
ছবি সংগৃহীত
হজের দিনভিত্তিক বিভিন্ন আমল ও কার্যক্রম
আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০১৪, ১২:৩৪
প্রথম দিন ৮ই জিলহজ ইহরাম অবস্থায় (ফরয) মক্কা থেকে হজ্জের নিয়্যাতে মিনায় রওয়ানা হোন। এ দিনের কাজ দু’টি (১) ইহরাম (ফরজ) (২) ৫ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা (সুন্নাত)। যোহর, আছর, মাগরিব, এশা ও ৯ তারিখ ফজর সর্বমোট ৫ ওয়াক্ত। দ্বিতীয় দিন ৯ জিলহজ আরাফা দিবসের ফজিলত জিলহজ মাসের নয় তারিখকে ‘ইয়াউমে আরাফা’-আরাফা দিবস বলে। এক আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম দিবস আরাফা দিবস। আল্লাহ তাআলা, আরাফা দিবসে, তাঁর বান্দাদেরকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, ‘এমন কোনো দিবস নেই যেখানে আল্লাহ তাআলা আরাফা দিবস থেকে বেশি বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এবং আল্লাহ নিশ্চয়ই নিকটবর্তী হন, ও তাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন, বলেন—ওরা কী চায়? অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা আরাফায় অবস্থানরতদেরকে নিয়ে আকাশবাসীদের সাথে গর্ব করেন। তিনি বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখো, তারা আমার কাছে এসেছে এলোথেলো ও ধুলায় আবৃত অবস্থায়। রাসূলুল্লাহ [সা.] আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পূর্বে বেলালকে [রা.] নির্দেশ দিলেন মানুষদেরকে চুপ করাতে। বেলাল বললেন : আপনারা রাসূলুল্লাহ [রা.] এর জন্য নীরবতা অবলম্বন করুন। জনতা নীরব হল। রাসূলুল্লাহ [সা.] বললেন, ‘হে লোক সকল! একটু পূর্বে জিবরাইল আমার কাছে এসেছেন। তিনি আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আহলে আরাফা ও আহলে মুযদালেফার জন্য আমার কাছে সালাম পৌঁছিয়েছেন, ও তাদের অন্যায়ের জিম্মাদারি নিয়েছেন। ওমর দাঁড়িয়ে বললেন, য়্যা রাসূলুল্লাহ [সা.]! এটা কি শুধুই আমাদের জন্য? তিনি বললেন, এটা তোমাদের জন্য ও তোমাদের পর কেয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে তাদের জন্য। ওমর [রা.] বললেন, আল্লাহর অনুকম্পা অঢেল ও উত্তম। আরাফা দিবস মুসলমানদের ওপর আল্লাহর দ্বীন ও নেয়ামত পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিবস। তারিক ইবনে শিহাব থেকে বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে, ইহুদিরা ওমর [সা.] কে বলল: আপনারা একটি আয়াত পড়েন, যদি তা আমাদের ওপর নাযিল হতো তাহলে এ দিবসে আমরা উৎসব পালন করতাম। ওমর [রা.] বললেন, আমি অবশ্যই জানি কী উদ্দেশ্যে ও কোথায় তা নাযিল হয়েছে, এবং রাসূলুল্লাহ [সা.] কোথায় ছিলেন যখন তা নাযিল হল। (তা ছিল) আরাফা দিবস। আর আমরা-আল্লাহর কসম- আরাফার ময়দানে। সুফয়ান বলেন, দিনটি জুমাবার ছিল কি-না, আমার সন্দেহ আছে। (আয়াতটি ছিল : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দিনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম) [বোখারি : হাদিস নং ৪৬০৬] আরাফা দিবসের রোজা, পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। তবে এ রোজা হাজিদের জন্য নয়, বরং যারা হজ করতে আসেনি তাদের জন্য। হাজিদের জন্য আরাফার দিবসে রোজা রাখা মাকরুহ। রাসূলুল্লাহ [সা.] বিদায় হজের সময় আরাফা দিবসে রোজা রাখেননি। বরং সবার সম্মুখে তিনি দুধ পান করেছেন। [দেখুন : মুসলিম : হাদিস নং ১১২৩-১১২৩] ইকরামা থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা [রা.] এর বাড়িতে প্রবেশ করে আরাফা দিবসে আরাফার ময়দানে থাকা অবস্থায় রোজা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: রাসূলুল্লাহ [সা.] আরাফার ময়দানে আরাফা দিবসের রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। উকুফে আরাফা ফেরেশতা জিব্রিল [আ.] হজের আমলসমূহ শিখিয়েছেন ইব্রাহীম [আ.] কে আরাফার ময়দানে। শেখানো শেষে ইব্রাহীম [আ.] কে জিজ্ঞেস করে বলেছেন, আপনি কি জানতে পেরেছেন?’। সেই থেকে আরাফার নাম ‘আরাফা’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আদম ও হাওয়া পৃথিবীতে আসার পর প্রথম পরিচয় হয় আরাফার ময়দানে বলেও একটি কথা আছে। [দেখুন : ড. মুহাম্মদ ইলয়াস গনী : তারিখু মাক্কাল মুকাররামা, পৃ:১১৫ , মাতাবেউর রাশীদ, ১৪২২ হি:] আরাফা শব্দের এক অর্থ পরিচয় লাভ করা, সে হিসেবেও আরাফার নাম আরাফা হয়ে থাকতে পারে। কারও কারও মতে, যেহেতু এ ময়দানে মানুষ আল্লাহর দরবারে গুনাহ-পাপ স্বীকার করে থাকে, এখান থেকেও আরাফা নামটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। আরাফার ময়দান হেরেম এলাকার বাইরে অবস্থিত। কাবা শরীফ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, মসজিদুল হারাম রোড হয়ে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আরাফার এই ময়দান। ১০.৪ কি.মি. জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আরাফার ময়দান। চতুর্দিকে সীমানা-নির্ধারণমূলক উঁচু ফলক রয়েছে। ৯ জিলহজ ভোরে ফজরের সালাত মিনায় আদায় করে সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় রওয়ানা হতে হয় আরাফা অভিমুখে। তবে বর্তমানে হজযাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফজরের পূর্বেই নিয়ে যাওয়া হয় আরাফায়। এটা নিশ্চয়ই সুন্নতের খেলাফ তবে সমস্যার কারণে এ সুন্নত ছুটে গেলে কোনো সমস্যা হবে না। আরাফার ময়দানে প্রবেশ আরাফার ময়দানে প্রবেশের সুন্নত তরিকা হল, মসজিদে ইব্রাহীমে- যা বর্তমানে নামিরার মসজিদ বলে খ্যাত-জোহর আসর একসাথে হজের ইমামের পিছনে আদায় করে আরাফার ময়দানে প্রবেশ করা। তবে বিশ লক্ষাধিক হাজির পক্ষে এ জাগায় অবস্থান নিয়ে জোহর আসর একসাথে পড়ে আরাফার ময়দানে প্রবেশ করা এবং উকুফ সম্পাদন করা অসম্ভব বিধায় এ সুন্নতের উপরও আমল করা সম্ভব হয় না। বর্তমান হজ ব্যবস্থাপনার আওতায় হাজিদেরকে সরাসরি আরাফার ময়দানের ভেতরে পূর্বেই নিয়ে যাওয়া হয়। এতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে যদি ব্যক্তিগতভাবে কারো পক্ষে সম্ভব হয় এবং পথঘাট ভালো করে চেনা থাকে, একা একা আরাফায় সাথিদের কাছে ফিরে আসতে পারবে বলে নিশ্চিত থাকে, অথবা একা একাই মুযদালেফা গমন, রাত্রিযাপন ও সেখান থেকে মিনার তাঁবুতে ফিরে আসার মতো সামর্থ্য-সাহস ও আত্মবিশ্বাস থাকে তবে তার পক্ষে নামিরার মসজিদে এ সুন্নত আদায় করাই উত্তম। আরাফার ময়দানে প্রবেশের পূর্বে গোসল করাকেও কেউ কেউ মুস্তাহাব বলেছেন। ইবনে ওমর [রা.] এরূপ করতেন। ওমর [রা.] ও ইবনে মাসউদ [রা.] ও গোসল করতেন বলে বর্ণায় এসেছে । [দেখুন : ইমাম নববী : কিতাবুল ইযাহ ফি মানাসিকিল হাজ্জি ওয়াল ওমরাহ , পৃ: ২৭২ ] জোহর-আসর এক সাথে আদায় প্রসঙ্গ রাসূলুল্লাহ [সা.] সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে জোহর আসর একসাথে আদায় করেছিলেন। বিদায় হজ সম্পর্কে যাবের [রা.] এর হাদিসে এসেছে, ‘নবী [রা.] উপত্যকার মধ্যখানে এলেন। তিনি লোকজনকে লক্ষ্য করে খোতবা দিলেন। অতঃপর আজান দেয়া হল, একামত হল, এবং তিনি যোহরের সালাত আদায় করলেন। এরপর একামত হল এবং তিনি আসরের সালাত আদায় করলেন। এ দু’য়ের মাঝখানে অন্য কোনো সালাত আদায় করলেন না। জোহর আসর একত্রে পড়ার ক্ষেত্রে কেউ কেউ দশটি শর্ত লাগিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি হল ‘হজের ইমামের পেছনে হওয়া’। তবে এসব শর্ত লাগানোর পেছনে শক্ত কোনো দলিল নেই। বরং ইবনে ওমর [রা.] হজের ইমামের পিছনে জামাত না পেলেও তিনি জোহর-আসর একসাথে জমা করতেন, এ মর্মে সহিহ বুখারিতে একটি বর্ণনা এসেছে। বর্ণনাটির ভাষ্য হল, - ইবনে ওমর [রা.] ইমামের সাথে সালাত না পেলেও দুই সালাত একত্রে পড়তেন। প্রসিদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারী নাফে’ [রা.] ইবনে ওমর [রা.] সম্পর্কে বলেন, -ইবনে ওমর (র) আরাফা দিবসে ইমামের সাথে (সালাত) ধরতে না পারলে, নিজ অবস্থানের জায়গাতেই জোহর-আসর জমা করতেন। হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ দুই ইমাম, ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমি এখানে এলাউস্সুনান কিতাব থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি অর্থাৎ: (ইমাম) মুহাম্মদ বলেছেন: (ইমাম) আবু হানিফা আমাদেরকে জানিয়েছেন, হাম্মাদ, ও ইব্রাহীম এর সূত্র ধরে, তিনি বলেছেন: আরাফার দিন যদি তুমি নিজের অবস্থানের জায়গায় সালাত আদায় কর তবে দুই সালাতের প্রত্যেকটি যার যার সময়ে আদায় করবে, ও সালাত থেকে ফারেগ হয়ে নিজের অবস্থানের জায়গা থেকে প্রস্থান করবে। (ইমাম) মুহাম্মদ বলেন, (ইমাম) আবু হানিফা এ বর্ণনা অনুযায়ী আমল করেন। পক্ষান্তরে আমাদের কথা এই যে (হাজি) তার উভয় সালাত নিজের অবস্থানের জায়গায় ঠিক একই রূপে আদায় করবে যেভাবে আদায় করে ইমামের পেছনে। উভয় সালাতকে একত্রে জমা করবে, এক আজান ও দুই একামতের সাথে। কেননা সালাতুল আসরকে উকুফের স্বার্থে এগিয়ে আনা হয়েছে। এরূপই আমাদের কাছে পৌঁছেছে আয়েশা, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আতা ইবনে আবি রাবাহ ও মুজাহিদ থেকে। সে হিসেবে হজের ইমামের পিছনে জামাতের সাথে সালাত আদায় সম্ভব হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় জোহর আসর একত্রে পড়া সুন্নত। ইমামুল হজের শর্ত লাগানোর পেছনে একটি যুক্তি এই দেখানো হয় যে, রাসূল [সা.] ছিলেন ইমামুল হজ আর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পেছনে সালাত আদায় করেছেন। তাই ইমামুল হজের পেছনে জামাতের সাথে সালাত আদায় না করলে জমা করা যাবে না। এই বিষয়টি প্রমাণের ক্ষেত্রে ফেকাহ শাস্ত্রের ‘মাফহুমুল মুখালাফার’ আশ্রয় নেয়া হয়েছে যা হানাফি মাজহাবে দলিল হিসেবে গণ্য নয়। আরাফা দিবসের মূল আমল ‘দোয়া’ আরাফা দিবসের মূল আমল দোয়া। দোয়ার কিছু আদব ও কায়দা-কানুন আছে যেগুলোর অনুসরণ দোয়া কবুলে সহায়ক হতে পারে। নীচে দোয়ার কিছু আদব উল্লেখ করা হল। ১.শুদ্ধ নিয়ত অর্থাৎ দোয়া আরম্ভের সময় মনে মনে নিয়ত করবেন যে আপনি একটি মহৎ ইবাদত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। কেননা ‘দোয়াই ইবাদত’ বলে হাদিসে এসেছে। মনে মনে এ ধরনের ভাবও উদ্রেক করবেন যে একমাত্র আল্লাহই সমস্ত হাজত পুরা করতে পারেন। হাজত-প্রয়োজন পুরা করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ২. ওজু অবস্থায় দোয়া করা। কেননা ওজু ব্যতীত দোয়া করা জায়েয হলেও যেহেতু দোয়া একটি ইবাদত তাই ওজু অবস্থায় করাই উত্তম। ৩. হাতের তালু চেহারার দিকে ফিরিয়ে দোয়া করা। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে তোমরা যখন সওয়াল করবে, হাতের তালু দিয়ে সওয়াল করবে। হাতের পিঠ দিয়ে নয়। রাসূলুল্লাহ [সা.] দোয়া করার সময় হাতের তালু চেহারার দিকে রাখতেন। প্রয়োজন ও হাজত প্রকাশের এটাই হল সর্বোত্তম ধরন, যাতে একজন অভাবী ব্যক্তি পাবার আশায় দাতার দিকে বিনয়াবনত হয়ে হাত বাড়িয়ে রাখে। ৪. হাত এতটুকু উঁচুতে ওঠাবেন যাতে বগলের নীচ দেখা যায়। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার হাত এতটুকু উঠায় যে, তার বগলের নীচ দৃশ্যমান হয়ে উঠে এবং আল্লাহর কাছে আর্জি পেশ করে, আল্লাহ তার আর্জি পূরণ করেন। ৫. আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বর্ণনার মাধ্যমে দোয়া শুরু করা। রাসূলুল্লাহ (স) অধিকাংশ সময় এভাবেই দোয়া করতেন। এমনকী কেয়ামতের ময়দানে আরশের কাছে সিজদায় রত হয়ে তিনি দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বয়ান করবেন, এরপর আল্লাহ তাঁকে সওয়াল করার অনুমতি দেবেন, ও বলবেন, হে মুহাম্মদ! মাথা উঠাও, বল, তোমার কথা শোনা হবে। সওয়াল কর দেয়া হবে। শাফায়াত করো, তোমার শাফায়াত মঞ্জুর করা হবে। ৬. নবী (স) এর প্রতি দরুদ পাঠ করা। কেননা দরুদ ব্যতীত দোয়া ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক দোয়া নবী (স) প্রতি দরুদ না পড়া পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত অবস্থায় থাকে। ৭. প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করা। পবিত্র কুরআনে এর কিছু উদাহরণ এসেছে, যেমন; Ñ হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার মাতাপিতাকে। - সে বলল, হে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার ভাইকে। - হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও আমাদের ভাইদেরকে যারা আমাদের পূর্বে ঈমান অবস্থায় অতিবাহিত হয়েছেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] ও কারো জন্য দোয়া করলে প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করতেন। ৮. দোয়া করার সময় কোনো ইতস্তত না করা। এরূপ না বলা যে হে আল্লাহ তুমার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে দোয়া কবুল করো। যদি ইচ্ছা হয় তবে রহম করো। যদি ইচ্ছা হয় আমাকে রিজিক দাও। বরং দৃঢ়-প্রত্যয়ী হয়ে দোয়া করা। ৯. মন-মস্তিষ্ক জমিয়ে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দোয়া করা। কেবল মুখে মুখে শব্দ উচ্চারণ করে না যাওয়া। হাদিসে এসেছে, ‘দোয়া কবুল হবে এই একীন নিয়ে আল্লাহর কাছে চাও। জেনে রাখো, আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন দোয়া কবুল করেন না যা গাফেল ও উদাসীন হৃদয় থেকে বের হয়। ১০. একীনের সাথে দোয়া করা। কেননা আল্লাহ পাক দোয়া কবুল করার ওয়াদা করেছেন, এরশাদ হয়েছে,-যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, বল, যে আমি নিকটেই। আহ্বানকারীর আহ্বানে আমি সাড়া দেই যখন সে আহ্বান করে। ওপরে বর্ণিত হাদিসেও উল্লেখ হয়েছে যে, ‘তোমরা কবুল হওয়ার একীন নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো।’ সংক্ষেপে উকুফে আরাফার নিয়ম ১. সম্ভব হলে আরাফার ময়দানে প্রবেশের পূর্বে বা পরে গোসল করে নেয়া। ২. যোহরের সময়ে জোহর-আসর একসাথে, এক আজান ও দুই একামতে কাসর করে আদায় করা। আসর ও যোহরের আগে পরে কোনো সুন্নত নফল সালাত আদায় না করা। সালাতের সময় নারীরা পুরুষের পেছনে একই জমাতে শরিক হতে পারবেন। ৩. সালাত শেষে দোয়া-মুনাজাতে ব্যস্ত হওয়া। দাঁড়িয়ে-বসে-চলমান অবস্থায় তথা সকল পরিস্থিতিতে দোয়া ও জিকির চালু রাখা। কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ নসিহতের বৈঠকে শরিক হওয়া ইত্যাদিও উকুফে আরাফার আমলের মধ্যে শামিল হবে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে কেবল চুপি স্বরে বসে বসে দোয়া-জিকির ও কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ রয়েছে। ৪. ক্লান্তি চলে এলে সহযাত্রী হাজিদের সাথে কল্যাণকর আলাপচারিতার মাধ্যমে ক্লান্তি দুর করা যেতে পারে। অথবা ভালো কোনো ধর্মীয় বই পড়েও কিছু সময় কাটানো যেতে পারে। ৫. যারা দিনের বেলায় উকুফে আরাফা করবে তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া-জিকির তথা উকুফ চালিয়ে যাবে। আর যারা ৯ তারিখ দিবাগত রাতে আরাফার ময়দানে আসবে, সুবহে সাদেকের পূর্ব পর্যন্ত সামান্য সময় অবস্থান করলেই উকুফ হয়ে যাবে। ৬. নারীদের পর্দা-পুশিদার ব্যাপারে সজাগ থাকা। কাপড় দিয়ে পর্দা টানিয়ে তার মধ্যে অবস্থান করা। বেগানা পুরুষের সামনে ওড়না বা চাদর ঝুলিয়ে চেহারা ঢেকে দেয়া। হাতও চাদরের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা। কেননা নারীর জন্য নেকাব ব্যবহার করে চেহারা ঢাকা ও হাত মোজা ব্যবহার করে হাত ঢাকা এহরাম অবস্থায় নিষেধ। তবে অন্য কিছু ব্যবহার করে ঢাকা নিষেধ নয়। ৭. আরাফার ময়দানের ভেতরে উকুফ হচ্ছে কি-না সে ব্যাপারে সজাগ থাকা। কেননা আরাফার বাইরে উকুফ করলে হজ হবে না। ৮. জাবালে আরাফায় উঠার কোনো বিধান নেই। তাই এ পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করা উচিত নয়। জাবালে আরাফার দিকে মুখ করে দোয়া করাও খেলাফে সুন্নত। ৯. উকুফে আরাফা হজের শ্রেষ্ঠতম আমল। হাদিসে এসেছে -হজ হল আরাফা। তাই এই পবিত্র দিবসে যেন কোনো প্রকার পাপের সাথে জড়িয়ে না যান সে ব্যাপারে কঠিনভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাই উচিত হবে সহযাত্রী হাজিদেরকে নিয়ে খোশগল্পে না বসা। কেননা এ ধরনের আসরে নিজের অজান্তেই গিবত-পরনিন্দার মতো জঘন্য পাপের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে নেয়া হয়। ১০. এ দিবসে বেশি বেশি দান-খয়রাত করার চেষ্টা করা উচিত। তাই সহযাত্রীদের প্রয়োজনে আপনার হাত প্রসারিত করুন। সঙ্গে করে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে যাবেন যেগুলো দিয়ে প্রয়োজনের সময় আপ্যায়ন করবেন। ১১. সম্ভব হলে কিছু সময় উন্মুক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে দোয়া করুন। মুযদালেফার পথে রওয়ানা ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পর রওয়ানা হতে হয় আরাফা থেকে মুযদালেফার উদ্দেশ্যে। মাগরিবের সালাত আরাফার ময়দানে না পড়েই রওয়ানা হতে হয়, কেননা মুযদালিফায় গিয়ে এশার সাথে মিলিয়ে পড়তে হবে মাগরিবের সালাত। রওয়ানা হতে হয় ধীরে-সুস্থে শান্তভাবে।আরাফার সীমানা শেষ হলেই মুযদালেফা শুরু হয় না। আরাফা থেকে প্রায় ৬ কি.মি. পথ অতিক্রম করার পর আসে মুযদালেফা। মুযদালেফার পর ওয়াদি আল-মুহাস্সার। এরপর মিনা। আরাফা থেকে যেতে দু পাশে সামনাসামনি দুটি পাহাড় পড়বে। ওয়াদি মুহাস্সার থেকে এ পাহাড়-দ্বয় পর্যন্ত মুযদালেফা। মুযদালেফার শুরু ও শেষ নির্দেশকারী বোর্ড রয়েছে। বর্তমানে মুযদালেফার একাংশ মিনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ননব্যালটি অধিকাংশ বাংলাদেশি হাজিদের মিনার তাঁবু মুযদালিফায় অবস্থিত। এই জায়গাটুকু মিনা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও যেহেতু মৌলিক অর্থে মিনায় পরিণত হয়নি, তাই এই অংশে রাত্রিযাপন করলেও মুযদালেফার রাত্রিযাপন হয়ে যাবে। মুযদালিফায় করণীয় মুযদালিফায় পৌঁছার পর প্রথম কাজ হল মাগরিব ও এশা এক সাথে আদায় করা। মাগরিব ও এশা উভয়টা এক আজান ও দুই একামতে আদায় করতে হবে। আজান দেয়ার পর একামত দিয়ে প্রথমে মাগরিবের তিন রাকা’ত সালাত আদায় করতে হবে। এরপর সুন্নত নফল না পড়েই এশার উদ্দেশ্যে একামত দিয়ে এশার দু’রাকা’ত কসর সালাত আদায় করতে হবে। ফরজ আদায়ের পর বেতরের সালাতও আদায় করতে হবে। মাগরিবের সালাত মুযদালিফায় পৌঁছার সাথে সাথেই আদায় করা উচিত। গাড়ি থেকে মাল-সামানা নামানোর প্রয়োজন হলে মাগরিবের সালাত পড়ে তারপর গিয়ে নামাবেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] বিদায় হজের সময় মাগরিবের সালাত আদায় করে তারপর যার যার উট যেখানে অবস্থান করবে সেখানে বসিয়েছেন। এরপর এশার সালাত আদায় করেছেন। খেয়াল রাখতে হবে যে মুযদালিফায় পৌঁছার পর যদি এশার সালাতের সময় না হয় তবে অপেক্ষা করতে হবে। কেননা, এক বর্ণনা অনুসারে, মুযদালেফার রাতে মাগরিবের সময় পরিবর্তন করে এশার ওয়াক্তে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাগরিবের সালাতের পর কোনো সুন্নত বা জিকির নেই। তবে এশার পর বেতরের তিন রাকাত সালাত আদায় করতে হবে। সালাত আদায়ের পর অন্য কোনো কাজ নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] বিদায় হজের সময় সুবহে সাদেক পর্যন্ত শুয়ে আরাম করেছেন। যেহেতু ১০ জিলহজ হাজি সাহেবকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাই রাসূলুল্লাহ [সা.] মুযদালেফার রাতে আরাম করার বিধান রেখেছেন। তাই যারা বলেন যে, মুযদালেফার রাত ঈদের রাত, যা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে দেয়া উচিত, তাদের কথা রাসূলুল্লাহ [সা.] এর সুন্নত মোতাবেক না হওয়ায় আমলযোগ্য নয়। তবে এক ফাঁকে কঙ্কর কুড়িয়ে নিতে পারেন। কেননা মিনায় গিয়ে কঙ্কর খুঁজে পাওয়া রীতিমতো কষ্টের ব্যাপার। তবে মুযদালেফা থেকেই কঙ্কর নিতে হবে এ ধারণা ঠিক নয়। মটরশুঁটির আকারের কঙ্কর নেবেন যা আঙুল দিয়ে নিক্ষেপ করা যায়। ৭০ টি কঙ্কর কুড়াবেন। কঙ্কর পানি দিয়ে ধুইতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] কঙ্কর ধুয়েছেন বলে কোনো হাদিসে পাওয়া যায় না। মুযদালিফায় থাকাবস্থায় সুবহে সাদেক উদিত হলে আওয়াল ওয়াক্তে ফজরের সালাত আদায় করে কেবলামুখী হয়ে হাত উঠিয়ে দোয়ায় মশগুল হবেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] অবশ্য ফজরের সালাত আদায়ের পর ‘কুযা’ পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে উপস্থিত হতেন ও উকুফ করতেন। এ স্থানটি বর্তমানে মাশআরুল হারাম মসজিদের সম্মুখ ভাগে অবস্থিত। এ মসজিদটি মুযদালেফার ৫ নং রোডের পাশে অবস্থিত, এবং ১২ হাজার মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা রাখে। মসজিদটির পশ্চাৎ ভাগে ৩২ মিটার উঁচু দু’টি মিনারা রয়েছে অনেক দূর থেকেই যা স্পষ্ট দেখা যায়। এ মসজিদের এখানে রাসূলুল্লাহ [সা.] উকুফ করেছেন এবং বলেছেন আমি এখানে উকুফ করলাম তবে মুযদালেফা পুরোটাই উকুফের স্থান। সম্ভব হলে উক্ত মসজিদের কাছে গিয়ে উকুফ করা ভাল।উক্ত মসজিদের কাছে গিয়েই হোক বা যেখানে অবস্থান করছেন সেখানেই হোক ফজরের সালাত আদায়ের পর দোয়ায় মশগুল হবেন ও খুব ফরসা হওয়া পর্যন্ত দোয়া ও জিকির চালিয়ে যাবেন। এরপর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য মধ্যরাতের পর চাঁদ ডুবে গেলে মুযদালেফা থেকে প্রস্থান করার অনুমতি আছে। ইবনে ওমর [রা.] তাঁর পরিবারের মধ্যে যারা দুর্বল তাদেরকে এগিয়ে দিতেন। রাতের বেলায় তারা মুযদালিফায় মাশআরুল হারামের নিকট উকুফ করতেন। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী আল্লাহর জিকির করতেন। তারা ইমামের উকুফ ও প্রস্থানের পূর্বেই মুযদালেফা থেকে ফিরে যেতেন। তাদের মধ্যে কেউ ফজরের সালাতের সময় মিনায় গিয়ে পৌঁছাতেন। কেউ পৌঁছাতেন তারও পর। তারা যখন মিনায় পৌঁছাতেন কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। ইবনে ওমর [রা.] বলতেন: রাসূলুল্লাহ [সা.] এদের ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন। মুযদালিফায় উকুফ করা ওয়াজিব। পবিত্র কুরআনে এসেছে -তোমরা যখন আরাফা হতে প্রত্যাবর্তন করবে, মাশআরুল হারামের নিকট পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে, এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁকে স্মরণ করবে। যদিও তোমরা ইতিপূর্বে বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। রাসূলুল্লাহ [সা.] মুযদালিফায় উকুফ করেছেন। সূর্যোদয়ের পূর্বে তিনি মুযদালেফা ত্যাগ করেছেন। তাই আমাদেরও উচিত রাসূলুল্লাহ [সা.] যেভাবে মুযদালিফায় রাতযাপন করেছেন, উকুফ করেছেন, ঠিক একই রূপে রাতযাপন ও উকুফ করা। মুযদালিফায় অবস্থানের ফজিলত রাসূলুল্লাহ [সা.] মুযদালিফায় অবস্থানের ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা এই দিনে তোমাদের ওপর অনুকম্পা করেছেন, অতঃপর তিনি গুনাহ্গারদেরকে সৎকাজকারীদের কাছে সোপর্দ করেছেন। আর সৎকাজকারীরা যা চেয়েছে তা তিনি দিয়েছেন। মিনায় পৌঁছার পূর্বে ওয়াদি মুহাস্সার (মুহাস্সার উপত্যকা) সামনে আসবে। ওয়াদি মুহাস্সারের সীমানা নির্ধারক ফলক রয়েছে যেখানে ওয়াদিয়েঢ মাহাসসর লেখা আছে। এখানে আবরাহা রাজার হাতির বাহিনী ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে নাস্তানাবুদ হয়েছিল। আল্লাহর আযাব নাযিল হওয়ার স্থান হিসেবে, অন্যান্য আযাব নাযিলের স্থানের মতো রাসূলুল্লাহ [সা.] এখানেও দ্রুত চলে পার হয়ে গেছেন। সে হিসেবে মুহাস্সার উপত্যকায় এলে দ্রুত চলে পার হয়ে যাওয়া মুস্তাহাব। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন দ্রুত চলতে গিয়ে অন্যদের কষ্ট না হয়। বর্তমানে অবশ্য ওয়াদি মুহাস্সারে তাঁবু টানিয়ে, মিনার দিনগুলোয়, হাজিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। মিনার মূল এরিয়ায় জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বিজ্ঞ ওলামাদের পরামর্শ ক্রমে এরূপ করা হয়েছে। তাই আপনার তাঁবু যদি ওয়াদি মুহাস্সারে অবস্থিত থাকে তা হলে এ জায়গাটুকু দ্রুত পার হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি বরং এখানেই থেমে যাবেন, এবং নিজ তাঁবুতে প্রবেশ করবেন। মিনায় পৌঁছে করণীয় আজ ১০ জিলহজ। হজের বড়ো দিন। রাসূলুল্লাহ [সা.] এই দিন সাহাবিগণকে প্রশ্ন করে বলেছিলেন, ‘এটা কোন দিন?’ উত্তরে তাঁরা বলেছিলেন, ‘এটা য়াইমুন্নাহর-কোরবানির দিন। রাসূলুল্লাহ বললেন, ‘এটি হজের বড়ো দিন’ বছরের সর্বোত্তম দিবস। রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলার কাছে সর্বোত্তম দিবস হল কোরবানির দিন। তারপর পরের দিন। এই দিনে হজের চারটি কাজ অনুষ্ঠিত হয়, যারা হাজি নয় তাদের জন্য ঈদের সালাত ও কোরবানি একত্রিত হয়। সে হিসেবে এই দিনের মর্যাদা অত্যন্ত বেশি। তাই হজ-পালনকারী ভাগ্যবান ব্যক্তির উচিত যথাযথ সম্মানের সাথে ও সমস্ত পাপ ও গুনাহ হতে মুক্ত থেকে এ দিনটি অতিবাহিত করা। ১০ জিলহজের আমলসমূহ ১. বড় জামরায় ৭ টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা। ২. হাদী জবেহ করা। ৩. মাথা মু-ন বা চুল ছোট করা। ৪.তাওয়াফে যিয়ারা সম্পন্ন করা। প্রথম আমল: কঙ্কর নিক্ষেপ, কঙ্কর নিক্ষেপের সময়সীমা রাসূলুল্লাহ [সা.] সূর্য ওঠার প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা পর কঙ্কর মেরেছিলেন। সে হিসেবে এ সময়টাতেই ১০ তারিখের কঙ্কর নিক্ষেপ করা সুন্নত। সূর্য ঢলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ-সুন্নত সময় চলতে থাকে। সূর্য ঢলে যাওয়া থেকে শুরু করে ১১ তারিখের সুবহে সাদেকের আগ পর্যন্ত জায়েয। বর্তমান-যুগে বিশ লক্ষাধিক হজ পালনকারীর ভিড়ে সুন্নত সময়ে কঙ্কর মারা দুঃসাধ্য না হলেও অনেকের পক্ষেই কষ্টকর। তাই প্রথমে খবর নিন কখন ভিড় কম থাকে। অনেক সময় সকাল-বেলা ভিড় কম থাকে। কেননা অনেকেই ভাবেন যে এখন মনে হয় প্রচন্ড ভিড়, তাই পরে যাই। আবার অনেক সময় সকাল-বেলায় প্রচন্ড ভিড় থাকে। তাই উচিত হবে, ভিড় আছে কি-না, তা খবর নিয়ে দেখা। ১০ জিলহজ সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ১১ জিলহজ সুবহে সাদেক উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত কঙ্কর মারা চলে, এটাই আপনি মাথায় রাখুন। এ সময়ের মধ্যে যখন ভিড় কম বলে খবর পাবেন তখনই কঙ্কর মারতে যাবেন। নারীদের জন্য ১০ তারিখ সূর্য ওঠার আগেও কঙ্কর নিক্ষেপ চলে। তবে বর্তমানে এ সময়টায় পথঘাটে প্রচন্ড ভিড় থাকে। যার কারণে এ সময়ে জামারাতে গিয়ে কঙ্কর মেরে ফিরে আসা কঠিন ব্যাপার। তবে বিকেল বেলায় ও রাতে সাধারণত ফাঁকা থাকে। তাই নারীদের জন্য এ সময়ে কঙ্কর নিক্ষেপ সহজ। কঙ্কর নিক্ষেপের পদ্ধতি তালবিয়া পড়ে পড়ে জামারাতের দিকে এগোবেন। মিনার দিক থেকে তৃতীয় ও মক্কার দিক থেকে প্রথম জামরায়- যাকে জামরাতুল আকাবা বা জামরাতুল কুবরা (বড় জামরা) বলা হয়-৭ টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। কাবা ঘর বাঁ দিকে ও মিনা ডান দিকে রেখে দাঁড়াবেন। আল্লাহ আকবার বলে প্রতিটি কঙ্কর ভিন্ন ভিন্নভাবে নিক্ষেপ করবেন। খুশুখুজুর সাথে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। কঙ্কর নিক্ষেপ আল্লাহর একটি শাআয়ের বা নিদর্শনসমূহের অন্যতম। কালামে পাকে এসেছে, -এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে তাজিম করলে তার হৃদয়ের তাকওয়ার কারণেই তা করে থাকে।’ হাদিসে এসেছে, ‘বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা মারওয়ার সাঈ ও জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ আল্লাহর জিকির কায়েমের উদ্দেশ্যে। সে হিসেবে কঙ্কর নিক্ষেপের সময় ধীরস্থিরতা বজায় রাখা জরুরি, যাতে আল্লাহর নিদর্শনের অসম্মান না হয়। রাগ-রোষ নিয়ে জুতো কিংবা বড় পাথর নিক্ষেপ করা কখনো উচিত নয়। জামারাতে শয়তান বাঁধা আছে বলে যে কেউ কেউ ধারণা করেন তা ঠিক নয়। কঙ্কর নিক্ষেপের ফজিলত হাদিসে এসেছে, ‘আর তোমার কঙ্কর নিক্ষেপ, সে তো তোমার জন্য সঞ্চিত করে রাখা হয়। দুর্বল ও নারীদের কঙ্কর নিক্ষেপ যারা দুর্বল অর্থাৎ হাঁটা-চলার ক্ষমতা রাখে না, তারা নিজের কঙ্কর অন্যকে দিয়ে মারাতে পারেন। এক্ষেত্রে যিনি প্রতিনিধি হবেন তাকে অবশ্য হজ পালনকারী হতে হবে, এবং নিজের কঙ্কর প্রথমে মেরে, পরে অন্যেরটা মারতে হবে। নারী মাত্রই দুর্বল এ কথা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ [সা.] এর সাথে উম্মাহাতুল মুমিনিন সকলেই ছিলেন। তাঁদের সবাই নিজের কঙ্কর নিজেই মেরেছেন। কেবল সাওদা [রা.] মোটা স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় ভিড় হওয়ার পুবের্, ফজরের আগেই, কঙ্কর নিক্ষেপের অনুমতি নিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ শেষ করেন। তবু তিনি নিজের কঙ্কর নিজেই মেরেছেন। তাই নারী হলেই প্রতিনিধি নিয়োগ করা যাবে, তেমন কোনো কথা নেই। যখন ভীড় কম থাকে নারীরা তখন গিয়ে কঙ্কর মারবে। এবং নিজের কঙ্কর নিজেই মারবে, এটাই উত্তম তরিকা। হাঁ যদি ভীড় লাঘব হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে প্রতিনিধির মাধ্যমে কঙ্কর নিক্ষেপ করালে সমস্যা হবে না। তবে বর্তমানে জামারাতের স্তম্ভ যেভাবে লম্বা করে দেয়া হয়েছে তাতে, সময়-ক্ষণ বুঝে, যে কেউ অনায়াসে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে পারে। দ্বিতীয় আমল : হাদী জবেহ করা বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ শেষ করে হাদী জবেহ বিষয়ে মনোনিবেশ করুন। তামাত্তু ও কেরান হজ পালনকারীর জন্য হাদী জবেহ করা ওয়াজিব। ইফরাদ হজকারীর জন্য মুস্তাহাব। উট-গরু-বকরি-মেষ হাদী হিসেবে জবেহ করা যায়। উট হলে ৫ বছর বয়সের, গরু হলে দুই বছর বয়সের ও মেষ হলে এক বছর বয়সের হতে হবে। উট ও গরু হলে একটাতে সাতজন অংশ নিতে পারবেন। তবে কারো অংশই যেন একসপ্তমাংশের কম না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বকরি ও ভেড়ার ক্ষেত্রে এক হাদী একজনের জন্য জবেহ করতে হবে। কোথায় পাবেন হাদী মিনায় হাদী বিক্রির হাট বসে। মক্কায়ও কোথাও কোথাও বসে। তবে সাধারণ হাজির পক্ষে এসব হাটে গিয়ে হাদী ক্রয় করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই হাদী জবাই করার ক্ষেত্রে নিুবর্ণিত পদ্ধতিসমূহের যে কোনো একটি অবলম্বন করুন। এক. ব্যাংকের মাধ্যমে হাদী জবেহ করার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে, হজের পূর্বে যে কোনো এক সুযোগে আল-রাজী ব্যাংক অথবা অন্য কোনো ব্যাংক, যেখানে হাদীর টাকা নেয়া হচ্ছে বলে শুনবেন, টাকা জমা করে রসিদ নিয়ে নেবেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, ১০ জিলহজ, সকাল দশটার পর হাদী জবাই শুরু করেন। সকাল ১০টা ১১টার দিকে আপনার হাদী জবাই হয়ে গেছে বলে ধরে নিতে পারেন ও মাথা মু-ন করতে পারেন। এটাই হল হাদী জবেহ করার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাধ্যম। বিশেষ করে ব্যালটি হাজিদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি বেশি উপযোগী। কেননা ব্যালটি হাজিদের কোরবানির পয়সা যার যার কাছে ফেরত দেয়া হয়। এই সুযোগে অনেক অসৎ লোক হাজিদের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য নানা প্রলোভন দেখায়, ও হাদী জবেহ না করেই ফোনের মাধ্যমে জবেহ হয়ে গিয়েছে বলে খবর দিয়ে দেয়। তাই ব্যালটি হাজিদের জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে হাদী জবেহ করাই হল সর্বোত্তম পন্থা। দুই. নন ব্যালটি হাজিগণ বিভিন্ন কাফেলার আওতায় থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাফেলার লিডাররা হাদী জবেহ করার দায়িত্ব নেন। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার জন্য করণীয় হল বিশ্বস্ত কয়েকজন যুবক-হাজি কাফেলার লিডারের সাথে দিয়ে দেয়া, যারা সরেজমিনে হাদী ক্রয় ও জবাই প্রক্রিয়া স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবেন ও সহযাত্রী অন্যান্য হাজিদেরকে এ মর্মে অবহিত করবেন। এরূপ না করে কেবল কাফেলা লিডারকে টাকা দিয়ে দেওয়া ও হাদী জবেহ হল কি-না ফোনের মাধ্যমে যেনে নেয়া উচিত হবে না। তিন. মক্কায় কারও বিশ্বস্ত আত্মীয়-স্বজন কর্মরত থাকলে তাদের মাধ্যমেও হাদী জবেহ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে যার মাধ্যমে হাদী জবেহ করানো হচ্ছে তার যথেষ্ট সময় আছে কি-না। কেননা হজ মৌসুমে মক্কায় অবস্থানকারীরা নানা ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অজানা ভুলের জন্য দম দেয়া নিয়ম মোতাবেক হজের প্রত্যেকটি কর্ম সম্পাদনের পরও কেউ কেউ এরূপ সন্দেহ পোষণ করতে থাকেন যে কে জানে কোথাও কোনো ভুল হল কি-না। কাফেলা লিডারদের কেউ কেউ হাজি সাহেবদেরকে উৎসাহিত করেন যে ভুলত্রট্টটি হয়ে থাকতে পারে তাই একটা দমে-খাতা দিয়ে দিন, শত-ভাগ বিশুদ্ধ হয়ে যাবে আপনার হজ। এরূপ করাটা মারাত্মক অন্যায়। কেননা আপনার হজ সহিহ-শুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নিজ ইচ্ছায় তাকে সন্দেহযুক্ত করছেন। আপনার যদি সত্যি সত্যি সন্দেহ হয় তাহলে একজন বিজ্ঞ আলেমকে আপনার হজের বিবরণ শুনান। তিনি যদি বলেন যে আপনার উপর দম ওয়াজিব হয়েছে তবেই কেবল দম দিয়ে শুধরিয়ে নেবেন। অন্যথায় নয়। শুধু আন্দাজের ওপর নির্ভর করে দমে-খাতা দেওয়ার কোনো বিধান ইসলামে নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন এ ধরনের কথায় আদৌ কর্ণপাত করবেন না। হাঁ, আপনি যদি নফল হাদী অথবা কোরবানি জবেহ করতে চান তাহলে যত ইচ্ছা করতে পারেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] বিদায় হজের সময় হাদী ও কোরবানি মিলিয়ে একশত উট জবেহ করেছিলেন। হজের হাদী ব্যতীত অন্য কোনো কোরবানি করতে হবে কি- না? বিজ্ঞ ওলামাগণ হজের হাদী উভয়টার জন্যই যথেষ্ট হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাজি যদি মুকিম হয়ে যায় এবং নেসাবের মালিক হয় তবে তার উপর ভিন্নভাবে কোরবানি করা ওয়াজিব বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে হাজি মুকিম না মুসাফির, এ নিয়েও একটা বিতর্ক আছে। হাদী জবেহ করার পূর্বে মাথা মুন্ডন প্রসঙ্গ ইচ্ছাকৃতভাবে হাদী জবেহ করার পূর্বে মাথা-মুন্ডন করা নিয়ম-বহির্ভূত কাজ। তদ্রুপভাবে এদিনের অন্যান্য কাজেও তরতিবের উল্টো করা উচিত নয়। তবে যদি কেউ অপারগ হয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারে, অথবা ভুলবশত উলট-পালট করে বসে তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না। রাসূলুল্লাহ [সা.] এর সাথে হজ করার সময় সাহাবায়ে কেরামদের কেউ কেউ এরূপ আগে-পিছে করেছেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, ‘কর, কোনো অসুবিধা নেই। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে -মিনায়, কোরবানির দিন, রাসূলুল্লাহ [সা.] কে জিজ্ঞাসা করা হত। তিনি বলতেন, ‘সমস্যা নেই’। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করে বললেন, আমি জবেহ করার পূর্বে মাথা মু-ন করে ফেলেছি। রাসূলুল্লাহ [সা.] বললেন জবেহ কর, কোনো সমস্যা নেই। লোকটি বললেন, ‘আমি সন্ধ্যার পর কঙ্কর মেরেছি, রাসূলুল্লাহ [সা.] বললেন, সমস্যা নেই। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে—আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস [রা.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ [সা.] কে শুনেছি- এক ব্যক্তি ১০ জিলহজ তাঁর কাছে এল। তিনি তখন জামরার কাছে দাঁড়ানো ছিলেন। লোকটি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্বে মাথা মু-ন করে ফেলেছি, তিনি বললেন, নিক্ষেপ করো সমস্যা নেই। অন্য আরেক ব্যক্তি এসে বলল, আমি কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্বে জবেহ করেছি। তিনি বললেন, নিক্ষেপ কর সমস্যা নেই। অন্য আরেক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করল, আমি কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্বে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেছি। তিনি বললেন, নিক্ষেপ করো সমস্যা নেই। বর্ণনাকারী বললেন, সেদিন রাসূলুল্লাহ [সা.] কে যে প্রশ্নই করা হয়েছে তার উত্তরেই তিনি বলেছেন, করো সমস্যা নেই। এ সম্পর্কে আরো হাদিস রয়েছে যেগুলো শুদ্ধ ও যেগুলোর আলোকে আমল করলে হজের আদৌ কোনো ক্ষতি হবে না। বিশেষ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে ও কোরবানি আদায় প্রক্রিয়া জটিল, এমনকী কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজ্ঞাত থাকা অবস্থায়, বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহ [সা.] যেভাবে সরল আকারে দেখেছেন আমদেরও সেভাবে নেয়া উচিত। বিশেষ করে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর প্রখ্যাত দুই ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ—যাদেরকে সাহেবাইন বলা হয় ও ইমামের বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের কথার ওপরই ফতোয়া দেয়া হয়—১০ জিলহজের কাজসমূহে তরতিব তথা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারলেও দম ওয়াজিব হবে না বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তৃতীয় আমল: মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করা হাদী জবেহ হয়েছে বলে নিশ্চিত হলে মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করুন। তবে মু-ন করাই উত্তম। পবিত্র কুরআনে মুন্ডন করার কথা আগে এসেছে, ছোট করার কথা পরে। এরশাদ হয়েছে, - তোমাদের কেউ কেউ মাথা মুন্ডন করবে ও কেউ কেউ চুল ছোট করবে। রাসূলুল্লাহ [সা.] নিজেও মাথা মুন্ডন করেছিলেন। হাদিসে এসেছে, আনাস [রা.] বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ [সা.] মিনায় এলেন, জামরাতে এসে তিনি কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন। এরপর তিনি মিনায় তাঁর অবস্থানের জায়গায় এলেন ও কোরবানি করলেন। এরপর তিনি ক্ষৌরকারকে বললেন, নাও। তিনি হাত দিয়ে (মাথার) ডান দিকে ইশারা করলেন, অতঃপর বাম দিকে। এরপর মানুষদেরকে তা দিতে লাগলেন। যারা মাথা মুন্ডন করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করেছেন তিন বার। আর যারা চুল ছোট করে তাদের জন্যে দোয়া করেছেন এক বার। মাথা মুন্ডনের ফজিলত হাদিসে এসেছে, ‘আর তোমার মাথা মুন্ডন কর, এতে প্রত্যেক চুলের বিনিময়ে একটি ছোয়াব ও একটি গুনাহের ক্ষমা রয়েছে। মাথা মুন্ডন অথবা চুল ছোট করার পদ্ধতি মাথা মুন্ডন করা হোক বা চুল ছোট করা হোক সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ [সা.] সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করে মু-ন করেছিলেন। মাথার কিছু অংশ মু-ন করা অথবা ছোট করা, আর কিছু অংশ ছেড়ে দেয়া রাসূলুল্লাহর আদর্শের বিপরীত। হাদিসে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। নাফে’ ইবনে ওমর [রা.] থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ [সা.] কাজা’ থেকে বারণ করেছেন। কাজা’ কি? এ ব্যাপারে নাফে’কে জিজ্ঞাসার করা হলে তিনি বললেন, শিশুর মাথার কিছু অংশ মু-ন করা ও কিছু অংশ রেখে দেয়া। কসর অর্থাৎ চুল ছোট করার অর্থ সমগ্র মাথা থেকে এক আঙুল পরিমাণ চুল কেটে ফেলা। কারো টাক মাথা থাকলে মাথায় ব্লেড অথবা ক্ষুর চালিয়ে দিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। নারীদের ক্ষেত্রে হাতের আঙুলের এক কড়া পরিমাণ চুল কেটে ফেললেই যথেষ্ট হবে। নারীদের জন্য হলক নেই। সমগ্র মাথার চুল একত্রে ধরে এক আঙুল পরিমাণ কাটতে হবে। এতটুকু কাটার নামই কসর। মাথা ম-নের পর নখ কাটা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ [সা.] নখ কেটেছিলেন। ইবনে ওমর [রা.] হজ অথবা উমরার পর দাড়ি ও গোঁফও সামান্য কাটতেন। তবে দাঁড়ির ক্ষেত্রে এক মুষ্টির বেশি হলে ইবনে ওমর [রা.] এর মতো করা যেতে পারে, অন্যথায় নয়। বগল ও নাভির নীচ পরিষ্কার করাও বাঞ্ছনীয়। কেননা তা পবিত্র কুরআনের নির্দেশ- এবং তারা যেন তাদের ময়লা পরিষ্কার করে।) এর আওতায় পড়ে। ক্ষৌর-কার্যের পর গোসল করে শরীরের ময়লা পরিষ্কার করে সেলাই করা কাপড় পরবেন। সুগন্ধি ব্যবহার করবেন। এভাবে আপনি প্রাথমিকভাবে হালাল হয়ে যাবেন। এখন থেকে আপনি সেলাই করা কাপড় পরিধান, সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি করতে পারবেন। তবে স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন মিলন ইত্যাদি এখনও বৈধ হবে না। তাওয়াফে যিয়ারার পরই কেবল এসব সম্ভব হবে, যখন সম্পূর্ণরূপে হালাল হয়ে যাবেন। চতুর্থ আমল : তাওয়াফে যিয়ারত ১০ জিলহজের চতুর্থ আমল হল তাওয়াফে যিয়ারত। তাওয়াফে যিয়ারত ১০ তারিখেই সেরে নেয়া ভালো। কঙ্কর নিক্ষেপ—হাদী জবেহ—ক্ষৌর কার্য এ-তিনটি আমল শেষ করে গোসল করে, সুগন্ধি মেখে সেলাইযুক্ত কাপড় পড়ে পবিত্র কাবার দিকে রওয়ানা হবেন। শুরুতে উমরা আদায়ের সময় যে নিয়মে তাওয়াফ করেছেন ঠিক সে নিয়মে তাওয়াফ করবেন। এ তাওয়াফটি হল হজের ফরজ তাওয়াফ। এ তাওয়াফে রামল ও ইযতিবা নেই। তাওয়াফের পর, উমরা অধ্যায়ে বর্ণিত পদ্ধতিতে সাফা মারওয়ার সাঈ করবেন। ইফরাদ হজকারী তাওয়াফে কুদুমের পর সাঈ করে থাকলে এখন আর সাঈ করতে হবে না। কেরান হজকারীও পূর্বে সাঈ করে থাকলে এখন আর সাঈ করতে হবে না। তবে তামাত্তু হজকারীকে অবশ্যই সাঈ করতে হবে। কেননা তামাত্তু হজকারীর ইতোপূর্বে সাঈ করে নেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। জমহুর ফুকাহার নিকট ১৩ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে তাওয়াফে যিয়ারত করে নেয়া উত্তম। তবে এরপরেও করা যেতে পারে, এবং এর জন্য কোনো দম দিতে হবে না। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর অভিমতও এটাই। অর্থাৎ সাহেবাইনের নিকট তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের সময়সীমা উন্মুক্ত এবং বারো তারিখের পরে আদায় করলে কোনো দম দিতে হবে না। মাসিক স্রাব-গ্রস্ত মহিলার করণীয় মাসিক স্রাব-গ্রস্ত মহিলাগণ অপেক্ষা করবেন। স্রাব বন্ধ হলে তাওয়াফে যিয়ারত সেরে নেবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো দম দিতে হবে না। আর যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে স্রাব বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত কোনো ক্রমেই অপেক্ষা করা যাচ্ছে না, ও পরবর্তীতে এসে তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করে নেয়ারও কোনো সুযোগ নেই, তাহলে ন্যাপকিন দিয়ে ভাল করে বেঁধে তাওয়াফ যিয়ারত সেরে নেওয়া বৈধ রয়েছে। সাঈ অগ্রিম করে নেয়া প্রসঙ্গে ১০ জিলহজ তাওয়াফে যিয়ারতের পর যে সাঈ করতে হয় তা ১০ তারিখের পূর্বে আদায় করে নেওয়া খেলাফে সুন্নত। তাওয়াফে কুদুমের সাথে সাঈ করে নিলে তাওয়াফে যিয়ারতের পর সাঈ করতে হয় না, সেটি অন্য ব্যাপার, এবং হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তবে যদি কেউ ১০ তারিখে তাওয়াফ করার পূর্বে সাঈ করে নেয় তবে তা শুদ্ধ হবে। হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ [সা.] কে জিজ্ঞাসা করলেন,Ñআমি তাওয়াফ করার পূর্বে সাঈ করে ফেলেছি’ রাসূলুল্লাহ [সা.] উত্তরে বললেন, ‘করো, সমস্যা নেই’ তবে হাদিসের ভাষ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, লোকটি ১০ জিলহজ তারিখে অগ্রিম সাঈ করেছিলেন। সে হিসেবে তামাত্তু হজকারী যদি ১০ জিলহজের পূর্বে অগ্রিম সাঈ করে নেয় তা হলে সাঈ হয়ে যাবে বলে হাদিস অথবা সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে কোনো প্রমাণ নেই। হানাফি ফেকাহর প্রসিদ্ধ কিতাব বাদায়িউস্সানায়ে’তে এ ভাবে সাঈ করার বিপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। উক্ত কিতাব থেকে এখানে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি: অর্থাৎ ‘তামাত্তু হজকারী ব্যক্তি যখন হজের উদ্দেশ্যে এহরাম বাঁধবে তখন সে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। সাঈও করবে না। এটা হল ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর অভিমত। কারণ তাওয়াফে কুদুম ওই ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত যে হজের এহরাম নিয়ে মক্কায় আগমন করল। পক্ষান্তরে তামাত্তু হজকারী উমরার এহরাম নিয়ে মক্কায় আগমন করেছে। হজের এহরাম নিয়ে আগমন করেনি। তামাত্তু হজকারী ব্যক্তি মক্কা থেকেই হজের এহরাম বাঁধে। আর তাওয়াফে কুদুম বাহির থেকে আগমন ব্যতীত হয় না। তাওয়াফ-সাঈ এ জন্যেও করবে না যে, তাওয়াফ ব্যতীত সাঈ করা শরিয়তসম্মত নয়। কেননা সাঈর মূল জায়গা তাওয়াফে যিয়ারার পর। কেননা সাঈ হল ওয়াজিব। আর তাওয়াফে যিয়ারা হল ফরজ। ওয়াজিব, ফরজের তাবে’ বা অনুবর্তী হতে পারে। পক্ষান্তরে তাওয়াফে কুদুম সুন্নত। এবং ওয়াজিব সুন্নতের তাবে’ বা অনুবর্তী হতে পারে না। তবে তাওয়াফে কুদুমের ক্ষেত্রে সাঈকে তার মূল জায়গা হতে এগিয়ে নিয়ে আসার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই অনুমতির কারণে তাওয়াফে কুদুমের পর ‘ওয়াজিব’ আদায়যোগ্য হয়েছে। তাই তাওয়াফে কুদুমের অনুপস্থিতে সাঈকে তার মূল জায়গায় পিছিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ তাওয়াফে যিয়ারতের পূর্বে আদায় করা জায়েয হবে না। উক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায় যে আমাদের বাংলাদেশি হাজিগণ ৮ তারিখ মিনায় যাওয়ার সময় এহরাম বেঁধে, নফল তাওয়াফ করে, যে ভাবে সাঈ সেরে নেন তা আদৌ উচিত নয়। কেননা এর পেছনে আদৌ কোনো যুক্তি নেই। কেউ কেউ বলেন যে সাঈ এহরাম অবস্থায় করা মুস্তাহাব। আর এ মুস্তাহাব বাস্তবায়নের একটাই সুরত। আর তাহলো ৮ তারিখ এহরাম বেঁধে নফল তাওয়াফ করে সাঈ করে নেয়া। এ কথার পেছনে আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। কেননা তামাত্তুকারী সাহাবিগণ এহরাম বিহীন সাঈ করেছিলেন। মুস্তাহাব হলে নিশ্চয়ই তারা এরূপ করতেন না। মিনায় রাত্রিযাপন তাওয়াফ-সাঈ শেষ করে মিনায় ফিরে আসতে হবে। ১০ তারিখ দিবাগত রাত ও ১১ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় যাপন করতে হবে। ১২ তারিখ যদি মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে যায় তাহলে ১২ তারিখ দিবাগত রাতও মিনায় যাপন করতে হবে। ১৩ তারিখ কঙ্কর মেরে তারপর মিনা ত্যাগ করতে হবে। মিনায় রাত্রিযাপন গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। রাসূলুল্লাহ [সা.] যোহরের সালাত মসজিদুল হারামে আদায় ও তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করে মিনায় ফিরে এসেছেন ও তাশরীকের রাতগুলো মিনায় কাটিয়েছেন। ইবনে ওমর [রা.] থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘ওমর [রা.] আকাবার ওপারে (মিনার বাইরে) রাত্রিযাপন করা থেকে নিষেধ করতেন। এবং তিনি মানুষদেরকে মিনায় প্রবেশ করতে নির্দেশ দিতেন। মিনায় কেউ রাত্রিযাপন না করলে ওমর শাস্তি দিতেন বলেও এক বর্ণনায় এসেছে। ইবনে আব্বাস [রা.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যেন মিনার কোনো রাত, আইয়ামে তাশরীকে, আকাবার ওপারে যাপন না করে। এলাউস্সুনান কিতাবে রয়েছে, -মিনায় রাত্রিযাপনের আবশ্যকতা বিষয়ে হাদিসের ভাষ্য স্পষ্ট। আর এটা পূর্বে উল্লেখ হয়েছে যে হেদায়ার শব্দমালা মিনায় রাত্রিযাপন আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অনুভূতি দিচ্ছে। সে হিসেবে হানাফি মাজহাবের নির্ভরযোগ্য মতামত হল, আইয়ামে তাশরীকে মিনার বাইরে অবস্থান করা মাকরুহে তাহরীমি তাই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মিনায় অবস্থায় করুন। দিনের বেলায়েও মিনাতেই থাকুন। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোও মিনায় কাটিয়েছেন। ১১, ১২, ও ১৩ জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ প্রসঙ্গ কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। কঙ্কর নিক্ষেপের দিন চারটি। ১০, ১১,১২, ১৩ জিলহজ। ১০ জিলহজ কেবল বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয় যা ইতোপূর্বে সেরে নিয়েছেন। অন্যান্য দিন (১১,১২,১৩ তারিখ) তিন জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়। এ দিনগুলোয় কঙ্কর নিক্ষেপের প্রথম ওয়াক্ত শুরু হয় দুপুরে সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে, চলতে থাকে দিবাগত রাতে সুবেহ সাদেক উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত। ১১ জিলহজ সূর্য ঢলে যাওয়ার পর তিন জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। প্রথমে ছোট জামরায় ৭ টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। কাবা শরীফ বাম দিকে ও মিনা ডান দিকে রেখে দাঁড়াবেন। খুশুখুজুর সাথে আল্লাহর শিআর বা নিদর্শনের যথাযথ তাজিম বুকে নিয়ে একটি একটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। ‘আল্লাহ আকবার’ বলে প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। ছোট জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ শেষ হলে একটু সামনের এগিয়ে যাবেন। কেবলামুখী হয়ে দাঁড়াবেন ও হাত উঠিয়ে দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর মধ্য জামরায় যাবেন। এখানেও ৭টি কঙ্কর একই কায়দায় নিক্ষেপ করবেন। নিক্ষেপের পর সামান্য এগিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আবারও দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর বড় জামরায় কঙ্কর মারতে যাবেন। নিয়ম মতো এখানেও ৭টি কঙ্কর মারবেন, তবে এবার আর দোয়া করতে হবে না, কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে দাঁড়ান নি। কঙ্কর মারা শেষ হলে তাঁবুতে ফিরে আসবেন। ১২ তারিখের কঙ্কর নিক্ষেপ ১২ জিলহজ সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে কঙ্কর নিক্ষেপের সময় শুরু হয়। চলতে থাকে দিবাগত রাতে সুবহে সাদেক উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত। ১১ তারিখের মত ১২ তারিখেও তিন জামরাতে, একই নিয়মে, কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। জামরাতুল উলা ও জামরাতুল উস্তায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর কেবলামুখী হয়ে যথা সম্ভব দীর্ঘক্ষণ দোয়া করবেন। শেষ জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর হাত উঠিয়ে দোয়া করার বিধান নেই। তবে যদি ১২ তারিখেই কঙ্কর মারা শেষ করতে চান তবে বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর মনে মনে অথবা মুখে উচ্চারণ করে বলতে পারেন, ‘হে আল্লাহ এই হজকে হজে মাবরুর বানাও, ও গুনাহ ক্ষমা করে দাও’। ১২ তারিখ কঙ্কর মারার প্রথম ওয়াক্তে প্রচন্ড ভিড় থাকে। তাই একটু দেরি করে বিকালের দিকে যাবেন। ১২ তারিখেই কঙ্কর-নিক্ষেপ পর্ব শেষ করা যায়। তবে ১২ তারিখ দিবাগত রাতে মিনায় থেকে গিয়ে ১৩ তারিখ কঙ্কর নিক্ষেপ করতে পারলে ভালো। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] ১৩ তারিখে কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে,Ñযদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দুই দিনে চলে আসে তবে তার কোনো পাপ নেই। আর যদি কেউ বিলম্ব করে তবে তারও কোনো পাপ নেই, এটা তার জন্য যে তাকওয়া অবলম্বন করে। কোনো কোনো হজ কাফেলার নেতাদেরকে দেখা যায় যে তারা ১১ তারিখ মধ্য রাতের পর হাজি সাহেবদেরকে নিয়ে মিনা ত্যাগ করে চলে যান। রাতের বাকি অংশ মক্কায় যাপন করে পরদিন যোহরের পর মক্কা থেকে এসে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন ও আবার মক্কায় চলে যান। এরূপ করাটা রাসূলুল্লাহ [সা.] এর আদর্শের বিপরীত। বিশেষ অসুবিধায় না পড়লে এরূপ করা উচিত নয়। আর মিনায় রাত ও দিন উভয়টাই যাপন করা উচিত। কেননা মিনায় রাত্রিযাপন যদি ওয়াজিবের পর্যায়ে পড়ে থাকে তাহলে দিন যাপন সুন্নত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] দিন ও রাত উভয়টাই মিনায় যাপন করেছেন। ১৩ তারিখ কঙ্কর নিক্ষেপ ১২ জিলহজ মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে গেলে মিনাতেই রাত কাটাতে হবে এবং ১৩ তারিখ সূর্য ঢলে গেলে তিন জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করতে হবে। তবে যদি কেউ ১২ তারিখ সূর্যাস্তের যথেষ্ট সময় পূর্বে তাঁবু থেকে মিনা ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়, এবং অনিচ্ছাকৃত কোনো সমস্যার কারণে—যেমন বৃষ্টি-যানজট ইত্যাদি—মিনা থেকে বের হওয়ার আগেই সূর্য অস্ত যায় তাহলে মিনায় রাতযাপন করতে হবে না। মক্কায় ফিরে যাওয়া কঙ্কর নিক্ষেপ-পর্ব শেষ করে মক্কায় ফিরে যাবেন। দেশে ফেরা অথবা মদিনা গমনের আগ পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করবেন। এ সময় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় ও দোয়া জিকিরে মশগুল থাকবেন। এ সুযোগে দেশে নিয়ে আসার জন্য যমযমের পানি সংগ্রহ করে নেওয়া যায়। স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য সাধ্য-মত হাদিয়া-তোহফা যেমন জায়নামাজ, বোরকা, কুরআন তিলাওয়াতের ক্যাসেট ইত্যাদি ক্রয় করতে পারেন। বিদায়ি তাওয়াফ মক্কা ত্যাগের পূর্বে বিদায়ি তাওয়াফ আদায় করে নেবেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] বিদায়ি তাওয়াফ আদায় করেছেন ও বলেছেন, বায়তুল্লাহর সাথে শেষ সাক্ষাৎ না করে তোমাদের কেউ যেন না যায়। অন্য এক বর্ণনা অনুসারে, রাসূলুল্লাহ [সা.] ইবনে আব্বাস [রা.] কে বললেন, লোকদেরকে বলো, তাদের শেষ কর্ম যেন হয় বায়তুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ, তবে তিনি মাসিক স্রাব-গ্রস্ত নারীর জন্য ছাড় দিয়েছেন। বিদায়ি তাওয়াফের নিয়ম তাওয়াফের নিয়ত করে হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফের নিয়মে বায়তুল্লাহ সাত বার প্রদক্ষিণ করবেন। তাওয়াফ শেষে ইচ্ছে হলে মুলতাযামে চেহারা, বুক ও দুই বাহু ও দুই হাত রেখে আল্লাহর কাছে যা খুশি চাইতে পারেন। এরপর দু’রাকাত তাওয়াফের সালাত আদায় করবেন। সালাত শেষে যমযমের পানি পান করবেন। পান করার সময় আপনার যা খুশি আল্লাহর কাছে সওয়াল করবেন। বায়তুল্লাহ শরীফ থেকে বের হওয়ার সময় পশ্চাৎমুখী হয়ে বের হতে হবে বলে যে একটি কথা আছে, তা নিতান্তই কুসংস্কার। এরূপ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন। হজের ভুলত্রট্টটির ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গ হজের ভুলত্রট্টটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক. এহরামের বিধিনিষেধ বিষয়ক ভুল। দুই. হজের কার্যসমূহ পালনের ক্ষেত্রে ভুল।এহরামের বিধিনিষেধ বিষয়ক ভুলের ক্ষেত্রে কী করণীয় তা ওপরে উল্লেখ হয়েছে। হজকর্মসমূহে কয়েক প্রকার ভুল হতে পারে। ক. হজের কোনো ফরজ ছুটে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দিয়ে কাজ হবে না। বরং গোটা হজই পুনরায় আদায় করতে হবে যেমন, কারও যদি উকুফে আরাফা ছুটে যায় তাহলে পরবর্তীতে আবার হজ করা ব্যতীত এর ক্ষতিপূরণ হবে না। খ. হজের কোনো ওয়াজিব সম্পূর্ণ ছুটে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে দম জবেহ করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যেমন কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। বিনা ওজরে যদি কেউ কঙ্কর নিক্ষেপ ছেড়ে দেয়, তবে দম জবেহ করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। হজের কোনো ওয়াজিব আংশিক ছুটে গেলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর নিকট সদকা দিয়ে ক্ষতিপূরণ দিলে হয়ে যাবে। গ.হজের কোনো সুন্নত-মুস্তাহাব ছুটে গেলে দম জবেহ করে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। তবে অবজ্ঞা অবহেলা করে কোনো সুন্নত তরক করা উচিত নয়। যে কোনো প্রকার ভুল হলেই দম জবেহ করতে হবে, কথা এমন নয়। যিয়ারতে মদিনা মক্কার ন্যায় মদিনাও পবিত্র নগরী। মদিনার পবিত্রতা রাসূলুল্লাহ [সা.] স্বয়ং ঘোষণা করেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘হে আল্লাহ! ইব্রাহীম মক্কাকে পবিত্র হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, আর আমি এই দুই পাহাড়ের মাঝখানের জায়গা (মদিনা) পবিত্র বলে ঘোষণা করছি।’ মদিনা ইসলামের আশ্রয়ের স্থল, রাসূলুল্লাহ [সা.] ও তাঁর সাহাবাদের হিজরতের জায়গা। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস মিশে আছে মদিনার ধুলো-কণায়। পবিত্র কুরআনের অর্ধেক নাযিল হয়েছে মদিনায়। অধিকাংশ হাদিসের উৎসও মাদানি জীবনের নানা ঘটনা-অনুঘটনা। সে হিসেবে যিয়ারতে মদিনা ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে। মজবুত করতে পারে আমাদের বিশ্বাসের ভিত। আর হজের সফর যেহেতু মদিনায় যাওয়ার একটা বিরাট সুযোগ এনে দেয়- বিশেষ করে যারা বহির্বিশ্ব থেকে আসে তাদের জন্য- তাই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করাটাই বাঞ্ছনীয়। তবে যিয়ারতে মদিনা যাতে সুন্নত তরিকায় হয় এবং কোনো ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহ [সা.] এর অনুমোদন ও ইজাযতের বাইরে না যায় সে বিষয়টি ভালোভাবে নজরে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটি আসবে মদিনা গমনের উদ্দেশ্য নিয়ে। কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করা যাবে না, এ মর্মে হাদিসে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বুখারি ও মুসলিম শরীফে এসেছে, -তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করো না। মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববি) ও মসজিদুল আকসা। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, জাহেলি যুগের মানুষেরা তাদের নিজস্ব ধারণা মতে বিশেষ-বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্থানে গিয়ে নানা রকম প্রথা চালু করেছিল। তারা সে সব স্থানের জিয়ারতকে পুণ্যের কাজ মনে করত। মুসলমানরা যাতে উক্ত জাহেলি প্রথার অনুকরণ না করে সেজন্য রাসূলুল্লাহ [সা.] কেবল তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করা নিষেধ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় বরং কবর কেন্দ্রিক সকল উরস-উৎসব কঠিনভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এবং আমার কবরকে তোমরা উৎসবে পরিণত করো না।’ উৎসবে পরিণত করার অর্থ, কবর-কেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যার মধ্যে কবরকে উদ্দেশ্য করে সফর করাও শামিল। ‘তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো জায়গার উদ্দেশ্যে সফর করো না’ এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে অধিকাংশ মুহাক্কিক ওলামাগণ রাসূলুল্লাহ [সা.] এর কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় সফর করাকে অবৈধ বলেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি, আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ, আবু মুহাম্মদ আল জনী, কাজী আয়াজ কাজী হুসাইন প্রমুখ। ফতোয়ায়ে রশীদিয়াতেও একই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। সে হিসেবে মদিনা গমনের উদ্দেশ্য, কবর যিয়ারত হলে, তা শুদ্ধ হবে না। নিয়ত করতে হবে মসজিদে নববি যিয়ারতের। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] মসজিদে নববিতে সালাত আদায় বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। এক হাদিসে এসেছে, ‘আমার এই মসজিদে সালাত অন্য মসজিদে এক হাজার সালাত থেকেও উত্তম। তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘আমার এই মসজিদে সালাত অন্য মসজিদে এক হাজার সালাত থেকে উত্তম। তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত। আর মসজিদুল হারামে সালাত অন্য মসজিদে এক লক্ষ সালাতের চেয়েও উত্তম। শুধু এতটুকই নয় বরং মসজিদে নববির একটি অংশ জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান বলে ব্যক্ত করেছেন। বুখারি শরীফে এসেছে, ‘আমার ঘর ও মেম্বারের মাঝখানের জায়গা জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান। আর আমার মিম্বারটি আমার হাউজের ওপর।’ সে হিসেবে মসজিদে নববি যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় সফর করার নিয়ত করাটাই শরিয়ত-সিদ্ধ। মদিনার পথে রওয়ানা মসজিদে নববি যিয়ারতের নিয়ত করে আপনি মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। মদিনায় প্রবেশের সময় মদিনায় ইসলামের যে ইতিহাস বনেছে তা স্মরণ করবেন। মক্কার মতো মদিনাও পবিত্র। তাই মদিনায় গিয়ে যাতে আপনার দ্বারা কোনো বেয়াদবি না হয়, কোনো গুনাহ-পাপে লিপ্ত না হন, সে জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন। মদিনায় আপনার হোটেল বা বাসায় গিয়ে মালপত্র রেখে সামান্য বিশ্রাম করে নিন। এরপর মসজিদে নববিতে চলে যান। মসজিদে নববিতে যাওয়ার জন্য কোনো এহরাম তালবিয়া নেই। রাসূলুল্লাহ [সা.] এর ওপর দরুদ ও সালাত পড়ে-পড়ে যেতে হবে এ ব্যাপারেও কোনো হাদিস নেই। মদিনার গাছপালার ওপর নজর-পড়া-মাত্র অথবা সবুজ গম্বুজের ওপর দৃষ্টি-পড়া-মাত্র সালাত ও সালাম পড়তে হবে এ মর্মেও রাসূলুল্লাহ [সা.] ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোনো আদর্শ নেই। যারা এরূপ করতে বলেছেন তারা একান্তই আবেগতাড়িত হয়ে বলেছেন। উপযুক্ত দলিল ব্যতীত আবেগের যথেচ্ছ প্রয়োগের কারণেই ইসলামি শরিয়ত স্বচ্ছতা হারিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। মসজিদে নববিতে প্রবেশ যে কোনো দরজা দিয়ে মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতে পারেন। প্রবেশের সময় ডান পা আগে দিন। আল্লাহর নাম স্মরণ করুন। রাসূলুল্লাহ [সা.] এর প্রতি দরুদ পাঠ করুন। আল্লাহ যেন আপনার জন্য তাঁর রহমতের সমস্ত দরজা খুলে দেন সে জন্য দোয়া করুন। মসজিদে প্রবেশের পর, বসার পূর্বে, তাহিয়াতুল মাসজিদের দু’ রাকাত সালাত আদায় করুন। হাদিসে এসেছে, -তোমাদের মধ্যে যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন দু’রাকাত সালাত আদায়ের পূর্বে না বসে’। রাওজাতুল জান্নাতে—মসজিদের মেহরাবের কাছে সাদা ও সবুজ কার্পেট বিছানো জায়গা—আদায় করতে পারলে ভালো। কেননা রওজা শরীফ পবিত্রতম একটি জায়গা, জান্নাতের বাগান হিসেবে হাদিসে যার পরিচয় এসেছে। রওজায় জায়গা না পেলে যে কোনো স্থানে তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করুন। এরপর লাইন ধরে রাসূলুল্লাহ [সা.] এর পবিত্র কবরের দিকে এগিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ [সা.] ও তাঁর দুই সাথির কবর যিয়ারতের আদব ১. রাসূলুল্লাহ [সা.] এর পবিত্র কবরের সামনে এলে আদবের সাথে দাঁড়ান। দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলে চলমান অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ [সা.] এর প্রতি সালাম পেশ করুন, বলনু [আসসালামু আলাইকা ইয়া আইয়ূহান নাবী]‘ আপনার ওপর শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকতসমূহ বর্ষিত হোক হে আল্লাহর নবী’, রাসূলুল্লাহর গুণাবলির সাথে সংগতিপূর্ণ আরো কিছু শব্দ বাড়িয়ে দেয়া যাবে। ২. এরপর সামনের দিকে এক গজ পরিমাণ এগিয়ে যান। এখানে আবুবকর সিদ্দীক [রা.] এর প্রতি সালাম পেশ করুন। ৩. এরপর আরেক গজ সামনে আগান। এখানে ওমর [রা.] এর প্রতি সালাম পেশ করুন। এরপর বাইরে চলে আসুন। কেবলামুখী হয়ে বা কবরের দিকে মুখ করে দোয়া করবেন না। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘কবরের কাছে দোয়া করতে দাঁড়ানো আমি শুদ্ধ মনে করি না। তবে সালাম দেবে, ও চলে যাবে যেমনটি করতেন ইবনে ওমর [রা.]। ইমাম ইবনুল জাওযি বলেন, ‘দোয়া করতে কবরে যাওয়া মাকরুহ। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ একই মন্তব্য ব্যক্ত করে বলেন, ‘দোয়ার উদ্দেশ্যে কবরে যাওয়া মাকরুহ। দোয়ার জন্য কবরের কাছে দাঁড়ানোও মাকরুহ। তাই রাসূলুল্লাহ [সা.] ও তাঁর সাথীদ্বয়ের [রা.] কবরের কাছে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানো ও নিজের জন্য দোয়া করা উচিত নয়। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউই কবরের কাছে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য দোয়া করতেন বলে ইতিহাসে নেই। সাহাবাগণ, বরং, মসজিদে নববির যে কোনো জায়গায় দোয়া করতেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] এর হুজরা মুবারকের কাছে এসেও তাঁরা দোয়া করতেন না। ইমাম মালেক (রহ.) মদিনাবাসীদের জন্য, যতবার মসজিদে প্রবেশ করবে ততবার, রাসূলুল্লাহ [সা.] এর কবরে আসা ভালো মনে করতেন না। কেননা সালাফে-সালেহীনদের কেউই এরূপ করতেন না। তাঁরা বরং মসজিদে নববিতে আসতেন। আবুবকর, ওমর, উসমান ও আলী (রাদি আল্লাহু আনহুম) এর পেছনে সালাত আদায় করতেন। সালাতের মধ্যেই রাসূলুল্লাহর প্রতি সালাম পেশ করতেন। সালাত শেষে হয়তো বসতেন অথবা বের হয়ে চলে যেতেন। সালাম পেশ করার জন্য রাসূলুল্লাহ [সা.] এর কবরে আসতেন না। কেননা তাঁরা জানতেন যে সালাতের মধ্যে যে দরুদ ও সালাম পেশ করা হল তা অধিক উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ। সাহাবাগণ যখন নিজের অভাব অনটনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে চাইতেন, কেবলামুখী হয়ে মসজিদের ভেতর দোয়া করতেন। যেমনটি করতেন রাসূলুল্লাহ [সা.] এর জীবিত থাকা কালে। দোয়া করার জন্য হুজরা মুবারকের কাছে যেতেন না, কবরেও প্রবেশ করতেন না। সাহাবাগণ দূরদূরান্ত থেকে খুলাফায়ে রাশেদিনদের সাথে দেখা করতে এলে মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করতেন। সালাতের ভেতর রাসূলুল্লাহ [সা.] এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করতেন। মসজিদে প্রবেশ ও মসজিদ বের হওয়ার সময়ও সালাত ও সালাম পেশ করতেন। কবরের কাছে এসে সাধারণত সালাম পেশ করতেন না। কেননা এরূপ করতে রাসূলুল্লাহ [সা.] নির্দেশ করেননি। হাঁ, ইবনে উমর [রা.] সফর থেকে ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ [সা.] ও তাঁর সাথি-দ্বয়ের কবরে এসে সালাম পেশ করতেন। তবে অন্যান্য সাহাবা এরূপ করতেন না। রাসূলুল্লাহ [সা.] এর পবিত্র কবর যিয়ারতের সময় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ রাসূলুল্লাহ [সা.] এর পবিত্র কবর হুজরা শরীফের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই কবরের দেয়াল ছুঁয়ে বরকত নেয়ার জজবা অনেকের মধ্যে থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আসলে এ ধরনের জজবা-বাসনা থাকাই উচিত না। কেননা কবরের চার পাশে তাওয়াফ, কবর ছুঁয়ে বরকত নেয়া ইত্যাদি শরিয়তে অনুমোদিত নয়। রাসূলুল্লাহ [সা.] কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন যে তাঁর কবরকে যেন পূজ্য মূর্তিতে রূপান্তরিত করা না হয়। আর স্পর্শ ও চুম্বন করার বিধান তো কেবল হাজরে আসওয়াদের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কাবার রুকনে য়ামেনিও স্পর্শ করার বিধান রয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো জায়গা, এমনকী পবিত্র কাবার অন্য কোনো অংশ স্পর্শ করে বরকত নেয়ারও বিধান নেই। মুআবিয়া [রা.] একদা হজ করার সময় রুকনে শামি ও রুকনে গারবি অর্থাৎ কাবা শরীফের উত্তর পাশের দুই কোণ স্পর্শ করলেন। ইবনে আব্বাস [রা.] বিরোধিতা করলেন। এরূপ করা রাসূলুল্লাহ [সা.] এর বিধানে নেই, স্পষ্ট করে তিনি মুআবিয়া [রা.] কে বুঝিয়ে দিলেন। মুআবিয়া খলিফা থাকা সত্ত্বেও ইবনে আব্বাস [রা.] এর কথা মেনে নিলেন। হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে য়ামেনি ব্যতীত যদি পবিত্র কাবার অন্য কোনো অংশ স্পর্শ করা শরিয়ত বহির্ভূত কাজ হয়ে থাকে তবে অন্য কোনো জায়গা ছুঁয়ে বরকত নিতে যাওয়া যে বড়ো বেদআত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই কবরে ঘর্ষণ মর্দন, গন্ডদেশ ও বক্ষ লাগিয়ে বরকত নেয়ার ইচ্ছা করা হকপন্থী সকল মুসলমানদের কাছে অবৈধ। বরং এটা একপ্রকার শিরক। পবিত্র কাবার অনুমোদিত অংশ ব্যতীত অন্য কোনো অংশ মাসেহ করা, ছোঁয়া যদি পুণ্যের কাজ না হয়ে থাকে তাহলে হুজরার দরজা জানালা স্পর্শ করে কী কোনো পুণ্যের আশা করা যেতে পারে?। হুজরার দেয়াল ও দরজা-জানালা তো নির্মিত হয়েছে বহু পরে। রাসূলের মহব্বত কবরের দরজা-জানালা স্পর্শ করে নয় বরং যথার্থভাবে রাসূলের আনুগত্য-ইত্তেবার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে হয় রাসূলুল্লাহর মহব্বত ও তাজিম। বিপদমুক্তি অথবা কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ [সা.] এর কাছে প্রার্থনা করা যাবে না। বলা যাবে না যে হে আল্লাহর রাসূল আমাকে অমুক বিপদ থেকে মুক্ত করুন। অথবা আর্থিক স্বচ্ছলতা দান করুন। কেননা এজাতীয় কাজ করা শিরক। এজাতীয় দোয়া কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে খেতাব করেই করতে হয়। এরশাদ হয়েছে -এবং তোমাদের প্রতিপালক বললেন, আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা আমার ইবাদতের প্রতি দম্ভ প্রদর্শন করে তারা প্রবেশ করবে জাহান্নামে, অপদস্ত হয়ে। অন্য এক জায়গায় এরশাদ হয়েছে, -বলুন আমি আমার নিজের কোনো অকল্যাণের বা কল্যাণের মালিক নই, তবে আল্লাহ যা চান। রাসূলুল্লাহ [সা.] যখন নিজের কল্যাণের-অকল্যাণের মালিক নিজে নন, তাহলে তিনি অন্যদের কল্যাণ-অকল্যাণ কীভাবে সাধন করতে পারেন। গুনাহ মাফ করানোর জন্য রাসূলুল্লাহ [সা.] কে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলাও ঠিক নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (স) এর ওফাতের পূর্বে এরূপ করা যেতো কিন্তু ওফাতের পর এ ধরনের কোনো অবকাশ নেই। মৃত্যুর পর মানুষের সকল কাজ রহিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটি স্পষ্ট হাদিস রয়েছে। সূরা নিসার ৬৪ নম্বর আয়াত যেখানে আল্লাহ পাক বলেছেন— অর্থ : এবং যদি তারা স্বীয় জীবনের উপর অত্যাচর করার পর তোমার নিকট আগমন করত, তৎপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত, আর রাসূলও তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইত, তবে নিশ্চয় তারা আল্লাহকে তওবা কবুলকারী, করুনাময় প্রাপ্ত হত। -এ আয়তের সম্পর্ক রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশার সাথে। এ আয়াতের মধ্যে রাসূলুল্লাহর মৃত্যুর পরও গুনাহ মাফ করানোর জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করতে তাঁর কাছে আর্জি পেশ করার কথা উল্লেখ নেই। আরবি ভাষার ব্যবহার রীতি অনুযায়ী এখানে إذا ব্যবহার করলে ভবিষ্যৎ কালেও এ প্রক্রিয়াটি কার্যকর থাকত। কিন্তু এখানে إذا ব্যবহার না করে إذ ব্যবহার করায় প্রক্রিয়াটি অতীতকালের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। এর অর্থ, অতীতে, রাসূলুল্লাহ [সা.] এর জীবদ্দশায়, অন্যায় করে যদি কেউ আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চায়, এবং রাসূলুল্লাহও তাদের জন্য গুনাহ মাফ চান, তাহলে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহকে তাওবা গ্রহণকারী ও দয়াময় পাবে। নারীর কবর যিয়ারত নিয়ে বিতর্ক আছে। এক হাদিসে কবর যিয়ারতকারী নারীর প্রতি রাসূলুল্লাহ [সা.] অভিসম্পাত করেছেন। এই হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ইসলামি শরিয়তজ্ঞ ওলামাদের একদল নারীর কবর যিয়ারত, হোক তা রাসূলুল্লাহর কবর, অবৈধ বলেছেন। অপর পক্ষে অন্যদল বলেছেন বৈধ। তাদের মতে কবর যিয়ারত, পূর্বে, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই অবৈধ ছিল। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে যিয়ারতের অনুমতি দেন রাসূলুল্লাহ [সা.]। এ অনুমতি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ছিল বলে দাবি করেন তারা। বিতর্ক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উচিত হবে নারীদের কবর যিয়ারতে না যাওয়া। বিশেষ করে বর্তমান-যুগের সার্বিক পরিবেশ নারীর পক্ষে সহায়ক নয়। বরং ফিতনা ও অনিরাপত্তার আশঙ্কা দিন দিন আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। তাই নারীদেরকে করব যিয়ারত হতে নিরুৎসাহিত করাই হবে উত্তম। আর অনুমতি প্রদানের হাদিসে নারীদেরকে শামিল করা হয়েছে কি-না, তার পক্ষে কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। কেননা নারীদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা ‘লানত’ শব্দ দিয়ে এসেছিল। তবে কি নারীরা রাসূলুল্লাহ [সা.] এর প্রতি সালাম পেশ করবে না? হাঁ, অবশ্যই করবে। তবে তা কবরে গিয়ে নয়। যে কোনো জায়গা থেকেই করা যায়। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের ঘর-বাড়ি কবরে পরিণত করো না। আর আমার কবরকে উৎসবে পরিণত করো না। আমার জন্য তোমরা দরুদ পাঠ করো। তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছে, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন। মদিনা শরীফে অন্যান্য যিয়ারতের স্থান : জান্নাতুল বাকি জান্নাতুল বাকি আরবিতে বাকিউল গারকাদ পবিত্র মদিনার একটি কবরস্থান যেখানে, ইমাম মালিক (রহ.) এর কথা মতে, প্রায় দশ হাজার সাহাবা কবরস্থ আছেন। আহলে বাইতের অধিকাংশ সদস্য, আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, উসমান ইবনে মাজউন, আকীল ইবনে আবি তালিব ও খাদিজা [রা.] ও মায়মুনা [রা.] ব্যতীত রাসূলুল্লাহ [সা.] এর অন্যান্য স্ত্রীগণ, আব্দুর রহমান, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস প্রমুখ জলিলুল কদর সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) বাকিতে কবরস্থ আছেন। সে হিসেবে তাদেরকে সালাম দেয়া ও তাদের জন্য ইস্তিগফার ও দোয়া করার উদ্দেশ্যে জান্নাতুল বাকিতে যাওয়া শরিয়তসম্মত। বাকি’তে সমাহিত মুমিনগণের প্রতি সালাম দেয়ার সুন্নত তরিকা হলো অনির্দিষ্টভাবে সবাইকে একসাথে সালাম দেয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা। অনুরূপভাবে বাকি’র কবরস্থানে গিয়ে নিজের জন্য দোয়া করারও কোনো উদাহরণ রাসূলুল্লাহ [সা.] ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় না। কবরের কাছে গিয়ে দোয়া করা বরং শরিয়ত বহির্ভূত একটি কাজ যা সালাফে সালেহীনদের কেউ করেননি। কবরবাসীদের ওসিলা বানিয়ে দোয়া করা—অর্থাৎ এরূপ বলা যে হে আল্লাহ জান্নাতুল বাকিতে শায়িত বুজুর্গ ব্যক্তিদের উসিলায় আমাকে ক্ষমা করে দাওÑমারাত্মক ধরনের অপরাধ। তাই বাকিতে আবেগতাড়িত হয়ে কখনো এরূপ করবেন না। যেটুকুর অনুমতি হাদিসে আছে সে-টুকু করেই ক্ষান্ত হবেন। এতেই কল্যাণ ও বরকত রয়েছে। মসজিদে কুবায় সালাত আদায় একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে মসজিদে কোবা। পবিত্র মদিনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ [সা.] কর্তৃক নির্মিত প্রথম মসজিদ, মসজিদে কোবা। আল্লাহ পাক স্বয়ং এ মসজিদের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন ও এতে যারা সালাত আদায় করতেন তাদের প্রশংসা করেছেন। এরশাদ হয়েছে—-নিশ্চয়ই একটি মসজিদ যা তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রথম দিন থেকেই, অধিক হকদার যে আপনি তাতে (সালাত আদায় করতে) দাঁড়াবেন। এতে রয়েছে এমন ব্যক্তিগণ যারা পবিত্রতা অর্জনকে পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে পছন্দ করেন। আয়েশা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ [সা.] বনি আমর ইবনে আওফ গোত্রে দশ দিনের অধিক সময় অতিবাহিত করলেন। তিনি তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি নির্মাণ করলেন, ও তাতে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি আরোহণের জন্তুতে উঠে বসলেন। তিনি চলতে লাগলেন, লোকজনও তাঁর সাথে চলতে লাগল। একসময় উট মসজিদে নববির কাছে বসে পড়ল। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর [রা.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী [সা.] প্রতি শনিবার, পায়ে হেঁটে অথবা বাহনে চড়ে, মসজিদে কোবায় আসতেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] এর অনুসরণে ইবনে ওমর নিজেও অনুরূপ করতেন। অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার বাড়িতে পবিত্রতা অর্জন করল, অতঃপর মসজিদে কোবায় এল, এবং তাতে সালাত আদায় করল, এতে তার উমরার মতো ছোয়াব হল। উমামা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বের হয়ে এই মসজিদে এল, ও তাতে সালাত আদায় করল, সে এক উমরার সমপরিমাণ ছোয়াব পেল।’ মসজিদে কোবায় সালাত আদায়ের নিয়ম মসজিদে কোবায় গিয়ে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দেবেন। মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়বেন। মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করবেন। এ সালাতের আলাদা কোনো নিয়ত নেই। কেবল মনে মনে স্থির করবেন, আমি দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করছি। সালাত শেষ হলে মসজিদ হতে বের হওয়ার দোয়া পড়ে বাঁ পা আগে দিয়ে বের হয়ে যাবেন। এখানে অন্য কোনো আমল নেই। যিয়ারতে শুহাদায়ে উহুদ হিজরি দ্বিতীয় সালে উহুদযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন হামযা [রা.] সহ তাঁদের অনেকেই উহুদ প্রান্তরেই শায়িত আছেন। তাদের কবর যিয়ারত করা শরিয়তসম্মত। যিয়ারতের উদ্দেশ্য তাঁদের জন্য দোয়া করা, তাঁদের জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করা। জান্নাতুল বাকি যিয়ারতের সময় যে দোয়া পড়তে হয় সে দোয়া পড়েই যিয়ারত করবেন। যে কোনো দিন শুহাদায়ে উহুদের যিয়ারত করা যেতে পারে। বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবার নির্দিষ্ট করার বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। উল্লেখিত জায়গাসমূহ ব্যতীত অন্যান্য জায়গা যিয়ারতের কোনো বিধান নেই। সুন্নত অথবা মুস্তাহাব মনে করে যদি কেউ সেসব জায়গা যিয়ারত করতে যায় তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা বেদআত হবে। হাঁ যদি কেবলই দেখার উদ্দেশ্য হয়, ছোয়াব ইবাদত ও বরকত অর্জনের কোনো নিয়ত না থাকে, তবে কোনো অসুবিধা নেই। মদিনার কিছু কূপ রয়েছে যেগুলোর পানি তাবারুক হিসেবে নিয়ে আসার ব্যাপারে যে একটি কথা আছে তারও কোনো ভিত্তি নেই। কেননা সাহাবায়ে কেরামের কেউই দূরদূরান্তে যাওয়ার সময় কোনো পানি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। নিরাময়ের মাটিও সঙ্গে নেয়ার কোনো প্রমাণ নেই। বাড়ি প্রত্যাবর্তনের আদব প্রসঙ্গ বাড়ি প্রত্যাবর্তনের সময় রাসূলুল্লাহ [সা.] এর সুন্নতের যথাযথ পায়রবি করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে, রাসূলুল্লাহ [সা.] যে দ্বীনকে স্বচ্ছ-শুভ্র আকারে রেখে গেছেন তা প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি প্রয়োগের মনোবৃত্তি নিয়ে, কখনো কোনো কাজে যেন সুন্নতে রাসূল পরিত্যাগ না হয় সে ধরনের মানসিকতা নিয়ে মদিনা থেকে দেশে ফিরে আসবেন। দেশে ফেরার পূর্বে মসজিদে নববিতে দু’রাকাত বিদায়ি সালাত আদায় করা শরিয়তসম্মত নয়। হাদিসে ও সাহাবায়ে কেরামের কর্মে এ ধরনের কোনো সালাত পাওয়া যায় না। বিদায়ি যিয়ারত বলতেও কোনো কিছু নেই। বিদায়ের পূর্বে রওজা মুবারকে উপস্থিত হয়ে সালাম নিবেদন করে দ্বীন-দুনিয়ার প্রয়োজনের জন্য, হজ ও যিয়ারত কবুল এবং নিরাপদে দেশে ফেরার জন্য দোয়া করার ব্যাপারে কোনো কোনো বইয়ে যে পরামর্শ আছে তারও কোনো ভিত্তি নেই। এলাকাবাসীর করণীয় ইবনে ওমর থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে—তুমি যখন হাজির সাথে সাক্ষাৎ করবে তাঁকে সালাম দেবে, তাঁর সাথে মুসাফা করবে, ও তাঁকে তোমার গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলবে, তার ঘরে প্রবেশের পূর্বেই। কেননা তার গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। লিখেছেন : ড. মাওলানা মুহাম্মাদ শামসুল হক সিদ্দিক