ছবি সংগৃহীত

হজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আমল-ইবাদত ও কার্যক্রম

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০১৪, ০৫:১২
আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০১৪, ০৫:১২

মীকাত ও এহরাম মীকাত : স্থান অথবা কালের সীমারেখাকে মীকাত বলে। অর্থাৎ এহরাম ব্যতীত যে স্থান অতিক্রম করা যায় না, অথবা যে সময়ের পূর্বে হজের এহরাম বাঁধা যায় না সেটাই হল মীকাত। স্থান বিষয়ক মীকাত (মীকাতে মাকানি) : বেশ দূর থেকে এহরাম বেঁধে রওয়ানা হওয়া আল্লাহর পানে ছুটে যাওয়ার ইচ্ছা-আগ্রহকে আরো মজবুত, আরো পরিপক্ব করে তোলে। নিজের ঈমানি জোশ-জযবাকে শতগুণ বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ককে বহুগুণে দৃঢ় করে দেয় এ ধরনের প্রস্তুতি। এ জন্যই, হয়তো, হজে মীকাতের নিয়ম রাখা হয়েছে। মীকাত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ [সা.] সীমানা বেঁধে দিয়েছেন, মদিনাবাসীদের জন্য যুল হুলায়ফা, শামবাসীদের জন্য জুহফাহ, নাজদবাসীদের জন্য কারনুল মানাযিল, ইয়েমেনবাসীদের জন্য য়ালামলাম, এগুলো তাদের জন্য এবং যারা অন্যত্র থেকে ওই পথে আসে হজ ও উমরা আদায়ের ইচ্ছা নিয়ে তাদের জন্য। আর যারা এ সীমার অভ্যন্তরে বসবাস করবে তাদের স্বস্থানই তাদের এহরামের জায়গা। তদ্রƒপভাবে মক্কাবাসী মক্কা থেকে। অন্য এক হাদিসে ইরাকবাসীদের মীকাত যাতু র্ইক নির্ধারণ করা হয়েছে। মক্কা থেকে মীকাতসমূহের দূরত্ব যুল হুলায়ফা : মক্কা থেকে ৪২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বর্তমানে আবয়ারে আলী বলে জায়গাটি পরিচিত। মদিনাবাসী এবং ওই পথ হয়ে যারা আসেন যুল হুলায়ফা তাদের মীকাত। জুহফাহ : এই জায়গাটি বর্তমানে পরিত্যক্ত হওয়ায় রাবেগ থেকে মানুষেরা এহরাম বাঁধে। মক্কা থেকে রাবেগের দূরত্ব ১৮৬ কিলোমিটার। সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার লোকজন, পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকার লোকজন, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও ফিলিস্তিনবাসীরা এই জায়গা হতে এহরাম বাঁধেন। কারনুল মানাযেল : এই জায়গার অন্য নাম আস্সাইলুল কাবির। মক্কা থেকে এর দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার। ইরাক ইরান ও অন্যান্য উপসাগরীয় অঞ্চলের লোকদের মীকাত হল এই কারনুল মানাযেল। ছালামলাম : মক্কা থেকে এর দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। ইয়েমেনবাসী ও পাক-ভারত-বাংলাসহ প্রাচ্য ও দূর প্রাচ্য হতে আগমনকারীদের জন্য মীকাত হল এই য়ালামলাম। যাতু ইরক : মক্কা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বর্তমানে এই মীকাতটি পরিত্যক্ত। কেননা ওই পথ হয়ে বর্তমানে কোনো রাস্তা নেই। স্থল পথে আসা পূর্বাঞ্চলীয় হাজিরা বর্তমানে সাইল অথবা যুল-হুলায়ফা থেকে এহরাম বাঁধেন। হাদিস অনুযায়ী মীকাতের বাইরে থেকে আসা হাজিদের জন্য মীকাত থেকে এহরাম বাঁধা ওয়াজিব। তবে যারা মীকাতের সীমানার অভ্যন্তরে বসবাস করেন তাদের অবস্থানের জায়গাটাই হল তাদের মীকাত। অর্থাৎ যে যেখানে আছে সেখান থেকেই হজের এহরাম বাঁধবে। তবে মক্কার হারাম এরিয়ার ভেতরে বসবাসকারী ব্যক্তি যদি উমরা করতে চায় তা হলে তাকে হারাম এরিয়ার বাইরেÑ যেমন তানয়ীম তথা আয়শা মসজিদে গিয়ে এহরাম বাঁধতে হবে। মীকাতে মাকানি বিষয়ে কিছু সমস্যার সমাধান : যদি কারও পথে দুটি মীকাত পড়ে তাহলে প্রথম মীকাত থেকেই এহরাম বাঁধা উত্তম। তবে দ্বিতীয় মীকাত থেকেও এহরাম বাঁধা চলে। বাংলাদেশ থেকে মদিনা হয়ে মক্কায় গমনকারী হাজিগণ এই মাসআলার আওতায় পড়েন। অতঃপর তারা জেদ্দা বিমান বন্দরের পূর্বে যে মীকাত আসে সেখান থেকে এহরাম না বেঁধে মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে যে মীকাত পড়ে—যুল হুলায়ফা—সেখান থেকে এহরাম বাঁধেন। যদি কোনো ব্যক্তি এহরাম না বেঁধে মীকাত অতিক্রম করত: ভেতরে চলে আসে তার উচিত হবে মীকাতে ফিরে গিয়ে এহরাম বাঁধা। এমতাবস্থায় তার ওপর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘দম’ দেয়া ওয়াজিব হবে না। মীকাতে ফিরে না গিয়ে যেখানে আছে সেখান থেকে এহরাম বাঁধলে হজ-উমরা হয়ে যাবে বটে তবে ‘দম’ দেয়া ওয়াজিব হবে। স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভাল যে, এহরাম না বেঁধে মীকাত অতিক্রম করে ফেললে ভেতরে ঢুকে মসজিদে আয়শায় গিয়ে হজের এহরাম বাঁধলে চলবে না, কেননা মসজিদে আয়শা হেরেম এলাকার অভ্যন্তরে বসবাসকারীদের উমরার মীকাত। কাল বিষয়ক মীকাত (মীকাতে যামানি) : পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হজ হয় নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসে’। এ নির্দিষ্ট মাসগুলো হল—শাওয়াল, যিলকদ ও জিলহজ মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত। কারও কারও মতে জিলহজ মাসের পুরোটাই হজের মাস। শাওয়াল মাস থেকে যেহেতু হজের মাস শুরু হয় তাই শাওয়াল মাসের পূর্বে হজের এহরাম বাঁধা উচিত হবে না। তা বরং খেলাফে সুন্নত ও মাকরুহে তাহরীমি হবে। এহরাম এহরামের মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হারাম করা। হাজি সাহেবগণ হজ অথবা উমরা অথবা উভয়টা পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করেন তখন তাদের উপর কতিপয় হালাল ও জায়েয বস্তুও হারাম হয়ে যায়। একারণেই এ-প্রক্রিয়াটিকে এহরাম বলা হয়। এহরাম বাধার সময় : হজ অথবা উমরার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করলে এহরাম ব্যতীত নির্দিষ্ট সীমারেখা—মীকাত—পার হওয়া যায় না, এ বিষয়ে আগেই আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার সময় বিমানে থাকা অবস্থাতেই মীকাত এসে যায়। মীকাত নিকটবর্তী হলে বিমানে কর্তব্যরত ব্যক্তিরা হাজি সাহেবদেরকে এ ব্যাপারে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেন। সে সময়ই এহরামের নিয়ত করা উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] মীকাতের পূর্বে এহরামের নিয়ত করেননি। তবে বিমানে আরোহণের পূর্বেই এহরামের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নেবেন। শুধুমাত্র নিয়তটা বাকি রাখবেন। বিমানে আরোহণের পূর্বেও এহরামের নিয়ত করতে পারেন, তবে তা খেলাফে সুন্নত হওয়ায় কেউ কেউ মাকরুহ বলেছেন। আপনি যদি প্রথমে মদিনায় যাওয়ার নিয়ত করে থাকেন তাহলে এসময় এহরামের নিয়ত করার দরকার নেই। কেননা মদিনা থেকে মক্কায় আসার পথে আরেকটি মীকাত পড়বে, সেখান থেকে এহরাম বাঁধলেই চলবে। এহরাম বাধার নিয়ম : বাংলাদেশ থেকে যারা হজ করতে যান তাদের অধিকাংশই তামাত্তু হজ করে থাকেন। তামাত্তু হজের জন্য দু’বার এহরাম বাঁধতে হয়। প্রথমবার শুধু উমরার নিয়ত করে মীকাত থেকে। দ্বিতীয়বার ৮ জিলহজ তারিখে মক্কা শরীফে যে জায়গায় আপনি আছেন সে জায়গা থেকে। উভয় এহরাম সম্পর্কে বিস্তারিত নিয়ম-কানুন নীচে উল্লেখ করা হল। প্রথম এহরাম : উমরার নিয়তে মীকাত থেকে শুরুতে আপনি ক্ষৌরকর্ম অর্থাৎ বগল ও নাভির নীচের চুল পরিষ্কার করুন। নখ কাটুন। মাথার চুল ছোট না করে যেভাবে আছে সেভাবেই রেখে দিন, কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] ও সাহাবায়ে কেরাম এহরামের পূর্বে মাথার চুল কেটেছেন বা মাথা মু-ন করেছেন বলে কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না। ধুলো-বালি লেগে অতিমাত্রায় উসকোখুসকো হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বর্তমান যুগের যন্ত্র-চালিত সফরে এ ধরনের আশঙ্কা নেই বললেই চলে—বিশেষ পদার্থ ব্যবহার করে চুলকে স্থিরকৃত আকারে রাখার জন্য হাদিসে ‘তালবিদ’ করার কথা আছে। তবে এহরামের পূর্বে মাথা মু-ন করে ফেলা বা চুল ছোট করে ফেলার কথা নেই। ক্ষৌরকর্ম সেরে সাবান মাখিয়ে গোসল করুন। গোসল করা সম্ভব না হলে অজু করুন। অজু-গোসল কোনটাই যদি করার সুযোগ না থাকে তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে তায়াম্মুম করতে হবে না। এরপর শরীরে, মাথায় ও দাঁড়িতে উত্তম সুগন্ধি মাখুন। স্বাভাবিক সেলাই করা কাপড় পরে এহরামের কাপড় আলাদা একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে হজ ক্যাম্প অথবা বিমান বন্দরে চলে যান। আপনার ফ্লাইটের সময়সূচি জেনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সেরে গাড়িতে ওঠার আগে এহরামের কাপড় পরে নিন। ফঅজু নামাজের সময় হলে এহরাম পরার পর নামাজ আদায় করুন। আর ফঅজু সালাতের সময় না হলে তাহিয়াতুল অজুর দু’রাকাত সালাত আদায় করুন। সালাতের পর এহরামের নিয়ত না করে বিমানে আরোহণ করুন। যেহেতু নিয়ত করেননি তাই তালবিয়া পাঠ করা থেকেও বিরত থাকুন। জেদ্দা বিমান বন্দরে পৌঁছার পূর্বে যখন মীকাতের ব্যাপারে ঘোষণা হবে তখন মনে মনে উমরার নিয়ত করুন ও মুখে বলুন (লাব্বাইকা উমরাতান্), এরপর পুরা তালবিয়াÑ পড়ে নিন। মাথায় টুপি থাকলে নিয়ত করার পূর্বেই তা সরিয়ে নিন। সালাতের পর এহরাম বাধা মুস্তাহাব। যদি ফঅজু সালাতের পর এহরাম বাধা হয়, তাহলে স্বতন্ত্র নামাজের প্রয়োজন নেই। অন্য সময় এহরাম বাধলে দু রাকাত সালাত আদায় করে নিবে। এ আদায়কৃত নামাজ কি এহরামের নামাজ না তাহিয়্যাতুল অজুর এ ব্যাপারে উলামাদের মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ একে এহরামের নামাজ বলেছেন। তবে বিশুদ্ধতম মত হল, এটি তাহিয়্যাতুল অজু হিসেবে আদায় করা হবে। বিমানের ভেতরে এহরামের নিয়ত করা যদি ঝামেলা মনে করেন তাহলে বিমানে ওঠার পূর্বেই ফঅজু সালাত অথবা দু’রাকাত তাহিয়াতুল অজুর সালাত আদায় করে সালাম ফেরানোর পর মাথায় টুপি থাকলে তা খুলে উপরে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে উমরার নিয়ত করুন ও তালবিয়া পাঠ করুন। এহরামের আলাদা কোনো সালাত নেই। রাসূলুল্লাহ [সা.] ফঅজু সালাতের পর এহরামের নিয়ত করেছিলেন। এহরামে প্রবেশের পর বেশি বেশি তালবিয়া পড়–ন ও জিকির আযকারে ব্যস্ত থাকুন। এহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ সকল জিনিস থেকে বিরত থাকুন যার বিস্তারিত বর্ণনা একটু পরে আসছে। দ্বিতীয় এহরাম : হজের নিয়তে মক্কা থেকে মক্কা শরীফ যাওয়ার পর উমরা আদায়ের পর মাথার চুল খাটো করে অথবা মাথা মু-ন করে এহরাম খুলে ফেলে স্বাভাবিক পোশাক-আশাক পরে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকুন ও যত বেশি সম্ভব বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করুন। ৮ জিলহজ আবার আপনাকে এহরাম বাঁধতে হবে। এবারের এহরাম হবে হজের নিয়তে। এ এহরামের জন্য কোথাও যেতে হবে না। আপনি যে বাসায় বা হোটেলে আছেন সেখান থেকেই এহরাম বাঁধুন। পূর্বের ন্যায় ক্ষৌরকর্ম সেরে নিয়ে গোসল করে নিন। শরীরে, দাড়িতে ও মাথায় আতর মাখুন। এহরামের কাপড় পড়ে নিন। ফঅজু সালাতের সময় হলে ফঅজু সালাত আদায় করুন। অন্যথায় তাহিয়াতুল অজুর দু’রাকাত সালাত আদায় করুন। এরপর মনে মনে হজের নিয়ত করুন, ও মুখে বলুন (লাব্বাইকা হাজ্জান) এরপর পুরা তালবিয়া পড়ে নিন। এহরাম অবস্থায় করণীয় ১. এহরাম বাধার পর গভীর মনোনিবেশের সাথে আল্লাহর আজমত- বড়োত্ব, রহমত-মাগফিরাত ইত্যাদির কথা ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করুন। বেশি বেশি দোয়া-দরুদ পড়ুন। তালবিয়া পড়ুন। তালবিয়া কোনো উঁচু জায়গায় ওঠার সময়, নিচু জায়গায় নামার সময়, বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময়, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসার সময়, কারও কাছে বেড়াতে গেলে সশব্দে তালবিয়া পড়–ন। কুরআন তিলাওয়াত করুন। হজ-উমরা বিষয়ক বই-পুস্তক পড়–ন। কোনো হক্কানি আলেম আলোচনা করতে থাকলে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ২.পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় করুন। বিমানে আরোহণরত অবস্থায় সালাতের সময় হলে একাকীই সালাত আদায় করে নিন। অজু না থাকলে তায়াম্মুম করুন। সালাত কাজা করার অপেক্ষায় থাকবেন না। ৩. ৮ জিলহজ এহরাম বাধার পর যেহেতু মূল হজ শুরু হবে তাই এহরাম খোলা পর্যন্ত নিজেকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করুণ। অন্যান্য হাজিদেরকেও নসিহত করুন, যেন সবাই তাওবা ইস্তিগফারের মধ্যে সময় কাটায়। যারা হজের কার্যক্রম সম্পর্কে অজ্ঞ তাদেরকে আপনি যতটুকু জানেন সেইটুকু বলুন। হজ পালনের জন্য সহিহ-শুদ্ধ কোনো বই সাথে থাকলে তা পড়ে শুনান। এভাবে পুরা সময়টাকে ঈমানি ভাবগাম্ভীর্যের আওতায় কাটান। এহরাম ও তালবিয়া : তালবিয়ার মাধ্যমেই কার্যত হজ ও উমরায় প্রবেশের ঘোষণা দেয়া হয়। সে হিসেবে তালবিয়াকে হজের স্লোগান বলা হয়েছে তালবিয়ার শব্দমালা [লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননেয়মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক] ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই। নিশ্চয়ই প্রশংসা ও নেয়ামত তোমার এবং রাজত্বও, তোমার কোনো শরিক নেই।’ ইবনে ওমর বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ [সা.] এ-শব্দমালায় আর কিছু বাড়াতেন না’ আবু হুরায়রা (রা.) এর বর্ণনা মতে তালবিয়ায় রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন ‘আমি হাজির সত্য ইলাহ আমি হাজির’। এক আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজিরা দেয়া, ও তাঁর লা-শরিক হওয়ার ঘোষণা বার বার উচ্চারিত হয় তালবিয়ার শব্দমালায়। তালবিয়া যেন সকল পৌত্তলিকতা, প্রতিমা-পূজা, অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার সমীপে হীনতা দীনতা প্রকাশের বিরুদ্ধে এক অমোঘ ঘোষণা যা নবী-রাসূল পাঠানোর পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত। যে ঘোষণার সার্থক রূপায়ণ ঘটতে দেখা যায় রাসূলুল্লাহর [সা.] শিরক ও মুশরিকদের সকল কর্মকা- থেকে দায়-মুক্তি ও তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা পড়ে শোনানোর মাধ্যমে। শুধু তালবিয়া নয় বরং অন্যান্য হজকর্মেও তাওহীদ চর্চা প্রচ-ভাবে দৃশ্যমান। তাওয়াফ শেষে যে দু’রাকাত সালাত আদায় করতে হয় সেখানেও তাওহীদ চর্চার বিষয়টি প্রকাশমান। রাসূলুল্লাহ [সা.] এ দু রাকাত সালাত আদায়ের সময় ‘সূরা ইখলাস’ ও ‘সূরা আল-কাফিরুন’ পাঠ করেছেন, এ দুটি সূরাতে তাওহীদের বাণী স্পষ্ট আকারে উচ্চারিত হয়েছে। জাবের (রা) বলেন: “তিনি [সা.] এ-দু’রাকাতে তাওহীদভিত্তিক সূরা ও ‘কুল য়্যা আইয়ুহাল কাফিরুন’ তিলাওয়াত করলেন”। অন্য এক বর্ণনায় তিনি ইখলাসের দুই সূরা ‘‘কুল য়্যা আইয়ুহাল কাফিরুন’ ও ‘কুল হুআল্লাহু আহাদ’, তিলাওয়াত করেন”। সাফা ও মারওয়ায় তাওহীদনির্ভর দোয়া একত্ববাদের সাথে হজের অচ্ছেদ্য সম্পর্ককে নির্দেশ করে। জাবেরের (রা.) এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ [সা.] সাফায় আরোহণ করলেন, কাবা দৃষ্টিগ্রাহ্য হল, তিনি কেবলামুখী হয়ে আল্লাহর একত্বের কথা বললেন, তাঁর বড়োত্বের ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, ও শত্রট্ট দলকে একাই পরাভূত করেছেন।’ মারওয়াতে গিয়েও তিনি অনুরূপ করলেন। আরাফার দোয়া ও রিজিকসমূহেও তাওহীদের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘উত্তম দোয়া আরাফা দিবসের দোয়া, আর আমি ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের সর্বোত্তম কথাটি হলো ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। হজকারীদেও এমন কি ব্যাপকার্থে মুসলমানদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে বিচিত্র ধরনের বেদআত, কুসংস্কার ও শিরকের ধূম্রজালে জড়িয়ে রয়েছে অনেকেই। এই জন্য ওলামা ও আল্লাহর পথে আহ্বায়কদের উচিত তালবিয়ার ভাব ও আদর্শ হাজি সাহেবদেরকে বেশি বেশি বলা। তালবিয়ার ঘোষণা অনুযায়ী সবাইকে জীবন গড়তে উৎসাহিত করা। তালবিয়া পাঠের হুকুম : তালবিয়া হজের স্লোগান। তাই তালবিয়া পাঠের কোনো বিকল্প নেই। তালবিয়া পাঠ ফঅজু না ওয়াজিব না সুন্নত এই নিয়ে ফেকাহবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। হানাফি মাজহাব অনুযায়ী এহরাম বাধার সময় তালবিয়া অথবা অন্য কোনো জিকির একবার পাঠ করা ফরজ এবং একাধিকবার পাঠ করা সুন্নত। উমরার ক্ষেত্রে তালবিয়ার শুরু এহরামের নিয়ত করার সময় থেকে এবং শেষ বায়তুল্লাহর তাওয়াফ শুরু করার সময়ে। আর হজের ক্ষেত্রে এহরামের নিয়ত করার সময় থেকে ১০ জিলহজ বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহ [সা.] থেকে বর্ণিত আরবি শব্দমালা ব্যবহার করে তালবিয়া পড়া সুন্নত। তবে যদি কেউ আল্লাহর আজমত ও বড়োত্ব প্রকাশক আরো কিছু শব্দ এর সাথে যুক্ত করতে চায় তাহলে তা জায়েয হবে। যেমনটি করেছেন ওমর (রা.)। তিনি উল্লেখিত তালবিয়ার শব্দমালা পড়ার পর বলতেন। [লাব্বাইক আল্লাহুম্মাব লাব্বাইক, ওয়াসায়দাইক। ওয়াল খাইরু ফি ইয়াদাইক। ওয়ারগবাযূ ইলাইকা ওয়াল আমালু] ‘আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাজির একমাত্র তোমারই সন্তুষ্টি কল্পে। কল্যাণ তোমার হাতে, আমল ও প্রেরণা তোমারই কাছে সমর্পিত।’ তবে আমাদের উচিত হবে রাসূলুল্লাহ [সা.] ও সাহাবাদের ব্যবহৃত শব্দমালার বাইরে না যাওয়া। যদি কেউ আরবি তালবিয়া আদৌ উচ্চারণ করতে না পারে, তাহলে বাংলা ভাষায় তালবিয়ার অনুবাদ মুখস্থ করে পড়লেও দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। তবে যেহেতু আরবি তালবিয়াটিই হজের শেয়া’র বা স্লোগান তাই হজ পালনেচ্ছু ব্যক্তিমাত্রেরই উচিত হবে মেহনত করে শুদ্ধভাবে আরবি তালবিয়াটি শিখে নেয়া। তালবিয়া মুখে উচ্চারণ করা জরুরি। যদি কেউ মনে মনে তালবিয়া পড়ে, তবে তা যথেষ্ট হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] ও সাহাবাগণ মুখে উচ্চারণ করে উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ [সা.] এর সাথে বের হলাম হজের তালবিয়া চিৎকার করে বলে বলে। আর রাসূলুল্লাহ [সা.] হজ বিষয়ে নির্দেশ করে বলেছেন, আমার কাছ থেকে তোমরা যেন তোমাদের হজকর্মসমূহ জেনে নাও।’ তালবিয়ার ক্ষেত্রে সশব্দে উচ্চারণ করে পড়া ব্যতীত অন্য কোনো পদ্ধতি আমাদের জানা নেই, তাই সশব্দে উচ্চারণ করে তালবিয়া না পড়লে রাসূলুল্লাহ [সা.] এর আদর্শের অনুসরণ হবে না। বর্তমানে দেখা যায় যে হাজি সাহেবদের মধ্যে একজন প্রথমে তালবিয়ার কিছু শব্দ উচ্চারণ করেন, পরে অন্যান্য হাজিগণ তাকে অনুসরণ করে সমস্বরে তালবিয়া পড়েন। এভাবে একবার তালবিয়া শেষ হলে আবার শুরু করেন। এরূপ করা সুন্নতের বিপরীত। তালবিয়া পাঠের সময় সুন্নত তরিকা হল প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা তালবিয়া পাঠ করবে। হাঁ যদি তালবিয়া শেখানোর প্রয়োজনে সাময়িকভাবে তালকিন করা হয়, তবে তার অনুমতি রয়েছে। নারীদের জন্য জোরে তালবিয়া পড়া নিষিদ্ধ। নারীরা এতটুকু শব্দে তালবিয়া পাঠ করবেন যাতে পাশে থাকা সঙ্গিনী কেবল শুনতে পান। কোন বেগানা পুরুষ শুনতে পায় এমন উচ্চারণে নারীদের তালবিয়া পাঠ অবৈধ। তালবিয়া বেশি বেশি পড়া মুস্তাহাব। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, চলন্ত অবস্থায়, অজু ও বে-অজু—সর্বাবস্থায় তালবিয়া পড়া যায়। বিশেষ করে ব্যক্তির অবস্থা পরিবর্তনের সময় তালবিয়া পড়া মুস্তাহাব। যেমন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসার সময়, বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময়, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, ঘরে প্রবেশের সময়, গাড়িতে উঠার সময়, গাড়ি থেকে নামার সময় তালবিয়া পড়া মুস্তাহাব। মসজিদুল হারাম, মিনার মসজিদে খাইফ, আরাফার মসজিদে নামিরায় তালবিয়া পড়া মুস্তাহাব। তবে মসজিদে নিচু স্বরে তালবিয়া পাঠ বাঞ্ছনীয়। এহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ হজ ও উমরার উদ্দেশে এহরামের ফলে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া বিষয়ের তিন অবস্থা। ১. নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। ২. কেবল পুরুষের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। ৩. কেবল নারীর ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিষয় প্রথমত : মু-ন কিংবা অন্য কোন উপায়ে মাথার চুল ফেলে দেয়া। আল্লাহ তা’আলা তার পবিত্র কালামে স্পষ্ট বর্ণনার মাধ্যমে মাথার চুল ফেলে দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কুরআনে এসেছে, অর্থ: যে পর্যন্ত না হাদির পশু তার স্থানে পোঁছায়, তোমরা মাথা মু-ন কর না। [সুরা বাকারাহ, আয়াত : ১৯৬] অসুস্থতা কিংবা মাথায় উকুন জনিত যন্ত্রণার ফলে যে ব্যক্তি মাথার চুল ফেলতে বাধ্য হবে, তার প্রদেয় ফিদয়া সম্পর্কেও আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে, অর্থ: তোমাদের মাঝে যে অসুস্থ হবে, কিংবা যার মাথায় যন্ত্রণা থাকবে, (এবং চুল ফেলতে বাধ্য হবে) সে যেন সিয়াম বা সদকা অথবা পশু জবাই দ্বারা ফিদয়া প্রদান করে। [সুরা বাকারাহ, আয়াত : ১৯৬] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত বিষয়টি বিশদ করেছেন এভাবে, কাব বিন আজরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি রাসূলের নিকট উপস্থিত হলাম, তখন আমার মুখে উকুন ঝরে পড়ছিল। দেখে রাসূল বললেন, তুমি এতটা কষ্ট পাচ্ছ এটা আমার ধারণা ছিল না। তোমার কাছে কোন বকরি আছে ? আমি বললাম, না। অত:পর নাজিল হল, তবে সিয়াম, বা সদকা অথবা কোরবানি দ্বারা ফিদয়া প্রদান করবে। [সূরা বাক্বারা, আয়াত : ১৯৬] তিনি বলেন: তা হচ্ছে তিন দিন রোজা রাখা, কিংবা ছয় জন মিসকিনকে আহার করানো। প্রতি মিসকিনের জন্য অর্ধ সা’ খাবার। [বোখারি, মুসলিম] এ হাদিস ফিদয়া সংক্রান্ত আয়াতকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে পূর্ণভাবে। স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে উল্লেখিত আয়াতের সিয়ামের সংখ্যা হচ্ছে তিন। সদকার পরিমাণ হচ্ছে ছয় জন মিসকিনের জন্য তিন সা’। প্রতি মিসকিনের জন্য অর্ধ সা’ (অর্থাৎ এক কেজি বিশ গ্রাম)। পশু জবাইয়ের ইচ্ছা করলে বকরির চেয়ে বড় যে কোন পশু জবেহ করে দেবে। এ তিনটির যে কোন একটি ফিদয়া হিসেবে প্রদানের সুযোগ রয়েছে। আয়াতটি এ ব্যাপারে উত্তম দলিল। কুরআন ও সহিহ হাদিসের স্পষ্ট প্রামাণ্যতার ফলে এ ব্যাপারে পিছ-পা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। অধিকাংশ শরিয়তবিদ এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। পশু জবাই করে ফিদয়ার ক্ষেত্রে এমন বকরি হওয়া বাঞ্ছনীয়, যা কোরবানির উপযুক্ত। পশুটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যাবতীয় ত্রট্টটি হতে মুক্ত হতে হবে। মস্তক ব্যতীত দেহের অন্য কোন স্থানের লোম মুন্ডন করলে বিজ্ঞ আলেমগণের ইজতিহাদ অনুযায়ী বিষয়টি নানারূপে বিভক্ত হবে। কিছু ক্ষেত্রে ফিদয়া প্রদান করতে হবে, কিছু ক্ষেত্রে দিতে হবে দম। কারণ, মাথা মু-ন করার ফলে যেমন পরিচ্ছন্নতা ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব হয়, তেমনি দেহের লোম ফেললেও এক প্রকার স্বস্তি অনুভূত হয়। তাই উভয়টিকে একই হুকুমের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। [খালেছুল জুমান : ৮৩] দ্বিতীয়ত: নখ উপড়ে ফেলা, কর্তন করা কিংবা ছাঁটা—চুল মু-ন করার হুকুমের ভিত্তিকে—ইত্যাদি এহরাম অবস্থায় নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য হারাম। ইবনে মুনযির বলেন: আলেমগণ এ ব্যাপারে এক মত যে, নখ কাটা মুহরিমের জন্য হারাম। হাত কিংবা পায়ের নখ—উভয়ের ক্ষেত্রেই একই হুকুম। তবে, যদি নখ ফেটে যায় এবং তাতে যন্ত্রণা হয় তবে যন্ত্রণাদায়ক স্থানটিকে ছেঁটে দেয়ায় কোন ক্ষতি নেই। এ কারণে কোন ফিদয়া ওয়াজিব হবে না। [মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরাহ : ৪৪] তৃতীয়ত: এহরাম বাধার পর শরীর, কাপড় কিংবা এ দুটির সাথে সম্পৃক্ত অন্য কিছুতে আতর ব্যবহার করা। ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত হাদিস দ্বারা জানা যায় মুহরিমের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, জাফরান কিংবা ওয়ারাস (এক জাতীয় সুগন্ধি) মিশ্রিত কাপড় পরিধান করবে না। [ফতহুল বারি : ৪/১৮১ অপর এক হাদিসে তিনি আরাফায় অবস্থান কালে বাহনে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণকারী এক সাহাবি সম্পর্কে এরশাদ করেন, তোমরা তার কাছে আতর নিয়ো না। [মুসলিম : ৪/৩৮৮] অপর রেওয়ায়েতে এসেছে, আতর স্পর্শ করো না। [মুসলিম : ৪/৩৮৭] কারণ, কেয়ামত দিবসে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় তার পুনরুত্থান ঘটবে। [প্রাগুক্ত : ৪/৩৮৮] মুহরিমের জন্য বৈধ নয় সুগন্ধি গ্রহণ, পানীয়ের সাথে জাফরান মিশ্রিত করা যা পানীয়ের স্বাদে ও গন্ধে প্রভাব সৃষ্টি করে, অথবা চায়ের সাথে এতটা গোলাপ জল মিশ্রণ করা, যা তার স্বাদে ও গন্ধে পরিবর্তন ঘটায়। মুহরিম ব্যক্তি সুগন্ধি মিশ্রিত সাবান ব্যবহার করবে না। [মানসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরা : ৪৭] এহরামের পূর্বে ব্যবহৃত সুগন্ধিতে কোন সমস্যা নেই। চতুর্থত: জমহুর ওলামার মতানুসারে বিবাহ এহরাম অবস্থায় অবৈধ। কারণ, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন : মুহরিম বিবাহ করবে না, বিবাহ দেবে না এবং প্রস্তাবও পাঠাবে না। [মুসলিম : ৫/২০৯] সুতরাং, কোন মুহরিমের পক্ষে বৈধ নয় বিয়ে করা, কিংবা অলি ও উকিল হয়ে কারো বিয়ের ব্যবস্থা করা অথবা এহরাম হতে মুক্ত হওয়া অবধি কাউকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো। এমনিভাবে নারী মুহরিমের জন্যও একই হুকুম। সে কোন পুরুষকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারবে না। পঞ্চমত : এহরাম অবস্থায় মুহরিমের জন্য সহবাস অবৈধ। শরিয়তবিদদের মাঝে এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, এহরাম অবস্থায় অবৈধ বিষয়গুলোর মাঝে কেবল সহবাস হজকে নষ্ট করে দেয়। কুরআনে বর্ণিত আয়াত, যে এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।) [সূরা বাক্বারা, আয়াত : ১৯৭] আয়াতে উল্লেখিত আররাফাস শব্দটি একই সাথে সহবাস ও সহবাস জাতীয় যাবতীয় বিষয়কেই সন্নিবেশ করে। এহরামের অবৈধ বিষয়গুলোর মাঝে সহবাসই সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর অনিষ্টকারী। এর কয়েকটি অবস্থা রয়েছে: প্রথম অবস্থা : ওকুফে আরাফার পূর্বে মুহরিম ব্যক্তির স্ত্রী-সম্ভোগে লিপ্ত হওয়া। আলেমদের কারো মাঝেই এ ব্যাপারে বিরোধ নেই যে, এর মাধ্যমে তার হজ নষ্ট হয়ে যাবে। তবে তার কর্তব্য হচ্ছে, আরম্ভ করা হজটি সমাপ্ত করা, এবং পরবর্তীতে তা কাজা করা। তাকে হাদী (পশু কোরবানি) দিতে হবে। পশুটি কেমন হবে এ ব্যাপারে জমহুরের মত হচ্ছে তার কর্তব্য একটি উট জবেহ করা। খালেছুল জুমান : ১১৪] দ্বিতীয় অবস্থা: ওকুফে আরাফার পরে, জামরায়ে আকাবা ও তাওয়াফে এফাদার পূর্বে যদি সহবাস সংঘটিত হয়, তবে ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও আহমদসহ জমহুর ফুকাহাদের মতে তার হজ ফাসেদ হিসেবে গণ্য হবে। এ অবস্থায় তার উপর দুটি হুকুম আরোপিত হবে। এক: তার উপর ফিদয়া ওয়াজিব হবে। সে ফিদয়া আদায় করতে হবে একটি উট বা গাভি দ্বারা, যা কোরবানি করার উপযুক্ত। এবং সব গোশত মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে, নিজে কিছুই গ্রহণ করবে না। দ্বিতীয়: সহবাসের ফলে হজটি নষ্ট হয়েছে বলে গণ্য হবে। তবে নষ্ট হজটিই পূরণ করা তার কর্তব্য এবং বিলম্ব না করে পরবর্তী বছরেই নষ্ট হজটির কাজা আদায় করতে হবে। ইমাম মালেক তার রচিত মুআত্তায় বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি যে, উমর, আলী এবং আবু হুরায়রা রা.-কে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে মুহরিম থাকা অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়েছে। তারা ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বললেন যে, তারা আপন গতিতে হজ শেষ করবে। এবং পরবর্তী বছরে হজ আদায় করবে এবং কোরবানি প্রদান করবে। [মুআত্তা মালেক : ১৩০৭/১] তিনি বলেন, আলী রা. বলেছেন: পরবর্তী বছর যখন তারা হজের এহরাম বাঁধবে, তখন হজ শেষ করা অবধি একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে। [প্রাগুক্ত] তৃতীয় অবস্থা: যদি জামরায়ে আকাবা আদায়ের পর এবং তাওয়াফে এফাদার পূর্বে সহবাস সংঘটিত হয়, তবে সকলের মতানুসারেই তার হজটি শুদ্ধ। মোটকথা, সর্বসম্মত মত হল ওকুফে আরাফার পূর্বে সহবাস হজকে বিনষ্ট করে দেয়। জামরায়ে আকাবার পর এবং তাওয়াফে এফাদার পূর্বে যদি সহবাস সংঘটিত হয়, তবে এ ক্ষেত্রেও সকলের ঐক্যমত হল হজ নষ্ট হবে না। যদি ওকুফে আরাফার পর এবং জামরার পূর্বে সহবাস হয়, জমহুর আইম্মার মতে হজ নষ্ট হয়ে যাবে। এহরাম বিরোধী অন্যান্য বিষয়গুলো হজকে সমূলে নষ্ট করবে না। [খালেছু জুমান : ১১৪] ষষ্ঠত : এহরাম অবস্থায় শিকার অবৈধ। হজ কিংবা উমরা—যে কোন অবস্থাতেই মুহরিমের জন্য স্থলজ প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ—এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত। তবে ঐকমত্য সংঘটিত হয়েছে এমন সব প্রাণীর ক্ষেত্রে যার গোশত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, এবং যা বন্য প্রাণী-ভুক্ত। উক্ত ‘শিকার’-এর সংজ্ঞা হল এমন সব প্রাণী যা স্থলজ, হালাল, এবং প্রাকৃতিকভাবেই বন্য, যেমন হরিণ, হরিণ-শাবক, খরগোশ, কবুতর ইত্যাদি। কারণ, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, অর্থ: যতক্ষণ তোমরা এহরামে থাকবে, ততক্ষণ তোমাদের জন্য স্থলের শিকার হারাম। [সূরা মায়েদা, আয়াত : ৯৬] অপর স্থানে এসেছে, অর্থ: হে মুমিনগণ! এহরামে থাকাবস্থায় তোমরা শিকার-জন্তু হত্যা করো না। [সুরা মায়েদা, আয়াত : ৯৫] সুতরাং, শিকার-জন্তু এহরাম অবস্থায় হত্যা করা বৈধ নয়। একই রূপে উল্লিখিত ধরনের জন্তু হত্যার ক্ষেত্রে কারণ হওয়াও নিষিদ্ধ, যেমন দেখিয়ে দেয়া, ইশারা করা, বা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার মাধ্যমে হত্যায় সহযোগিতা করা। আবু কাতাদা হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে—তিনি কতিপয় সাহাবির সাথে ছিলেন, যারা ছিলেন মুহরিম, পক্ষান্তরে তিনি ছিলেন হালাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তাদের সম্মুখে। আবু কাতাদা জুতো সেলাইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারা তাকে অবহিত করেননি। তারা চাচ্ছিলেন যেন তিনি তা দেখতে পান। তিনি তা দেখতে পেলেন এবং ঘোড়ার লাগাম ধরলেন। অত:পর ঘোড়ায় চড়লেন কিন্তু ভুলে তীর-ধনুক রেখে গেলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাকে তীর ধনুক দাও। তারা উত্তর করল: আমরা, আল্লাহর কসম! তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। এতে তিনি রাগান্বিত হয়ে নেমে এলেন এবং তীর-ধনুক নিয়ে ঘোড়ায় চড়লেন ও গাধার উপর আক্রমণ করলেন। অত:পর জংলি গাধাটিকে জবেহ করে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে সেটি মরে গিয়েছিল। সকলে আহার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল...। [মুসলিম : ৪/৩৬৩] শিকার করা জন্তু দ্বারা আহার গ্রহণের তিন হুকুম। প্রথমত: এমন জন্তু যা মুহরিম ব্যক্তি হত্যা করেছে কিংবা হত্যায় শরিক হয়েছে। এমন জন্তু খাওয়া মুহরিম ও অন্য সকলের জন্য হারাম। দ্বিতীয়ত: মুহরিমের সাহায্য নিয়ে কোনো হালাল ব্যক্তি যে জন্তুকে হত্যা করেছে, যেমন মুহরিম ব্যক্তি শিকার দেখিয়ে দিয়েছে, অথবা শিকারের অস্ত্র এগিয়ে দিয়েছে—এমন জন্তু কেবল মুহরিমের জন্য হারাম—অন্য সকলের জন্য হালাল। তৃতীয়ত: হালাল ব্যক্তি যে জন্তু মুহরিমের জন্য হত্যা করেছে। এমন জন্তুও মুহরিমের জন্য হারাম। অন্য সকলের জন্য হালাল। কারণ, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, অর্থ: স্থলের শিকার তোমাদের জন্য হালাল যতক্ষণ না তোমরা নিজেরা তা শিকার কর, কিংবা তোমাদের উদ্দেশে শিকার করা হয়। [আবু দাউদ : ১৮৫১, তিরমিজি : ৫/১৮৭] আবু কাতাদা হতে বর্ণিত, তিনি একটি জংলি গাধা শিকার করলেন। আবু কাতাদা মুহরিম ছিলেন না। তার সঙ্গীরা সকলেই মুহরিম ছিলেন। সকলে তা হতে আহার গ্রহণ করেছিল। পরে তাদের আহারের ব্যাপারে মতানৈক্য হল। এ ব্যাপারে তারা রাসূলকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন: কেউ কি ইঙ্গিত করেছে বা কোন কিছুর নির্দেশ দিয়েছে? তারা উত্তর করল: না। তিনি বললেন: তবে তোমরা খাও। [বোখারি : ১৭২৫, মুসলিম : ১১৯৬] মুহরিম ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে শিকার হত্যা করে, তবে এর জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছে, অর্থ: তোমাদের মাঝে কেউ তা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে, তার বিনিময় হচ্ছে অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু, যার ফয়সালা করবে তোমাদের মাঝে দুজন ন্যায়বান লোক, কাবায় প্রেরণ করা হাদী (কোরবানি) রূপে। কিংবা তার কাফফারা হচ্ছে দরিদ্রকে খাদ্য দান করা অথবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা। [সূরা মায়েদা, আয়াত : ৯৫] সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি কবুতর হত্যা করে তবে তার বিনিময় হচ্ছে একটি বকরি জবেহ করা, কবুতরের ফিদয়া স্বরূপ যা দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেবে। কিংবা বকরির মূল্য নির্ধারণ করে সমপরিমাণ খাদ্য মিসকিনদের দিয়ে দেবে। (যতজন মিসকিনকে সম্ভব) প্রতি মিসকিনকে অর্ধ সা’ আহার প্রদান করবে। অথবা প্রতি মিসকিনের খাদ্যের পরিবর্তে একদিন রোজা রাখবে। এ তিন পদ্ধতির যে কোন একটি অবলম্বন ইচ্ছাধিকার থাকবে। [মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরা : ৫১] পক্ষান্তরে ক্ষতিকর পোকা-মাকড় কিংবা হিংস্র প্রাণীকে শিকার-জন্তু হিসেবে গণ্য করা হবে না। সুতরাং হারাম এলাকা কিংবা অন্য যে কোন স্থানে মুহরিম বা হালাল, সকলের জন্য তা হত্যা করা বৈধ। প্রমাণ: আবু সাইদ খুদরি হতে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহরিমের জন্য হত্যা-বৈধ প্রাণীর উল্লেখ করে বলেন: সাপ, বিচ্ছু, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ—আর কাককে ঢিল ছুঁড়ে তাড়িয়ে দেবে, হত্যা করবে না—লোলুপ কুকুর, মাংসাশী পাখি, হিংস্র পশু। [তিরমিজি : ৮৩৮] আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: হারাম, কিংবা হালাল উভয় এলাকায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচ প্রকার প্রাণী হত্যার বৈধতা প্রদান করেছেন, কাক, মাংসাশী পাখি, বিচ্ছু, ইঁদুর এবং লোলুপ কুকুর। ভিন্ন রেওয়ায়েতে আছে ‘সাদা কাক’। [খালেছুল জুমান, ফতহুল বারি : খন্ড : ৬, পৃষ্ঠা : ৫১১, শরহে মুসলিম : খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৭২] ইবনে মাসঊদের হাদিসও এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ্য, তিনি বর্ণনা করেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনায় এক মুহরিমকে সাপ হত্যার অনুমতি প্রদান করেছেন। [শরহে মুসলিম : খন্ড ৭, পৃষ্ঠা : ৪৯১] এহরামের কারণে বৃক্ষ কর্তন মুহরিমের জন্য নিষিদ্ধ নয়। কারণ, এতে এহরামে কোন প্রকার প্রভাব সৃষ্টি হয় না। তবে তা যদি হারামের নির্দিষ্ট সীমার ভিতরে হয়, তবে মুহরিম হোক কিংবা হালাল—সকলের জন্য হারাম। এই মৌলনীতির ভিত্তিতে আরাফায় মুহরিম কিংবা হালাল, উভয়ের জন্য বৃক্ষ কর্তন বৈধ; মুযদালেফা ও মিনায় অবৈধ। কারণ, আরাফা হারামের বাইরে, মুযদালেফা ও মিনা হারামের সীমা-ভুক্ত। বিশেষভাবে পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ আরো দুটি বিষয় রয়েছে, তা নিন্মরূপ: ১. মাথা আবৃত করা। কারণ, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফায় বাহনে পিষ্ট মুহরিম ব্যক্তির ক্ষেত্রে এরশাদ করেন : তাকে পানি ও বড়ই পাতা দ্বারা গোসল দাও এবং তার দুই কাপড় দ্বারা কাফন পরাও এবং তার মস্তক আবৃত করো না। [শরহে মুসলিম : খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৮৭] ভিন্ন রেওয়ায়েতে আছে, তার মস্তক ও মুখম-ল আবৃত করো না। [মুসলিম : ৪/৫৪৩] সুতরাং, পুরুষ মুহরিমের জন্য পাগড়ি, টুপি ও রুমাল জাতীয় কাপড় দিয়ে মস্তক আবৃত করা বৈধ নয়, যা তার দেহের সাথে লেগে থাকে। এবং মুসলিমের বর্ণনা মোতাবেকে মুখও আবৃত করা বৈধ নয়। আর যা মস্তকের সাথে লেগে থাকে না; যেমন ছাতা, গাড়ির হুড, তাঁবু ইত্যাদি ব্যবহারে কোন অসুবিধা নেই। প্রমাণ: উম্মে হাসিন হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রাসূলের সাথে হজ পালন করলাম- যখন তিনি আকাবার কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন। অত:পর তিনি বাহনে চড়ে প্রত্যাবর্তন করলেন, তার সাথে ছিলেন বেলাল ও উসামা। তাদের একজন বাহন চালাচ্ছিলেন, অপঅজুন রাসূলের মস্তকের উপরে কাপড় উঁচিয়ে রেখেছিলেন, যা তাকে সূর্য থেকে ছায়া দিচ্ছিল। [মুসলিম : ২২৮৭] অন্য রেওয়ায়েতে আছে, তাকে তাপ হতে ঢেকে রাখছিল, যতক্ষণ না তিনি আকাবার কঙ্কর নিক্ষেপ সমাপ্ত করলেন। মাথায় আসবাব-পত্র বহন করা অবৈধ নয়, যদিও তা মাথার কিছু অংশ ঢেকে ফেলে। কারণ, সাধারণত এর মাধ্যমে কেউ মাথা আবৃত করার উদ্দেশ্য করে না। পানিতে ডুব দেয়াতে কোন অসুবিধা নেই, যদিও তা মাথাকে সম্পূর্ণ আবৃত করে নেয়। ২. স্বাভাবিক অবস্থায় যে পোশাক পরিধান করা হয়, তা পরিধান পুরুষের জন্য বৈধ নয়। হোক তা জোব্বার মত পুরো শরীর ঢেকে নেয়ার মত পোশাক কিংবা পাজামার মত অর্ধাঙ্গ ঢাকে এমন পোশাক। প্রমাণ: উমর রা. বর্ণিত হাদিস—রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুহরিমের পরিধেয় পোশাক সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন : সে জামা, পাগড়ি, ঝুল কোট, পাজামা, মোজা এবং এমন কাপড় পরিধান করতে পারবে না, যাতে জাফরান ও ওয়ারাস (এক প্রকার সুগন্ধি) ব্যবহার করা হয়েছে। [মুসলিম : ৪/৩৩১] তবে, যদি ইজার ক্রয় করার মত টাকা না থাকে, তবে পাজামাই পরিধান করে নিবে। এবং জুতো কেনার মত সংগতি না থাকলে মোজা পরে নিবে, সাথে অন্য কিছু পরিধান করবে না। প্রমাণ: ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত হাদিস, তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরাফার ময়দানে খুতবা প্রদান করতে শুনেছি, তিনি বলছেন : যে ইজার পাবে না, সে যেন পাজামা পরে নেয়। যে জুতো পাবে না, সে যেন মোজা পরে নেয়। [মুসলিম : ৪/৩৩১] পরিধান ব্যতীত জামা শরীরের সাথে কেবল পেঁচিয়ে রাখাতে কোন দোষ নেই। স্বাভাবিক অবস্থায় ঝুল জামা যেভাবে পরিধান করা হয়, সেভাবে পরিধান না করে চাদর হিসেবে ব্যবহারে কোন দোষ নেই। জোড়া-তালি যুক্ত চাদর বা লুঙ্গি পরিধানে কোন বাধা নেই। ইজারের উপর রশি বাধা নিষিদ্ধ নয়। আংটি, হাত-ঘড়ি, চশমা, শ্রবণযন্ত্র ব্যবহার বৈধ। গলায় পানির মশক এবং দান-পাত্র ঝুলাতে পারবে। যদি চাদর খুলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে তা বেধে রাখতে পারবে, কারণ, এ সমস্ত বিষয়ে রাসূলের পক্ষ হতে কোন স্পষ্ট কিংবা ইঙ্গিতসূচক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। কেবল যখন রাসূলকে মুহরিমের পরিধেয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তখন তিনি এরশাদ করেছিলেন: সে জামা, পাগড়ি, ঝুল কোট, পাজামা, এবং মোজা পরিধান করবে না। পরিধেয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার পর যখন রাসূল পরিধানের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিষয় সম্পর্কে জানালেন, তখন প্রমাণিত হয় যে, উল্লেখিত পরিধেয় ছাড়া অন্য যাবতীয় পোশাক মুহরিম ব্যক্তি পরিধান করতে পারবে। জুতো না থাকলে পায়ের সুরক্ষার জন্য তিনি মুহরিম ব্যক্তির জন্য মোজা ব্যবহার বৈধতা প্রদান করেছেন। সুতরাং, এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি, চোখের সুরক্ষার জন্য চশমা ব্যবহারও বৈধ। শেষোক্ত নিষিদ্ধ বিষয় দুটো কেবল পুরুষের ক্ষেত্রেই বিশিষ্ট। নারীর জন্য তার মস্তক আবৃত করে রাখতে পারবে, এবং এহরাম অবস্থায় যে কোন ধরনের পোশাকই পরতে পারবে। তবে, অত্যধিক সাজ-সজ্জা করবে না, হাত মোজা ব্যবহার করবে না। মুখম-ল ঢেকে রাখবে না, তবে পুরুষের সামনে মুখ ঢেকে রাখবে। কারণ, মাহরাম ব্যতীত পর-পুরুষের সামনে মুখম-ল উন্মুক্ত করা নারীদের জন্য বৈধ নয়। এহরামে পরিধান করা বৈধ, এমন যে কোন পোশাক নারী-পুরুষ উভয় মুহরিমই পরিবর্তন করে পরিধান করতে পারবে। মুহরিম ব্যক্তি যদি উল্লেখিত সহবাস, শিকার হত্যা বা এ জাতীয় যে কোন একটি এহরাম বিরোধী কাজ করে, তবে এ ক্ষেত্রে তিন অবস্থা হবে: প্রথমত: হয়তো সে তা ভুলে, না জেনে, বাধ্য হয়ে কিংবা নিদ্রিত অবস্থায় করবে। এ ক্ষেত্রে তার উপর কোন কিছুই ওয়াজিব হবে না। তার কোন পাপ হবে না, ফিদয়া ওয়াজিব হবে না, কিংবা তার হজও নষ্ট হবে না। কারণ, কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে রব! আমরা যদি বিস্মৃত হই, কিংবা ভুল করি, তবে আমাদের পাকড়াও করবেন না। [সূরা বাক্বারা, আয়াত : ২৮৬] অপর স্থানে এসেছে, তোমরা ভুল করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই, কিন্তু তোমাদের অন্তরে ইচ্ছা থাকলে অপরাধ হবে। [সূরা আহযাব, আয়াত : ৫] ভিন্ন এক আয়াতে এসেছে, যে ঈমান আনার পর কুফুরে নিমজ্জিত হল, এবং কুফুরির জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখল, তার উপর আল্লাহর গজব আপতিত হবে এবং তার জন্য আছে মহা-শাস্তি। তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফুরিতে বাধ্য করা হয়, কিন্তু তার হৃদয় ঈমানে অবিচলিত। [সূরা নহল, আয়াত : ১০৬] বাধ্য করার পর যদি কুফুরির হুকুমই রহিত হয়ে যায়, তবে কুফুরি ব্যতীত অন্যান্য পাপের ক্ষেত্রে কী হুকুম হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এ আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বাধ্য হয়ে কিংবা অজণরের কারণে যদি এহরামের নিষিদ্ধ বিষয় সংঘটিত হয়ে যায়, তবে হুকুমের আওতাভুক্ত হবে না। বরং, তা ক্ষমা করে দেয়া হবে। শিকার হত্যা সংক্রান্ত নিষিদ্ধ বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, তোমাদের মাঝে কেউ তা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে, তার বিনিময় হচ্ছে অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু। [সূরা মায়েদা, আয়াত : ৯৫] এ আয়াতে বিনিময় ওয়াজিব হওয়ার জন্য আল্লাহ পাক ইচ্ছাকৃতভাবে করাকে শর্ত করেছেন। শাস্তি ও জামানত আরোপ করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করা শর্ত। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে না করে, তবে তাকে বিনিময়ও দিতে হবে না, এবং সে পাপীও হবে না। তবে যখন অজণর দূরীভূত হবে, এবং অজ্ঞাত ব্যক্তি জ্ঞাত হবে, বিস্মৃত ব্যক্তি স্মরণ করতে সক্ষম হবে, নিদ্রিত ব্যক্তি জাগ্রত হবে, তৎক্ষণাৎ তাকে নিষিদ্ধ বিষয় হতে নিজেকে মুক্ত করে নিতে হবে। অজণর দূর হওয়ার পরও যদি সে তাতে যুক্ত থাকে, তবে সে পাপী হবে, সন্দেহ নেই। এবং যথারীতি তাকে ফিদয়া প্রদান করতে হবে। উদাহরণত: ঘুমন্ত অবস্থায় মুহরিম যদি মাথা ঢেকে নেয়, তাহলে যতক্ষণ নিদ্রিত থাকবে, ততক্ষণ তার উপর কিছুই ওয়াজিব হবে না। জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে তার কর্তব্য হল মস্তক আবৃত করা। জেনে বুঝেও যদি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর মস্তক আবৃত রেখে দেয়, তবে এ জন্য তাকে ফিদয়া প্রদান করতে হবে। দ্বিতীয়ত: নিষিদ্ধ বিষয় ইচ্ছাকৃতভাবে, কিন্তু অজণর সাপেক্ষে ঘটানো। এ ক্ষেত্রে তাকে ওয়াজিব প্রদেয় আদায় করতে হবে, এবং সে পাপী হবে না। প্রমাণ: আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, যে পর্যন্ত না কোরবানির পশু তার স্থানে উপনীত হয়, তোমরা মস্তক মু-ন কর না। তবে তোমাদের মাঝে যে অসুস্থ হবে, কিংবা যার মস্তকে যন্ত্রণা থাকবে, (এবং চুল ফেলতে বাধ্য হবে) সে যেন সিয়াম বা সদকা অথবা কোরবানি দ্বারা ফিদয়া দেবে। [সূরা বাক্বারা, আয়াত : ১৯৬] তৃতীয়ত: নিষিদ্ধ বিষয় ইচ্ছাকৃতভাবে, বৈধ কোন অজণর ব্যতীত সংঘটিত করা। এ ক্ষেত্রে তাকে প্রদেয় প্রদান করতে হবে, এবং পাপীও হবে। ফিদয়া হিসেবে নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রকারভেদ ফিদয়া হিসেবে নিষিদ্ধ বিষয় চার ভাগে বিভক্ত: যথা ১. যাতে কোন ফিদয়া নেই, তা হচ্ছে বিবাহের আকদ সংঘটিত হওয়া। ২. যার ফিদয়া একটি উট। তা হচ্ছে প্রথম হালালের পূর্বে হজ চলাকালীন সহবাস করা। ৩. যার ফিদয়া হচ্ছে বিনিময় বা সমতুল্য অন্য কিছু। যেমন শিকার হত্যা। ৪. যার ফিদয়া সিয়াম, সদকা, কিংবা কোরবানি। যেমন মস্তক মুন্ডন। আলেমগণ প্রথম তিন প্রকারে উল্লেখিত নিষিদ্ধ বিষয় ছাড়া অন্য যাবতীয় নিষিদ্ধ বিষয়কে চতুর্থটির সাথে সংযুক্ত করে দেন। দৃষ্টি আকর্ষণ ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, ভুলবশত অথবা জবরদস্তিমূলক পরিস্থিতি, সকল অবস্থায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে যে একটা কথা আছে তা কেবলই কেয়াস ও ধারণানির্ভর। যেমন বলা হয়েছে, ভুলবশত যদি কেউ কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে তবে তাকে দিয়াত আদায় করে ভুলের মাশুল দিতে হবে। যা প্রমাণ করে যে ভুল করে কোনো কাজ করে ফেললেও তাতে কাফফারা দিতে হবে। তবে কথা হল যে মানুষ হত্যা করা হক্কুল ইবাদ, মুয়ামালাতের ব্যাপার। আর মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে ভুল হলেও ভুলের মাশুল দিতে হয়। ইবাদতের ক্ষেত্রে ভুলে গেলে ক্ষতিপূরণ না দেয়ার উদাহরণ হল ভুলবশত খেয়ে ফেললে রোজা ভঙ্গ না হওয়া। পবিত্র মক্কায় প্রবেশের বিবরণ মক্কায় প্রবেশের পূর্বে রাসূলুল্লাহ [সা.] যি-তাওয়া স্থানে-বর্তমানে জেরওয়াল এলাকার প্রসূতি হাসপাতালের জায়গাÑ গোসল করতেন। সে হিসেবে মক্কায় প্রবেশের উদ্দেশ্যে গোসল করা মুস্তাহাব। [ইমাম নববী : কিতাবুল ইযাহ ফি মানাসিকিল হজ্জে ওয়াল ওয়াল উমরা, পৃ : ১৯৪] মক্কায় হাজিদের বাসস্থানে গিয়ে গোসল করে নিলেও, কারও কারও মতে, এ মুস্তাহাব আদায় হয়ে যাবে। কেননা মোটরযানে সফরের সময় গাড়ি থামিয়ে গোসল সেরে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। পবিত্র মক্কায় প্রবেশের সময় আল্লাহর আজমত ও বড়োত্বের কথা স্মরণ করুন। মনকে নরম করুন। আল্লাহর কাছে পবিত্র মক্কা যে কত সম্মানিত-মর্যাদাপূর্ণ তা স্মরণ করুন। পবিত্র মক্কায় থাকা অবস্থায় পবিত্র মক্কার যথাযথ মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করুন। বর্তমান-যুগে মোটরযানে করে আপনাকে মক্কায় নেয়া হবে। আপনার বাসস্থানে যাওয়ার সুবিধা-মত পথে হজযাত্রীদেরকে নেয়া হয়। তাই রাসূলুল্লাহ [সা.] যেদিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেছেনÑকাদা পথ দিয়ে জান্নাতুল মুয়াল্লার এদিক থেকে -আপনার জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। এ জন্য কোনো অসুবিধা হবে না। আপনার গাড়ি সুবিধা-মত যে পথ দিয়ে যাবে সেখান দিয়েই যাবেন। আপনার বাসস্থানে মালপত্র রেখে উমরার জন্য প্রস্তুতি নেবেন। [-বোখারি : ৪৪৮] উমরা আদায়ের পদ্ধতি তালবিয়া পড়ে-পড়ে পবিত্র কাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হোন। পবিত্র কাবার চার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদুল হারামের উঁচু বিল্ডিং। এ বিল্ডিংটির যে কোনো দঅজুা দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করুন। প্রথমে ডান পা এগিয়ে দিন। আল্লাহ যেন আপনার জন্য তাঁর রহমতের সকল দঅজুা খুলে দেন সে আকুতি নিয়ে মসজিদে প্রবেশের দোয়াটি পড়–ন। সম্ভব হলে নীচের দোয়াটি পড়–ন। উচ্চারণ: বিসমিল্লাহ ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাগফির লি যুনুবি ওয়াফতাহ লি আবওয়াবা রাহমাতিক্। অর্থ: আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ [সা.] এর ওপর। হে আল্লাহ আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের সকল দরজা উন্মুক্ত করে দিন। এরপর আপনার কাজ হবে তাওয়াফ শুরু করা। বায়তুল্লাহ শরীফ দেখামাত্র দু’হাত উঠানোর ব্যাপারে যে একটি কথা আছে তা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। [শাওকানী: নাইলুল আওতার, পৃ: ৯৬০] তবে বায়তুল্লাহ শরীফ দৃষ্টির আওতায় এলে দোয়া করার অনুমতি রয়েছে। ওমর [রা.] যখন বায়তুল্লাহর দিকে তাকাতেন তখন নীচের দোয়াটি পড়তেন, আল্লাহুম্মা আনতাসসালাম, ওয়ামিনকাসসালাম, ফা হাইয়ানান রব্বানা বিসসালাম। যথার্থভাবে তাওয়াফ সম্পন্ন করার জন্য নিুবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখুন, ১.ছোট-বড় সকল প্রকার নাপাকি থেকে পবিত্র হয়ে তাওয়াফ করা। ২.তাওয়াফের শুরুতে মনে মনে নিয়ত করা। এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেই চলবে। বিভিন্ন পুস্তকে তাওয়াফের যে নিয়ত লেখা আছে তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। ৩.সতর ঢাকা অবস্থায় তাওয়াফ করা। ৪.হাজরে আসওয়াদ ইস্তিলাম (চুম্বন-স্পর্শ) অথবা ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করা এবং হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে তাওয়াফ শেষ করা। ৫.হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতে না পারলে হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র ডান হাত উঠিয়ে ইশারা করা ও বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা। ৬.হাতিমের বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করা। ৭.হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে য়ামানি ব্যতীত কাবার অন্য কোনো অংশ তাওয়াফের সময় স্পর্শ না করা। হাঁ, তাওয়াফ শেষ হলে বা অন্য কোনো সময় মুলতাযামের জায়গায় হাত-বাহু-গ-দেশ ও বক্ষ রাখা যেতে পারে। ৮.মাকামে ইব্রাহীম স্পর্শ না করা। ৯.পুরুষদের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব পবিত্র কাবার কাছ দিয়ে তাওয়াফ করা। ১০.নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে একপাশ হয়ে তাওয়াফ করা। ১১.খুশুখুজুর সাথে তাওয়াফ করা ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা না বলা। ১২.রুকনে য়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মাঝে [রব্বানা আতিনা ফিদদুনইয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা। ওয়াকিনা আজাবান নারি] -এই দোয়া পড়া। ১৩.প্রত্যেক তাওয়াফে ভিন্ন ভিন্ন দোয়া আছে এরূপ বিশ্বাস না করা। ১৪.সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করা। ১৫.তাওয়াফ করার সময় নারীদের স্পর্শ থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকা। ১৬.তাওয়াফ শেষে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দু’রাকাত সালাত আদায় করা। জায়গা না পেলে অন্য কোথাও আদায় করা। ১৭.সালাত শেষে যমযমের পানি পান করা ও মাথায় ঢালা। উমরার তাওয়াফ শুরু গায়ের চাদরের মধ্যভাগ ডান বগলের নীচে রেখে ডান কাঁধ খালি রাখুন। চাদরের উভয় মাথা বাঁ কাঁধের ওপর রেখে দিন, অর্থাৎ ইযতিবা করুন। মনে-মনে তাওয়াফের নিয়ত করুন। হাজরে আসওয়াদ সোজা মুখোমুখী দাঁড়ান। ভিড় না থাকলে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করে তাওয়াফ আরম্ভ করুন। হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের পদ্ধতি হল এইÑহাজরে আসওয়াদের ওপর দু’হাত রাখুন। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে আলতোভাবে চুম্বন করুন। আল্লাহর জন্য হাজরে আসওয়াদের উপর সিজদাও করুন। [দেখুন : মুসনাদ আদ-তায়ালিসি : ১/২১৫-২১৬] চুম্বন করা দুষ্কর হলে, ডান হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করুন এবং হাতের যে অংশ দিয়ে স্পর্শ করেছেন সে অংশ চুম্বন করুন। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন ও স্পর্শ উভয়টাই অত্যন্ত কঠিন ও অনেকের পক্ষেই দুঃসাধ্য। বোখারির বিবরণ মতে, সে হিসেবে দূরে দাঁড়িয়ে ডান হাত উঁচু করে, ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে হাজরে আসওয়াদের দিকে এক হাত দ্বারা ইশারা করুন। যেহেতু হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি তাই হাতে চুম্বনও করতে হবে না। পূর্বে হাজরে আসওয়াদ বরাবর একটি খয়েরি রেখা ছিল বর্তমানে তা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই হাজরে আসওয়াদ সোজা মসজিদুল হারামের কার্নিশে থাকা সবুজ বাতি দেখে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসেছেন কি-না তা নির্ণয় করুন। হাজরে আসওয়াদ স্পর্শের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে য়ামানি মাসেহ (স্পর্শ) গুনাহ-অন্যায় সমূলে বিলুপ্ত করে দেয়। তাই হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শের বিষয়টি কখনো অগুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন না। তবে অন্যদের যেন কষ্ট না হয় সে বিষয়টি নজরে রাখতে হবে। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন, স্পর্শ অথবা ইশারা করার পর কাবা শরীফ হাতের বায়ে রেখে তাওয়াফ শুরু করুন। পুরুষদের ক্ষেত্রে কাবা শরীফের কাছ দিয়ে তাওয়াফ করতে পারলে ভাল। রামলবিশিষ্ট তাওয়াফ হলে প্রথম তিন চক্করে রামল করুন। ছোট কদমে কাঁধ হেলিয়ে বীর-বিক্রমে চলুন। অবশিষ্ট চার চক্করে চলার গতি স্বাভাবিক রাখুন। প্রত্যেক তাওয়াফে ভিন্ন ভিন্ন দোয়া পড়তে হবে এ ব্যাপারে হাদিসে কিছু পাওয়া যায় না। যখন যে ধরনের আবেগ আসে সে ধরনের দোয়া করুন। আল্লাহর প্রশংসা করুন। রাসূলুল্লাহ [সা.] ওপর দরুদ পড়–ন। যে ভাষা আপনি ভাল করে বোঝেন ও আপনার মনের আকুতি সুন্দরভাবে প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দোয়া করুন। রুকনে য়ামানি অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদের আগের কোণের কাছে এলে তা স্পর্শ করুন। রুকনে য়ামানি স্পর্শ করার পর হাত চুম্বন করতে হয় না। সরাসরি রুকনে য়ামানিকে চুম্বন করাও শরিয়তসম্মত নয়। রুকনে য়ামানি থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ [সা.] Ñ‘হে আমাদের প্রতিপালক আপনি আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন, ও পরকালেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন’ পড়তেন। সে হিসেবে আমাদের জন্য এ জায়গায় উক্ত দোয়া পড়া সুন্নত। হাজরে আসওয়াদ বরাবর এলে ডান হাত উঁচু করে আবার তাকবির বলুন। এভাবে সাত চক্কর শেষ করুন। শেষ চক্করেও হাজরে আসওয়াদ বরাবর এলে তাকবির দিন। অর্থাৎ সাত চক্করে তাকবির হবে ৮ টি। তাওয়াফ শেষ হলে, ডান কাঁধ ঢেকে ফেলুন, যা ইতোপূর্বে খোলা রেখেছিলেন। এবার মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দু’রাকাত সালাত আদায় করুন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন,-মাকামে ইব্রাহীমকে তোমরা সালাতের স্থল হিসেবে সাব্যস্ত করো। জায়গা না পেলে মসজিদুল হারামের যে কোনো স্থানে সালাত আদায় করুন। মাকরুহ সময় হলে এ দু’রাকাত সালাত পরে আদায় করে নিন। সালাতের পর হাত উঠিয়ে দোয়া করার বিধান নেই। এ সালাতের প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা ‘কাফিরুন’ - ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা ইখলাস পড়া সুন্নত। সালাত শেষ করে যমযমের পানি পান করুন, ও মাথায় ঢালুন। যমযমের পানি পানের ফজিলত যমযমের পানি পবিত্রতম পানি। পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম পানি। রাসূলুল্লাহ [সা.] যমযমের পানি পান করেছেন ও বলেছেন, এটা মুবারক পানি, এটা ক্ষুধা নিবারক খাদ্য, ও রোগের শেফা।[বোখারি ও মুসলিম] যমযমের পানি পান করার আদব কেবলামুখী হয়ে তিন নিশ্বাসে যমযমের পানি পান করতে হয়। পান করার শুরুতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে হয়। পেট ভরে পান করতে হয়। পান করা শেষ হলে আল্লাহর প্রশংসা করতে হয়। ইবনে আব্বাস [রা.] যমযমের পানি পানের পূর্বে এই দোয়া পড়তেন, Ñ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান, বিস্তৃত সম্পদ, ও সকল রোগ থেকে শেফা কামনা করছি’। পানি পান করার পর মাথায়ও কিছু পানি ঢালুন। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] এরূপ করতেন। যমযমের পানি পান করে সাঈ করার জন্য প্রস্তুতি নিন। সাঈ যাতে যথার্থভাবে আদায় হয় সেজন্য নিন্মবর্ণিত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখুন 1. সাঈ করার নিয়ত বা প্রতিজ্ঞা করা। 2. হাজরে আসওয়াদ ইস্তিলাম (চুম্বনÑস্পর্শ) করে সাঈর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া। 3. অজু অবস্থায় সাঈ করা। 4. তাওয়াফ শেষ করার সাথে সাথে সাঈ করা। 5. সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে, হাত উঠিয়ে, দীর্ঘক্ষণ দোয়া করা। 6. পুরুষদের জন্য সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে একটু দৌড়ে অতিক্রম করা। 7. সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে পড়বেন, হে আল্লাহ ! ক্ষমা করে দাও, নিশ্চয় তুমি মহা পরাক্রমশালী ও মহা দয়াবান। 8. সাত চক্কর পূর্ণ করা। 9. সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী পূর্ণ দূরত্ব অতিক্রম করা। 10. সাফা মারওয়া বরাবর মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ করা। মাসআ অর্থাৎ সাঈ করার সুনির্ধারিত স্থানের বাইরে দিয়ে চক্কর লাগালে সাঈ হবে না। 11. দুই চক্করের মাঝে বেশি বিলম্ব না করা। উল্লিখিত পয়েন্টগুলো অনুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করুন। তাহলে আপনার সাঈ শত ভাগ শুদ্ধ হবে। এর কোনোটায় ত্রট্টটি থেকে গেলে বিজ্ঞ আলেমের পরামর্শ নিন। সাঈ শুরু সাঈ করতে যাচ্ছেন এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করুন। সাঈর পূর্বে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ করুন। চুম্বন-স্পর্শ সম্ভব না হলে, এ ক্ষেত্রে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করার কোনো বিধান নেই। এরপর সাফা পাহাড়ের দিকে আগান। সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলে, রাসূলুল্লাহ (স) এর অনুসরণে বলুন, উচ্চারণ: ইন্নাস্সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআয়িরিল্লাহ। আব্দায়ু বিমা বাদায়াল্লাহু বিহি। অর্থ: নিশ্চয়ই সাফা মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন। আমি শুরু করছি আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন। [ইমাম মুসলিম কর্তৃক জাবের রা. হতে বর্ণিত হাদিস : কিতাবুল মুগনি : ৩১০] এরপর সাফা পাহাড়ে ওঠে বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন এবং আল্লাহর একত্ববাদ, বড়ত্ব ও প্রশংসার ঘোষণা দিয়ে বলবে, উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকালাহু লাহুল্মুল্কু ওয়ালাহুল হাম্দু ইউহয়ী ওয়া ইয়ুমীতু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু আনজাযা ওয়াদাহু, ওয়া নাছারা আব্দাহু ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহ্। অর্থ: আল্লাহ সুমহান, আল্লাহ সুমহান, আল্লাহ সুমহান ! আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, এবং আল্লাহ মহান। আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসাও তাঁর। তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, ও সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক। তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন, ও তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রট্টদেরকে পরাজিত করেছেন। এবং উভয় হাত উঠিয়ে দোয়া করবে। উপরোক্ত দোয়া এবং ইহ-পরকালের জন্য কল্যাণকর অন্যান্য দোয়া সামর্থ্য অনুযায়ী তিন বার পড়বে। পদ্ধতি এমন হবে যে, উক্ত দোয়াটি একবার পাঠ করে তার সাথে সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য দোয়া পড়বে। অত:পর পুনরায় উক্ত দোয়াটি পাঠ করবে এবং তার সাথে অন্যান্য দোয়া পাঠ করবে। এভাবে তিন বার করবে। [মুসলিম : হাদিসে জাবের : ২১৩৭] দোয়া শেষ হলে মারওয়ার দিকে রওয়ানা হোন। যেসব দোয়া আপনার মনে আসে পড়–ন। সাফা থেকে নেমে কিছু দূর এগোলেই ওপরে ও ডানে-বামে সবুজ বাতি জ্বালানো দেখবেন। এই জায়গাটুকু, পুরুষ হাজিগণ, দৌড়ানোর মত করে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলুন। পরবর্তী সবুজ বাতির আলামত এলে চলার গতি স্বাভাবিক করুন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় চলার গতি থাকবে স্বাভাবিক। সবুজ দুই আলামতের মাঝে চলার সময় নীচের দোয়াটি পড়–ন, উচ্চারণ: রাব্বির্গ্ফি ওর্য়াহাম্, ইন্নাকা আন্তাল্ আয়া’য্যুল আকরাম্ অর্থ: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন রহম করুন। নিশ্চয়ই আপনি সমধিক শক্তিশালী ও সম্মানিত। মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছার পূর্বে, সাফায় পৌঁছার পূর্বে যে আয়াতটি পড়েছিলেন, তা পড়তে হবে না। মারওয়ায় উঠে সাফার মতো পবিত্র কাবার দিকে মুখ করে একই কায়দায় হাত উঠিয়ে মোনাজাত করুন। মারওয়া থেকে সাফায় আসার পথে সবুজ বাতির এখান থেকে আবার দ্রুত গতিতে চলুন। দ্বিতীয় সবুজ আলামতের এখানে এলে চলার গতি স্বাভাবিক করুন। সাফায় এসে কাবা শরীফের দিকে মুখ করে আবার মোনাজাত ধরুন। সাফা মারওয়া উভয়টা দোয়া কবুলের জায়গা। কাজেই তাড়াতাড়ি সাঈ সেরে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার চিন্তা করবেন না। ধীরে সুস্থে রাসূলুল্লাহ [সা.] যেখানে যা করেছেন সেখানে সেটা সেভাবেই করার চেষ্টা করুন। কতটুকু করলে ফঅজু আদায় হয়ে যাবে, এই চিন্তা মাথায় আনবেন না। বরং এটা টারগেট বানাবেন যে রাসূলুল্লাহ [সা.] কোথায় কোন কাজ কীভাবে ও কত সময় করেছেন, আমিও ঠিক সেভাবেই করব। একই নিয়মে সাঈর বাকি চক্করগুলোও আদায় করুন। সাঈ করার সময় সালাত দাঁড়িয়ে গেলে কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করুন। সাঈ করার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসে আরাম করে নিন। এতে সাঈর কোনো ক্ষতি হবে না। আপনার শেষ সাঈ—অর্থাৎ সপ্তম সাঈ—মারওয়াতে গিয়ে শেষ হবে। শেষ হওয়ার পর মাথা মু-ন বা চুল খাটো করতে যাবেন। মারওয়ার পাশেই চুল কাটার সেলুন রয়েছে। সেখানে গিয়ে মাথা মু-ন অথবা চুল ছোট করে নিন। যদি হজের জন্য মাথা মু-ানোর সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ জিলহজ এর পূর্বে আপনার মাথার চুল গজাবে না এরূপ আশঙ্কা হয় তবে উমরার পর চুল ছোট করা উত্তম। বিদায় হজের সময় তামাত্তুকারী সাহাবাগণ কসর - চুল ছোট-করেছিলেন। কেননা তাঁরা হজের পাঁচ দিন পূর্বে উমরা আদায় করেছিলেন। তবে অন্যসব ক্ষেত্রে মাথা মু-ন করা উত্তম। মনে করিয়ে দেয়া ভাল যে, পবিত্র কুরআনে ‘হলক’ এবং’কসর’ এর কথা এসেছে। মাথার চুল গোড়া থেকে কেটে ফেলাকে হলক বলে আর ছোট করাকে বলে কসর। কারও কারও মতে এক আঙুল চুল ছেঁটে ফেলাকে কসর বলে। তাই মাথায় যদি একেবারেই চুল না থাকে তাহলে সত্যিকার অর্থে হলক ও কসর কোনোটাই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। মুন্ডিত মাথায় নতুন করে ক্ষুর চালালে এটাকে কেউ মাথা মু-ন বলে না, বরং এটা হবে (ক্ষুর সঞ্চালন) যা কেবল টাক-মাথা ওয়ালাদের জন্য প্রযোজ্য। মাথা মু-ন বা চুল ছোট করার পর গোসল করে স্বাভাবিক সেলাই করা কাপড় পরে নেবেন। ৮ জিলহজ পর্যন্ত হালাল অবস্থায় থাকবেন। এহরাম বাঁধতে হবে না। এখন আপনার কাজ হবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় করা, ও হজের ব্যাপারে পড়াশোনা করে খুব সুন্দরভাবে বড় হজের জন্য প্রস্তুতি নেয়া। সাধ্য-মত বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা। উমরা বিষয়ে আরো কিছু তথ্য পবিত্র কুরআনে, হজ ও উমরা উভয়টির কথা এসেছে। এরশাদ হয়েছে, তোমরা হজ ও উমরা আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণ করো’ এ’তেমার শব্দ থেকে উমর উৎকলিত। এর শাব্দিক অর্থ,যিয়ারত করা। পারিভাষিক অথের্, পবিত্র কাবার যিয়ারত তথা তাওয়াফ, সাফা মারওয়ার সাঈ ও মাথা মু-ন (হলক) ও চুল ছোট করা (কসর) কে উমরা বলা হয়। উমরার ফজিলত হাদিসে এসেছে, ‘রমজান মাসে উমরা করা এক হজের সমান’ ‘এক উমরা থেকে অন্য উমরা, এ-দুয়ের মাঝে কৃত পাপের, কাফফারা।’ ‘যে ব্যক্তি এই ঘরে এলো, অতঃপর যৌনতা ও শরিয়ত-বিরুদ্ধ কাজ থেকে বিরত রইল, সে মাতৃ-গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট ‘হওয়ার দিনের মত হয়ে ফিরে গেল।’ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানির মতানুসারে এখানে হজকারী ও উমরাকারী উভয় ব্যক্তিকেই বুঝানো হয়েছে। হজের সফরে একাধিক উমরা রাসূলুল্লাহ [সা.] এবং সাহাবায়ে কেরাম এক সফরে একাধিক উমরা করেননি। শুধু তাই নয় বরং তামাত্তু হজকারীদেরকে উমরা আদায়ের পর হালাল অবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে। তাই উত্তম হল এক সফরে একাধিক উমরা না করা। একাধিক উমরা থেকে বরং বেশি বেশি তাওয়াফ করাই উত্তম। তবে যদি কেউ উমরা করতেই চায় তাহলে হজের পরে করা যেতে পারে, যেমনটি করেছিলেন আয়েশা [রা.] ; তবে, রাসূল তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন—এমন কোন প্রমাণ নেই। বরং, নিরুৎসাহিত করেছেন এমন বর্ণনা হাদিসে পাওয়া যায়। অন্যান্য সময়ে একাধিক বার উমরা করা প্রসঙ্গে এক বর্ণনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ [সা.] জীবনে মোট চার বার উমরা করেছেন। প্রথমবার: হুদায়বিয়ার উমরা, যা পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সম্পন্ন করতে পারেননি। বরং সেখানেই মাথা মু-নের মাধ্যমে হালাল হয়ে যান। দ্বিতীয় বার: উমরাতুল কাজা। তৃতীয় বার : জিয়িররানা থেকে। চতুর্থবার: বিদায় হজের সাথে। তবে রাসূলুল্লাহ [সা.] উমরার উদ্দেশ্যে হেরেমের এরিয়ার বাইরে বের হয়ে উমরা করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। সাহাবায়ে কেরামের উমরা আদায়ের পদ্ধতি থেকে অবশ্য হজের সময় ব্যতীত অন্য সময়ে বছরে একাধিকবার উমরা করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। মক্কায় ইবনে যুবায়ের [রা.] এর শাসনামলে ইবনে উমর বছরে দুটি করে উমরা করেছেন। আয়েশা [রা.] বছরে তিনটি পর্যন্ত উমরাও করেছেন। এক হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা বার বার হজ ও উমরা আদায় করো। কেননা এ দুটি দারিদ্র্য ও গুনাহ বিমোচন করে দেয়।’ সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রে দেখা যেত, এক উমরা আদায়ের পর তাদের মাথার চুল কাল হয়ে যাওয়ার আবার উমরা করতেন, তার আগে করতেন না। উমরা করা সুন্নত না ওয়াজিব উমরা শুরু করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব। তবে হজের মত উমরা আদায় আবশ্যিক কি-না সে ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্মল [রা.] এর নিকট উমরা করা ওয়াজিব। প্রমাণ: পবিত্র কুরআনের বাণী -তোমরা আল্লাহর জন্য হজ ও উমরা পূর্ণ কর।’ এই অভিমতের পক্ষে বেশ কিছু হাদিসও রয়েছে তন্মধ্যে কয়েকটি হল নিন্মরূপ : ১.এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ [সা.] এর কাছে এসে বললেন আমার পিতা খুব বৃদ্ধ। তিনি হজ-উমরা করতে অপারগ, এমনকী সফরও করতে পারেন না। উত্তরে রাসূলুল্লাহ [সা.] বললেন, ‘তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ ও উমরা পালন করো। ২.কোনো কোনো বর্ণনায় হাদিসে জিব্রিলের একাংশে এসেছে, -তুমি হজ করবে ও উমরা করবে) ৩.আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ [সা.] কে জিজ্ঞাসা করলেন, নারীর ওপর কি জিহাদ ফঅজু? উত্তরে রাসূলুল্লাহ [সা.] বললেন, তাদের ওপর জিহাদ আছে যে জিহাদে কিতাল (যুদ্ধ) নেই। আর তা হল হজ ও উমরা। ৪.হাদিসে এসেছে, ‘হজ ও উমরা দুটি ফঅজু কর্ম। এতে কিছু যায় আসে না যে তুমি কোনটি দিয়ে শুরু করলে।’ ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতানুসারে উমরা করা সুন্নত। প্রমাণ, জাবের [রা.] থেকে বর্ণিত হাদিস: উমরা করা ওয়াজিব কি-না রাসূলুল্লাহ [সা.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। উত্তরে তিনি বলেছেন, না; তবে যদি উমরা করো তা হবে উত্তম। উভয়পক্ষের দলিল প্রমাণ পর্যালোচনা করলে যারা ওয়াজিব বলেছেন তাদের কথাই প্রাধান্যপ্রাপ্ত বলে মনে হয়। উমরা কখন করা যায় আরাফা দিবস, ও ১০, ১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ এই পাঁচ দিন উমরা করা উচিত নয়। তবে বছরের বাকি দিনগুলোতে যে কোনো সময় উমরা আদায়ে কোনো সমস্যা নেই। উমরার মীকাত হজের মীকাতের বর্ণনা আগেই গিয়েছে। উমরাকারী যদি এই মীকাতের বাইরে থেকে আসে তাহলে মীকাত থেকে এহরাম বেঁধে আসতে হবে। উমরাকারী যদি হেরেমের অভ্যন্তরে থাকে তাহলে হেরেম এর এরিয়া থেকে বাইরে যেতে হবে। হিল্ল থেকে এহরাম বাঁধতে হবে। সবচেয়ে নিকটবর্তী হিল্ল হল তানয়ীম, যেখানে বর্তমানে মসজিদে আয়েশা রয়েছে। [দেখুন মুসলিম : হাদিস নং ১১৮১] তাওয়াফ ও সাঈ বিস্তারিত আলোচনা তাওয়াফের সংজ্ঞা : কোনো কিছুর চারদিকে প্রদক্ষিণ করাকে শাব্দিক অর্থে তাওয়াফ বলে। হজের ক্ষেত্রে কাবা শরীফের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। পবিত্র কাবা ব্যতীত অন্য কোনো জায়গায় কোনো জিনিসকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা হারাম। তাওয়াফের ফজিলত হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করল, ও দু’রাকাত সালাত আদায় করল, তার এ কাজ একটি গোলাম আযাদের সমতুল্য হল। হাদিসে আরো এসেছে, ‘তুমি যখন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলে, পাপ থেকে এমনভাবে বের হয়ে গেলে যেমন নাকি আজই তোমার মাতা তোমাকে জন্ম দিলেন। [মুসান্নাফু আব্দিুররাজ্জাক : ৮৮৩০] তাওয়াফের প্রকারভেদ ১. তাওয়াফে কুদুম : এফরাদ হজকারী মক্কায় এসে প্রথম যে তাওয়াফ আদায় করে তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। কেরান হজকারী ও তামাত্তু হজকারী উমরার উদ্দেশ্যে যে তাওয়াফ করে থাকেন তা তাওয়াফে কুদুমেরও স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়। তবে হানাফি মাজহাব অনুযায়ী কেরান হজকারীকে উমরার তাওয়াফের পর ভিন্নভাবে তাওয়াফে কুদুম আদায় করতে হয়। হানাফি মাজহাবে তামাত্তু ও শুধু উমরা পালনকারীর জন্য কোনো তাওয়াফে কুদুম নেই। কুদুম শব্দের অর্থ আগমণ। সে হিসেবে তাওয়াফে কুদুম কেবল বহিরাগত হাজিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মক্কায় বসবাসকারীরা যেহেতু অন্য কোথাও থেকে আগমন করে না, তাই তাদের জন্য তাওয়াফে কুদুম সুন্নত নয়। ২. তাওয়াফে এফাদা বা যিয়ারত : সকল হজকারীকেই এ তাওয়াফটি আদায় করতে হয়। এটা হল হজের ফঅজু তাওয়াফ যা বাদ পড়লে হজ সম্পন্ন হবে না। তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের আওয়াল ওয়াক্ত শুরু হয় ১০ তারিখ সুবহে সাদেক উদয়ের পর থেকে। জমহুর ফুকাহার নিকট ১৩ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পন্ন করা ভাল। এর পরে করলেও কোনো সমস্যা নেই। সাহেবাইন (ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ) এর নিকট তাওয়াফে এফেদা আদায়ের সময়সীমা উন্মুক্ত। ইমাম আবু হানিফা (র) এর নিকট তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের ওয়াজিব সময় হল ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এ সময়ের পরে তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করলে ফরজ আদায় করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে তবে ওয়াজিব তরক হওয়ার কারণে দম দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে। তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের পূর্বে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য হালাল হয় না। ৩. তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ি তাওয়াফ : বায়তুল্লাহ শরীফ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে বিদা বলে। এ তাওয়াফ কেবল বহিরাগতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মক্কায় বসবাসকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেহেতু মক্কায় বসবাসকারী হাজিদের জন্য প্রযোজ্য নয়, তাই এ তাওয়াফ হজের অংশ কিÑনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেননা হজের অংশ হলে মক্কাবাসী এ থেকে অব্যাহতি পেত না। মুসলিম শরীফের একটি হাদিস থেকেও বুঝা যায় যে বিদায়ি তাওয়াফ হজের অংশ নয়। হাদিসটিতে রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, মুহাজির ব্যক্তি হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর মক্কায় তিন দিন অবস্থান করবে।[ মুসলিম : হাদিস নং ২৪০৯] ‘হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর’ এই বাক্য দ্বারা বুঝা যায় যে বিদায়ি তাওয়াফের পূর্বেই হজের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে বহিরাগত হাজিদের জন্য বিদায়ি তাওয়াফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হানাফি মাজহাবে ওয়াজিব। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] তাগিদ দিয়ে বলেছেন, বায়তুল্লাহর সাথে শেষ সাক্ষাৎ না দিয়ে তোমাদের কেউ যেন না যায়। তবে এ তাওয়াফ যেহেতু হজের অংশ নয় তাই ঋতুস্রাবগ্রস্থ মহিলা বিদায়ি তাওয়াফ না করে মক্কা থেকে প্রস্থান করতে পারে। ৪. তাওয়াফে উমরা : উমরা আদায়ের ক্ষেত্রে এ তাওয়াফ ফঅজু ও রুকন। এ তাওয়াফে রামল ও ইযতিবা উভয়টাই রয়েছে। ৫. তাওয়াফে নযর : ইহা মান্নত হজকারীদের ওপর ওয়াজিব। ৬. তাওয়াফে তাহিয়্যা : ইহা মসজিদুল হারামে প্রবেশকারীদের জন্য মুস্তাহাব। তবে যদি কেউ অন্য কোনো তাওয়াফ করে থাকে তাহলে সেটিই এ তাওয়াফের স্থলাভিষিক্ত হবে। ৭. নফল তাওয়াফ : যখন ইচ্ছা তখনই এ তাওয়াফ সম্পন্ন করা যায়। তাওয়াফ বিষয়ক কিছু জরুরি মাসায়েল তাওয়াফের পূর্বে পবিত্রতা জরুরি : কেননা আপনি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে যাচ্ছেন যা পৃথিবীর বুকে পবিত্রতম জায়গা। বিদায় হজের সময় রাসূলুল্লাহ [সা.] প্রথমে অজু করেছেন, তারপর তাওয়াফ শুরু করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ [সা.] যেভাবে হজ করেছেন আমাদেরকেও তিনি সেভাবেই হজ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, Ñ আমার কাছ থেকে তোমাদের হজকর্মসমূহ জেনে নাও।’ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তাওয়াফকে সালাতের তুল্য বলা হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, আল্লাহ তা’আলা এতে কথা বলা বৈধ করে দিয়েছেন, তবে যে কথা বলতে চায় সে যেন উত্তম কথা বলে। এহরাম অবস্থায় আয়েশা [রা.] এর ঋতুস্রাব শুরু হলে রাসূলুল্লাহ [সা.] তাঁকে তাওয়াফ করতে নিষেধ করে দেন। এ হাদিসও তাওয়াফের সময় পবিত্রতার গুরুত্বের প্রতিই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে কারণেই ইমাম মোহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ অজু অবস্থায় তাওয়াফ করাকে ওয়াজিব বলেছেন। [ইমাম মুহাম্মদ আশ্শানকীতি: খালিসূল জুমান,পৃ: ১৮২] তাওয়াফের সময় সতর ঢাকাও জরুরি : কেননা জাহেলি-যুগে উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করার প্রথাকে বন্ধ করার জন্য পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে,Ñ হে বনী আদম, প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সৌন্দর্য অবলম্বন করো। [সূরা আরাফ : ৩১] ইবনে আব্বাস [রা.] সৌন্দর্য অর্থ পোশাক বলেছেন। এক হাদিস অনুযায়ী তাওয়াফও একপ্রকার সালাত তা পূর্বেই উল্লেখ হয়েছে। তাছাড়া ৯ হিজরীতে, হজের সময় পবিত্র কাবা তাওয়াফের সময় যেন কেউ উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ না করে সে মর্মে ফরমান জারি করা হয়। [ইবনে কাছীর : খন্ড১, পৃ: ১৫৭] তাওয়াফের শুরুতে নিয়ত করা বাঞ্ছনীয় : তবে সুনির্ধারিতভাবে নিয়ত করতে হবে না। বরং মনে মনে এরূপ প্রতিজ্ঞা করলেই চলবে যে আমি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে যাচ্ছি। অনেক বই-পুস্তকে তাওয়াফের যে নিয়ত লেখা আছেÑআল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদু তাওয়াফা বায়তিকাল হারাম ফা য়াস্সিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি—হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই। সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করা উচিত : চার চক্করে তাওয়াফ শেষ করা কখনো উচিত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইনদের মধ্যে কেউ চার চক্করে তাওয়াফ শেষ করেছেন বলে হাদিস ও ইতিহাসে নেই। তাওয়াফ হজরে আসওয়াদ থেকে শুরু করে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে শেষ করতে হবে : কেউ যদি হজরে আসওয়াদের বরাবর আসার একটু পূর্বেও তাওয়াফ ছেড়ে দেয় তাহলে তার তাওয়াফ শুদ্ধ বলে গণ্য হবে না। তাওয়াফ করার সময় রামল ও ইযতিবা কোন কোন তাওয়াফে রামল ও ইযতিবা আছে তা নিয়ে ফেকাহবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। উমরার তাওয়াফ ও কুদুমের তাওয়াফেই কেবল ইযতিবা আছে, এটাই হল বিশুদ্ধ অভিমত। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] এ দু’ধরনের তাওয়াফে রমল ও ইযতিবা করেছেন। [দেখুন : ফাতহুল বারী : ৩/২৬৯] হানাফি মাজহাব অনুসারে যে তাওয়াফের পর সাফা-মারওয়ার সাঈ আছে সে তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল ও পুরা তাওয়াফে ইযতিবা আছে। নারীর তাওয়াফ নারী অবশ্যই তাওয়াফ করবে। তবে পুরুষদের সাথে মিশ্রিত হয়ে নয়। যখন ভিড় কম থাকে তখন নারীদের তাওয়াফ করা বাঞ্ছনীয়। অথবা, একটু সময় বেশি লাগলেও দূর দিয়ে নারীরা তাওয়াফ করবে। পুরুষের ভিড়ে নারীরা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতে যাবে না। আয়েশা [রা.] এর তাওয়াফের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে,-আয়েশা [রা.] পুরুষদের একপাশ হয়ে একাকী তাওয়াফ করতেন। পুরুষদের সাথে মিশতেন না। এক মহিলা বললেন: চলুন, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ করি। তিনি বললেন, তুমি যাও—আমাকে ছাড়। তিনি যেতে অস্বীকার করলেন। [- বুখারি : ১৫১৩] ঋতুস্রাব অবস্থায় নারীরা তাওয়াফ করবে না। প্রয়োজন হলে হজের সময়ে ঋতুস্রাব ঠেকানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে, ব্যবহার করার বৈধতা রয়েছে। তাওয়াফের সময় নারীর জন্য কোনো রামল বা ইযতিবা নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] নারীকে রামল ইযতিবা করতে বলেননি। হজের ফঅজু তাওয়াফের সময় যদি কারও ঋতুস্রাব চলে আসে এবং ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করা কোনো ক্রমেই সম্ভব না হয়, পরবর্তীতে এসে ফঅজু তাওয়াফ আদায় করারও কোনো সুযোগ না থাকে, এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ ওলামাগণ ফতোয়া দিয়েছেন যে ন্যাপকিন দিয়ে ভালো করে বেঁধে তাওয়াফ আদায় করে নিতে পারে। সাফা মারওয়ার মাঝে সাঈ সাত চক্কর কীভাবে হিসাব করবেন? সাফা মারওয়ার মাঝে যাওয়া-আসা করাকে সাঈ বলে। সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত এক চক্কর হয়, আবার মারওয়া থেকে সাফায় ফিরে এলে আরেক চক্কর। অনেকেই ভুল করে, সাফা থেকে মারওয়া আবার মারওয়া থেকে সাফায় পর্যন্ত, এক চক্কর হিসাব করে থাকে। অর্থাৎ সাফা মারওয়ার মাঝে ১৪ বার যাতায়াত করে ৭ চক্কর হিসাব করে থাকে, এটা মারাত্মক ভুল। সাঈ করার গুরুত্ব ও হুকুম ফঅজু তাওয়াফ - যেমন তাওয়াফে উমরা ও তাওয়াফে ইফাযাÑ এর পর সাফা মারওয়ার মাঝে সাঈ করাও আবশ্যিক। জমহুর ফুকাহা সাফা মারওয়ার মাঝে সাঈকে রুকন হিসেবে গণ্য করেছেন। [সূরা আল বাকারা : ১৫৮] হাদিসে এসেছে, ‘আয়েশা [রা.] বলেন, আমার জীবনকে সাক্ষী রেখে বলছি, ওই ব্যক্তির হজ আল্লাহর কাছে পূর্ণতা পাবে না যে সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করল না। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘সাঈ করো, কেননা আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর সাঈ লিখে দিয়েছেন। হানাফি মাজহাবে সাঈ করা ওয়াজিব, যদি কেউ ছেড়ে দেয় দম দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে। সংক্ষেপে উমরা আদায়ের নিয়ম পূর্বে উল্লেখিত নিয়মানুযায়ী এহরাম বেঁধে উমরার নিয়ত করে (লাব্বাইয়কা উমরাতান) বলতে হবে। এরপর তালবিয়া পাঠ করে করে তাওয়াফ করতে যেতে হবে। তাওয়াফের নিয়ম অনুযায়ী সাত চক্করে পবিত্র কাবার তাওয়াফ করতে হবে। প্রথম তিন চক্করে রমল করতে হবে। ইযতিবাও করতে হবে। এরপর তাওয়াফের দু’রাকাত সালাত আদায় করে সাফা মারওয়ার সাঈ করতে হবে। সাঈ শেষ হলে মাথা মু-ন অথবা চুল ছোট করতে হবে। এখানেই উমরা শেষ। উমরার জন্য আর কিছু করতে হবে না। জিলহজ মাসের প্রথম দশদিনের মর্যাদা জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন গুরুত্বপূর্ণ সময়। পবিত্র কুরআনে জিলহজ মাসের প্রথম দশ অজুনি নিয়ে কসম খেয়েছেন আল্লাহ তা’আলা। এরশাদ হয়েছে,“শপথ প্রত্যুষের ও দশ অজুনির।” [সূরা আল ফাজর : ১-২] দশ অজুনি বলতে জিলহজের প্রথম দশ অজুনি বুঝায় এ ব্যাখ্যা ইবনে আব্বাস রা. ইবনে যুবায়ের ও মুজাহিদ রহ. সহ অনেকের। প্রসিদ্ধ মুফাসসির ইবনে কাসির এ মতটিকেই বিশুদ্ধ বলেছেন। হাদিসে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দিন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস [রা.] থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেন, এমন কোনো দিবস নেই যার আমল জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হবে। প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করা থেকেও কি অধিক প্রিয়? রাসূলুল্লাহ [সা.] বললেন, হাঁ জিহাদ করা থেকেও অধিক প্রিয় তবে যদি এমন হয় যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে বের হল এবং এর কোনো কিছুই ফেরত নিয়ে এল না। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত নবী কারিম (সা.) বলেছেন: এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবির (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় কর। এ দু হাদিসের অর্থ হল বছরে যতগুলো মর্যাদাপূর্ণ দিন আছে তার মধ্যে এ দশ দিনের প্রতিটি দিন হল সর্বোত্তম। যেমন এ দশ দিনের অন্তর্গত কোন জুমা’র দিন অন্য সময়ের জুমা’র দিন থেকে উত্তম বলে বিবেচিত হবে। লিখেছেন : ড. মাওলানা মুহাম্মাদ শামসুল হক সিদ্দিক