ হয়েছিল তিনি তখন ২৬ বছরের যুবক।

মুশতাত বলেন, ‘আমি মেডিকেল স্কুল শেষ করলাম। এক বছর হাসপাতালে কাজ করলাম। তারপর চলে গেলাম যুদ্ধে।’
‘ওই সময় শুধু আমি নই, প্রতিটি ইরাকির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হতো। টিভি খুললেই যুদ্ধের খবর । হঠাৎ একদিন শুনলেন আপনার প্রতিবেশীর ছেলে রণাঙ্গনে মারা গেছে। আমি আমার অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি। পরিবারের অনেক সদস্য হারিয়েছি। জঘন্য সময় ছিল সেটা।’
‘আমি লেখালেখি করতাম। কিন্তু যুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু লেখা সম্ভবই ছিল না। নিরাপত্তা গোয়েন্দারা সর্বক্ষণ সবার ওপর কড়া নজর রাখত।’
যুদ্ধ শুরুর সাত বছর পর মুশতাত আহমেদ চিঠি পেলেন তাকে সেনাবাহিনীর মেডিকেল ইউনিটে যোগ দিতে হবে।
মুশতাত বলেন, ‘এ রকম একটি চিঠি একদিন আসবে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু আমি চাইনি তা আসুক। কারণ ওই সময় রণাঙ্গনে গিয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল ৯০ ভাগ। কিন্তু নিয়তি অস্বীকার করার কোনো উপায় ছিল না। কারণ আপনি ওই নির্দেশ অবজ্ঞা করতে পারতেন না। পালানোর কোনো উপায় ছিল না। পালালেই আপনাকে ধরা পড়তে হবে, আপনাকে না পেলেও আপনার পরিবারকে তারা রেহাই দেবে না।’

খুঁজে না পেলে কী হতে পারত, এমন প্রশ্নের জবাবে মুশতাত বলেন, ‘সোজা মেরে ফেলত। আত্মরক্ষার, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই ছিল না।’
১৯৮৭ সাল নাগাদ যুদ্ধে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। কোনো পক্ষই বলতে পারছিল না, তারাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ তার মধ্যে মারা গেছে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছিল।
এত সৈন্য মারা গিয়েছিল যে, একপর্যায়ে দুটি দেশই জোর করে তরুণ যুবকদের ধরে সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দিচ্ছিল।
যুদ্ধের চেহারা নিয়েছিল অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো, কাঁটাতার, মাইন আর ট্রেঞ্চে ভরা রণাঙ্গন। সব সময় মাস্টার্ড গ্যাস হামলার ভয়।
ইরাকের তেল সমৃদ্ধ বসরার দখল নিয়ে লড়াইতে ১০ হাজার ইরাকির মৃত্যু হয়। আর ১২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার মরুতে ৫০ হাজার ইরানির মৃতদেহ পচছিল।
ইরাকিদের শক্ত অবস্থানের ওপর ইরানি তরুণ স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা ঢেউয়ের মতো একের পর এক হামলা চালিয়েছিল।

আয়াতুল্লাহ খোমেনির ডাকে শহীদ হওয়ার উন্মাদনা নিয়ে ইরাকি মেশিনগান উপেক্ষা করে মাইন-ভর্তি এলাকা পেরিয়ে দলে দলে তারা ইরাকি অবস্থানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে।
মুশতাত আহমেদ তখন বসরার কাছেই একটি ইরাকি ব্রিগেডের সঙ্গে ছিলেন।
মুশতাত বলেন, ‘আমাকে বসরার কাছে আমরা নামে একটি জায়গায় একটি ব্রিগেডের সঙ্গে যুক্ত করা হলো। সে বছর যুদ্ধে তখন তুঙ্গে। আমি যখন প্রথমবার আমার ইউনিটের কাছে যাচ্ছিলাম, গোলার শব্দ ততই জোরালো হচ্ছিল। সেই সাথে আমার হৃৎপিণ্ডের গতিও বাড়ছিল।’
ইউনিটে মোট আটজন পুরুষ নার্স ছিল, ইরাকের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা। উত্তরের কুর্দি এলাকা থেকে কুর্দি, সুন্নি, শিয়া।
মুশতাত বলেন, ‘সবাই আমার খেয়াল রাখছিল, কারণ আমার কোনো সামরিক অভিজ্ঞতাই ছিল না। সুতরাং তারা আমাকে শেখাত কীভাবে মাইনফিল্ড এড়িয়ে চলতে হবে, কীভাবে বোমা থেকে বাঁচতে হবে। রাসায়নিক অস্ত্রের হামলা কীভাবে বুঝতে হবে, কী করতে হবে। খুব ভালো ছিল তারা। ওই দিনগুলোর কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। অনেক সময় স্বপ্নেও দেখি।’

১৯৮৮ সাল নাগাদ দুই দেশই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। শেষের দিকে যুদ্ধ ইরাকের উত্তরের সীমান্তে জোরদার হলো। আহমেদের ব্যাটালিয়ানকে সেখানে পাঠানো হলো। যদিও ইরান তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে রাজি হয়েছিল, তারপরও উত্তর সীমান্তে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল।
যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার দিনগুলোর কথা মনে করে মুশতাত বলেন, ‘তিন দিনে আমরা প্রায় দেড় হাজার সৈন্য হারাই। রক্তে ভেজা আহত সৈন্যরা যন্ত্রণায় চিৎকার করতো। ভয়ানক দৃশ্য সব। আমরা যতটুকু পারতাম করতাম। এখনো সেই বারুদ মেশানো ধোঁয়ার গন্ধ পাই আমি।’
মুশতাত জানান, যুদ্ধ হচ্ছিল হালাপজা শহরের কাছে ছোটো একটি পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ইরানি বাহিনীর হামলার মুখে তিন দিন পর ইরাকি বাহিনীকে পিছু হটতে হয়েছিল।
এরপর ব্রিগেড কমান্ডার আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তিনি সৈন্যদের লড়াই থেকে পালাতে সাহায্য করেছেন, কারণ অল্প জখম সৈন্যদের তিনি ফিল্ড হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
মুশতাত বলেন, ‘তিনি আমাকে বললেন, তোমার জন্যই আমরা এই লড়াইতে হেরে গেলাম। আমি অবশ্য বুঝতে পারছিলাম, তিনি কারো ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছিলেন।’
মুশতাত ভয় পেয়েছিলেন, তাকে হয়তো কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্ত অন্য কয়েকজন অফিসারের হস্তক্ষেপে তিনি রক্ষা পান।
অবশ্য কমান্ডারের অভিযোগ কি সত্যি ছিল, সত্যিই রণাঙ্গন থেকে সরতে সৈন্যদের সাহায্য করেছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মুশতাত বলেন, ‘আমি সবাইকে রক্ষা করতে চাইছিলাম। তারা আমার চোখের দিকে এমনভাবে তাকাত যেন বলতো, “প্লিজ আমাকে আর যুদ্ধ করতে পাঠিও না”। আমি এখনো অনেক সৈন্যের নাম মনে করতে পারি। আমি মনে করতে পারি, তারা আমার প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ ছিল। তাদের জীবন বেঁচেছিল।’
কম-বেশি ১০ লাখ ইরাকির মৃত্যু হয়েছিল আট বছর ধরে চলা ওই যুদ্ধে।

যদিও এই যুদ্ধ নিয়ে বাইরের বিশ্বে তত বেশি কথা হয়নি, কিন্তু আহমেদের মতো ওই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে, যারা যুদ্ধ করেছে এবং বেঁচে গেছে, তারা কখনো ভোলেন না।
মুশতাতের ভাষ্য, ‘এখনো বহু সৈন্যর মুখ আমার মনে আছে। লড়াইতে যাওয়ার আগে তারা বিদায় জানিয়ে যেত। তারাও বুঝতো, আমিও জানতাম, তারা হয়তো ফিরবে না। আমি সব মুখগুলো মনে করতে পারি।’
১৯৮৮ সালের ২০ অগাস্ট ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হয়। দুই বছর পর ইরাক আরেকটি যুদ্ধ শুরু করে, কুয়েতে সৈন্য পাঠিয়ে।
আহমেদ অবশ্য সেই যুদ্ধে যাননি। ১৯৯৪ সালে তিনি ইরাক ছেড়ে যান। এখনো তিনি ডাক্তার। একই সাথে তিনি একজন কবি। সম্প্রতি একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তার।
প্রিয় সংবাদ/শান্ত