ছবি সংগৃহীত

মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ও সৃষ্টি

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০১৬, ১৭:০২
আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০১৬, ১৭:০২

গ্রাফিক্স : আকরাম হোসেন।

(প্রিয়.কম) বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এ বছরের এ মাসেই সনেটের দেড়শ’ বছর পূর্তি হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে প্রিয়.কম বিশেষ আয়োজন করেছে। তারই অংশ হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ও কর্ম নিয়ে থাকছে প্রাথমিক আলোচনা। লিখেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ।

জন্ম ও শৈশব

মধুসূদন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত সেকালের রীতি অনুযায়ী ফারসি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিলেন। কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতের ব্যবহারজীবীরূপে তিনি প্রভূত প্রতিষ্ঠা ও অর্থ উপার্জন করেছিলেন। খিদিরপুরের বড় রাস্তার উপরে একটি দোতলা বাড়ি কিনে যখন তিনি কলকাতায় পরিবারবর্গ নিয়ে এলেন, কবির বয়স তখন সাত বৎসর।

গ্রামে মাতা জাহ্নবী দেবীর তত্ত্বাবধানে তাঁর শৈশবশিক্ষা শুরু হয়েছিল। রামায়ণ-মহাভারতের প্রতি আকর্ষণের বীজ সম্ভবত এই সূত্রেই তাঁর মনের কোণে উপ্ত হয়। তিনি ফারসি ভাষায়ও কতকটা জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
   
হিন্দু কলেজে

কলকাতায় এসে কবি হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেন। ইংরেজি তথা ইউরোপীয় সাহিত্যরস ও বিচিত্র মানববিদ্যা যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নব্য বাংলার অন্তরে প্রবেশ করেছিল, হিন্দু কলেজের স্থান তাদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নূতন মানবমন্ত্রে বিশ্বাস, পাশ্চাত্য জীবনতন্ত্রে আসক্তি, গভীর ইংরেজি সাহিত্যপ্রীতি, দেশীয় আচার ও ভাবনার প্রতি অশ্রদ্ধা- সব বিষয়ে বিদ্রোহী মনোভাব হিন্দু কলেজের শিক্ষার সাধারণ ফল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মধুসূদনের ব্যক্তিচরিত্র এবং শিল্পীপ্রাণের গঠনে হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের পর্ব অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল।

হিন্দু কলেজে ছাত্র হিসেবে কলকাতার সর্বোৎকৃষ্ট স্তরটি এসে সমবেত হত। তাদের মধ্যেও মধুসূদনের ঔজ্জ্বল্য সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। পোশাক-পরিচ্ছদ-বিলাস-ব্যসনে, বাকপটুতায়, বুদ্ধির দীপ্তিতে তিনি বন্ধুদের কেন্দ্রে আসন পেতেছিলেন। এবং ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, ভোলানাথ চন্দ্র, বঙ্কুবিহারী দত্তের ন্যায় ব্যক্তিরা (পরবর্তী জীবনে এঁরা সবাই অল্পাধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন) ছিলেন কবির সহপাঠী। কখনো ফারসি গজল গান গেয়ে, কোনোদিন সাহেব-নাপিতের দোকানে চুল কাটিয়ে, কখনো মুহুর্মুহু শেক্সপিয়র-বায়রন আবৃত্তি করে তিনি বন্ধুদের চমকে দিতেন। আবার এর সঙ্গে ছিল কোনো কোনো শিক্ষকের প্রতি সরব অশ্রদ্ধা, মদ্যপান, অমিতব্যয়িতা, পিতার সঙ্গে একই আলবোলায় ধূমপান এমনই আরও বিচিত্র সব আচরণ।

কলেজের পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি পেতেন। ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন, ছাপার হরফে তা প্রকাশিত হত। বিখ্যাত বিলিতি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কবিতা পাঠাতে তাঁর কুণ্ঠা ছিল না। ওয়ার্ডসওয়ার্থকে কবিতা উৎসর্গ করতেও। আবার এরই মধ্যে নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে পেলেন প্রথম পুরস্কার, একটি স্বর্ণপদক। একদিন হঠাৎ ধুতি ছেড়ে আচকান-পায়জামা ধরলেন, তারপরে সোজা সাহেবি প্যান্ট-কোট। এক কথায় সকলের কাছে মধু একটি বিস্ময়, একটি প্রতিভা। প্রথম তারুণ্যের কবিতাগুলি নিয়ে তাঁর গর্বের অন্ত ছিল না, ভবিষ্যতে তিনি বিখ্যাত কবি হবেন, গৌরদাস তাঁর জীবনী রচনা করবেন এরূপ আশা বহু চিঠিতেই তিনি ব্যক্ত করেছেন। এবং বিলেত গেলেই বড় কবি হতে আর কোনো বাধাই থাকবে না, এরূপ একটি অদ্ভুত ধারণা কোনো অজ্ঞাত কারণে তাঁর মনে দানা বেঁধেছিল।

ইংল্যান্ডে যাওয়া মধুসূদনের তরুণচিত্তে কতবড় প্রবল ভাবাবেগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ওই সময়ে লেখা একাধিক কবিতা ও চিঠিতে তার প্রমাণ আছে। অবশেষে ১৮৪২ সালে, যখন তিনি সিনিয়র ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র, তাঁর জীবনে এল এক গুরুতর পরিবর্তন।
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ

মধুসূদন হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হলেন। শোনা গেল তিনি খ্রিস্টান হবেন। প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি রাজনারায়ণ লাঠিয়াল সংগ্রহ করে পুত্রকে ধর্মান্তর-গ্রহণে বাধা দেবেন এই অজুহাতে মধুসূদনকে ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে আশ্রয় দেওয়া হল। ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-এ ওল্ড মিশন চার্চে আর্চডিকন ডিয়াল্ট্রি তাঁকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করলেন। মধুসূদন নিজের লেখা Hymn গান করলেন "Long sunk in superstition's night..."। তাঁর নূতন পরিচয় হল মাইকেল।

মধুসূদন হঠাৎ কেন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন তা একটি গুরুতর সমস্যার ব্যাপার। খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকর্ষণ বশে যে করেননি তা নিশ্চিত। উল্লিখিত Hymn-টি সাক্ষ্য হিসেবে মূল্যহীন। বরং যার কাছে তিনি ধর্মান্তরের বাসনা প্রথম প্রকাশ করেছিলেন সেই রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের কিছু মূল্য আছে।

মধুসূদনের ইংল্যান্ড গমনের বাসনা কী পরিমাণ প্রবল ও প্রগলভ হয়ে উঠেছিল তার পরিচয় আগেই পেয়েছি। বিশেষ করে নব্যতন্ত্রের প্রতি গভীর অনুরাগ হিন্দুধর্মসংক্রান্ত কোনো সংস্কারকেই তাঁর মনের মধ্যে দৃঢ় হয়ে উঠতে দেয়নি।

আরও একটি গুরুতর কারণ ছিল। কবির খ্রিস্টান হবার কিছুদিন আগে একটি গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা উঠেছিল। কবির তা মোটেই পছন্দ ছিল না। তা থেকে উদ্ধারের একটি সহজ উপায় খুঁজে পেলেন ধর্মান্তর গ্রহণের মধ্যে।

তা ছাড়া রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেবকী নাম্নী রূপবতী বিদুষী দ্বিতীয়া কন্যার সঙ্গে মধুসূদনের প্রেম-সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এমন সংবাদ পাওয়া যায়। গৌরদাস বসাক তাঁর স্মৃতিকথায় খুব স্পষ্ট করে না লিখলেও এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত করেছেন। মধুসূদনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের প্ররোচনাকে দায়ি করেছেন। নিজের পছন্দমতো শিক্ষিতা তরুণীর পাণিগ্রহণের বাসনা কবির ছিল।
বিশপ্স কলেজে

খ্রিস্টান ছাত্রদের হিন্দু কলেজে পড়বার অধিকার ছিল না। মধুসূদনকে হিন্দু কলেজ ছাড়তে হলো। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের প্রায় দুই বছর পরে তিনি শিবপুরে বিশপ্স কলেজে ভর্তি হলেন। ধর্মান্তরিত পুত্রের পড়ার খরচ দিতেন রাজানারায়ণ। বন্ধুদের সঙ্গে তখনও কবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সমকালে লেখা চিঠিগুলি পড়ে তা জানা যায়। বিশপ্স কলেজের সাধারণ বিভাগের ছাত্র হিসেবে তিনি গ্রিক, লাতিন এবং হিব্রু ভাষা শেখার সুযোগ পেলেন এখানে।

ইংল্যান্ড থেকে আগত বহুভাষাবিদ বিশপ পণ্ডিতদের কাছ থেকে প্রাচীন ভাষা শিক্ষা মধুসূদনের জীবনের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মধুসূদন ভবিষ্যতে বহুভাষাবিদ রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। তার বীজবপন হল বিশপ্স কলেজে। তার চেয়েও বড় কথাক্রমে মধুসূদনের মনের গভীরে যে ক্লাসিক রুচি, জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনা গড়ে উঠেছিল তার ভিত্তি স্থাপিত হল এই ভাষাশিক্ষায়। অবশ্য কবি সে সম্বন্ধে সচেতন হয়েছিলেন অনেক পরবর্তী কালে।
 

বিশপ্স কলেজে ইউরোপীয় ছাত্রদের সঙ্গে ভারতীয় ছাত্রদের সহবাসের ফলে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হত। কর্তৃপক্ষের অগণতান্ত্রিক আচরণ মধুসূদনকে বিক্ষুব্ধ করে তুলল। খাবার টেবিলে গ্লাস ভেঙে ফেলে আহার্যবিষয়ে বৈষম্য এবং নানারঙের পোশাক পরে পরিচ্ছদসংক্রান্ত বিধিনিষেধের তীব্র প্রতিবাদ করে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ বিধানের বৈষম্য দূর করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

কয়েক বছর বিশপ্স কলেজে কাটিয়ে ১৮৪৮-এর গোড়ার দিকে তিনি হঠাৎ মাদ্রাজ চলে গেলেন। কাউকে কোনো খবর দিলেন না।

অকস্মাৎ কবির এই মাদ্রাজ যাবার কারণ ঠিক করে বলা কঠিন। তবে কয়েকটি ঘটনার কথা এ প্রসঙ্গে মনে আসে।

রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর পড়ার খরচ হঠাৎ বন্ধ করে দিলেন। পিতার বিরক্তির কারণ জানা যায়নি। কিন্তু এর ফলে বিশপ্স কলেজ থেকে তাঁকে চলে যাবার ব্যবস্থা করতে হলো। তিনি একটি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হল। ইংল্যান্ডে যাবার সম্ভাবনা আগেই বিনষ্ট হয়েছিল। মধু পিতার বিরাগভাজন হওয়ায় পরিচিত সকলে ভয় পেলেন, রাজনারায়ণ পুত্রকে উত্তরাধিকারচ্যুত করবেন। মধুসূদনের মতো লোকের পক্ষে সবদিকের এই পরাজয়ের লজ্জা বহন করে কলকাতায় পরিচিত সমাজে বাস করা সম্ভব হল না। তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসন বরণ করলেন মাদ্রাজে।
   
মাদ্রাজে

১৮৪৮ সালের প্রারম্ভে সহায়সম্বলহীন মধুসূদন সম্পূর্ণ অপরিচিত মাদ্রাজ নগরে উপস্থিত হলেন। তিনি দেশীয় খ্রিস্টান এবং এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের কৃপায় প্রথমে একটি আশ্রয় এবং অবশেষে একটি চাকরি পেলেন। ‘মাদ্রাজ মেল অরফ্যান এসাইলাম’ নামক বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষকের পদ।

মধুসূদন মাদ্রাজে সাত বৎসর ছিলেন। শিক্ষক, সাংবাদিক এবং কবি হিসেবে তিনি সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। মাদ্রাজপ্রবাসে তাঁর দাম্পত্য জীবনের দিক দিয়েও গুরুতর আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল।

১৮৪৮ থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন উক্ত অনাথ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১৮৫২ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বিদ্যালয় বিভাগের দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেকালে এই সরকারি পদটি সম্মান ও যোগ্যতার চিহ্নবাহী ছিল। অল্পকালের মধ্যে মধুসূদন আপন পান্ডিত্যের সুনিশ্চিত পরিচয় দিয়েছিলেন মাদ্রাজের শিক্ষাবিদদের কাছে।

সাংবাদিক ও কবি হিসেবে ইংরেজি-জানা সমাজে মধুসূদনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এক সময়ে 'Athenaeum'-এর সম্পাদকও ছিলেন। 'Hindu Chronicle'  নামক একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদকও ছিলেন মধুসূদন।

এইসব পত্রপত্রিকায় মধুসূদনের যেসব রচনা প্রকাশিত হত তাদের ভাষায় ওজস্বিতা ও স্বাধীন তীক্ষ্ম মনোভাবের ছাপ গুণগ্রাহীদের দৃষ্টি এড়াত না। কলকাতার ‘হরকরা’ প্রভৃতি পত্রিকায় কোনো কোনো রচনা পুনমুদ্রিত হয়েছিল।

প্রবন্ধাদি ছাড়াও মধুসূদন সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠায় নিয়মিত কবিতা লিখতে লাগলেন। বিশেষ করে 'Madras Circulator and General Chronicle' নামক পত্রিকায় Timothy Penpoem এই ছদ্মনামে তাঁর অনেকগুলি গীতিকবিতা, সনেট, খন্ডকাব্য প্রকাশিত হয়েছিল। Visions of the Past  এবং The Captive Ladie-এই দুটি কবিতা একসঙ্গে প্রকাশিত হল। এটিই পুস্তকাকারে কবির রচনার প্রথম প্রকাশ।

মাদ্রাজে মধুসূদন একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেটিও "The Anglo-Saxon and the Hindu" নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘রিজিয়া’ নামে ইংরেজি অমিত্রাক্ষর ছন্দে একটি নাটকও কবি লিখেছিলেন। ‘ইউরেশিয়ান’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়।
‘ক্যাপটিভ লেডি’ গ্রন্থটি মাদ্রাজে প্রশংসিত হলেও কলকাতায় বিশেষ সমাদৃত হল না।

গৌরদাসও বন্ধুকে বাংলা কাব্য রচনায় উৎসাহিত করছিলেন। কিন্তু দূর প্রবাসে কবির মনে মাতৃভাষার প্রতি সুপ্ত আকর্ষণ দানা বাঁধছিল। বেথুনের পরামর্শের পূর্বেই গৌরদাসের কাছে শ্রীরামপুর সংস্করণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত চেয়ে পাঠিয়েছিলেন তিনি। বাংলা ভাষা ভুলতেই তো চাইতেন এক কালে; না ভোলার এই সাধনা কেন? মাদ্রাজে-গৃহে, কর্মস্থলে, সমাজে-কোথাও বাংলা কথার স্থান ছিল না। সাহিত্যপাঠ-বিশ্বের বহু শ্রেষ্ঠ ভাষার; সাহিত্যরচনা-তাও ইংরেজিতে। এ প্রায় বৈদবাণীর মতো। বিশ্বভাষার এই চর্চা কোনোদিন বাংলা সাহিত্য-সৃষ্টিতে নিয়োজিত হবে এ ধারণা তাঁর মনে কী করে এল? অজানিতভাবেই কি কবির মনের গভীরে নূতন মহাদেশ সৃজিত হচ্ছিল?

অন্তত ইংরেজি কাব্যরচনায় ও প্রকাশনায় কবির উৎসাহ অনেকটা কমে গিয়েছিল একথা বলা যায়। ‘ক্যাপটিভ লেডি’র পরে আর কোনো কাব্যগ্রন্থ মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয়নি-এ ঘটনা লক্ষ করবার মতো।
   
মাদ্রাজে কবির পারিবারিক জীবনে এই পর্বে উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনা ঘটেছিল। মাদ্রাজ গমনের তিন বছর পরে তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে। তিনি একবার কলকাতায় এসে শুধু পিতার সঙ্গে দেখা করে মাদ্রাজে ফিরে যান। কেন তা জানা যায়নি। কিন্তু সবচেয়ে আলোড়ন-সৃষ্টিকারী ব্যাপার দেখা দিল তাঁর বিয়েকে কেন্দ্র করে। মাদ্রাজ গমনের অল্প দিন পরে তিনি অরফ্যান এসাইলামের বালিকা বিভাগের ছাত্রী রেবেকা ম্যাক্টাভিসকে বিয়ে করেন।

মধুসূদন-রেবেকার দাম্পত্যজীবনে শান্তি কী পরিমাণ ছিল বলা কঠিন। তাঁর চিঠিপত্রে কোনো সিদ্ধান্ত করার মতো প্রমাণ বা ইঙ্গিত মেলে না। কিন্তু কবি তৃপ্ত ছিলেন না। কবির অন্তর শান্তির একটি আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছিল হয়তো নিজের অজ্ঞাতসারেই। হেনরিয়েটার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কবি তাঁকে পেতে চাইলেন। প্রাপ্তি, অতৃপ্তি এবং কামনা তাঁকে প্রবল উত্তেজনা ও শৃঙ্খলাহীন চাঞ্চল্যে প্রতিনিয়ত তরঙ্গিত করতে লাগল। মধুসূদনের সঙ্গে হেনরিয়েটার আইনত ও ধর্মসঙ্গত বিবাহ হয়েছিল কি না এ বিষয়ে ড. রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত স্পষ্ট করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নূতন কথা শোনাতে চেয়েছেন। রেবেকার সঙ্গে কবির নিয়মমতো বিবাহবিচ্ছেদ যেমন ঘটেনি তেমনি হেনরিয়েটার সঙ্গেও কবির আইনানুমোদিত বা ধর্মানুমোদিত বিবাহ সম্পন্ন হয়নি। তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। ২৭ ডিসেম্বর কবি কলকাতা ফিরে আসবার সংকল্প করেছিলেন। পিতার মৃত্যুসংবাদ, জ্ঞাতিদের কাছ থেকে সম্পত্তি উদ্ধারের বাসনা, গৌরদাসের আমন্ত্রণ এর অন্যতম কারণ হতে পারে। কিন্তু মূল কারণ কবির দাম্পত্যজীবনের সমস্যা। মাত্র এক মাসের মধ্যে রেবেকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে এবং হেনরিয়েটার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে আইনসম্মত বিবাহবিচ্ছেদ এবং নূতন বিবাহ হওয়া সম্ভব নয়। কলকাতায় আসার সময়ে তিনি ‘মিঃ হোল্ট’ এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন কেন তাও ভাববার মতো।
   
কবি মাদ্রাজ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘুচল সেই অজ্ঞাতবাস যেখানে নিজে জেনে এবং না জেনে ভবিষ্যৎ কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন; কবির ব্যক্তিগত প্রেমজীবনেরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই পর্বে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত হল।
কলকাতার সৃষ্টি-মহোৎসব। ১৮৫৬ সালে কবি কলকাতায় ফিরে এলেন। কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় সূচিত হল। প্রথমে বিশপ্স কলেজে এসে উঠলেন। পরে বন্ধুদের চেষ্টায় পুলিশকোর্টে একটি কেরানির পদ পেলেন। কিছুকাল পরে তিনি দ্বিভাষিকের পদে উন্নীত হলেন।

কলকাতায় চাকরিজীবনের এই গ্লানি কবির অভিমানী অন্তরকে বিদ্ধ করেছিল। তবে সাহিত্যসৃষ্টির মহোৎসবে মেতে সাত বৎসর কবি আপনাকে সংযত রেখেছিলেন।
সাহিত্যসৃষ্টি ছাড়াও তিনি সংবাদপত্র-সাময়িকপত্রে প্রবন্ধাদি লিখে অর্থোপার্জন করতেন। ১৮৬২ সালে কিছুদিন 'Hindo Patriot' পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

মধুসূদনের জীবনে এই পর্ব সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল। সাহিত্যসৃষ্টির অতন্দ্র তপস্যায় তাঁর সর্বশক্তি নিয়োজিত। অপরাপর ঘটনা তাই যেমন বাহুল্যবর্জিত তেমনি অনুল্লেখ্য।
রত্মাবলী নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে কবির সঙ্গে ১৮৫৮ সালে বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চের ঘনিষ্ঠতা। তারপর একে একে শর্মিষ্ঠা, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী প্রভৃতি নাটক ও প্রহসন রচনা। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে বিতর্কের উত্তরে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য প্রণয়ন। তারপরে ব্রজাঙ্গনা, মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনার সৃষ্টি। এ ছাড়া শর্মিষ্ঠা এবং দীনবন্ধুকৃত নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলা ভুলে-যাওয়া, কোটপ্যান্টলুনপরা মাইকেল বাংলা সাহিত্যের নবজন্ম ঘটালেন, গোটা দেশের চিত্তপদ্মের মধু হয়ে উঠলেন মধুসূদন। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিকে কেন্দ্র করে প্রবল ভাবান্দোলনের সৃষ্টি হল এদেশীয় বুদ্ধিজীবী মহলে। সংশয়বাদী এবং সমালোচক হয়তো অনেকেই ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জাতির মূল ভাবনাটি বাণীরূপ পেল কালীপ্রসন্ন সিংহ আয়োজিত কবি-সম্বর্ধনায়।

মধুসূদন জ্ঞাতিশত্রুদের বিরুদ্ধে মামলায় জিতে পিতৃসম্পত্তি উদ্ধার করলেন ১৮৬০ সালে। অবশেষে বিষয়সম্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে, আর্থিক সমস্যার একটা সমাধান করে ব্যারিস্টারি পড়বার উদ্দেশ্যে ইউরোপযাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। খিদিরপুরের বাড়ি তিনি সাত হাজার টাকায় বিক্রয় করলেন কবি রঙ্গলালের ভাই হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সুন্দরবনের ভূসম্পত্তি মহাদেব চট্রোপাধ্যায়ের স্ত্রী মোক্ষদা দেবীকে পত্তনী দিলেন। চুক্তি হল, তাঁরা চার দফায় মোট প্রায় তিন হাজার টাকা ইউরোপ পাঠাবেন। এবং কবির স্ত্রী-পুত্রকে কলকাতায় মাসিক দেড় শত টাকা হিসেবে দেবেন। এই চুক্তির প্রতিভূ ছিলেন বিখ্যাত রাজা দিগম্বর মিত্র এবং কবির পিসতুতো ভাই বৈদ্যনাথ মিত্র।

আর্থিক ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা করেই কবি ইউরোপ চললেন ৯ জুন, ১৮৬২ সালে ‘ক্যান্ডিয়া’ জাহাজে করে। য়ুরোপ গমনের ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলে কবির মনোলোকের কিছু নিগূঢ় তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি পড়বে। ইউরোপ ভ্রমণের ইচ্ছা কৈশোর থেকেই কবির কাছে একটা অপ্রতিরোধ্য ভাবাবেগের প্রবলতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। তখন তাঁর ধারণা ছিল ইংল্যান্ড গেলেই তিনি বড় কবি হতে পারবেন। বড় কবি তিনি হয়েছেন-দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, কিন্তু ইংল্যান্ড যাওয়া এখনও হয়নি। বরং কাব্যসৃষ্টিতে পরিপূর্ণভাবে নিমগ্ন থাকার কালে ইংল্যান্ড গমনের বাসনা তাঁকে বিশেষ বিচলিত করতে পারেনি। মহৎ কবির সৃষ্টিকালীন সংযম তাঁকে অন্য সর্ববিধ কামনার অতিরেক থেকে নিবৃত্ত করে এসেছে। কিন্তু বীরাঙ্গনা কাব্য শেষ করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে "The fit has passed away". বীরাঙ্গনার কয়েকটি পত্র তিনি আরম্ভ করেও শেষ করতে পারেননি। উপাদান সংকলন এবং পরিকল্পনা রচনা করেও নূতন মহাকাব্য ‘সিংহল-বিজয়’-এর কয়েকটি চরণমাত্র লিখে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। অন্তরের গভীরে তিনি সুনিশ্চিতভাবে অনুভব করেছেন কাব্যজগত থেকে এবার অবশ্য-বিদায়ের পালা। সৃষ্টিকালীন সেই সংযম বিচলিত হয়েছে। কাব্যের কল্পলোক থেকে বাস্তব পৃথিবীতে পা দিয়ে দোভাষীর সামান্যপদ তাঁকে পীড়িত করতে লাগল। মানুষ মধুসূদনের পক্ষে কিশোরীচাঁদের অধীন চাকরি নিশ্চয়ই অবমাননাকর মনে হয়েছে। যেখানে তিনি কবি সেখানে আকাশে উঠেছে তাঁর মাথা। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, পাইকপাড়ার রাজা, দিগম্বর মিত্রের সহায়তা লাভে, আর্থিক আনুকূল্যে যেন তাঁর স্বাভাবিক অধিকার। কিন্তু সেই ধ্যানলোক ভেঙে যাওয়ার ব্যক্তি মধুসূদনের নিজেকে অপরের কৃপাপ্রার্থী বলে মনে হল। তিনি বিলেত যাবেন, আবাল্যের কামনা চরিতার্থ করবেন, তিনি ব্যারিস্টার হবেন- সামান্য চাকরির অপমান থেকে ঊর্ধ্বে উঠবেন ঠিক করে ফেললেন। আর্থিক সংস্থানও একরকম হয়ে গেল।
   
ইউরোপ-প্রবাসে

মধুসূদন ১৮৬২ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে ইংল্যান্ড পৌঁছে ব্যারিস্টারি শিখবার জন্য ‘গ্রেজ-ইন’-এ যোগ দিলেন। প্রথম কিছুকাল সবই পূর্ব ব্যবস্থা মতো চলছিল। কিন্তু পত্তনিদার মহদেব চট্রোপাধ্যায় চুক্তির খেলাপ করায় সব পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। কিছুকাল টাকা না পেয়ে হেনরিয়েটা কোনোক্রমে পাথেয় সংগ্রহ করে ইউরোপ রওনা হলেন, মধুসূদনের কাছেও মহাদেব টাকা পাঠানো বন্ধ করেছিলেন। এই অবস্থায় ১৮৬৩ সালের ২ মে হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যাসহ ইংল্যান্ড পৌঁছোলেন। অর্থাভাবে মধুসূদন চরম বিপদে পড়লেন। প্রতিভূ দিগম্বর মিত্র ও বৈদ্যনাথ মিত্রকে অনেকগুলি চিঠি লিখেও কোনো ফল পাওয়া গেল না।

১৮৬৩ সালের মধ্যভাগে তিনি সপরিবারে ফ্রান্সে গেলেন। প্রথমে প্যারিসে এবং পরে ভার্সাই শহরে বাস করতে লাগলেন। প্রায় বৎসরকাল কলকাতা থেকে টাকা না পাওয়ায় সপরিবারে মধুসূদন শোচনীয় অবস্থায় পড়লেন। পত্মীর আভরণ, গৃহসজ্জার উপকরণ এবং পুস্তকাদি বন্ধক দেওয়া ও বিক্রয় করা হতে লাগল। প্রচুর ঋণের দায়ে জেলে যাবার উপক্রমও একবার হয়েছিল।
    বিদ্যাসাগর পত্রপাঠ দেড় হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন। পরে অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা এবং শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে জোগাড় করলেন। মধুসূদন প্রয়োজনীয় দলিলপত্র পাঠিয়ে দিলে তাঁর পিতৃসম্পত্তি অনুকূলচন্দ্রের কাছে বাঁধা রেখে আরও বারো হাজার টাকা সংগ্রহ করা বিদ্যাসাগরের পক্ষে সম্ভব হল। বিদ্যাসাগর কবিকে নিদারুণ বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। তাঁর পক্ষে আবার ইংল্যান্ড এসে ‘গ্রেজ-ইন’-এ যোগ দেওয়া সম্ভব হল ১৮৬৫ সালের শেষভাগে। ১৮৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি ব্যারিস্টার হয়ে বেরুলেন।
   
ইউরোপ-প্রবাসে মধুসূদনের জীবনের অন্যতম মুখ্য ঘটনা চতুর্দশপদী কবিতাবলী রচনা। ১৮৬৫ সালে তিনি ভার্সাই বাসকালে এই সনেটগুলি লেখেন এবং প্রকাশের জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কয়েকটি নীতিগর্ভ কবিতাও এই সময়ে লেখা হয়। ফ্রান্সে সম্ভবত কতকগুলি কাহিনীকাব্যও লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।

ইউরোপ-প্রবাসের অপর দুটি ঘটনারও উল্লেখ করা চলে। তিনি যখন লন্ডনে ছিলেন বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত গোল্ডস্টুকর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপকের পদটি গ্রহণ করতে তাঁকে অনুরোধ করেন। পদটি অবৈতনিক হওয়ায় কবির পক্ষে সে অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
    ভার্সাই নগরে বাসকালে মধুসূদন দান্তের ষষ্ঠ শতবার্ষিকী জন্মোৎসব উপলক্ষে একটি সনেট রচনা করে ইতালীয় অনুবাদসহ ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের নিকট প্রেরণ করেন। আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের দিক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কবির এই চেষ্টা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
    অবশেষে ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি কবি ভারত অভিমুখে যাত্রা করলেন। ভারতে আইনব্যবসায়ে সাফল্য লাভ না করা পর্যন্ত পরিবার ফ্রান্সেই থাকবে স্থির করলেন। পুত্র-কন্যাদের ইউরোপীয় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যও তাঁর ছিল।
    কবির ইউরোপবাসকালীন ঘটনাবলী এবং সেখান থেকে লেখা চিঠিপত্র বিশ্লেষণ করলে তাঁর অন্তর্জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ পরিচয় লাভ করা যায়।
    ঋণের দায়ে জেলে যেতে যেতে ফরাসি, ইতালীয় ও জার্মান ভাষা-শিক্ষায় একাগ্রচিত্ত তাঁকে হয় পাগল না হয় প্রতিভাবান বলে মেনে নিতে হবে। এবং পণ্ডিতদের মতে এ-দুয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে। মধুসূদন কাব্য-রাজ্য থেকে তখন প্রায় বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু শুধু কবিতায়ই নয়, সুখে-দুঃখে, আচারে ও বাক্যে তিনি একটি অগ্নিগর্ভ প্রতিভা-তার নিদর্শন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।
    মধুসূদন যে ইংল্যান্ডকে কামনা করেছেন আবাল্য "I sigh for Albion's distant shore"- আসলে তা ইউরোপীয় আধুনিক ভোগবাদী সভ্যতার প্রতি কবির গভীর আসক্তির পরিচায়ক। ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে অনেক দুঃখ তিনি পেয়েছেন, অভীষ্ট সিদ্ধির পথে ঘটেছে বহু বিঘ্ন।
   

ইউরোপীয় সভ্যতাকে শুধু সাহিত্যিক আদর্শের মধ্যে নয়, জীবনাদর্শের মধ্যেও কবি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় চিন্তা ও মনোভাব বৈরাগ্য ও নিবৃত্তি-প্রধান হয়ে উঠেছিল। নবযুগ নিয়ে এল তার বিরুদ্ধে এক উচ্চকন্ঠ বিদ্রোহ। জীবনকে ভালোবাসা এবং পার্থিব ভোগবাসনাকে মূল্য দেওয়া পরম পুরুষার্থ বলে গণ্য হতে লাগল। আমাদের পরাধীন, দরিদ্র দেশে এই জীবনাদর্শ চরিতার্থ হবার সম্ভাবনা ছিল না। মধুসূদনের কাছে ইউরোপ ছিল সেই কামনার মোক্ষধাম। এই কামনা যুগপ্রভাবজাত, মধুসূদনের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনচেতনার সঙ্গে তা হয়ে পড়েছিল অন্বয়-সম্বন্ধ।
   
   
ভারতে প্রত্যাগমন

১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে কবি কলকাতায় ফিরলেন। ব্যয়বহুল স্পেনসেস হোটেলে বাসস্থান ঠিক করলেন। কিন্তু হাইকোর্টে প্রবেশের ব্যাপারে বিচারপতিদের মধ্যে অনেকে প্রশ্ন তুলে বাধার সৃষ্টি করলেন। ২০ ফেব্রুয়ারির আবেদনপত্রটি গৃহীত হল না। আরও সুপারিশপত্র দাখিল করতে বলা হল। বিচারপতিদের এই আপত্তির প্রকৃত কারণটি সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে মনে হয় ‘নীলদর্পণ’ অনুবাদের কথা ইংরেজ বিচারপতিদের অজানা ছিল না। সম্ভবত হেনরিয়েটার সঙ্গে অবৈধ বিবাহের ব্যাপারটিও তাঁদের কানে উঠেছিল। মধুসূদনের বিরুদ্ধে প্রভাবশীল কোনো গোষ্ঠী যে বিচারপতিদের মতামতকে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত করেছিল, তাঁদের সভার বিবরণ পড়ে সেকথা স্পষ্টই বোঝা যায়।
    মধুসূদন অবশ্য কলকাতার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের বহুসংখ্যক প্রশংসাপত্র হাইকোর্টে পাঠিয়ে দিলেন। একরূপ জনমতের চাপে ৩ মে তারিখে তাঁকে ব্যারিস্টাররূপে গ্রহণ করা হল।
    মধুসূদন আইনব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হলেন এবং ক্রমেই অধিক অর্থাগম হতে লাগল। কিন্তু আয়ের সঙ্গে কোনোরূপ সমতা না রেখে দু-হাতে ব্যয় করাই তাঁর চিরকালের স্বভাব।
    আইনব্যবসায়ে আশাতিরিক্ত আয় করা কিছুতেই সম্ভব হল না। এদিকে পুরানো ও নূতন ঋণ নিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বিপদগ্রস্ত হলেন। মধুসূদন ১৮৬৮ সালে সম্পত্তি কুড়ি হাজার টাকায় বিক্রয় করে বিদ্যাসাগরকে বিপদমুক্ত করলেন।
    ১৮৬৯ সালে হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যাসহ কলকাতায় চলে এলেন। মধুসূদন হোটেল ছেড়ে লাউডন স্ট্রিটে বাগান-ঘেরা দোতলা বাড়ি ভাড়া করলেন। মাসিক বাড়িভাড়া ছিল ৪০০ টাকা। এর দ্বারাই সামগ্রিক খরচের ধারণা করা যায়।
    মধুসূদন আইনব্যবসায়ে সাফল্যের পরিমাণ নিয়ে স্পষ্ট করে জীবনীকারেরা কিছু বলেননি। সমকালীন ব্যক্তি ও পত্রিকাগুলির সাক্ষ্যে পরস্পরবিরোধী নানা কথা বলা হয়েছে। মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা তিনি অবশ্যই উপার্জন করতেন। কিন্তু তাঁর মতো প্রতিভাশালী ব্যক্তির কাছ থেকে যতটা প্রত্যাশা করা যায় ততটা আর্থিক সফলতা তিনি পাননি। শেষ দিকে সম্ভবত তাঁর আয়ের পরিমাণও কমে আসছিল এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিল।
    ১৮৭০ সালে হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিল আফিসের অনুবাদ-বিভাগে পরীক্ষকের পদ লাভ করলেন মধুসূদন। বেতন হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। প্রায় দুই বৎসর তিনি এই চাকরি করেছিলেন। কিন্তু এই বেতনে তাঁর প্রয়োজন কিছুই মিটত না। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি কাজটি ছেড়ে দিলেন। বেশি আয়ের আশায় তিনি আবার আইনব্যবসা আরম্ভ করলেন। কবির স্বাস্থ্য তখন ভেঙে পড়েছে।
    ১৮৭২ সালে মানভূমে পঞ্চকোট রাজ্যের আইন-উপদেষ্টার পদটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই কাজটি তিনি ছেড়ে দিলেন।
    কবি আবার আইনব্যবসায়ে ফিরে এলেন। কিন্তু এখন তিনি নানা রোগে জীর্ণ। জীবন নিঃশেষিতপ্রায়।
   

কবি শেষ জীবনে নানা সময়ে সাময়িক কারণে কয়েকটি সনেট এবং সনেটকল্প কবিতা লিখেছিলেন। কতকগুলি অসমাপ্ত থেকে গিয়েছে।‘মায়া-কানন’ নামে একটি নাটক সম্পূর্ণ করেছিলেন। ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ নামে আর-একটি নাটক হয়তো আরম্ভ করেছিলেন। তার কোনো খোঁজ মেলেনি। ‘হেক্টর-বধ’ নামে একটি গদ্য আখ্যান সম্পূর্ণ আকারেই এই পর্বে প্রকাশিত হয়েছে।
    এই পর্বে কবির সাহিত্যসাধনা যেমন খণ্ডিত তেমনি ক্লান্ত। দীপশিখা আজ নির্বাণোন্মুখ।
   

মৃত্যু

মধুসূদন খুবই অসুস্থ হয়ে উত্তরপাড়ার জমিদারের লাইব্রেরি-গৃহে বাস করতে গেলেন। রোগযন্ত্রণা, অর্থাভাব, ঋণ-সব মিলে মধুসূদনের এই শেষজীবন বড়ই দুঃখবহ হয়ে পড়েছিল। ক্রমে তিনি উত্থানশক্তিরহিত হয়ে পড়লেন।
    উত্তরপাড়ায় রোগের উপশম হল না দেখে তিনি সপরিবারে বেনেপুকুর রোড়ের বাড়িতে চলে এলেন। পত্নী হেনরিয়েটাও তখন শেষশয্যায়।
    অবশেষে মুমূর্ষু মধুসূদনকে জেনারেল হাসপাতালে ভরতি করা হল। ইউরোপীয়ান ছাড়া সেকালে এ হাসপাতালে অপর কোনো শ্রেণীর প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু তখন আর চিকিৎসা করে রোগ সারাবার অবস্থা ছিল না।
    ১৮৭৩ সালে ২৬ জুন হেনরিয়েটা পরলোক গমন করলেন। মুমূর্ষু কবি হাসপাতালে সে সংবাদ শুনে শূষ্ককন্ঠে রুদ্ধস্বরে কেবল বললেন,
    “জগদীশ! আমাদিগের দুইজনকেই একত্র সমাধিস্থ করিলে না কেন? কিন্তু আমার আর অধিক বিলম্ব নাই, আমি সত্বরই হেনরিয়েটার অনুবর্তী হইব। -এই শোকসংঘাতেই মধুসূদনের জীর্ণবক্ষপিঞ্জর চূর্ণ হইয়া গেল!”
   
    ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন রবিবার বেলা দুটোয় কবি মধুসূদন প্রাণত্যাগ করলেন।
 ....................................................................................

মুক্ত করে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের সিংহদ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দসৃষ্টিতে নূতন ধরনের আখ্যানকাব্য-রচনায়, এ দেশের একমাত্র খাঁটি মহাকাব্যসৃষ্টিতে, আধুনিক গীতিকবিতা ও সনেটের উদ্ভাবনায়, কাব্যচরিত্রসৃজনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা প্রকাশ করায় তিনি যুগান্তকারী দায়িত্ব পালন করেছেন।
    ঘটনাটি ১৮৫৯ সালের মধ্যভাগে। মহড়া চলছিল ‘শর্মিষ্ঠা’র। যতীন্দ্রমোহন ৩৩ বছর পরে ব্যাপারটি স্মরণ করতে গিয়ে একটু ভুল করেছেন।
    “কোন সুচতুর কবির সাহায্যে আমরা নিম্নস্থ কাব্য প্রকটিত করিতে সক্ষম হইলাম। ইহার     রচনাপ্রণালী অপর সকল বাঙালি কাব্য হইতে স্বতন্ত্র। ইহাতে ছন্দ ও ভাবের অনুশীলন, ও অন্ত্য     যমকের পরিত্যাগ, করা হইয়াছে। ঐ উপায়ে কি পর্যন্ত কাব্যের ওজোগুণ বর্ধিত হয় তাহা সংস্কৃত ও ইংরেজি কাব্যপাঠকেরা জ্ঞাত আছেন। বাংলাতে সেই ওজোগুণের উপলব্ধি করা অতীব বাঞ্ছনীয়; বর্তমান প্রয়াসে সে অভিপ্রায় কি পর্যন্ত সিদ্ধ হইয়াছে তাহা সহৃদয় পাঠকবৃন্দ নিরূপিত করিবেন।”
    কাব্যরচনা ১৮৫৯ সালের জুলাই মাসের পূর্বে আরম্ভ হয়ে ১৮৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির পূর্বে শেষ হয়েছিল। কাব্যটির শেষ দুই সর্গ প্রথম সর্গ দুইটির মতো কোনো সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়নি।
    কাব্যটির প্রথম সংস্করণ ১৮৬০ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়েছিল, ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস থেকে। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১০৪।
    বাংলা ১২৬৮ সালে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হল। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৯৯। এই সংস্করণে গ্রন্থটির বহুল পরিবর্তন ঘটে।
    তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হল ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৭০ (বেঙ্গল লাইব্রেরির পুস্তকতালিকা)। এটি দ্বিতীয় সংস্করণেরই প্রায় পুনর্মুদ্রণ। উল্লেখ্য কোনো পরিবর্তন নেই।
    কবির জীবিতকালে প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণ এটি। বর্তমান রচনাবলীতে একেই আমরা আদর্শরূপে গ্রহণ করেছি।
    পদ্মাবতী নাটক লিখতে লিখতে মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দ আবিষ্কার করলেন। এই something, এই অমিত্রাক্ষর ছন্দই হল তিলোত্তমার কেন্দ্রীয় সত্য। নব আবিষ্কারের আনন্দোল্লাস এবং একে সম্পূর্ণ না চেনার বিস্ময়। ছন্দের প্রবল স্রোতে ভেসে চলেছেন কবি, এবং বিচিত্র বস্তু, ভাব, কল্পনাকে ভাষাচিত্রে রূপ দিচ্ছেন- নবসৃজনশীলতার আনন্দে।
    “তিলোত্তমাসম্ভব প্রস্তুতির কাব্য। জীবন ও জগৎ, মানুষ ও প্রকৃতি, চিত্তের মুক্তি ও পরিবারের বন্ধন, মধুসূদনের চেতনায় বিশিষ্ট কাব্যবোধ রূপে ধরা দিয়েছিল- দার্শনিক তত্ত্বকথা হিসেবে নয়, আর মেঘনাদবধের নয় সর্গের বিস্তৃতিতে তা আপনাকে রূপধৃত প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। তিলোত্তমায়     কবিপ্রাণের গভীরে চলেছে তারই অনুসন্ধান। আর কখনও ধরা পড়েছে তার স্পষ্টতর অনুভূতি,     ফলে এ কাব্যে ঘটেছে তার অপুষ্ট পঙ্গু প্রকাশ। আখ্যায়িকা-গঠনে নবসংহতি যে নূতন আদর্শের  সৃষ্টি করেছে মেঘনাদবধে এখানে তা অনুপস্থিত, যদিও বাইরের বস্তুপুঞ্জের অভ্যন্তরে তার একটা  রক্তমাংসহীন কাঠামোর সূত্র অনুসরণ করা সম্ভব। নূতন মানবতাবোধের যে আদর্শ মধুসূদনের কাব্যকল্পনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য তার সম্যক প্রকাশ এখনও বিলম্বিত। এই মানবতাবোধের সন্ধানে কবিচিত্ত এখানে দ্বিধা-দীর্ণ।
    এক কথায় বলা যেতে পারে যে প্রতিভালক্ষ্মী গরুড়ের জন্মসম্ভাবনার দোহদলক্ষণা।     অকালবোধনে সেখানে অরুণের জন্ম ঘটেছে। সে অপূর্ণ কিন্তু সূর্যরথের সারথিও বটে।”
    মহাভারতের আদিপর্বের নবাধিকদ্বিশততম, দশাধিকদ্বিশততম, একাদশাধিকদ্বিশততম এবং দ্বাদশাধিকদ্বিশততম অধ্যায়ে সুন্দ-উপসুন্দের যে কাহিনী বর্ণিত আছে মধুসূদন সেখান থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু মূল কাহিনীর উল্লেখ্য কোনো পরিবর্তন তিনি ঘটাননি। নূতন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগে কবির বিদ্রোহী চিত্ত ভাবকল্পনার নবীন দিগন্ত উন্মোচন করেনি এ কাব্যে। বরং কবিহৃদয় সহানুভূতির সূত্রে দ্বিধাবিভক্ত এখানে। কখনো স্বর্গচ্যুত দেবতাদের প্রতি, কখনো অমিতবীর্যশালী অসুরদের প্রতি কবিচিত্ত আকৃষ্ট।
    কবির এই অস্থিরতা এবং বিশ্ব কাব্যসমুদ্র মন্থনের প্রতিফলন তিলোত্তমায়। কবির জীবনভাবনার ধ্রুবতারার এখনও খোঁজ মেলেনি। রোমান্টিক সৌন্দর্যাবেশে সৌন্দর্যলক্ষ্মীর এক কল্পমূর্তি কবি গড়ে তুলেছেন।
    মেঘনাদবধ কাব্য। বেলগাছিয়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের অকালমৃত্যুর প্রসঙ্গ এবং হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখোপাধ্যায়ের মুমূর্যু অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের মৃত্যু হয় ১৮৬১ সালের ২৯ মার্চ। হরিশ মুখোপাধ্যায় মারা যান ১৮৬১ সালের ১৪ জুন। এই সাক্ষ্যের অনুসরণ করে বলা যায়, ওই বছর এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে মেঘনাদবধ কাব্য লেখা হয়েছিল।
    কাব্যটির প্রথম সংস্করণ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। প্রথম খন্ডে পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত (পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৩১) প্রকাশিত হয়েছিল ৪ জানুয়ারি, ১৮৬১ সাল। দ্বিতীয় খন্ডে শেষ চার সর্গ (পৃষ্ঠা ১০৪) প্রকাশিত হয় ১২৬৮ বঙ্গাব্দে। দ্বিতীয় খন্ডের আখ্যাপত্রটি পাওয়া গিয়েছে।
    মেঘনাদবধ কাব্য। / দ্বিতীয় খণ্ড। / শ্রীমাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রণীত। / “-কৃতবাগ্দ্বারে বংশেহস্মিন্ পূর্বসূরিভিঃ, / মণৌবজ্রসমূৎকীর্ণে সূত্রস্যেবাস্তি মে গতিঃ।” / বঘুবংশঃ। কলিকাতা। / শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং বহুবাজারস্থিত ১৮২ সংখ্যক / ভবনে / ষ্ট্যান্হোপ্ যন্ত্রে যন্ত্রিত। সন ১২৬৮ সাল।
    রাজা দিগম্বর মিত্র প্রথম সংস্করণের ব্যয়ভার বহন করেন। কাব্যটি তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়। প্রথম সংস্করণের প্রথম খণ্ডে মঙ্গলাচরণ রূপে উৎসর্গপত্রটি মুদ্রিত হয়েছিল।
    দ্বিতীয় সংস্করণও দুই খন্ডে প্রকাশিত হয় হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় যথাক্রমে বাংলা ১২৬৯ এবং ১২৭০ সালে। পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৫১ এবং ১২৮।
    তৃতীয় সংস্করণ, প্রথম খণ্ডের প্রকাশকাল ২১ অগাস্ট, ১৮৬৭। পৃষ্ঠা ১৪৮। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণের মধ্যে এত দীর্ঘ ব্যবধানের কারণ সম্ভবত কবির ইউরোপ-প্রবাস।
    তৃতীয় সংস্করণ থেকে মঙ্গলাচরণটি বর্জিত হয়, কারণ দিগম্বর মিত্র সম্বন্ধে য়ুরোপ-প্রবাসে কবির তীব্র বিরূপতা জন্মেছিল।
    ষষ্ঠ সংস্করণে দুই খন্ড একসঙ্গে প্রকাশিত হয় ২০ জুলাই, ১৮৬৯। পৃঃ ৩২০। মধুসূদনের জীবিতকালে প্রকাশিত এটিই শেষ সংস্করণ।
    এদেশীয় সাহিত্যে মেঘনাদবধ কাব্য অভিনব। এ কাব্যের কোথায় কল্পনা কতটুকু কেন্দ্রচ্যুত, রূপরচনা তুলনায় ম্লান, সে আলোচনা খুঁটিয়ে করা যেতে পারে। কিন্তু সব ত্রুটি নিয়ে এবং ছাপিয়ে আধুনিক ভারতীয় একমাত্র এই কাব্যটিই sublime- এর রসে স্তম্ভিত হয়ে আছে, অথচ কৃত্রিমতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। মধুসূদন ইউরোপীয় কাব্যসাহিত্যের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন, বহু মহাকাব্য পাঠে তাঁর চিত্ত প্রশস্ত হয়েছিল। মধুসূদনের মহাকাব্যরচনার প্রবৃত্তি তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের ফল। যুগপরিবেশও গৌণভাবেই অবশ্য সাহায্য করেছে। প্রাচীন ভাষা এবং কাব্যগুলি দীর্ঘকাল ধরে চর্চা করার ফলে তিনি অন্তরের গভীরে একটি খাঁটি ক্লাসিক জীবনচেতনার সন্ধান পেলেন। মধুসূদনের জগৎ ও জীবনদৃষ্টি মহাকবির। কল্পনা মহাকাব্যিক। এর মূলে গীতিধর্ম ছিল, ছিল ব্যক্তি-আত্মার প্রকাশবেদনার অনুরণন। কিন্তু ব্যক্তিগত গীতাবেদনের তরল প্রবাহে উচ্ছ্বসিত বিশ্ব (এককথায় যাকে বলা যায় লিরিক কবির জগৎ) তাঁকে মুগ্ধ করেনি। সমতল ভূমির নদীপ্রবাহের কুলুকুলু ধ্বনি নয়, উপলব্যথিত মর্মরমুখরতাও নয়, মধুসূদনের কল্পনার গীতিসুর অভ্রভেদী-পর্বত-দীর্ণকারী স্রোতস্বিনীর সঙ্গেই উপমিত হবার যোগ্য। মধুসূদনের গীতিধর্মের সঙ্গে কাঠিন্য, বিপুলতা, গৌরবের বিরুদ্ধতা নেই, সালোক্য আছে।
    মহাকাব্যের মূল লক্ষ্য হলো sublime-এর রসসঞ্চার। আধা-ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে দেশমাহাত্ম্য বা ব্যক্তিগরিমার অভ্রভেদী মিনার গড়ে তুলতে পারে যে কবিকল্পনা, কিছু অলৌকিকের সংযোগে, বর্ণনার গাম্ভীর্যে, বাচনভঙ্গির ব্যাপকতায় একের কাহিনীকে বহুর বিমূঢ় জিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত করতে পারে যে কবিশক্তি তাকেই মহাকাব্যিক কবিকল্পনা এবং মহাকাব্যিক সৃষ্টিক্ষমতা বলে অভিহিত করা উচিত।
    মধুসূদনের এই কল্পনা ছিল, এই শক্তি ছিল। বড় কিছু লিখবার বহিরঙ্গ ভাবনা অথবা আপন প্রতিভার বৈশিষ্ট্য না বুঝে অপরের দ্বারা সাময়িকভাবে প্রভাবিত হবার ফলে তিনি মহাকাব্য লিখতে প্রবৃত্ত হননি। তবে তাঁর এই দৃষ্টি পুষ্ট হবার পেছনে প্রাচীন মহাকবিদের প্রভাব ছিল গভীরভাবে কার্যকর। কিন্তু স্থূলভাবে নয়। তাকে আত্মসাৎ করে আপন ব্যক্তিত্বটি গড়ে তুলেছিলেন মধুসূদন। তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের সবচেয়ে বড় কথা হল ক্ষত্রিয়ের ভোগবাদ। এই বীর্যের শুল্কে জীবনকে জয় করা, অন্তত জয়ের সাধনা, নেহাত সে সাধনপথে জীবনত্যাগ- এই চেতনা জাগতিক হয়েও অতিজাগতিক। এই কল্পনায় বসুন্ধরার যে মূর্তি ধরা পড়ে ভীরুর দুর্বলতা তার নাগাল পায় না, বীরের বাহুই তাকে অধিকার করে। সে বসুন্ধরা সত্যই বসুকে ধরে রেখেছে, ব্যাপকতাই তার মূল্য নয়, মহৎ মহিমা ও ঐশ্বর্যবলেই তার এই বিস্তার। এই বীর্য দেহের বল নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে মাত্র এর প্রমাণ নয়, এ হল প্রধানত অন্তরের সামগ্রী। এর সঙ্গে হৃদয়ের কোমলপেলব উপলব্ধির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু এ জীবনমাল্য ‘বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা’। রাবণ-মেঘনাদ-রাম-বিভীষণ-প্রমীলার চরিত্রে এবং কাহিনীবিন্যাসে কবির এই কল্পনাভিত্তিই রূপধারণ করেছে।
    মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনীবিন্যাসের কৌশল, ভাষাভঙ্গি, চিত্রকল্পনা, পৌরুষ ও পেলবতার মিশ্রণজাত চরিত্রচিত্রণ এবং চরিত্রভেদী জীবন-সমালোচনার গভীরতা সম্বন্ধে নানা কথা বলা চলে। কিন্তু সব কিছুর কেন্দ্রে রয়েছে রাবণের ব্যক্তিত্ব ও নিয়তি-বিধ্বস্ত ভাগ্যের আর্তনাদ-জড়িত রস। কবির ব্যক্তিচেতনার রং মিলিয়ে এই ট্র্যাজেডির আস্বাদ হয়ে উঠেছে আরও মর্মভেদী, আরও বিচিত্র। কাহিনী, বর্ণনা, চরিত্রসৃষ্টি সবকিছু ছাপিয়ে একটা বিস্ময়বিমূঢ় জিজ্ঞাসা বিশ্ববিধানের তল খুঁজে বেড়ায়। কেন এই ব্যর্থতা, করায়ত্ত সিদ্ধি কেন স্খলিত হয়ে পড়ে, সব শক্তি দিয়ে, সাধনা দিয়েও কেন কামনার বস্তুকে ধরে রাখা যায় না? ভারতীয় কর্মফলের বোধ দিয়ে একে ব্যাখ্যা করতে পারেননি কবি, আর পারেননি বলেই তাঁর অতৃপ্তি বিশ্বনীতিকে বিদ্ধ করেছে। রাবণের ট্র্যাজেডির হাহাকার ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠীজীবন, দেশ ও কালকে ছাপিয়ে মহাবিশ্বে প্রসারিত।
    মেঘনাদবধ কাব্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ কবির ভাবনার বিজাতীয়ত্বে। রামায়ণের রামচন্দ্র হিন্দুর পরমারাধ্য দেবতা, তাঁকে হেয় করে রাবণকে গৌরব দেওয়ায় পাঠকের রস-বিশ্বাসের চিরায়ত স্তরটিতে আঘাত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গত একশো বছর ধরে নানারূপ বিতর্ক চলে আসছে। সাহিত্য-ব্যাপারে পূর্বসংস্কার বিসর্জন দিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত বলেই মনে হয়। মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণের ইন্দ্রজিৎ-মৃত্যুপ্রসঙ্গের সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর নয়, এটি সম্পূর্ণ নূতন এবং স্বাধীন একটি কাব্য। কবি বাল্মীকি-রামায়ণের যতটুকু নিয়েছেন, উপাদান রূপেই গ্রহণ করে বদল করে নিজের করে নিয়েছেন। ফলে একটি মৌলিক কাব্য রচিত হয়েছে, যা স্বাদে এবং জীবনজিজ্ঞাসায় একেবারেই মৌলিক।
    ব্রজাঙ্গনা কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হবার পরে ব্রজাঙ্গনা কাব্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু মেঘনাদবধ লিখতে আরম্ভ করার আগে কাব্যটি লেখা শেষ হয়েছিল। কিন্তু বইটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতে অনেক দেরি হয়। এ বিষয়ে রাজনারায়ণ বসুকে লেখা একাধিক চিঠিতে কবিকে মন্তব্য করতেও দেখা যায়। বাংলা ১২৬৮ সালের ২৮ আষাঢ় কাব্যটি প্রকাশিত হল। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৪৬।
    ব্রজাঙ্গনা কাব্য মেঘনাদবধ কাব্যের পূর্বে লেখা হয়েছিল। তিলোত্তমাসম্ভবে নূতন ছন্দের সংগীতপ্রভাবে কবিচিত্ত উল্লসিত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্যে ছন্দ-ভাব-কল্পনার মহিমা ঘনীভূত ও দৃঢ়পিনদ্ধ ভাষারূপ ধারণ করেছে। ব্রজাঙ্গনার মৃদুকন্ঠ সংগীত দুই পর্বতের মধ্যভাগের প্রশান্ত উপত্যকা। মধ্যা‎েহ্নর সূর্যের এখানে যেন ক্ষণিক বিশ্রাম।
    ব্রজাঙ্গনা কাব্যে কোনো গভীর ভাবকল্পনার পরিচয় নেই। জীবনচেতনার সুতীব্র আর্তি, ট্রাজিকভাবনার মহিমা, লিরিক উচ্ছ্বাসের অনির্বচনীয়তা কোনো দিক থেকেই ব্রজাঙ্গনা শ্রেষ্ঠ কবিতার মর্যাদা দাবি করতে পারে না।
    মধুসূদনের বৈচিত্রসন্ধানী কবিচিত্তই ব্রজাঙ্গনার  ছন্দ, সুর ও কল্পনার স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে তুলেছিল। অমিত্রাক্ষর ছন্দ সম্বন্ধে সেকালের একশ্রেণীর লোকের এরূপ অভিযোগ ছিল যে যাঁরা মিত্রাক্ষর কবিতারচনায় অপারগ তাঁরাই এই দুর্বলতা ঢাকতে চাইছেন অমিত্রাক্ষরের আবরণের অন্তরালে। মধুসূদন অন্তঃসারশূন্য এই সমালোচনাকে অনায়াসে অস্বীকার করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে একটি শিশুহৃদয় লুকিয়ে ছিল। জয়ের প্রগলভ নেশায় সে হৃদয় আত্মাহারা। তিনি যে মিত্রাক্ষর কবিতারচনায় কীরূপ পারদর্শী তা প্রমাণ করার লোভ সংবরণ করতে পারলেন না। মিলের পদ্ধতি যে কত বিচিত্র ও জটিল হতে পারে কবি তা দেখিয়ে দেবার জন্য কোমর বেঁধে নামলেন।
    ব্রজাঙ্গনার কবিতাগুলিতেও পয়ার বা ত্রিপদীর মাত্রাভঙ্গির সাধারণ কাঠামোটি মূলত রক্ষিত হয়েছে। বিদেশি ওডের প্রভাব এখানে কার্যকর। বহুপংক্তির সহযোগে গঠিত দীর্ঘ-স্তবক এই কাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। হ্রস্ব-দীর্ঘ চরণে মিলের ব্যাপারটিও ওডের কথাই মনে করিয়ে দেয়। যেমন- ‘ভুবনমোহন’-এর সঙ্গে ‘নিশি হাসি বিহারয়ে লয়ে সে রতন’-এর মিল; কিংবা ‘ত্যাজি আজি ব্রজধাম গিয়াছেন তিনি’, ‘ভজে শ্যামে রাধা অভাগিনী’ এবং ‘আমি গো ফণিনী’-এর মধ্যে মিল। আবার চৌদ্দ অক্ষরের চারটি মিত্রাক্ষর পংক্তি (ক-খ-খ-ক) ঠিক মাঝখানে তৃতীয় স্থানে একটি আঠারো মাত্রার অমিল পংক্তি-সহযোগে পাঁচ চরণের স্তবক-নির্মাণ জটিল কারুকর্মের চিহ্ন বহন করে।
    মধুসূদন বহিরঙ্গে য়ুরোপীয় ওডের ন্যায় অঙ্গপ্রসাধন ঘটালেও প্রাণধর্মের দিক থেকে ওডের আদর্শ বজায় রাখতে পারেননি। এগুলি বাংলাদেশের পুরানো গীতিকবিতার জগৎ পরিত্যাগ করে নব্য গীতিকবিতার রাজ্যে প্রবেশ করতে পারেনি। ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ এবং ‘আশার ছলনে ভুলি’- এই দুটি কবিতায় ভাবে, রূপে আধুনিক লিরিকের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছেন কবি। কিন্তু ব্রজাঙ্গনায় কবিওয়ালাদের সুর অশ্রুত নয়, ভাব ও রূপ যতই মার্জিত হোক না কেন।
    ব্রজাঙ্গনা কাব্যে রাধার ক্রন্দনে আন্তরিকতার স্পর্শ নেই। কবির শিল্পীমনের উদ্বোধন এখানে ঘটেনি। কারণ রাধার মধ্যে আপনাকে প্রক্ষেপ করার সুযোগ যেমন ছিল না, তেমনি মনোমতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল চরিত্রনির্মাণের সম্ভাবনাও ছিল না। কবিপ্রতিভার মধ্যাহ্নে ব্রজাঙ্গনা অলস কারুবিলাস এবং পরীক্ষানিরীক্ষায় সীমাবদ্ধ থেকেছে।
   
    বীরাঙ্গনা কাব্য। কাব্যটি রচিত হয় ১৮৬১ সালের একেবারে শেষ দিকে বা পরের বছর জানুয়ারির মধ্যে। এই বছর ২৯ অগাস্টে লেখা এক চিঠিতে দেখা যায় কবি তাঁর পরবর্তী কাব্যের বিষয় স্থির করতে পারেননি। এ থেকে বোঝা যায় বীরাঙ্গনা কাব্য রচনার সূত্রপাত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের আগে হয়নি।
    কাব্যটির দ্বিতীয় সংস্করণ বাংলা ১২৭৩ সালে (পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭৬) এবং তৃতীয় সংস্করণ ১৫ জানুয়ারি ১৮৬৯ সালে (পৃষ্ঠা ৭৬) প্রকাশিত হয়। সংস্করণগুলির মধ্যে উল্লেখ্য কোনো পাঠভেদ নেই। বর্তমান রচনাবলীতে কবির জীবিতকালে শেষ সংস্করণকে (তৃতীয়) আদর্শরূপে গ্রহণ করা হয়েছে।
    বীরাঙ্গনা কাব্যের পরিকল্পিত দ্বিতীয় খন্ডের সামান্য অংশমাত্র লিখিত হয়েছিল। অসম্পূর্ণ কবিতাবলীরূপে এই রচনাবলীতে তা মুদ্রিত হয়েছে।
    বীরাঙ্গনা কাব্যের পরিকল্পনা ও রচনার কথা কবির চিঠিতে মাত্র উল্লিখিত হয়েছে। একটি চিঠি থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ আগে উদ্ধৃত হয়েছে। অন্য চিঠিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কাব্যটি উৎসর্গ করার খবর জানানো হয়েছে রাজনারায়ণ বসুকে।
    ওভিদের ‘হিরোইদ্স’ কাব্যের আদর্শে লেখা হলেও ভাবে একং দেহরূপে বীরাঙ্গনা কাব্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের রচনা। কবি পত্রাকারে লিখলেও এগুলি অনেকটা dramatic monologue-শ্রেণীর। নায়িকাদের সংলাপের ভাষাকে বিচিত্র সূক্ষ্ম কৌশলে তরঙ্গিত করে তুলেছেন কবি। রুদ্ধ ভাবাবেগ, দৃপ্ত আত্মঘোষণা, অন্তস্তলবিহারী যন্ত্রণা, সব ভাসিয়ে-নেওয়া উচ্ছ্বাস ভাষার বন্ধনে কম্পিত হয়ে উঠে নাট্যরস সৃষ্টি করেছে। অবশ্য পুরাণকাহিনীর খন্ডাংশগুলি একদিকে বৃহৎ পটভূমির অভ্যাস এনেছে, অন্যদিকে গল্পরস কিছু পরিবেশন করেছে। এই দ্বিমুখী উপাদানের সঙ্গে মিলেছে লিরিকের রস-প্রতিটি নারীর হৃদয়গভীর থেকে উদ্বারিত একটি আর্ত দীর্ঘশ্বাস, একটি সতেজ কামনা, সর্বহারা বেদনা-হতাশার সুর। গীতিপ্রাণতার উচ্ছ্বাস ও আবেগকে একদিকে আখ্যায়িকার সাহায্যে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করে, অপরদিকে নাটকীয় চমক ও চমৎকারিত্বে অপ্রতিহত করে তুলেছেন কবি। বীরাঙ্গনা নিঃসন্দেহে উচ্চাঙ্গের কাব্যকলার নিদর্শন হয়ে উঠেছে।
    বীরাঙ্গনার নারীরা প্রেমমন্ত্রে মহিমময়ী। কবি প্রেম বিষয়ে কোনো তত্ত্বভাবনা, কোনো ইন্দ্রিয়োর্ধ্ব কল্পনার অনুগামী ছিলেন না। প্রাচীন গ্রিকদের মতো প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতেন।
    বীরাঙ্গনা কাব্যে প্রেমের বৈচিত্রকে যথাস্থিত রূপে তুলে ধরতে চেয়েছেন কবি। শকুন্তলা, কেকয়ী দ্রৌপদী, ভানুমতী, দুঃশলা, জাহ্নবী, জনা প্রভৃতি কবিতায় বিরহিত জীবনের বহু বিচিত্র চিত্র মূর্তি পেয়েছে। রুক্ষিনী ও শূর্পণখার পত্রে কুমারীর প্রেম চিত্রিত হয়েছে। স্বর্গনর্তকী উর্বশীর পত্রে বারাঙ্গনার আর তারার পত্রে অবৈধ প্রেমের আনন্দ-বেদনাকে রূপায়িত করেছেন কবি। মানবজীবনে প্রেমের অনন্ত বৈচিত্র্য; তার একটি খণ্ডাংশের যথাস্থিত রূপাঙ্কনের বাসনা থেকেই এ কাব্যের জন্ম।
    বীরাঙ্গনার নারীদের বিচিত্র চরিত্রস্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে আছে একটি বিশেষ সত্য, সেখানেই তাদের ঐক্য। বীরাঙ্গনার নায়িকারা আপন হৃদয়কামনাকেই চরম বলে জেনেছে। চিত্তমুক্তির মাহাত্ম্যে তারা মহিমময়ী; বাহিরের কোনো প্রথা, কোনো রীতিনীতির কাছে আত্মার আনুগত্য তারা মেনে নেয়নি।
    “একদিকে বিবাহিত প্রেমের মধ্যে পূর্বরাগের রোমান্সসৃষ্টি, অপরদিকে অস্তরাগের ক্ষুব্ধ দীর্ঘশ্বাস  যেমন মধুসূদনের কবিতায় রূপ পেয়েছে, তেমনি আবার একদিকে তারা বিবাহিত জীবনকে অস্বীকার করে মুক্ত প্রেমের সন্ধানে ছুটেছে, এবং অপরদিকে উর্বশী স্বাধীন, মুক্ত, বারাঙ্গনার জীবনকে পার্থিব প্রেমসম্পর্কের মধ্যে সংহত ও সঙ্কুচিত করবার বাসনা প্রকাশ করেছে। সর্বত্রই হৃদয়ের একাধিপত্য। আর কারও নির্দেশে মানব না, বাইরে থেকে আরোপিত সুখ ও ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করব, নীতিবোধ ও সমাজবোধকে দূরে সরিয়ে দেব, কেবলমাত্র প্রেমকেই সর্বশক্তিমান বলে জানব, হৃদয়ের নির্দেশই মাথা পেতে গ্রহণ করব। এই হৃদয়-নির্দেশ মানতে গিয়ে ভানুমতি  ভীতি ও দৌর্বল্যের পরিচয় দিয়েছে; জনা আত্মমর্যাদায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে; দ্রৌপদী মাতৃভক্তি, ধর্মবোধ ও পঞ্চস্বামী সম্ভোগের অন্তরালে শুধুমাত্র একজনের একান্ত ভালোবাসার জন্য লোলুপ হয়েছে; তারা ঋষি-পত্মীকে জীর্ণবস্ত্রের মত পরিত্যাগ করে ঘর ছাড়বার জন্য পা উঠিয়েছে; উর্বশী দেবরাজ-দত্ত সুধাপাত্রটি ভ্রুভঙ্গি সহ সরিয়ে দিয়ে মুক্ত বিলাস-পক্ষদুটি গুটিয়ে সংসার-পিঞ্জরে আশ্রয় চাইছে; রাজকুমারী শূর্পণখা নিভৃত শয়নকক্ষ ছেড়ে গোদাবরীর তীরে তীরে     প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় রাত্রিযাপন করেছে। সর্বত্রই প্রেমের জয়, হৃদয়ের অনন্য-পারতন্ত্র্য জয়ী     হয়েছে।”
    ১৮৬৬ সালের ১ অগাস্ট চতুর্দশপদী কবিতাবলী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। (পৃষ্ঠাসংখ্যা ১+১২২)। প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্রটি নিম্নরূপ-
    চতুর্দশপদী-কবিতাবলী। / শ্রীমাইকেল মধুসূদন দত্ত / প্রণীত। * / কলিকাতা। / শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং স্ট্যান্হোপ্ যন্ত্রে / মুদ্রিত। / সন ১২৭৩ সাল, ইংরাজি ১৮৬৬।
    প্রথম সংস্করণে পুস্তকের তিনটি ভাগ ছিল। (১) উপক্রম। মধুসূদনের হস্তাক্ষরে মুদ্রিত আপনার এবং কাব্যটির পরিচয়-জ্ঞাপক দুটি সনেট। (২) চতুর্দশপদী কবিতাবলী। ১০০টি সনেট। (৩) অসমাপ্ত কাব্যাবলী। এতে ছিল দুটি অসমাপ্ত কবিতা এবং তিনটি নীতিগর্ভ কবিতা।
    কাব্যটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় বাংলা ১২৭৫ সালে। ইংরেজি ১৭ মার্চ ১৮৬৯। পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৯২। সামান্য কিছু পাঠভেদ আছে, কিছু মুদ্রণপ্রমাদ এ সংস্করণে সংশোধিত হয়েছে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল প্রথম সংস্করণের অসমাপ্ত কাব্যাবলী অংশটির পরিবর্জন। উপক্রম এবং চতুর্দশপদী কবিতাবলী- এই দুটি অংশের পার্থক্য আর রক্ষিত হল না। মোট ১০২টি সনেট নিয়ে চতুর্দশপদী কবিতাবলীর দ্বিতীয় সংস্করণ একটি সংহত কাব্যগ্রন্থরূপে পরিকল্পিত হয়ে প্রকাশিত হল। এই সম্পাদনায় স্বয়ং কবির হাত ছিল মনে হয়। তিনি তখন ইউরোপ থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। প্রথম সংস্করণের সম্পাদনা প্রকাশকেরা করেছিলেন।
    কবি সনেট সম্বন্ধে তিনটি চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন। দুটি চিঠি প্রাসঙ্গিক অংশ পূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে। অন্যান্য চিঠির সাহায্যেও কোনো কোনো সনেট-রচনার উৎসনির্দেশ করা যেতে পারে।
    । এক। “কবিগুরু দান্তে” নামক সনেটটি লেখার পেছনে উল্লেখ্য পটভূমি আছে। দান্তের ষষ্ঠ-শতবার্ষিকী জন্মোৎসব উপলক্ষে এই সনেটটি রচিত হয়। তিনি এই সনেটটি এবং এর স্বকৃত ফরাসি ও ইতালিয় অনুবাদ ইতালির রাজার নিকট পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে একটি চিঠি ছিল। চিঠিটি এই সংকলনে 'Letters'-এর মধ্যে মুদ্রিত হলো।
    চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে নানা বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে। কাব্যসাফল্যের দিক থেকে কবিতাগুলি অবশ্য সমস্তরের নয়। বিশেষ করে নিজের গোপন চিত্তটি উদ্ঘাটিত হবার সুযোগ ঘটেছে যেখানে, বেদনার সুর সেখানে অভ্রান্ত।
    নানা স্তরে-উপস্তরে, প্রাণের বাহিরে ও অন্দরে, তথ্যের ভারে আর কাব্যের দীপ্তিতে বৈচিত্র্যের বিস্তৃতি আছে চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছের। কিন্তু সবকিছুর মধ্য দিয়ে চতুর্দশপদীতে কবির মানসভ্রমণের একটি বিশিষ্ট রাজ্য উঁকি দেয়। মধুসূদনের সারা জীবনের মাধুকরীবৃত্তি ইউরোপের ক্লাসিক ও আধুনিক কবিদের কল্পনার রাজ্যে, এবং ভারতীয় রামায়ণ-মহাভারতের বিপুল সমুন্নত মহাকাব্যের মহাসমুদ্র-তীরে। কাব্যজীবনের মধ্যভাগে, আপনার সর্বসংকট-সমন্বিত এবং সর্বদ্বিধা-উত্তীর্ণ মেঘনাদবধ-কথার স্বর্ণলঙ্কায় চলেছে মধুসূদনের মানসভ্রমণ। তার চার পাশে ‘প্রচণ্ড সমর-তরঙ্গ উথলিল’। সেই সমরতরঙ্গে উদ্বেলিত হতে হতে কবি-হৃদয়ের শক্তি, সাহস ও আশা আজ শ্রান্ত এবং নির্বাণোন্মুখ। সে সংগ্রাম এখন অতীতের স্বপ্নে আর স্মৃতিতে বিচরণ করাই সমাপ্ত। তাদের স্থান বাহির-মহলে, অন্তরের অন্দরমহলে আজ এক শ্রান্ত শান্তির কামনা- ‘জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম।’
    এ রাজ্যে গদা-যুদ্ধ গোগৃহ-হরণ শুধুই প্রথানুগত্য, রৌদ্ররসের গর্জন, বীররসের উচ্চকন্ঠ ঘোষণা আর প্রাণে সাড়া জাগায় না। রণক্লান্ত সেনাপতি বিশ্রামের বাঁশি শুনেছেন। সেই বাঁশির আহ্বান এক কোমল গানে ভরা শ্যামল বনস্থলে কবিকে নিয়ে গিয়েছে- সে রাজ্যের প্রান্তে কপোতাক্ষের কুলুনাদ, আম্রশাখা শ্যামাপক্ষীর কূজন-মর্মরিত, আর কাশীদাসের ভাগীরথীধারা ভারত-কাহিনীর রসপানে মানুষ আকন্ঠ তৃপ্ত; দেবদোলের ফাগমুষ্টিতে, দুর্গোৎসবের আনন্দসংগীতে আর বিজয়াদশমীর বিষণ্নতায় দেবতা-মানব একাকার। আর সায়ংকালের একটি তারার স্বপ্নে কিংবা রাত্রিগভীরে ইন্দ্রাণীর পায়ে পায়ে ফুটে-ওঠা ছায়াপথের রহস্যে বসে আপনার না-জানা এবং না-পাওয়া প্রিয়তমার কানে বাণী-প্রেরণ-
            কুসুমের কানে স্বনে মলয় যেমতি
            মৃদুনাদে, কয়ো তারে, এ বিরহে মরি।
    অমিত্রাক্ষর ছন্দ। মধুসূদনের আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দ ছন্দ-শাস্ত্রে একটি নূতন সংযোজন মাত্র নয়, বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ পথিকৃৎ শুধু নয়, মধুসূদনের শিল্পীপ্রাণের প্রতিফলন। মধুসূদনের কবি-আত্মার নাম দেওয়া যেতে পারে রাবণ অথবা অমিত্রাক্ষর ছন্দ। যতিপাতের স্বাধীনতায়, অজ্ঞাতপরিচয় accent-syllable-quantity-র মিশ্রণ বাংলা ছন্দের ধমনীতে সঞ্চারিত করায়, যুক্তাক্ষরের সুমিত ব্যবহারে ভাষাকে সংগীত-ঝংকৃত করে তোলায় মধুসূদন যে অসাধ্যসাধন করেছিলেন তার গভীর তাৎপর্যটি সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের ভাষায় ব্যক্ত করা যেতে পারে :
    “আমাদের উচ্চারণে, শব্দ বা বাক্যাংশের (phrase) আদ্য-অক্ষরে একটু ঝোঁক পড়ে, সে কথা বলিয়াছি। আবার হসন্ত-বর্ণের জন্য পূর্ব অক্ষরে যে একটু মাত্রাবৃদ্ধি হয়, তাহাও দেখিয়াছি। এই দুইটির সাহায্যে বাংলা ছন্দে ছন্দপস্পন্দ সৃষ্টি করিবার উপায় পূর্ব হইতেই ছিল। তথাপি, এ     পর্যন্ত বাংলা কবিতার ছন্দে স্বাভাবিক কন্ঠস্বরভঙ্গি প্রশ্রয় পায় নাই- যেন প্রাণের ভাষা কাব্যছন্দে ছন্দিত হইতে পারে নাই। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে বাঙালীর প্রাণ যে মুক্তিকামনার আবেগে স্পন্দিত হইয়াছিল-ভাবচিন্তার ক্ষেত্রে নূতন করিয়া যে আত্মপ্রতিষ্ঠার আগ্রহে সে অধীর হইয়াছিল, সে Romantic ভাবোৎসারের ফলে, আর সকল আন্দোলনের মত, কাব্যের আদর্শ- কল্পনায় যে বিপ্লব আসন্ন হইয়া উঠিল- মধুসূদন তাহারই প্রথম ও প্রধান নেতা; তিনিই, যে বস্তুর সহিত ভাষা অপেক্ষা কবিতার ভাবগত যোগ অধিক, সেই ছন্দকে স্বাধীন স্বচ্ছল বাক্যরীতি ও উচ্চারণরীতির সহিত যুক্ত করিলেন; তাহাতে সেই পুরাতন অক্ষর, বা স্বরান্ত বর্ণ, তাহার ছন্দোগত বৈশিষ্ট্য বজায় রাখিয়াই, নূতন মতই পায়ে পায়ে ঠিক চলিতে লাগিল, কিন্তু তাহাদের মাথা শস্যশীর্ষের মত দুলিতে আরম্ভ করিল, আমাদের বর্ণবৃত্তেও অক্ষরের স্বরবৃদ্ধি ছন্দকে তরঙ্গিত করিতে লাগিল।”
    নানা কবিতা। মধুসূদনের খন্ডিত কাব্য-কবিতা এবং যেসব কবিতা তাঁর জীবিতকালে প্রকাশিত কোনো গ্রন্থে স্থান পায়নি।
    নানা কবিতার রচনাগুলিকে নীচের ক্রম অনুসারে কয়েকটি উপবিভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
   
    ১. বাল্যরচনা। যোগীন্দ্রনাথ বসুর “মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত” গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম কবিতাটির আদ্যক্ষর মিলিয়ে পড়লে হয় ‘গউরদাস বসাক’। অনুমান, হিন্দু কলেজে পড়বার সময়ে কৌতুকবশে কবিতাটি রচিত হয়েছিল।
   
    ২. গান। শর্মিষ্ঠা নাটকের প্রথম সংস্করণে ‘প্রস্তাবনা’ এবং ‘উপসংহার’ রূপে গানদুটি মুদ্রিত হয়েছিল। সংস্কৃত নাটকের আদর্শানুযায়ী নাট্যারম্ভে প্রস্তাবনা-সংগীত এবং নাট্য-সমাপ্তিতে উপসংহারসংগীত সংযুক্ত হয়েছিল সন্দেহ নাই। তৃতীয় সংস্করণ থেকে এ দুটি গান পরিত্যক্ত হয়। শর্মিষ্ঠার অন্যান্য পরিত্যক্ত গানগুলি আমরা এই রচনাবলীতে গ্রহণ করিনি। সাক্ষ্যাদি বিশ্লেষণ করে মনে হয় সেগুলি সবই যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের লেখা।
   
    ৩. গীতিকবিতা। ‘আত্মবিলাপ’ ‘তত্ত্ববোধিনী পত্��িকা’য় ১৭৮৩ শক, আশ্বিনে, প্রকাশিত হয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্য ব্রাহ্মসংগীত লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। কবি ব্রাহ্মসংগীতের পরিবর্তে এই কবিতাটি লিখে পাঠালেন। ১৮৬১ সালে লেখা এই কবিতাটি আধুনিক রীতির প্রথম বাংলা লিরিক।
    ৪. নীতিগর্ভ কাব্য। এই শিরোনামে চিহ্নিত হয়ে ‘ময়ূর ও গৌরী’, ‘কাক ও শৃগালী’, ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’ চতুর্দশপদী কবিতাবলীর প্রথম সংস্করণের শেষভাগে মুদ্রিত হয়েছিল। পরবর্তী সংস্করণে এই অংশ পরিত্যক্ত হয়। ‘অশ্ব ও কুরঙ্গ’ কবিতাটি প্রথম যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখিত ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত’ গ্রন্থে মুদ্রিত হয়। ‘দেবদৃষ্টি’ কবিতাটি ১৩০১ সালে ‘চিকিৎসাতত্ত্ব-বিজ্ঞান এবং সমীরণ’ পত্রিকায় এবং ‘গদ্য ও সদা’ ১৩১২ সালের প্রবাসীতে প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘কুকুট ও মণি’, ‘সূর্য ও মৈনাক-গিরি’, ‘মেঘ ও চাতক’, ‘পীড়িত সিংহ ও অন্যান্য পশু’, ‘সিংহ ও মশক’- এই কবিতাগুলি দীননাথ সান্যাল মহাশয় সংগ্রহ করে প্রথম তাঁর সম্পাদিত চতুর্দশপদী কবিতাবলীর সঙ্গে গ্রথিত করে প্রকাশ করেন।
    নীতিগর্ভ কাব্যের প্রথম তিনটি কবিতা চতুর্দশপদী কবিতাবলীর সমকালে রচিত। ফরাসি কবি লা ফঁতেন্-এর কবিতার আদর্শে এগুলি রচিত।
    ৫. সনেট ও সনেট-কল্প কবিতা। ‘কবি-মাতৃভাষা’ কবির প্রথম সনেট। এটির রচনাবিষয়ে চতুর্দশপদী কবিতাবলীর ভূমিকায় আলোচনা করা হয়েছে।
    ‘ঢাকাবাসীদিগের অভিনন্দনের উত্তরে’ কবিতাটি ১৮৭১ সালে রচিত। যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত’ গ্রন্থে কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। আইনব্যবসা উপলক্ষে কবি ঢাকা গিয়েছিলেন। ঢাকার জনসাধারণ তাঁকে পোগোজ স্কুলে একটি এবং কলেজিয়েট স্কুলগৃহে আর-একটি সভায় অভিনন্দন জানান। কবি তার উত্তরে স্বরচিত এই কবিতাটি পাঠ করেছিলেন।
    ‘পুরুলিয়া’, ‘পরেশনাথগিরি’, ‘কবির ধর্মপুত্র’, কবিতা তিনটি ১৮৭২ সালে আইনব্যবসা উপলক্ষে পুরুলিয়ায় গিয়ে লিখিত হয়েছিল। প্রথম ও তৃতীয় কবিতাদুটি খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ‘জ্যোতিরিঙ্গণ’ নামক পত্রিকায় ওই বৎসরই কবিতাদুটি প্রকাশিত হয়েছিল। ‘পরেশনাথগিরি’ বেরিয়েছিল বাংলা ১২৮১ সালের ‘আর্যদর্শন’ পত্রিকায়।
    ১৮৭২ সালে মানভূমের অন্তর্গত পঞ্চকোট রাজ্যের দেওয়ান ম্যানেজারের পদ গ্রহণ করেছিলেন কবি। সেখানে তিনি আট মাস ছিলেন। ‘পঞ্চকোটগিরি’, ‘পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী’ এবং ‘পঞ্চকোটগিরি বিদায়-সঙ্গীত’ কবিতা-তিনটি পঞ্চকোটে বসে রচিত। কবিতা-তিনটি নগেন্দ্রনাথ সোমের ‘মধুস্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত হয়েছে।
    ‘হতাশ-পীড়িত হৃদয়ের দুঃখধ্বনি’ সনেট ঢঙের এই অসম্পূর্ণ কবিতাটি ‘আর্যদর্শন’ পত্রিকায় বাংলা ১২৯১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কোনো বন্ধুর প্রতি’ যোগীন্দ্রনাথ বসুর লেখা ‘জীবনচরিত’ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ‘জীবিতাবস্থায় অনাদৃত কবিগণের সম্বন্ধে’ এবং ‘পন্ডিতবর শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামক কবিতাদুটি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বাংলা ১৩১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সবকটি কবিতাই জীবনের শেষ কয়েক বৎসরের মধ্যে রচিত।
    ‘সমাধি-লিপি’ প্রথম মুদ্রিত হয় যোগীন্দ্রনাথের লেখা কবির ‘জীবনচরিত’-এ। মৃত্যু অল্পপূর্বে রচিত কবিতাটি গৃহের ছিন্ন কাগজের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল।
    ৬. অসমাপ্ত কবিতা। মধুসূদনের অসম্পূর্ণ রচনাগুলির একটি তালিকা সঙ্কলন করা হল।

নাম          শ্রেণীপরিচয়      রচনাকাল             কী পরিমাণ রচিত হয়েছিল

সুভদ্রা       নাট্যকাব্য   ১৮৫৯ সালের শেষ দিক কিংবা ১৮৬০ সালের প্রথম দিক।   

                           দুই অঙ্ক সমাপ্ত করেছিলেন। কিন্তু কিছুই একালের হাতে এসে পৌঁছোয়নি।

রিজিয়া    নাটক    (অমিত্রাক্ষর ছন্দে এবং গদ্যে)     ১৮৬০ সালের এপ্রিলের পূর্বে।   

 খুব অল্পই লেখা হয়েছিল। আলতুনিয়ার একটি স্বগতোক্তিমূলক সংলাপের কতকাংশ মাত্র পাওয়া গিয়েছে।

‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’-এর কবিতা     ‘বিহার’ নামক ২য় সর্গ      কবিতা     ১৮৬০ সালের এপ্রিলের পূর্বে।    মাত্র তিনটি স্তবক লেখা হয়েছিল।

সিংহল-বিজয়           মহাকাব্য        ১৮৬১ সালের মাঝামাঝি।      গোড়ার কয়েকটি পংক্তি মাত্র লেখা হয়েছিল।

‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর ২য় খন্ড       কবিতা        ১৮৬২ সালের ফেব্রুয়ারির পরে।    খন্ডিত পাঁচটি কবিতা। একটি কবিতার দুটি পাঠভেদ।

দ্রৌপদী স্বয়স্বর
মৎস্যগন্ধা
সুভদ্রাহরণ
পান্ডববিজয়

দুর্যোধনের মৃত্যু       ভারত বৃত্তান্তের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাহিনীকাব্য বা একটি মহাকাব্য (?)             ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৪-এর মধ্যে।     

কবিতাগুলির স্বল্পাংশ মাত্র লিখিত হয়েছিল।

দেবদানবীয়ম্       ব্যঙ্গকবিতা        জীবনের শেষ ভাগে      কয়েকটি চরণ মাত্র লেখা হয়েছিল।
   

ব্রজঙ্গনা কাব্যের ‘বিহার’ নামক দ্বিতীয় সর্গ লেখার পরিকল্পনা কবির ছিল। প্রথম সর্গ সমাপ্ত করার পর ‘বিহার’ নামক একটি কবিতার তিনটি স্তবক লিখেছিলেন। কবির একটি পুস্তকের মলাটের পৃষ্ঠায় এই অংশটি পাওয়া গিয়েছিল।
    বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রসঙ্গে কবির যেসব পত্রাংশ উদ্ধৃত হয়েছে তাতে দেখা যায় কাব্যটির একটি দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশের পরিকল্পনা তাঁর ছিল। এই উদ্দেশ্যে একাধিক কবিতা লেখায় তিনি হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু মানস-অস্থৈর্যের জন্য কোনোটিই শেষ করতে পারেননি। এই ভগ্ন চেষ্টাগুলি ১৮৬২ সালের, য়ুরোপ-যাত্রার পূর্বে। ‘ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি গান্ধারী’, ‘অনিরুদ্ধের প্রতি ঊষা’, ‘যযাতির প্রতি শমিষ্ঠা’, ‘নারায়ণের প্রতি লক্ষ্মী’, [এই কবিতার দুটি পাঠভেদ, একটি আবার ‘বিষ্ণুর প্রতি লক্ষ্মী’ এই ভিন্ন নামে ‘প্রবাসী’ ১৩১১ আশ্বিন প্রকাশিত হয়।], ‘নলের প্রতি দময়ন্তী’ এই পাঁচটি কবিতার অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছে। নগেন্দ্রনাথ সোম ‘ভীমের প্রতি দ্রৌপদী’ নামক অপর একটি কবিতার অংশবিশেষ রচিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
    ‘রিজিয়া’র যে অংশটুকু পাওয়া গিয়েছে তা কবির পরিকল্পিত ওই নামের নাটকের স্বগত-সংলাপ। রিজিয়া নাটকের একটি পরিকল্পনা করে কবি কেশববাবুর মারফত বেলগাছিয়া থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পরিকল্পনাটি এই গ্রন্থে সংকলিত হল। পরিকল্পনাটির প্রথমে কবি চরিত্রগুলির পরিচয় দিয়েছেন। পুরুষ চরিত্রগুলির মধ্যে রিজিয়ার ভ্রাতা এবং পরবর্তী সম্রাট বাইরাম, সিন্ধুর শাসনকর্তা আলতুনিয়া, রিজিয়ার প্রণয়ী জামাল নামক ক্রীতদাস, মনোহর সিংহ নামক রাজপুত সেনাপতি প্রধান। এ ছাড়া আছে আলতুনিয়ার বন্ধু কেবর্ক এবং বালিন, মস্ত নামক এক মাতাল, জনৈক দালাল প্রভৃতি। নারী চরিত্রগুলির মধ্যে সম্রাজ্ঞী রিজিয়া, সম্রাজ্ঞীর দুই পরিচারিকা, পারস্যগত সেরী এবং হিন্দু বালিকা লীলাবতী আর আছে মস্তের স্ত্রী মেহদী। এর পর কবি একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা লিখে নাটকটির দৃশ্যবিভাগ বিষয়েও পরিকল্পনার উল্লেখ করেছিলেন। যোগীন্দ্রনাথ বসুর জীবনচরিতে এটি প্রথম মুদ্রিত হয়। নাটকটি অংশত অমিত্রাক্ষর ছন্দে এবং অংশত গদ্যে লিখবার ইচ্ছা তাঁর ছিল। আলতুনিয়ার প্রারম্ভিক স্বগত-সংলাপের কতকটামাত্র লেখা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে বেলগাছিয়া থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের উৎসাহের অভাব কবিকে নিবৃত্ত করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় মাদ্রাজ প্রবাসকালে কবির লেখা ইংরেজি কাব্যনাট্য 'Rizia-the Empress of Inde'-এর কথা।
   

 মহাভারতের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কবি কয়েকটি আখ্যানকাব্য লিখতে চেয়েছিলেন। ‘সুভদ্রা হরণ’ প্রসঙ্গে সম্ভবত একটি পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য লিখবার বাসনাই তাঁর ছিল। “ভারতবৃত্তান্ত” নামটি একস্থানে সাধারণ শিরোনাম রূপে কবি ব্যবহারও করেছেন। যে কবিতাগুলির অংশ পাওয়া গিয়েছে তা হল-‘দ্রৌপদীস্বয়ম্বরা’, (এ শিরোনামে দুটি কবিতার অংশ মিলেছে। মনে হয় প্রথমটি পছন্দ না হওয়ায় দ্বিতীয়টি লিখেছিলেন কবি, কিন্তু সেটিও পছন্দ না হওয়ায় আরম্ভের সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যক্ত হয়েছে।) ‘মৎস্যগন্ধা’, সুভদ্রাহরণ’, ‘পান্ডববিজয়’ এবং ‘দুর্যোধনের মৃত্যু’। ১৮৬৪-৬৫-তে সনেটের নূতন রীতিতে সাফল্যলাভ করবার সঙ্গে-সঙ্গেই কবি এজাতীয় ব্যর্থ চেষ্টার উপরে যবনিকা টেনে দিয়েছিলেন।
    ‘সিংহল-বিজয়’-এর কাহিনী নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনার ইচ্ছা কবির ছিল। রাজনারায়ণ বসু তাঁকে একটি পরিকল্পনাও দিয়েছিলেন। কবি রাজনারায়ণ বসুর কাছ থেকে কাহিনীটি নিয়ে নিজেই একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। কবির পরিকল্পনাটি এই গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। যোগীন্দ্রনাথ বসুর গ্রন্থ থেকে এটি সঙ্কলিত।
    কবির পরিকল্পনা পড়ে মনে হয় হোমারের ‘ওডেসি’ মহাকাব্যের আদর্শটি কবি অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। ট্রয় ধ্বংসের পরে সমুদ্রপথে অদিস্যুস দেবতাদের চক্রান্তে যেভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন কবি বিজয়সিংহের সিংহলযাত্রায় সেই সুরই বাজাতে চেয়েছিলেন।
    তখন কবির শিল্পক্ষমতা পূর্ণতেজে দীপ্যমান ছিল। কিন্তু কয়েকটি সুমার্জিত পংক্তির বেশি তিনি লিখতে পারেননি। মেঘনাদবধ কাব্য রচনার পরে নূতন মহাকাব্য রচনা আর সম্ভব ছিল না, অন্তরের গভীরে এই বোধে তিনি পৌঁছেছিলেন।
    ‘দেবদানবীয়ম্’ নামক অংশটি ইউরোপ-প্রবাসের পরে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে লেখা। বাংলা ১৯২০ সালের ‘আর্যদর্শন’ পত্রিকায় এই কবিতাংশটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত সংস্কৃত ছন্দে বাংলা কবিতা লেখার চেষ্টার প্রতি ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্য ছিল কবির।
নাটক ও প্রহসন
মধুসূদন বাংলা নাট্যসাহিত্যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশ্চাত্য নাট্যরীতির প্রতিষ্ঠা ঘটল তাঁরই সাধনায়। প্রথম ঐতিহাসিক নাটক, উল্লেখযোগ্য ট্র্যাজেডি, ইংরেজি ধরনের প্রহসন তিনিই লিখলেন। তবে প্রথম দিকে সংস্কৃত নাট্যরীতির সঙ্গে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাচ্য আদর্শের কাছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আনুগত্য স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। বেলগাছিয়া নাট্যশালা মধুসূদনকে নাট্যরচনায় আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলা সাহিত্যের মহৎ উপকার করেছে একথা যেমন সত্য, তেমনই নাট্যবস্তু এবং নাট্যরস সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষের পুরাতন দৃষ্টিভঙ্গি মধুসূদনের প্রতিভার পক্ষে বন্ধনও হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর নূতন পরীক্ষানিরীক্ষা সেখানে সমর্থন পায়নি। আসলে নাট্যকার মধুসূদন ছিলেন তাঁর নিজের ভাষায় "too early for the age"।
   

মধুসূদনের প্রতিভার মধ্যেও উচ্চ নাট্যসৃজনের পক্ষে একটি বড় বাধা ছিল। তা হল কবিত্ব। কিন্তু তবুও দু-খানি উচ্চাঙ্গের প্রহসন তিনি লিখেছিলেন। কৃষ্ণকুমারীও নানাবিধ দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলা নাট্যসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে একখানি প্রধান নাটক বলেই গণ্য হবে।
   
    শর্মিষ্ঠা নাটক। শর্মিষ্ঠা নাটক মধুসূদনের প্রথম বাংলা রচনা। সমকালে লেখা অনেকগুলি চিঠিতে এর বিষয়ে নানা কথা বলেছেন কবি।
    শর্মিষ্ঠার মূল্য যতটা ঐতিহাসিক ততটা সাহিত্যিক নয়। নাটক হিসেবে যুগোত্তীর্ণ হবার উপকরণ এর মধ্যে নেই। সমকালীন সমালোচকদের প্রশংসাবাণীতে ইতিহাসের উল্লাস ধ্বনিত হয়েছে, রসিকের বিচার সেখানে আবৃত।
   
    একেই কি বলে সভ্যতা? বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। প্রহসনদুটি একই সঙ্গে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। সে কারণে এদের পরিচয় একসঙ্গেই দেওয়া হল। ১৮৫৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে শর্মিষ্ঠা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। অব্যবহিত পরে প্রহসন অভিনয় করার কথা ছিল। জুন-এর মধ্যে প্রহসন লেখা নিশ্চয়ই শেষ হয়েছিল। জুলাই মাস পড়বার আগে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য লেখা আরম্ভ হয়। হাতের কাজ শেষ না করে কবি তাঁর প্রথম কাব্যরচনা শুরু করেননি।
    প্রহসনদুটি বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হল না। প্রভাবশীল মহল থেকে এজাতীয় ব্যঙ্গাত্মক রচনা সম্পর্কে আপত্তি করায় ঈশ্বরচন্দ্র-প্রতাপচন্দ্র প্রহসন অভিনয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করেছিলেন।
    কিন্তু ছোট রাজার অর্থানুকূল্যে প্রহসনদুটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হল। প্রকাশকাল ১৮৬০ সালের প্রথম দিকে। প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্র উদ্ধৃত হল।
        একেই কি বলে সভ্যতা? / (প্রহসন)। / শ্রীমাইকেল মধুসূদন দত্ত / প্রণীত। / -“ন     প্রিয়ং প্রবক্তুমিচ্ছন্তি মৃষা হিতৈষিণঃ।” কিরাতার্জুনীয়ং। / কলিকাতা। / শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং     বহু বাজারস্থ ১৮৫ সংখ্যক ভবনে / ইষ্টান্হোপ যন্ত্রে যন্ত্রিত। / সন ১২৬৬।
         বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ / (প্রহসন)। / শ্রীমাইকেল মধুসূদন দত্ত / প্রণীত। /     কলিকাতা। / শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং বহুবাজারস্থ ১৮৫ সংখ্যক ভবনে / ইষ্টান্হোপ যন্ত্রে     যন্ত্রিত। / সন ১২৬৬। /
    প্রথমটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৮, দ্বিতীয়টির ৩২।
    মধুসূদনের জীবিতকালে এদের আর একটি মাত্র (দ্বিতীয়) সংস্করণ প্রকাশিত হয় বাংলা ১২৬৯ সালে। সংস্করণদুটির মধ্যে উল্লেখ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বর্তমান রচনাবলীতে দ্বিতীয় সংস্করণই আদর্শরূপে অনুসৃত হয়েছে।
    মধুসূদন লিখবার সময়ে দ্বিতীয় প্রহসনটির নাম দিয়েছিলেন ‘ভগ্নশিবমন্দির’। তাঁর একটি চিঠি থেকে এ সংবাদ পাওয়া যায়। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ রাখা হয়।
    রচিত হবার বহুকাল পরে প্রহসনদুটির প্রথম অভিনয় হয়। ১৮৬৫ সালের ১৮ জুলাই শোভাবাজার থিয়েট্রিকাল সোসাইটি কর্তৃক ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ১৮৬৬ সালে আরপুলি নাট্যসমাজ কর্তৃক ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রথম অভিনীত হয়। পরবর্তী কালে দীর্ঘদিন ধরে এদের অভিনয় নাট্যরসিক-মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
    মধুসূদন নিজেও প্রহসন লিখতে গিয়েই প্রথম সংস্কৃত ক্লাসিক রীতির অনুবর্তন থেকে মুক্তির পথ করে নিলেন। দুটি প্রহসনই ঘটনার প্রত্যক্ষতায়, দ্বন্দ্বে, চিত্তচাঞ্চল্যে, মুহুর্মুহু চমকে পাঠক-দর্শকের চিত্তে খাঁটি নাটকীয় রস পরিবেশন করতে পেরেছে।
    মধুসূদনের সমাজদৃষ্টির সমগ্রতাও আলোচনার বস্তু। সমকালে রচিত প্রহসনগুলি সাধারণত কৌল্যন্য প্রথা, বিধবাবিবাহ-আন্দোলন প্রভৃতি সমাজসংস্কারমূলক প্রশ্নগুলিকে বিষয়বস্তু রূপে গ্রহণ করেছে। মধুসূদন কিন্তু সমকালীন বাঙালিজীবনে আধুনিকতা এবং প্রাচীনত্বের বিকৃতি দেখিয়ে, ইংরেজিসংস্পর্শজাত সমাজচাঞ্চল্যের মূলে হাত দিয়েছেন। একদিকে নবযুগের জীবনসত্যকে গভীর গাম্ভীর্যে যেমন আয়ত্ত করেছেন কবি কাব্যগুলিতে, অন্যদিকে এ যুগের লঘু অসঙ্গতির ভিত্তিটি রূপায়িত করেছেন প্রহসনে।
    প্রহসনদুটিই চরিত্রসৃষ্টি এবং সংলাপ-রচনার দিক থেকে উচ্চ প্রশংসার যোগ্য। কলকাতার কথ্যভাষা এমনকী ‘সংখ্যা’ পর্যন্ত অনায়াসে সাহিত্যভাত করেছেন তিনি। অপরপক্ষে যশোহরের গ্রাম্য ভাষাকে সংলাপে স্থান দিয়েছেন। ফলে এই দুটি রচনায় সংলাপ জীবনের উত্তাপে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। একই ভাষা-কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য প্রতিফলিত হয়েছে। চরিত্রগুলির মধ্যে প্রহসনোচিত সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতা আছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত। তাদের আচরণ ও কথায় যেমন স্বতন্ত্র মনুষ্যত্বের লক্ষণ প্রকট, তেমনি ধমনীতে উদ্দাম রক্তস্রোত অনুভূত।
   
    পদ্মাবতী নাটক। পদ্মাবতী নাটক লেখা আরম্ভ হয় ১৯ মার্চ, ১৮৫৯ সালের আগে। চতুর্থ অঙ্ক শেষ হবার পরে কবি কিছুকাল পদ্মাবতী নাটক অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছিলেন বলে মনে হয়। কারণ ৮ মে ঈশ্বর সিংহ শর্মিষ্ঠার পরে অভিনয় করবার উপযোগী প্রহসন দ্রুত লিখে দিতে অনুরোধ করেন। সম্ভবত প্রহসনদুটি শেষ করে তিনি অসমাপ্ত পদ্মাবতী নাটকে হাত দেন। পদ্মাবতীর প্রথম চার অঙ্কে নানাবিধ দুর্বলতা সত্ত্বেও প্রাণের স্পর্শ ছিল, বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষাও ছিল। কিন্তু প্রহসনদুটিতে তিনি অনেক উন্নত নাট্যকলা আয়ত্ত করে ফেললেন। পদ্মাবতী আর তাঁকে আকর্ষণ করতে পারল না। নাটকটি সম্পূর্ণ করার তাগিদে পঞ্চমাঙ্ক লেখা। এটি নিষ্প্রাণ এবং অনুকরণাত্মক।
    পদ্মাবতীর শেষ অঙ্কও জুলাই মাসের আগে (১৮৫৯ সালে) সমাপ্ত হয়েছিল। কারণ, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে হাত দেবার আগে অসম্পূর্ণ লেখাগুলি তিনি নিশ্চয়ই শেষ করে নিয়েছিলেন।
    ১৮৬০ সালের ২৪ এপ্রিলের পরে এবং ১৫ মে-র আগে পদ্মাবতী নাটক প্রকাশিত হয়েছিল। পদ্মাবতীতে প্রচলিত প্রথার বাহিরে কৌতুকসৃষ্টিতে সাফল্যের উল্লেখ্য চিহ্ন আছে, আর আছে সংলাপে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহারের প্রথম ঐতিহাসিক প্রয়াস।
    তিনটি দেবনারীর চরিত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন কবি। ইন্দ্রনীল মামুলি সংস্কৃত প্রেমনাট্যের নায়ক। নাট্যারম্ভে তার চরিত্রে যে লঘু লাস্যলীলা দেখানো হয়েছে কাহিনীর উত্তরার্ধে প্রাপ্ত পরিচয়ের সঙ্গে তা সঙ্গতিহীন। নায়িকা পদ্মাবতীও একেবারেই বিবর্ণ।
   
    কৃষ্ণকুমারী নাটক। মধুসূদন ‘রিজিয়া’র কাহিনী অবলম্বন করে এক নাটক লিখবার পরিকল্পনা করেছিলেন। বেলগাছিয়া থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ মুসলমানী বিষয়ের প্রতি অনীহা প্রকাশ করলেন। বিশিষ্ট অভিনেতা কেশব গঙ্গোপাধ্যায় কবিকে রাজপুত ইতিহাস অবলম্বন করে নাটক লিখতে পরামর্শ দিলেন। মধুসূদন টডের রাজস্থান পড়তে লাগলেন এবং সেখান থেকে তাঁর নূতন নাটকের উপাদান সংকলন করলেন।
    রাজানারায়ণ বসুকে লেখা মধুসূদনের চিঠিগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মেঘনাদবধ কাব্য লিখতে লিখতে তিনি কৃষ্ণকুমারী রচনায় হাত দেন। ৩ অগাস্ট ১৮৬০ সালে কাব্যের দ্বিতীয় সর্গ লেখা শেষ হয়েছে বলে কবি বন্ধুকে জানান।
    কৃষ্ণকুমারী নাটক লেখা শেষ হবার প্রায় এক বছর পরে ১৮৬১ সালের শেষভাগে প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা ১১৫। আখ্যাপত্রটি এখানে উদ্ধৃত হল।
    ১৮৬০ সালে ৭ সেপ্টেম্বর কৃষ্ণকুমারী রচনা শেষ হলেও দীর্ঘ সাত বছর পরে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৭ সালে শোভাবাজার নাট্যশালায় এটি প্রথমবার অভিনীত হয়।
    কৃষ্ণকুমারী নাট্যগঠনে নিপুণতার পরিচয় আছে। টডকে অনুসরণ করায় সমস্যা দেখা দিতে পারত, ইতিহাস-ঘটনার মধ্যে গল্পসূত্র হারিয়ে যাবারই ছিল বেশি সম্ভাবনা। মধুসূদন সুকৌশলে এই সমস্যার সমাধান করেছেন। প্রথমত মদনিকা-ধনদাস-বিলাসবতীর প্রসঙ্গটি নিয়ে এসে বিচিত্র মানসিক প্রবৃত্তির সহযোগে, দ্বিতীয়ত মদনিকার চেষ্টায় মানসিংহের প্রতি কৃষ্ণকুমারীর ভালোবাসার উদ্ভব ঘটিয়ে নাটকটিকে হৃদয়বৃত্তির বিচিত্র তরঙ্গদোলায় ঊদ্বেল করে তোলা হয়েছে। ইতিহাস-ঘটনাকে বিকৃত না করে, একান্ত স্বাভাবিক কল্পনার সাহায্যে তিনি এইসব মানবিক প্রসঙ্গকে স্থান দিয়েছেন নাট্যমধ্যে। ফলে নাটকটি ঐতিহাসিক ঘটনাপরস্পরায় পরিণত না হয়ে বৃত্তাকার কাহিনীর রূপ পেয়েছে।
    মধুসূদন কৃষ্ণকুমারীর কাহিনীকে রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক পরিমন্ডলে স্থাপন করলেও প্রত্যক্ষ পরিবার-জীবন এবং ব্যক্তিগত চিত্তবৃত্তির উপরেই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অথচ এটি একটি পারিবারিক বিপর্যয় ও ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা-বেদনার কাহিনীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
        “যুগসন্ধির সব বেদনা, অসহায়তা, দুর্বলতা ও শক্তিহীনতা একটা ধ্বংসমুখী জাতির     অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস এবং বর্তমান নীচতার চরমে নেমে গিয়ে আর্তনাদ     কৃষ্ণকুমারীর কাহিনীর চারপাশে মহাকালের রুদ্র নৃত্যকে যেন বেঁধে রেখেছে। একটি রাজকন্যার     বিবাহকে কেন্দ্র করে উত্থিত ধূলিজালে সারা দেশের এবং জাতির জীবনে একটি মহাযুগ     পরিবর্তনের অস্থিরতা ধরা পড়েছে। মধুসূদনের এক আঙ্গুল যখন একটি রাজকন্যার মৃত্যুর করুণ     সুর বাজিয়েছে তখন তাঁর আর চার আঙ্গুলের পেছনের বহু তারে ঝঙ্কার উঠেছে। তাতে     ইতিহাসের ব্যাপকতা, বিস্তৃতি ও গাম্ভীর্য ব্যঞ্জিত হয়েছে।”
    হেক্টর-বধ। ‘হেক্টর-বধ’ অনুবাদধর্মী গ্রন্থ। হোমারের ‘ইলিয়াড’ কাব্যের কাহিনী সংক্ষিপ্তাকারে পরিবেশন করা কবির উদ্দেশ্য ছিল। তবে সংক্ষিপ্ত কাহিনীও মূলের যথাসম্ভব অনুসরণ করেই বলতে চেয়েছিলেন কবি। ছয়টি পরিচ্ছেদে মূল কাব্যের বারোটি সর্গের কাহিনী বিবৃত করেছেন কবি। অপর বারোটি সর্গের কাহিনী আর বলা হয়নি। অসমাপ্ত আকারেই বইটি ১৮৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হল।
ইংরেজি রচনাবলী
মধুসূদন কৈশোর থেকেই ইংরেজি কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন। ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করবার বাসনাই কবির ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার মুখ্য কবিরূপেই তিনি খ্যাত হয়েছেন। এখন তাঁর ইংরেজি কবিতার মূল্য তাদের শিল্পোৎকর্ষের জন্য নয়, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির প্রস্তুতিকালীন রচনা বলেই এরা বিচার্য।
    Poems, Other Poems.  মধুসূদনের ইংরেজি কবিতাগুলি সমকালীন নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দু কলেজে ছাত্র থাকাকালে অনেকগুলি কবিতা তিনি লিখেছিলেন। তাদের উৎসাহী পাঠক ও স্তুতিগায়কের অভাব ছিল না। এই কবিতাগুলি ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’, ‘গ্লীনর’, ‘ব্লসম’, ‘কমেট’ প্রভৃতি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হত।
    পরবর্তী কবিতাগুলি মাদ্রাজ-প্রবাসে রচিত। মাদ্রাজে তিনি ‘মাদ্রাজ সার্কুলেটর অ্যান্ড জেনারেল ক্রনিক্ল’, ‘স্পেকটেটর’, ‘এথেনিয়াম’, ‘হিন্দু ক্রনিক্ল’ প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখতেন। প্রথমোক্ত পত্রিকায় "Timothy Penpoem"  ছদ্মনামে নিয়মিত কবিতা লেখা চলত। "Disjecta Membra Poetae" (কবি এই লাতিন শিরোনাম হোরেস থেকে গ্রহণ করেছিলেন। এর ইংরেজি অর্থ হল "The Limbs of the Dismembered Poet") এবং 'Sonnets' শীর্ষক দুটি সিরিজে টি. পি. অনেকগুলি কবিতা লিখেছিলেন বলে জানা যায়। ‘ক্যাপটিভ লেডি’ এবং ‘ভিসন্স্ অব দি পাস্ট’ স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছিল।
    ক্যাপটিভ লেডি কাব্যটির গুরুত্ব মধুসূদনের জীবনে অসাধারণ। এই কাব্যটি পাঠ করে বেথুন সাহেব তাঁকে মাতৃভাষা চর্চা করার উপদেশ দেন। সে উপদেশ মধুসূদনের মনের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৮৪৯-এর পরে কবির লেখা ইংরেজি কবিতার প্রকাশ বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছিল, প্রসঙ্গত এই তথ্যটি লক্ষ করবার মতো।
    ক্যাপটিভ লেডিতে কবির ইংরেজি কাব্যসাধনার সবচেয়ে পরিণতরূপ দেখতে পাই। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল কবির অন্তর-পুরুষের সংকটটি প্রকট করে তোলায়। কবি ইংরেজি ভাষায় ভারতের ইতিহাসকথা বলেছেন। কালী, রুদ্র, লক্ষ্মীদেবীর প্রসঙ্গ, অগ্নিদেব, সরস্বতীর বর্ণনা কাব্যটির প্রধান অংশ জুড়ে আছে। এ যেন ইংরেজি ভাষায় বাঙালির কল্পনাধৃত দেশীয় পুরাণকাহিনী ও পৌরণিক দেবলোকের এক চিত্রপ্রদর্শনী। কিন্তু সেজাতীয় কাব্যজগৎ- জাতীয় ভাষা কবির কল্পনায়ও এখনও ধরা পড়েনি। অবশ্য এই সংকট প্রমাণ করে তাঁর কবিপ্রতিভা কতটা খাঁটি ছিল। এবং এরই ফলে শর্মিষ্ঠা-তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে তিনি এত সহজে নিজের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।
    তাঁর কলকাতায় ফিরে আসার পরে ইংরেজি কবিতা লেখার কোনো প্রকৃত চেষ্টা চোখে পড়ে না।