ছবি সংগৃহীত

মা, তুমি আছো বলে...

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০১৫, ১২:৪৩
আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৫, ১২:৪৩

সংগৃহীত ছবিতে অলঙ্করণ করেছেন আকরাম হোসেন।

(প্রিয়.কম) আজ প্রকাশিত হলো দীপান্বিতা ইতি’র গল্প ‘মা, তুমি আছো বলে...’।


মা, তুমি আছো বলে...

১.

খুব ঠান্ডা লাগছে রাহাতের। খুউব। মাঘ মাসের গাঢ় শীতে খালি পায়ে খালি গায়ে খেজুরের রস কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে দেবার জন্য ফুল চুরি করতে গিয়েও এতো ঠান্ডা লাগেনি কখনো ওর। বরফের দেশের ছবি যখন দেখাতো টিভিতে, তখন মনে হতো- বাবারে তুষারের মধ্যে তো কম্বল গায়ে চাপালেও দাঁতে দাঁত লেগে যাবে। এখন মনে হচ্ছে, তুষারের মধ্যে গড়াগড়ি দিলেও হয়তো এতো শীত লাগতো না। কচুরিপানার মধ্যদিয়ে যখন প্রাণপনে প্রাণঘাতী এই দীঘির তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখন শীতের বদলে শরীর গরম হয়ে উঠছিলো। একটু একটু করে শক্তি শেষ হয়ে গেল। প্রথমে ঘন কচুরিপানার মধ্যে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগলো রাহাত। আমাজান জঙ্গলের একটা ভিডিও দেখেছিল মামার বাসায়। নাকটা পানিতে ডুবে গেলেও চোখ দিয়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সে জঙ্গলেরর গভ��রতাও হার মানায় জেঁকে এসে বসা এই কচুরিপানাগুলো। শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিঃশেষ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে মাথার চুলগুলোও ডুবে যায় ওর। তখনই চেপে ধরে এই অতিপ্রাকৃত ঠান্ডা। শরীরের প্রতিটি রোমকুপ দিয়ে বরফপানি ঢুকছে। অবশ করে দিচ্ছে শেষ চেতনাটুকুও। চেতনা কি ছিল রাহাতের? নাকি পরাজয়ের হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে নিশ্চিত আর অনিশ্চয়ের দোলাচলে নতুন কোন জগতে প্রবেশ করছিল সে? নয়তো কোন অনুভূতিতে শেষ মুহুর্তে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠেছিলো? হঠাৎ করেই মায়াবী উষ্ণ কোন স্পর্শে সকল শীতলতা উধাও। ভরশূন্য মনে হলো শরীরকে। না- বাবা, তার বকার ভয়- কোন কিছু মনে পড়ছে না। ভালো রেজাল্ট করলে মা যে লাল রঙের হারকিউলিস সাইকেলটা কিনে দেবে বলেছে, সেটা কিংবা রান্নাঘরের মিটসেফের তাকে রাখা ঘন দুধের পায়েসের কথাও মনে পড়ছে না। সারাদিন হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় বলে  রাহাতই ছোট বোনটার নাম রেখেছে হাম্মি। বাবার বকুনি খেয়ে মন খারাপ করে বসে থাকলে হাম্মি কাছে এসে ছোট্ট হাতে গাল ধরে বলে আদোল... আদোল... আর মুখ থেকে চাকোলেটের টুকরো বের করে রাহাতের মুখে পুরে দেয়। ডল পুতুলের মতো হাম্মির কথাও মনে পড়ছে না। নতুন কেনা ক্রিকেট ব্যাট, জ্যামিতি বক্সে লুকানো টাকা কিংবা পড়ার বইয়ের তাকের পিছনে রাখা দোলন ভাইদের বাড়ী থেকে চুরি করে আনা মৎসকন্যার ছবির প্রচ্ছদের বড়দের উপন্যাস... কোন কিছুর কথাই মনে পড়ছেনা তার। মনে পড়ছে না প্রাণের বন্ধুদের, তাদের সঙ্গে কাটানো অসংখ্য সময়, অসমাপ্ত অগুনতি প্ল্যান। যে সব প্ল্যানের নিত্য নতুন আইডিয়া রাহাতের মাথা থেকেই বেরোয় বলে বড়দের মধ্যে তার পরিচয়, ‘দুষ্টের শিরোমনি’। মনে পড়ছেনা, জমিদার বাড়ীর প্রাণঘাতী দিঘির জলে মুহুর্মুহু তলিয়ে যাচ্ছে সে। বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে মনে। নতুন এক অচেনা জগতের দরজা যেন খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছে এতো শান্তি আর কোনদিন পায়নি। দুচোখ ভেঙে আসছে গভীর ঘুমে। আর ঘুমোতে ভয় কি! খুব আদরে, খুব মমতায় তাকে যেনো কেউ জড়িয়ে রেখেছে। গভীর আবেশে কি মনে করে হাসলো যেনো, তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো রাহাত। ঠোঁটের কোনে তখনও স্বস্তির হাসি।
 


২.
গরমের ছুটির আগের ক্লাশগুলো এতো বেশী লম্বা মনে হয়, যে কলেজ ভার্সিটির নাম শুনলে গায়ে জ্বর আসে। হাই স্কুলেই এতো পড়া আর পড়া, কলেজে গেলে না জানি কি হয়। হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়, ক্লাস সিক্সের চেয়ে প্রাইমারী স্কুলের পাঁচ পাঁচটা বছর কত মধুর ছিল। এখানে তো স্যার পড়ানো শুরু করলে আর থামতেই চায় না। ইংলিশ আর বাংলায় পার্থক্য থাকে না কোন, সব কেমন যেনো জড়িয়ে আসে। জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের সিংহাসন আরোহন থেকে শুরু করে মোঘল সম্রাজ্যের পতন সব একই ক্লাসে পড়াতে চায়। পৌর ও অর্থ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি এক সমাজ নীতি তৈরী হয়ে যায়। বিজ্ঞানের বিশেষ জ্ঞান উড়ে যায় হাই তোলার বিশাল শ্বাসে ভেসে। এক একটা অংকের শুরু থেকে শেষের নাগাল পাওয়া ভার। কৃষিশিক্ষার ক্লাসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ‘আমি যদি কৃষক হতাম’ রচনা সিনেমার মতো স্বপ্নে দেখা হয়ে যায়। স্কুলের গেট পার  হয়ে ক্লাসঘরে ঢোকার পর ছুটির ঘন্টা শোনা অব্দি বয়স মনে হয় বেড়ে যায় অনেকটা। আর স্কুল শেষ হওয়ার পর? তারপর আর থাকে কতটুকু সময়? ফুটবলে দুটো লাথি, ব্যাটে বলে ক্রিকেট, একেকদিন পুকুরে একটা কি দুটো ডুব, পড়তে বসে ঝিমানো আর ঘুমচোখে খেয়ে বিছানায় যাওয়ার জন্য কতটুকুই আর সময় পাওয়া যায়? রাত তো কেটে যায় নানা স্বপ্নে। কিন্তু দিনগুলোকে তো মনে হয় এক একটা বছর। তবে ছুটি শুরু হয়ে গেলে প্রথম দুএকদিন খুব আমোদ হয় মনে। ক্লাসের লম্বা ঝিমুনি, স্যারদের বকাঝকা এমনটি কানটানা বা বেতের আদর, বাবার রক্তচক্ষু আর মায়ের ধারাবাহিক অভিযোগের তালিকা থেকেও ছুটি মিলেছে ভেবে ভারি আনন্দ হয়। এখন এই হবে সেই হবে এই করবো সেই করবো ভেবে উত্তেজনায় খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে যায়। কিন্তু তারপর কয়েকদিন পরেই অস্বস্তি শুরু হয়। মনে হয় এই কিছু একটা ঘটে যাবে, কিন্তু ঘটেনা। ছুটির দিনগুলোতেও গৎ বাঁধা জীবনে আটকা পড়ে যেতে হয়। ছুটির প্ল্যান একেক জনের একেক রকম থাকলেও প্রথম কদিনের পর সব বন্ধুদের জীবনধারা একই রকম হতে থাকে। প্রথম কদিনে কেউ মামা বাড়ি, ফুপু বাড়ি, গ্রামের বাড়ি ঘুরে আসে। বা বাড়ীতে আসা মেহমানদের নিয়ে ব্যস্ত থাকা। কিংবা বাড়ীতে আনা নতুন টিভি, ডিভিডি, ক্যাসেট, ক্যামেরা ইত্যাদির উপর নজরদারী করা। আর দুএকজনের ভিডিও গেমস্ নিয়ে মাতামাতি। কিন্তু ছুটির প্রথম দিনগুলোর আমেজ কেটে যেতেই সব বন্ধুদের প্রতিদিনের ধরন ধারন একরকমই হয়ে যায়। এই যেমন ছুটি শুরুর কদিন পরেই রাহাত, সুজন, তুহিন, জিতু, রনি, তানিম আর হাসিবের প্রতিদিনের রুটিন মোটামুটি একই রকম হয়ে গেলো। সকালে উঠে নাস্তা করা এবং তারপরে বাবা মায়ের চোখের শান্তির জন্য অংকের বই নিয়ে খানিকটা সময় বসে থাকা। এরপর পুরোদিন বাইরে কাটালেও কোন সমস্যা নেই, দুপুরে একফাঁকে খেয়ে গেলেই হলো। ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা কারও বাসায় গিয়ে ক্যারাম কিংবা লুডো খেলা ছাড়া আর কোনও কিছু করার নেই। গল্পের বই অদল বদল করে পড়েও তো সময়টা কাটেনা। এসব করে করেও তো অদৃশ্য কোন এক নিয়মের মধ্যে আটকে যায় ওরা। স্কুলের রুটিনের পরে শুরু হয় ছুটির দিনের রুটিন। এতো রুটিন বাঁধা জীবন যাপন ভালো লাগে? যদি নিয়মই ভাঙা না গেল, তবে লম্বা এই ছুটির মানে কি?



৩.
প্রতিদিন বিকালে স্কুলের মাঠে বা বাজারের শেষ মাথায় ধানের চাতালে প্রত্যেকেরই মাথায় বসে নিত্য নতুন প্ল্যান আসে। এই যেমন মোটকা রনির মাথায় সেদিন এক বুদ্ধি আসলো। ‘চল, একদিনের জন্য কোথাও হাওয়া হয়ে যাই।’ কিন্তু তুহিন যখন প্রশ্ন করলো কই যাবো, তখন ওর মুখটা দেখে মনে হল রনি ভাবছে ‘সেটাও কি আমার দায়িত্ব’? হাসিবের প্রস্তাব ছিল, চাল ডাল নিয়ে বনের মধ্যে পিকনিক করতে যাওয়া যায়। কিন্তু রাহাত, জিতু আর তানিমের কথা হল- এটা প্রাইমারির পোলাপান করে। তানিম আবার হাসিবকে উপদেশও দিয়ে দিলো, ‘তোর ভুলে যাওয়া উচিত না, আমরা এখন আর প্রাইমারি স্কুলে পড়ি না। ক্লাস সিক্সের ছাত্র হয়ে তুই এমন কোন কাজ করতে পারিস না যাতে প্রাইমারির পোলাপানের সাথে আমাদের কোন পার্থক্য না থাকে।’ প্রতিবাদে অবশ্য মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে হাসিব বলেছিল, ‘কই, আমরা তো এখনও প্রাইমারি স্কুলের মাঠে গিয়ে খেলি। আর প্রাইমারির পোলাপানও তো আমাদের সাথে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে’। কিন্তু অন্য সবার উদাস চেহারা আর তানিমের চোখে বিরক্তি দেখে এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় নি হাসিব। প্রাইমারির ছেলেদের নিয়ে কথা হচ্ছিল দেখেই রাহাতের মনে হঠাৎ এক বুদ্ধি এলো। ‘শোন, আমরা এখন বড় হয়েছি। হাইস্কুলের ছাত্র। মনে নাই, ক্লাস সিক্সের প্রথম দিন বড় ভাইরা এসে আমাদের দিয়ে ইচ্ছামতো মজা করলো। কাউকে বললো গাইতে, কাউকে বললো নাচতে।’ রনি সাথে সাথে ফোস করে উঠে বললো, ‘হ্যা, আমায় বলে কি না, কি খেয়ে এতো মোটা হয়েছিস? পুরো টিফিন খেয়ে নিয়েছিল। স্কুলের প্রথমদিন দেখে আম্মা স্পেশাল নাস্তা বানিয়ে দিয়েছিল রে।’
রনির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে রাহাত আবার তার প্ল্যান বলা শুরু করলো। আর কিছু না, এলাকায় যতো প্রাইমারীর ছেলে আছে, তাদের ডেকে এনে ওইরকম কিছু একটা করতে হবে। রনি সাথে সাথে রাজি। রাজি হলো তুহিন, জিতু আর হাসিবও। সেদিন বড় ক্লাশের ছেলেরা এসে তুহিনের শার্টে কলমের কালি লাগিয়ে দেয়, বাসায় বকাও কম খেতে হয়নি তা নিয়ে। হাসিবকে কাতুকুতু দিয়েছে অনেক্ষণ, মাটিতে নাক না ঠেকানো পর্যন্ত। জিতুর তো সেদিনের অপমানের কথা চিন্তা করতেই কান লাল হয়ে যায়। ওর চুল একটু বড় বড়। তাই বলে টাকা বাঁধার রাবার দিয়ে মাথায় ঝুঁটি বেঁধে সকলের সামনে নাচতে বলবে? তবে সুজনের কথায় রাহাতের প্ল্যান প্রায় বানচাল হওয়ার যোগাড়। ‘প্রাইমারির ছেলেগুলার তো কোনো দোষ নাই। আমরা ওদের সাথে এমন করলে ওরাও তো আমাদের খারাপ ভাববে।’ সুজনের এই কথায় একরকম বাধ্য হয়েই সায় দেয় সবাই। কিন্তু চাপা রাগ কমেনা কারও। ‘দ্যাখ, আমাকেও তো কম কষ্ট দেয় নি। কুজন বলে ডেকেছে।আমার টিফিন বক্স থেকে কেক বের করে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছে।তোদের কি মনে হয়, ওদের বাগে পেলে আমি ছেড়ে দেবো? কিন্তু সুযোগের অপেক্ষা তো করতে হবে, না?’ নতুন উৎসাহে চনমন করে ওঠে সবাই। এ আলোচনায় কিন্তু মন নেই তানিমের, যেন অন্যদিকে তাকিয়ে মন দিয়ে আকাশ বাতাস দেখছে। ও এই আলোচনায় অংশ নেবে কেনো? ওকে তো কেউ কিছু বলে নি। চেয়ারম্যানের ছেলে তো, তাই তানিমকেও বড় ক্লাশের ছেলেরা এড়িয়ে চলে। আর স্কুলের জমিও নাকি ওদের ছিল একসময়। তাই স্যাররা পর্যন্ত খাতির করে তানিমকে। বন্ধুরা তাই তানিমকে দলে রাখে ঠিকই, তবে কেউ পছন্দ করে না খুব একটা। সুজনের নতুন উদ্যমে সবাই নড়ে চড়ে বসলেও আড়চোখে তাই তানিমকে দেখছিলো।  সুযোগ পেলে বড় ক্লাসের ছাত্রদের কি কি শিক্ষা দেওয়া হবে, এটা নিয়ে কথা শুরু হওয়ার আগেই কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তানিম। ‘আমাদের আশে পাশে অনেক বিখ্যাত জায়গা আছে, সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলে কেমন হয়?’ প্রস্তাবটা মন্দ না। নিজেদের বাড়ী ঘর আর মামার বাড়ি চাচার বাড়ির বাইরে নতুন কোন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখা যাবে। তুহিন প্রথমেই রাজি হয়। ‘হ্যাঁ, বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যাবে। যেখানে কেউ যায় না, সেখানে গিয়ে সবাই কে চমকে দেওয়া যাবে।’ সাথে সাথেই বাঁধ সাধে হাসিব। ‘বিপদ আপদ কত কিছু হতে পারে। আর বাসা থেকে যেতে দেবে ভেবেছিস?’ তানিম অবশ্য বলে দেয়, দূরে কোথাও না গেলেই হল। ফোঁস করে ওঠে জিতু, ‘আরে, আমরা কি বাচ্চা নাকি? যেতে দেবে না মানে? আর বিপদকে ভয় পাস নাকি তুই’।
হাসিবের মিইয়ে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে সুজন বলে, ‘শিক্ষনীয় ব্যাপারও তো থাকতে পারে। মনে নাই স্কাউটে শিখিয়েছে। কি করে ক্যাম্প করতে হয়। হেঁটে হেঁটে কি ভাবে নতুন জায়গা খুঁজে বের করতে হয়। সবাই একসঙ্গে বিখ্যাত জায়গা ঘুরতে যাওয়ার কথা বললে বাড়িতে রাজি হয়ে যাবে মনে হয়।’ সুজনের কথা পছন্দ হয়না শুধু রনির। স্কাউটের ট্রেনিংয়ের সময় ওযে কি কষ্টে ছিল, তা মনে আছে সবার। মোটা শরীর নিয়ে এতো নিয়ম কানুন আর শারীরিক কসরতের অভিজ্ঞতা যে রনি এখনো ভোলে নি, আমসির মতো মুখ দেখে বুঝতে পারে সবাই। কিছুটা ভয় ভয় নিয়েই রনি বলে, ‘দূরে গিয়ে কি লাভ। কাছে ধারেই গেলে ভালো হতো না?’ রনির কথার রেশ ধরে তানিম বলে ওঠে, ‘আমিও তাই বলছিলাম। আপাতত কাছে কোন ঐতিহাসিক বিখ্যাত জায়গা থেকেই এই প্রজেক্ট শুরু করি। এই যেমন ধর আমাদের বাড়ি।’ তানিমের কথায় সবাই স্পষ্ট বিরক্ত। জিতু আর রনি তো একসাথেই বলে ফেললো, ‘তোদের বাড়ি’। ‘হ্যাঁ। আমাদের বাড়ি।আমাদের বাড়ির বয়স কত জানিস, পায় দেড়’শো বছর। এমন জমিদার বাড়ি আর কটা আছে এ এলাকায়? বাড়ির পাশে কত্ত বড় দিঘি। আসে পাশে অ্যাডভেঞ্চার করার মতো এতো ভালো জায়গা আর আছে নাকি?’ নাক কুঁচকে যায় সকলের। জমিদার বাড়ির আশে পাশের পুরনো বাড়ি ঘর তো দূর থাক, তানিমদের বাড়ি বা দিঘির প্রতিও কোন আগ্রহ নেই ওদের। বরং জমিদার বাড়ি আর লালদিঘী থেকে দূরেই থাকতে চায় সব্বাই।আর কথায় কথায় নিজেদের জমিদার পরিবারের কথা টেনে এনে নিজেকে আর সবার থেকে উচু প্রমাণ করার জন্য তানিমের এই কথা গুলোও সহ্য হয়না কারো। তার কথা উড়িয়ে দিয়ে অন্যান্য প্ল্যান চলতে থাকে পুরোদমে।


৪.
তানিমের বাবা সুন্দরপুরের চেয়ারম্যান, খুব প্রতাপশালী মানুষ। ওদের পরিবার এই এলাকার জমিদার ছিল একসময়ে। সুন্দরপুর হাইস্কুল ওদের জমির উপরই তৈরি, স্কুলটা নাকি ওর দাদাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিরাট বাড়ি ওদের। অনেকদিনের পুরানো জমিদার বাড়ি, কিন্তু নিয়মিত সংস্কার হয় বলে অত পুরনো মনে হয় না। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকলে মনে হয় মোটা মোটা থাম্বা, দেয়াল আর ভারী কাজ করা দরজা জানালা গলা বন্ধ করে দিচ্ছে। প্রতিটি ঘরেই পুরনো দিনের আসবাবপত্র, দেয়ালে পূর্বপুরুষদের ছবি, পুরানো অস্ত্র ঝোলানো। একটা ঘর থেকে আরেকটা ঘরে ঢুকলে মনে হয় কয়েকযুগ পার হয়ে গেছে। বইয়ের পাতায় ইতিহাস কিংবা বাংলাদেশের অতিত ঐতিহ্য পড়তে গিয়ে অনেক কিছুর ছবি দেখে ওরা। সেসব ছবির অনেককিছুই খানিকটা জাদুঘরের মতো করে ওদের বাড়িতে সাজানো। তানিমের মা খুব রুচিশীল, সবকিছু ছবির মতো গুছিয়ে রাখেন। আবার প্রত্যেকটা ঐতিহাসিক জিনিসপত্রের সঠিক ইতিহাসটাও তিনি জানেন। তিনিই টোটা রাইফেল, বল্লম, ঢাল, বিখ্যাত আঁকিয়ের আঁকা ছবি এবং সেই ছবির ইতিহাস ওদের বলেন। সবাই মিলে এঘর ওঘর ঘুরলে কেমন যেন রোমাঞ্চ হয়, তবে একা থাকলে হঠাৎ হঠাৎ কেমন জানি গা ছমছম করে ওঠে। আর সেই অদ্ভুত অনুভূতিই রাহাতের খুব পছন্দ। তবে অন্যান্যরা অস্বস্তিতে পড়ে অথবা ভয় পায় বলেই আন্টি বার বার যেতে বললেও ওরা তানিমের বাড়ি তেমন একটা যেতে চায় না। আন্টি ওদের অনেক আদর করে। গেলে না খাইয়ে ছাড়ে না, আর কত রকমের যে রান্না তার। আর তানিম তো ওর নতুন খেলনা, বন্দুক, জামা কাপড়, বই কিংবা জমানো টাকা দেখিয়ে অবাক করে দিতে চায় তাদের। মনে মনে খুশি না হলেও মুখে ওরা চমকৃত হওয়ার ভান করে। খালি ঠোঁট কাটা রাহাত মাঝে মধ্যে বলে বসে, ‘তুই কি শুধু তোর জিনিসপত্র দেখাতো ডাকিস আমাদের?’ তবে ওদের ছাদটা বিশাল ছাদটা অন্য সবার মতো রাহাতেরও পছন্দ। একপাশে সিঁড়িঘর, মোড়ানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে প্রায় আড়াই পাক উঠলে ছাদের দরজা। দরজাটা খুলে দিলেই যেন অন্য ইচ্ছেপুরীর দরজা খুলে যায়। প্রায় মাঠের মতো বিশাল ছাদ। প্রায় বুক সমান মোটা পাঁচিল ঘেরা ছাদের চারপাশে নানা গাছপালা। তারমধ্যে বরই, পেয়ারা, আম, জাম তো আছেই- গাব, তেঁতুল, কাউফলের গাছগুলোও হাতের নাগালে। ফলের মৌসুমে তাই তানিমদের ছাঁদ সবার জন্য লোভনীয়। সুজনদের বাড়িতেও অনেক ফলের গাছ, জিতুদের বাড়িতেও কম নেই। তুহিন, রাহাত, রনিদের বাড়িতে কম ভাবলেও চার পাঁচ রকমের ফলের গাছ। তবে লবণ মরিচ নিয়ে ছাদে উঠে হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফল খেয়ে আর গল্প করে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটানোর ব্যবস্থা এ বাড়ি ছাড়া আর কোথাও নেই। হাসিব তো তাই ফলের মৌসুমে তানিমকে রিতিমতো খাতিরদারি করে। আর করবেই কি বেচারা! বন্ধুরা যেভাবে তানিমের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে মাঝে মাঝে, ভয় হয় হাসিবের- যদি তানিম ছাঁদে উঠতে না দেয়? তবে ওরা এলে তানিম খুশিই হয়। ফলের জন্য হলেও নিজের কদর খানিকটা বাড়ে বন্ধুদের মধ্যে। মৌসুম ছাড়াও খেলাধুলা আর আড্ডাবাজির জন্য ছাঁদটা পারফেক্ট। পাঁচিলের সঙ্গেই বেঞ্চের মতো করে বসার জায়গা তৈরি করা আছে, সুজন প্রায়ই সেটায় বসে উদাস মনে কি যেন ভাবে। তুহিনের ধারণা মনে মনে কবিতা লেখে সে। তবে সুজনকে খানিকটা সমীহ করে বলেই জিতু মনে করে বড় হয়ে কি করবে, তাই ভেবে চলে বন্ধু। যে যখন যেটা বলে, তাতে সায় দিয়েই হাসিবের শান্তি। ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখলে খুব খুশি হয় রনি, মোটা শরীর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার পর নিজে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় পায়। অবশ্য রাহাত এসব ভাবাভাবির মধ্যে না গিয়ে এক ধাক্কায় সুজনের ভাবনার সুতো কেটে দিয়ে সবাইকে নিয়ে নিত্যনতুন খেলা শুরু করে। তবে বন্ধুর বাড়িতে এসে হৈহুল্লা তো আর করা যায় না, তাই ওরা ছাঁদে উঠে প্রায়ই ঘুড়ি ওড়ায়। পুরো ছাঁদে লাল ইটের দাগ কেটে কেটে নানা রকম খেলা খেলে। তবে খেলা, গল্প, আড্ডা বা ফল খাওয়া যাই হোক না কেন, একটা দিকে কেউ যায় না। বাকি তিনদিকে অবাধ যাতায়াত হলেও দক্ষিণ দিকটা সচেতন ভাবে সবাই এড়িয়ে চলে। বাড়ির দক্ষিণ দিকের প্রাচীরের বাইরেই তো দিঘিটা। আর ওই দিঘি নিয়েই তো যত গণ্ডগোল।


৫.
সুন্দরপুরের সবাই জানে, ওই দিঘিটা খারাপ। খারাপ মানে এতোই খারাপ, বিশাল দিঘিটা এখন প্রায় পরিত্যাক্ত। জমিদার বাড়ির দক্ষিণ দিকে দিঘিটার একটা কোনা। গোল নয়, খানিকটা আয়তাকার এই দিঘি আরও দক্ষিণে লম্বায় প্রায় আধ মাইলের কাছাকাছি। আর চওড়াও কম নয়, কোয়ার্টার মাইল তো হবেই। লম্বালম্বি কাউকে ডাক দিলে এপাড়ের কণ্ঠ ওপারে যাওয়া মুশকিল। আর এক কোনে দাঁড়ানো মানুষকে বিপরীতের কোনা দিয়ে পুতুলের মতো দেখায়। জমিদার বাড়ির ঠিক উল্টো কোনায় ভাঙা একটা একতলা দালান। কোনকালে নাকি এটা মন্দির ছিল। চার দিকেই বাঁধানো ঘাট। জমিদার বাড়ির দক্ষিণে অনেকদূর পর্যন্ত কোন বাড়ি ঘর নেই। তাই দিঘির দক্ষিণ দিকটা জঙ্গলের মতো হয়ে গেছে। তানিমদের বাড়িতে ঢোকার রাস্তা থেকে অন্যান্য পাড় দেখা গেলেও বোঝা যায়, লোকজনের যাতায়াত নেই কোনপাড়েই। এতো বড় দিঘি, তবুও কচুরিপানায় ভরে থাকে সারাবছর। কোন লোকজন দিঘিটা ব্যবহার করে না। পারতপক্ষে দিঘির পাড়ে কেউ যায়ও না। শুধু তানিমের বাবা কালেভদ্রে লোকজন নিয়ে দিঘির চারপাশে চক্কর দিয়ে আসেন। যাতে কোন বদমায়েশ লোক আস্তানা না গেড়ে বসে। আর বাঁশ কিংবা গাছের দরকার হলে কেটে আনা হয় দিঘীর পাড় থেকে। বিশাল দিঘি, শান বাঁধানো ঘাট, টলটলে পানি- গরমের কালে বাচ্চাদের কাছে কাছে খুবই লোভনীয় জায়গা। কিন্তু বাচ্চাদের ওটায় নামা তো দূরের কথা, পাড়ে যাওয়াও নিষেধ। ভুল করেও যদি দিঘির পাড়ে কোন কম বয়সী ছেলে মেয়েকে দেখা যায়, কেউ না কেউ ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সবার ধারণা, কোন বাচ্চা ওই দিঘিতে পড়ে গেলে তাকে আর জীবিত ফিরে পাওয়া যাবে না। এক কথায়, দিঘিটা মানুষখেকো। তবে কেন এমন কথা বিশ্বাস করে, তা সুজন, তুহিন, জিতু, হাসিব, রাহাত, রনিরা জানে না। তবে এটা সবাই জানে, দিঘির পাড়ে মাঝে মাঝে এক পেত্মীকে দেখা যায়। বড়রা অনেকেই দেখেছে, শাড়ি পরে রাত বিরেতে দিঘির চারপাশে হেঁটে বেড়ায়। আর নাঁকি কণ্ঠে টেনে টেনে কাঁদে। নিশুতি রাতে সেই কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ে অনেকদূর পর্যন্ত। মাঝরাতে তার কান্নার আওয়াজ শুনেছে অনেকেই। যদিও রনি দাবী করে, সে ও এক রাতে কান্নার শব্দ শুনেছে। কান্নার শব্দে নাকি বাতাসে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। তবুও ওর কথা উড়িয়ে দিয়েছে রাহাত। গণ্ডগ্রামের লোকজন আলেয়া দেখে ভুতের ভয় পায়, কান্নার শব্দও নাকি সেরকম কিছু। রনি একটু গল্পবাজ টাইপের বলে তার কথায় যেমন সায় দেয় নি কেউ। তবে আবার রাহাতের কথাতেও খুশি হতে পারলো না ওরা। পেত্মী কিংবা তার কান্না নিয়ে সবাই নিশ্চই মিথ্যা কথা বলে না। গ্রামের অনেক ছেলেই তো লেখাপড়া শিখে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ঢাকায় থাকে। দিঘির এই অদ্ভুতুড়ে রহস্যের নিশ্চই কেউ সমাধান করতে চেয়েছে। কই, পারলে তো জানতো সবাই। জিতুর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট চাচা তো একবার ছুটিতে তার বন্ধুদের নিয়ে গ্রামে এসেছিল শুধু দিঘি আর প্রেত্মীর কথা বলে। তারা নাকি কি সব ভূত পেত্মী নিয়ে গবেষণা করে। দিনে দিঘির চারপাশে ঘুরতো, আর রাতে ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে দিঘির পাড়ে বসে থাকতো। এক রাতে তারা কান্নার শব্দ শুনে রেকর্ড করে ফেলে সেই রহস্যময় শব্দ। কিন্তু বাসায় এসে বাজানোর পরে দেখা যায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর দুই একটা রাত জাগা পাখির ডাক ছাড়া কিছুই নেই। অথচ তাদের সবাই ওই কান্নার আওয়াজ শুনেছিল। তাদের এই গবেষণা কাজ হয়তো আরও কয়েকদিন চলতো। কিন্তু পথচলতি হাঁটুরে, প্রাইমারি স্কুলের শোভনলালের বুড়ো দাদু কানাইলাল আর ছিঁচকে চোর রহমত স্বচক্ষে পেত্মীটাকে দেখে তানিমের বাবাকে নালিশ করে। সুন্দরপুরের হাঁটে সবজি বেচা শেষ করে পাশের গ্রামের সুবল মহাজন শর্টকাটে বাড়ি ফিরছিল দিঘির পাশের রাস্তা দিয়ে। সামনে দিয়ে সাৎ করে কি যেন একটা চলে যায়, দিঘির দিকে তাকিয়ে দেখে সাদা শাড়ি পরা কে যে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। রাম রাম করতে করতে মূল রাস্তায় উঠে এসে অন্যান্যদের সঙ্গে ঘুরপথে বাড়ি ফেরে সে। শোভনলালদের বাড়ি বড় রাস্তার উল্টো পাশেই। ওর বুড়ো দাদু কানাইলাল সারা বছরই এ রোগ সে অসুখে ভোগে। সে রাতে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে উঠানে আসে কাশতে কাশতে। দিঘির দিকে চোখ পড়তেই তার কাশি বন্ধ। খোলা চুলে কোন এক নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে পাড়ে। বেগ চেপে কোনমতে ঘরে ঢুকে পড়ে সে, রাতে আর একবারও বাইরে আসার নাম নেয় নি। আর রহমতের কথা আর কাজের মধ্যে মিল কম পাওয়া গেছিল। সে একবার বলছে পাশের গ্রামে বোনের বাড়ি যাচ্ছিল, একবার বলছে সেখান থেকে ফিরছিল। তবে যে কাজেই সে দিঘির দিকে গিয়ে থাকুক, পেত্মী যে তাকে দেখা দিয়েছে এ বিষয়ে সবাই একমত। নয়তো দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তানিমদের বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে হাক ডাক দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল কেন? তাও ভাগ্যিস দারোয়ান ওর গলা শুনে সদর দরজা খুলে দেখে মুখ থেকে গ্যাজলা বেরোচ্ছে তার। পেত্মী নিয়ে একটা নয়, তিন তিনটা নালিশ আসে চেয়ারম্যানের কাছে। সবার অনুরোধে জিতুদের বাড়ি এসে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে তানিমের বাবা। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এসব ছেলেদের কর্মকাণ্ড পছন্দ হচ্ছেনা সেই অশরীরির। তাই ভয় দেখাচ্ছে সবাইকে। আর এলাকার মানুষ যেহেতু চাইছে না এসব নিয়ে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলুক গ্রামে, তখন আর দরকার নেই। তানিমের বাবা চলে গেলে জিতুর বাবা ছোটভাই আর তার বন্ধুদের ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। গবেষণা সেখানেই বন্ধ করে ফিরে যেতে হয় নবীন ভূত গবেষক দলের। অবশ্য যাবার আগে ছোটচাচার এক বন্ধু গজ গজ করে বলে গেছে, ‘পেত্মী না ছাই। হাঁটে মাল বেঁচে টাকা পেয়ে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরছিল ওই মহাজন। মনগড়া কি দেখেছে, তাই সবাইকে গপ্প দিয়ে বেড়াচ্ছে। আর ওই বুড়ো দাদুর তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তার চোখের কোন বিশ্বাস আছে? নিশ্চয়ই চুরি করে পালাতে গিয়ে হাঁপিয়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়েছে ওই শালা চোর, তাকেও সাপোর্ট করতে হলো চেয়ারম্যানের? তোরা গ্রামের লোক পারিসও।’ এত বড় হেনস্থার পর থেকে ছোটচাচা গ্রামে এলে এড়িয়ে চলে দিঘি আর দিঘির কাহিনীকে। পুরো ব্যাপারটাতে একটুও সত্যতা না থাকলে সুন্দরপুরের সবাই কি শুধু শুধু অমন বিশাল দিঘিটাকে এড়িয়ে চলে?

 

৬.
গতকালই তানিম বলে গেছে, আজ সে আড্ডায় আসতে পারবে না। ঢাকা থেকে চাচারা বেড়াতে আসবে আজ। ওর বড় চাচা ঢাকায় থাকে, অনেক বড় ব্যবসা। আসলে ব্যবসাটা করে দুই ভাই মিলেই। আশে পাশের গ্রাম থেকে সবজি, মাছ, দুধ আরও কি কি যেন সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠায় তানিমের বাবা। আর ঢাকায় থেকে সে ব্যবসা দেখে ওর চাচা। এছাড়াও আরও কিসের কিসের ব্যবসা আছে তার। মাঝে মাঝেই গ্রামে আসেন তিনি। কিন্তু ছুটি ছাটায় বউ ছেলে নিয়ে আসেন তারা। তানিমের বড় চাচারও এক ছেলে। ওদের চেয়ে বয়সে বড়। সেই ভাইয়ের গুণমুগ্ধ ভক্ত তানিম। গ্রামে কিংবা ঢাকায় ভাইয়ের লেজ হয়ে থাকে সে। বোধহয় আজও সেই ভাই আসবে ওদের বাড়িতে।

তানিম নেই বলেই এক কথায় দুকথায় দিঘির প্রসঙ্গ চলে আসে। ওর উপস্থিতিতে দিঘি নিয়ে কথা বলতে চায় না কেউ। শত হলেও ওদের বাড়ির দিঘি। যদিও দিঘির দেও কিংবা রাত বিরাতে কেঁদে বেড়ানো পেত্মীর কথা স্বীকার করে না সে। বলে, ‘আরে, এগুলো কুসংস্কার। আমাদের জমিদার পরিবারতো, তাই লোকে বিভিন্ন কথা রটায়। আমার ঘরের পাশেই তো দিঘি। এমনকি আমার ঘরের অন্যপাশের জানালাটা দিয়ে দিঘির ওই পাড়ের ভাঙ্গা মন্দিরটা পর্যন্ত দেখা যায়। কই, আমি তো কোনদিন দেও বা ওই পেত্মীকে দেখলাম না। যত্তোসব’। অন্যসবাই মুখবুজে সহ্য করলেও সুজন ওকে বোঝায়। ‘দ্যাখ, সুন্দরপুরের সবাই কিন্তু এ কথা বলে। সবকিছু মিথ্যা হলে নিশ্চয় এমন হতো না। নিশ্চয় কোন না কোন ঘটনা আছে এমন কাহিনীর পিছনে।’ সুজনের কথায় যেনো তেড়ে ওঠে তানিম, ‘একটা মানুষ খুঁজে বের করতে পারবি, যে পেত্মীটাকে সামনে থেকে দেখেছে?’ জিতু সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ‘কেন পারবো না? সুবল মহাজন, রহমত ভাই আর কানাই দাদুর স্বাক্ষীতেই তো ছোট চাচাদের গবেষণা বন্ধ হলো। মনে নেই?’ মুখ ভেংচে তানিম উত্তর দেয়, ‘এহ্, মনে নেই? সামনা সামনি দেখেছে কেউ? কেউ দেখেছে ছায়া, আর কেউ সাৎ করে চলে যাওয়া। গাছ না শিয়াল তাই তো বোঝা যায় না।’ রেগে ওঠে তুহিন, ‘তোর বাবাও তো বিশ্বাস করে। আর তাই তো তোর বাবা জিতুর বাবাকে বলে গবেষণা বন্ধ করে দিলো। তার বেলা?’ একথায় বড়দের মতো গলা খাকাড়ি দিয়ে তানিম বলে, ‘বাবা বিশ্বাস করে না। পর পর তিন জনের নালিশের জন্যই জিতুর বাবার কাছে গিয়েছিল। এলাকায় কোন অশান্তি করে তো লাভ নেই, না? আর বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। পারলে এমন কোন মানুষ নিয়ে আয়, যে সামনা সামনি পেত্মীটাকে দেখেছে।’ ওর খোলাখুলি চ্যালেঞ্জে কিছুটা যেন হতাশ হলো রনি। ভোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রকাশ করলো সেটা। তবে তানিমের কথায় উৎসাহ পেয়ে এক হাতে আরেক হাত দিয়ে কিল মেরে হাসিব বললো, ‘এমন কাউকে আনতে পারলে কি করবি তুই’? তানিম সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘তোরা যা বলবি করবো। শুধু দেও বা পেত্মী না, তোরা যদি বলিস তোরা একেকজন সুপার হিরো- আমি তাও বিশ্বাস করবো।’ পুরো সময় রাহাত চুপ করে থাকলেও মুখ খোলে সে, ‘ঠিক তো?’ অহংকারি কণ্ঠে তানিম বলে, ‘জমিদার বংশে কেউ কথার বরখেলাপ করে না, বুঝলি? আগে তো আমায় সেই পেত্মীর প্রমাণ দে। তারপর তো কথা রাখা আর না রাখা।’

সেদিন তানিম ডাঁট দেখিয়ে চলে যাওয়ার পরে অনেক্ষণ গুম মেরে বসেছিল ওরা। অপমানটা যেন কিছুতেই হজম হচ্ছে না।জমিদার বাড়ীর মানুষ ছাড়া সুন্দরপুরের সবাই মিথ্যুক? না, এটা হতে পারে না।কিন্তু নিজেদের বিশ্বাসে তো কিছু আসে যায় না।তানিমকে তো প্রমাণ দিতে হবে।কিন্তু কি করে? অনেক ভেবে ভেবে কোন কূল না পেয়ে সবাই মিলে তানিমের অজান্তে এমন মানুষ খুঁজছে, যে সামনা সামনি পেত্মীটাকে দেখেছে।সত্যি কথা বলতে কি, এখন পর্যন্ত কেউ বলে নি সামনে থেকে পেত্মীটাকে দেখেছে। তবে তাদের পরিচিত কেউ দেখেছে বলে আশ্বাস দেয় অনেকেই। কেউ কেউ আবার কবে কোন বাচ্চা পানি থেকে আর উঠে আসতে পারে নি, সেই গল্প ফেঁদে বসে। মাঝে মধ্যে তানিম নিজেই পেত্মীর প্রসঙ্গ তুললে খুব যত্ম করে এড়িয়ে যায় ওরা। শেষ মেষ কি তানিমের কথাই ঠিক হবে? দেও কিংবা পেত্মী শুধু কুসংস্কার? সুন্দরপুরবাসী এতোদিন কুসংস্কার বিশ্বাস করে এসেছে? তবে এই অনুসন্ধান কার্যক্রমে সবার কাছ থেকে গল্প শুনে শুনে বিভিন্ন তথ্য জোড়া লাগিয়ে মোটামুটি একটা দিঘির একটা কাহিনি জানতে পারলো রাহাত, সুজন, তুহিন, জিতু, রনি, আর হাসিব।

 


৭.

সে অনেকদিন আগের কথা। ঠিক কত আগের কথা, তা কেউ বলতে পারে না। একসময় এই সুন্দরপুরে পানির অনেক কষ্ট ছিল। চাষবাসের জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভর করতে হতো। আশে পাশের গ্রামের পুকুর থেকে অনেক কষ্টে পানি এনে প্রয়োজন মেটাতো সবাই। গ্রামের দয়ালু জমিদার অনেক চেষ্টা করেও কোনভাবে পানির কষ্ট দূর করতে পারছিল না। যেখানেই পুকুর কাটছে, পানি উঠছে না সেখান থেকে। আর কুয়ার পানিতেও এতো কাদা আর নোংরা, যে ব্যবহারের অযোগ্য। অনেক পুকুর, পাতকুয়া কেটেও লাভ হয় নি। প্রজাদের কষ্ট কষ্টই থেকে যায়, আর জমিদারের মনের অশান্তিও দূর হয়না।

একদিন একদল সাধু এসে উপস্থিত সুন্দরপুর গ্রামে। গেরুয়া কাপড় পরা, জটাধারি, সৌম্যদর্শন সাধুরা হাতে জপমালা নিয়ে  সারাদিন গ্রামে ঘুরলো। গ্রামের মানুষ তাদের অনেক সম্মান করলো। না চাইতেই তাদের ফলমূল খেতে দিলো। সহজ সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তায় মুগ্ধ সাধুরা সন্ধ্যের সময় দেখা করলো জমিদারের সঙ্গে। জমিদারও তাদের অতিথির মতো আপ্যায়ন করলেন। খুশি হয়ে সাধুর দল জমিদারকে বললেন, গ্রামের মানুষের পানির কষ্ট দূর করে দেবেন তারা। একটি দিঘির মাধ্যমেই পানির চাহিদা মেটাতে পারবে সুন্দরপুরবাসী। তবে শর্ত ছিল, দিঘিতে পানি আসার পরে দিঘির এক কোনে একটি মন্দির স্থাপন করতে হবে। এককথায় রাজি হয়ে যায় জমিদার।

পরদিন সকালে জমি নির্বাচন করে দেন সাধুরা। জমিদারকে আদেশ দেন, ১০০ জন শ্রমিক যেন ঠিক ১০১ দিনে দিঘিটি কাটা শেষ করে। পানির কষ্ট দূর হবে শুনে গ্রামের অনেকেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে লাইন দেয় জমিদার বাড়ির দরজায়। বাছাই করা শ্রমিকেরা রাতদিন এক করে কাটা শুরু করে দিঘিটি। তবে গ্রামের প্রায় সব মানুষই তাদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে। সব শ্রমিকের জন্য খাবার রান্না  করে, রাতে আলোর ব্যবস্থা করে, শ্রমিকদের ক্লান্তি দূর করতে গান বাজনা আয়োজন করে, এমনকি কেটে উঠানো মাটি দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় সবাই মিলে। জমিদারের তত্ত্বাবধায়নে দিনগুলো উড়ে যেতে থাকে কেমন করে যেন। সবার মধ্যেই তখন মরিয়া ভাব। যেভাবেই হোক, দিঘি কেটে শেষ করতে হবে। ঠিক ১০১ দিনের দিন দিঘি কাটা শেষ করে বিজয়ীর ভঙ্গিতে উঠে আসে শ্রমিকের। সবাইকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেন জমিদার। গ্রামের মানুষের মনে যেন খুশির দোলা লাগে। কিন্তু তখনও পানি ওঠেনি দিঘিতে।

সবাইকে ধৈর্য্য ধরতে বলে সাধুরা। গ্রামের মানুষকে আশীর্বাদ করে আর জমিদারকে শর্তের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিশাল দিঘির ঠিক মাঝখানে বসে পুজা শুরু করে সাধুরা। ৩ দিন ৩ রাত তারা দিঘির পাড়ে পুজা অর্চনা করে। এই কদিন দিঘির নির্দিষ্ট সীমানায় কোন মানুষ আসা নিষেধ ছিল। সাধুরা খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে টানা পুজা করে চলে রাত ভোর সকাল সন্ধ্যা। ৩ দিন ৩ রাত শেষে ভোরে কল কল শব্দে ঘুম ভেঙে যায় জমিদারের। উঠে এসে দেখেন দিঘিতে টলটলে পানি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন তিনি। গ্রামের মানুষ ভেঙ্গে পড়ে দিঘির পাড়ে। খুশির মেলা বসে যায় চারপাশে। কিন্তু অনেক খুঁজেও সাধুদের কোথাও দেখতে পায় না কেউ। সুন্দরপুরের পানির কষ্ট দূর হয়েছে দেখে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ জমিদার শর্ত অনুযায়ী মন্দির স্থাপনা শুরু করেন। স্থানীয় এক হিন্দু বামুনের তদারকিতে শুরু হয় মন্দিরের কাজ। তর তর করে এগিয়ে চলে সে কাজ।

কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন মারা যান দয়ালু জমিদার। স্তব্ধ হয়ে যায় সব আনন্দ উৎসব। সুন্দরপুরের ঘরে ঘরে শুরু হয় শোকের মাতম। জমিদার বিশ্বাসের উপরই তার জমিদারি চালাতেন, তাই হিসাবপত্রও ঠিকঠাক মতো রাখা ছিলনা।তাছাড়া জমিদারের বড় ছেলেও তখন নাবালক, অবস্থার অবনতি দেখে জমিদার গিন্নীর ভাইয়েরা এসে জমিদারীর হাল ধরেন। ঠিকঠাক করেন জমিদারির হিসেবপত্র। নতুন নিয়মের বেড়াজাল আর হিসাবপত্রের কড়াকড়িতে নাভিশ্বাস ওঠে সুন্দরপুরবাসীর। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে সকলের অগোচরে বন্ধ হয়ে যায় মন্দির নির্মাণের কাজ। যদিও সেই বামুন লোকটি প্রায়ই এসে ধর্ণা দিতো, মনে করিয়ে দিতো দিঘির ইতিহাস এবং সাধুদের শর্তের কথা। কিন্তু হিসেবপত্রের ঠিক না থাকায় এবং তহবিলের টানাটানিতে তাকে কোন টাকাপয়সা দেওয়া হতো না। অর্ধসমাপ্ত মন্দিরের করুণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে দুএকজন বুজুর্গ মানুষ বামুনের সাথে এসে জমিদারি প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে আসে। কিন্তু হালে পানি না পেয়ে ফিরে যায় অমঙ্গলের আশঙ্কায়। একদিন মন্দিরের আশা ছেড়ে দিয়ে বামুনও কৃষি কাজে মন দেয়। শেষ হয়না মন্দির নির্মাণের কাজ, পূরণ হয়না দিঘির বিনিময়ে সাধুদের দেওয়া শর্ত।

 


৮.

দিঘির ইতিহাসে এরপরের ঘটনা আরও অনেকদিন পরে। তানিমের দাদার দাদা তখন প্রতাপশালি জমিদার। তিনিও প্রজাদের জন্য দয়ালু জমিদার ছিলেন। তবে বদরাগি হিসেবে তার বদনাম ছিল খুব। বৃটিশ রাজত্বে তিনি কাউকে ভয় পেতেন না। একবার যা বলতেন, তা আর ফেরাতেন না। একদিন ভোরে এক সাধু এসে দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়ায়। তার পরনে লাল রঙের দুই টুকরা কাপড়- এক টুকরা লুঙ্গির মতো করে পরা, আর আরেক টুকরা গায়ে। অনেক লম্বা ও টকটকে ফর্সা সে সাধুর কাঁধে ঝোলা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশুল, মাথায় ইয়া বড় এক সিঁদুরের ফোঁটা। কাউকে কিছু না বলে বড় বড় চোখ করে দিঘির এপার থেকে তাকিয়ে থাকেন মন্দিরের দিকে। একজন দুজন করে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায় তার চারপাশে। জমিদার খবর পেয়ে মহলে ডেকে নেন সেই সাধুকে। সাধু মহলে যান, কোন আসন গ্রহণ না করে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকেন জমিদারের চোখের দিকে। নানা কথা জিজ্ঞেস করেন জমিদার, কিন্তু কোন কথার উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ থাকেন সাধু। এমন আচরণে কিছুটা বিরক্ত হন জমিদার। হঠাৎ জলদ গম্ভীর কণ্ঠে সাধু বলে ওঠেন, ‘এই দিঘিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার যে শর্ত ছিল তা পূরণ করা হয় নি।’

সাধুদের ইতিহাস জানতেন তানিম��র বড়দাদা। তাই তিনি প্রথমে বোঝাতে চাইলেন সাধুকে। কিন্তু যত কথাই বলেন না কেন, সাধুর কেবল একই কথা- শর্ত পূরণ হয়নি। জমিদার অধৈর্য হয়ে ওঠে। তবুও তিনি বলেন শর্ত পূরণ হবে। জানতে চান, মন্দির প্রতিষ্ঠার বিহিত কি। কিন্তু সাধু বলে চলে, ‘কথা দিয়ে কথা না রাখা অধর্ম। এই দিঘিই ছিল সুন্দরপুরের প্রাণ। কালে কালে এই দিঘিই সুন্দরপুরের কাল হয়ে দাঁড়াবে।’ রেগে যান তানিমের বড়দাদা। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত জমিদার পূর্বপুরুষের ঋণ ভুলে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সাধুর উদ্ধত কথাবার্তা শুনে তাড়িয়ে দেন তাকে। সাধুটি যাবার সময় দিঘীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে যান, ‘সুন্দরপুরের মানুষের কষ্ট দূর করার জন্য এই দিঘিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে এই দিঘি এখন থেকে সুন্দরপুরের মানুষের চোখের পানির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

ফলে যায় সেই তেজি সাধুর কথা। কিছুদিন পরে দিঘির পানিতে ভেসে ওঠে জমিদারের লাশ। কেন, কিভাবে এবং কখন তিনি দিঘিতে নেমেছিলেন- কেউ জানে না। জমিদারের মৃত্যু কাকতালি ভেবে ভুলে যায় অনেকেই। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎই রহস্যজনক ভাবে দিলির পানিতে মানুষ ডুবে মরতে থাকে। দিঘিতে গোসল করতে এসে হারিয়ে যেতে থাকে একের পর এক বাচ্চা। কান্নার রোল ওঠে সুন্দরপুরের অনেক ঘরে। ভীতি ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। সবাই বুঝতে পারে, অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে সাধুর অভিশাপ। এই দিঘির কারণেই সুন্দরপুরের মানুষের চোখে কান্নার বান। অনেক পীর ফকির সাধু দরবেশ এসেও কোন সুরাহা করতে পারে নি এই রহস্যের। সকলের উপদেশ অনুযায়ী মন্দিরটির নির্মাণকাজ আবার শুরু হয়। আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পয়সা খরচ করে তৈরি হতে থাকে মন্দির। কিন্তু সবার মনে আনন্দ, উত্তেজনা, ভক্তির চেয়ে ভয় কাজ করে এই মন্দির ঘিরে। এই মন্দিরের জন্যই তো এতো কাহিনি। কতগুলো মায়ের কোল খালি হলো, কত বাড়ির জীবনযাত্রা ওলটপালট হয়ে গেলো, কত স্বপ্ন ছারখার হয়ে গেল। ভয়ে ভয়েই সকলে মিলে এগিয়ে নিতে থাকে মন্দিরের কাজ।

কিন্তু কাজ আর শেষ হয়না। যতবার দেয়াল গাঁথা হয়, কোন এক অজানা কারনে ভেঙে পড়ে তা। জিদ চেপে যায় সবার। নতুন ইট সুরকি আর সিমেন্ট দিয়ে আগের বারের চেয়ে মজবুত করে তৈরি হয় দেয়াল, ডিমের খোসার মতো ভেঙে পড়ে মুহুর্তে। প্রতিমূহুর্ত ভয়ে কাটে শ্রমিকদের, এই বুঝি ভেঙে পড়লো দেয়াল। একসময় অনেক বেশি মজুরির লোভেও কাজ করতে রাজি হলো না কোন নির্মাণশ্রমিক। গ্রামের মানুষ নিজেরাও চেষ্টা করলো কম নয়। কিন্তু সে এক অসম্ভব ব্যাপার। এক সময় হাল ছেড়ে দিলো সবাই। দ্বিতীয়বারের মতো অসমাপ্ত রয়ে যায় মন্দিরের কাজ। ততদিনে অবশ্য পানির অন্যান্য সংস্থান হয়েছে গ্রামে। ধীরে ধীরে ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় দিঘিটির। টলটলে পানিতে রাজত্ব শুরু করে কচুরিপানার দঙ্গল। লোক সমাগম কমতে কমতে শূণ্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। সবাই এড়িয়ে চলা শুরু করে মানুষখাকি এই দিঘিকে। রটে যায়, এই দিঘিতে দেও থাকে। মানুষ নামলে হয় মরে যায়, আর নয় হারিয়ে যায় চিরতরে।  
 

 

৯.

বেশ কিছুদিন পরের কথা। তখন তানিমের দাদার বাবার আমল। যদিও জামিদারি প্রথা ততদিনে উঠে গেছে। তবুও অনেক জমির মালিক এবং বংশানুক্রমিক জামিদার বলে তাকেও সবাই জমিদার বলেই সম্মান করতেন। সে সময়ে গরিব এক চাষা থাকতেন সুন্দরপুরে, নাম তার আনু শেখ। ফুটফুটে এক মেয়ের জন্ম দিয়ে মারা যায় তার বউ। মেয়েকে কোলে পিঠে করে ধীরে ধীরে বড় করে তোলে। ফুলের মতো সেই মেয়ের নাম রাখেন কুসুম। ভারি লক্ষীমন্ত সেই মেয়ে। খুব ছোটবেলা থেকেই বাপের সঙ্গে সংসারের হাল ধরে। রান্না করা, মাঠে খাবার নিয়ে যাওয়া, ঘরদোর সামলানো, হাস মুরগীর দেখভাল সবই করতো পাকা গিন্নীর মতো। মিষ্টি স্বভাবের সুন্দরী মেয়েটিকে সবাই খুব পছন্দ করতো। রূপের কারণে অনেক বড় ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতো। স্বামীর বাড়িতে রাজ রানী হয়ে থাকবে, এই আশায় গরীব বাবা অনেক দেখে শুনে তার বিয়ে দিয়েছিলেন শখ করে বড় ঘর দেখে। কুসুমের স্বামীর বাড়িতে ছিলও রাজার হাল। অনেক ধানি জমি, গোয়ালে শ’খানেক গরু, বাড়ি ভর্তি কামলা, জোগাল, ঝি, চাকর, রাধুনী। চার ভাইয়ের চার বউয়ের মধ্যে ছোটবউ কুসুম, বাকী তিন বউয়ের বড়লোক বাপের বাড়ি। পাছে গরীব বাপকে অপমান করে তারা, সবার মন যুগিয়ে চলতো সে। তবুও নানা কটুকথা শুনতো মাঝে মাঝেই। সব মুখ বুজে সহ্য করে হাসি মুখেই দিন কাটাতো কুসুম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ঘর আলো করে দুনিয়ায় এলো ছেলে। নাতি হওয়ার সংবাদ শুনে আনু শেখ আনন্দে মিষ্টি বিলিয়েছে সুন্দরপুরে। সবাই মিলে চাঁদা তুলে নাতির জন্য সোনার হার গড়িয়ে তুলে দেয় আনু শেখের হাতে। সেই হার, মিষ্টির হাড়ি, পান সুপারি নিয়ে নাতির মুখ দেখতে গিয়েছিল সে। ফিরে এসে নাতির চাঁদপানা মুখের বর্ণনা দিতে গিয়ে জনে জনে কেঁদে ফেলে বুড়ো আনু শেখ। গরীব বাপের বাড়ি বলে কুসুমকে সুন্দরপুরে আসতে দিতো না শশুরবাড়ীর লোকজন। তবে কিছুদিন পর পরই এ ছুতায় সে অজুহাতে আনু শেখ মেয়ের বাড়িতে চলে যেত। খুব ভোরে রওনা করে যেত, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সন্ধ্যা সন্ধ্যি গ্রামে ফিরতো। মা মরা দুখি মেয়েটির সুখেই জীবন কাটাতো বুড়ো বাপ। নাতির হাসি, আধো আধো বোল, নানা ডাক আর নিত্য নতুন খেলা নিয়েই যতো গল্প আনু শেখের।

কিন্তু না, কুসুমের কপালে এতো সুখ লেখেনি উপরওয়ালা। হঠাৎ একদিন আনু শেখ খবর পায়, জামাইয়ের কালাজ্বর। পরদিন সকালেই রওনা হয় জামাই বাড়ি। দুপুরের সূর্য মাথায় করে বাড়ি ঢুকে দেখে ততক্ষণে সব শেষ। বারান্দায় সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা জামাইয়ের লাশের পাশে আলু থালু বেশে পাথরের মতো বসে আছে কুসুম। বুড়ো বাপ কাছে এসে ডাকতেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সে। ‘বাবা গো, তুমি আরও আগে আইলা না ক্যান। হ্যায় আমারে ছাইড়া কেমনে চইল্যা গেল।’ এরপরই কুসুমের অজ্ঞান দেহ এলিয়ে পড়ে আনু শেখের কোলে। কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরে আসে, আবার অজ্ঞান হয়ে যায় সে। প্রায় দুই দিন এমন চলার পরে বুড়ো বাপের বুকে মাথা রেখে ছেলেকে বুকে চেপে ধরে একটু একটু করে সুস্থ হতে থাকে কুসুম। আনু শেখ চেয়েছিল নাতি সহ কুসুমকে কদিনের জন্য হলেও সুন্দরপুরে এনে রাখবে। কিন্তু জামাইয়ের ভাইয়েরা কেউ রাজি হলো না!

রাজি হবেই বা কেন? তাদের মনে ছিল অন্য ফন্দি।শোকের কদিন বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কুসুমের খুব যত্ন আত্তি করে তারা। তারপর সবাই চলে গেলে শুরু হয় নানা অত্যাচার। কসুম ছেলে নিয়ে এ বাড়িতে থাকলে সম্পত্তির ভাগিদার বাড়বে। তাই নানা দোষ ধরে একদিন তাড়িয়ে দিলো তাকে। সহায় সম্বলহীন কুসুম তিন বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে ফিরে এলো সুন্দরপুরে। আনু শেখের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। একলা মানুষ ছিল, প্রতিদিনই কোন না কোন ভাবে এক মুঠো চালের সঙ্গে আলুটা মুলোটা জোগাড় হয়ে যেতো তার। কিন্তু মেয়ে আর নাতিকে কিভাবে পালবেন তিনি? নতুন করে ক্ষেতমজুরি শুরু করলেন আনু শেখ। নিজে খেয়ে না খেয়ে নাতির জন্য খাবার, ওষুধ নিয়ে আসতেন। তবুও যেন হাড়ির হাল। মরিয়া হয়ে ঘুমটুকু ছাড়া প্রায় রাতদিনই টাকার জন্য একাজ সে কাজ করা শুরু করলেন তিনি। বুড়ো হাড়ে এতো কষ্ট সইলো না। বছর পেরুল না, এক ভোর রাতে হঠাৎ শুরু হলো বুকে ব্যথা। কুসুমের হাকডাকে লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই সে ব্যাথা মরণ কামড় বসিয়ে দেয় আনু শেখের বুকে। বাপকে হারিয়ে হতবাক কুসুম চুড়ান্ত রকম অসহায় হয়ে পড়ে। তানিমের দাদার বাবা এবং অবস্থাপন্ন সকলের সাহায্যে কোনমতে দিন কাটতে লাগলো তাদের। কিছুদিনের মধ্যে ধানের গোলায়, মানুষের বাড়িতে কাজ করা শুরু করে কুসুম। গ্রামের সবার আদরেই বড় হচ্ছিলো ছেলেটি। দেখতে ছিল যেমন সুন্দর, আচার ব্যবহারেও চমৎকার। পড়াশোনায় খুব আগ্রহ দেখে নিজের বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় জমিদার। সকলের বিশ্বাস ছিল, লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে মায়ের কষ্ট ঘুচিয়ে দেবে সে। স্কুল থেকে ফিরে মায়ের কাজে সাহায্য করতো সে। ধান সেদ্ধ করার সময় চুলার আঁচ থেকে মাকে দূরে বসিয়ে নিজেই লাকড়ি দিতো। যে বাড়িতে কাজ করতো কুসুম, সে বাড়ির ছোট খাট কাজ করে দিতো। তাছাড়া ক্ষেত থেকে শাক তুলতো, খাল থেকে মাছ ধরতো, শুকনা ডাল পাতা কুড়িয়ে জড়ো করতো নিজেদের রান্নাঘরের চুলার পাশে। মাকে না বলেই একদিন গেল দিঘি থেকে কচুরিপানা তুলতে, রোদে শুকিয়ে রান্নার সময় চুলায় জ্বালানো যাবে ভেবে। আর ফিরে আসেনি ছেলেটি। এমনকি তার মৃতদেহটিও কেউ খুঁজে পায় নি। কচুরিপানায় ভরা অতবড় দিঘিতে একটা বাচ্চা ছেলের লাশ খুুঁজে পাওয়া কি অত সহজ? তবুও চেষ্টার ত্রুটি করা হয় নি। অনেক লোকের উপস্থিতিতে জামিদারের নির্দেশে দিঘিতে জাল ফেলে ফেলে দেখা হয়েছে, কচুরিপানা সরিয়ে সরিয়ে দেখা হয়েছে। কোন লাভ হয় নি। ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেলেন দুখিনি মা। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিঘির পাড়েই ঠাঁই নিলেন তিনি। চিৎকার করে কাঁদতেন আর দিঘির কাছে নিজের বুকের মানিককে ফেরত চাইতেন, ‘তোর কি লাগবে ক, আমি দিমু। তার বদলে আমার সাত রাজার ধনরে ফেরত দে। আমি কি নিয়া বাচুম এহন? তোর যদি খিদাই মিটান লাগবো, তাইলে আমার জান কবচ করলি না ক্যান? আমারে নে, তাও আমার জাদুরে ফিরাইয়াদে।’ তার দুঃখে চোখে পানি চলে আসতো সবার। বাতাস ভারী হয়ে উঠতো সেই বুকফাটা কষ্টে। দিন রাত দিঘির পাড়ে পড়ে থাকতে দেখে কেউ কেউ খাবার দিয়ে যেতো, যেমনটা তেমনই থাকতো সে খাবার। ছুঁয়েও দেখতেন না পাগলিনী মা।কেউ জোর করে ঘরে ফেরাতে চাইলে বলতেন, ‘আমি চলে গেলে খোকা একা একা ভয় পাবে।’ দিনরাত কাঁদতে কাঁদতে বেশি দিন বাঁচেন নি সেই দুখী মা। এক সকালে সুন্দরপুরের মানুষ দেখে, দিঘির পাড়ে পড়ে আছে তার নিথর দেহ। তখনও তার চোখের পানি ধারা গিয়ে মিশছে দিঘির পানিতে।
তারপর থেকে অনেকেই শুনেছে দুখিনী মায়ের কান্নার শব্দ। সন্তান হারানোর বেদনার নিদারুণ সেই হাহাকারে বুক ভারী উঠতো সবার। উথলে ওঠা চোখের পানি সামলানো কষ্টকর হতো মায়েদের জন্য। মাঝে মাঝে তাকে দেখা যেত, দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলের জন্য- অনন্ত অপেক্ষায়। প্রজন্মের পর নতুন প্রজন্ম এসে অতৃপ্ত সেই মায়ের আত্মাকে ভূত পেত্মী মনে করে। ভয় পায়। বোঝে না, মায়ের কাছে ভয়ের কি?


১০.

বিকালের আড্ডায় আজও তানিম আসে নি। চাচাতো ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত মনে হয়। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করেই এক এক করে প্রাইমারি স্কুলের মাঠের এক কোনায় জড়ো হয়েছে ওরা। সবাই একসঙ্গে বসে আছে ঠিকই, তবে প্রতিদিনের মতো আড্ডাটা জমছে না। রনি একটু পর পর মাথা নাড়ছে আর ভোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। রাহাত পেয়ারা গাছের একটা ডাল নিয়ে নিজের গায়ে বাতাস করার চেষ্টা করছে আনমনে। সুজন মাথা নিচু করে আঙুল দিয়ে মাটিতে কি যেন আঁকিবুকি করছে। জিতু ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবছে, আর একটু পর পর এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালুতে ঘুষি মারছে। তুহিন দূরে তাকিয়ে আছে, যেখানে বাচ্চারা হৈ চৈ করে খেলছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, খেলা দেখছে না সে। হাসিব সবার দিকে তাকিয়ে একটু উশখুশ করছে, আর ঘাষের ডাটা চিবুচ্ছে। আড্ডার তালটাই যেন নেই। বরং সবার মনটা যেনো ঠিক ভালো নেই আজ। অবশ্য তার জন্য দায়ি সুজন। আড্ডার শুরুতে এমন মন খারাপের আবহাওয়া ছিল না। অন্যদিনের মতো সবাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করে। এ গল্পে সে গল্পে রনি আর জিতুর ছোটখাট রাগারাগি হয়ে যায়। ‘তানিম আসছে না কেন?’- এই প্রশ্ন করাতে রাহাত হাসিবকে ঝাড়ি দেয় একটা। ‘কেন? তোর বন্ধু না আসলে কি আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালো লাগে না তোর?’ রাহাতের গরম কথা শুনে মিইয়ে যায় হাসিব। তুহিন প্রস্তাব করে, লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘুরে আসা যায় না? ওদের কারো কোন কিছুতেই যেন সুজন নেই, এক পাশে বসে চুপ করে কি যেন ভাবছে সে। অন্যমনস্ক বন্ধুকে খেয়াল করে তুহিন। ‘কি হয়েছে তোর? এতো কি ভাবছিস বলতো?’ তুহিনের প্রশ্নে পাশ কাটাতে চাচ্ছিল সুজন, ‘না, কিছু না’। রনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে যখন বললো, ‘এতো ভেবেও তো ছুটিটাকে ভালোভাবে কাটানোর মতো কিছু বের করতে পারলি না। রানীক্ষেত মুরগীর মতো ঝিমাচ্ছিস কেন?’ ওর কথায় একটু হাসে সুজন। তারপর বলে, ‘আমি ভাবছি সেই মায়ের কথা। জন্ম থেকেই সুখের মুখ দেখলো না। ছেলেকে নিয়েই বেঁচে ছিল। দিঘিটা তাকেও কেড়ে নিলো। ছেলের জন্য আজও সে দিঘির পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। একবার ভেবে দেখেছিস, কত্ত ভালোবাসতো নিজের ছেলেকে? মায়ের ভালোবাসার তুলনা হয়না। আমাদের কিছু হলে মায়েদের কত কষ্ট হবে, বুঝিস?’ ব্যস, তারপর থেকেই মন ভার হয়ে আছে সবার। মা যখন পড়তে বসতে বলে, পুকুরে অনেকক্ষণ গোসল করতে না করে, বৃষ্টিতে ভিজতে না করে, ঘুম এলেও জোর করে খেতে বসতে বলে কিংবা যখন তখন খেলতে যেতে দেয় না- মনে হয় মা একটুও ভালোবাসেনা। কিন্তু মা যে পছন্দের খাবার রান্না করে, বেশি মিষ্টি দিয়ে পায়েস করে আলাদা বাটিতে তুলে রাখে, ইলিশের ডিম কিংবা মুরগীর পা পাতে তুলে দেয়, নতুন সোয়েটার বুনে দেয়, ভোরে উঠে মজার মজার নাস্তা বানায়, ভয় পেলে জড়িয়ে ধরে- তখন মনে হয়, মা করবে না তো কে করবে? আর সব আবদারই তো মায়ের কাছে। রাগ, দুঃখ, অভিমান, অপমান, পরাজয় কিংবা ভয়ের সময় মা যখন বুকে চেপে ধরে- তখন সব যেন এক তুড়িতে উড়ে যায়। মায়ের কথা শুনলে মা কি সুন্দর করে হাসে! কিন্তু দুখিনী মায়ের ছেলের মতো যদি ওরা হারিয়ে যায়, কি হবে মায়ের সেই হাসির? কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকবে মা। আহারে-

 

১১.

মায়ের কষ্টটা কল্পনা করে সকলেই যখন খানিকটা মুখ কালো করে বসে আছে, তখন হঠাৎ তানিম মাঠে এসে উপস্থিত। সঙ্গে জিন্সের প্যান্ট আর চেক শার্ট পরা আরেকটা ছেলে। ওদের কাছে এসে তানিম পরিচয় করিয়ে দিলো, ‘এটা আমার চাচাতো ভাই আরিফ। ঢাকায় থাকে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, ক্লাস এইটে। আর ভাইয়া ওরা হচ্ছে সুজন, রাহাত, হাসিব, জিতু, তুহিন আর রনি। আমার সঙ্গে একই ক্লাশে পড়ে।’ কি! একই ক্লাশে পড়ে! বন্ধুও বললো না তানিম! আধুনিক কেতায় হাই বলবে নাকি সালাম দেবে, বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে সবাই। শুধু হাসিব উঠে দাঁড়ায়। ওদের নিরবতা কিংবা হাসিবের জানানো সম্মানের পরোয়া না করে ওদের দিকে ভ্র কুঁচকে তাকিয়ে আরিফ বললো, ‘এরাই তাহলে বলে যে আমাদের বাড়িতে ভূত আছে, না?’ প্রতিবাদ করে তুহিন, ‘বলি নি তো বাড়িতে ভূত আছে। বলেছি, দিঘির পাড়ে এক প্রেতাত্মা ঘোরে। রাতে মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ শোনা যায়।’ ওর কথা শুনে হ্যা হ্যা করে হেসে ওঠে আরিফ। ‘এসব সুপারস্টিশনস্ বিলিভ করো বুঝি তোমরা।কোন প্রিমেটিভ স্টেজে থাকো? সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির যুগে এখনও পড়ে আছো প্রেতাত্মায়? কামঅন বয়েজ, এসব ফালতু ভুত ফুতের গল্প ছাড়ো।’ রনি ফোঁস করে উঠলো, ‘সুন্দরপুরের অনেকেই ওনাকে দেখেছে। কান্না শুনেছে। সব বাচ্চাদের ওই দিঘির কাছে যাওয়া বারণ। সবাই কি ভুল বলে নাকি?’ তানিম ভেবেছিলো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া শহুরে ভাইকে দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেবে বন্ধুদের। উল্টো ভাইয়ের সঙ্গে ওরা ঝগড়া করছে দেখে তানিম বললো, ‘তোরা ভাইয়ার চেয়ে বেশি জানিস? আর আমাদের দিঘির পাড়ে ভূত থাকবে কেন? আমাদের দিঘিতে ভূত থাকলে আমি জানতাম না?’ সুজন ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে যায় ওদের, ‘আছে কি নাই সেটা কথা না, কথা হল...’ ওকে কথা শেষ না করতে দিয়েই একটু ক্ষেপে গিয়ে আরিফ বলে, ‘সবাই বিলিভ করে, তাইতো?এসব গাঁইয়া লোকের কথায় কি আসে যায়? প্রোপার এডুকেশান পায় নি। টেকনোলজি সম্পর্কে জানেই না। ওয়ার্ল্ড কত এগিয়ে গিয়েছে, ধারণাই করতে পারে না। তাদের বিলিভস্ দিয়ে কিছু স্ট্যাবলিশ করা যায় না।’ ওর কথা শুনে আমতা আমতা করে হাসিব বলে, ‘কই না, সুন্দরপুরের অনেকেই তো দেশের বাইরে থাকে। কত মানুষ বড় বড় জায়গায় কাজ করে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারও তো কম না। আর জিতুর ছোট চাচার মতো অনেক ছেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর অন্যান্য জায়াগায় পড়ে।’ এবার আর নিজের রাগ চেপে রাখতে পারলো না আরিফ। ‘পড়ে তো কি হয়েছে। গাঁইয়া স্বভাব তো বাদ দিতে পারে নি কেউ। আর এখানকার লোকজন, সবাই তো ভিলেজ পলিটিক্সে বিজি। জমিদার ফ্যামিলির বদনাম করতে পারলেই নিজেদের বড় মনে করে। কথায় আছে না, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। নিজেরা উন্নতি করতে পারে না, আমাদের বদনাম করে। আরে, আজে বাজে কথা স্প্রেড করলেই কি এসব গাঁইয়া লোকজন আমাদের সিমিলার হয়ে যাবে? নো, নেভার।’ এতোগুলো কথা শুনে সুজনও যেন গুছিয়ে উঠতে পারছে না, কি বলবে। রাগে গনগনে হয়ে গেছে জিতুর মুখ। ‘এসব গাঁইয়া লোকজন দিয়েই তোমরা জমিদার। গাঁইয়া লোকেরা ভোট দিয়েই চেয়ারম্যান চাচাকে চেয়ারম্যান বানিয়েছে। যাদের অনেক টাকা, কিছু করার পায় না, তারাই আজে বাজে গুজব ছড়ায়। খেটে খাওয়া গাঁইয়া লোকজন না।’- রগচটা জিতুর মুখে এতো গোছানো কথা শুনে অবাক হয়ে যায় বাকি সবাই। অবাক হয় আরিফও, গ্রামের পুচকে পুচকে পোলাপান এভাবে কথার মারপ্যাচে ফেলে দেবে ভাবে নি সে। ওদের সঙ্গে কথায় না পেরে এবার পুরো রাগ আর বিরক্তি তানিমের উপর ঝাড়লো সে। ‘এসব গাঁইয়া আর ঘাড়ত্যাড়া ছেলেদের সাথে মিশিশ তুই? চাচা ঠিক ডিসিশনই নিয়েছে, তোকে ঢাকা পাঠিয়ে না দিলে তুই নিজেও গাঁইয়া হয়ে যাবি। কথায় কথায় তর্ক করবি, আর হাবি জাবি বিশ্বাস করা শুরু করবি। আর শোন, দিঘিটা তোর ঘরের পাশে না? আজ রাতে তোর ঘরে থাকবো আমি। দেখি কোন পেত্মী নাঁকি সুরে কাঁদে। আজ পেত্মীর একদিন, কি আমার একদিন।’ বলে ওদের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে হন হন করে হাঁটা দেয় আরিফ। ভাইয়া এমন অপমানিত হবে, স্বপ্নেও ভাবে নি তানিম। আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে ‘একই ক্লাসে’ পড়া ছেলেগুলোর দিকে। তারপর ভাইয়ার পিছু পিছু দৌঁড় দেয়। ওরা তাকিয়ে তাকিয়ে ওদের যাওয়া দেখে। হঠাৎ ‘পাইছি’ শুনে ঘুরে তাকায় সবাই। রাহাত আরও একবার বলে ওঠে, ‘পাইছি’। এতক্ষণ চুপ করেই ছিল রাহাত, তাই ওর মুখে এই কথা শুনে এক দফা অবাক হয় ওরা। এক হাত দিয়ে আরেক হাতে ঘুষি দিয়ে রাহাত আবারও লাফ দিয়ে ওঠে, ‘পাইছি। আজ টের পাবে চান্দুরা। কত ধানে কত চাল।’ রনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি পাইছিস রে?’ রাহাত একে একে সবার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ছুটিটাকে কি ভাবে কাজে লাগানো যায় ভাবছিলাম না? বুদ্ধি পাইছি। আজকে আমরা এমন একটা জিনিস করবো, পুরো ছুটি আর কিছু না করলেও চলবে।’ রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই নড়ে চড়ে বসে। ওর কথায় অবিশ্বাস করার মতো কিছু নেই। গত ছুটিতে ও যা করেছিল, তার রেশ এখনও কাটেনি কারো মন থেকে।

 

১২.

গত ছুটিটা খুব কমই ছিল ওদের জন্য। ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার পর হাই স্কুলে ভর্তি, নতুন ইউনিফর্ম, বই, খাতা, জ্যামিতি বক্স আর নতুন স্কুলে যাবার উত্তেজনায় মাঝের ছুটিটায় আসলে ঠিক ছুটির আমেজ পায় নি ওরা। তবুও সবাই এক সঙ্গে বসলে নতুন কি করা যায়, পুরোদমে প্ল্যানিং চলতো ঠিকই। একদিন জিতুর মাথায় বুদ্ধি এলো, ‘সবাই মিলে একদিন থানায় যাই চল।’ তুহিন বিশাল হাই তুলে বলে, ‘থানায় গিয়ে কি হবে? আমি তো প্রায়ই যাই, ছোট বোনটার বাপ পুলিশ। প্রায়ই গিয়ে সে বাসা থেকে ওকে নিয়ে আসতে হয়।’ কথার মধ্যে বাগড়া দেওয়ায় চটে যায় জিতু। কিন্তু ওর প্ল্যানটা বোঝেই নি কেউ, তাই নতুন করে বলা শুরু করে, ‘আমি পুলিশ কোয়ার্টারের কথা বলছি না। থানার মেইন অফিসে ঘুরে আসি চল। পুলিশ কিভাবে কাজ করে, চোর ডাকাত ধরে, তাদের ধরে রাখে কই? আর এতো মানুষ রোজ রোজ থানায় যায় আসে, নালিশ করে, বিচার চায়- তারাই বা করে কি?’ হমম, প্ল্যানটা মন্দ না। বাকি সবার মুখ দেখে মনে হলো জিতুর। সেদিনের আড্ডায় তানিম ছিল ওদের সঙ্গে। কৃতিত্ব নেওয়ার জায়গাটুকু ছাড়বে কেন সে? তাই বললো, ‘আব্বুকে বলবো। ওসি আঙ্কেলকে বলে দিলে আমরা খুব ভালো মতোই থানার ভিতরটা ঘুরে আসতে পারবো।’ সে অনুযায়ী ঠিকঠাক হলো পুরো পরিকল্পনা। পুলিশের কাছে কার কি প্রশ্ন আছে, কে কি জানতে চায়- এসব আলোচনা শেষে বাসায় ফেরে সবাই। পরদিন তানিম জানায়, ওর আব্বু রাজি হয়েছে। আগামীকাল সকালেই থানায় ঘুরতে যাওয়া যাবে। কথা মোতাবেক সকাল সকাল নাস্তা করে ওরা হাজির হয় তুহিনের বাসায়, ওর বাসাটা থানার সবচেয়ে কাছে। তুহিনের বাসায় আরেকবার রুটি, আলুভাজি, ঘন ডাল, নারকেলের নাড়ু– আর দই দিয়ে নাস্তা করে থানায় ঢোকে ওরা। ঢুকে দেখে থানায় বসে আছে তানিমের বাবা। ওসির সঙ্গে চেয়ারম্যান চাচাও ঘুরে ঘুরে থানার কর্মকাণ্ড বোঝালেন সবাইকে। থানা নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছিল সবার মধ্যে, ঘুরে ফিরে মোটামুটি হতাশই হলো ওরা। আর পাঁচটা অফিসের সঙ্গে পার্থক্য নেই তেমন। শুধু গরাদ দেওয়া একটা ঘর ছাড়া। সেটাই নাকি জেল! তবে ওই জেলের ভিতর লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বসা দুজন লোককে কিছুতেই আসামি বলে মনে হলো না কারো। সব শেষে ওসির টেবিলে সমুচা, চমচম আর কোকাকোলা খাওয়ার জন্য ডাক পড়লো ওদের। এতো খাবার দেখেও কেউ মুখ ফুটে বললো না, ইতোমধ্যেই দুবার নাস্তা করে ফেলেছে সবাই।

খেয়ে দেয়ে খুশি মনে যখন থানা থেকে বেরুনোর সময় রাহাতের চোখ পড়লো দাঁড়িয়ে থাকা একটা মোটরসাইকেলের উপর। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওসি আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলো, ‘মোটরসাইকেলে চড়বে তোমরা?’ সবাই ভদ্রতা বশত না বললো। কিন্তু লাজুক ছেলের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে রাহাত বলে ফেললো, ‘আমি চড়বো আঙ্কেল।’ ওসি এসে মোটরসাইকেল স্টার্ট দেয়। পা দিয়ে গিয়ার বদলে এক্সিলেটরে হাত রেখে রাহাতকে পিছনে উঠতে বলে। মোটরসাইকেলে চেপে ওসি কি কি করেছে, সব দেখেছে রাহাত। তারপর বাধ্য ছেলের মতো উঠে গিয়ে বসে তার পিছনে। হুস করে টান দিয়ে থানার গেট দিয়ে বেরিয়ে যায় ওসি। বাকি সবাই খালি করুন চোখে তাকিয়ে দেখে মোটরসাইকেলের ধোঁয়া। একটু পরেই আবার ফিরে আসে ওসি, মোটরসাইকেল থেকে নেমে বিনয়ে বিগলিত রাহাত একটু ঝুঁকে পড়ে ওসিকে বলে, ‘থ্যাঙ্ক-ইউ আঙ্কেল।’ বন্ধুদের দিকে তাকায় রাহাত, মুখে হাসি। ওর হাসি দেখে গা জ্বলে যায় সবার। কিন্তু কিছু করার নেই। ততক্ষণে চেয়ারম্যান চাচার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে থানার গেট থেকে।

তারপর দুদিন আড্ডায় অনুপস্থিত রাহাত। তৃতীয় দিন সকালে জিতু আর হাসিব চলে যায় ওর বাসার দিকে। সময়টা একেবারে পারফেক্ট, বাসার কাছাকাছি যেতেই গেটের কাছেই দেখা হয়ে যায় ওর সঙ্গে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে দ্রুত ভঙ্গিতে কোথায় যেন যাচ্ছে। জিতু আর হাসিবের মুখোমুখি হয়ে যেতেই অপ্রস্তুত হয়ে যায় রাহাত। তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘হাম্মি কান্না কাটি করছে তো খুব, ওর জন্য চকলেট আনতে যাচিছ।’ ঠিক এমন সময় হাম্মিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ায় ওর আম্মু। জিতু আর হাসিব তো অবাক! হাম্মি কাঁদছে কই? দিব্যিতো আন্টির কোলে বসে কাঠি লজেন্স চুষছে। ওদের দেখেই আন্টি বলে উঠলো, ‘খেলতে যাচ্ছিস যা, কিন্তু বাড়ীর কথা ভুলে যাসনে। একটু তাড়াতাড়ি এসে দুপুরের খাওয়াটা সেরে আমায় উদ্ধার করিস।’ ধরা পরে যায় রাহাত। মিথ্যা কথা বলেছে সে। কিন্তু কেন? কোন ব্যাখ্যা দেবার আগেই ওকে টানতে টানতে মাঠের দিকে নিয়ে যায় জিতু।

 

১৩.

মাঠে সবার সামনেই মিথ্যাটা কবুল করে রাহাত। অবশ্য পুরোপুরি নিজস্ব ঢঙে। ‘শোন, ভালো কিছুর জন্য মিথ্যা বললে সেটা ঠিক মিথ্যা হয় না।’- হাসিমুখে বলে সে। সোজা ওর দিকে তাকিয়ে সুজন জিজ্ঞেস করে, ‘ঠিক কি ভালো কাজের জন্য আমাদের সঙ্গে মিথ্যা বলার দরকার হলো তোর, বলা যাবে?’ ঠান্ডা গলায় কথা বলছে দেখে রাহাত বুঝে যায়, ক্ষেপেছে সুজন। ‘আমি তো তোদের বলতামই। ছুটিটা যাতে ভালোভাবে কাটে আমাদের, তাই তো তো এই দুইদিন এতো কষ্ট করলাম। তবে আসলে কাজটা শেষ করে তারপর তোদের চমকে দিতে চেয়েছিলাম আরকি।’ তারপর শোনা যায় তার গোপন চমকের ইতিহাস। থানায় মোটর সাইকেলে চড়ে বুদ্ধি আসে তার মাথায়, এই জিনিস চালানো শিখলে বড় ক্লাসের সবাই খুব অবাক হবে। নতুন স্কুলে ওদের নাম ছড়িয়ে পড়বে। রনি ছাড়া আর সবাই সাইকেল চালাতে পারে ওরা। জিতু আর সুজনের তো সাইকেল আছেই। ও দুটোই ঘুরে ফিরে চালায় সবাই মিলে। তবে জিতু ছাড়া আর কেউ রনিকে পিছনে বসিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারে না। হাই স্কুলের অনেক ছাত্রই সাইকেল নিয়ে স্কুলে যায়। তবে কাউকে মটরসাইকেল চালাতে দেখা যায় নি এ পর্যন্ত। তাই এই দুইদিন মোটর সাইকেল চালানো শিখেছে সে। ‘তুই মোটরসাইকেল চালাতে পারিস?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সবাই। হাসিবের মুখ তো হা হয়ে গেছে। সুজনের মুখেও হতভম্ব ভাব স্পষ্ট। বাকি সবাই যেন চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছে। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসে রাহাত। ‘হ্যাঁ, পারি’। ‘কোথায় শিখলি?’- তুহিনের প্রশ্নে রাহাত জানায় বাজারের কোনায় যে মোটর গ্যারেজটা আছে, সেখানে। ওই দোকানে সাইকেলের চাকা পাম্প করতে মাঝে মাঝেই যায় ওরা। দোকানে যে ছেলেটা কাজ করে, ওদের চেয়ে খুব বেশি বড় হবে না সে। সেই ছেলেটিকেই পটিয়ে কাজ উদ্ধার করেছে রাহাত। দোকানে মেরামত করতে দেওয়া মোটর সাইকেল দিয়ে কিভাবে চালাতে হয়, তা শিখিয়েছে সে। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অন্য লোকের মোটর সাইকেল চালানো খুব ভালো ভাবে দেখেছে রাহাত। তারপর অবশ্য আক্ষেপ নিয়ে বললো, ‘গ্যারাজ মালিক নেই আজ। তাই পুরো গ্যারাজ সামলাবে ওই ছেলেটাই। বলেছিল, মালিকের অজান্তে আজই আমায় মোটরসাইকেল চালাতে দেবে। কিন্তু আমি যেতে পারলাম কই? জিতুটা আমায় টানতে টানতে নিয়ে এলো।’ একথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সুজন, ‘তাই বল, চালানো শিখেছিস। কিন্তু চালাস নি। তাই তোর হাড্ডি গুড্ডি আস্ত আছে এখনও।’ রাহাতের অভিমান যেন বেড়েই চলেছে, মুখ কালো করে ঠোঁট ফুলিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তাই দেখে রনি নরম গলায় বললো, ‘তুই প্রথমবার মোটর সাইকেল চালাবি, আর আমরা থাকবো না? আমাদের না নিয়ে তুই একা একা মোটরসাইকেল চালাতে পারতি?’ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে রাহাত। তাই তো, বন্ধুদের বাদ দিয়ে সে একা একা মোটরসাইকেল চালালে লাভ কি হতো? কেউ তো দেখতোই না। আমতা আমতা করে বললো, ‘কিন্তু আজই যে সুযাগ। মালিক তো আর প্রতিদিন প্রতিদিন গ্যারাজ খালি রেখে যাবে না। দুপুরের সময় খদ্দের থাকে না বললেই চলে। তখনই আমায় মোটরসাইকেল দেবার কথা।’ হাসিব এই কৃতিত্বে খুশি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। রাহাতের দ্বিধা দেখে সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘ঠিক আছে চল। আমরা সবাই একসঙ্গে যাই। তোর মোটরসাইকেল চালানো দেখি।’ হাসিবের কথায় খুশি হয় রাহাত। অন্য সবার মুখ দেখে মনে হলো তাদেরও এই বুদ্ধি অপছন্দ হয় নি। শুধু সুজন ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘চালাতে পারবি তো? নাকি হাত পা ভেঙে ঘরে বসে থাকবি? ছুটিটা ভালোভাবে কাটাতে গিয়ে পুরো সময়টা বরবাদ করে দিস না যেন।’ ওর কথা মোটামুটি উড়িয়ে দিয়েই বন্ধুদের নিয়ে রওনা হলো রাহাত।

এরপরের কাহিনি খুবই সংক্ষিপ্ত। রাস্তার লোম ওঠা নেড়ী কুকুরের মতো একটা মোটরসাইকেল দাঁড় করানো ছিল ওই গ্যারেজে। ওদের দাঁড় করিয়ে রেখে খদ্দের বিদায় দিয়ে গ্যারেজের ছেলেটি আবারও মোটরসাইকেল চালানো বুঝিয়ে দিয়ে চাবি দিলো রাহাতের হাতে। রাহাত মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় উঠে আসবে, তারপর পুকুরের পাশদিয়ে মাঠে চলে যাবে। এমন প্ল্যান করে সবাই মিলে পুকুরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। রাহাত খুব ভাব নিয়ে বসলো মোটরসাইকেলের সিটে। চাবি দিয়ে মোটর অন করে সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো, তবুও যেন ওর বুকের ধুকপুক শব্দ ওখানে দাঁড়িয়েই শুনতে পাচ্ছে ওরা। এরপর স্টার্ট করার জন্য লাথি দিলো রাহাত। না, হলো না। আবার, এবারও হলো মোটর সাইকেল স্টার্ট হলো না। পর পর তিন চারবার চেষ্টা করার পরেও যখন স্টার্ট নিল না, তখন গ্যারেজের ছেলেটি রাহাতের বদলে নিজে স্টার্ট করানোর চেষ্টা করলো। ততক্ষণে ওরা দৌঁড়ে আবার গ্যারেজে চলে এসেছে। হাত বদলের পরেও মোটর সাইকেল কিছুতেই স্টার্ট নেয়না। বুড়ো মানুষের মতো কাশি দিয়ে আবার থেমে যায়। সবার মুখে হতাশ ভাব, আর রাহাতের মুখ তো দেখার মতো। মনে হচ্ছে, আরেকটু হলে কেঁদে ফেলবে সে। গলা খাকাড়ি দিয়ে সুজন বললো, ‘শোন রাহাত, মোটরসাইকেলের অবস্থা তো দেখতে পাচ্ছিস। প্রজেক্ট বাদ দে। অন্য কোন ভালো মোটরসাইকেল পেলে না হয়-’ সুজনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘোঁ ঘোঁ শব্দ করে স্টার্ট হয়ে গেল। খুশিতে লাফিয়ে উঠলো রাহাত। তাড়াতাড়ি ছেলেটি এক্সিলেটর থেকে হাত না সরিয়েই রাহাতকে সিটে বসতে বলে। এক্সিলেটরে হাত রেখে সিটে বসে চোখ বুজে কি যেন বললো রাহাত বিড় বিড় করে, মনে হয় দোয়া দরুদ পড়লো। তারপর চোখ খুলে ঠোঁট কামড়ে এক্সিলেটর ছেড়ে দিলো। আর যাবে কই! একটু একটু করে এক্সিলেটর ছেড়ে মোটরসাইকেল সামনে এগিয়ে নিতে হয়। আর সেখানে একবারে ছেড়ে দিয়েছে রাহাত। মোটরসাইকেল পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে সামনে এগিয়ে চললো। রাহাতের গলা চিড়ে ভয়ের চিৎকার বেরিয়ে এলো, মোটরসাইকেলটা কোনমতে সোজা রাখার চেষ্টা করছে সে। এমন অবস্থা দেখে ওরাও গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠলো, রাহাতের পিছন পিছন দৌঁড় লাগালো সবাই। রাহাতের হাতের এক্সিলেটর যেন আর বশে নেই, এই প্রায় থেমে যাচ্ছে তো এই ঘোড়ার মতো লাফিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে। পুকুরের প্রায় কাছে চলে গিয়েছে রাহাত। এমন সময় যেন সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কোত্থেকে এক পিকআপ ট্রাক আসছে উল্টা দিকে। এ দৃশ্য দেখে এক মুহুর্ত সবাই যেন পাথর হয়ে গেল। পরপরই নিজেদের গলার চিৎকারে রাহাতের গলা শুনতে পাচ্ছে না কেউ। অন্যদের ভয়ের চেচামেচির মধ্যে শুধু সুজন টানা চিৎকার করছে, ‘লাফ দে রাহাত, লাফ দে।’ এগিয়ে আসছে ট্রাক। রাস্তার একপাশে পুকুর, অন্যপাশে খড়ের গাদা। সুজনের হিসাবটা যেন একমুহূর্তে বুঝে যায় ওরা। এবার সবাই গলা মিলায় সুজনের সঙ্গে, ‘লাফ দে রাহাত, লাফ দে।’ মোটরসাইকেলটা বশে আনার জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে এক্সিলেটর, ব্রেক, গিয়ার দেখছিল সে। মুখ তুলে ট্রাকটাকে দেখে একেবারে জমে যায়। চিকন রাস্তায় উল্টোপাশ দিয়ে তারই দিকে ধেয়ে আসছে মূর্তিমান আতঙ্কের মতো। ওদিকে ভয়ে সবাই চোখ বুজে ফেলেছে, কিন্তু সমানে বলে যাচ্ছে, ‘লাফ দে রাহাত, লাফ দে।’ একদম শেষমুহুর্তে বন্ধুদের চিৎকার কানে ঢোকে তার। কোনকিছু না ভেবেই লাফ দেয় চোখ বুজে।   

 

১৪.

চোখ বুজে থাকা ওই সময়টুকু মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। হৃদপিণ্ডের ধিপ ধিপ শব্দে মনে হচ্ছিল হাতুড়ির ঘা পড়ছে বুকে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয় হচ্ছিল চোখ খুলতে, যদি দেখে...। না, সুজনের চিৎকারে চোখ খুলে পড়িমড়ি করে ছুটে যায় ওর পাশে। খড়ের গাদায় পড়ে আছে রাহাত, আর ওর কাছে বসেই চিৎকার করছে সুজন। ভয় পেয়ে যায় সবাই। চোখ বন্ধ করে হাত পা মুচড়ে এভাবে শুয়ে আছে কেন রাহাত? গ্যারেজের ছেলেটা তাড়াতাড়ি কাছে এসে নাকের কাছে হাত দিয়ে বলে, ‘বাইচ্যা আছে। নিঃশ্বাস পড়তাছে। অজ্ঞান হইয়া রইছে। শিগগির পানি নিয়া আসেন।’ পুকুরে থেকে আজলা ভরে পানি নিয়ে এলো সবাই। তুহিন খুব বুদ্ধিমানের মতো গায়ের গেঞ্জিটা খুলে পানিতে চুবিয়ে এনেছে। নাকে মুখে পানি পড়তেই নড়ে চড়ে উঠলো রাহাত। চোখ পিট পিট করে উঠে বসে হঠাৎ সুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলো। ওকে বকার বদলে সবার চোখ ভিজে গেল, ও যে সুস্থ আছে এটাই বা কম কিসে!

অবশ্য কাহিনি এখানেই শেষ হয় নি। মোটরসাইকেলটার অবস্থা দেখার মতো হয়েছিল। ভাগ্যিস পুকুরে পড়ে নি সেটা, পুকুরের পাশে ডোবার কাদা থেকে টেনে তুলে এনে পরিষ্কার করতে কম বেগ পেতে হয় নি ওদের। তারপর আবার ভালো হেডলাইটটা গুঁড়ো হয়ে গেছে। নতুন লাগাতে হয়েছিল। ফুটবল কেনার নাম করে সবার বাসা থেকে টাকা এনে গ্যারেজের ওই ছেলেটির হাতে তুলে দিয়েছিল ওরা। তারপর থেকে মোটরসাইকেলের নামও নেয় নি রাহাত। কিন্তু টাকা নিয়ে তো ফুটবল কেনা হয় নি, তাই পুরো ছুটিতে ছোট ছেলেদের বল নিয়েই খেলতে হয়েছিল। তাই এবারের ছুটিটা জমিয়ে দিতে ওর বিশেষ বুদ্ধির কথা শুনে সবাই যেন দ্বিধায় পড়ে যায়।

‘কি করতে চাস তুই?’- তানিমের উপর রাগ যায় নি এখনও, তাই একটু জোরেই জিজ্ঞেস করলো জিতু। ‘ওদের বিশ্বাস করাতে হবে, সুন্দরপুরের মানুষ মিথ্যাবাদি না।’ রাহাতের এই কথা শুনে সবাই নড়ে চড়ে বসে। সুন্দরপুরের নামে, এখানকার মানুষের নামে যা ইচ্ছা তাই বলে গেল ওরা। যদি প্রমাণ দেওয়া যেত, সত্যিই দিঘির পাড়ে ঘুরে বেড়ায় এক অতৃপ্ত মায়ের আত্মা- তাহলে হয়তো ওদের থোতা মুখ ভোঁতা হয়ে যেত। কিন্তু কিভাবে? রাহাত তখন তার মনের কথা খুলে বলে, ‘ওদের ভয় দেখাতে হবে। ভূতের ভয়। আজ রাতে ওদের এমন ভয় দেখাবো, সারাজীবন মনে রাখবে। কোনদিন আর সুন্দরপুরের মানুষকে অসম্মান করে কথা বলবে না।’ তানিম আর ওর ইংলিশ মিডিয়াম বড় ভাই আরিফকে ভয় দেখাতে আপত্তি নেই কারও। কিন্তু কি করলে ওরা ভয় পাবে? সে বুদ্ধিও রাহাতের মাথায়। ‘আরিফ আজ তানিমের ঘরে থাকবে, ঘরটিও দিঘির পাড়ে। প্রাচীরের বাইরের শিমুল গাছটায় উঠলেই তানিমের ঘর দেখা যায়। রাতে গাছে উঠে পুরনো কায়দায় তৈরি ওই ঘরের বড়সড় ভেন্টিলেটর দিয়ে একটা হাত ঢুকিয়ে দিতে হবে। আর তার সঙ্গে যোগ হবে কান্নার শব্দ। ব্যাস, এতেই বিছানা ভিজিয়ে ফেলবে দুই জমিদার নন্দন। কি ঠিক আছে না?’


১৫.

প্ল্যান করা খুব সহজ। কিন্তু সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া এতো সহজ না। রাহাত তো বলেই খালাস, ঘরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কান্নার আওয়াজ করে ভয় দেখাবে ওদের। আদৌ কি সম্ভব এটা? কিন্তু রাহাতের প্ল্যান বলে কথা, ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি করেছে সে। পুরো প্ল্যান শুনে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো সবাই-

তুহিন: হাত পাবি কই?

রাহাত: কেন? দস্তানা পড়িস না হাতে? সেটার মধ্যে কাপড় ঠেসে বানাবো।

জিতু: তানিমের ঘর পর্যন্ত নিবি কিভাবে?

রাহাত: চিকন বাঁশের আগায় বেঁধে।

হাসিব: আমি গাছে উঠতে পারি না। গাছের অত উপরে উঠবে কে?

রাহাত: আমি উঠবো। তোরা নিচ থেকে কান্নার আওয়াজ দিবি।

রনি: ঘরের ভেন্টিলেটরে তো ডিজাইন করা থাকে। হাত সহ বাঁশ ঢুকবে?

রাহাত: আমি আগেই খেয়াল করেছি, তানিমের ঘরের ভেন্টিলেটর ভাঙা। ও যখন নতুন নতুন জিনিস দেখাতো, আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকতাম। তখন দেখেছি।

সুজন: ওদের বাড়িতে অনেক লোকজন থাকে। কান্নার শব্দে তারা যদি কেউ আমাদের ধরে ফেলে?

রাহাত: ওদের গেটটা অন্যপাশে।গেট থেকে কেউ বেরুতে শুরু করলে লুকিয়ে পড়লেই হবে। আর তাছাড়া কান্নার শব্দ তো হবে আস্তে। আমাদের শব্দ শোনার আগে তানিম আর ওর মডার্ন সফিসটিকেটেড ভাইয়ের চিৎকারে সবাই উপরে ওদের ঘরের দিকেই দৌঁড়াবে। বুঝলি?

এরপর আর কারও কোন প্রশ্ন নেই। সবাই একবাক্যে মেনে নিলো, এমন ফুলপ্রুফ পরিকল্পনা কেবল রাহাতের মাথায়ই আসতে পারে। সুজন এবার গম্ভীর মুখে বললো, ‘প্ল্যানে আপাতত কোন খুঁত নেই। কিন্তু এতো রাতে বাড়ির বাইরে কি করে থাকবো? কাউকে বেরোতে দেবে বাসা থেকে?’ এবার আটকে গেল রাহাত। ওর মুখ দেখে মনে হলো এই সমস্যার কথা সে নিজেও ভাবে নি। এতো সুন্দর পরিকল্পনা শুনে এতক্ষণ কেমন যেনো অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছিল সবাই। কিন্তু বাসার কথা ভেবে সবাই মনমরা হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস গোপন করল না কেউ। রনির তো চাপা গলায় বলেই ফেললো, ‘নাহ্, শেষ মেষ ওদের ছেড়েই দিতে হবে রে...।’ শুকনা গলায় হাসিব বললো, ‘আব্বা যদি জানে, কেটে দুই টুকরা বানিয়ে দেবে।’ সবাই বুঝতে পারলো, বাসা থেকে বেরুতে পারছে না দেখে আজ এতো সুন্দর প্ল্যানটা কাজে খাটানো গেল না। বড়রা কি সুন্দর ধুপ ধাপ বাড়ির বাইরে যাচ্ছে, থাকছে। যত ঝামেলা সব ছোটদের। সবার মাথায় ঘুরছে, ‘কবে যে বড় হবো!’

সমস্যাটা এসেছিল সুজনের মাথা থেকে। সুজনই উদ্ধার করলো সবাইকে। ‘এখনই সবকিছু যোগাড় করে হাতটা বানিয়ে ফেলতে হবে। তারপর সেটাকে কোথাও রেখে যে যার বাসায় চলে যাবো আমরা। রাত ১১টার পরে কোনও না কোনও ভাবে আধঘন্টার জন্য পালাতে হবে। তাই বাসায় ফিরে লক্ষী ছেলের মতো সবার কথা শুনতে হবে। বাসার পরিবেশ দেখে পালানোর কোন বুদ্ধি ঠিক করে নিবি তোরা। যত দ্রুত সম্ভব খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বি সবাই। কিন্তু কোনভাবেই ঘুমিয়ে পড়া যাবে না। যে ঘুমিয়ে পড়বে, সে প্ল্যান থেকে আউট। যে যে ভাবেই বাসা থেকে পালাস না কেন, ঠিক সাড়ে ১১টার মধ্যে জিতুর বাসার সামনে চলে আসবি। জিতুদের বাড়িটা জমিদার বাড়ির সবচে কাছে। কোনভাবেই যেন সাড়ে ১১টা পার না হয়। ঠিক আছে?’

এতো সুন্দর প্ল্যানটা ভেস্তে যাচ্ছিল। তবে শেষ মুহুর্তে তার প্ল্যানটা বেঁচে গেল দেখে কৃতজ্ঞ চোখে সুজনের দিকে তাকায় রাহাত। তবে একটা জিনিস সবাই বুঝতে পারছে, কুখ্যাত ওই দিঘির পাড়ে যেতে ভয় লাগছে কিছুটা।সবাই একসঙ্গে থাকলে অন্য কথা। তবে অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনার পাশাপাশি কিছুটা ভয় করছে সবারই, এটাও ঠিক। দিঘি আর ভয়ের কথা উঠতেই রাহাতের মতো দুষ্ট ছেলে বললো, ‘কোন মা কি পেত্মী হতে পারে? কোন মা কি পারে বাচ্চাদের ক্ষতি করতে? বল?’ সবাই বুঝতে পারছিলো- ভয় কমানোর জন্য কিংবা নিজেকে শান্তনা দিতে নয়, বিশ্বাস থেকেই কথাটা বলেছে সে। তাই ভয়টা কেমন যেন কমে গেল।

 

১৬.

রনির বাবা মা চাকরি করে, বাসায় এখন তারা কেউ থাকেন না। আর ওর কোন ভাই বোনও নেই। তাই বাসায় কাজের বুয়া জহুরা খালা ছাড়া কেউ নেই। আর সে এসময় নাক ডেকে ঘুমায়, নইলে রাত জেগে সিনেমা দেখতে পারে না। জহুরা খালার এই এক বাতিক, বেতন কম দিলেও ক্ষতি নেই। তবে রাতে তাকে সিনেমা দেখতে দিতেই হবে। আর রনি বা তার বন্ধুদের খুব আদর করে খালা। তাই হাতটা বানানোর সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা রনির বাসা। দেরি না করে হাতটা বানানোর জন্য ওর বাসায় রওনা দিলো সবাই। রাহাতের কালো রঙের দস্তানা আছে, তাই শুধু এক দৌঁড়ে বাসা থেকে সেটা নিয়ে এলো। হাপাতে হাপাতে প্যান্টের পকেট থেকে বের করে কালো রঙের একটা বিশাল দস্তানা। রাহাতের হাতের চেয়ে তিন গুন বড়। এতো বড় দস্তানা ওর! পরে অবশ্য স্বীকার করেছে, ওরটা না পেয়ে তাড়াহুড়োয় ওর বাবার একটা চুরি করেছে। তুহিনকে পাঠানো হয়েছিল লম্বা আর চিকন বাঁশ নিয়ে আনতে। আশে পাশে কোথাও না পেয়ে নিজের বাসার ঝুল ঝাড়ুটা নিয়ে এসেছে। ওদের বাসার ঘর গুলো অনেক উঁচু। তাই ঝাড়ুুর বাঁশটা বেশ লম্বা। আর সবাই ব্যস্ত ছিল রনির পুরনো কাপড় চিড়ে ন্যাকড়া তৈরির কাজে। একটা আঙুল মোটা আর অন্য আঙুল চিকন না হয় যেন, তাই অনেক কসরৎ করে দস্তানায় ন্যাকড়া আর তুলা ঠাসা হলো। তারপর ঝাড়ুর উল্টো মাথায় ন্যাকড়ায় ঠাসা কালো রঙ্গের দস্তানা বেঁধে ফেলার পর কাজ শেষ ভেবে স্বস্তিতে বসে পড়লো সবাই। শুধু সুজন চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে হাতটার দিকে। ওর দিকে চোখ পড়তেই রাহাত জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে? ভালো হয় নি?’ ইতস্তত করে সুজন উত্তর দেয়, ‘হয়েছে। কিন্তু এটা ঘরে পাঠালে ওরা দেখবে শুধু আঙুল গুলো। আর যদি বেশি ভেতরে ঢোকাস, তাহলে ওরা বাঁশটা দেখে ফেলবে। হাতের আরও খানিকটা বানাতে হবে রে।’

সত্যি কথা। কিন্তু কবজির উপরের অংশ বানাবে কি করে? সবাই মিলে বুদ্ধি করে রনির কালো মোজা কেটে পায়ের পাতার অংশ কেটে ফেলে দিলো। গোড়ালি থেকে পায়ের অংশটুকুর মধ্যে আবারও ন্যাকড়া ঠেসে একই ভাবে হাতের উপরের অংশ তৈরি করলো। তারপর দস্তানা খুলে প্রথমেই ঝাড়ুর মধ্যে ন্যাকড়া ঠাসা মোজাটা ঢোকালো। এবার মোড়ার শেষ প্রান্তে দস্তানার হাতটা লাগিয়ে দিতেই অদ্ভুত সুন্দর কালো রঙের একটা হাত তৈরি হয়ে গেল। অনেক কম সময়ে হাত তৈরি হয়ে গেছে, প্ল্যানের প্রথম অংশই শেষ করে ফেলেছে সবাই। তাই অ্যাডভেঞ্চারের বাকি অংশ চিন্তা করে চোখ চকচক করছে ওদের।

সুজন হঠাৎ করেই উঠে রনির বাবার টেবিলের কাছে যায়। অফিসের ফাইলপত্র বাসায় এসে এই টেবিলেই মাঝে মাঝে কাজ করেন তিনি। অনেক জিনিপত্রের মধ্যে পেয়ে যায় সাদা রঙের ফ্লুইড। লেখার মাঝে কোন শব্দ বা বানানে কোন ভুল হলে সাদা রঙের কালি দিয়ে লেখাটা মুছে দেওয়া যায় ফ্লুইড দিয়ে। শুকিয়ে গেলে দিব্যি তার উপরই আবার সঠিক শব্দটি লেখা যায়। দস্তানার হাতের আঙুলের মাথায় সাদা রং দিয়ে নখ এঁকে দেয় সুজন। এবার আসলেই মনে হচ্ছে কনুই পর্যন্ত কাটা একটা কালো হাত। নিজেদের তৈরী হাত দেখে ওরা নিজেরাই মুগ্ধ।
ওদিকে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। সুজন আবারও সবাইকে মনে করিয়ে দিলো, ‘ঠিক সাড়ে এগারোটার মধ্যেই কিন্তু জিতুর বাড়ির সামনে যে কাঠাল গাছটা আছে, তার নিচ থেকে তানিমদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবো আমরা। তার আগেই চলে আসবি সবাই।’ সঙ্গে যোগ করে তুহিন, ‘গাঢ় রঙের জামা প্যান্ট পরবি সবাই। তাহলে অন্ধকারে গা ঢাকা দিতে সুবিধা হবে।’ কিছু একটা বলবো বলবো করেও বলছে না হাসিব। জিতুর কথায় রনি যেন একটু স্বস্তি পেলো, ‘তুহিন, তুই রনির বাড়ি থেকে হাতটা নিয়ে যাবি। আর রনিকে বিশ্বাস নেই। তুই না গেলে হয়তো খেয়ে দেয়ে ঠেসে ঘুম দেবে।’ রাগের বদলে হেসে ফেললো রনি। ‘ওকে, আমি ঠিক এগারোটায় তোর বাড়ির সামনে দাঁড়াবো। নেমে আসবি। দেরি করলে কিন্তু আমি পেঁচার মতো ডাক দেবো, বুঝিস’ নিজেদের প্ল্যান ঠিক করে নিলো তুহিন। বলি বলি করে বলে ফেললো হাসিব, ‘একা একা অন্ধকারের মধ্যে আসবো কি করে? সোজা রাস্তা দিয়ে আসার সময় যদি কেউ দেখে ফেলে?’ কথাটা ঠিক। এই বয়সী কোনো ছেলেকে একা রাস্তায় দেখলে যে কেউ সন্দেহ করবে। আর সুন্দরপুরে সবাই সবাইকে চেনে। তাই উল্টা পাল্টা কিছু বুঝলে কান ধরে আবার বাড়ি রেখে আসবে। ‘স্কুলের স্কাউট ক্যাম্পিংয়ের সময় পেন্সিল ব্যাটারির টর্চ কিনেছিলাম আমরা, মনে আছে? সেটা খুঁজে বের করে রাখবি।ব্যাটারি না থাকলে জোগাড় করে নিবি। দরকার হয় দেয়াল ঘড়ি থেকে খুলে নিস। টর্চের আলোয় এদিক ওদিক দেখে গাছের আড়ালে আড়ালে চলে আসবি।’- ঠান্ডা মাথায় সমাধান দেয় সুজন।

রাতে কি হবে তা নিয়ে উত্তেজনা, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা সেই সন্দেহ, দিঘির পাড়ের ভয় ভয় ভাব, বিপদের আশঙ্কা এবং শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক হয় কি না- তা নিয়ে উদ্বেগে ভুগছে সবাই। তবে অ্যাডভেঞ্চারের নায়ক রাহাত যেন কিছুটা নিশ্চুপ। জিতু ঘাড়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি রে, তুই কিছু বলছিস না যে?’ চিন্তিত মুখে রাহাত বললো, ‘আমরা তো একটা প্ল্যান করলাম। এটা বিফলেও তো যেতে পারে, না? যেকোন কাজ উদ্ধার করতে হলে দ্বিতীয় প্ল্যান রাখতে হয়। ধর, তোরা পালাতে পারলি, কিন্তু আমি তো থাকবো গাছের আগায়। ধরাওতো পড়তে পারি, নাকি? তাই ভাবছিলাম, চোরদের মতো গায়ে সরিষার তেল মাখবো কিনা।’ শেষের কথাটা বলতে বলতে অবশ্য সবকটা দাঁত বেরিয়ে গিয়েছে তার। কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো সবাই। সুজন হাসতে হাসতেই বলে, ‘ওকে, তোকে গাছের আগায় রেখেই আমরা পালাবো। ঠিক আছে?’ হাসির বেগ বেড়ে গেল সবার। চাপা দুশ্চিন্তা কাজ করছে সবার মধ্যে, তবুও হাসতে হাসতে রনিকে বাই বাই বলে বাসার দিকে রওনা দিলো সুজন, তুহিন, জিতু, হাসিব আর রাহাত।

 

১৭.

ঘড়ি ধরে ঠিক এগারোটার সময় গাঢ় রঙের জামা প্যান্ট পরে পিছনের দরজা দিয়ে বেরুলো জিতু, হাতে ছোট টর্চ। ওদের বাড়ীর বাইরের দিকে একটা ঘর আছে, যেটাতে ছোটচাচা থাকতো। ছোট ভাই সেতু জন্মাবার পর থেকে ছোটচাচার সঙ্গে জিতুও ওই ঘরে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে চলে যাওয়ার পর ওই ঘরে জিতুর একার রাজত্ব। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা চুরি করে ঘরে ঢোকা জিতুর জন্য সহজ। কাঁঠাল গাছের নিচে এসে দেখে রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। নেভী ব্লু রঙের গেঞ্চি আর কালো পাজামা পরেছে সে। সবার আগে ওকে আসতে দেখে নিঃশব্দে হাসলো জিতু। কাছে এসে বুঝলো, অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে রিতিমতো টগবগ করছে রাহাত। নিজেই প্ল্যান করেছে, তাই বোধহয় বেশি উত্তেজিত। কাছে এসে হাসি মুখে হাত মেলালো দুজন। তারপর চুপচাপ অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো ওরা। মাঝে মধ্যে ইশারায় টুকটাক কথা চলছে। 

কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়লো হাসিব। ভয়ে ভয়ে এসেছে সে, বোঝাই যাচ্ছে। গাছতলায় এসে জিতু আর রাহাতকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই ঠোঁটে আঙুল রেখে নিষেধ করে জিতু। কথা বলতে না পারলেও বার বার শব্দ করে হেসে ফেলছে সে। বাড়ি থেকে আসতে সারা পথ ভয়ে কাঁটা হয়েছিল, এখন ফিচিক ফিচিক করে হাসছে। চাপা গলায় রাহাতের ধমক খেয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘ভয় পাওয়ার পর ওদের অবস্থা চিন্তা করে হাসি পাচ্ছে আমার।’ কালো গেঞ্জি কালো প্যান্ট পরে সুজন কখন এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায় নি হাসিব। তাই সুজন যখন ঘাড়ের পিছন থেকে বললো, ‘হাসি বন্ধ কর’- চমকে গেল সে। বাজে প্রায় ১১টা ১৫। এখনও রনির দেখা নেই। তুহিন নিশ্চয় ফেঁসে গেছে রনির বাড়ির সামনে। হাতটা নিয়ে তো আসতে হবে, নইলে রনিকে ফেলেই নিশ্চিত চলে আসতো তুহিন। কিন্তু এখন তো কিছু করার নেই, হাতটার জন্য হলেও রনির জন্য অপেক্ষা করছে একা দাঁড়িয়ে। অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। তারউপর কথা বন্ধ করে রাখতে হয়েছে। আসে পাশে পায়চারি শুরু করেছে রাহাত। হাসিব হেসেই চলেছে, তবে সুজনের ধমক খেয়ে এখন নিঃশব্দে হাসছে। জিতু এগিয়ে গিয়ে সুজনকে কি যেন বলতে যায়, তখনই আলো আঁধারিতে দেখা গেল বিশাল বপু নিয়ে হেলে দুলে আসছে রনি। এসেই হাঁপ ছেড়ে বললো, ‘এতো ভারী খাওয়ার পর এভাবে হাঁটা যায়?’ পিছন পিছন হাতটা নিয়ে গাছতলায় এলো তুহিন। বিরক্ত মুখে বললো, ‘তিন প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে এসেছে বেশরম। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, আর সে বিরিয়ানির আমেজে মনের সুখে বিছানায় গড়াচ্ছে। তিন বার পেঁচার ডাক দেওয়ার পর বেরিয়েছে শয়তান।’ তুহিনকে কোনমতে শান্ত করে চাপা গলায় সুজন বলে, ‘সবাই রেডি?’ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় সবাই।
হাটা শুরু করতেই রাহাত হাত দেখিয়ে থামায়, ‘শোন, মজা করছি না। পরিস্থিতি যে আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী হবে, তা না। যদি প্ল্যানের বাইরে কিছু হয়, পরিবেশ মতো সিদ্ধান্ত নিবি। দরকার হয় পালাবি, কিন্তু কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না।’ অসন্তুষ্ট হলেও ওর কথায় সম্মত হয় ওরা। কারণ ধরা পড়লে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জান কাবার হয়ে যাবে। তাছড়া বাড়ির বকা আর মাইর তো আছেই। সবচে বড় কথা, তানিম আর ওর ভাই। ওরা যদি বুঝে যায়, ভয় দেখাতে এসে ধরা পড়েছে কেউ- লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। ভালোয় ভালোয় প্ল্যানটা সফল হোক, এ আশা নিয়েই সবাই রওনা দেয় জমিদার বাড়ির দিকে। সোজা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে একটু ঘুরপথে যাচ্ছে ওরা। সোজা রাস্তায় পাহারাদার কিংবা অন্য লোকজন থাকতে পারে। মন খুলে কথা বলা যাচ্ছে না ঠিকই, তবে ফিস ফিস করে শুরু করলো কে কি ভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সে গল্প।

 

১৮.

কাঁঠাল তলায় সবার প্রথমে এসে পৌছেছে রাহাত। জিতুর অনুরোধে তাই রাহাতই বলা শুরু করলো বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার কাহিনি। দাঁত বের করে আগে একচোট হেসে নিলো সে। তারপর বললো, ‘আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেছি। আর আমার পাশে তো ঘুমায় দাদা। ঘুমের ট্যাবলেট খায় তো, তাই প্রতিদিন দাদা অনেক আগেই ঘুমাতে যায়। আজ দাদার আগেই আমি গিয়ে শুয়ে পড়েছি। কিছুক্ষণ পরেই দাদার নাক ডাকার শব্দ শুরু হলো। আর আমি তো ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে আছি। বাসার সবাই একজন একজন করে শুয়ে পড়লো। সবশেষে আম্মা লাইট নিভিয়ে ঘরে গেলে ঘড়ি ধরে দেখি প্রায় ১১টা বাজে। এরপর কখন আমি  উঠে ছাঁদে চলে গেছি, ঘুমের ট্যাবলেটের গুনে দাদা টেরই পায়নি। ছাঁদের পাশের গাছটা দিয়ে নিচে নেমে সবার আগে এখানে চলে এলাম। কোন সমস্যাই হয় নি, শুধু গাছের ঘষায় কনুই থেকে নুনছাল উঠে গেছে।’ দাঁত বের করেই কনুই তুলে দেখায় সে। তুহিন আর হাসিব বাড়ি থেকে বেরুবার বুদ্ধি আগেই করে রেখেছিল। তুহিন বাসায় বলেছে আজ রাতে হাসিবের বাসায় থাকবে, আর হাসিব ওর মাকে বলেছে তুহিনের বাসায় থাকবে। তাই বেরুতে কোন সমস্যা হয় নি। অত রাতে তো আর বাড়ি থেকে বেরুনো যায় না, তাই খেয়ে দেয়েই যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। তুহিন চলে গেছে রনিদের বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে। ওই দোকানে অনেক মানুষ জমা হয়ে সিনেমা দেখে। ওকে আর কেউ আলাদা করে খেয়াল করে নি। হাসিব ওর খালার বাসায় গিয়ে আবারও খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ফিরছে বলে কাঁঠাল তলায় চলে এসেছে। কিন্তু কাজ শেষে তারা দুজন কই থাকবে, তা ঠিক করে নি। তবে দুশ্চিন্তা থেকে জিতু উদ্ধার করে ওদের। জিতুর ঘরটা যেহেতু আলাদা, রাতে ওরা থাকলেও কেউ টের পাবেনা। খুব সকালে উঠে যে যার বাড়ি চলে গেলেই হলো। সুজন তো বেরুবার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই সে বলেছে, পেটে ব্যাথা। পেট খামচে ধরে কয়েকবার আউ আউ শব্দ করেছে। পেটের অসুখের ভান করে বার বার বাথরুমে গিয়ে বুঝিয়েছে, আরও বাথরুমে যেতে হবে তাকে। ওদের বাথরুমটা ঘরের সঙ্গে লাগানো না। উঠানের এক কোনে। তাই ঘরের দরজা খুলে বেরুবার সময় কেউ যদি টের পেয়ে থাকে, ভেবেছে সুজন বাথরুমে গেছে। ঢুকবার সময়ও এই পেটে ব্যথার বুদ্ধি কাজে দেবে। ওদের তুলনায় রনির কোন কষ্টই করতে হয় নি। বাবা মায়ের সঙ্গে ভরপেট বিরিয়ানি খেয়ে বিছানায় গিয়েছে সে। ওর বাবা নিজের ঘরে ফিরে অফিসের কাজে বসেছে, আর মা রনির মশারি খাটিয়ে দিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। রনি আগেই জহুরা খালাকে বলে রেখেছে, জিতুদের বাড়ি যাচ্ছে সবাই। নাইট কুইন গাছের ফুল দেখার জন্য। রাত ১২টার পর ফুল ফুটবে, দেখে আবার বাসায় আসবে। খালাও সানন্দে রাজি, ফুলই তো দেখতে যাচ্ছে। বাবা মাকে বলার দরকার কি? বাসায় ফিরলে খালাই দরজা খুলে দেবে। এমনকি বাবা মা যদি টের পায়, রনি বাসায় নেই- তাহলেও জহুরা খালা ম্যানেজ করবে।

নিজেদের কথা নিয়ে সবাই যখন হাসছিল, হঠাৎ বাঁশির শব্দ। সচেতন হয়ে যায় ওরা। দেখে বাজার পাহারা দেওয়ার লোকটা হুইসেল বাজিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়, পাহারাদার লোকটা ওদের দেখতে পায় নি। নিয়মমাফিক বাঁশি বাজাচ্ছে। ওদের চোখের সামনে দিয়েই এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হেঁটে বেশ দূরে চলে গেল লোকটা। তার দিকে চোখ রেখেই ফিসফিস করে সুজন বললো, ‘সবাই একসঙ্গে গেলে ঝামেলা হবে। কথা বেশি হচ্ছে। শোন, আমি তুহিন আর হাসিব হাতটা নিয়ে আসছি। রাহাত, রনি আর জিতু- তোরা এগিয়ে যা। তানিমদের বাড়ির বাইরে শিমুল গাছটার নিচে দাঁড়াবি। ঠিক আছে?’ মাথা ঝাকিয়ে রাহাত বলে, ‘ঠিক আছে। তোরা আয়। আমি গিয়ে গাছে উঠতে থাকি। বাই।’ অন্ধকারে মিশে গিয়ে এগিয়ে যায় ওরা। কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে সুজন বলে ওঠে, ‘চল।’

 

১৯.

সুজন, তুহিন আর হাসিব পথে কোন বিপদ আপদ ছাড়াই গাছের নিচে পৌঁছালো। গাছের নিচে রনি আর জিতুকে দেখে বোঝা গেল, ওরাও কোন ঝামেলার মধ্যে পড়ে নি। আর রাহাত কথা মতো এরমধ্যেই গাছের উপরে উঠে গেছে। জিতুর রেডিয়াম দেওয়া ঘড়িতে দেখা গেল, রাত বাজে প্রায় পৌনে বারটা। তানিমের ঘরের লাইট বন্ধ। ‘আমার ভাইয়া অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়ে। পড়ার বইয়ের পাশাপাশি ভাইয়ার আরও কত সুন্দর সুন্দর বই আছে। সব ইংলিশ। আর তাছাড়া কম্পিউটারে কত্ত কিছু করে। ঝড়ের মতো ইংলিশে কত কি লিখে ফেলে। কিবোর্ডে তখন খটাখট শব্দ হয়। গেমস্ খেলে, ইন্টারনেটে বসে। আর ঢাকায় ১২টার নিচে রাতই হয়না। চাচাতো অনেক রাতেই বাসায় ফেরে। ভাইয়া আর আমার জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে আসে।’- নিজের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ভাইয়ের গুণগানে এসব প্রায়ই বলতো তানিম। সে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে? গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তানিমের সাথে ইংলিশ মিডিয়ামও শুয়ে পড়েছে হয়তো।

নিচ থেকে হাত লাগানো ঝাড়ুটা ওর হাতে দিয়ে দিলো তুহিন।ঝাড়ুটা ঘুরিয়ে হাতের দিকটা তানিমের ঘরের দিকে নিতে গিয়ে গাছের ডালে একবার টাল খেল রাহাত। রনি একটু শব্দ করেই বলে ফেললো, ‘সাবধান’। ওর কথায় সবাই একসাথে হিসস করে যে শব্দটা করলো, সেটাও খুব আস্তে ছিলনা। ওদের কাণ্ড দেখে হেসে ফেললো রাহাত। এক ডালে পা রেখে আরেকটা ডালকে এক হাতের বগলের নিচে নিয়ে শক্ত করে দাঁড়ালো সে। এবার এক হাতে ঝাড়ু’র বাঁশটাকে বেশ কায়দা করে ধরলো, অন্যহাতে হাতের দিকটাকে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছে। অত লম্বা ঝাড়ুর হাতটাকে সামলাতে একটু কষ্ট হচ্ছে ওর। তবু ভালো বাঁশটা খুব চিকন, ঝাড়ু’র ওজন খুব একটা বেশি না। একটু নড়ে চড়েই হাতটাকে তানিমের ঘরের ভেন্টিলেটরের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললো রাহাত। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে খুব হালকা করে একটা শিস বাজালো।

গাছের নিচ থেকে দুই হাত মুখের সামনে নিয়ে মাইকের মতো বানিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার মতো শব্দ করতে শুরু করে সবাই। খুব আস্তে করে টেনে টেনে শব্দ করছে ওরা। তানিমের ঘরের কোন পরিবর্তন না দেখে শব্দ একটু বাড়ালো সুজন। কাজ হয়েছে, আলো জ্বলে উঠলো তানিমের ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে রাহাত বাঁশের হাতটাকে বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। ঘর থেকে এখনও কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হাতটা কি এখনও দেখতে পায়নি ওরা? বাঁশটাকে উপর নিচে নাড়িয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরে ঢোকানো হাতটাকে কাঁপিয়ে দিলো রাহাত। ব্যাস-
রাহাত তো বটেই, গাছের নিচ থেকে সবাই শুনতে পেল তানিমের ভয় পাওয়া কণ্ঠ, ‘ইয়া আল্লাহ্। এইটা কার হাত? ও মা-’ আরিফ মনে হয় ভেন্টিলেটর দিয়ে কালো রঙের হাত দেখে ভয়ে বরফ হয়ে গিয়েছিল। তাই কয়েক মুহুর্ত পুরাই চুপ। তারপর শুরু করলো চিৎকার। ‘ভূ-উ-উ-উ-ত। বাবাগো, খেয়ে ফেললো রে-। ভূ-উ-ত।’ তানিমের মা ডাক তখনও থামে নি। ভূতের জিকির থামিয়ে দিয়ে আরিফও তানিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘মা---।’ ওদের গলায় যেন অসুর ভর করেছে। ‘আমাদের মাফ করে দাও। আর কোনদিনও করবো না। ওরে বাবারে, কেউ বাঁচাও আমাদের।’- কান্নার সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার করে আবোল তাবোল বলছে দুই ভাই। ঝাড়ুর তৈরী হাতটা আস্তে আস্তে নাড়াচ্ছে রাহাত, গাছের নিচ থেকে অনবরত চলছে সুজন, হাসিব, রনি, জিতু আর তুহিনের নাঁকি কান্না। হাতের খেল দেখাতে বাঁশটাকে কায়দা করে এদিক ওদিক উপরে নিচে নাড়াচ্ছে রাহাত। এতো লম্বা বাঁশটা সামলাতে বেশ কষ্টই হচ্ছে ওর। ভেতরে দুই ভাই ভয়ে ততক্ষণে পাগল হয়ে গেছে, দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বদলে ভিতর থেকেই দরজার মধ্যে দুম দুম করে কিল দিচ্ছে। ‘মেরে ফেললো রে, বাঁচাও, ভূত, মাফ করে দাও, ও মা, বাবা গো...’- ভেতরের কণ্ঠ দুটো তখন ভয়ে আধমরা। হাতটাকে ঘরের ভেতর আরেকটু ঢোকাতে একটু সামনে ঝুঁকালো রাহাত। ঠিক তখনই....


২০.

ঠিক তখনই একসঙ্গে দুটি ঘটনায় নির্বাক হয়ে গেল ওরা। জ্বলে উঠলো জমিদার বাড়ির লাইট, মানুষজন উঠে পড়েছে। আর এদিকে, যে ডালে দাঁড়িয়ে হাতের খেল দেখাচ্ছে রাহাত, কেঁপে উঠলো সেটা। আলো জ্বলে উঠেছে দেখে লম্বা বাঁশটাকে সামলে হাতটাকে ভেন্টিলেটরের গর্ত থেকে টেনে বাইরে আনতে গিয়ে নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। বাঁশটা টান দিতেই পায়ের নিচের ডালটা বড়সড় একটা দোল খেল।যে ডালটা হাতে ধরে ছিল, সেটাকে আকড়ে ধরলো ও। চিকন ডালটা রাহাতের ভর নিতে পারলো না, ভেঙে হাতে চলে এসেছে সেটা। আশে পাশে ধরার মতো কোন ডাল নেই। এক হাতে বাঁশটাকে ধরে রেখে অন্য হাতে ধরার মতো কিছু একটা খুঁজছে তাড়াহুড়োয়। পায়ের নিচের ডালটা দুলেই চলছে। আর ওদিকে ভয়ে দুলছে গাছের নিচে দাঁড়ানো বন্ধুদের প্রাণ। হৃৎপিণ্ড যেন বশে নেই কারো। উপরের দিকে তাকিয়ে সবাই বলে চলেছে, ‘রাহাত সাবধান। হ্যাঁ হ্যাঁ, ডালটা ধর। আরে বাঁশটা ছেড়ে দে না। ধর ধর-’। বাড়ীর ভিতরে তানিম আর আরিফের ক্রমাগত চিৎকার আর কান্নাকাটির মধ্যে ওদের কথা শুনতে পাবে না কেউ। তবুও রাহাতের পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চাপা গলায় সাবধান করছে ওকে।

অনেক চেষ্টা করেও শেষরক্ষা করতে পারলো না রাহাত, বাঁশটা ছেড়ে দিয়ে ঝুপ করে পড়লো দিঘির পানিতে। হতভম্ব হয়ে গেছে গাছের নিচে দাঁড়ানো সুজন, রনি, তুহিন, জিতু, হাসিব। কি করবে বুঝতে উঠতে পারছে না কেউ। বাড়ির মধ্যে অনেক লোকের হাক ডাকে সম্বিৎ ফেরে ওদের। রাহাতের ছেড়ে দেওয়া ঝাড়ুর হাতটাও এতক্ষণে গাছের ডালপালার মধ্য দিয়ে ঝুলে নিচের দিকে পড়ছে। ধরার আগেই মাটিতে একটা ঠোক্কর খেয়ে সেটাও চলে যায় দিঘিতে। কচুরিপানার দঙ্গলের মধ্যদিয়েই হাত পা নেড়ে পাড়ের দিকে আসছে রাহাত, ওস্তাদ সাঁতাড়ু সে। দৌঁড়ে দিঘির একদম পাড়ে চলে এলে ওরা। হাতের ইশারায় রাহাতকে আরও তাড়াতাড়ি আসতে বলছে। ওদিকে উপরের হৈ চৈ চিৎকার চেচামেচি বাড়ছে, তানিম আর আরিফের কান্নার সঙ্গে যোগ হয়েছে নারী কণ্ঠের কান্না। ছেলেদের ভয় পেতে দেখে মনে হয় ভয় পেয়ে কাঁদছে আন্টি। গেটের কাছেও হাকডাক আর দৌঁড়াদৌঁড়ির শব্দ। মনে হয় গেট খুলে বেরুবে কেউ। হ্যাঁ, অনুমান ঠিক। জ্বলে উঠলো গেটের বাইরের লাইট। তখনই রাহাত পাড়ে পৌঁছাতে পারে নি। উপায়ন্তর না দেখে জামিদার বাড়ির উল্টো দিকে দৌঁড় দেয় সবাই। নিরাপদ দূরত্বে এসে একটা দোকানের আড়ালে সুজন দাঁড়িয়ে পড়ে, হাফাতে থাকে বাকিরাও। ‘তোরা এখানে দাঁড়া। আমি রাহাতকে নিয়ে আসি।’- বলে দিঘির দিকে আবার হাঁটা দেয় সুজন। ‘না।’- সুজনের পথ আটকে দাঁড়ায় তুহিন। ‘রাহাত কি বলেছিল মনে নেই? কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। গেটের বাইরের লাইট জ্বলছে। এক্ষুনি কেউ বেরুবে। তোকে দেখে ফেললে কি বলবি?’ মাথা নিচু করে ভাবে সুজন। ওর কাছে এসে ঘাড়ে হাত রেখে জিতু বলে, ‘লোকগুলো যাক, তারপর আমরা গিয়ে দেখছি। আর ততক্ষণ নিশ্চয় রাহাত লুকিয়ে থাকবে। আমরা কেউ ধরা পড়ে গেলে ও উঠে এসে খুব রাগারাগি করবে।’ সুজনের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কারো কথা মানতে কষ্ট হচ্ছে ওর। রাহাতকে এভাবে একা ফেলে আসাটা কিছুতেই মানতে পারছে না সে। কিন্তু করার তো কিছু নেই। তাই মেনে নেয় ওদের কথা। ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

২১.

রাতে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হয়েছে। সবজি পোলাও করেছিল মা। সঙ্গে পুরভরা পটোল ভাজি, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, নারকেলের দুধে ডিমের কোরমা, চিতল মাছের কালিয়া, মুরগির রোস্ট আর গরুর কালাভুনা। শেষ পাতের ঘনদুধের পায়েসের স্বাদটা তো এখনও মুখে লেগে রয়েছে। আর দুধ বাদামের লাচ্ছি তো মায়ের বিশেষ রেসিপি। খেতে খেতে চাচা আর ভাইয়া মায়ের রান্নার প্রশংসা করছিলেন খুব। চাচাতো বলেই ফেললেন, ‘বৌমা, তুমি ঢাকায় চলো। একটা রেস্টুরেন্ট খুলে দেবো। দেখবে রমরম করে বিজনেস চলছে। বড় বউ তো রান্নায় অন্নপূর্ণা, একবার খেলে দ্বিতীয়বার মুখে তুলতে ভয় হয়। সে না হয় হিসাবটা দেখবে। দুই বউ মিলে বিশাল হোটেল খুলে ফেলতে পারবে।’ হা হা করে হেসে ফেলেন বাবা। মুচকি হেসে ঘোমটাটা আরেকটু টেনে দেয় মা। ‘আপাও ভালো রাধে ভাইজান। কিন্তু আপনিই তো খাবার সময় পান না।’ মন দিয়ে মুরগির ঠ্যাং চিবুচ্ছিল আরিফ ভাই। সে অবস্থায় বললো, ‘চাচি তুমি জানো, প্রতিবার এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আমার ওজন কত বেড়ে যায়? তোমার হাতে সত্যিই জাদু আছে। বাবা খুব খারাপ বলেনি। রেস্টুরেন্ট খুব ভালো চলবে তোমার।’ খুব আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মা। এতো ভালো লাগলো তানিমের। মায়ের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে?

এতো ভারী খাওয়া দাওয়ার পরে প্রতিদিনের আড্ডাটা আজ আর জমলো না। চাচা ঘুমাতে চলে গেল। বাবাও নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। আরিফ ভাইকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো তানিম। গেমস্ টেমস্ বাদ দিয়ে বিছানায় চিৎপাত হয়ে পড়লো দুই ভাই। বুয়া টেবিল পরিষ্কার করে নিয়ে গেলে মা লাইট নিভিয়ে দিয়ে ওদের রুমে আসেন। মাকে দেখে আরিফ ভাই বলে, ‘এতো খেয়েছি চাচী, পেট ফেটে যাবে মনে হয়।’ হেসে ফেলেন মা। ‘কি আর খেয়েছ। সারাদিন স্কুল প্রাইভেট কোচিং করে খাওয়ার সময় পাও কই? সে জন্যই তো শরীরের এই অবস্থা। বাড়ন্ত বয়স, এই বয়সে বেশি বেশি খেতে হয়। এ কদিন আমি আমার ইচ্ছেমতো খাওয়াবো। না বলতে পারবে না। বুঝলে?’ বলে লাইট নিভিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে যায় মা।

শুয়ে গল্প করতে করতে ইয়া বড় বড় হাই তোলে দুই ভাই। ঘুমে চোখ ছোট হয়ে এসেছে, ঘুমের আবেশে কথা জড়িয়ে আসে দুজনেরই। ঘুমিয়ে তলিয়ে যেতে যেতে কেমন যেন একটা শব্দ শুনলো তানিম। মনে হল, দূরে কোথাও বেড়াল ডাকছে, বাচ্চাকে খুঁজে না পেয়ে মা বেড়াল ডেকে ডেকে হয়রান। বাচ্চা বেড়ালটার দুষ্টুমির কথা ভেবেই হাসি পেয়ে গেল। ঠিক তখনই তন্দ্রা ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলো আরিফ। একমুহুর্তে কেটে গেল তানিমের ঘুমও। ‘কি হয়েছে ভাইয়া?’ অবাক হয়ে আরিফকে জিজ্ঞেস করে সে। খানিকটা ফিসফিস করে আরিফ উত্তর দিলো, ‘শুনতে পাচ্ছিস না? কান্নার শব্দ। এতো রাতে দিঘির পাড়ে কে কাঁদে?’ বলতে বলতে বিছানা থেকে উঠে ঘরের লাইট জ্বালায় আরিফ। বন্ধুদের আড্ডায় বাহাদুুরি করে বলেছে ঠিকই, কিন্তু দিঘির ওই পেত্মীটাকে নিজেও খুব ভয় পায় তানিম। তাই ভাইয়ের সঙ্গেই উঠে দাঁড়ায় সে। ‘মনে হচ্ছে না, খুব কাছেই কেউ কাঁদছে?’ ভাইয়ের কথায় মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে তানিম আঙুল তুলে দক্ষিণদিকে দেখায়, ‘হ্যাঁ। মনে হচ্ছে...’
মুখের কথা মুখেই রয়ে যায় ওর। চোখ পড়েছে ভেন্টিলেটরের দিকে। বিশাল একটা কালো লোমশ হাত ভেন্টিলেটরের গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে, এগিয়ে আসছে সোজা ওদের দিকে। ‘ইয়া আল্লাহ্। এইটা কার হাত? ও মা-’ চিৎকার করে বিছানায় বসে পড়ে তানিম। ওর অবস্থা দেখে আরিফও সোজা তাকায় হাতটার দিকে। কয়েক মুহুর্ত যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, বিশাল এক ভুতুড়ে কালো হাত ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। হাতটা হঠাৎ ইশারায় তাদের কাছে ডাকতে শুরু করলো। হঠাৎ অপ্রকৃতস্থের মতো চিৎকার করে উঠলো, ‘ভূ-উ-উ-উ-ত। বাবাগো, খেয়ে ফেললো রে-। ভূ-উ-ত।’ ভূতের হাতটা কি অদ্ভুত ভঙ্গি করে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। ওদিকে পেত্মীর কান্নাও বাড়ছে। ঘরের এমাথা ওমাথা দৌঁড়াচ্ছে আরিফ, লুকানোর মতো কোন জায়গা না পেয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আরিফের সঙ্গেই পাগলের মতো চিৎকার শুরু করলো, ‘মা... বাঁচাও...।’ একটু একটু কাঁপছে হাতটা, মনে হচ্ছে শিকার পাওয়ার আনন্দে নাচছে। পারলে পিঠের চাপে দরজা ভেঙে বেরিয়ে যেত দুই ভাই। কালো হাতটা এগিয়ে আসছে তো আসছে। আরেকটু হলেই প্রায় ধরে ফেলবে ওদের। ব্যাস, মরিয়া হয়ে দরজায় দুম দুম কিল মারা শুরু করলো আরিফ। দেখাদেখি তানিমও কিলের চোটে দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। একমুহূর্তের জন্যও থামেনি ভয়ে আধমরা হয়ে দুজনের মরিয়া চিৎকার, ‘মেরে ফেললো রে, বাঁচাও, ভূত, মাফ করে দাও, ও মা, বাবা গো...’

হঠাৎ করেই ছেলেদের চিৎকারে যে যার ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসেন তানিমের বাবা, মা, চাচা। বাড়ির অন্যান্য লোকজনও আচমকা এই ত্রাহি চিৎকারে কাঁচা ঘুম ভেঙে এসে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে উঠানে। কেউ বুঝে উঠতে পারছে না, কি হয়েছে। তানিমের মা দৌঁড়ে ছেলের ঘরের দরজায় গিয়ে কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘কি হয়েছে বাবারা? কি হয়েছে? দরজা টা খোল।’ ততক্ষণে তানিমের বাবার হাকডাকে সবাই দৌঁড় ঝাপ করে বাড়ির সব লাইট জ্বেলে দিয়েছে। সবাই মিলে দরজা ধাক্কাচ্ছে, কিন্তু তানিম বা আরিফ কেউই দরজার লক খুলছে না। ঘরের ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে পাগলের মতো ওদের চিৎকার, ‘ভূ-উ-উ-উ-ত। ও মা... ভূ-উ-উ-উ-ত। কেউ বাঁচাও। ভূ-উ-উ-উ-ত।’ দরজা খোলার কোন উপায় না পেয়ে সবাইকে সরে যেতে বলে তানিমের বাবা, ধাক্কা দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করবে সে। প্রথম ধাক্কায় কিছুই হয়না দরজার, দ্বিতীয় ধাক্কা দেবার আগেই দরজা খুলে দৌঁড়ে বেরিয়ে আসে তানিম আর আরিফ। ‘ভূ-উ-উ-উ-ত’ বলে কোলে ঝাপ দেয় মায়ের। পাগলের মতো অনবরত কাঁদছে তানিম, কিন্তু আরিফ কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। মুখে তার তখনও একটাই কথা, ‘ভূ-উ-উ-উ-ত’। 

 

২২.

দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে জমিদার বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে আছে পাঁচজোড়া চোখ। উৎকণ্ঠায় যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে সবাই। গেটের লাইটটা জ্বলেছে ঠিকই, কিন্তু বাড়ির ভিতর থেকে কেউ বেরুচ্ছে না। কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে সুজন আবারও বলে, ‘দেখ, রাহাতের যদি কোন সাহায্যের দরকার হয়? সবাই তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, দুজনও একসঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। তোরা একটু দাঁড়া। আমি দৌঁড় দিয়ে রাহাতকে নিয়ে আসি।’ সবাই বুঝতে পারে, সুজনকে আটকানো যাবে না। এবার জিতুও আর বাঁধা দেয় না। শুধু বলে, ‘দরকার হলে ইশারা করে ডাক দিস। আমি যাবো।’ কথা শেষ হতেই দোকানের পিছনের থেকে এক দৌঁড়ে রাস্তা পেরিয়ে যায় সুজন। চোখ তানিমদের বাড়ির গেটের দিকে। এরপর গাছের আড়ালে গা বাঁচিয়ে দিঘির কাছে যায়। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই দেখতে পাচ্ছিলো রাহাত পাড়ে এসে পৌছায় নি। তবে এক জায়গায় দিঘির কচুড়িপানা নড়ছে একটু একটু, হয়তো হাত নাড়াচ্ছে রাহাত। বাড়ির মধ্যে চিৎকার, কান্না, অনেক লোকের কথাবার্তা উপেক্ষা করে শিমুলতলায় পৌঁছে যায় সুজন। কই, রাহাতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন? অন্ধকারের মধ্যে��� পানির একদম কাছে চলে যায় সে, তবুও রাহাতের কোন চিহ্নই নেই। কি করবে এখন? বন্ধুদের কাছে বলে এসেছে, রাহাতকে নিয়ে ফিরছি। কিন্তু আঁতি পাতি করে খুঁজেও তো রাহাতের দেখা পাচ্ছে না। এমন সময় জমিদার বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দে চমকে ওঠে সুজন। বসে পড়ে শিমুল তলায়। গেট থেকে কে যেন সাইকেল নিয়ে দ্রুত বেগে কোথাও চলে গেল। বাড়ির কথা বার্তায় কান দিয়ে বুঝলো, শিমুল তলায় কেউ আছে কি না দেখতে বলছে তানিমের বাবা। নয়তো ছেলেদুটো কি দেখে ভয় পেলো?

তাড়াতাড়ি শিমুলতলা ছেড়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে এলো সুজন। তিন চারজন লোক গেট থেকে বেরুতেই বড় একটা রেইনট্রি গাছের গুড়িতে নিজেকে আড়াল করে ফেললো নিজেকে। সেখান থেকেই দুচোখ তন্ন তন্ন করে দিঘির পানিতে খুঁজছে রাহাতকে। ওদিকে তিন চার জন লোক এসে ঠিক ওই শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাতের টর্চ মেরে চারপাশে দেখে। দিঘির পানি, ডানে বামে, এমনকি গাছের উপরেও টর্চ মেরে দেখে তারা। একজন আবার হাক দেয়, ‘হই... কেউ আছে নাকি এইহানে?’ তারপর জোরে বলে, ‘চাচা, এইহানে কেহই নাই। পুরা ফকফকা।’ বাড়ির ভিতর থেকে তানিমের বাবা ওনাদের ভেতরে যেতে বলেন। নিজের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক টর্চ মেরে বাড়ীর মধ্যে ঢুকে যায়।

তারা বাড়িতে ঢুকে গেলেও গেট আবার আটকানো হয় না। যেকোন সময় কেউ বেরুতে পারে, তবুও ঝুঁকি নিয়ে রেইনট্রি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে পরে সুজন। দিঘির পাড়ে এ গাছ ওগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে ডাকে, ‘রাহাত...। রাহাত...।’ কোন জবাব আসে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে সুজনের। ঠিক শিমুল গাছের নিচে এখন কচুরিপানার দঙ্গলের ভীড় দেখলে মনেই হয় না, কিছুক্ষণ আগে এখানেই রাহাত পড়ে গিয়েছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে রাহাত? নাকি সুজন, রনি, হাসিব, তুহিন আর জিতুকে চমকে দিতে আগেই দিঘি থেকে উঠে দুষ্টুমি করে কোথাও লুকিয়ে আছে?

 

২৩.

এক রাতে সবার যেন বয়স বেড়ে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত রাহাতের জন্য অপেক্ষা করেছে সুজন, জিতু, হাসিব, রনি আর তুহিন। এমনকি জিতুও একবার দিঘির পাড়ে গিয়ে ওকে খুঁজে এসেছে। না, রাহাত ফিরেও আসে নি, রাহাতের কোন খোঁজও পায় নি ওরা। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে বাড়ির লোকের হাতে ধরা পরতে পারে সবাই। এটা মনে করেই তাই আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী হাসিব আর তুহিন জিতুর বাড়িতে থেকে গেছে। রনি আর সুজন যে যার বাড়ি চলে গিয়েছিল। ফেরার সময় কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ভয়, শঙ্কা, উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তায় সবার মুখ এতোটুকু হয়েছিল। প্রত্যেকের মনেই প্রশ্ন জমে আছে, কিন্তু উত্তর জানা নেই কারোরই।
 
ভোর না হতেই সবাই সবাই জড়ো হলো স্কুলের মাঠে। সবারই চোখ মুখ ফুলে আছে। জিতু সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারে নি দুশ্চিন্তায়, বিছানায় এপাশ ওপাশ করে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। জিতুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন যেন তুহিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিচ্ছিরি একটা দুস্বপ্ন দেখে জেগে গেছে। হাসিব তো সারারাতই বলতে গেলে কান্নাকাটি করেছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে। রনিও প্রায় একই অবস্থা। তবে এই কান্নাকাটি ভয়ে নাকি রাহাতের জন্য কষ্টে, তা জানেনা। ভ্রু কুচঁকে সারারাত কত কি ভেবেছে সুজন। কখনো আশার আলো পেয়েছে, আবার কখনো চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। মাঠে একে অন্যের গায়ের কাছ ঘেষে বসে আছে ওরা। কারো মুখেই কোন কথা নেই। কারণ এখানে আসার আগে রাহাতের বাড়ি গিয়েছিল ওরা। রাহাত বাড়িতে নেই। ওর মা ভেবেছে, ভোরে উঠেই খেলতে চলে গেছে বা বন্ধুদের বাড়ি গেছে। রাহাত এমন কাজ প্রায়ই করে। ভোরে উঠে হাম্মির জন্য ফুল কুড়ায়, গত বিকালে ফেলে আসা মার্বেল কিংবা খেলনা মাঠ থেকে খুঁজে নিয়ে আসে কিংবা বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে নাস্তার টেবিলে হামলা দেয়। তাই এতো ভোরে ওর অনুপস্থিতিতে অবাক হয় নি কেউ।
মাঠে আসার পথে ওরা বুঝতে পারলো, সুন্দরপুরে এখন একটাই আলোচ্য বিষয়। দিঘির পাড়ের পেত্মী জমিদার বাড়ির ছেলেদের আক্রমণ করেছিল কাল রাতে। চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে ঢাকা থেকে বেড়াতে এসে পেত্মীর খপ্পরে পড়েছে। আরিফ প্রায় ঘন্টা খানেক অজ্ঞান হয়েছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে সাইকেলে করে ও বাড়ির কেউ একজন ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার ডেকে তার জ্ঞান ফেরানো হয়েছে। তবে জ্ঞান ফিরলেও কোন কথা বলছে না। শুধু একটু পর পর চমকে উঠছে। আর চেয়ারম্যানের ছেলে তানিমের ধুম জ্বর। দুজনকেই ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে আজ। গ্রামের গন্যমান্য লোকজন ভেঙে পড়েছে জমিদার বাড়িতে। তার কৌতুহলী লোকজনতো বাড়িটাকে ঘিরে আছে। দিঘির পাড়েও এখানে সেখানে ছোট ছোট জটলা। রাতে তো দূরে থাক, দিনের বেলাতেও যে দিঘির পাড়ে একা যেতে সাহস করে না অনেকে- সেখানে আজ অনেকেই দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।

পেত্মীর কাহিনি কতখানি ছড়িয়েছে সুন্দরপুরে, তা বোঝা গেল বেলা একটু বাড়তেই। বাজারের লোকজন, দোকাননী, প্রতিটি বাড়িতে এমনকি বিভিন্ন আড্ডার মূল বিষয় পেত্মী।পুরো এলাকায় কেমন যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট ছেলে মেয়েরা ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয় নি। বাবা মায়েরা ছেলে মেয়েদের চোখে চোখে রাখছে। আর যারা তাদের চেয়ে একটু বড়, এ বিষয়ে উৎসাহের অন্ত নেই। অতি উত্তেজনায় তাদের মুখে কাহিনির পাখা গজিয়ে গেছে। পেত্মীর চেহারা কেমন, কেমন করে কাঁদে, কেমন করে ঘরে ঢুকেছে, কোন পোশাক পরা ছিল- সব বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খ দিয়ে দিচ্ছে। এমনকি পেত্মীটা তানিমকে কয়টা কামড় দিয়েছে, আরিফকে কয়টা থাপ্পরে অজ্ঞান করে ফেলেছে, চলে যাওয়ার আগে কি বলে গেছে- সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাহিনির নিত্যনতুন লেজ গজাচ্ছে। শুধু কারও মুখে রাহাতের কোন কথা নেই।

 

২৪.

বাড়ির মানুষ আছে নিশ্চিন্তে, এলাকার কারো কোন মাথাব্যাথা নেই। ওরা যে কাউকে সত্যি ঘটনাটা বলবে, তার কোন উপায় নেই। দুশ্চিন্তা আর কষ্টে পাথরের মতো বসে আছে সবাই। এখানে তবু ভয় একটু কম, তেমন কেউ দেখছে না ওদের। বাড়িতে বা রাস্তায় এর ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। মুখ কালো করে রাখলে প্রশ্ন, চুপ করে থাকলে প্রশ্ন, তানিমকে নিয়ে প্রশ্ন- তবুও ভালো রাহাতকে নিয়ে এখনও পর্যন্ত কেউ কোন প্রশ্ন করে নি। ওরা যা করেছে, তা যদি জানাজানি হয়ে যায়? ভাবতেই ভয়ে হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকে যেতে চায়। ছোট ছেলে বলে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। আর বাড়ির লোকদের শাস্তির কথা তো বাদই গেল। কিন্তু যদি রাহাতকে খুঁজে না পাওয়া যায়? বন্ধুকে ফেলে চলে আসা যে অপরাধ, তার যোগ্য কোন শাস্তি আছে?

কষ্টও হচ্ছে খুব। স্কুলের মাঠের আড্ডায় রাহাত নেই, এটা খুবই অস্বাভাবিক। ওই তো আড্ডার প্রাণ। ও যদি আর ফিরে না আসে? না না, এমন ভাবনা মনে আনাও ঠিক না। ও নিশ্চয় ফিরে আসবে। তবে এখন ও কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে। কোন বিপদ আপদ হয় নি তো? রাহাতের খোঁজ নেই, অথচ কিছুই করতে পারছে না ওরা। আবার মূর্তির মতো বসে থাকতেও অসহ্য লাগছে। কিছু তো করতে হবে। রাহাতকে খুঁজে বের করতে হবে। এখন না হয় কেউ রাহাতের অনুপস্থিতি খেয়াল করছে না। তবে একটা না একটা সময় তো ঠিকই করবে। তখন কি হবে? সুজন, তুহিন, হাসিব, জিতু, রনি- সবার মাথাতেই ঘুরছে, ‘কিছু একটা করতে হবে।’ কিন্তু কি করা যায়?

তুহিনের ইচ্ছা, দুপুরের পরে দিঘির পাড়ে যাবে। দিনের আলোয় রাহাতকে খুঁজে দেখা যাবে। ‘যদি কেউ সন্দেহ করে’- তুহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রনি। তবে উত্তরটা দিল জিতু, ‘সন্দেহ করবে কেন? এমনিতেই আজ দিঘির পাড়ে অনেক মানুষ। চেয়ারম্যান চাচাও লোকজনকে থাকতে বলেছেন। কৌতুহলি হয়ে যারা ওখানে আছে, তাদের সঙ্গে গেলে কে সন্দেহ করবে?’ মাথা নিচু করে বসেছিল সুজন। জিতুর কথা শেষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘দিঘি ছাড়া আর তো খোঁজার কোন জায়গাও নেই, না? রাহাতকে খুঁজে বের করতে হলে দিঘির পাড়ে তো যেতেই হবে। রাহাতকে খুঁজে বের করতেই হবে। এখনও কেউ বোঝে নি। তবে আমরা যদি রাহাতকে খুঁজে বের করতে না পারি, ভেবে দেখেছিস আন্টির কি হবে?’

চোখ টল টল করছে ওর। রনি কেঁদেই ফেলে। তুহিনও অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি সামলায়। দৃঢ় গলায় জিতু বলে, ‘রাহাতকে খুঁজে পেতেই হবে। না পেলে আমাদের কি হবে ভেবেছিস? সবাই সত্য কাহিনিটা জেনে গেলে...।’ কথাটা শেষ না করেই হাতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে ও। ‘আমাদের তো দোষ নেই। এটা তো ওর নিজের বুদ্ধি ছিল। আর আমরা কি জানতাম নাকি গাছ থেকে দিঘিতে পড়ে যাবে ও?’ একটু দূর থেকেই বলে হাসিব। ওর কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় সবাই। স্বার্থপরের মতো কথা শুনে ক্ষেপে যায় সবাই, দৌঁড়ে গিয়ে হাসিবের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় জিতু। কোমড়ে হাত দিয়ে মারদাঙ্গা ভঙ্গিতে বলে, ‘কি বললি তুই? আরেকবার বল।’ ভেঙে পড়ে হাসিব। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় জিতু। হাসিব কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘এখন কি হবে?’ সবাই বুঝতে পারে রাহাতের জন্য কষ্ট আর ধরা পড়ার ভয় থেকেই উল্টা পাল্টা কথা বলছে সে। কিন্তু যেভাবে কাঁদছে, তাতে তো লোকজন জড়ো হয়ে যাবে। তাই দ্রুত শান্তনা দিয়ে, বকা দিয়ে মাথায় ঘাড়ে হাত বুলিয়ে সবাই মিলে কান্না থামায় ওর। চোখ মুছে আবারও সবাই এসে এক জায়গায় বসে ওরা।

খুঁজতে যাওয়ার প্ল্যান করে। সুজনকে চুপ করে থাকতে দেখে রনি আঙুল দিয়ে খোঁচা দেয়, ‘কি রে, কি ভাবছিস।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুজন বলে, ‘আমি ভাবছিলাম, এখন না গিয়ে বিকালে গেলে ভাল হয়।’ তুহিন জিজ্ঞেস করে, ‘দেরি করে লাভ কি? তারচে এখনই যাই।’ এক মুহুর্ত ভাবে সুজন। তারপর বলে, ‘এখন দিঘির পাড়ে অনেক লোকজন। ছোট ছেলেমেয়েদের যেতে দিচ্ছে কি না কে জানে। সবার মনেই ভয় ছড়িয়ে পড়েছে। তাই দিঘির পাড় দিয়ে আমাদের হাঁটতে দেখলে কেউ হৈ হট্টগোল করতে পারে। এতো ঝামেলার মধ্যেও আমরা যে কোন কাজে গিয়েছি, বুঝতে পারলে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেবে সবাই। ধরা পরার ভয়ও কম না।’ একমত হয় সবাই। তাই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা না বাড়িয়ে দুপুরের পরে সবাই জিতুদের বাড়ি একসাথে হওয়ার কথা বলে উঠে পড়ে সবাই।

 

২৫.

‘কাউকে কোন প্রশ্ন করবি না। দিঘির পাড়ে হাঁটবো ঠিকই, কিন্তু গল্প করতে করতে। আমরা যে কাউকে খুঁজছি, তা যেনো কেউ না বোঝে। বড়রা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তর্ক করবি না, তাহলে আমাদের তাড়িয়ে দিতে পারে। আর যেহেতু আমরা তানিমের বন্ধু, ওদের বাড়ির কাছাকাছি গেলেও কেউ কিছু মনে করবে না। শিমুল গাছের নিচটায় সবাই ঠিকঠাক মতো দেখবি। আর হ্যাঁ, দিঘির কোন পাশই বাদ দেওয়া যাবে না।’- দুপুরের পরে জিতুদের বাড়ি থেকে বেরুবার সময় সবাইকে বলে দেয় সুজন।

সবাই যে যার বাড়িতে গিয়েছিল ঠিকই, তবে দেখে মনে হচ্ছে ইটভাটার ধোঁয়ার মধ্যদিয়ে দৌড়ে এসেছে। ওদের উপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে গেছে। কেউই মনে হয় ঠিকমতো খায় নি পর্যন্ত। এমনকি রনিকে একদিনেই অনেক শুকনা মনে হচ্ছে। দুপুর পার হতে না হতেই সবাই এসে জিতুদের বাড়িতে হাজির। তারপর সবাই রওনা দেয় দিঘির উদ্দেশ্যে।

সুজনের কথার পরে তুহিন যোগ করে, ‘সবাই একসঙ্গে থাকবো। কেউ যেন আলাদা না হয়ে পড়ে।’ কথা বলতে বলতে ওরা পৌঁছে যায় জমিদার বাড়ির কাছাকাছি। ভীড় এখন একটু কম। তবুও বাড়ির সামনে জটলা করে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। দিঘিটা যেন অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশিই রহস্যজনক লাগছে। দিনের বেলাতেও রাক্ষুসে এই দিঘিটা ওদের কাছে সমান ভীতিকর। কারণ এখনও পর্যন্ত রাহাতের কোন হদিস নেই। এই দিঘিতেই শেষ দেখা গেছে ওকে, প্রাণপনে সাঁতরে তীরের দিকে আসছিল ও। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে তানিমদের বাড়ির গেটের কাছে চলে যায় তুহিন, হাসিব, রনি, জিতু আর সুজন। ভয় আর কষ্ট মিলে মিশে ওদের চেহারায় অশুভ একটা ছাপ ফেলেছে। তবে শিমুল তলায় যেতে যেতে কৌতুহলী চোখে যেন ঝিলিক মারে একটু খানি আশা, খুঁজে পাওয়া যাবে রাহাতকে। কিন্তু আবারও হতাশ হয় ওরা। নাহ্, কাল রাতের কোন চিহ্ন নেই। দিঘির শান্ত নিস্তরঙ্গ পানি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই, রাহাত ঠিক কোথায় পড়ে গিয়েছিল। সাঁতড়ে তীরের দিকে আসার সময় দুহাত দিয়ে কচুরিপানা সরিয়েছে রাহাত, দেখে মনেই হচ্ছেনা। শিমুলতলাটাই ভালো ভাবে দেখছে ওরা, যদি কোন কিছু বুঝতে পারে। কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়লনা কারো। উল্টো গেটের কাছের লোকজনের চোখে পড়ে ওরা, লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরা এক মধ্যবয়স্ক মানুষ হেকে ওঠে, ‘হই, তোমরা কি করো এইহানে?’ থতমত খেয়ে যায় ওরা। মিষ্টি হেসে রনি উত্তর দেয়, ‘কিছু না চাচা। আমরা তানিমের বন্ধু। ওদের বাড়িতে এসেছিলাম। এখন চলে যাচ্ছি।’ রনির কথা পুরো না শুনেই সঙ্গের লোকজনের দিকে তাকিয়ে আবারও গল্প শুরু করে সেই মধ্যবয়স্ক মানুষটি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ওরা। সকলে মুখে কৃত্রিম ভদ্রতা ফুটিয়ে লোকগুলোকে উপেক্ষা করেই ধীরে ধীরে রাস্তার পাশ দিয়ে দিঘির পাড়ে হাঁটতে শুরু করে ওরা।

নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে বলতে দিঘির একদম পাশ ঘেষে হাঁটতে থাকে ওরা। গল্পের ছলে হাঁটলেও প্রত্যেকের চোখ ঠিকই দিঘির দিকে। রাস্তা থেকে বামে বাঁক নিয়ে জঙ্গুলে রাস্তায় চলে যায় ওরা। দিঘির এই পাড়ে লোকজন খুব একটা আসে না। কাঁটাঝোপ, বুনো ফুল, বিভিন্ন লতা পাতায় ছেয়ে আছে পথটা। সাপখোপ আর পোকামাকড়ের ভয়ে একটু সাবধানেই হাঁটছে ওরা। একটু বেশি সাবধানে থাকতে গিয়ে একটা ইট পায়ে বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রনি। কেউ ধরে তোলার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে যায় আবার। জিতু রাগী চোখে ওর দিকে তাকালে কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘কিছু হয় নি আমার। চল।’ তবুও রনির হাঁটু পরীক্ষা করে দেখে তুহিন। হাঁটুর কাছে বেশ খানিকটা চামড়া ছড়ে গিয়েছে। ‘এহ্হে, তুই তো হাঁটু ছুলে ফেলেছিস। দেখে হাটবি না।’ তুহিনের কথা শুনে সুজন পাশেই বুনো একটা লতা থেকে কয়েকটা পাতা ছিড়ে নেয়। দুই হাতের তালুতে পাতাগুলো দলামোচা পাকিয়ে ঘষে নেয় সে। তারপর রস বের করে পাতা সহই ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়। মুখটা সামান্য বিকৃত করে রনি। ‘আরে এই পাতার রসে জ্বলুনি হয় না। দেখবি একটু পরে তুই বুঝতেই পারবি না, এখানে ব্যথা পেয়েছিস তুই। রক্ত বেরুলেও এই পাতার রস খুব কাজে দেয় রে।’- সুজনের আশ্বাসবানী পেয়ে রনি উজ্জিবীত হয়ে ওঠে। জিতু বলে ওঠে, ‘কিন্তু এখানে ইট আসলো কোত্থেকে?’ সুজন তখনও পাতার রস চেপে ধরে আছে রনির পায়ে। সেখান থেকেই বলে, ‘মন্দির বানানোর জন্য এনেছিল বোধহয়। চল, এগিয়ে যাই।’ উঠে দাঁড়িয়ে হাটতে শুরু করে সে। একটু সামনে এগিয়ে সবাই বুঝতে পারে, ভাঙা মন্দিরের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। কেমন যেন প্রচ্ছন্ন ভয়ে ছেয়ে যায় মন। হঠাৎ হাসিব দাঁড়িয়ে পড়লে সবাই থেমে যায়। ‘ওদিকে গিয়ে আর লাভ কি? আমরা তো দিঘির আরেক পাড়ে চলে এলাম। শিমুল গাছটা তো দিঘির ওই কোনায়। চল, ফিরে যাই।’- হাসিবের এই কথায় কারোরই বুঝতে দেরি হয়না, ও ভয় পেয়েছে। তুহিন ওকে বোঝায়, ‘দ্যাখ, আমরা তো সবাই একসঙ্গে আছি। ভয় কিসের? আর এখন তো বিকাল। ভয় নেই, চল।’ কিন্তু তবুও নড়েনা হাসিব। রনি একটু ভাব নিয়েই বলে, ‘আমি তো পড়ে গিয়েও পিছিয়ে পড়ি নি। তোদের সঙ্গেই তো আছি। আর রাহাতের জন্য তোর কোন চিন্তা নেই, না?’ হাসিব সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘কে বললো নেই? তবে ও তো শিমুলতলায় পড়ে গিয়েছিল। ও নিশ্চয় ওই পাড়েই উঠেছে। কিন্তু এপাড়ে তো ওকে খোঁজার কোন মানে নেই, না?’ সুজন বোঝাতে আসে ওকে, ‘কোন মানের জন্য তো আমরা রাহাতকে খুঁজছি না। দিঘির চারপাশে দেখি। এর আগে কোনদিন হেঁটেছিস দিঘির পাড়ে? আজ না হয় রাহাতের জন্যই ঘোরা হয়ে গেল দিঘির চারপাশ।আর আমরা এতোজন একসঙ্গে হাঁটছি, ভয়ের তো কিছু নেই।’ আমতা আমতা করে হাসিব বলে, ‘না মানে, মন্দিরের কথা অনেক শুনেছি তো। কাছে যেতে ভয় লাগছে। এই মন্দিরের জন্যই তো কতকিছু হয়ে গেল...।’ ওর দ্বিধাদ্বন্দ দেখে এবার ক্ষেপে যায় জিতু। ‘ধ্যাত্তেরি। তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে ক্লাশ থ্রিতে পড়া বাচ্চা। ভয় লাগে! যা যা বাড়ি যা, এখানে থাকলে ভয় পেয়ে প্যান্ট খারাপ করে ফেলবি। যা, তুই তোর বাড়ি গিয়ে রাহাতকে খোঁজ। যা। আরে, বাদ দে তো হাসিবের হিসাব। তোরা চল তো।’ বলেই জিতু লম্বা লম্বা পা ফেলে মন্দিরের দিকে এগোতে থাকে। জিতুকে বীরদর্পে অনুসরণ করে রনি। তুহিন আর সুজন দোলাচলে, হাসিবকে নিয়েই মন্দিরের কাছে যাওয়ার ইচ্ছা ওদের। কিন্তু হাসিব আগের জায়গা থেকে নড়ছে না। সুজন তাকিয়ে দেখে জিতু পৌঁছে গেছে মন্দিরের কাছে, রনিও জিতুর চেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে শেষবারের মতো হাসিবকে বোঝানোর জন্য ওর দিকে তাকায় সুজন। হঠাৎ ঠিক মন্দিরের সামনে গিয়েই দাঁড়িয়ে যায় জিতু, একবারে মূর্তির মতো অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মন্দিরের ভিতর। 

 

২৬.

রাহাতের জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব, বন্ধুরা ভিতু বলে গালি দিচ্ছে, সত্য ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে কি হবে ভেবে দুশ্চিন্তায় খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে- তবুও ভয়ে নড়তেই পারছে না হাসিব। জন্মের পর থেকেই মন্দির নিয়ে নানা ভয়াবহ কথা শুনেছে। তাই সেই ভয়াল মন্দিরের কাছে যেতে হবে, ভাবতেই পারছিল না সে। হাসিবের করুন মুখের দিকে তাকিয়ে সুজন বলা শুরু করলো, ‘জিতু আর রনি মন্দিরের কাছে চলে গেছে। ওই দ্যাখ-’ বলে আঙুল দিয়ে জিতুদের দেখায় সুজন। কিন্তু মন্দিরের সামনে জিতুকে ওভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌঁড়ে ওর কাছে চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় তুহিনও ছোটে সুজনের পিছনে, রনি গিয়ে পাশে দাঁড়ায় জিতুর। ওখানে পৌঁছে মন্দিরের ভিতর তাকিয়ে সবার চেহারা জিতুর মতোই হয়। সবাই মন্দিরের কাছে চলে গেছে, একা দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় লাগছে হাসিবের। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওদের পিছনে এসে দাঁড়ায় সে, সবার দৃষ্টি অনুসরণ করে মন্দিরের ভিতর তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় ওর। যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। অস্ফুট স্বরে বলে, ‘রাহাত’।

আধভাঙা মন্দিরের মধ্যে শুয়ে আছে রাহাত। ইট, সুরকি আর আগাছার মধ্যে একচিলতে পরিষ্কার জায়গা, আর সেখানেই একটা ইট মাথার নিচে বালিশের মতো করে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে রাহাত। কয়েক মুহুর্ত পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে রাহাতের কাছে চলে যায় সুজন আর তুহিন। দেখাদেখি সবাই গিয়ে রাহাতের চারপাশে ঘিরে বসে। গভীর ঘুমের মধ্যে যেন কোন স্বপ্ন দেখছে ও, ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে আছে। গাঢ় ঘুমে থাকলে মানুষ যেমনভাবে শ্বাস নেয়, সেভাবে টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ও। গায়ে গতরাতের গেঞ্জি আর পাজামা, ধুলা ময়লা লেগে থাকলেও জামাকাপড় একদম শুকনা। দেখে মনেই হচ্ছে না, দিঘির পানিতে পড়ে গিয়েছিল সে। রাহাতের গায়ে আস্তে হাত রাখে সুজন। ডাক দেয়, ‘রাহাত, এই রাহাত’।

সুজনের দেখাদেখি অন্যরাও ধীরে ধীরে ডাকতে থাকে রাহাতকে। হাত দিয়ে আস্তে ধাক্কা দিলে ভ্রু কুঁচকে মুখে একটা শব্দ করে সে, গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে যেমন সবাই যেমন করে। উৎসাহ পেয়ে যায় রনি, সুজন, তুহিন, জিতু আর হাসিব। এক নাগাড়ে ডাকতে থাকে, ‘রাহাত, এই রাহাত। ওঠ। রাহাত।’ বহুদূর থেকে যেন ভেসে আসছে বন্ধুদের কণ্ঠস্বর। ঘুমের জগত থেকে একটু একটু করে বন্ধুদের কাছে ফিরে আসতে থাকে রাহাত। ধীরে ধীরে চোখ খোলে। ঠিক যেনো কেবল মাত্র ঘুম ভাঙলো তার। ঘুম ভাঙা চোখে নির্লিপ্ত ভাবে সবার মুখে চোখ বোলায় সে। তারপর যেন একটু হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। ‘তোরা?’ রাহাতকে উঠে বসতে সাহায্য করে ওরা। বেশ অবাক হয়ে বন্ধুদের দিকে তাকায় সে। সবার চোখে পানি কেন? চারপাশের এতো আগাছা, দেয়াল গুলো ভাঙা কেন? এটা কোন জায়গা? আরে, ওরা কেউ কিছু বলছে না কেন? পাশে বসা তুহিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘আমি এখানে কেন?’

কিছু বোঝার আগেই হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে হাসিব। বাকিরাও যেন এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল। সবাই মিলে জড়িয়ে ধরলো রাহাতকে। হতচকিত হয়ে পড়ে সে, ‘আরে, আরে কি হয়েছে? আমরা কোথায়?’
 

 

২৭.
রাহাতের শরীরটা খুব দুর্বল। সবাই মিলে ধরে ধরে ওকে নিয়ে জিতুর বাসায় ঢোকে সবাই। প্রথমেই রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসে জিতু। দুধটা খেয়ে জামা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে আসে। ততক্ষণে আন্টিকে খাবার দিতে বলেছে জিতু। রাহাতের সঙ্গে সঙ্গে সবার জন্যই খাবার বেড়েছে আন্টি। ছেলেদের এই সময় অসময়ে খাওয়া দাওয়ায় অভ্যস্ত হয় মায়েরা। তবে খেতে বসে জানা যায়, জিতু বলেছে রাহাত বাড়ি থেকে রাগ করে দুপুরে না খেয়ে বেরিয়েছে। আর ওকে খুঁজতে গিয়ে কেউই ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করে নি। রাহাতের কথাটা না হয় মিথ্যা। তবে অন্য সবার খাবার কথা যে হাড়ে হাড়ে সত্য, একেক জনের খাওয়ার বহর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ডিম ভাজি, ডাল আর মুরগির মাংস দিয়ে এতো এতো ভাত খেয়ে নেয় সবাই। একসঙ্গে বসে খাওয়ার যে এতো আনন্দ, আজকের আগে কখনো অনুভব করেনি কেউ।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু সুস্থ হয় রাহাত। জিতুর ঘরে এসে ঢোকে সবাই। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। বালিশে আধশোয়া হয়ে গতরাতের কাহিনি বলা শুরু করে রাহাত, ‘বাঁশের হাতটাকে টেনে বাইরে আনতে গিয়ে হঠাৎ দিঘিতে পড়ে গেলাম। কি বিচ্ছিরি কচুড়িপানা, আর পানির একটু নিচ থেকেই থকথকে কাদা। দিঘির খুব বেশি ভিতরের দিকে তো পড়ি নি, তাই একটু একটু করে পাড়ের দিকে আসতে চাইলাম। সাঁতরাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তানিম আর আরিফের চিৎকার শুনতে পেলাম। মনটা খুশিতে নেচে উঠলো, প্ল্যান তা হলে সাকসেসফুল। অনেক লোকজনের হৈ চৈ আর হাকডাকও শুনতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট। অন্ধকারের মধ্যে তোদের দেখতেও পাচ্ছিলাম আমি। পাড়ের দিকে চলে আসলেই তোরা ধরে তুলে ফেলবি, তাই লোকজন আসার আগেই তাড়াতাড়ি আসতে চাইলাম। কিন্তু যতই চেষ্টা করি না কেন, পারছিলাম না। প্রথমে ভাবলাম, ঘন কচুরিপানার জন্যই আসতে পারছি না। কাদা পানিতে ভেসে থেকে প্রাণপনে তাই দুই হাত দিয়ে কচুরিপানা সরাচ্ছিলাম। কিন্তু একবিন্দু এগোতে পারলাম না। গেটের আলো জ্বলে উঠেছে ততক্ষণে।তোরা তাই লুকিয়ে পড়লি কোথাও। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম, নিচদিক থেকে কেউ টানছে আমায়। না, কোন স্পর্শ টের পাইনি আমি। শুধু টানটা টের পাচ্ছিলাম। চুম্বকের মতো কেউ যেন পানির নিচের দিকে টানছিল। ধীরে ধীরে পানির নিচে তলিয়ে যেতে লাগলাম। হাত পা অবশ হয়ে আসছে, ক্লান্ত লাগছিল খুব। পানির নিচে ডুবে গেল মাথা, শেষ চেষ্টা করার জন্য হাত দিয়ে কচুরিপানা ধরে উঠতে চাচ্ছিলাম।কিন্তু গায়ে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিলনা।শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো, মাথার মধ্যে ধপ ধপ করে আগুন জ্বলতে লাগলো। বিশ্বাস করবি না, ওই সময় কত কি যে মনে পড়লো। মনে হচ্ছিল, আর কোনদিন ফিরে আসতে পারবো না। তারপর আর কিছু মনে নেই রে। তোরা আমায় ভাঙা মন্দির থেকে তুলে নিয়ে এলি।’

সবাই নিশ্চুপ। এ ঘটনা শোনার পরে কিইবা বলা যায়? রাহাতকে পানির নিচে কে টেনে নিলো, দিঘি থেকে উঠলো কেমন করে, শিমুলতলার ঠিক উল্টো পাড়ের মন্দিরে পৌঁছালো কি করে- জানে না কেউ। তবে প্রচলিত লোককাহিনি যে একেবারে মিথ্যা নয়, বুঝতে পারছিল ওরা। কি হয়েছে আর কি হতে পারতো, ভেবেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে এখনও। গা ঘেষাঘেষি করে বসেও কেমন যেন অজানা এক ভয়ের আবেশ ছড়িয়ে আছে সবার মধ্যে। রাহাতই একমাত্র নির্লিপ্ত। বালিশে আধশোয়া অবস্থায় ছাদের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। কি ভাবছে, কে জানে। তবে মুখটা বিষন্ন, চোখ দুটোও টল টল করছে। হঠাৎ বললো, ‘জানিস, আমার না আবছা আবছা স্বপ্নের মতো কিছু জিনিস মনে পড়ছে।’ এ কথায় আবারও রাহাতের দিকে মনোযোগ দেয় সবাই। ‘আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল মরে যাচ্ছি। ভয়ও হচ্ছিল খুব। হঠাৎ খুব শীত লাগে। প্রচন্ড শীত। হঠাৎ তখনই, কে যেনো আমায় কোলে তুলে নেয় বাচ্চাদের মতো করে। আদর করে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে দেয় আমায়। শীতটা একদম কমে যায়। খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিলো আমার আর কোন কষ্ট, দুঃখ কিংবা ভয় নেই।মায়ের কোলে যেমন বাচ্চারা ঘুমায়, তিনিও আমায় খুব আদর করে ঘুম পাড়াচ্ছিল।’

সবাই যেনো একটু জড়োসড়ো হয়ে বসে। রাহাতের কথা অবিশ্বাস করার মতো মনের অবস্থা কারো নেই। কিন্তু এটা যে রাহাতের স্বপ্ন নয়, তা কেমন করে যেনো সবাই বুঝে যায়। রাহাতকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ কিংবা অলৌকিক শক্তির ভয় নয়, সবার মুখে হঠাৎ বিষাদ ভর করে। এক অশরীরি মায়ের জন্য কষ্ট হয় সবার, কষ্ট হয় সকল মায়ের জন্য। অতৃপ্ত সেই মায়ের আত্মার জন্য ভিজে ওঠে মন, গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে কান্না। রাহাতের দুচোখ ভর্তি পানি দেখে চোখ ভিজে যায় বন্ধুদের। চোখভরা পানি নিয়ে ভেজা গলায় রাহাত বলে, ‘মা তো মা। কোন মা কি পেত্মী হতে পারে?’ পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে ওদের বুক।

 

২৮.

ছুটি শেষে স্কুল শুরু হয়ে গেছে। তানিম আর আগের মতো দাপট নিয়ে থাকে না। বরং ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে চলে। অন্য সবার মতো ওরাও তানিমের কাছে সেই রাতের কথা জানতে চায়।তানিম আগড়ুম বাগড়ুম অনেক কিছুই বলে। পেত্মীর সঙ্গে তার সাহসিক যুদ্ধের কথা, পেত্মীটার শাস্তির কথা, পেত্মীটার শর্তের কথা বলে প্রতিদিনই গল্পের শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। গল্প শুনে ওরা সবাই হাসে। তবে একটা জিনিস ভালো হয়েছে, তানিমের বাবা দিঘিটা পরিষ্কার করে ফেলেছেন। ভাঙাচোরা ঘাটগুলোও নতুন করে বাঁধানো হয়েছে। আজকাল অনেকেই দিঘিতে গোসল করে, পানি নেয়। দিঘির চারপাশে ছোটখাট দোকানও হয়েছে, সবসময় লোকজনের আনাগোনা চলছেই। ভাঙা মন্দিরেই পুজা শুরু করেছে এক ব্রাহ্মণ। দিঘির পাড়ে ঘুরতে যেতে আর কেউ বারণ করে না। তানিমদের বাসার ছাঁদেও কাটানো যায় দুরন্ত সময়। ভয়হীন অবাধ সময় কেটে যায় সবার।
কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে বড় ক্লাসের ছেলেরা এসে ওদের যন্ত্রণা দেয়। আর রাহাত মাথায় হাত দিয়ে কি যেন ভাবে। আর প্রতিবার চিন্তায় পড়ে যায় সুজন, তুহিন, জিতু, রনি, আর হাসিব। কি জানি, ওদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আবার নতুন কি পরিকল্পনা করে বসে দুষ্টের শিরোমনি রাহাত।