অতি প্রাচীনকাল থেকে মরুভূমির মানুষের কাছে একটি প্রয়োজনীয় গাছের নাম বাওবাব। গ্রীষ্মকালে যখন তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশী তখন মরুভূমিতে পানি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। মরুভূমির কিছু কিছু বৃক্ষ এবং ক্যাকটাস তাদের শরীরে পানি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল বাওবাব বৃক্ষ। এই বৃক্ষ এত পরিমাণ পানি ধারণ করে রাখতে পারে যা মানুষের ধারনার অতীত। এর পানি ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১ লাখ লিটার। অর্থাৎ ১০০টি এক হাজার লিটার পানির ট্যাঙ্কে যত পানি ধারণ করা সম্ভব একটি বাওবাব বৃক্ষ সেই পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করে রাখতে সক্ষম।
বাওবাব বৃক্ষের নয়টি প্রজাতি পৃথিবীতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ছয়টি প্রজাতি পাওয়া যায় মাদাগাস্কারে, আফ্রিকায় দুইটি প্রজাতি এবং অস্ট্রেলিয়ায় একটি করে প্রজাতি পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়াতে এই গাছকে বলা হয় “বোতল গাছ”। সাধারণত এটি লম্বায় প্রায় ৫-৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং ব্যাস হতে পারে ৭-১১ মিটার পর্যন্ত। কিন্তু ৪৭ মিটার লম্বা ও ১৫.৯ মিটার চওড়া গাছের সন্ধান ও পাওয়া গেছে।
বাওবাব গাছের জেনাস নাম
Adansonia. এই নামকরণ করা হয়েছে ফ্রান্সের প্রকৃতিবিদ মাইকেল এডানসন এর নাম অনুসারে। তিনিই প্রথম বাওবাব গাছের একটি প্রজাতির নামকরণ করেন
Adansonia digitata. প্রজাতির ভিন্নতায় বাওবাব গাছের আকার ও আকৃতির কিছুটা হেরফের হতে পারে। কিন্তু সেটা খুবই সামান্য।
বাওবাব গাছের নিচের অংশ গোলাকার এবং কোন শাখাপ্রশাখা নেই বললেই চলে। উপরের দিকে ঝাড়ুর মত কিছু শাখা প্রশাখা রয়েছে। বার মাসের নয় মাসই বাওবাব গাছের কোন পাতা থাকে না। গাছের পাতা ঝড়ে গেলে মনে হয় এই গাছের ডালপালা সব মাটির নিচে এবং শিকড় গুলো সব মাটির উপরে অর্থাৎ গাছটি উল্টো করে লাগানো। এই কারণে একে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক মজার গল্প। যা শুধু রূপকথার বইতেই বেশি মানায়। সব চেয়ে বেশি প্রচলিত গল্পটি এরকম। বাওবাব গাছের আদি নিবাস ছিল স্বর্গে। একদিন শয়তানের মাথায় এক বদ খেয়াল চাপল। সে স্বর্গ থেকে বাওবাব গাছটি উপড়ে এনে পৃথিবীতে উল্টো করে গেড়ে দিল। সেই থেকে বাওবাব গাছে উল্টো হয়ে রয়েছে।
আরও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে সেটি এরকম। ধারনা করা হয় বাওবাব গাছ পৃথিবীর প্রথম ডাঙ্গার গাছ। এরপর আসে তাল, নারিকেল। পাম গাছগুলো যখন সরু কাণ্ড নিয়ে তরতর করে লম্বা হয়ে এ গাছকে ছাড়িয়ে যেতে লাগল, তখন বাওবাব পাম গাছের মতো লম্বা হওয়ার জন্য কান্না জুড়ে দিল। এরপর যখন লাল ফুলের শোভা নিয়ে হাজির হল শিমুল গাছ, তখন বাওবাব গাছ চাইল তার ডালেও যেন ওরকম ফুল ফোটে। এরপর একদিন বাওবাবের দেখা হল অনন্য সুন্দর ডুমুরের সঙ্গে। বাওবাব চাইল ডুমুরের মতো ফল ধরুক। বাওবাবের এত ইচ্ছার কথা শুনে ঈশ্বর রেগে গিয়ে ওটাকে উপড়ে ফেলেন এবং পরে আবার মাটিতে পুঁতে দিলেন উল্টো করে। সেই থেকে নাকি উল্টো হয়ে জন্মাচ্ছে বাওবাব! এইসব গল্প সেখানকার আদিবাসীদের মুখে মুখে ফেরে। এমন আরও অনেক মজার মজার গল্প বাওবাব গাছকে ঘিরে গড়ে উঠেছে।
বাওবাব গাছ অনেক দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এমন একটি বাওবাব গাছের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল যার বয়স প্রায় ১২৭৫ বছর। অনেক বছর টিকে থাকার জন্য এই গাছকে প্রতিকূল আবহাওয়ার সাথে লড়াই করতে হয়। আর প্রতিকূল আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য এই গাছে ঘটেছে বিশেষ ধরনের অভিযোজন।

এর মূলগুলো অনেক মোটা। তাই এটির পানি শোষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। এর রয়েছে নিজস্ব পানি ধারণ ক্ষমতা। আফ্রিকায় যখন পানির তীব্র সংকট দেখা যায় তখন সেখানকার যাযাবর মানুষরা এই গাছ থেকে পানি সংগ্রহ করে। অনেক মানুষ সেই পানি খেয়ে জীবন বাঁচায়। বাওবাব গাছের ফল দেখতে লাউয়ের মত। এই ফলের উপরটা শুকনো। বানরের প্রিয় খাবার এই বাওবাব গাছের ফল। তাই বাওবাব গাছকে কেউ কেউ “মাংকি ব্রেড ট্রি” বলেও ডাকে।
বাওবাব গাছের বাকল অনেক মোটা হয়। এর বাকল হয় শক্ত ও আঁশ যুক্ত এবং লম্বা। তাই এর বাকল দিয়ে তৈরি করা যায় রশি ও কাপড় তৈরির জন্য সুতা। এই গাছের ফল খাওয়া যায় এবং পাতা থেকে চাটনি তৈরি করা যায়। এছাড়া এই গাছের পাতা থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধও তৈরি হয়। গাছের কাণ্ড এতো বিশাল যে, এর গুড়ির গর্তে মানুষ বসবাস করতে পারে। মরু ঝড়ে মানুষ এই গাছের গুড়ির গর্তে আশ্রয় নিয়ে থাকে। অর্থাৎ মরুভূমির মানুষের কাছে একটি উপকারী বৃক্ষ বাওবাব গাছ।