ছবি সংগৃহীত

স্মৃতিকথা- "তিনি আমার বাবার বাবা"

অথই নীলিমা
লেখক
প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০১৩, ২৩:২০
আপডেট: ১৭ জুন ২০১৩, ২৩:২০

স্বচক্ষে এর আগে কখনও বাবাকে এমনভাবে কাঁদতে দেখিনি আমি। হাসতে দেখেছি, দুঃখিত হতে দেখেছি, কখনো কখনো রাগতে, ক্ষুব্ধ হতে দেখেছি, ভীষণ রাগে চেঁচামেচিও করতে দেখেছি। কিন্তু কাঁদতে দেখিনি। অবশ্য কাঁদতে না দেখলেও বাবার কান্নার শব্দ শুনেছিলাম একবার, টেলিফোনে। সেবারও মাসটা ছিল আগস্ট। ২০০৬ সাল। রাহমান চাচু তখন কোমাতে। মোবাইলের ওপাশ থেকে ভেসে আসা বাবার বেদনার্ত নিঃশ্বাসের শোঁ শোঁ শব্দ আজো আমার কানে গেঁথে আছে। হ্যাঁ, বাবা ভেঙ্গে পড়েছিলেন। দূর থেকেও বুঝতে পারছিলাম তাঁর চোখের নিচে কালি জমেছে, চুলগুলো হয়ে আছে স্বাভাবিকের চেয়ে বড্ড বেশি এলোমেলো, নাওয়া-খাওয়ার চিন্তা পর্যন্ত মাথায় আসছেনা তাঁর, সমস্ত বোধ জুড়ে রয়েছেন কেবলই কবি শামসুর রাহমান। অদ্ভুত এক ভেঙ্গে পড়া, ডুবন্তপ্রায় মানুষের মতো আকুল কণ্ঠে বাবা আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, “ অথই, তোমার রাহমান চাচা হয়ত চলেই যাচ্ছেন...” সে সময় মা –আমি দুজনেই রাজশাহীতে। পরীক্ষার ঝামেলায় ঢাকা যেতেও পারিনি, অনেকটা একা একাই বড় ভাইসম মানুষটার চলে যাওয়ার সময়টা পার করেছিলেন বাবা। রাহমান চাচুর কোমায় থাকা, অতঃপর মৃত্যু-বাবাকে যেমনটা বিধ্বস্ত করেছিল তা স্বচক্ষে না দেখলেও অনুভব করতে পারছিলাম নিয়মিত ফোনালাপে। কষ্ট হচ্ছিলো ভীষণ। মনেপ্রাণে চাচ্ছিলাম বাবাকে এতোটা বিধ্বস্ত যেন আর কোনোদিন দেখতে না হয় আমাকে, কিন্তু বিধির লিখন, আবারো দেখতে হল। মাসটা একই- আগস্ট। তবে সালটা ভিন্ন। ২০১২| আইসিইউএর ওপাশে এবার বাবার ভাই নয়, ছিলেন বাবা। আমার দাদা। ডঃ মুঃ সিরাজউদ্দিন। আমি বাবাকে এতোটা বিষণ্ণ যেমন আগে দেখিনি, দাদাকেও এতোটা দুখি মনে হয়নি আগে কখনও। ইউনাইটেড হসপিটালের আইসিইউতে দাদা ভরতি তখন। ঢাকায় পৌঁছানর পর বাবা যখন আমাদের নিতে আসলেন, বাবাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম! এ কি হাল হয়েছে বাবার! চোখ লাল, চোখের নিচে কালি, মাথার চুলগুলো যেন আগের চেয়ে কিছুটা বেশি সাদা, শার্ট কুঁচকান, যেন নিজের যত্ন নেয়না বহুদিন। সিগারেটে সিগারেটে এসট্রে ভর্তি, আর ঘর ভরতি বিষণ্ণতায়। কি ভীষণ দমবন্ধ পরিবেশ! আমি ঘরের জানালা খুলে দিতে দিতে শুনতে পেলাম কানের কাছে মায়ের অশ্রুসিক্ত ফিসফিস, তোর বাবা অনেক ভেঙ্গে পড়েছে রে। শুধু কি বাবা? ভেঙ্গে তো পড়েছে মাও, মার চেহারার দিকে তো তাকানো পর্যন্ত যাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে কি যে দশা করেছে মা, যে কোন কিছু মুখে দিতে গেলেই বলে উঠছে, “আব্বা এই রান্নাটা কতই না পছন্দ করেন। বাবাটা আইসিইউতে, আমি খাই কি করে?” প্লেট সরিয়ে রাখেন।বাবা আরেকটা সিগারেট ধরান টেনশন দূর করতে।আর আমার মাথার ভেতরটা ফাঁকা মনে হয়। কী হঠাৎ করেই না এতোসব ঘটে গেলো! বিশ্বাস হতে চাইছিল না। ঢাকা আসবার কিছু পূর্বে দাদার সংবাদটা পেয়েছি। একই হাসপাতালে ভরতি দাদীও, কিন্তু দাদার ভর্তি হওয়াটা ছিল অপ্রত্যাশিত। আমি মনকে শক্ত করছিলাম, আশা করছিলাম এই ভেবে যে, দাদা-দাদীর কিচ্ছু হবে না। প্রতিবারের মতো এবারো সুস্থ হয়ে তাঁরা ফিরবেন বাড়িতে। কিন্তু সেদিন, মাস্ক, এপ্রোন, গ্লাভস পড়ে যখন আইসিইউ তে ক্ষণিকের জন্য ঢুকবার পারমিশন পেলাম, মনটাকে আর আমি শক্ত রাখতে পারলাম না। শক্ত রাখবই বা কেমন করে? ওই তো দেখতে পাচ্ছি আমার সাধাসিধে শান্ত মিতভাষী ভালো মানুষ দাদাটা অসহায়ের মতন শুয়ে আছেন আইসিইউ এর একটা বিছানায়, চোখ খুলতে তো পারছেন কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না।যদিও ঠিকই চিনতে পারলেন আমাকে দেখে। আমি আস্তে আস্তে তাঁর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম। মনে মনে একটানা নিজের উদ্দেশেই বলতে লাগলাম- অথই কাঁদবি না, দাদার সামনে একদম কাঁদবি না, অভয় দিবি, দাদা কে অভয় দিবি। অনেক কষ্টে চোখটাকে আটকে রাখলাম, দাদাকে বললাম, “দাদা, তুমি ভালো হয়ে যাবে, একটু শক্ত হও।” কিন্তু আমার চিরসবুজ দাদাটাকে দেখলাম একটু হলেও ভেঙ্গে পড়েছেন, চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি, চোখ দিয়ে কি যেন একটা বুঝাতে চাইছেন আমাকে। দাদার দৃষ্টির সেই গভীরতা আমার বোধবুদ্ধিকে যেন তলিয়ে দিলো, ঘোলাটে হয়ে গেলো মাথার ভেতরটা, মনে হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো যেন দাদা নিজেও জেনে গিয়েছেন যে আর বেশিদিন নেই। আমি দাদার হাতটা চেপে ধরি। বুঝতে পারিনা কেন- কাকে অভয় দেবার জন্য, দাদাকে নাকি নিজেকেই? জানিনা। তবু চেপে ধরি। জোরে জোরে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ঠিক হয়ে যাবে। দাদী ঠিক হয়ে যাবে। সামনে ঈদ, আমরা তোমাদের সাথে ঈদ করবো। তুমি মায়ের রান্না পায়েস দিয়ে ঈদের দিন শুরু করবে। আমরা সব ভাইবোনরা মিলে তোমাকে ঘিরে দাঁড়াবো। সালাম করবো। ছোটবেলার মত কার বেশি সালামী হল তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করবো। সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক... নার্স আমাকে বাইরে নিয়ে এলো। আইসিইউতে বেশিক্ষণ থাকা নিষেধ। এরপর মা ঢুকবে, সব শেষে বাবা। দাদার হাত ছেড়ে দিতে হল আমাকে। দরজা দিয়ে বেরোবার সময় একবার পেছন ফিরে দেখে নিলাম তাঁকে। স্বল্প দৃষ্টিশক্তি সত্ত্বেও তিনি তাকিয়ে আছেন আমার চলে আসার পথের দিকে। দাদাকে জীবিত সেই আমার শেষ দেখা। দাদা এতো নাজুক হয়ে গেলেন কি করে? আমি ভাবতে বসি। তাঁর তো এতো সহজে ভেঙ্গে পড়বার কথা না! আমার দাদা তো আমার দেখা সবচাইতে শক্ত মানুষ। জীবনে কোনোদিন তাঁর চোখে আমি জল দেখিনি। ঠিক আমার বাবার মতই। বছর কয়েক আগে দাদার যখন কোলনে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল, ভেঙ্গে যাননি তখনও। নিজের দুর্বলতাকে তখনও লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। মনে আছে, যখন আমরা বলছিলাম, “দাদা কিচ্ছু ভাববে না, ডাক্তার তো বলেইছেন ফার্স্ট ষ্টেজ, অপারেশন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” দাদা বলেছিলেন, “হ্যাঁ সোনা, তোদের দোয়াতে সব ঠিক হয়ে যাবে।” যদিও আমাদের মধ্যে যে অদ্ভুত এক লুকোচুরি খেলা চলছিল তা জানতাম সবাই। জানতাম যে আমরা চিন্তিত, মর্মাহত, কিন্তু কেউ কাউকে তা জানাতে দিতে চাইতামনা। কেউ চাইতাম না অপরজন দুঃখ পাক, দাদার সামনে তাই আমরা, ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনীরা অভয় দেই, দাদা দেন আমাদের অভয়। তবু কি শক্ত মনোবল! এমনকি আলমারি খুলে তাঁর স্বর্ণপদকটা যা কি না তিনি আমার অনার্সের রেজাল্টের জন্য তুলে রেখেছিলেন সেটাও আগাম দিয়ে বসলেন আর আমি দাদাকে সান্ত্বনা দেব কি নিজেই কেঁদে আকুল হলাম আর দেখা গেলো দাদা নিজেই আমাকে আদর করে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আর বলছেন, “তোরা আছিস না? আমার কিচ্ছু হবেনা, তবু একটু অনিশ্চয়তা তো থেকেই যায়, তাই পদকটা এখনি তোর হাতে দিয়ে দিলাম, আমি জানি তুই অনেক ভালো করবি। বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন?” না, দাদার সেবার কিচ্ছু হয়নি, দাদা ক্যান্সারমুক্ত হয়ে ফিরে আসবার পর আমরা আবার দেখতে পেলাম সেই শক্ত ঋজু ব্যক্তিত্বশীল দাদাকে, যিনি আবারো আমাদের সাথে হেসে হেসে কথা বললেন, একসাথে টিভি দেখলেন, অনার্সে আমার ৪ এলো না কেন এই ভেবে দুঃখে ভারাক্রান্ত হলেন। তাহলে আজ কেন? আজ, এই ২০১২ তে, মাত্র বছর দুয়েকের মাথায় দাদা এমন নাজুক হয়ে গেলেন কিভাবে? আমি ভেবে কূল পাইনা, মা কাঁদতে কাঁদতে আইসিইউ থেকে দাদাকে দেখে বের হয়ে আসে, আমি পাশের ইউনিটে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় থাকা দাদীর প্রশ্নবাণে জর্জরিত হই, দাদীর হাত-পা ছোট্ট শিশুর মতো রুগ্ন হয়ে গেছে, কিছু খেতে পারেন না, নার্সদের নিবিড় পরিচর্যায় আছেন তিনি ২৪ ঘণ্টা কিন্তু আমাকে দেখবার পর তাঁর ১০ টা কথার মধ্যে ৮টা কথাই হল দাদাকে নিয়ে, তোর দাদা কেমন আছেন? ডাক্তার কি বলছেন? ডাক্তার আশা দিচ্ছেন তো? দাদা তাকাতে পারছেন? চিনতে পারছেন? কবে ভালো হয়ে উঠবেন? আমি আঁতিপাঁতি করে দাদীর প্রশ্নের উত্তর হাতড়াই, খারাপগুলো লুকিয়ে ভালো সংবাদ গুলো দেই। দাদা চোখ খুলতে পারছেন। আগের দিনের চেয়ে ভালো আছেন। তুমি চিন্তা করোনা দাদী। তুমি নিজের যত্ন নাও। ঠিকমত খাও। নার্সরা চেষ্টা করে দাদীকে হাসিখুশি রাখার। পারেনা। আর আমি অভিনয় করি। দাদীকে অভয় দেই। কেবিন থেকে বেরিয়ে মাকে অভয় দেই। বাবাকে অভয় দেই। ভালো ভালো কথা বলি। নিজের চোখের পানি আটকে রাখি। কিন্তু নিজেকে অভয় দিতে পারি না।চোখ থেকে দাদার চোখের সেই চিকচিক পানির ছবি দূর হয়না। বাবার মতো আমিও উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ি। বাড়ি ফিরবার পথে ২ ২ টা ট্র্যাফিকজ্যামে পড়েও বিরক্ত হইনা। তাকিয়ে দেখি কাঁচের ওপারের শহর। পাশের গাড়ির মেয়েটা ওর দাদুর সাথে বেরিয়েছে। খুব হাসি ঠাট্টা করছে দাদু-নাত্নি মিলে। আমার হিংসে হয়। চোখ ফেরাই। এফ এম রেডিও কানে দেই। কোন এক চ্যানেলে গম্ভিরা গান হচ্ছে। নানা-নাতি। আবারো অস্থির লাগে। ইয়ারফোন খুলে ফেলি। দাদা... তুমি কেমন আছো দাদা? তুমি ঠিক হয়ে যাও, আমার জন্য না হোক, আমার দাদিটার জন্য। তোমার একমাত্র ছেলেটার জন্য। মেয়েগুলোর জন্য। এতোগুলো নাতিনাতনির জন্য। নাতির ঘরের পোতা-পুতি ইউশরা কিংবা আহনাফের জন্য। ফিরে আসো দাদা ফিরে আসো। দাদা ফিরে আসেন না। আমরা ফিরে আসি, বাসায়। পরের দিন রাজশাহীতে ফিরি, পরীক্ষা সামনে আমার তখন। বাবা ভেঙ্গে পড়েছে। রোজা শুরু হয়েছে ততদিনে। সামনে ঈদ। কিন্তু আমাদের মনে আনন্দ নেই। দাদা অসুস্থ- দাদাকে ছাড়া ঈদ ভাবাই যায় না। বাবার চোখের কালি বড় হয়েছে। ফোনে কথা বললে উদ্বিগ্নভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাড়ি ফিরলেই বাবার মনে হয় এক অদ্ভুত একাকীত্ব তাঁকে চেপে বসেছে। অন্ধকার ঘিরে ফেলছে চারিদিক। বাবা চায় কিছুদিন রাজশাহী ঘুরে যেতে। দাদীকে বাসায় নেয়া হয়েছে। দাদা তখনও আইসিইউতে। বাবার মন ভারী হয়ে আসে। নিজ বাবাকে হারানোর অজানা আশঙ্কা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমার বাবাকে তখন। এক পর্যায়ে আর পারে না, ২ দিনের জন্য রাজশাহীতে চলে আসে বাবা। চেহারার দিকে আর তাকানো যায় না। আমার এতো বড় বাবাটা যেন একদম শিশু হয়ে গেছে। আমাকে কাছে এনে বসিয়ে দাদার গল্প বলতে শুরু করে। এমন এমন সব গল্প, যা শুনিনি আগে কোনোদিন। বিশেষ করে ’৭১ এর গল্পটা শুনে গর্ব অনুভব করি দাদার জন্য। বাবা বলতে থাকেন- "একাত্তরের এপ্রিল মাস। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। কিন্তু তার বজ্রচেরা ডাকে সাড়া দিয়ে যার যা আছে তাই নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাঙালি। আবার পাক হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক তাণ্ডবে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ও গোটা জাতি। শহর ছেড়ে গ্রামে-গঞ্জে পালাচ্ছে নিরস্ত্র মানুষ। ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোয় বাড়ছে স্বদেশত্যাগী মানুষের ভিড়। সীমান্তের ঐ পারে শুরু হচ্ছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিও। এইসময় বন্দি নেতা মুজিবকে প্রেরণারউৎস মেনে মুজিবনগর সরকারগঠনের উদ্যোগ নেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তখনও সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ভারতে পাড়ি জমাতে পারেননি। ঢাকা থেকে পালিয়ে তিনি তখন পৈতৃক জেলা কিশোরগঞ্জের একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। মুজিবনগর সরকার গঠন হচ্ছে শুনে সৈয়দ নজরুলের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফ এবং ছাত্র লীগ নেতা আব্দুল হামিদ দ্রুত একটি জিপ নিয়ে কিশোরগঞ্জ রওনা হলেন। উদ্দেশ্য: ঐ জিপেই সৈয়দ নজরুলকে দ্রুত ভারতে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু পথেই জিপের জ্বালানি তেল গেল ফুরিয়ে। পাকহানাদার বাহিনীর বর্বরতা তখন ঢাকা ছাড়িয়ে বাংলার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পথে-পথে পেট্রোল পাম্পগুলোও বন্ধ। সৈয়দ আশরাফ ও আব্দুল হামিদের কাছে খবর এল কয়েক মাইল দূরে কলকাতাপাড়ায় আছেন সৈয়দ নজরুলের ভাইঝি-জামাই আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহম্মদ সিরাজউদ্দিন।" “প্রফেসর সিরাজউদ্দিন... মানে দাদা?????” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি। বাবা বলেন, “হ্যাঁ।তোমার দাদাও তখন ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। সঙ্গে তার ফোর্ড কর্টিনা গাড়িটি ছাড়াও সঞ্চয়ে দুই জেরিক্যান পেট্রোল আছে। পত্রপাঠ ছাত্র লীগের দুজন কর্মীকে পাঠানো হল কলতাপাড়ায়। বিস্তারিত শুনে প্রফেসর সিরাজউদ্দিন তার গাড়ির জন্য রাখা জ্বালানি তেলের সবটুকুই ওদের হাতে তুলে দিলেন। বললেন, “আমি ভাগ্যবান। আমার সামান্য সঞ্চয় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অসামান্য কাজে লাগতে যাচ্ছে। দেরি কোরো না, তোমরা এখনি রওনা হও।” দাদা তো কোনোদিন এ কথা আমাদের কাছে বলেননি! আমি বিস্মিত হই। বাবা বলেন, “দেরিতে তো জেনেছি আমিও। গল্পটি তোমার আতাউল করিম চাচুর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাধর্মী বই থেকে নেওয়া। রাস্কিনের একটা প্রবাদতুল্য কথা আছে :"The best men those who have done the greatest good to humanity are those, that we don't know of"। আব্বা ঠিক সেইরকম একজন ‘নিভৃতিচারী সেরা মানুষ। ” বাবা আপন মনে তাঁর বাবার গল্প বলতে থাকেন, আমি আর মা শুনে যাই। শুনতে শুনতে কখনও হাসি, কখনও কাঁদি। বাবা বাবার স্মৃতির ভাণ্ডার খুলেন তো মা তাঁর। মাঝে মাঝে আমিও দাদাকে ঘেরা স্মৃতিগুলো ঝালাই করি। ছোটবেলায় আমরা ভাইবোনেরা মিলে দাদার পাশে গোল হয়ে বসতাম। দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ওয়ালম্যাটের ছবি নিয়ে দাদা দারুন একটা গল্প বানিয়েছিলেন। শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল সবার গল্পটা, কিন্তু তারপরও বারবার শুনতে চাইতাম। আমাদের সাথে দাদার ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। ছিল তাঁর অদ্ভুত এক চিরসবুজ মন। তাঁর চেস্ট অফ ড্রয়ার ছিল আমাদের গুপ্তধনের খনি। সেই ছেলেবেলাতেই তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন পয়সা জমানো। সালামির যে কয়টা টাকা পেতাম, আমরা ভাইবোনেরা দাদার সেই ঘরোয়া ব্যাঙ্কে জমা রাখতাম। দাদা সযত্নে সেগুলো গোপন ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখতেন। টাকা জমা/ওঠানোর সময় আমাদের আবার আসল ব্যাঙ্কের মতই নিয়ম মেনে সই দিতে হতো। আমি আবার ছিলাম একটু বেশি সচেতন, আমার টাকা যেন ব্যাঙ্ক ডাকাতি না হয়ে যায় সেজন্য সইয়ের পাশাপাশি কলম দিয়ে ইয়া লম্বা চওড়া একটা গার্ডের ছবি এঁকে দিতাম। যে কিনা ডাকাতদের হাত থেকে আমার জমানো পয়সা রক্ষা করবে। কি ছেলেমানুষি, কিন্তু কতই না নিটোল, আনন্দময়! আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে বড় আপু (চুমকি আপু) প্রায়ই জমানো টাকা তুলে নিয়ে পুতুল কিনত। মেজ আপু (রুমকি আপু) ছিল সবচেয়ে সঞ্চয়ী (এবং এখনও! মজার ব্যাপার রুমকি আপু নিজেই এখন ব্যাঙ্কে চাকরি করেন, বেশ ভালো পোস্টে) আমার অবস্থা ছিল সো-সো, দুইজনের মাঝামাঝি। বছর কয়েক আগে মেজ ফুপি যখন দাদা-দাদিকে অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন দাদা আমাদের সবার একাউন্তের টাকা আমাদের দিয়ে দিয়েছিলেন। জমাবইটাও। এতো বড় হয়ে যাওয়ার পরও আমরা সেবার সেই পিচ্চিবেলার মতো জমা বই তে সই করে (এবং আমি আমার সেই কাল্পনিক গার্ডকে ছুটি দিয়ে) টাকা তুলেছিলাম। আচ্ছা, এভাবে কি জীবনটাও সঞ্চয় করে রাখা যায়না? আমি ভাবি। যদি এমন হতো, আমার প্রাণটা ভাগাভাগি করে কিছুটা দাদাকে দেয়া যেত! দাদা তাহলে জলদি সুস্থ হয়ে উঠতেন,ঈদের দিন দাদা দাদী ফুপু ফুপা ভাই বোন সবাইকে নিয়ে আমরা প্রতিবারের মতো আনন্দ করতে পারতাম! এমনটা হয় না কেন? মোবাইলের শব্দে আমার চিন্তায় ছেদ পড়ে। বাস্তবতা যেন এক ঝটকায় স্মৃতির জগত থেকে আমাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে। মোবাইলের ওপাশের কথা শুনতে পাই না, শুধু শুনতে পাই বাবা কাঁদছেন। আমি বাবাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখিনাই। বাবা কাঁদছেন। মোবাইল হাতে নিয়ে বাবা কাঁদছেন। মা কাঁদছেন। আমি বেভুলের মতো একবার বাবা একবার মা এর দিকে তাকাই। সব তাহলে শেষ হয়েই গেলো? সব সব কিছু... ক্যালেন্ডারে তখন ৩০ রমজান, ১৯ আগস্ট ২০১২। আমি বাবাকে আগে কোনোদিন এভাবে শিশুর মতো হয়ে যেতে দেখিনি। সেদিন দেখলাম। ঢাকা যাওয়ার পথে সারাটা পথ বাবাকে দেখলাম। মাকে দেখলাম। খুব কাছের কেউ মারা যাওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগে কেবল একবারই হয়েছে, ফুপাত ভাই সাবিতের মৃত্যুর সময়।১৯৯৩ সালে। মাত্র সাড়ে ৩ বছরেই চলে গিয়েছিল ব্লাড ক্যান্সারের শিকার আমার ছোট্ট মিষ্টি ভাইটা। আমি নিজেও তখন ছোট ছিলাম বলে হয়তো মৃত্যুর কষ্টটা সেভাবে বুঝতে পারিনি। তারপর বহু বছর গড়িয়ে গেছে। সাবিত এতদিন একা ছিল। এখন দাদাও তাঁর কাছে চলে গেলেন। সন্ধ্যাবেলা যখন বনানী সেনা নিবাস কবরস্থানে পৌঁছুলাম, দাদাকে সবে মাত্র সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে তখন। সাবিত সেখানেই আছে। দাদা সাবিতের কাছে এলেন। আমরাও এলাম। আমরা সবাই। ফুপা, ফুপি, বাবা, ভাই বোন সবাই। সাবিতও। দাদাও। সবাই সবাই আবার একসাথে। সাবিত, আমরা এসেছি। তোমার নানাভাইকে নিয়ে। নানার সব আদরে এখন কেবল তোমার একার ভাগ। নানাকে দেখে রেখ, সাবিত... সাবিত... দাদার মুখটা শেষবার যখন দেখলাম তখন এক মুহূর্তের জন্য যেন ভুলেই গেলাম যে আমার দাদাটা আর বেঁচে নেই। সেদিনো কি তরতাজা সেই মুখখানি, কি স্নিগ্ধ, কি শান্ত! মনে হয় যেন এখনি কথা বলে উঠবেন, আদর করে ডাকবেন, ‘অথই...” কিন্তু বললেন না। চুপ করে থাকলেন। কী ভীষণ চুপ, কী ভীষণ নীরবতা! ঠিক তাঁর লেখা সেই কবিতাটির মত- "আমি যদি তোমার সাথে কথা বন্ধ করি তাইলে কিন্তু ভীষণ মজা হয় কথা- সে তো কথাই কেবল তাও তো খারাপ লাগে, কথা সে তো কথার কথা নয়।" দাদীর লেখনীর সাথে পরিচয় বহুবার হলেও দাদার কবিতার সাথে পরিচয় সেই একবারই- ১৯৯৩ সালে। আমার "পড়াখেলা"র জন্য লেখা চাইলে দাদা এই কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন। তারপর বহুবছর কেটে গেছে। "পড়াখেলা"য় ছাপার অক্ষরে দাদার এই কবিতাটি পড়তে গিয়ে কস্মিনকালেও কি ভেবেছিলাম, আর মাত্র ১৯ বছর পরেই দাদা আমাদের সবার সাথে চিরতরে কথা বন্ধ করে দেবেন? আমার চোখের সামনে ওরা দাদাকে কবরে শোয়ালো, আমরা অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকলাম- দাদা কথা বললেন না। যেমনটা বলেননি আই সি ইউ তে থাকার সময়ও। সারা শরীরে কষ্ট নিয়ে চলেছেন, তবু কোনোদিন একটা অভিযোগ পর্যন্ত করেননি। এমনকি শেষ যেদিন কিছুটা ভালো ছিলেন, আমার বাবাকে বলেছিলেন, "আমার মনে হয় চলে যাওয়াই ভালো। মিছিমিছি তোদের অনেক কষ্ট দিচ্ছি।" আমার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসছিল। বাবা উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে বেড়াচ্ছিলেন, কাঁদছিলেন।একসময় শান্ত হলেন, কবরে শোয়ালেন দাদা কে। বাবা কাঁদলেন... ভীষণ কাঁদলেন। উদ্ভ্রান্ত হলেন। বিধ্বস্ত হলেন। আবার কাঁদলেন। আবার... বাবাকে, বাবার বাবাকে এতোটা নাজুক হতে আমি আগে কোনোদিন দেখিনাই... দাদার মৃত্যুর কিছুদিন পর আমাকে লেখা একটা খোলা চিঠিতে বাবা লিখেছিলেন, “... গত ১৯ আগস্ট ২০১২ তারিখে আমরা তাকে চিরদিনের মতো হারিয়েছি। দু বছর আগের এক ভোরেও আমি তাকে একইরকম হারিয়েছিলাম। তবে সেটা ছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। আবার ফিরেও পেয়েছিলাম। এবার সেই গল্পও শোনাই তোমাকে। তুমি জানো, তোমার দাদা মিতভাষী মানুষ। তবু সেদিন তিনি স্মৃতিমেদুর গলায় ফেলে আসা জীবনের অনেক গল্প করেছিলেন ছেলের সঙ্গে। বাবা-ছেলের সেই ভাববিনিময়ের কথা আমার অপ্রকাশিত দিনলিপিতে আছে। তোমার জন্য নিচে তুলে দিচ্ছি: ২৩ জুন ২০১০ : রাতজেগে আর্জেন্টিনা বনাম গ্রিসের খেলা দেখায় ভোরে উঠতে পারিনি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে-সুরে লেকপাড়ে হাঁটতেও বেরইনি। বাবা-মা’র খোঁজ নিতে ফোন করেছিলাম সকালে। মা ধরলেন। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন না আমাকে। তাই বাবাকে ডাকছিলেন। ‘ও সাহেব, ও সাহেব’ বলে মা ডেকেই চলেছেন, বাবার সাড়া নেই। ফোনের এ প্রান্তে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। কিছু হয়নি তো বাবার! বেঁচে আছেন তো তিনি! মিনিট দুয়েক ডাকাডাকির পর সাড়া পাওয়া গেল। স্বস্তিতে ভরে গেল বুক। আজ বারিধারায় গিয়ে বাবার মুখে তার ফেলে আসা জীবনের গল্প শুনে এলাম। প্রধানত ছাত্রজীবনের। বাবার বাবা মানে আমার দাদা ফজলুর রহমান ছিলেন সাধারণ গেরস্ত। স্বচ্ছলতা তেমন না-থাকলেও বিদ্যার প্রতি বিস্তর অনুরাগ ছিল তার। বাবার মামা মেহের বক্স তালুকদার ছিলেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত দারোগা। বগুড়ায় থাকতেন। পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলেকে তার কাছেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দাদা। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণী গাইবান্ধার জ্ঞানদায়িনী মিডিয়াম ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন আমার বাবা। পঞ্চম শ্রেণীতে প্রাইমারি বৃত্তি পেয়েছিলেন। মুজিববাদ বইয়ের লেখক খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন বাবার স্কুলজীবনের সহপাঠী। একই বৃত্তি তিনিও পেয়েছিলেন। এরপর তিন বিষয়ে লেটার এবং স্টার মার্ক নিয়ে গাইবান্ধা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন বাবা। ১৯৪৩ সালে। বৃহত্তর বাংলা তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত। তার মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ টাকা আর কলেজের ৭ টাকা মোট ২৩ টাকা সম্বল করে বাবা কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। তখন ম্যাট্রিক-ইন্টারমিডিয়েট সব পরীক্ষাই হত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। বঙ্গবাসী কলেজের কারমাইকেল হোস্টেলে বাবার ফ্রি বোর্ডিংএর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। বাবা বরাবরই কম কথার মানুষ। বঙ্গবাসী কলেজের দিনগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ছোট্ট করে বললেন-- ‘খুব কষ্ট করে চলতাম।’ বঙ্গবাসী থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর তিনি ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্স করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বোটানি ও জুলোজি তখনও আলাদা বিভাগ হয়নি-- একসঙ্গে বায়োলজি। ঐ বিভাগের প্রথম ব্যাচের ফার্স্ট কাস ফার্স্ট বাবা। বাবার জীবনের পথচলা ছিল পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কবিতার সেই বিখ্যাত চরণটির মত-- ‘যে যাবে অনেক দূর, তাকে বলি, ধীর পায়ে হাঁটো’ ধীর পায়ে হেঁটেছিলেন বলেই অস্বচ্ছলতার বাধা উজিয়ে বাবা নিঃশব্দে দূরের পথ পাড়ি দিতে পেরেছিলেন। তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে চরম অর্থনৈতিক অনিরাপত্তার মধ্যে। তাই একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সরকারি কলেজে শিকতার সুযোগ পেয়ে দ্বিতীয়টিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি ৩০ টাকা বেশি বেতন আর অধিকতর নিরাপত্তার কারণে। সেটা পঞ্চাশ দশকের শুরুর কথা। চাকরিসূত্রে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরতে হয়েছে বাবাকে। পঞ্চাশ দশকের শেষপ্রান্তে, তিনি যখন রাজশাহী সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন, তখন পদ্মাপাড়ের ঐ শহরটিতে আমার জন্ম। আমার জন্মের বছর তিনেক পর বাবা পিএইচ.ডি করতে বিলেত যান। চার বছর পর ফিরে এসে ফের রাজশাহী কলেজে যোগ দেন। ঐসময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগেও পার্টটাইম শিক্ষকতা করেছেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনকালে শামসুজ্জোহা যেদিন শহীদ হন, বাবাও ছিলেন ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিবাদমিছিলে। ইচ্ছে ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও সরাসরি অংশ নেওয়ার। সেই উদ্দেশ্যে আমাকে ও আমার মেজবোন সুরমাকে নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম গাবরগাঁতী পর্যন্ত পৌঁছেওছিলেন। কিন্তু স্ত্রী ও বাকি সন্তানরা সময়মতো সেখানে পৌঁছতে না-পারায় সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হন। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিস্তর কাজ করেছেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ এর মার্চ পর্যন্ত বাবা ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার অব্যাহতি আগে ঐ কলেজে একই দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। এরপর বাবা কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং বাংলাদেশ স্কুল টেকস্টবুক বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যান্ডস কমিশনে কাজ করেন। পরিচালক পদে। এরপর কয়েক বছর একটি শিক্ষা বিষয়ক বেসরকারি সংস্থায়। আদর্শ শিক্ষক তো তিনি ছিলেনই, কর্মজীবনে বাবার সততা ও নিষ্ঠাও ছিল সর্বজনপ্রশংসিত। যে-সব প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন, আজও সেগুলোয় তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ছেলেবেলায় বাবা স্বপ্ন দেখতেন, বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। বিভিন্ন প্রতিকূলকতার কারণে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি তার। তাই পিতৃপ্রতিম স্নেহে ছোট ভাইকে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন। সাধ ছিল, একমাত্র ছেলেকেও বড় ডাক্তার হিসেবে দেখে যাবেন জীবনে। এই সাধটিই শুধু পূরণ হয়নি তার (এক বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেও আমি আর ঐ পথ মাড়াইনি বলে)। অথই সোনা, তোমার ফেসবুক কভারে তুমি দাদার সঙ্গে তোলা তোমার একটা ছবি দিয়েছ। ঐরকম ছবি তুমি চাইলেও আর তুলতে পারবে না। ... তুমি মেধাবী ছাত্রী বলে দাদার বিশেষ স্নেহ পেয়েছ। নিজের মেধার সর্বোচ্চ স্বীকৃতিস্বরূপ পাওয়া সোনার মেডেলটাও তিনি তোমাকেই উপহার দিয়ে গেছেন। আমি নিশ্চিত, ঐ মেডেল তোমাকে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ারে কবিতার সেই পংক্তিটির ভাষায় দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার প্রেরণা জোগাবে-- “যে যাবে অনেক দূর, তাকে বলি, ধীর পায়ে হাঁটো।” এবার দাদার সঙ্গে তোমার মধুর স্মৃতিগুলোর কথা ভেবে মুখে একটু-একটু করে হাসি ফিরিয়ে আনো। প্রায় একবছর হতে চলল দাদা নেই, তবু আমরা বেঁচে আছি। কি নিষ্ঠুর স্বার্থপর আমরা! কি নিষ্ঠুর! কবি মণীন্দ্র রায় বুঝি সেই জন্যই লিখেছিলেন- “যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে, দু হাতের উল্টোপিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়।”