
ছবি সংগৃহীত
মীর কাসেমের মন খারাপ!
আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪, ০৫:৫২
জামাত নেতা মীর কাসেমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো গত রমজানে। আমি তখন কাসিমপুর কারাগারে বন্দি। যেদিন আমাকে একজন চোর-গুন্ডা বা বদমাসের মতো মহা যতন করে গ্রেফতার করা হয়েছিলো সেদিন আমার নামের সঙ্গে এমপি নামক একটি পদবীও ছিলো। আমাকে নেয়া হলো প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে - তারপর কি মনে করে যেনো সন্ধ্যার পর পরই পাঠানো হলো কাসিমপুর। গভীর রাতে আমি যখন কারা ফটক অতিক্রম করে আমার বন্দী নিবাসের দিকে যাচ্ছি তখন ক্ষুধা, ক্লান্তি, অবসাদ এবং অপমান আমাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো। জীবনের প্রথম কারাবাস- আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ ওখানে যায়নি- আর তাই আমি জানতাম না ওখানকার নিয়ম কানুন, সুযোগ সুবিধা বা অসুবিধা সমূহ। কাসিমপুর কারাগারের মূল ফটক পার হয়ে অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হয়। তখন সম্ভবত ১৪ বা ১৫ রোজা চলছিলো। আকাশে অর্ধচন্দ্রের মিষ্টি আলো। আমি হাঁটছি সঙ্গে ২জন কারারক্ষী, চারিদিকে গা ছম ছম করা সুনশান নিরবতা। ভয়ে ভয়ে কারারক্ষীদেরকে বললাম- আমি যেখানে থাকবো সেখানে আর কে কে আছেন। তারা বললো - মীর কাসেম, মাহমুদুর রহমান এবং গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। রাতে কারো সঙ্গে দেখা হবে না - তবে সকালে দেখতে পাবেন সকলকে। সকালে দেখা হলো মীর কাসেমের সঙ্গে। করমর্দন করলেন এবং আমার দিকে অতীব আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে বললেন- আপনাকে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে! কোথায় যেনো দেখেছি! আমি বললাম টিভিতে দেখেছেন। তিনি ও আচ্ছা বলে তখনকার আলোচনার ইতি টানলেন। আমি কিছুটা মনক্ষুন্ন হলাম। কারন জনাব মাহমুদুর রহমান কিংবা জনাব গিয়াস উদ্দিন আল মামুন যতোটা আন্তরিকতা, আগ্রহ এবং খোলামেলা ব্যবহার দেখালেন সে তুলনায় জনাব মীর কাসেমের অভিব্যক্তি ছিলো স্বতন্ত্র। আমার মনে হলো - লোকটি ভীষন রাশভারী, বেরসিক অথবা মনে প্রানে প্রচন্ড আওয়ামী বিদ্বেষী। কিন্তু আমার সেই ভুল ভাঙ্গতে খুব বেশী সময় লাগেনি। রোজার মাসে আমরা ইফতারী এবং রাতের খাবার একসঙ্গে খেতাম। রোজার পর সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং রাতের খাবার একসঙ্গে খেতাম। প্রথমে আমরা ছিলাম ৪ জন। পরে আমাদের সঙ্গে যোগ হয় অপর জামাত নেতা এটিএম আজহার। তাকে গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে কাসিমপুরে আনা হয় রমজানের ঠিক কয়েকদিন পর। আমরা ফজর বাদে বাকী নামাজ জামাতে আদায় করতাম। আর প্রতি বিকেলে আমাদের ভবনের সামনে খোলা মাঠে চেয়ার নিয়ে বসে গল্প গুজুব করতাম- আবার মাঝে মধ্যে হাঁটা হাঁটি করতাম। ২/৩ দিন পর আমার সঙ্গে অন্যসবার মতো মীর কাসেমের সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং আমরা পরস্পরের প্রতি সম্মান রেখে বন্ধুর মতো আচরন করতে থাকি। জেলখানার অখন্ড অবসরে আমি প্রায়ই হাঁফিয়ে উঠতাম। নামাজ কালাম, তছবীহ তাহলিল, বই পড়া, ঘুম, ব্যায়াম- সবকিছু রুটিন মতো করার পরও হাতে অনেক সময়। মন ভার হলেই আমি বারান্দায় পায়চারী করতাম। মীর কাসেম তখন পরম স্নেহে আমাকে তার রুমে ডেকে নিতেন নতুবা আমার রুমে আসতেন। তিনি কথা বলতেন কম এবং শুনতেন খুব বেশী। তিনি আমার জীবন, দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম, প্রেম-ভালোবাসা, সমাজ, সংসার, নির্বাচনী এলাকার খুঁটিনাটি নিয়ে মেধাদীপ্ত প্রশ্ন করতেন এবং সবকিছু শোনার পর সুন্দর বা আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি বলেই ক্ষান্ত থাকতেন। কয়েকদিন পর আমি বুঝলাম মীর কাসেম সাহেব সমাজের অন্য মানুষের মতো নন। এ আমি বুঝেছিলাম তার আচার আচরন, চালচলন, কথাবার্তা, খাদ্যাভ্যাস এবং ইবাদত বন্দেগীর ধরন দেখে। যেসব বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগতো আমি নির্দিধায় সেগুলো তাকে জিজ্ঞাসা করতাম এবং তিনি সাধ্য মতো সুন্দর করে আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতেন। জেলে যাওয়ার আগে বহুজনের কাছে বহুবার তার ব্যাপারে বহু কথা শুনেছি। তার নাকি হাজার হাজার কোটি টাকা। তিনি জামাতের প্রধান অর্থ যোগানদাতা, দেশে বিদেশে তার রয়েছে নামে বেনামে বহু প্রতিষ্ঠান। দেশের মধ্যে চলাফেরার জন্য তিনি সব সময় নাকি নিজস্ব হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন -ইত্যাদি। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় গুজুবটি হলো- তিনি নাকি যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করে লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ করেছেন। আমি ওসব গাঁজাখুরী গল্প বিশ্বাস করতাম না আবার যারা ওসব বলতো তাদের সঙ্গে তর্কও করতাম না। কারন গুজুবকারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্তর এতো নীচু মানের যে তাদের সঙ্গে তর্ক করাটাই মস্তবড় এক নির্বূদ্ধিতা। আমি নিজে ব্যবসা বানিজ্য করি সেই ১৯৯১ সাল থেকে। বাংলাদেশে কয়জন ধনী আছে এবং কোন কোন ধনীর কি কি ব্যবসা আছে তা মোটা মুটি নখদর্পনে। বাংলাদেশের ধনীদের বসবাসের কযেকটি এলাকা আছে - তাদের মেলা মেশার জন্য কয়েকটি ক্লাব আছে, তাদের ব্যক্তিগত বিলাসিতার গাড়ী, বাড়ী, নারী, বাগানবাড়ী, বন্ধু বান্ধব, সভা-সমিতির এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের নাম ধাম অনেকের মতো আমিও জানি। ঐ সমাজে মীর কাসেম নামে কোন লোক নেই। মিরপুরের কোন এক জায়গায় পাঁচ কাঠার ওপর নির্মিত একটি পৈত্রিক বাড়ীতে স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকেন। মার্কিন রাজনীতি, অর্থনীতি এবং লবিষ্ট ফার্ম সম্পর্কে আমার ধারনা বাংলাদেশের অনেকের চেয়ে স্পষ্ট। কারণ ঐ বিষয়ের ওপর আমার মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশীপ রয়েছে। ওখানকার লবিষ্ট ফার্ম গুলো কি কি কাজ করে বা করতে পারে তা আগে জানতে হবে। দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করবে? যুক্তরাষ্ট্র কেনো- পৃথিবীর কোন দেশের কি সেই ক্ষমতা আছে ? আর আমরাই কি সেই আগের অবস্থায় আছি? যেখানে জননেত্রী শেখ হাসিনা-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন ধরেন না! বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সাক্ষাৎকার দেন না, সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না সেখানে কোন লবিষ্ট ফার্ম কি করবে তা নিয়ে গল্প বানানোর নির্বুদ্ধিতা আমার সাজে না। মার্কিন সমাজের বেশির ভাগ নাগরিক দিন আনে দিন খায়। শতকরা ৯০ ভাগ লোকের সামনে ৫ হাজার ডলার নগদ ফেললে তারা ভয় পেয়ে যায়। কাজেই বাজারের গুজুব নিয়ে কথা না বলে আমি কথা বলতাম ১৯৭১ সাল নিয়ে এবং জানার চেষ্টা করতাম ঐ সময়ে তার ভূমিকা সম্পর্কে। একদিন কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম-জেলে থাকার কারনে আপনার ব্যবসা বানিজ্যে কি কোন সমস্যা হচ্ছে না ? তিনি বললেন - ঝামেলার মতো কোন ব্যবসা বানিজ্য নেই। চট্রগ্রাম কেন্দ্রীক একটি ডেভেলপার কোম্পানী আছে। এখন ফ্ল্যাট ব্যবসায় বাজার মন্দা থাকার কারনে নতুন কোন প্রজেক্ট নেই। সেন্ট মার্টিন - টেকনাফ রুটে ২ টা জাহাজ চলে কেয়ারী সিন্দাবাদ নামে। সিজনাল ব্যবসা । ভালো চলছে। অন্যদিকে নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত টিভিতে অনেক পরিচালক আছেন আর উভয় কোম্পানীই পাবলিক লিমিটেড। কাজেই টেনশন নেই। ব্যবসা - বানিজ্য- ছেলেরাই দেখাশুনা করে। অন্যদিকে ইবনে সিনা বা ইসলামী ব্যাংকে আমার পরিচালক পদ অনেকটা অনারারী ধরনের। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক জামাত নেতার মতো আমিও ছিলাম পরিচালনা পরিষদে। এই প্রতিষ্ঠান গুলোর গঠন প্রক্রিয়া এবং পরিচালন পদ্ধতি দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলোর মতো নয়। যেমন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন যাদের একটাকার মালিকানাও ব্যাংকটিতে ছিলো না। আমি মীর কাসেম সাহেবের কথা শুনছিলাম এবং তার রুমের চারিদিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। জামা কাপড়, সাজ সজ্জা, আসবাব পত্র কোন কিছুই আমার কাছে অসাধারন মনে হয়নি বিশেষ করে ডিভিশন প্রাপ্ত অন্যান্য কয়েদীদের তুলনায়। আমরা সবাই জেলখানার ভেতরের দোকান থেকে কিনে মিনারেল ওয়াটার খেতাম। অন্যদিকে মীর কাসেম খেতেন সাধারন টেপের পানি। কোন বিদেশী ফল মূল খেতেন না। জাম্বুরা, আনারস, আমড়া, কলা প্রভৃতি দেশী ফল সময় ও সুযোগ মতো খেতেন। আমাদের সবার রুমে ৬টি করে সিলিং ফ্যান ছিলো। আমরা নিজেরা সব সময় সব গুলো ফ্যান ছেড়ে রাখতাম। মীর কাসেম ভুলেও সে কাজটি করতেন না - দরকার পড়লে একটি মাত্র ফ্যান ছাড়তেন। তার এই অবস্থা দেখে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন প্রায়ই বলতেন- স্যার এতো টাকা দিয়ে কি করবেন! তিনি জবাব না দিয়ে শুধু হাসতেন। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে তিনি আরো খোলামেলা এবং আন্তরিকতা দেখাতে লাগলেন। আর এই সুযোগে আমিও নানা রকম বেফাস কথা বলে তার মানসিক অবস্থা বুঝার চেষ্টা করতাম। একদিনের একটি কথার জন্য আমার আজও আফসোস হয়-কেন আমি ওমন করে সেদিন ওকথা বলতে গিয়েছিলাম! ঘটনার দিন বিকেলে আমি, মাহমুদুর রহমান এবং মীর কাসেম সাহেব আমাদের কারা প্রকোষ্ঠের সামনের মাঠটিতে চেয়ারে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমি প্রশ্ন করলাম- ভাই আপনার ওজন কতো ? তিনি বললেন ৯২ কেজি? আমি বললাম সর্বনাশ তাড়াতাড়ি কমান! না হলে সিরিয়াস ঘটনা ঘটে যাবে। কি ঘটনা ঘটবে- তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন । আমি বললাম হাব ভাবে মনে হচ্ছে আপনার ফাঁসি হবে! তিনি বললেন তাতে কি ? আর ফাঁসির সাথে ওজনের কি সম্পর্ক? আমি বেওকুফের মতো বলে ফেললাম- শুনেছি শায়খ আব্দুর রহমানের অতিরিক্ত ওজনের জন্য তার লাশ ফাঁসিতে ঝুলানোর এক পর্যায়ে ঘাড় থেকে - - - - - -। আমার কথা শুনে উনি শিশুর মতো হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসতে হাসতে আসমানের পানে তাকালেন এবং বললেন- এমপি সাহেব! সব ফয়সালা তো ঐ আসমান থেকেই আসবে ! আমার মুখের ওপর যেনো বজ্রপাৎ হলো- বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। আমি অনেকটা অমনোযোগী হবার ভান করে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম কিন্তু কিছুতেই নিজের দূর্বলতা গোপন রাখতে পারলাম না। আমি তার মুখপানে তাকালাম। আমার চোখ অশ্বস্তিতে জ্বালা পোড়া করতে লাগলো। আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে চোখের আড়াল করতে চেষ্টা করলাম। তিনি তখনো আকাশের পানে তাকিয়ে ছিলেন। এই ঘটনার পর আমি মনে মনে তওবা করলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম জীবনে আর বেফাস কথা বলবো না। মাহমুদুর রহমান সাহেব, মামুন সাহেব ও আমি বেশির ভাগ সময়ই রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করতাম। আর মীর কাসেম সাহবে শুধু শুনতেন। একদিন মামুন বললেন - স্যার! আমি আপনার মতো বেওকুফ লোক জিন্দেগীতে দেখিনি। আপনি তো বিদেশ ছিলেন। দেশে এসে ধরা দিলেন কেনো? তিনি শিশুর মতো প্রশ্ন করলেন- বিদেশে কেনো থাকবো? মামুন আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন- শুনেন! কথা শুনেন ! তিনি মামুনের কথার জবাবে বললেন - আমি তো নিজে জানি যে আমি কি করেছি! তাই নিজের কর্মের ওপর বিশ্বাস করেই দেশে ফিরেছিলাম। তা ছাড়া দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতিও আমার আস্থা ছিলো । তার উত্তর শুনে মামুন মহা বিরক্ত হয়ে বললো - স্যার খান! আরেকটা রুটি খান। আমি আর মাহমুদুর রহমান মুচকী মুচকী হাসতে লাগলাম। মীর কাসেমের ২টি অভ্যাস নিয়ে আমরা হাসা হাসি করতাম। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে সে একেক সেট পোশাক পরতেন। আমরা চার ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করতে গিয়ে দেখতাম প্রতিবারই তিনি পোশাক পরিবর্তন করে আসতেন। মামুন ছিলো দারুন মুখপোড়া প্রকৃতির- বলতেন কেন চার বেলা পোশাক পরিবর্তন করেন ? তিনি বলতেন - ৪ বেলা নয় - আমি তো ৫ বেলা পোশাক পরিবর্তন করি। একজন রাজা বাদশাহ বা সম্মানীত লোকের দরবারে আমরা যেমন পরিপাটি নতুন পোশাকে হাজির হই- তেমনি আল্লাহর দরবারে হাজির হতে গিয়ে আমি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় পোশাক পরিবতর্ন করি। পোশাক পরিবর্তন ছাড়াও তার আরেকটি অভ্যাস ছিলো প্রতি বিকেলে নীচে নেমে সকলের সঙ্গে সালাম বিনিময় ও করমর্দন করা। আমাদের সেলের প্রধান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি রাস্তায় চলাচলকারী আসামী এবং অন্য সেলের কয়েদীদের সঙ্গে সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। আসামীদের মধ্যে কিলার আব্বাস সহ বেশ কয়েকজনের বাড়ী ছিলো মিরপুরে। তিনি তাদের সঙ্গে একটু বেশী আন্তরিকতা দেখাতেন। মামুন টিপ্পনি কাটতেন - স্যার মিরপুর থেকে ইলেকশন করবেন তো ! তাই জেলে বসে সব কিছু ঠিক ঠাক করছেন। তিনি শান্ত শিষ্ট ভঙ্গিতে সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিতেন- আরে নাহ;কোন ইলেকশন না । আমি প্রতিবেশীর হক আদায় করার চেষ্টা করছি। যেদিন তার কোর্টে হাজিরা থাকতো সেদিন সকালে তিনি আমাদের সবাইকে সালাম জানিয়ে যেতেন। ট্রাইবুনালে হাজিরার দিন তিনি সব সময় স্যুট নিয়ে যেতেন। ফিরে এসে বিভন্ন বিষয় মজা করে বর্ননা করতেন। তাকে আমরা মুখ কালো করে থাকতে দেখিনি কোনদিন। হঠাৎ একদিন নাস্তার টেবিলে দেখলাম মীর কাসেম সাহেবের মন খুব খারাপ। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপার কি? কি হয়েছে? তিনি বললেন-একটি বিষয় চিন্তা করতে করতে রাতে আর ঘুম হলো না। আর সে কারনেই রাত থেকে মনটা ভার হয়ে আছে। আমরা কথায় বেশ সিরিয়াস হয়ে গেলাম। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-কি নিয়ে সারারাত চিন্তা করলেন আর কেনোই বা এতো মন খারাপ হলো? তিনি মুখ ভার করেই জবাব দিলেন- কাল রাতে একটি জার্নালে পড়লাম সাইবেরিয়া, আইসল্যান্ড এবং এন্টার্কটিকার বরফের স্তর বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের কারনে দ্রুত গলে যাচ্ছে। এভাবে গলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো দেশ সমূদ্রের জলরাশির মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ যদি বিলীন হয়ে যায় তবে ১৭ কোটি মানুষের কি হবে ? আমি পুরো বেওকুফ হয়ে গেলাম এবং তার মুকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবলাম- হায়রে মানুষ! যার নিজের জীবনের যেখানে ঠায় ঠিকানা নেই সেখানে তিনি কিনা ভাবছেন এ্যান্টার্কটিকার বরফ নিয়ে। আমার ওয়াক্তের নামাজ সহ তারাবীর নামাজে তিনিই ইমামতি করতেন। নামাজ শেষে লম্বা মোনাজাত ধরতেন। আমরা ছাড়াও আরও ৭/৮ জন সেবক কয়েদি আমাদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন। প্রতি দিনকার মোনাজাতে বলতেন- ” হে আমাদের পরওয়ার দিগার। তুমি আমাদের কর্ম, আমাদের মন এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বেখবর নও। আমরা যদি অন্যায় করে থাকি- তাহলে আমাদের বিচার কর! আর যদি অন্যায় না করে থাকি তবে তোমার রহমতের চাদর দিয়ে আমাদের আচ্ছাদন করে রাখো। তোমার উত্তম ফয়সালা, রহমত এবং বরকত সম্পর্কে আমরা যেনো হতাশ হয়ে না পড়ি এজন্য আমাদের চিত্তকে শক্তিশালী করে দাও। ইয়া আল্লাহ! আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোন জালেমের জুলুম কোনদিন তোমার মাহবুব বান্দাদের একচুল ক্ষতি করতে পারেনি। হায় আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তোমার মাহবুব বানিয়ে নাও। আমাদেরকে এই কারাগার থেকে বের কর- তোমার দেয়া নেয়ামত-আমাদের পরিবার পরিজন সন্তান সন্ততিদের নিকট আমাদেরকে ফেরত যাবার তওফিক দাও। এই কারাগারের চার দেয়ালের বেদনা এবং অপমান থেকে আমাদেরকে এবং আমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর। হে মালিক-বাংলাদেশের প্রতি তুমি রহম কর। দেশের ক্ষমতাসীনদেরকে ন্যায় বিচার করার তওফিক দাও। আর আমাদের বিশ্বাসকে মজবুতি দান করো। তোমার রহমতের আশায় চাতক পাখির মতো আকাশ পানে তাকিয়ে থাকি! তোমার দরবারে হাত পাতি- হে আল্লাহ তুমি আমাদের গুনাহ সমূহ মাফ করো, আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে অতি উত্তম প্রতিদান দাও এবং সর্বাবস্থায় আমাদেরকে হেফাজত করো। আমীন। (এই পোষ্টটি দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে) (এই বিভাগে প্রকাশিত মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে )
- ট্যাগ:
- রাজনীতি
- মীর কাশেম আলী