
বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম
‘মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই, অমানুষের ভিড়ে নয়’
আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০১৮, ১৭:২০
(প্রিয়.কম) শুধু জীবন নয়, মনের রংটাও ধূসর হয়ে গেছে। তবে বাড়ির চার দেয়াল রঙিন। যার কারণে এরমধ্যেই রসদ খুঁজে পান। বেঁচে থাকার, সামনে এগিয়ে চলার। রূপাকাশ্রয়ী জীবনই তাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। সেগুনবাগিচায় এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। তার একটি অংশেই থাকেন বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ছিমছাম পরিপাটি বসার ঘর। যেখানে তিনি নিজেকে খুঁজে পান। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই বসার ঘরে উপস্থিত হলেন এ অভিনেতা।
‘তোমার তো আরও আগেই আসার কথা ছিল?’ মৃদু পায়ে বসার ঘরের দিকে আসতে আসেত হালকা ভাঙা স্বরে কথাগুলো বললেন প্রবীর মিত্র। পরনে ধবধবে সাদা গোল গলার গেঞ্চি আর লুঙ্গি।
ছেলের সহায়তায় শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে এসেছেন। সবশেষ যেদিন দেখা হয়েছিল এফডিসিতে সেদিনও এতটা নাজুক লাগেনি তাকে। তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘সড়কে জ্যাম’। আর তিনি বললেন, ‘আমাদের মধ্যে না, আসলে দেশপ্রেমটা নাই।’
সম্প্রতি শিল্পীকলা একাডেমির পাশের একটি ভবনে অবিস্থত তার বাসায় কিছু সময়ের জন্য প্রিয়.কমের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন এই অভিনেতা। সে সময় এখনকার জীবনযাপন ছাড়াও বেশ কিছু প্রসঙ্গে কথা বলেন।

‘এক অভিনয়জীবনে সুনাম, যশ, খ্যাতি সবই পেলেন। আপনি কি ঠিক এমনটাই হতে চেয়েছিলেন?’
এ প্রশ্নের মধ্য দিয়েই শুরু হলো আলাপ। প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। এরপর তার চোখের পলক গিয়ে পড়ল ঠিক তার সামনের একটি শোকেসের দিকে। যেখানে তার এক জীবনের সব অর্জনগুলো থরে থরে সাজানো রয়েছে।
এরপর বললেন, ‘আমার ওই নায়ক-টায়ক হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ফ্যাসিনেশনও ছিল না। ইচ্ছে ছিল অভিনেতা হব। যাই হোক, চাওয়া তো অনেক কিছুই থাকে, কটা পূরণ হয়? আমি অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম, অভিনেতার স্বীকৃতি পেয়েছি। এটাই আমার কাছে সব। আর কী কমু? এই তো। এসবের মধ্যে একটা ভালোলাগা আাছে। যা অন্য কোথাও নেই।’
প্রবীর মিত্র অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত হয়ে চার দেওয়ালে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। চার যুগের ক্যারিয়ারে শুরুর দিকে নন্দিত নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন তৈরি করে নেন। ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময় থেকে চরিত্রাভিনয়ের দিকে মনোযোগী হন। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাকে ছাপিয়ে তার ফুটিয়ে তোলা চরিত্রগুলো দর্শকমহলে আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে।
জীবনের পালাবদল ও সময়ের পরিবর্তনে এখন আর অভিনয় করেন না, কিন্তু এখনকার দিনগুলো কাটে কীভাবে?
প্রবীর মিত্র বললেন, ‘এখনকার সময়গুলো দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে কাটে। আমি হাঁটতে পারি না, ঠিক করে। যার কারণে ঘরের বাইরে যাইতে পারি না। আর একটা হেল্পিং হ্যান্ড (সহকারি) লাগে আমার। না হলে লাঠিতে ভর করেই চলতে হয়। কোনো কিছূ করার ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারি না। যেটা আমার দু:খ লাগে, আমি অভিনয় করতে পারছি না।
তারপরও করা যেত। কিন্তু মেকাররা (নির্মাতারা) সেভাবে এগিয়ে আসে না। কিন্তু এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নাই। যা পেয়েছি জীবনে, অনেক পেয়েছি। এতটা পাওয়ার কথা ছিল না। কোটি কোটি মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছি। এর দাম তো দেওয়া যাবে না। আমার নামটা বললে পরেই মানুষের রিঅ্যাকশন হয়। এটা আমার কাছে পরম পাওয়া।’
নিজ ঢংয়েই জীবনের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে ধরেছেন প্রবীর মিত্র। কথা বলে যাচ্ছেন নিজ ভঙিমায়। এ কথার যেনো কোনো স্টপেজ নেই। থামবে কখন তাও জানা নেই। বলতে বলতে একটা সময় চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছিল। এরমধ্যে আনন্দ আর বিষাদের ছায়া ভর করেছিল। তাও টের পাওয়া গেল। কিছুটা সময় যাওয়ার পর নিজেকে সামলে নিলেন।
‘কিন্তু দাদা এরমধ্যে একাকীত্ব কী আপনাকে ঘিরে ধরে না…?’
বললেন, ‘আমার ওয়াইফ (স্ত্রী) মারা গেছে ২০০০ সালে। তারপর আমার ছোট ছেলেটা মারা গেছে ২০১২ সালে। এই দুইটা ঘটনা আমাকে এখনো ভীষণ পীড়া দেয়। আমার ছোট ছেলেটা বাইরের খাবার খুব পছন্দ করত। এরপর একটা সময় গিয়ে ওর গ্যাসস্ট্রিকের সমস্যা শুরু হয়। সেখান থেকেই ওর স্ট্রোক হয়। তারপর মারা যায়। এসব নিয়ে এখন স্মৃতি রোমন্থন করি। এভাবেই আমার দিন কাটে। টিভি দেখি, খবরের কাগজ পড়ি। বাসায় কেউ আসলে ভালো লাগে।’

প্রত্যেকটা বয়সের আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে, এই সময়ে এসে সেটা ঠিক কেমন উপভোগ করেন?
‘এই বয়সে ভালো লাগার কিছু নাই। ভালো লাগে সন্তানরা যখন আমার খোঁজ খবর নেয়। ওরা আসে, তত্ত্বাবধান করে। আমি যাদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম কিংবা আমার বন্ধু যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই তো এখন আর নেই। এই অনুভূতিটা বোঝানো যাবে না। কারণ যখন যার জীবন এই সময়টা আসবে সে তখনই বিষয়টা বুঝতে পারে।’ বললেন প্রবীর মিত্র।
আলাপের মাঝে হঠাৎ ভাঙা গলায় গেয়ে শোনালেন, ‘ও রে নীল দরিয়া…’ গানটি। এভাবেই কথায় কথায় জমাট বাঁধে সময়গুলো। কত চাওয়া-পাওয়ার বাক্য বিনিময় হয়ে গেল অল্প সময়েই।
‘আপনার সহশিল্পীরা খোঁজ-খবর নেয়?’ জবাবে বললেন, ‘না, কেউ আমার খবর নেয় না। আর তাদের সময়ই বা কেথায়? এখনকার জীবন তো বেশ ব্যস্ত। আসলে সময়ই মানুষকে ভীষণ বদলে দেয়। অথচ একটা সময় ছিল, কত কত মানুষ কতভাবেই না প্রবীর মিত্রর সঙ্গে সৌহার্দ্য বজায় রাখত। যাক না জীবন এভাবে। ভালো আছি, এটাই বা কম কিসের? ক’জন মানুষ পারে আমার মতো একটা জীবন কাটাতে?’
‘আপনার শরীরের কী অবস্থা, চিকিৎসক কী বললেন?’
‘বয়স তো কম হল না। ৭৭ থেকে ৭৮ এ পা রাখলাম। আমার শুধু আথ্রাইটিসের সমস্যা। আমার শরীরে আর কোনো সমস্যা নেই। আর এটাই আমাকে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে। জীবনটাকে বেশ কঠিন সময়ের মুখোমুখি করে দিয়েছে।’
গেল জন্মদিনটা কীভাবে পালন করবেন? এ প্রশ্নে বললেন, ‘জন্মদিন কোনোদিনই জাকজমকভাবে পালন করা হয় না। আমি করিও না। মাঝে-মাঝে ছেলে-মেয়েরা হঠাৎ করেই করে ফেলে। আগে যেটা করতাম জন্মদিনে আমার ছেলে-মেয়েদের বলতাম, আসো আসো এরপর বাতাসা কিংবা নকুল দিতাম আর বলতাম, নাও আজ আমার জন্মদিন। কখনো বা মিছরি।’
‘এখনকার সিনেমার বাজারের খোঁজ-খবর রাখেন?’
‘সব খবর তো আর রাখতে পারি না। তবে এটুকু জানি সিনেমার বাজার একটু বেটার যাচ্ছে। সবাই কিছু না কিছু করে খাক। অনেক লোক এই ফিল্মের সঙ্গে জড়িত। এরা সবাই ভালো থাক। কাজের মধ্যে থাক।’
কথা হয় চলচ্চিত্রের বিভিন্ন প্রসঙ্গে। এখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ে ভিন্নতা নেই। শিল্পী হিসেবে নিজেকে বদলানো কতটা জরুরি? ‘শিল্পীদের কাজে চেঞ্জ (পরিবর্তন) না থাকলে তো মনোটোনাস (একঘেঁয়ে) হয়ে যাবে।
তখনই ঝামেলাটা হয়। তখন আর ভালো লাগবে না। কারণ নিজে নিজেই পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনটা জরুরি। কাজেই মনোটোনাস যাতে না হয়ে যায়, সে ব্যাপারটা খেয়াল রাখা দরকার।’ যোগ করেন প্রবীর মিত্র।

‘চলচ্চিত্রের মানুষদের মধ্যে এখন আর আগের মতো হৃদ্যতা নেই বলে অনেকেই অভিযোগ করেন, আপনার কী মত?’
‘হৃদ্যতা তো নাই। কেউ কারো খোঁজ নেয় না। আগে সাংঘাতিক হৃদত্য ছিল। দেখা যেত স্টুডিওতে দশজন হিরো কাজ করতেছে, সবাই যে যার খবর নিত। এখন মনে হয় না এ রকমটা আছে! এখন তো শুনি পাশের ফ্লোরে কাজ করলেও কেউ কারো খবর নেয় না। এখন যে যার কাজ-কর্ম শেষ করেই দৌঁড়। কারণ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। উপায়ও নেই। সময়টা তো খুব খারাপ যাচ্ছে।’
‘বর্তমানে বাংলাদেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, একজন শিল্পী হিসেবে বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?’
‘এগুলো তো আর এক দিনে হয় না। এই অস্থিরতার অবসান হওয়া দরকার। না হলে তো দেশের উন্নতি হবে না। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে তরুণ সমাজ সে সমাজ যদি নানানদিকে বিক্ষপ্ত হয়ে যায় নানান দিকে।
তাদের দিকে যদি সরকার লক্ষ না রাখে তাহলে তো বিপদ। আমাদের কী হবে আমি জানি না। তবে সবারই উচিত হবে দেশের, মানুষের, নিজের উন্নতি কীভাবে হবে এ ব্যাপারগুলো নিয়েই চিন্তাভাবনা করা উচিত। আর আমার তো কিছু করার নেই। আমি আশা করতে পারি। সুদিন আসছে। ভালো হবে, সবাই ভালো থাকবে।’
যতই শব্দ ফুরোয় ততই গলা ভারি হয় বর্ষীয়ান এ অভিনেতার। বললেন, ‘কত বিচিত্র মানুষই না দেখলাম এ জীবনে!’ সময় দরজায় কড়া নাড়ছে। বিদায় বলার ক্ষণ এসে গেছে। প্রতিবেদকের হাতে ভর করে দাঁড়ালেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
বললেন, ‘মৃত্যুভয় আমার নাই। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনেক আয়ু দিয়েছে, আরও আয়ু দেবে। আমি আরও অনেক দিন বাঁচব। আমি পৃথিবী থেকে এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাই না। আমার এই পৃথিবীটাকে আরও অনেক দেখার ও শোনার ইচ্ছে রয়েছে। মানুষের মাঝে আমি বেঁচে থাকতে চাই, অমানুষের ভিড়ে নয়।’
প্রিয় বিনোদন/গোরা