
মেহের আফরোজ শাওন। ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম
যে জীবনটা চাইনি সেই জীবনটাই যাপন করছি : শাওন
আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:২৯
(প্রিয়.কম) শীত ঢুকছে শহরে। ক্লান্ত হলদে পাতাগুলো খুব নীরবে ঝরে পড়ছে। সবুজ বলতে এখনোও কিছুটা আছে ধানমন্ডিতে। এই এলাকার একটা অন্যরকম ব্যাপার সেপার আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের তুমুল নির্বাচনি গরম হাওয়া শরীরে মেখে আমরা হাজির হই দক্ষিণা হাওয়ায়। শেষ বিকেলের খানিকটা রোদ এখনো আটকে আছে হুমায়ূন আহমেদের দরজার চৌকাঠে। রোদটুকু বাইরে রেখেই প্রবেশ করি এক অন্য আলোর ভুবনে। একজন এসে জানিয়ে গেলেন, ‘আপনারা বসেন। আপা রেডি হইতাছে’। আমরা বসে বসে বসার রুমটাই দেখছিলাম। লেখকের বসার রুম বলে কথা। পশ্চিমের দেয়াল জুড়ে বড় একটা স্ক্রিন লাগানো। পুরো হোম থিয়েটারের সেটআপ। খুব ছোট একটা রেকে সাতজন মিসির আলী, সাতজন হিমু পাশাপাশি মলাটবন্দী হয়ে বসে আছেন। ইচ্ছে করছিল তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করি ‘হুমায়ূন আহমেদ কেমন আছেন?’। মনের ইচ্ছা মনে রেখে দেখতে থাকি লেখকের ঘরদুয়ার। দেয়াল জুরে লটকে আছে এস এম সুলতান, কাইয়ুম চৌধুরী, শাহাবুদ্দিন, পূর্নেন্দপত্রীর আঁকা দৃশ্যমালা। আনাচে-কানাচে নানান ভঙিমায় দাঁড়িয়ে, বসে ও ঝুলে আছে বেশ কিছু ভাস্কর্য। ছবি, ভাস্কর্য আর বই এসব দেখতে দেখতেই চলে আসলেন মেহের আফরোজ শাওন। চটপটে একটা বিষয় আছে শাওনের ভেতর। এসেই বলনে, ‘সরি অনেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। আমি অফিস থেকেই ফিরলাম কিছুক্ষণ আগে। কোথায় বসে কথা বলব বলেন তো, এখানে?’
প্রিয়.কম : আমরা ফ্লোরে বসেই কথা বলতে পারি। হুমায়ূন আহমেদের বইদের পাশে বসে...
শাওন : হুম, হতে পারে, চলুন তাহলে...
[বিশাল একটি বুক সেলফের পাশে কাঠের মেঝেতে বসে পড়লাম আমরা। শাওন একটা বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি পরে আছেন। তার শাড়ির জমিনে প্রজাপতিরা নেচে বেড়াচ্ছে যেন। আমরা কথা বলা শুরু করি]
প্রিয়.কম: কমন প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যাক, কেমন আছেন...
মেহের আফরোজ শাওন: ভালো আছি।
প্রিয়.কম: যদি একই প্রশ্ন দরজার আড়াল থেকে করা হয়, যদি প্রিয় নাম ধরে কেউ ডেকে জিজ্ঞেস করে, কুসুম তুমি কেমন আছ? তখন কী উত্তর দেবেন?
[গলাটা পরিষ্কার করে বলা শুরু করলেন শাওন]
শাওন : ছয় বছর কিন্তু খুব বেশি সময় না। আবার খুব কম সময়ও না। অন্তত এত কম সময় না যে দরজার আড়াল থেকে কেউ ডাকলে আমি চমকে ওঠব। প্রথম দুই তিন বছর আমার তাই হতো। কেউ না ডাকলেও আমি চমকে উঠতাম। নূহাশপল্লীতে যখন যেতাম, সন্ধ্যার পর আমার প্রায় মনে হতে কেউ একজন বসে আছেন। দরজার আড়াল থেকে আমাকে কেউ ডাকবে এটা ভাবতেও চাই না।

প্রিয়.কম : আচ্ছা। আমার প্রশ্নটা ছিল যে, যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করেন কুসুম তুমি কেমন আছ তখন কী বলবেন। আমাকে তো বললেন ভালো আছেন?
শাওন : এ প্রশ্নটা আসলে কে করছে?
প্রিয়.কম: হুমায়ূন আহমেদ
শাওন: আচ্ছা, তিনি যদি আমাকে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেন তাহলে আমি বলব, আমি ভালো নেই।
প্রিয়.কম : কেন?
শাওন : বিশেষ কোনো কারণ যে বলতে পারব তা না। মানুষ তো আসলে খুব অভ্যাসের দাস। মানুষ কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে যায়। শিখে যায় অনেক কিছু। আমার বাচ্চারাও কিন্তু অনেক কিছু শিখে যাচ্ছে।
প্রিয়.কম : প্রতিটি সম্পর্কই তো এক একটা অভ্যাস...
শাওন : একমদ...তো প্রচলিত সাংসারিক জীবনে যা হয় বা যে স্ট্রাকচার থাকে, আমার বাসা কিন্তু তা না। আমার বাসায় কিন্তু এই যে দুপুর বেলা সবাই একসাথে বসে খাচ্ছি, অফিস থেকে কেউ একজন আসবে তার জন্য বিশেষ কিছু রান্না করতে হবে এমন না কিন্তু আমার বাসা। আমার বাচ্চারা কিন্তু এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তো এখন আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই জীবনে, কিন্তু এই অভ্যস্ততা যে আমি খুব পছন্দ করছি তা না। আমি আমার সেই জীবনটাকেই বেশি পছন্দ করি।
প্রিয়.কম : তার মানে আপনি এখন মেনে নিচ্ছেন...
শাওন: এটা এক রকমের মেনে নেওয়া আমার কাছে। হাতে আর কোনো অপশন নাই। মেনে নিয়ে যদি বলি তাহলে আমি ভালো আছি। কিন্তু আমি তো আসলে মেনে নিতে চাইনি। আমি তো এমনটা আশা করিনি। বিশ্বাস করতেও অনেক দিন কষ্ট হয়েছে। যে জীবনটা চাইনি সেই জীবনটাই যাপন করছি। সেজন্য যদি তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে বলব ভালো নেই।
প্রিয়.কম : চলুন আমরা ভালো থাকার গল্প করি, হুমায়ূন আহমেদের একটা প্রিয় অভ্যাস ছিল মানুষকে চমকে দেওয়া। এ কাজটি করে তিনি খুব মজা পেতেন। আমার প্রশ্ন হলো আপনাকে জীবনের প্রথম কীভাবে চমকে দিয়েছিলেন তিনি?
শাওন : প্রচুর প্রচুর...প্রথমতো হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন মানুষ, ওনার সঙ্গে কাজ করেছি অনেক ছোটবেলা থেকে, যখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম। ৯১-এ আমাদের প্রথম প্রোডাকশন হয়। তখন থেকেই দেখেছি এই মানুষটা সবাইকে চমকে দিতে পারেন। কিন্তু চমকে দেওয়ার মধ্যেও যে এক ধরনের মুগ্ধতা আছে সেটা আসলে ৯৫-এর দিকে আবিষ্কার কির। তখন আমি ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকের শুটিং করি। শুটিং ইউনিটে সাধারণতো সেটেই সবাই খাওয়া দাওয়া করে। শুটিং হতো বেইলি রোডে, আমার বাসা ছিল ইস্কাটনে। দুপুরের সময় আমি বাসায় এসে খেয়ে আবার শুটিংয়ে যেতাম। আমি একদিন বাসা থেকে ফিরে শুটিং স্পটে গিয়ে দেখি উনি আমার জন্য ওয়েট করছেন একসঙ্গে খাবেন বলে। এটা আসলে চমকে দেওয়া বলা যায় না, তবে এ ঘটনায় আমি খুব চমকে গিয়েছিলাম। আমি যে ওনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ, এবং আমাকে চমকে দেওয়া, খুশি রাখার চেষ্টা এটাই ছিল আমার জন্য চমক।
প্রিয়.কম : তখন থেকেই কি আপনাদের প্রেমের শুরু...
শাওন : আমার কাছে ওনার গুরুত্বটা ভালো লাগত। গুরুত্ব কথাটা বোধহয় ভুল বলা হচ্ছে।
প্রিয়.কম : কেয়ার নেওয়া...
শাওন : আমি না থাকলে ভালো না থাকা, আমি থাকলে আনন্দে থাকা, এই পরিবর্তনটা আমি ধরতে পারতাম। আমার ধারণা এই চেঞ্জটা সবাই ধরতে পারেন।

প্রিয়.কম : আমি আসলে আরেকটু ডিটেইল জানতে চাচ্ছিলাম। মানে বলতে চাচ্ছি আপনাদের দুজনার সম্পর্কের রসায়নাটা কবে থেকে...
শাওন: এটা আসলে দিনক্ষণ ধরে বলতে পারব না। এভাবে প্রেমটাও হয় না।
প্রিয়.কম : হুমায়ূন আহমেদ এ বিষয়ে বলেছেন, যুদ্ধ এবং প্রেমে কোনো কিছু পরিকল্পনা মতো হয় না...
শাওন : গল্প আসলে কম হতো, উনি লিখতেন প্রচুর...
প্রিয়.কম : চিঠি লিখতেন...
শাওন : বড় বড় চিঠি লিখতেন, কখনো কখনো তিন পাতার চিঠি, আবার দুই লাইনের চিঠিও লিখতেন। একতরফা গল্প তো। উনি গল্প করতেন আমি শুনতাম। প্রচুর ফোনে কথা হতো।
প্রিয়.কম : ল্যান্ডফোনে?
শাওন : হুম ল্যান্ডফোনে, এবং খুব মজার ব্যাপার, সব সময়ই তো আর ফোনের কাছে থাকা হয় না। যখন উনি ফোন করতেন যদি কাজের মেয়েটা ফোন ধরত উনি বলতেন, এটা কি কমলাপুর রেলস্টেশন? কাজের মেয়ে বলত জ্বি না। পরপর তিনচারবার কমলাপুর রেলস্টেশনের ফোন আসছে, প্রথম প্রথম আমি খুব রাগ করে ফোনটা ধরলাম তখন দেখি যে উনি। বাসায় এটা প্রতিষ্ঠিত হলো যে, ফোনে কেউ যদি উল্টা পাল্টা কথা বলে, তাহলে পরের ফোনটাই আমি ধরব। আমি নিশ্চিত যে কাজের মেয়েরা ফোন ধরলে বলবে এটা কি রেলস্টেশন কিনা, বা এটা কি ধর্মমন্ত্রীর বাড়ি, নয় বলবে এটা কী শাহবাগের ওসির বাড়ি। ফোনে আমাদের প্রচুর গল্প হতো। এটাকে আসলে খুনসুটি বলব কিনা বুঝতে পারছি না।
প্রিয়.কম: কী ধরনের কথা হতো...
শাওন : সেগুলো খুব অর্থহীন নির্ভেজাল কথা। যেমন শুটিং না থাকলে, দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছি, মাছ? কীভাবে রান্না ছিল, মটরশুটি ছিল, আলু দিয়ে রান্না কিনা। কোন সময় যে এসব খুনসুটি প্রেমে টান নিলো ওনার দিক থেকে আমি বলতে পারব না। উনি সরাসরি আমাকে একদম চিঠি লিখেই প্রেমের প্রস্তাব দেন।
প্রিয়.কম : আপনিও কি তাহলে লিখেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিলেন?
[খুব করে হাসলেন শাওন। প্রাণবন্ত হাসি যাকে বলে। হাসতে হাসতেই বললেন]
শাওন : আমি তো আর লেখক না।
প্রিয়.কম : আপনি কি চিঠি লিখেননি তাকে...
শাওন : একবারই লিখেছিলাম, কারণ তিনি বারবার বলতেন যে কেন আমি চিঠি লিখি না, আমার একটা খুব ভয় ছিল, ভয়টা হচ্ছে, আমার খালি মনে হতো আমি তো আর তার মতো সুন্দর করে লিখতে পারব না। খুব সিলি হবে লেখাটা আর এটা নিয়ে নিশ্চয়ই খুব হাসাহাসি হবে। একা একা হলেও তিনি হাসাহাসি করবেন। অন্য একটি ভয় ছিল যে পুরো বিষয়টাই হয়তো ফান, আমি চিঠি লেখার পর হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে চিঠিটা দেখিয়ে বলবেন যে, দেখছ মেয়েটা আমাকে চিঠি লিখছে। এরকম ভয় ছিল। তো খুব টেনশনে পড়ে আমার খুব জ্বর চলে এলো। আমার এসএসসি পরীক্ষা ছিল ৯৬-এর মার্চে। আমি একটা চিঠি লিখলাম পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে। সেদিন থেকে আমি সিরিয়াসলি অসুস্থ হয়ে পড়লাম ভয়ে। আমি অসুস্থ হবার পর হুমায়ূন আহমেদ আমার জন্য বাসায় এক ট্রাক ডাব পাঠালেন।
প্রিয়.কম : এক ট্রাক!
শাওন : হ্যাঁ, তারপরে আমি তাকে বারবার বলতে থাকলাম যে, আমি চিঠিটা ফেরত চাই। তিনি আমাকে চিঠিটা ফেরত দিতে আসলেন মার্চের ১৫ তারিখে। চিঠিটা আমি দিয়েছিলাম একটা বইয়ের ভেতর ঢুকিয়ে। তিনি বইসহই ফেরত দিলেন, সঙ্গে ওনার একটা চিঠি। তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, আমি চিঠি ফেরত চেয়ে ঠিক করিনি, চিঠিটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ
ছিল, শুধুমাত্র আমাকে খুশি করার জন্যই চিঠিটা ফেরত দিয়েছেন। জীবনে ওই একটি চিঠিই লিখেছিলাম। এরপর আর কোনোদিন সাহস পাইনি। একজন লেখককে চিঠি লেখার সাহস ও ক্ষমতা আছে বলে আমি মনে করি না। যদি ভাবতাম যে লিখতে পারব দুই তিন লাইন তাহলে হয়তো লিখতাম।
প্রিয়.কম: যেহেতু সম্পর্কের বিষয়টা আসল তাহলে জানতে চাইব তিনি কি খুব রাগ করতেন?
শাওন : উনি খুব রাগ করতেন না। তবে অল্পতে রেগে যেতেন। যত দ্রুত রেগে যেতেন তত দ্রুত আবার ঠান্ডা হয়ে যেতেন।
প্রিয়.কম : সাধারণত কী বিষয় নিয়ে ওনার সঙ্গে আপনার ঝগড়া হতো...
শাওন : আমার তরফ থেকে ছিল সিগারেট। আমি সত্যিকারের অভিমান করতাম তার সঙ্গে সিগারেট নিয়ে। তার সিগারেট খাওয়া নিয়েই ছিল আমার যত রাগ, অভিমান, ঝগড়া।
প্রিয়.কম : সিগারেট তো আর ছাড়ানো যায়নি...
শাওন : না সিগারেট ছাড়ানো গেছে, উনি সিগারেট ছেড়েছেন ২০১১-এর নভেম্বরে। তার ছোটপুত্র সেদিন প্রথম হাঁটল। বয়স তখন এক বছরের মতো। নড়বড়ে পায়ে হেঁটে দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওইদিনই তিনি সিগারেট ছেড়েছেন।
প্রিয়.কম: আপনি কি কখনো তাকে কান্না করতে দেখেছেন?
শাওন : হ্যাঁ...

[যেন কিছুটা স্থির হলেন শাওন। প্রশ্নের উত্তরের জন্য ভাবতে হয়নি। চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে শাওন বলেন]
শাওন : যখন আমাদের কন্যা লীলাবতি মারা গেল তখন আমি ওনাকে প্রথম কাঁদতে দেখি। হাউ-মাউ করে কান্না করতে দেখেছি। ওনার পুত্র কন্নাদের জন্য ওনার প্রচণ্ড একটা হাহাকার ছিল। উনি তাদের জন্য মাঝে মধ্যেই কান্না করতেন এই বারান্দায় বসে। গল্প করতে গিয়েই আসলে চোখ দিয়ে পানি চলে আসত। হয়তো বিপাশার ছোটবেলার কোনো একটা গল্প করছেন, হয় না স্বামী স্ত্রীর একসঙ্গে বসে গল্প করা। তখন হয়তো বলে উঠলেন, জানো বিপাশা না আমার বুকের উপর রাখলেই ঘুমিয়ে যেত। এটা বলতে বলতেই কান্না করে দিতেন। নূহাশ তো নিয়মিত বাসায় আসত। নূহাশকে নিয়ে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। কারণ নূহাশ দেখা যেত সপ্তাহের পাঁচ দিনই বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত। দুপুরে একসঙ্গে খেত, সন্ধ্যায় আড্ডা দিত। শীলা-বিপাশাকে খুব মিস করতেন। আরেকবার ওনাকে আমি হাউ-মাউ করে কান্না করতে দেখেছি যেদিন ক্যান্সার ধরা পড়ল। হাসপাতাল থেকে হাসিমুখেই বের হলেন। খুব সিলি সিলি ফান করছিলেন, বলছিলেন আহারে মানুষের কত ভালো ভালো জায়গায় ক্যান্সার হয়, ব্রেনে হয়, লাংয়ে হয়, আমার এমন একটা জায়গায় হলো লজ্জায় বলতেও পারব না। ওখান থেকে বের হয়ে শপিং করলেন। গাছপালা কিনলেন। তারপরে বেড়াতে গেলেন। বাচ্চাদের নিয়ে ডিনার করতে গেলেন, আমার মাও ছিলেন সঙ্গে। সবকিছু ফানটান করে হঠাৎ করে আমার মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করতে থাকলেন। অবাক করার বিষয় ক্যান্সার ট্রিটমেন্টের সময় ওনাকে আর কাঁদতে দেখিনি।
প্রিয়.কম: হাসপাতালের দিনগুলোতে আপনিতো সার্বক্ষণিক ওনার সঙ্গে ছিলেন। ওই সময়গুলোতে আপনাদের কী বিষয়ে আলাপ হতো?
শাওন : আমাকে যদি বলা হয় আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দর সময় কখন কেটেছে, আমি বলব নিউ ইয়র্কের হাসপাতালের সময়গুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়। ভালো সময় কোন অর্থে, তখন আমি সত্যিকার অর্থে সংসার করেছি। ঢাকায় থাকতে এমন কোনো দিন ছিল না যে আমাদের বাসায় কেউ আসেনি। গেস্ট... গেস্ট... গেস্ট। আমাদের কোনো নিজস্ব সময় ছিল না। আমার কোনো জন্মদিনে আমি শুধু তার সঙে থাকতে পারিনি। বিয়ের পর আমরা শুধু দুজন কোথাও বেড়াতে যাইনি। অ্যালন টাইম বলতে যা বুঝায় তা আমি পুরোপুরি পেয়েছি নিউ ইয়র্কে। তখন আমরা খুব বেড়াতাম। কেমো থেরাপির মাঝখানে একটা গ্যাপ পাওয়া যেত এগারো দিনের। কোথাও না কোথাও ঘুরতে যেতাম, কিচ্ছু না হলে নিই ইয়র্কের কোনো নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। স্বাভাবিক জীবনে আসলে এটা আমার খুব পছন্দ, কোথাও থেকে একটু বেড়িয়ে আসা। ঢাকার জীবনে এটা সম্ভব ছিল না। ওখানে আমরা খুব ঘুরেছি। খুব সুন্দর একটা সময় ছিল। আর কী নিয়ে গল্প করতেন, জীবনের কী কী ভুল তা নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করতেন। কী কী ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি পাঁচটি ভুল সিদ্ধান্ত খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন।
প্রিয়.কম: ভুলগুলো কী ছিল...
শাওন : না থাক, বলতে চাই না। সবগুলো আসলে কিছুটা পারিবারিক, কিছুটা ব্যক্তিগত, তো পাঁচটি ভুলের কথা উল্লেখ করে বলতেন যে, এগুলো আমার জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তারপর আরও পরের দিকে গিয়ে সর্ট লিস্ট করে তিনটি ভুলের তালিকা করলেন। তিনি মনে করতেন এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া ঠিক হয়নি। একটা ভুলের কথা অবশ্য বলতে পারি। তিনি মনে করতেন তার জীবনের তিনটি ভুলের মধ্যে একটি ভুল ছিল রসায়নে পড়া। তার ব্যাখ্যাটা ছিল, আমি আমার জীবনের অনেক মূল্যবান সময় এই রসায়নের পেছনে দিয়েছি। যে সময়টা আমি এখানে ইনভেস্ট করেছি সেটা আমি ইনভেস্ট করতে পারতাম আমার লেখালেখিতে। যেহেতু রসায়ন পড়েছি, রসায়নের শিক্ষক হয়েছি, টিচার হলে তো নিজেকেও প্রচুর পড়তে হয়, তো ওই সময়টা আমি লেখা লেখিতে দিতে পারতাম।
[এর মধ্যে গৃহকর্মী এসে জানাল নিষাদ জানিয়েছে তার জ্বর। সে আজ পড়তে যাবে না। শাওন ডাকালেন নিষাদকে। এর মধ্যে নিনিত তার পাশের রুমে চলে গেল। নিষাদ এসে মায়ের কাছে পরম মমতায় বসল। নিষাদের শরীর ভালো নেই। সে আজ পড়তে যাবে না। মা বললেন, মন না চাইলে জোর করে যেতে হবে না। নিষাদ চলে যায় তার রুমে। এর মধ্যে একটু পানি খেয়ে নিলেন শাওন। আবার কথা শুরু হয় আমাদের। খুব দ্রুত লয়ে কথা বলে যাচ্ছেন তিনি]
শাওন : [নিনিতকে] বাবা যাও, ছয়টার মধ্যে ক্লাসে যেতে হবে।
নিনিত : যাচ্ছি...
শাওন : যাচ্ছি না, যাও, না হলে দেড়ি হয়ে যাবে। নাহার এসিটা ছেড়ে দাও তো। তাহলে একটু গরমটা কমবে।
[গৃহকর্মী নাহার এসিটা ছেড়ে দিলেন]
প্রিয়.কম: হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালোবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।’ তো আপনি কী ধরনের অত্যাচার করেছেন তাকে?
শাওন : এই যে তার পছন্দের সিগারেট খাওয়াটাকে বন্ধ করার চেষ্টা করেছি বারবার। যতভাবে সম্ভব, ভয় দেখিয়ে, হয় সিগারেট থাকবে না হয় আমি থাকব এমনও বলেছি, রাগ করে জীবনে দুবার বাবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেটা সিগারেটের জন্যই। এটা হতে পারে একটা ভালোবাসার অত্যাচার।

প্রিয়.কম: কখনো কোনো কিছুর জন্য বায়না করা...
শাওন : আমি বায়না করার টাইপ ছিলাম না। হুমায়ূন আহমেদ তো আর সরকারি চাকরিজীবী টাইপ ছিলেন না, যে নয়টা পাঁচটা অফিস করা, বিকেলে স্ত্রীকে নিয়ে ফুচকা খেতে যাওয়া, নতুন একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে চল খেতে যাই। এই টাইপের বায়না ধরতাম না। এইটুকু বুঝি বলেই হয়তো হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে নয় বছর প্রেম করতে পেরেছি এবং আট বছর সংসার করেছি।
প্রিয়.কম : নয় বছর প্রেম করে বিয়ে। তো যেদিন দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তখন প্রথম কার কথা মনে পড়ল?
শাওন : আমার মায়ের কথা...
প্রিয়.কম : কেন? ওনারা কি রাজি ছিলেন না...
শাওন : এটা রাজি থাকার কথা? আমার মা তখন খুব অসুস্থ ছিলেন। মায়ের তখন হার্টের সার্জারি হয়েছে। এবং আমার কারণেই তিনি অসুস্থ হয়েছেন। তাই তখন শুধু মায়ের কথাই মনে পড়েছে। বাবার কথাও অতটা মনে পড়েনি।
প্রিয়.কম : এটা কি কখনো মনে হয়নি, যে মানুষটা আমাকে পাবার জন্য আরেকজনকে ছেড়ে আসছেন, তিনি যদি আমার চেয়ে আরও ভালো কাউকে পান আমাকেও ছেড়ে যেতে পারেন...
শাওন : না, এরকম কখনো মনে হয়নি। আমি যখন নিশ্চিত হয়েছি যে তার জন্য আমার চেয়ে ভালো কাউকে পাওয়াটা একটু ডিফিকাল্ট। আমার চেয়ে ভালো কেউ নেই পৃথিবীতে আমি কিন্তু এটা বলছি না। আমি বলছি প্রত্যেকটা মানুষের জন্য একটা ভালো লাগা থাকে। লাল আমার জন্য ভালো লাল যে সবার জন্য ভালো হবে ব্যাপারটা এমন না। এটা একটু ফান করেই বললাম যে, আমার চেয়ে ভালো তার জন্য আর কেউ নাই, এটা কিছুটা কিন্তু হ্যাঁ, একটা মানুষকে তার সবকিছু মিলিয়ে কিন্তু গ্রহণ করতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ। আমি কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে সবভাবে দেখেছি। সেই সবকিছু গ্রহণ করে নেওয়ারও কিন্তু একটা বিষয় আছে। এরকম কোনোদিনই মনে হয়নি একটি দিনের জন্য যে তার সঙ্গে আমার ভুল বোঝাবুঝি হবে। বিয়ের পরপর এটা নিয়ে অনেকেই আমার সঙ্গে খুব ফান করেছে। বলেছে, বিয়ে তো করেছে ছয় মাস পর দেখব কী হয়। ছয় মাস পার হলো, তখন বলে, এক বছর পর দেখব কী হয়, তারপর শুনলাম যে শাওন হুমায়ূনের সংসারে ঝড়। এরকম শিরোনামে নিউজও হলো কোথায় কোথায় যেন। আমারই হাসাহাসি করতাম। এটা সম্ভব ছিল না। কোনোভাবেই না।
প্রিয়.কম : যতটুকু জানি আপনার গানের গলার জন্যই হুমায়ূন আহমেদ আপনার প্রেমে পড়েন। আপনি এমনিতেও ভালো গান করেন। আপনার পরিচালিত প্রথম সিনেমায় গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। আপনার কি মনে হয়নি সিনেমাটির জন্য আপনাকে সেরা পরিচালকের পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল...
শাওন : না। আমি কৃষ্ণপক্ষ চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার পাওয়ার মতো ডিরেকশন দিইনি। আমি নিজেই নিজেকে পুরস্কারটা দিই না। সুতরাং আমি আশা করবো কী করে যে ওরা আমাকে দিবে।
প্রিয়.কম : আপনার সিনেমার শেষ দৃশ্যটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। দৃশ্যটা দেখে আমার মনে হচ্ছিল মেঘের ভেলায় করে লক্ষীন্দরের লাশ যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বেহুলা। তার স্বামীকে যদি বাঁচানো যায়। তখন আমার আপনার কথা খুব মনে পড়েছে...
শাওন : আপনার যে জায়গাটা ভালো লেগেছে। ওটা কিন্তু আমারও পছন্দের একটা দৃশ্য। যে কারণে আমি দৃশ্যটা যত্ন নিয়ে শুট করেছি। আমি সিনেমাটাতে শিখেছি। যেটা শিখেছি সেটা হচ্ছে কীভাবে মোমেন্ট ক্রিয়েট করতে হয়। অনেকগুলো মোমেন্ট মিলেই তো একটা সিনেমা। আমি আমার ভুলগুলোও ধরতে পেরেছি ছবিটা বানাতে গিয়ে। হ্যাঁ এ ছবিটাতে আরও কয়েকজন পুরস্কার পেতে পারত, বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের একটা গান আছে ছবির শেষে এই গানটা যদি পুরস্কার পেত আমার খুব ভালো লাগত। আজাদ আবুল কালাম, এস আই টুটুল পুরস্কার পেতে পারত। কিন্তু আমার ডিরেকশন নিয়ে একবারও মনে হয়নি আমি পেতে পারতাম।
প্রিয়.কম : গান বিষয়ে আপনাদের কী ধরনের আলাপ হতো...
শাওন : গান বিষয়ে আসলে আমাদের আলাপ খুব কম হতো। যতবার আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, কেন আপনি আমাকে পছন্দ করেন, তিনি একটাই কারণ বলেছিলেন যে গান। প্রেমের সময়ে চিঠিতে খুব লিখতেন যে, ইস যদি আমাদের জীবনে এমন একটা সময় আসতো যে আমি তোমার কোলে মাথা রেখে গান শুনছি। মজার বিষয় হচ্ছে যখন সে সুযোগটা আসল কিন্তু এরকম কিছুই আর হয়নি। মানুষ কিন্তু কল্পনায় অনেক কিছু ভাবে। মানুষ যখন একটা সম্পর্কে জড়ায় তখন কিন্তু অনেক রোমান্টিক চিন্তা করে। একবার আমি একটা অনুষ্ঠানে গান গাইছি। তখন মাত্র সেল ফোনের যুগ শুরু হয়েছে। তো তিনি অনেক দূর থেকে আমাকে টেক্সট পাঠাচ্ছেন এই লিখে যে, ইস এখন যদি তোমার কোলে মাথা রাখতে পারতাম। কিন্তু যখন আমাদের বিয়ে হলো, এবং এই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব তখন কিন্তু আর তিনি এ ধরনের কথা বলেননি। পরবর্তীতে গান নিয়ে যেসব কথা হতো সেগুলো হচ্ছে কাজের কথা। যেমন একটা গান লিখছি, দেখ তো এই জায়গাটা কী হতে পারে, বা ঠিক আছে কী না। আমার যেটা ভালো লাগত সেটা আমি বলতাম। উনি খুব দ্রুত প্রভাবিত হতে পারতেন। যদি তাকে লজিক দিয়ে বোঝানো যেত। উপন্যাসের বড় অংশও চেঞ্জ করে ফেলতেন। এমনি আপনি যদি বলার জন্য বলেন, স্যার আমার ভালো লাগেনি তাহলে হবে না। লজিক দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে। আমাদের প্রচুর আড্ডা হতো এখানে। সেখানে প্রচুর গান বাজনা হতো। অামি গান গাইতাম। লেখকরা আসতেন আড্ডায়। সুনীল দা খুব আসতেন।
প্রিয়.কম : আচ্ছা এবার একটু আপনার বিষয়ে আসি...আপনার তো অনেকগুলো পরিচয় আছে। তবে একটি পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাই। আপনি তো মাঝখানে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন...অভিজ্ঞতা জানতে চাই...
শাওন : এটা আসলে আমার মায়ের একটা কৌশল ছিল আমাকে ব্যস্ত রাখার জন্য। যদিও আম্মু তা বলেন না। আম্মু এখনো বলেন, তুমি যদি এখন হাল ধরতা আমি আবারও চালু করতাম। আমি ছেড়ে দেওয়ার পরে বোধহয় তিন চার মাস পত্রিকাটা ছিল। এরপর বন্ধ হয়ে যায়। আমার মায়ের একটা শখ ছিল পত্রিকা করার। ‘৭১ এবং’ পত্রিকাটার নাম ছিল। আমাকে একরকম জোর করে আম্মা নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তখন ঘর থেকে বের হতাম না খুব একটা। তখন বাধ্য হয়ে অফিস করতে হতো। আমার ধারণা এটা ছিল আমাকে জীবনে ফেরানোর একটা কৌশল।

প্রিয়.কম : আপনার আর্কিটেকচার ফার্মটা কেমন চলছে...
শাওন : খুবই ভালো চলছে। অনেকগুলো প্রজেক্টের কাজ করছি। একটা হাসপাতালের ডিজাইন করেছি, আমার বাবার একটা ১৭ তলার বিল্ডিং এর ডিজান শেষে ওটার কাজ চলছে। এসব নিয়েই ব্যস্ত।
প্রিয়.কম : যেহেতু হাসপাতাল প্রসঙ্গ আসল, জানতে চাই হুমায়ূন আহমেদ যে একটি ক্যান্সার হাসপাতালের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার জন্য কী আপনারা পারিবারিকভাবে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?
শাওন: না আমরা পারিবারিকভাবে কোনো উদ্যোগ নিইনি। পারিবারিকভাবে হয়তো একটা উদ্যোগ নেওয়া যেত, তাহলে সেটা হয়ে যেত হুমায়ূন আহমেদের পারিবারিক হাসপাতাল। সেটা হোক আমি চাইনি। হুমায়ূন আহমেদ বিষয়টা যেভাবে অনেক বড় করে চিন্তা করেছেন তার জন্য অনেক বড় বড় মানুষ দরকার। হুমায়ূন আহমেদ থাকলে এটা খুব দ্রুত সম্ভব ছিল। হুমায়ূন আহমেদ ছাড়াও এটা সম্ভব, যদি গুরুত্বপূর্ণ দশ বারোজন মানুষকে একত্রিত করা যেত তাহলে আসলেই সম্ভব ছিল। আমি নাম ধরেই বলতে পারি, যেমন আনিসুজ্জামান স্যার, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম স্যার, সরকারের তরফ থেকে দু একজন এমন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যারা প্লান ম্যাক করেন। কিছু বিখ্যাত ডাক্তার। এরকম দশ জনের যদি একটি কমিটি করা যেত। তাহলে শুরু করা যেত। একজন হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন যে আমি হাসপাতালের জন্য মানুষের কাছে হাত পাতব। ধরেন আমিও মানুষের কাছে গেলাম হাত পাতলাম। টাকা নিলাম। ধরেন পাঁচ কোটি কাটা উঠেছে। আপনি যে মুহূর্তে আমাকে টাকা দিলেন সেই মুহূর্ত থেকে আপনি যুক্ত হয়ে গেলেন বিষয়টার সঙ্গে। কিন্তু আমি তো তখনই কাজ শুরু করতে পারছি না। আমি খুব চাই হাসপাতালটা হোক। আমার কাছে এটাও মনে হয়েছে শুরু হয়ে গেলে কিন্তু কাজটা শেষ হয়ে যাবে।
প্রিয়.কম : স্কুলটা তো ভালোই চলছে...
শাওন : স্কুলটা খুবই ভালো চলছে। প্রতিবছর আমি যাই স্কুলে। স্কুলের রেজাল্টাও খুব ভালো।
প্রিয়.কম : সাধারণ মানুষের একটা অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে, আপনি বান্ধবীর বাবাকে বিয়ে করেছেন। যদিও আপনি বলেছেন বিভিন্ন সময় কথাটা সত্য না...
[অনেকক্ষণ সিরিয়াস আলাপ সালাপের পর এই প্রশ্নটা শুনে আবার হাসলেন শাওন। মুখে হাসিটা রেখে বলেন]
শাওন : আমি কতবার যে বলেছি এটা একটা মিথ্যা কথা। তারপরেও লোকজন এটা বলেই থাকে। আমি যদি মরেও যাই তারপরেও লোকজন এ কথা বলবে। ফেসবুকে সেদিন দেখি কে যেন লিখেছে ভান্দবীর বাবা। দেখে হাসতে হাসতে শেষ।
প্রিয়.কম : আপনি তো আপনার সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে ফাইট করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। আপনাকে তো ফাইটার বলতেই পারি। একা একা ফাইট করে যাচ্ছেন। ক্লান্তি আসে না কখনো।
শাওন : খুব ক্লান্ত লাগে মাঝে মধ্যে। ক্লান্তিটা কখন লাগে? আমার মা ২০১২ সালে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, এই যে কেউ আসলেই তুমি কান্না কাটি কর, ভেঙে পড়, এতে করে তাদের কাছে তুমি বিরক্তিকর মানুষে পরিণত হবে। তখন ওরা বলবে, ওর কাছে গেলেই খালি দু:খের প্যাঁচাল পাড়ে। দু:খ আসলে সবাইকে দেখানোর জন্য না। দু:খ ভুলতে হবে না। কিন্তু এই অস্বাভাবিকতা থেকে তোমাকে বের হয়ে আসতে হবে। এই কথাটা আসলেই আমাকে হেল্প করেছে ক্লান্তি দূর করতে।
প্রিয়.কম : সারা জীবন একা থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুনলাম...
শাওন : কী মনে হয় আপনার...
[বলেই খুব করে হেসে নিলেন]
শাওন : শোনেন, বিয়ে আর করব কিনা এই কৌতূল আসাটা স্বাভাবিক। আমি এমন একজন মানুষের সঙ্গে জীবনযাপন করেছি, সেই মানুষটার সঙ্গে আপনি যদি দুই দিন গল্প করেন অাপনি তাকে এক সেকেন্ডের জন্য ভুলতে পারবেন না। সুতরাং এটা আমার লাইফে একেবারেই ইম্পোসিবল থিংক। কোনোভাবেই সম্ভব না। এই সিদ্ধান্ত কোনো দিনই পরিবর্তন হবে না। আমি খুবই সুখে আছি আমার দুই পুত্রকে নিয়ে।
প্রিয়.কম : আপনার ছেলেরা যদি কখনো উদ্যোগি হয় মায়ের বিয়ে দিতে তখন কী করবেন?
শাওন : আমার ছেলেরা এমনটা করবে না আমি নিশ্চিত। ওদের মাথায়ই আসবে না। আমি আমার বাচ্চাদের কাছে ওপেন বুকের মতো। আমাদের প্রচুর গল্প হয়। কী কী গল্প হয় এটা শুনলে ওনেকে অবাক হয়ে যাবে। আমার কাজিনরা আমাকে মাঝে মধ্যে বলে, তুই না একটু বেশি বেশি করিস। আমি ভাবি যে এই বেশিটাই আমার জন্য দরকার।
প্রিয়.কম : জন্মদিন আসলে হুমায়ূন আহমেদ কী করতেন...
শাওন : জন্মদিন নিয়ে তার তেমন কোনো আদিক্ষেতা ছিল না। তিনি তার ফেমটাকে খুব এনজয় করতেন। ভক্তদের ভালোবাসা। ভক্তদের কান্না। ফুল খুব ভালোবাসতেন।
প্রিয়.কম: উনি কি রান্না করতেন...
শাওন : মাঝে মধ্যে শখ করে করতেন। বিশেষ করে কোরবানির সময় গরুর মাংস রান্না করতেন।
প্রিয়.কম: শেষ প্রশ্ন, যদি একদিন ঘুম ভেঙে দেখেন হুমায়ূন আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন, কী করবেন প্রথমে...
শাওন: জানি না!
প্রিয়.কম: সত্যি?
শাওন: সত্যি জানি না!
প্রিয়.কম: ইচ্ছে করবে না খুব ঝগড়া করতে, বকা দিতে, চুল এলোমেলো করে দিয়ে বুকে চেপে ধরে কান্না করতে?
শাওন: সেটাও জানি না! ইচ্ছা করাই না তো কিছু, তাই আর ভাবিও না!

দক্ষিণা হাওয়ায় সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেক্ষণ হলো। মাগরিবের আজানের মায়বী সুর ভেসে আসছে দূর মসজিদ থেকে। মলাটবন্দী হিমু আর মিসির আলী হাত ধরাধরি করে হয়তো নেমে পড়েছে আলো আঁধারের পথে। আমিও ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকি। আর ভাবতে থাকি ইস আরও তো প্রশ্ন ছিল, জানার ছিল অনেক কিছু, কিছু প্রশ্ন করাই হয়নি সামাজিকতার ভয়ে। কিছু কথা লেখাই যাবে না। মনে পড়ে যায় হুমায়ূন আহমেদের একটি কথা। তিনি বলেছেন, ‘জীবনে কিছু কিছু প্রশ্ন থাকে যার উত্তর কখনো মিলে না, কিছু কিছু ভুল থাকে যা শোধরানো যায় না, আর কিছু কিছু কষ্ট থাকে যা কাউকে বলা যায় না।’