
ছবি সংগৃহীত
হারেমের ইউনাখ বা খোজা বৃত্তান্ত
আপডেট: ০৭ জুন ২০১৬, ১৪:২৩
হারেম সিক্রেটস। পর্ব-৫।
(প্রিয়.কম) সময়ের পিঠে চেপে আমরা আধুনিক মানুষের দলে নাম লিখিয়েছি আরো আগেই। তাই বলে আমাদের অতীত কিছু মুছে ফেলা যাবে না। তেমনি পাল্টায়নি মৌলিক কিছু অভ্যাস। সেই সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের জৈবিক তাড়নার একটা আলাদা প্রকোপ ছিল। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় প্রাচীন আমল থেকেই পুরুষরা বহুগামী ছিল। বহুগামীতার এই অভ্যাস পরবর্তীতে রাজা-বাদশরা নিয়মে পরিণত করেন। ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আগের দিনের রাজা-বাদশাদের নানা কীর্তিকলাপ এখনো মানুষের মুখে মুখে। এসবের অনেক কিছু যেমন ঐতিহাসিক প্রমাণে ভাস্বর, আবার অনেক কিছুই নেহায়েত মানুষের কল্পনাপ্রসূত। কোনো কোনো রীতি আবার স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পাল্টেছে নিজের রঙ। হারেমের কথাই ধরা যাক। অন্তঃপুরের নারীদের থাকার জায়গা হিসেবে যার শুরু, এর বিবর্তন কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রহস্য। সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ‘হারেম’ সব সময়ই ছিল মানুষের চিরন্তণ আগ্রহের কারণ। প্রিয়.কম পাঠকের জন্য ধারাবাহিকভাবে গোপন সেই অধ্যায় তুলে ধরছেন রণক ইকরাম।
প্রথম থেকে চার পর্ব পর্যন্ত আমরা দেখেছি হারেম কি, কেন কিভাবে, মুঘল হারেম, অটোমান হারেমসহ এক ঝলকে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হারেমের ঘটনা। এবার আমরা বিস্তারিত পর্বে প্রবেশ করবো। বিস্তারিত পর্বে থাকছে খোজা ইতিহাস, মুঘল হারেম, অটোমান হারেম এবং আধুনিক হারেম পর্যন্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ। আজ থাকলো সিরিজের পঞ্চম খণ্ড।]
আগের পর্বের লিংক
হারেম সিক্রেস ১
হারেম সিক্রেস ২
হারেম সিক্রেস ৩
হারেম সিক্রেস ৪
পূর্বে প্রকাশের পর...
হারেমে সুলতান বা রাজার পরিবার পরিজন বা রক্তসম্পর্কীয় নারীদের বসবাসের কথা এসেছে। উপপত্মীদের কথাও এসেছে। মুঘল এবং অটোমান দুই জায়গার হারেমেরই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সেই অংশটি হচ্ছে হারেমে বসবাসকারী একটি বিশেষ গোত্রীয় মানুষ বা খোজা। এরা প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজকীয় হারেমে বা জেনানামহলে প্রহরী, কর্মী ও কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এদেরকে কিশোর এবং শিশু অবস্থায় নিয়ে আসা হতো। তারপর তাদের ক্যাস্ট্রেশন অর্থাৎ অন্ডকোষসহ শুক্রথলি কেটে ফেলে তাদেরকে বিশেষ শ্রেণীর পুরুষ বানানো হতো যাতে তাদের সন্তান জন্ম দানের ক্ষমতা না থাকে। শুক্রাশয় কেটে ফেলার জন্য খোজাদের জৈবিক চাহিদা থাকতো না। ফলে হারেমের নারীদের পাহারাদার ও কর্মচারী হিসেবে এদের চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ ছিল না। বিশেষ উদ্দেশ্যে পুরুষদের খোজা করার প্রথা খ্রিস্টপূর্ব আট শতকের গোড়ার দিকেও প্রচলিত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে খোজারা রাজকীয় হারেমের ভৃত্য বা প্রহরী হিসেবে, খেতাবধারী বা বৃত্তিভোগী রানী এবং সরকারের যোদ্ধা ও মন্ত্রীদের পরামর্শদাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
তিউনিশিয়ায় হারেমের পাহারারত অস্ত্রধারী খোজা। ছবিটি ১৯৩১ সালে তোলা।
খোজা বা ইউনাখ [Eunuch] শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ [Eunoukhos] থেকে যার অর্থ হচ্ছে শয়নকক্ষের পাহারাদার। গ্রীক শব্দ Eune অর্থ বিছানা এবং Ekhein অর্থ হচ্ছে পাহারা দেয়া। ঠিক একইরকমভাবে ল্যাটিন ভাষায় স্প্যাডো, ক্যাস্ট্রাটাস শব্দগুলোর মানেও খোজা। বাংলায় আমরা ইউনাখদের বলি ‘খোজা’। খোজা শব্দটি উর্দু, পুরো শব্দটি হল খোজা সারাহ। তবে ইউনাখ কিংবা খোজাকৃত পরুষরা কেবল মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তা নয়। প্রাচীন চীনের অভিজাত সমাজেও এদের বিশেষ ভূমিকায় দেখা গেছে। চীনে শিশ্নচ্ছেদ (castration) বা ক্যাস্ট্রেশন ছিল একাধারে শাস্তি এবং ইউনাখ করার অন্যতম পদ্ধতি। ষোড়শ সপ্তদশ শতকে চীনে সম্রাট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ইউনাখের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০,০০০!
ইউনাখ বা খোজা হচ্ছে পৌরুষবর্জিত পুরুষ। খুব ছোটোবেলায় বা কিশোরবেলায় তাদের প্রজনন অঙ্গ কেটে ফেলা হতো। বয়ঃসন্ধির পূর্বেই যেসব শিশুর ক্যাস্ট্রেশন করানো হতো তাদের কোনো প্রকার যৌন আকাঙ্ক্ষাই থাকতো না। অতীত কাল থেকেই দাস শ্রেণির পুরুষ শিশুদেরকে যত কম বয়সে সম্ভব তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্যাস্ট্রেশন করানো হত। এ ধারাটিই অধিকাংশ সমাজে প্রচলিত ছিল। কিন্তু প্রাচীন লেখনীতে খোজা বলতে বলা হয়েছে এমন ব্যক্তি যিনি প্রাকৃতিকভাবেই যৌনমিলন এবং সন্তান জন্মদানে অক্ষম এমন পুরুষ। তবে অনুমান করা যায় যেহেতু এ ধরনের পুরুষ হরহামেশা খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল, সেহেতু কৃত্রিমভাবে খোজা তৈরির এই রীতি তৈরি হয়। পুরুষের হারেমে নারীদের বন্দিত্ব পাকাপোক্ত করতেই ইউনাখ নিযুক্ত করা হত। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার ছিল এই যে, কখনও কখনও বালক কিংবা তরুণরা স্বেচ্ছায় খোজা হতে রাজী হতো। কারণ একটাই- রাজপ্রাসাদে উচ্চপদ লাভ করা! তবে খোজা বানানোর রীতিকে মোটামুটি অমানবিক বলা চলে। খোজা বানাতে গিয়ে যখন বালকদের অণ্ডকোষ কিংবা পুরুষাঙ্গ কাটার সময় অথবা পরবর্তীতে জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেরই মৃত্যু ঘটেছে। আর অণ্ডকোষ ও পুরুষাঙ্গ কর্তনের পর ক্ষত সারাতে ব্যবহার করা হতা মরুভূমির বালি। আবার অনেক সময় বালকদের মুরুভূমিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখা হতো যতদিন না ক্ষত ভালো হয়।
তবে খোজাকরনের এই ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো! ব্রোঞ্জ যুগের প্রথম দিকে সুমেরীয় সভ্যতা অর্থাৎ বর্তমান ইরাকের সভ্যতায়ও খোজাকরনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ সভ্যতা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ সালের। তখনকার লাঘাস নামের শহরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ক্যাস্ট্রেশন করানোর তথ্য পাওয়া যায়। তার মানে, ইউনাখরা সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই প্রভাবশালী পুরুষের দাসত্ব করত! প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও ইউনাখ ছিল। তবে প্রাচ্যের মতন এত প্রবলভাবে নয়। প্রাচীন মিশরেও পুরুষের অঙ্গচ্ছেদ করানোর রীতি ছিল। এক্ষেত্রে মিশরীয়রা তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করতো।
(১) পুরুষ জননাঙ্গের অপসারন;
(২) কেবল অন্ডকোষের অপসারন; এবং
(৩) একত্রে পুরুষাঙ্গ ও অন্ডকোষের অপসারণ। প্রাচীন মিশরের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে পুরুষ বন্দিদের অঙ্গচ্ছেদ করে ফারাও-এর কাছে উপস্থাপন করা হত। এ ছাড়া ধর্ষকের শাস্তিও ছিল অঙ্গচ্ছেদ। এছাড়াও প্রাচীন মিশরের রাজকীয় জেনানামহলে ইউনাখরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করত।
যুগের পর যুগ ধরেই খোজারা ক্ষমতাবানদের সেবায় নিজেদের নিযুক্ত রেখেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ বছর পূর্বেও খোজা বা যৌনমিলনে অক্ষম পুরুষদের তথ্য পাওয়া যায় যা চীন থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তারা প্রধানত ধর্মযাজক বা দাস ছিল। কখনো কখনো ক্যাথলিক চার্চ সুরেলা কন্ঠের বালক দিয়ে পোপের কোরাস গাওয়ানানোর জন্য চার্চের বালকদের খোজা বানিয়ে রাখতো।
হাজার হাজার বছর ধরেই খোজারা ক্ষমতাশীল মানুষের হয়ে দাস হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে হারেমের রাজকীয় পাহারাদার ও সুলতান বা সম্রাটের ব্যক্তিগত কাজে খোজাদের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও কর্মচারী, যোদ্ধা, গৃহস্থালির কাজ, সংগীতশিল্পী, সরকারি কাজকর্ম, ব্যক্তিগত রক্ষী ও চাকর হিসেবে খোজাদের ব্যবহার করা হতো।
তবে সব সমাজেই একটা ব্যাপার একইরকম ছিল। সেটি হচ্ছে সব ক্ষেত্রেই খোজারা সাধারণত চাকর বা দাস শ্রেণির ছিল। তাদের দিয়ে ক্ষমতাসীন লোকদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই তাদেরকে খোজা বানানো হতো। সেই প্রাচীন আমল থেকেই রাজকীয় কোর্ট কিংবা প্রাসাদের অন্দরমহল যেখান কেবলমাত্র রাজা ব্যতিত অন্যান্য পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল সেখানে রাজা ও অন্যান্য নারীদের পাহারা নিশ্চিত করার জন্য খোজা প্রহরীর প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিহার্য। শুধু হারেম পাহারা নয়, আসলে খোজাদের অনেক কাজই করতে হতো। যেমন প্রভূর বিছানা তৈরি, গোসল করানো, চুল কাটা, পালকি টানা, মলমূত্রের পাত্রবহন করা ইত্যাদি কাজ করানো হতো। কোনো কোনো বিশ্বস্ত খোজাকে দিয়ে চরের কাজও করানো হতো।
খোজারা কেবল শাসকের নিকটই অনুগত ছিল। সরাসরি শাসক ব্যতিত রাজ্যের অন্য কোনো উঁচু পদের কর্মচারী বা প্রশাসক হলেও খোজাদের নিকট খুব বেশি পাত্তা পেতো না। খোজারা রাজা বা প্রভু অন্তঃপ্রাণ থাকতো। এমনকি কোনো কোনো খোজা কোনো কোনো রাজার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। তারা তাদের বিশ্বস্ততার গুণটিকে খুবই সম্মান এবং মর্যাদার মনে করতো। যেহেতু এদের জৈবিক চাহিদা বলতে কিছুই ছিল না, সেহেতু এদর ব্যক্তিগত বংশ প্রতিষ্ঠা বা সংসার স্থাপনের ব্যাপারে কোনো ইচ্ছা ছিল না। তাদের শারীরিক অক্ষমতার কারণেই সমাজে তাদের অবস্থান ছিল খুব দুর্বল। এই দুর্বলতার কারণে তাদেরকে প্রচুর নির্যাতন সহ্য করতে হতো। কখনো কখনো খুব তুচ্ছ কারণে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হতো এমনকি হত্যাও করা হতো। তারা এতই সহনশীল ছিল যে এরপরও খোজাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতো না।
প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যেও ক্যাস্ট্রেশন করানোর রীতি ছিল।
ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক নানা গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বহুবিবাহ, উপপত্মী (বাঁদি) ও হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণেই মূলত খোজা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। হারেমের নারীদের ওপর নজর রাখার জন্য খোজাকৃত পুরুষ প্রহরী নিয়োগ করা হতো। সাধারণত রণাঙ্গণে বন্দি তরুণ সৈনিকদের খোজা করা হতো। আর দাস ব্যবসায়ীরা দাস বাজার থেকে ক্রয় করা স্বাস্থ্যবান ও তরুণ বালকদের খোজা করে এবং প্রাথমিক ধরনের কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজকীয় ও অভিজাতবর্গের হারেমে বিক্রয় করত। তুর্কি-মুঘল শাসনামলের আগে বাংলায় খোজা প্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমন সন্তোষজনক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে সংস্কৃত সূত্র থেকে প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় যে, বাংলা ও ভারতের প্রাচীন শাসকগণ তাদের হারেম প্রহরার জন্য হিজড়াদের নিয়োগ করতেন, কখনও তারা খোজা-করা কোনো পুরুষকে নিয়োগ করতেন না। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, খোজা প্রথা এদেশে প্রবর্তিত হয় বিদেশিদের দ্বারা। আরো স্পষ্ট করে বললে তুর্কি-মুগলরাই ভারতীয় উপমহাদেশে এবং মধ্যযুগের বাংলায় খোজা প্রথার প্রবর্তন করে। বহুবিবাহ ও উপপত্মী (বাঁদি) ও হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণে মুসলিম বিশ্বে খোজা ব্যবস্থারও উদ্ভব ঘটে।
অটোমান হারেমে খোজারা নানাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
হারেমের প্রসঙ্গ আসলেই সবার আগে চোখে ভাসে অটোমান তুর্কি বাদশাদের হারেম। যেমন ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদ। ১৪৬৫-১৮৫৩ সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল হারেম সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। তুর্কি হারেমে খোজাদের দারুন ভুমিকা ছিল। তাদের হারেমে দু’ধরনের খোজা ছিল। (ক) কৃষ্ণকায়; ও (খ) শ্বেতকায় খোজা। কৃষ্ণকায়রা মূলত আফ্রিকার। কৃষ্ণকায়রা হেরেমের নারী, অন্যান্য কর্মকর্তা ও নিচুশ্রেণির বাঁদিদের দেখাশোনা করত। তোপকাপি প্রাসাদের শ্বেতকায় খোজারা ছিল মূলত ইউরোপীয় বলকান এলাকার। যা এখনকার বুলগেরিয়া-রুমানিয়া। শ্বেতাঙ্গ খোজারা তোপকাপি প্রাসাদের বিদ্যালয়ের দেখভাল করত। তবে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের পর এরা আর হারেমের ভেতরে ঢোকার অনুমতি পায়নি।
তবে তুরস্কের প্রাসাদের খোজারা তুর্কী ছিলেন না। এদেরকে বাইরে থেকে আনা হতো। কারণ ইসলামে কাউকে জোরপূর্বক কিংবা স্বেচ্ছায় খোজা বানানো নিষিদ্ধ। তাই অটোমান সম্রাটরা যখন কোনো খ্রিস্টান দেশ জয় করত তখন তারা সেখান থেকে সাদা ও কালো চামড়ার খোজা নিয়ে আসত। প্রধানত মিশর, আবিসিনিয়া, সুদান প্রভৃতি স্থান থেকে খোজাদের সংগ্রহ করা হতো। অটোমান সাম্রাজ্যের দরবার ও হারেমে ৬০০ থেকে ৮০০ খোজা ছিল বলে জানা যায়। অটোমান দরবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল প্রধান কৃষ্ণকায় খোজার। এদের বলা হত-চিফ ব্ল্যাক ইউনাখ। চিফব্ল্যাক ইউনাখ ছিল হারেমের গুপ্তচর নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে।আর যে কোনও ধরনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। হারেমের সকল নারী, খোজা এবং দরবারের অনেকেই তাকে খুব সমীহ করে চলতেন। হারেমের নারীদের নিরাপত্তার বিধান করাই তার প্রধান কাজ হলেও তিনি রাজকীয় অনুষ্ঠানের তদারকি কিংবা হত্যার জন্য কোন মেয়েকে হত্যাকারীর নিকট নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজ করতেন।
এই ছবিটি ১৯২১ সালের একজন কৃষ্ণাঙ্গ খোজার। অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের প্রধান খোজা ছিলেন তিনি।
মোঘল যুগে রাজকীয় হারেম বা জেনানামহলে খোজারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করত। এদের কারও কারও অবস্থান ছিল অনেক ওপরে। কোনও কোনও খোজা ছিল খেতাবধারী, বৃত্তিভোগী, যোদ্ধা ও মন্ত্রীদের পরামর্শদাতা। ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রথার প্রবর্তন সম্ভবত সুলতানি আমলের গোড়ার দিকে। খোজাদের প্রধানত সুলতানদের প্রাসাদে হারেম প্রহরার জন্য নিযুক্ত করা হলেও চীনা খোজাদের মতো সুলতানি আমলের খোজারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালন করেন। যেমন, সুলতান আলাউদ্দীন খলজীর (১২৯৬-১৩১৬) অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি ও উজির মালিক কাফুর ছিলেন একজন খোজা। দিল্লির খোজাদের মতো বাংলার অভিজাতবর্গের খোজারাও প্রশাসনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। বাংলায় হাবশি শাসনামলে (১৪৮৭-১৪৯৩) বস্তুত শাসকদের ক্ষমতার উত্থান-পতনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শাহজাদা ওরফে বারবক নামে এক খোজা ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদ দখল করেন। পণ্ডিতদের বিশ্বাস, হাবশী সুলতান শামসউদ্দীন মুজাফফর শাহ (১৪৯০-১৪৯৩) খোজা ছিলেন। সমসাময়িক বাংলায় পর্তুগিজ পরিব্রাজক দুয়ার্তে বারবোসার বিবরণ অনুসারে বাংলার শাসক ও অভিজাতবর্গের হারেমগুলিতে দেশীয় ও বিদেশি বংশোদ্ভূত খোজারা প্রহরায় নিয়োজিত থাকত। কথিত আছে, নওয়াব সুজাউদ্দীন খানের (১৭১৭-১৭৩৯) হারেম প্রহরায় নিয়োজিত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে সংগৃহীত খোজারা।
ষোড়শ/সপ্তদশ শতকের মোঘল শাসিত সুবাহ বাংলা হয়ে উঠেছিল সমগ্র মোঘল সাম্রাজ্যের জন্য খোজাদের শীর্ষ যোগানদার। ইউরোপীয় লেখকগণ ও বিশিষ্ট মোঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজল আইন -ই -আকবরী গ্রন্থে এ তথ্য সমর্থন করেছেন। খোজা সরবরাহের একচেটিয়া বাণিজ্য করত সিলেট ও ঘোড়াঘাটের সরকারেরা। ঠিক কখন বাংলা এই ব্যবসায় জড়ায় জানা যায়নি।
তথ্যসূত্র:
আইন ই আকবরী- আবুল ফজল ভলিউম-১, ট্রান্সলেটেড বাই এইচ ব্লচম্যান
দি অটোমান সেঞ্চুরিজ- লর্ড কিনারস
মহাভারতে যৌনতা- শামিম আহমেদ, গাঙচিল প্রকাশনী, কলকাতা
দি হিস্টোরি অব বেঙ্গল- শাহরিয়ার ইকবাল
অটোমান হারেমের নারীরা- আশরাফ উল ময়েজ
হারেম- লাভ টু নো ১৯১১ এনসাইক্লোপেডিয়া
দ্য প্রাইভেট ওয়ার্ল্ড অব অটোমান ওমেন- গুডউইন গডফ্রে
হারেম- জন দেলপ্ল্যাটো
হারেমের কাহিনী- জীবন ও যৌনতা- সাযযাদ কাদির
ইনসাইড দ্য সেরাগেলিও- প্রাইভেট লাইভস অব সুলতানস ইন ইস্তাম্বুল
হারেম- শ্রীপান্থ
বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া ও রিলেটেড ওয়েবসাইটস।
- ট্যাগ:
- প্রবন্ধ
- সাহিত্য
- রণক ইকরাম
- হারেম সিক্রেটস