বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি এই পৃথিবী। আর তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর জটিল রহস্যময় সৃষ্টি হচ্ছে মানবদেহ। বিজ্ঞান ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়েছে বহুদুর,কিন্তু আজও মানুষের শরীরকে পুরোপুরি আবিস্কার করতে সক্ষম হয়নি। তারপরেও যতটুকু জানতে পেরেছে,সেটা বুঝতে পারলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় যে কি অসীম নিপুণতার সাথে সৃষ্টি করা হয়েছে এই মানবদেহকে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙয়ের অভাবনীয় সাফল্যের হাত ধরে আজ দেহের অনু পরমানু কনাগুলো পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের হাতের মুঠোর মধ্যে। এর মধ্যে অন্যতম রহস্যে ভরা আগ্রহের বিষয়টি হচ্ছে ডিএনএ বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড।
আমরা অনেকেই সমুদ্র সৈকতে গিয়ে বালু দিয়ে অনেক কিছু তৈরী করি। বালু দিয়ে তৈরী করা একটা ঘর কিংবা অন্য কিছুতে থাকে কোটি কোটি বালুকণা যা গুনে শেষ করা অসম্ভব। আমাদের দেহটাও তেমনি বালুকণার চেয়েও অনেক ক্ষুদ্র অগণিত কোষ দিয়ে তৈরী। কোষের মধ্যে থাকা পদার্থ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। সাইটোপ্লাজম ও তার মধ্যে ভাসমান অন্যান্য অঙ্গানু। আর মাঝখানে আছে নিউক্লিয়াস তথা কোষের মস্তিস্ক। এই নিউক্লিয়াসে টেপের মত প্যাঁচানো থাকে ডিএনএ। এটিকে সোজা করা হলে তা এক মিটার লম্বা হবে।

মানবদেহে যত কোষ আছে,সবগুলোর নিউক্লিয়াসে আছে একটি করে ডিএনএ। প্রত্যেকটি একটি অপরটির কার্বনকপি। মানবদেহে ডিএনএ সাত লক্ষ ধরনের কাজ করে থাকে। একটি ডিএনএতে যে পরিমান তথ্য আছে,তা লিপিবদ্ধ করাহলে এক হাজার খন্ড বিশ্বকোষের সমান হবে। ডিএনএ দেখতে অনেকটা প্যাঁচানো সিড়ির মত। সিড়ি না বলে মই বললে আরও ভাল হয়। মইয়ের দুই পাশের লম্বা অংশটিকে ডাবল হেলিক্স বলা হয়। আর মাঝখানের ধাপগুলোতে সমস্ত তথ্য বিদ্যমান থাকে। যা কিনা জেনেটিক কোড হয়ে লেখা আছে। সুনির্ধারিত কোডের জন্যই মানুষ সর্বদা মানুষ হয়েই জন্ম নেয়, অন্য প্রানী বা গাছ হয়ে নয়। অন্যান্য সমস্ত প্রাণী আর গাছপালা সবারই আছে ভিন্ন ধরনের ডিএনএ।
মাতৃগর্ভে একটি ডিম্ব ও একটি শুক্রকীটের মিলনের পর দুটি ডিএনএ মিলে সৃষ্টি হয় নতুন ডিএনএ। এই নতুন ডিএনএ তে কোড করা আছে কিভাবে ক্রমান্বয়ে একটি মানব শিশু জন্মলাভ করবে। একটি কোষ থেকে ক্রমে ক্রমে ৫০ থেকে ৭০ ট্রিলিয়ন কোষ সাজিয়ে পুরো মানবদেহ তৈরী করা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এমনকি ব্রেনের মত জটিল অঙ্গও তৈরী করেছে ডিএনএ কোডিং। শুধু তৈরী করা নয়, মৃত্যু পর্যন্ত মানবদেহের সমস্ত কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে,তাও সব ডিএনএ কোডে লেখা আছে। দেহের প্রতিটি অঙ্গ যেমন ফুসফুস, লিভার, হার্ট,কিডনী ব্রেন ইত্যাদি কিভাবে তাদের জটিল কার্যকলাপ চালিয়ে যাবে তা সবই লেখা আছে ডিএনএ তে। কিভাবে হার্ট রক্ত পাম্প করে, কিভবে ফুসফুসে অক্সিজেন কণাপ্রবেশ করে হিমোগ্লোবিনেরসাথে যুক্ত হয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে,কিভাবে দেহের কোষগুলো বদলে যায়,কিভাবে মস্তিষ্কের কোষ নিউরন থেকে তথ্য নিয়ে নিউরোট্রান্সমিটার ২২৫ মাইল গতিতে সারা দেহে ভ্রমন করে। এভাবে দেহের লক্ষ লক্ষ কার্যাদি অনায়াসে সম্পন্ন হয় একমাত্র ডিএনএ কোডের তথ্য অনুযায়ী।
মানুষ ডিএনএ আবিষ্কার করেছে,কিন্তু ডিএনএন এর যে তথ্য ভান্ডার,সেটাকে এখনও পুরোপুরি করায়ত্ত করতে পারেনি। তবে সে ভান্ডারও যে একসময় আমাদের সামনে সম্পুর্ন উন্মুক্ত হয়ে যাবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তখন আমরা জানতে পারব সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানব দেহ বিবর্তনের নানা ধারা,যা আমাদের অজানা ছিল।