ছবি সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথের জীবনে তিন নারী

Nusrat Sharmin Liza
লেখক
প্রকাশিত: ০৬ আগস্ট ২০১৩, ০৬:৪৮
আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০১৩, ০৬:৪৮

রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন ধাপে যে নারীদের উপস্থিতি ছিলো তাদের মধ্যে তাঁর মা, বৌদি ও স্ত্রী অন্যতম। ঠাকুরবাড়ির এই তিন নারী, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য সাহিত্যে এই তিনজন নারীর সাথে কল্পনার সংমিশ্রন ঘটিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের সৃষ্টি করেছে। ঠাকুরবাড়ির নারীরা অন্যান্য সমসাময়িক নারীদের চাইতে অনেকটাই আধুনিক ছিলেন। লেখাপড়া, রান্না-বান্না, ঘর সামলানো, ফ্যাশন সবদিক থেকেই তারা ছিলেন অনুকরণীয় ও সেরা। কবিগুরুর জীবনের এমনই তিন নারীর উপস্থিতি ও অবদান সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিন।

সারদা সুন্দরী দেবীঃ

রবীন্দ্রনাথের মা সারদা সুন্দরী দেবী ছিলেন সেকালের যশোর জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর আদরের কন্যা। তাঁর সঠিক জন্মসন জানা যায়নি। ১৮৩৪ সালে সতেরো বছর বয়সী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ৬ বছর। সর্বশেষ সন্তান রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় তাঁর বয়স চৌত্রিশ এর মত। তিনি ছিলেন পনেরো সন্তানের জননী। ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, সারদা দেবী সন্তানদের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে পারতেন না। কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিলো। বিভিন্ন লেখায় রবীন্দ্রনাথের সাথে তার মায়ের সম্পর্কের মধুরতা ফুটে উঠেছে। মাকে নিয়ে তিনি লিখেছেনঃ “তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ, তুমি যেন হবে আমার চাঁদ- দু হাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে, আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ”। ১৮৭৫ সালের ১১ মার্চ সারদা দেবী মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের যখন মৃত্যু হয় তখন কবিগুরুর বয়স মাত্র তেরো বছর। তিনি তার লেখাতে তার মায়ের মৃত্যুর বিবরণ দিয়েছিলেন। তারই কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ “মা’ র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প। অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়- তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে।” তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন-পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে- দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না- সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না। বেলা হইল, শ্মশান হইতে ফিরিয়া আসিলাম; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম- তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন”।

কাদম্বরী দেবীঃ

রবীন্দ্র সাহিত্যে, তাঁর জীবনের যেই কয়জন নারীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তার বৌদি কাদম্বরী দেবী। কাদম্বরী দেবীর আসল নাম ছিল মাতঙ্গিনি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন কবির সাহিত্যের অনুপ্রেরণাদাত্রী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কাদম্বরী দেবীর বিয়ে হয় ৫ই জুলাই ১৮৬৮ সালে। কাদম্বরী ঠাকুর বাড়ীর বৌ হয়ে এসেছিলেন মাত্র নয় বছর বয়সে। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র সাত বছর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নানারকম কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন বলে কাদম্বরী দেবী একাকিত্বে ভুগতেন। শ্যামা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন বউ কাদম্বরীর কথা উল্লেখ করেছেন। “উজ্জ্বল শ্যামল বর্ন,গলায় পলার হারখানি চেয়েছি অবাক মানি তার পানে বড় বড় কাজল নয়ানে, অসংকোচে ছিলো চেয়ে নব কৈশরের মেয়ে"। প্রায় সমবয়সী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী। তাই ছোটবেলা থেকেই খেলার সাথী ও ভালো বন্ধু ছিলেন তারা। রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় মাকে হারানোর শোক তিনি ততোটা বুঝতে পারেননি, কারন কাদম্বরী দেবী মায়ের অভাবটা বুঝতে দেননি। কাদম্বরী দেবী ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪ সালে আত্মহত্যা করেন। তার অকাল প্রয়াণ কবির মনে গভীর শোকের ক্ষত সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন গান ও কবিতায় কাদম্বরী দেবীকে খুঁজে পাওয়া যায়। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর কবি বলেছেন যে মৃত্যু তাঁকে মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো, পরম বিচ্ছেদের বেনায় দীর্ণ করেছিলো-তা হলো তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর অকাল প্রয়াণ। এই মৃত্যুর সম্পর্কে তিনি বলেছেন-"আমার ২৪ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইয়াছিলো তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ-শোকের সঙ্গেই মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাথিঁয়া চলিয়াছিলো”।
মৃণালিনী দেবীঃ ১৮৮৩ সালের ৯ডিসেম্বর ২২ বছর বয়সে হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত ভাবেই বিয়ে হয় রবীন্দ্রনাথের। খুলনা জেলার ফুলতলা গ্রামের বেনী মাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারণীর বয়স তখন বারো বছর। বেনী মাধব ছিলেন ঠাকুর এস্টেটের একজন সামান্য কর্মচারী। বিয়ের পরপরই নতুন বধুর নামকে আধুনিক করার জন্য নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই গুণবতী নতুন বৌ বাড়ির সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। সাংসারিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে অনেক সম্মান করতেন ও ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে শিক্ষিত করেছিলেন ও পত্র লেখা শিখিয়েছিলেন। নিয়মিত স্ত্রীর পত্র না পেলে মন খারাপ হতো তাঁর। মৃণালিনীকে নিয়ে তার সাহিত্যে তেমন লেখা-লিখি না থাকলেও তাদের নিজেদের মধ্যে নীরব ভালোবাসার আদান প্রদান হতো। সাংসারিক জীবনে নানান সময়ের ভালো থাকা ও মন্দ থাকার মাঝে মৃণালিনী দেবী সবসময়েই কবির পাশে থেকেছেন ও তাকে উত্সাহ দিয়েছেন। পরবর্তিতে বেশ কয়েক মাস রোগে ভুগে ৭ অগ্রহায়ণ ১৩০৯ মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে মৃণালিনী দেবী মৃত্যুবরণ করেন। মৃণালিনী দেবীর স্মরণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ “আজিকে তুমি ঘুমাও , আমি জাগিয়া রব দুয়ারে — রাখিব জ্বালি আলো । তুমি তো ভালো বেসেছ , আজি একাকী শুধু আমারে বাসিতে হবে ভালো"। রবীন্দ্রনাথ তাঁর হৃদয়ের গভীরতম যায়গা থেকে নারীকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সাহিত্যে তিনি নারীর আবেগ ও অনুভূতিকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। নারীকে তিনি শৈল্পিক ভাবে তাঁর সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন। তার জীবনে যতজন নারী এসেছিলেন তারা প্রায় সকলেই তার সাহিত্যের প্রেরণার উৎস ছিলেন। তার অধিকাংশ সাহিত্যের নারী চরিত্রগুলো বাস্তব জীবন সাথে কল্পনার মিশ্রনে তৈরী হয়েছে। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগে ভোগার পর ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ বাংলা সাহিত্যের এই অমর দিকপালের প্রয়াণ দিবস। তাকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।