ছবি সংগৃহীত

সুরা নং- ০০৪ : সুরা আন-নিসার শানে নুজুল

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ০৪ মার্চ ২০১৪, ১৬:৩৩
আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৪, ১৬:৩৩

নামকরণ, নাজিল হওয়ার সময়-কাল, নাজিল হওয়ার কারণ ও আলোচ্য বিষয় এবং শানে নুজুল

নামকরণ : তখনকার সময় নারী ও এতীমরা অবহেলিত ছিল, তাদের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার নিমিত্তে উক্ত সূরা অবতীর্ণ হয়। এই সুরার মাঝে নারী বিষয়ক আলোচনা রয়েছে এবং সেই বিবেচনায় এই সুরার নাম নিসা রাখা হয়েছে। নাজিল হওয়ার সময়-কাল ও বিষয়বস্তু : এ সূরাটি কয়েকটি ভাষণের সমষ্টি । সম্ভবত তৃতীয় হিজরীর শেষের দিক থেকে নিয়ে চতুর্থ হিজরীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম হিজরীর প্রথম দিকের সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন অংশ নাজিল হয়। যদিও নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না, কোন আয়াত থেকে কোন আয়াত পর্যন্ত একটি ভাষণের অন্তরভুক্ত হয়ে নাজিল হয়েছিল এবং তার নাযিলের সময়টা কি ছিল, তবুও কোন কোন বিধান ও ঘটনার দিকে কোথাও কোথাও এমন সব ইংগিত করা হয়েছে যার সহায়তায় রেওয়ায়াত থেকে আমরা তাদের নাযিলের তারিখ জানতে পারি। তাই এগুলোর সাহায্যে আমরা এসব বিধান ও ইংগিত সম্বলিত এ ভাষণগুলোর মোটামুটি একটা সীমা নির্দেশ করতে পারি। যেমন আমরা জানি উত্তরাধিকার বন্টন ও এতিমদের অধিকার সম্বলিত বিধানসমূহ ওহোদ যুদ্ধের পর নাজিল হয়। তখন সত্তর জন মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনাটির ফলে মদীনার ছোট জনবসতির বিভিন্ন গৃহে শহীদদের মীরাস কিভাবে বন্টন করা হবে এবং তারা যেসব এতিম ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন তাদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরি ভিত্তিতে আমরা অনুমান করতে পারি, প্রথম চারটি রুকু, ও পঞ্চম রুকূর প্রথম তিনটি আয়াত এ সময় নাজিল হয়ে থাকবে। যাতুর রিকা’র যুদ্ধে ভয়ের নামায (যুদ্ধ চলা অবস্থায় নামায পড়া) পড়ার রেওয়ায়াত আমরা হাদীসে পাই। এ যুদ্ধটি চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়। তাই এখানে অনুমান করা যেতে পারে, যে ভাষণে (১৫ রুকূ) এ নামাযের নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে সেটি এরি কাছাকাছি সময়ে নাজিল হয়ে থাকবে। চতুর্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মদীনা থেকে বনী নযীরকে বহিষ্কার করা হয়। তাই যে ভাষণটিতে ইহুদীদেরকে এ মর্মে সর্বশেষ সর্তকবাণী শুনিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আমি তোমাদের চেহারা বিকৃত করে পেছন দিকে ফিরিয়ে দেবার আগে ঈমান আনো, সেটি এর পূর্বে কোন নিকটতম সময়ে নাজিল হয়েছিল বলে শক্তিশালী অনুমান করা যেতে পারে। বনীল মুসতালিকের যুদ্ধের সময় পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর এ যুদ্ধটি পঞ্চম হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই যে ভাষণটিতে (৭ম রুকূ) তায়াম্মুমের কথা উল্লেখিত হয়েছিল সেটি এ সময়ই নাজিল হয়েছিল মনে করতে হবে। নাজিল হওয়ার কারণ ও আলোচ্য বিষয় : এভাবে সামগ্রীক পর্যায়ে সূরাটি নাজিল হওয়ার সময়-কাল জানার পর আমাদের সেই যুগের ইতিহাসের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়া উচিত। এর সাহায্যে সূরাটি আলোচ্য বিষয় অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে সে সময় যেসব কাজ ছিল সেগুলোকে তিনটি বড় বড় বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। এক, একটি নতুন ইসলামী সমাজ সংগঠনের বিকাশ সাধন। হিজরাতের পরপরই মদীনা তাইয়েবা ও তার আশেপাশের এলাকায় এ সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের পুরাতন পদ্ধতি নির্মূল করে নৈতিকতা, তামাদ্দুন, সমাজরীতি , অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা নতুন নীতি-নিয়ম প্রচলনের কর্মতৎপরতা এগিয়ে চলছিল। দুই, আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদী গোত্রসমূহ ও মুনাফিকদের সংস্কার বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে ইসলামের যে ঘোরতর সংঘাত চলে আসছিল তা জারী রাখা। তিন, এ বিরোধী শক্তিগুলোর সকল বাধা উপেক্ষা করে ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকা এবং এ জন্য আরো নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সেখানে ইসলামকে বিজয়ীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করা। এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে যতগুলো ভাষণ অবতীর্ণ হয়, তা সবই এই তিনটি বিভাগের সাথে সম্পর্কিত। ইসলামের সামাজিক কাঠামো নির্মাণ এবং বাস্তবে এ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম অবস্থায় যে সমস্ত নির্দেশ ও বিধানের প্রয়োজন ছিল সূরা বাকারায় সেগুলো প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে এ সমাজ আগের চাইতে বেশী সম্প্রসারিত হয়েছে। কাজেই এখানে আরো নতুন নতুন বিধান ও নির্দেশের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য সূরা নিসার এ ভাষণগুলোতে মুসলমানরা কিভাবে ইসলামী পদ্ধতিতে তাদের সামাজিক জীবনধারার সংশোধন ও সংস্কার সাধন করতে পারে তা আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে পরিবার গঠনের নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। বিয়েকে বিধি-নিষেধের আওতাধীন করা হয়েছে। সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। এতিমদের অধিকার নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মীরাস বন্টনের নিয়ম-কানুন নির্ধারিত হয়েছে। অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘরোয়া বিবাদ মিটাবার পদ্ধতি শিখানো হয়েছে। অপরাধ দণ্ডবিধির ভিত গড়ে তোলা হয়েছে। মদপানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তাহারাত ও পাক-পবিত্রতা অর্জনের বিধান দেয়া হয়েছে। আল্লাহ ও বান্দার সাথে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষের কর্মধারা কেমন হতে পারে, তা মুসলমানদের জানানো হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে দলীল সংগঠন-শৃংখলা প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। আহলি কিতাবদের নৈতিক, ধর্মীয় মনোভাব ও কর্মনীতি বিশ্লেষণ করে মুসলমানদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন পূর্ববর্তী উম্মতদের পদাংক অনুসরণ করে চলা থেকে বিরত থাকে। মুনাফিকদের কর্মনীতির সমালোচনা করে যথার্থ ও খাটিঁ ঈমানদারীর এবং ঈমান ও নিফাকের পার্থক্য সূচক চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে রেখে দেয়া হয়েছে। ইসলাম বিরোধী শক্তিদের সাথে যে সংঘাত চলছিল ওহোদ যুদ্ধের পর তা আরো নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল। ওহোদের পরাজয় আশপাশের মুশরিক গোত্রসমূহ, ইহুদী প্রতিবেশীবৃন্দ ও ঘরের শক্র বিভীষণ তথা মুনাফিকদের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলমানরা সবদিক থেকে বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিকে আবেগময় ভাষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করলেন এবং অন্যদিকে যুদ্ধাবস্থায় কাজ করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। মদীনায় মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকেরা সব ধরনের ভীতি ও আশংকার খবর ছড়িয়ে হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। এ ধরনের প্রত্যেকটি খবর দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার এবং কোন খবর সম্পর্কে পুরোপুরি অনুসন্ধান না করার আগে তা প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার নির্দেশ দেয়া হয়। মুসলমানদের বারবার যুদ্ধে ও নৈশ অভিযানে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় তাদের এমন সব পথ অতিক্রম করতে হতো যেখানে পানির চিহ্নমাত্রও পাওয়া যেতো না। সে ক্ষেত্রে পানি না পাওয়া গেলে ওযু ও গোসল দুয়ের জন্য তাদের তায়াম্মুম করার অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়াও এ অবস্থায় সেখানে নামায সংক্ষেপে করারও অনুমতি দেয়া হয়। আর যেখানে বিপদ মাথার ওপর চেপে থাকে সেখানে সালাতুল খওফ ( ভয়কালীন নামায) পড়ার পদ্ধতি শিকিয়ে দেয়া হয়। আরবের বিভিন্ন এলাকায় যেসব মুসলমান কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং অনেক সময় যুদ্ধের কবলেও পড়ে যেতো, তাদের ব্যাপারটি ছিল মুসলমানদের জন্য অনেক বেশী পেরেশানির কারণ। এ ব্যাপারে একদিকে ইসলামী দলকে বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া হয় এবং অন্যদিকে ঐ মুসলমানদেরকেও সকদিক থেকে হিজরাত করে দারুল ইসলামে সমবেত হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ইহুদীদের মধ্যে বিশেষ করে বনী নাযীরের মনোভাব ও কার্যধারা অত্যন্ত বিরোধমূলক ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তারা সব রকমের চুক্তির খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করে ইসলামের শক্রদের সাথে সহযোগীতা করতে থাকে এবং মদীনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে। তাদের এসব কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরকে সর্বশেষ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়া হয় এবং এরপরই মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কারের কাজটি সমাধা করা হয়। মুনাফিকদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে। কোন্ ধরনের মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করা হবে, এ সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাই এদের সবাইকে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে বিভক্ত করে প্রত্যেক শ্রেণীর মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তা বলে দেয়া হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ নিরপেক্ষ গোত্রসমূহের সাথে মুসলমানদের কোন ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তাও সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। মুসলমানদের নিজেদের চরিত্রকে ক্রটিমুক্ত করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এ সংঘাত সংঘর্ষে এ ক্ষুদ্র দলটি একমাত্র নিজের উন্নত নৈতিক চরিত্র বলেই জয়লাভ করতে সক্ষম ছিল। এ ছাড়া তার জন্য জয়লাভের আর কোন উপায় ছিল না । তাই মুসলমানদেরকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তাদের দলের মধ্যে যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে কঠোর ভাষায় তার সমালোচনা করা হয়েছে। ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের দিকটিও এ সূরায় বাদ যায়নি। জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলাম দুনিয়াকে যে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক সংশোধনের দিকে আহবান জানিয়ে আসছিল, তাকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করার সাথে সাথে এ সূরায় ইহুদী, খৃস্টান ও মুশরিক ও তিনটি সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা-বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তাদের সামনে একমাত্র সত্য দীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়েছে। আয়াতভিত্তিক শানে নুজুল আয়াত-১ : তখনকার লোকেরা অনাথ এতীমের ধন সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করত না এবং মহিলাদের সাথে আচার-ব্যবহারে ধীর নীতি অবলম্বন করত এবং তারা দারুণ অবহেলিত ছিল। তাই প্রত্যেকেই যে একই মূল হতে আগত এবং একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সন্তান হওয়ার কথা স্মরণ করে দিয়ে পরস্পরের মধ্যে সৎভাব জাগিয়ে তোলার জন্য এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আয়াত-২ : গাতফান গোত্রে এক লোক তার আপন পিতৃহারা ভাতিজির অভিভাবক ছিল। ভাতিজি সাবালিকা হয়ে চাচার নিকট হতে সম্পদ ফেরত চাইলে সে দিতে অস্বীকার করল। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি হুজুর (সা.)-এর দরবারে পেশ করা হলে তখন মালামালসমূহ ফেরত দেয়ার আদেশ সম্বলিত এ আয়াত নাজিল হয়। আয়াত-৩ : আয়াতটি একাধিক স্ত্রী বিবাহের অনুমতি দেয়ার জন্য অবতীর্ণ হয়নি। কারণ এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব থেকেই তা হালাল ছিল। রাসূল (সা.)-এর তখনও একাধিক বিবি বর্তমান ছিলেন। মূলতঃ যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিল তাদের এতীম সন্তানদের একটি সুন্দর সামাজিক ব্যবস্থাই এর উদ্দেশ্য। এ ছাড়া আয়াতটিতে স্ত্রীদের সংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ আয়াতের মাধ্যমে একত্রে চার জনের বেশি স্ত্রী গ্রহণ অবৈধ করে দেয়া হয়েছে। আয়াত-৭ : জাহিলিয়াতের যুগে নারী ও শিশুদেরকে মীরাসের কোন অংশ দেয়া হত না এবং বলা হত, ‘যারা শক্রর সাথে মোকাবেলায় সক্ষম কেবল তারাই মীরাসের হকদার। ইসলামের আর্বিভাবের পর মুসলমানদের মধ্যে হযরত আউছ ইবনে সাবেতের ইন্তেকাল হলে তার সম্পদ তাঁর চাচাত ভাই- সুওয়াইদ, খালেদ ও আরফজা দখল করে নেয় এবং ইবনে সাবেতের ছোট ছোট দুই কন্যা, এক ছেলে এবং এক স্ত্রীর কাকেও কিছুই দিল না। তখন তাঁর বিধবা স্ত্রী উম্মে কুহাহ্ রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), আমার স্বামী ইবনে সাবেত জঙ্গে ওহুদে শহীদ হন। তাঁর তিনটি ছোট ছোট সন্তান আছে। এ দিকে তাঁর পরিত্যাজ্য সমুদয় সম্পদ তাঁর চাচাত ভাইয়েরা দখল করে নিয়েছে। এখন বলুন এ সন্তানদের লালন-পালন কি করে করি? তখন আলোচ্য আয়াতটি নাজিল হয়। আর সঙ্গে সঙ্গে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) র্আফজা ও ছুওয়াইদকে ডেকে ইবনে সাবেতের যাবতীয় সম্পদ যথাপূর্ব রেখে দিতে বললেন এবং এতে যে নারীদেরও অংশ আছে তা বলে দিলেন। কিন্তু পরিমাণ তখনও জানা ছিল না। পরে আয়াত দ্বারা পরিমাণ জানান হলে মীরাস সংক্রান্ত বিধান পূর্ণ হয়ে যায়। (বয়ানুল কোরান) আয়াত-১১ : হযরত জাবের থেকে বর্ণিত, হযরত ছা’আদ ইবনে রুবীর পতœী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! এ কন্যাদ্বয় ছা’আদের, তাঁদের পিতা ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান। এদের চাচা ছা’আদের পরিত্যক্ত সমুদয় সম্পদ দখল করে নিয়েছে। এখন বলুন, আমি এ কন্যাদ্বয়কে নিয়ে কি করতে পারি এবং বিবাহ শাদীই বা কি করে দিতে পারি? তখন অত্র আয়াতটি নাজিল হয়। আয়াত-১৯ : জাহিলিয়াত যুগের প্রথা ছিল, কেউ মারা গেলে তার অন্য পরিবারের পুত্র বা কোন নিকটতম আত্মীয় তার স্ত্রীকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিত। এর মাধ্যমে সে তাকে আপন করায়ত্তে নিয়ে গেল- সে ইচ্ছা করলে মৃত স্বামীর মহরের উপর বিবাহ করতে পারত অথবা অন্যের নিকট বিবাহ দিতে পারত, অথবা এমনিতে বন্দী করে রাখত। এ প্রথা অনুসারে হযরত আবু কুবাইছের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী কুবাইসাহ্ বিনতে মা’আনকে তাঁর প্রথম পরিবারের ছেলে কুবাইস তাদের চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। তৎপর সে তার কোন খোঁজ খবর নেয় না। তখন আবু কুবাইসের স্ত্রী হুজুর (সা.)-এর নিকট এ ফরিয়াদ নিয়ে গেলেন। হুজুর (সা.) তাঁকে আল্লাহর কি আদেশ হয় তার প্রতীক্ষায় থাকতে আদেশ দিলেন। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। আয়াত-২২ : হযরত আবু কুবাইসের মৃত্যুর পর বর্বর যুগের নিয়মানুসারে তার প্রথম পরিবারের ছেলে মুহসেন যখন আপন বিমাতা, কুবাইসের স্ত্রীকে বিবাহ করতে চাইল, তখন বিমাতা বলল, হে মুহসেন! আমি তোমাকে পুত্রবৎ মনে করি, তবে কি তুমি মাতুল্য রমণীর সঙ্গে এরূপ করতে চাও, এটি তো খুবই অসঙ্গত। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এই ঘটনার বিবরণ শুনালেন। তখন এ আয়াতটি নাজিল হয়। আয়াত-২৪ : তাওতাছ যুদ্ধে কাফেরদের স্ত্রী-মেয়েদের যখন মুসলমানদের নিকট হাযির করা হল, তখন মুসলমানরা তাদের সাথে মিলনের বৈধতার ব্যাপারে সন্দেহ করতে লাগল। সন্দেহের কারণ হল, যেহেতু তারা পর স্ত্রী এবং পতিবতিœ বা সধ্বা। উক্ত সন্দেহ অপনোদনের জন্য আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং পতিবতিœ উক্তরূপ যুদ্ধবন্ধিদের সাথে মিলন করা বৈধ হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। ২. হযরত আবু মা’মর হাযরমী হতে বর্ণনা করেন, অনেকে মোহর নির্ধারণ করত বটে, কিন্তু পরে অভাব অনটনে পড়লে তা শোধ করার ক্ষমতা রাখত না। এ প্রেক্ষিতে অত্র আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আয়াত-৩২ : একদা হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর খেদমতে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! নারী-পুরুষদের মধ্যে মীরাছী সম্পদ বন্টনে এবং আরও অন্যান্য বিষয়ে যে বৈষম্য রয়েছে তা রহিত করে সমতার বিধান করা হলে ভাল হত। তখন এ আয়াতটি নাজিল হয়। অন্য রিওয়াতে আছে যে, একদা এক নারী হুজুর (সা.)-এর নিকট বললেন, নারীরা মীরাছী সম্পদে যেমন অর্ধেক সম্পদের মালিক হয় আমলের ক্ষেত্রেও কি তারা অর্ধেক ছওয়াবের অধিকারী হবে? তখন এ আয়াতটি নাজিল হয়। উভয় শানেনুযূলের সমন¦য় হল- “আর তোমরা এমন কোন বিষয় কামনা করও না” বলে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)-এর প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়। অর্থাৎ ঐসব কিছু আল্লাহ্র ইচ্ছাধীন, সেখানে অন্য কারও কোন ক্ষমতা চলবে না। আয়াত-৩৬ : আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা সকল আদম সন্তানকে এটাই বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের এ শ্রেষ্ঠত্ব কেবমলমাত্র পার্থিব। পারলৌকিক শ্রেষ্ঠত্ব যখন মূল বিষয় তখন এতে ভিন্ন রূপও ধারণ করার সম্ভাবনা আছে, যাতে মুনিব থেকে চাকর, স্বামী থেকে স্ত্রী, আমীর থেকে গরীব আপন আপন কর্মফলের ভিত্তিতে অগ্রগামী হয়ে যাবে। তাই এখানে পারলৌকিক ফায়দার কথা বর্ণনা করেছেন, যা মুখ্য উদ্দেশ্য ও আসল শ্রেষ্ঠত্ব! এ প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা দুটি শক্তির সংশোধনের উপর নির্ভর করে- প্রথমটি হল দৃঢ় বিশ্বাস ভিত্তিক আর দ্বিতীয়টি হল আমলী বা কর্ম ভিত্তিক। প্রথমটির সংশোধনের জন্য বলা হয়েছে- আল্লাহর একক সত্তায় বিশ্বাস স্থাপন করে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদতে রত থাকার কথা। আর দ্বিতীয়টির সংশোধনের নিমিত্ত নয়টি আদেশ দেয়া হয়েছে। প্রথম- মা-বাবার প্রতি অনুগ্রহশীল হওয়া এবং তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করা। দ্বিতীয় সকল আÍীয়-স্বজনের সাথে মর্যাদানুসারে বৈষম্যহীন আচরণ করা। তৃতীয়- অনাথ ও এতীমদের স্বার্থে কাজ করা। চতুর্থ- দরিদ্র ও দুঃস্থ মানবের কল্যাণ করা। পঞ্চম- নিকটতম প্রতিবেশীদের সাথে সদাচরণ করা। ষষ্ঠ- দূরের প্রতিবেশীদের সাথে অমায়িক ব্যবহার করা। সপ্তম-সঙ্গী সাথীদের সাথে সদ্ব্যবহার করা। অষ্টম- পথিক ও মুসাফিরদেরকে সঙ্গত ও রুচি সম্মত আপ্যায়ণ করা। নবম- নিজের দাস -দাসীদের সাথে কল্যাণজনক আচরণ করা। আয়াত-৩৭ : হযরত ইবনে আব্বাস ও ইবনে যাইদ, হাই ইবনে আখতাব, রেফা’আ ইবনে যাইদ, ইবনে তাবুত, উছামা ইবনে হাবীব, নাফে এবং বাহার ইবনে আমর ইত্যাদি কতিপয় ইহুদী সম্বন্ধে এ আয়াতটি নাজিল হয়। তারা জনৈক আনসারীর নিকট আসা যাওয়া করত এবং বলত-“এভাবে তোমার ধন-সম্পদ ব্যয় করে ফেলও না, পাছে তুমি দরিদ্র হয়ে যাও, এ আশঙ্কা হয়। তখন যে অবস্থার সম্মুখীন হবে তা তুমি খণ্ডাতে পারবে না। আর কারও মতে আয়াতটি সেসব ইহুদী সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়, যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গুণাবলী ও পরিচয় বর্ণনায় বখিল অর্থাৎ তা গোপন করার চেষ্টা করত। আর হযরত সায়ীদ ইবনে যাইদ (রাঃ) বললেন, আলোচ্য আয়াতটি আল্লাহর হুকুম গোপন করার উপর ভর্ৎসনার্থে নাজিল হয়। আয়াত-৪৩ : একদা হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) তার গৃহে হযরত আলী (রাঃ)-সহ কয়েকজন সাহাবীকে দাওয়াত করেন। খাওয়ার পর মদ পান শুরু করল, কেননা, তখনও শরাব পান হারাম ছিল না। তাঁরা নেশায় থাকা অবস্থায় মাগরিবের আযান হল এবং হযরত আলী (রাঃ) কে ইমাম দাঁড় করালেন। তিনি নেশার মধ্যে সূরাটি পাঠ করতে তথাকার কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়েই শেষ পর্যন্ত পাঠ করার ফলে তৌহীদের বিপরীত অর্থই হয়ে যায়। এ ব্যাপারেই উক্ত আয়াতটি নাজিল হয়। আয়াত-৪৮ : যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদী আলেম সম্প্রদায়কে আহ্বান করে বলেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর এবং ইসলাম কবূল কর। কেননা, তোমরা সম্যক অবগত আছ যে, পবিত্র-এ কোরআন ও বিধানাবলী মহান প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে তোমাদের হেদায়েতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। এতদ্ব্যাতীত আল্লাহ তা‘আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি অবতীর্ণ কিতাব তাওরাতেও আমার সম্পর্কে তোমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। ইহুদীরা হিংসার বশবর্তী হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গুণাবলী ও পবিত্র কোরআন সম্পর্কে অবহিত নয় বলে জানিয়ে দেয়। তখন অত্র আয়ত অবতীর্ণ হয়। সময় থাকতে আÍরক্ষার সুযোগ গ্রহণ কর, পবিত্র কোরআনের প্রতি ঈমান আন এবং তাওরাতে বর্ণিত নির্দেশাদির সত্যতা ঘোষণা কর। -( ইযাহুল কোরআন)। আয়াত-৫১ : ওহুদ যুদ্ধের পর ইহুদী নেতা কা’আব ইবনে আশরাফ ৭০ জন সঙ্গীসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোরাইশদেরকে যুদ্ধের জন্য খেঁপিয়ে তোলার মানসে মক্কাভিমুখে যাত্রা করল। কা’আব আবুসুফিয়ানের গৃহে আর অন্যান্য ইহুদীরা অন্যান্য কোরাইশদের গৃহে অবস্থান নিল। কোরাইশরা ইহুদীদের বলল, তোমারাও কিতাবী এবং মুহাম্মদও কিতাবী। অতএব, বিচিত্র নয় যে, তোমরা উভয়ে মিলে একটি ছল-চাতুরী করছ। সুতরাং তোমরা যদি চাও যে, আমরাও তোমাদের সাথে একত্রিত হয়ে যুদ্ধে অগ্রসর হই। তবে তোমরা প্রথমে আমাদের প্রতিমাকে সেজদা কর। কা’আব বলল, তোমরা তো নিজেদের আÍ-সান্ত্বনা দিলে, আমরাও তোমাদের প্রতি তখনই পরিতুষ্ট হব যখন আমাদের ৩০ জন এবং তোমাদের ৩০ জন সম্মিলিতভাবে এ কা’বা গৃহের প্রাচীর ধরে তার মালিকের নামে শপথ করবে যে, আমরা সকলে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকব। কোরাইশরা কা’আবের এ প্রস্তাব গ্রহণ করল। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে কোরাইশ কাফেররা ইহুদীদের জিজ্ঞেস করল যে, কারাই বা হিদায়েতের উপর আছে? কা’আব বলল, তোমাদের ধর্মের পরিচয় দাও। আবু সুফিয়ান নিজেদের ধর্মের কিছু ব্যাখ্যা দান করে বলল, মুহাম্মদ স্বীয় পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করে কা’বা হতে পৃথক হয়ে গিয়েছে। তখন কা’আব বলল, তোমরাই উত্তম। এ প্রেক্ষিতে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আয়াত-৬৯ : একদা কয়েকজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আবেদন করলেন, মৃত্যুর পর জান্নাতের মধ্যে আপনার যে উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আসন হবে সেখান পর্যন্ত পৌঁছা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে? তখন আমরা আপনার সাথে কেমন করে সাক্ষাত করে ধন্য হতে পারব। আর যদি সাক্ষাতই না হয়, তবে বিরহ যাতনায় সান্ত্বনাই বা কিরূপে লাভ করব। এমনকি এ চিন্তা ভাবনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আযাদকৃত গোলাম হযরত ছৌবান (রাঃ) এর চেহারা বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাঁর এই বিষণ্নাবস্থা লক্ষ্য করলেন তখন তিনি তাঁর কোন রোগ-শোক হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে হযরত ছৌবান (রাঃ) উক্ত চিন্তা-ভাবনার কথা পেশ করলেন। তখন আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আয়াত-৭১ : মুজাহিদরা জেহাদের উদ্দেশে রওয়ানা হলে মুনাফিকরা বিভিন্ন অজুহাতে সরে পড়ত এবং যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তারা বলত আমরা তো যাওয়ার জন্য প্রস্তুতই ছিলাম কিন্তু অমূক কাজে নিয়োজিত থাকায় একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, এদিকে আপনারা চলে গিয়েছেন। অনন্তর মুসলমানদের উপর কোন বিপদ আপতিত হলে বলত আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা যুদ্ধে যাই নি। আর মুসলমানরা বিজয়ী বেশে গণীমতের মাল নিয়ে ফিরলে তারা এ মর্মে পরিতাপ করতে থাকত যে, হায়। আমরাও এদের সাথে যুদ্ধে শরীক হলে গণীমতের মালের ভাগী হতে পারতাম। সাধারণতঃ উল্লেখিত অবস্থা মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়েরই বৈশিস্ট্য ছিল, তাই আয়াতটি তার সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়। (রঃ কোঃ) আয়াত-৭৭ : কাফেররা মুসলমানদেরকে নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগলে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ, মিক্কদাদ্ ইবনে আছওয়াদ, সা’আদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস এবং ক্বুদামা ইবনে মযউন (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যখন মুশরিক ছিলাম তখন সকলেই আমাদের সম্মান করত, কেউ আমাদের প্রতি চক্ষু রাঙ্গাতে পারত না। আর এখন মুসলমান হওয়ায় সকলেই আমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছে, অধঃপতিত মনে করছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমার প্রতি এবং তোমাদের প্রতি ধৈর্যের আদেশ রয়েছে, সুতরাং তোমরা নামায পড়তে থাক এবং সবর করতে থাক।” অতঃপর মদীনায় হিজরতের পর যখন জিহাদের আদেশ হল, তখন ধর্মে দুর্বল এমন অনেক ব্যক্তি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। তাই তাঁদেরকে উৎসাহ প্রদান কল্পে আলোচ্য আয়াতটি গঞ্জনার সূরে নাজিল হয়। অপর বর্ণনায় মক্কায় মুসলমানেরা অত্যাচারিত হতে থাকলে কিছু সংখ্যক সাহাবী জিহাদের জন্য তীব্র আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন; এ সময় তাদের প্রতি ক্ষমার আদেশই ছিল। মদীনায় হিজরতের পর জিহাদের আদেশ প্রদত্ত হলে কতিপয় ব্যক্তির নিকট তা অপ্রীতিকর মনে হল। তাই অভিযোগ স্বরূপ এই আয়াতটি নাজিল হয়। উদ্ধৃত আয়াতের উক্তি মুসলমানদের প্রতি কোন ভর্ৎসনা নয়। কেননা, জিহাদের এ নির্দেশের প্রতি তাঁদের কোন প্রতিবাদ ছিল না; বরং তাঁদের তরফ থেকে অবকাশের প্রত্যাশা করা হয়েছিল। সুতরাং আলোচ্য আয়াতের উৎস হল, মুসলমানদের মধ্যে জিহাদের প্রেরণা সৃষ্টি করা। যা মক্কায় অত্যাচারিত অবস্থায় তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল এবং হিজরতের পর তা লুপ্ত হওয়ায় এবং সম্যক নিরাপত্তা লাভের পর তাদের পার্থিব জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় এই আয়াত নসীহত হিসাবে বর্ণনা করা হয়। আয়াত-৮২ : একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) জনৈক ছাহাবীকে যাকাত আদায়ের জন্য কোথাও পাঠিয়েছিলেন। স্থানীয় লোকেরা তাঁর সংবর্ধনার্থে একত্রে বের হয়ে পড়ল। তিনি তদ্দর্শনে তাঁকে মারপিট করতে এসেছেন মনে করে মদীনায় ফেরত আসলেন এবং বললেন, “সেখানকার লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছে।” সংবাদটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কানে-আসার পূর্বেই শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) কোথাও সৈন্য পাঠিয়ে দিলে এবং তাঁদের জয় পরাজয়ের কোন কথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ হতে ঘোষণার পূর্বেই কতিপয় দুর্বলমনা মুসলমান তা প্রচার করে দিত। যার পরিণাম হত খারাপ। তাই এরূপ গুজব রটনা এবং গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করা হতে বারণ করার উদ্দেশে আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আয়াত-৮৭ : ওহুদ যুদ্ধে যাত্রা করার পর রাস্তা থেকে যারা কেটে পড়েছিল, তাদের সম্বন্ধে ছাহাবারা দু দল হয়ে গিয়েছিলেন- এক দল বললেন, তারা মুনাফিক, তাদের শিরোচ্ছেদ করা হোক এবং অপর দল এর বিপক্ষে মত দিলেন। কারণ তাঁদের ধারণা ছিল, ঐ মুনাফিকরা হয় তো মুসলমানদের সাথে একত্রে থাকলে ধীরে ধীরে হিদায়তের পথে চলে আসতে পারে। তখন এই আয়াতটি নাজিল হয়। মুজাহিদ-এর বর্ণনা মক্কার কতিপয় মুশরিক মদীনায় এসে নিজেরা মুসলমান হয়ে হিজরত করে চলে এসেছে- এ মর্মে আÍপ্রকাশ করল। অতঃপর ব্যবসার ভান করে মুরতাদ হয়ে মক্কায় চলে গেল। এদের সম্বন্ধে মুসলমানরা দ্বিমত হয়ে তাদের ধর্মান্তর হওয়ার প্রমাণসমূহে বিভিন্ন হেরফের ব্যাখ্যার মাধ্যমে এক দল তাদেরকে মুসলমান সাব্যস্ত করল। তখন এ বিবাদ নিরসনার্থে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে মুনাফিক বলার কারণ হল, তারা নিজেদেরকে মু’মিন বলে দাবী করেছিল কিন্তু হৃদয়ে লালিত কুফরীকে তখনও গোপন করে রেখেছিল। আর বিশেষ কারণে তাদেরকে হত্যা করাও ঠিক হচ্ছিল না, যে পর্যন্ত তাদের কুফুরী ও মুরতাদ হওয়ার কথা সকলের নিকট পরিষ্কার হয়ে না যায়। হযরত হাসানের বর্ণনানুযায়ী, ছোরাক্কা ইবনে মালেক মুদলজী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে বদর ওহুদের পর এসে বর্ণ মুদলজীর সাথে সন্ধির আবেদন জানিয়ে ছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) সন্ধিনামা প্রণয়ন করার জন্য হযরত খালিদকে সেখানে পাঠালেন এবং এ মর্মে সন্ধিনামা প্রণয়ন করা হল যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিপক্ষ কোন শক্তিকে কোন প্রকার সাহায্য করবে না এবং কোরাইশরা যখন মুসলমান হবে তারাও তখন মুসলমান হবে। তখন আলোচ্য আয়াতটি নাজিল হয়। আয়াত-৯৩ : কিন্দী বংশীয় মুক্কীয় ইবনে খোবাব্ আপন ভাই হিশামের সঙ্গে মুসলমান হয়েছিল। কিছু দিন পরে হিশামের লাশ বনী নাজ্জারের বস্তিতে সে খুঁজে পেল। ঘটনাটি সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে পেশ করলে তিনি বনী ফিহেরের এক ব্যক্তিকে তার সঙ্গে দিয়ে বনী নাজ্জারের নিকট এ মর্মে সংবাদ পাঠালেন, তোমাদের কেউ হেশামের হন্তা জানলে তাকে মুক্কীছের হাওয়ালা কর। সে যেন তাকে প্রতিশোধস্বরূপ হত্যা করে দেয়। নতুবা তাঁর রক্তপণ শোধ কর। বনী নাজ্জারের লোকেরা বলল, আল্লাহর শপথ, আমরা তাঁর হন্তা কে তা জানি না। তাই রক্তপণ আদায় করতে প্রস্তত আছি। তৎপর তার রক্তপণ বাবদ একশ’টি উট মুক্কীছকে দিল। মুক্কীছ্ বণী ফিহেরের লোকটিসহ মদীনার দিকে রওয়ানা হল। পথে ফিহের বংশীয় সঙ্গীকে শহীদ করে সে উটসহ মক্কায় চলে গেল। এতে আয়াতটি নাজিল হয়। আয়াত-৯৪ : একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) লাইছ বংশীয় গালেব ইবনে ফুজালার অধিনায়কত্বে ফেদকবাসীর নিকট একদল সৈন্য পাঠালেন। তথাকার সকলেই মুসলিম বাহিনীকে দেখে পালিয়ে গেল। কিন্তু আমের ইবনে আযবতে আশজায়ী নামক এক ব্যক্তি, যিনি প্রথম হতেই মুসলমান ছিলেন এবং নিজে মুসলমান হওয়ায় থেকে গেলেন; পরে অন্য কোন সৈন্য সন্দেহে নিজের ছাগ পাল নিয়ে পাহাড়ে আÍগোপন করলেন। অতঃপর অশ্বারোহী সৈন্যরা নিকটে এসে তাকবীর ধ্বনি তুললে ঐ ব্যক্তি ইসলামী সৈন্য হিসাবে পরিচয় পেয়ে উচ্চ শব্দে কলেমায়ে তৈয়্যেবা পড়তে পড়তে আস্সালামু আলাইকুম বলে তাদের সামনে বের হয়ে আসলেন। হযরত উসামা (রাঃ) তাঁর এই কালেমা পাঠ জীবণ রক্ষার্থে বলে মনে করে লোকটিকে হত্যা করলেন এবং তাঁর ছাগ পাল স্বীয় দখলে আনলেন। তখনই এই আয়াতটি নাজিল হয়। আয়াত- ১০১ : ওহুদের যুদ্ধের পর রাসূল (সা.) ছাহাবীদের নিয়ে কাফেরদের পিছনে ধাওয়া করার জন্য হামরাউল আসাদ এ উপস্থিত হন শত্র“রা ভয়ে পলায়ন করে। এখানে সেই ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আয়াত -১০২ : অর্থাৎ আপনি যদি তাদেরকে জামাআতে নামায পড়াতে চান, আর তখন যদি এ আশঙ্কা হয় যে, সকলে একত্রে জামাতে নামায আদায় করলে কোন শত্র“ সুযোগ পেয়ে হয়ত আক্রমণ করে বসতে পারে। তখন এই প্রক্রিয়ায় নামায পড় একদল, একদল করে। আয়াত-১০৩ : আলোচ্য আয়াত ভয়ঙ্কর অবস্থায় নামাযের মধ্যে বিভিন্ন আচরণ ও গতিবিধির অনুমতি ও তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নামায যথাযথ ও সঠিকভাবে পড়তে হবে, তার বর্ণনাপূর্বক আল্লাহপাক এরশাদ করেন, অতঃপর যখন তোমরা এ নামায সম্পন্ন কর তখন তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করতে থাক দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায়ও। অতঃপর যখন তোমরা নিশ্চিত হও, তখন যথানিয়মে নামায পড়তে থাক। নিশ্চয়ই নামায মুসলমানদের উপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরয করা হয়েছে। অর্থাৎ সময়ের মধ্যে কেবল নামাযই সীমাবদ্ধ। যিকির প্রত্যেক অবস্থায়ই চলতে পারে। আয়াত-১০৪ : অত্র আয়াতে কাফেরদের পশ্চাদ্ধাবনে মুসলমানরা যেন সাহস না হারায় তার ইঙ্গীত প্রদানপুর্বক আল্লাহপাক এরশাদ করেন, কাফেরদের পশ্চাপদ্ধাবনে সাহস হারা হয়ো না। তোমরা যদি কষ্টপাও, তবে তারাও তোমাদেও মত কষ্ট পাচ্ছে। অথচ আল্লাহর নিকট তোমাদের সওয়াবের আশা আছে আর তাদের সে আশাও নেই। আল্লাহ সব কিছু জানেন, বিচার বিবেচনা রাখেন। অতএব তাঁর নির্দেশ পালনকে নিজেদের পরম ও চরম সৌভাগ্য মনে করো। আয়াত- ১০৫ : হযরত রেফায়ার (রাঃ)-এর কিছু মাল বশীর নামক দুর্বল ম’ুমিন চুরি করে জনৈক ইহুদীর নিকট জমা রাখে। পরে ধরা পড়লে সে মক্কায় কাফিরদের কাছে আশ্রায় নেয়। এই প্রসংগে উক্ত আয়াত নাজিল হয়। আয়াত-১০৬ : একবার জনৈক মুসলমান রাতেরবেলা অন্য এক মুসলমানের ঘরে ঢুকে এক বস্তা আটা ও কিছু অস্ত্র-শস্ত্র চুরি করল। বস্তার মধ্যে ছিদ্র ছিল। পথিমধ্যে আটা পড়ে গিয়েছিল। চোর ঐ চুরির মাল নিজের ঘরে না রেখে এক ইহুদীর বাড়ীতে রাখল। মালিক সন্ধান করে ইহুদীর বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। উক্ত ইহুদী মালের কথা স্বীকার করল এবং বলল যে, অমুক মুসলমান আমার বাড়িতে এই মাল রেখে গিয়েছে। ইত্যবসরে চোরের গোত্রের লোকেরা ষড়যন্ত্র করে উক্ত ইহুদীকে চোর সাব্যস্ত করে নবী করীম (সা.) এর নিকট মিথ্যা সাক্ষ্য পেশ করল। নবী করীম (সা.) ইহুদীর উপর চুরির শাস্তি প্রয়োগ এবং হস্ত কর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ হয়। এতে উক্ত মুসলমানটি চোর সাব্যস্ত হয় এবং ইহুদী দোষমুক্ত হয়। (মারেফুল কুরআন) আয়াত-১১৩ : অত্র আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জ্ঞান আল্লাহ পাকের জ্ঞানের ন্যায় সর্বব্যাপী ছিল না; যেমন কতক মূর্খ বলে থাকে। তবে এ কথা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যেই জ্ঞান লাভ করেছেন তা সমগ্র সৃষ্টি জীবের জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশি। (মারেফুল কুরআন) আয়াত-১১৭ : অত্র আয়াতটি মক্কায় মুশরিকদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। তারা আলাদা আলাদাভাবে নারী রূপী কতিপয় প্রতিমা বানিয়ে রেখেছিল এবং এদের নামও নারীর ন্যায়-লাত, মানাত, ওজ্জা ইত্যাদি রেখেছিল এবং তারা এদেরকেই সেজদা করত এবং এদেরই উপাসনা করত। আয়াত-১১৯ঃ আল্লাহর সৃষ্ট রূপ-রেখাকে পরিবর্তন করা দু প্রকারের হতে পারে- “খালক” শব্দের অর্থ যখন দ্বীন হবে তখন এর অর্থ হবে দ্বীনে বিবর্তন করা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। আয়াত-১২৩ : কতিপয় ইহুদী ও খৃস্টান এবং মুসলমান এক জায়গায় সমবেত ছিল। ইহুদীরা বলল, আমরা নবীর সন্তান। জান্নাতে আমরা প্রবেশ করব। খৃস্টানেরা বলল, আমরাই জান্নাতের অধিকারী, যেহেতু আল্লাহ্র জাত-পুত্র হযরত ঈসা (আঃ) আমাদের পাপ মোচনের জন্য তিনি ক্রুশ বিদ্ধ হয়েছেন। ফলে আমরা নিস্পাপ হয়ে গিয়েছি। (মূলতঃ তাদের এই ধারণা ছিল অলীক, সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন)। মুসলমানেরা বলল, নবীকুল সরদার আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এরই উম্মত আমরা, তাই জান্নাতের হকদার আমরা। অতঃপর এরূপ দম্ভ-গর্ব হতে বিরত থাকার জন্য আলোচ্য আয়াতটি নাজিল হয় এবং বলা হয়, জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামত অথবা জাহান্নামের শাস্তি সবই ব্যক্তির কর্মফলের উপর নির্ভর করে যদি সে নবীর ছেলেও হয়। আয়াত-১২৪ : এই আয়াতে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীর পরকালীন পুরস্কার প্রাপ্তির সুসংবাদ ঘোষিত হয়েছে। যে সকল অজ্ঞ অদূরদর্শী বিদ্বেষ-পরায়ণ খৃস্টান ও পৌত্তলিক লেখক “ইসলামে নারীর আত্মমর্যাদা নেই” বলে অসাধারণ অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে, আমরা তাদেরকে পবিত্র কোরআন পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি এবং সাথে সাথে একথাও মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করছি, যে পবিত্র ইসলাম নারী-জাতির স্বাধীনতা, অধিকার, গৌরব ও মর্যাদার যে উচ্চ আদর্শ স্থাপন করেছে, জগতের অন্য কোন ধর্মেই তার তুলনা নেই। আয়াত-১২৮ : কোন স্ত্রী স্বামীর তরফ থেকে উপেক্ষার আশংকায় শর্ত সাপেক্ষে তার অধিকার হতে কিছু ছেড়ে দিয়ে স্বামীকে খুশি করার চেষ্টা করতে পারে। এটা সম্পূর্ণ জায়েয। (মারেফুল কুরআন, মুঃ কোঃ) আয়াত-১২৯ : অপরকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখার অর্থ হল, যে স্ত্রীর প্রতি মনের আকর্ষণ কম থাকে তার দাবীও পূর্ণ করে দেয়া হয় না এবং পরিত্যাগও করা হয় না। (মারেফুল কুরআন) আয়াত ১৩৬ : হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালামসহ কতিপয় আহলে কিতাবের অনুসারী মুসলমান হয়েছিলেন। তাঁরা রাসূল (সা.) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আমরা আপনার প্রতি ও কোরআনের প্রতি এবং হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত ওযাইর (আঃ) এর প্রতি ঈমান এনেছি; এত্যদ্বতীত অন্য কাউকে মানি না। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল হয়। আয়াত ১৪০ : মক্কা শরীফে মুসলমানদের প্রতি কাফের মুশরিকদের যে সমাবেশে কোরআনের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হত সে সমাবেশে না যাওয়ার আদেশ ছিল। আর পূর্ব হতে যদি তথায় উপস্থিত থাকে তখন তথা হতে উঠে আসার আদেশ ছিল। অতঃপর মদীনায় হিজরতের পর যখন ইহুদী বেদুঈনের পক্ষ হতে সে ঠাট্টা বিদ্রুপ চলতে লাগল , তখন পূর্ব আদেশটি পূনঃ জারী করা হয় এবং বলা হয়, এ আদেশ লঙ্ঘনে তাদেরকেও সেই উপহাসকারীদের মধ্যে পরিগণিত করা হবে। অবশ্য যারা দুর্বল উঠে আসতে সাহস রাখে না তাদেরকে আপনার গণ্য করা হবে, কিন্তু অন্তরে তাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে হবে। আবার যখন কাফেররা কোন বিষয়ে লাভবান হয়, তখন তারা বলে যে, আমরা তোমাদের সাহায্যের জন্য মুসলমানদেরকে নানাভাবে প্রতিরোধ এবং ক্ষতিগ্রস্থ করেছি বলে তোমরা এই সুফল লাভে সমর্থ হয়েছে; সুতরাং, তোমাদের লব্ধ বিষয়ে আমরাও আছি। আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন, পুনরুত্থান দিবসে তারা এই কপটচারীতার সমুচিত প্রতিফল পাবে এবং ঈমানদারদের উপর কাফেররা কখনই জয়যুক্ত হবে না। আয়াত-১৪৪ : হে ঈমানদাররা! তোমরা না কাফেরদের বন্ধু বানাবে আর না মুনাফিকদের সাথে হাত মিলাবে। কারণ, তারা আল্লাহকে সাথে রাখে না। সুতরাং তাদের সংশ্রব তোমাদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক হতে বিস্মৃত করে দিবে এবং পার্থিব কামনার প্রতি আসক্ত করবে। কেননা, এক অন্তরে দুটি ভিন্ন স্তরের জিনিস একই সাথে অবস্থান করতে পারে না। আয়াত-১৪৫ : অর্থাৎ মুনাফিকরা যন্ত্রনাদায়ক আযাব ভোগ করবে। কারণ কাফেররা প্রকাশ্য শত্র“ হওয়ার কারণে ইসলামের তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে নি, যে ক্ষতি এ মুনাফিকদের দিয়ে হয়েছে। বর্তমানেও এমন ধৃষ্ট ও কুটিল লোক রয়েছেন, যারা কাফের ও মনের দিক দিয়ে বেদ্বীন, কিন্তু বাহ্যতঃ ইসলামের মুখোশ পরিধান করে ইসলামের ক্ষতি করে, শত সহস্র বিদআত পয়দা করে এমনকি দুর্বল ও বিভান্তিকর ব্যাখ্যার দ্বারা কোরআনের মধ্যে বিবর্তন আনার চেষ্টা করে। অতঃপর কোরানের চিরাচরিত নিয়মানুসারে ভয় প্রদর্শনের পর উৎসাহিত করার জন্য “ অবশ্য যারা তওবা করবে” বলে ক্ষমার প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়। কিন্তু চারটি শর্ত সাপেক্ষ; প্রথম- আন্তরিকতার সাথে তওবা করা। দ্বিতীয়- সৎ চরিত্রের মাধ্যমে ইলম ও আমলের বৈষম্যমুলক দোষ-ত্রুটি সংশোধন করা। তৃতীয়- আল্লাহ বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক বর্জন করে কেবলমাত্র আল্লাহ্র প্রতিই নির্ভরশীল হওয়া। চতুর্থ- স্বীয় আমলে নিষ্ঠাবান হওয়া। গ্রন্থনা : মাওলানা মিরাজ রহমান