
ছবি সংগৃহীত
রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়: জামায়াত কর্মীদের চাঁদার টাকা কোথায় যায়?
আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৩, ১১:১০
একটি রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের বিষয়টি আমাদের দেশে কখনোই আলোচিত হয় না। তারা নির্বাচন কমিশনে একটি আয়-ব্যয়ের হিসাব দেয়; স্বাভাবিকভাবেই তা একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে থাকে। কোন কর্তৃপক্ষই এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে সকল রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয় সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষিদের চাঁদার টাকায়। চাঁদা প্রদানের জন্য বিজ্ঞাপন-ধর্মী পদক্ষেপও তারা নেয়। আমাদের দেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগ অথবা অন্য কোন দলের চাঁদা গ্রহণের অফিশিয়াল কোন প্রচলন নেই বললেই চলে, যেটি আছে তা অলিখিত। কিন্তু জামায়াতের টাকা গ্রহণের সুনির্দিষ্ট একটি কাঠামো আছে। জামাতের প্রতিটি নেতাকর্মী বাধ্যতামূলকভাবে চাঁদা দেয়। জামাতের বাণিজ্যিক বা অলাভজনক ঘোষণা দেয়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর টার্ন-ওভার থেকে তাদের গৃহীত চাঁদার পরিমাণ কম নয়। তাই জামায়াতের আর্থিক হিসাব দায়বদ্ধতায় আনা প্রয়োজন। ৭৮ সাল থেকে ৯টি খাতে বিনিয়োগ জামায়াতে ইসলামী ৭৮ সালে রাজনীতি করার অনুমোদন পাবার পর থেকে পাকিস্তানি শাসকদের তল্পীবাহক হিসেবে উপার্জিত টাকা, ৭১ সালে লুটতরাজ করা টাকা, বিদেশি অনুদান এবং নেতাকর্মীদের টাকা এসব মিলিয়ে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯টি সেক্টরে বিনিয়োগ শুরু করে। ৯টি খাতের মধ্যে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত, শিক্ষা খাত, চিকিৎসা খাত এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের ভাষায়, দেশের অর্থনীতির ভেতরে তাদের আরেকটি অর্থনৈতিক চক্র রয়েছে এবং আমাদের প্রবৃদ্ধির হার যদি ৬ শতাংশ হয় জামাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের উপরে। জামায়াতের বিপুল অংকের অপ্রদর্শিত চাঁদাবাজি জামাতের নেতাকর্মীরা প্রত্যেকেই জামাতকে চাঁদা দেয়। চাঁদা গ্রহণের এ প্রথা চলে আসছে পাকিস্তান আমল থেকে। ছাত্রশিবিরের সাথী একজন স্কুল ছাত্রও প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা চাঁদা দেয়। জামাতের চাকুরীজীবী ও ব্যবসায়ীরা তাদের আয়ের কমপক্ষে ১৫% দলীয় ফান্ডে জমা দেয়। জানা যায়, জামাত নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্তৃপক্ষই বেতন থেকে চাঁদার টাকা কেটে রাখে। এ বাধ্যতামূলক চাঁদার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের কর্মীদের মাঝে ধারণা তৈরি করা হয় যে, তাদের নেতারা সাধারণ জীবনযাপন করে এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার কারণে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে তাদের দেয়া টাকা বিশেষ ভূমিকা রাখছে এবং তারা সওয়াবের অধিকারি হচ্ছে। নিয়মিত চাঁদা ছাড়াও জাকাত-ফেতরা ও কোরবানির চামড়ার টাকা গ্রহণ করে দলের কেন্দ্রীয় বায়তুল মাল। অন্যদিকে বিদেশ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য বিপুল অংকের টাকা আসে। আবার আইএসআই বা জঙ্গি সংগঠন থেকে টাকা গ্রহণের বিভিন্ন প্রতিবেদন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। টাকা ভোগ করে শীর্ষ নেতারা জামায়াত ও শিবিরের টাকা গ্রহণ করা হয় স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। স্থানীয় ইউনিট/শাখার মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় আমীর দলীয় কর্মকাণ্ডের ব্যয়ের অর্থ রেখে বাকী টাকা জমা দেয় কেন্দ্রের ফান্ডে। অন্যদিকে বড় অংকের অনুদানসমূহ কেন্দ্রই সরাসরি গ্রহণ করে। তবে যেভাবেই সংগ্রহ হোক সে টাকা কুক্ষিগত থাকে গুটিকয়েক শীর্ষ নেতার কাছে। কমন এ উৎসগুলো ছাড়াও দেশে-বিদেশে ওয়াজ মাহফিল এবং জাতীয় সভা-সমাবেশ উপলক্ষেও টাকা তোলা হয়। ইসলাম পুঁজিবাদে বিশ্বাস না করলেও জামাতের একটি অংশ হচ্ছে পুঁজিবাদি শ্রেণীর। জামায়াত শিবিরের প্রভাবশালী নেতাদের টেন্ডার, চাঁদাবাজি ইত্যাদি প্রসঙ্গ নাইবা আনলাম। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত টাকায় ভোগ বিলাস করে জামায়াতের গুটিকয়েক নেতা। তাদের বিলাসী জীবনযাত্রা ছাড়াও অনেকের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে বিদেশে। একটি সাধারণ হিসেব যদি করি যে - জামাতের সদস্য-সমর্থক ৫০ লক্ষ। এদের প্রত্যেকে মাসে ৫০ টাকা করে চাঁদা দিলে পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যাটি নিশ্চিতভাবে অনেক অনেক গুণ বেশি। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী এবং মওদুদীর ছেলের ভাষ্য সম্প্রতি জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবু আলা মওদুদীর ছেলে হায়দার মনজুর মওদুদী এক সাক্ষাতকারে জামায়াত নেতাদের ধর্মের নামে, মিল্লাতের নামে লুটপাট করে কোটিপতি হবার কথা বলেছেন। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর সৈয়দ মনোয়ার হাসানের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেছেন, “মনোয়ারের পক্ষে তার পরিবারের ব্যয় বহন করাই কষ্টকর ছিল। এই মনোয়ার পরবর্তীতে নেওয়াজ শরীফকে ১৪ কোটি রূপী দেয়ার স্বীকারোক্তি দেয়। এখন সে কয়েক শ টাকার মালিক।” তিনি জামাতের হিডেন এজেন্ডার কথা, আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ সমর্থনে কর্মকাণ্ড পরিচালনার কথা এবং জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের কথা বলেছেন। জামায়াতে ইসলামীকে দানব হিসেবে আখ্যায়িত করে মনজুর মওদুদী এটিও স্বীকার করেছেন যে, জামায়াতকে কল্যাণকামী মনে করেনি বলে এর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী স্বয়ং তার নয় ছেলেমেয়ের কাউকে জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হতে দেন নি। উল্লেখ্য বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের জামায়াত একই নীতিতে চলে এবং গোলাম আযম নিজেই সাক্ষাতকারে বলেছেন, জামায়াতের হেডকোয়ার্টার পাকিস্তানে। জামায়াতের অর্থের উৎস এবং তার ব্যবহার নিয়ে যে প্রশ্ন তার নিয়ামক হচ্ছে মনজুর মওদুদীর বক্তব্য। জামাতের আর্থিক হিসাব যে কারণে প্রয়োজন অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু মোটের উপর এটিই সত্যি যে - জামাতের দলেরই নেতা বা কর্মী ছাড়া তাদের কোন সাধারণ সমর্থক নেই। তারা কোথায় কত ভোট পাবে এ তথ্য সম্পর্কেও তারা অবগত। জামাতের সাথে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দেশের অনেক এলাকাতেই অনেক জামাত বা ��িবির নেতাদের বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা বিভিন্ন মিডিয়ায় জানা যায়। বিগত সরকারে অংশীদার থাকাকালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আইনের আওতায় না এলেও, গত চার বছরে বিরোধী দল হিসেবে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এতে করে তাদের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। জঙ্গি তৎপরতার সাথে বিপুল অংকের আর্থিক লেনদেনও সম্পর্কযুক্ত। তাই জামাতের টাকা কোথায় কোন খাতে খরচ হয়, তার উপর কর ধার্য হবে কিনা - এ বিষয়ে তদন্ত এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনে নামমাত্র একটি হিসাব প্রদান করে। নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রদত্ত আয় সংশ্লিষ্ট তথ্য একান্তই ব্যক্তিগত এবং তথাকথিত হিসাব বিবরণী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দলীয়ভাবে জামাতের আসনসমূহে দলীয় ফান্ড থেকে বরাদ্দ করা হয় বিপুল অংকের টাকা। অন্যদিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তাই প্রশ্ন হচ্ছে জামায়াতের সংগৃহীত এ বিপুল পরিমাণ টাকা যাচ্ছে কোথায়? একটি রাজনৈতিক দল যদি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মত আয় করে তবে কি তা করের আওতা বহির্ভূত থাকবে? যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমরা জামাতের কোটি কোটি টাকা খরচের অনেক প্রতিবেদন দেখেছি। জামায়াত প্রায়শই আরেকটি ১৫ই আগস্টের হুমকি দেয় যা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা তাদের প্রকাশ্য দাবি। পক্ষান্তরে প্রতিটি টাকাই ব্যবহৃত হচ্ছে বা হবে এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে। তাই জামাতের টাকা কোথায়, কোন খাতে খরচ হয়, তাদের প্রকৃত আয়-ব্যয় কি - রাজনৈতিক দল হিসেবে এ তথ্য জানার অধিকার এদেশের জনগণের রয়েছে। জামাতও আর্থিক হিসাব বিবরণী প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত নয়। এ বিষয়ে তদন্ত শুধু সময়ের প্রয়োজনই নয়, এ পদক্ষেপ প্রয়োজন দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেও।
- ট্যাগ:
- রাজনীতি