ছবি সংগৃহীত

বাল্যবিয়ে রোধ: চাই সামাজিক সচেতনতা

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২১:২৭
আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২১:২৭

(প্রিয়.কম) নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে বাল্যবিয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলো না ১০ বছরের শিশু রোজিনা। উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নের কেরণখলা গ্রামের আব্দুল বারেক ও শাহিনা খাতুন তাদের ১০ বছরের কন্যা রোজিনা আক্তার হারিছাকে একই ইউনিয়নের চন্ডিগড় গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে নূরুল হকের সঙ্গে রেজিস্ট্রিবিহীন বাল্যবিবাহ দিয়েছেন। ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এ ঘটনা ঘটে। এ বিয়েতে কন্যাপক্ষ থেকে বরকে ৯০ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে। 

আরেক দুর্ভাগা মেয়ের নাম রেবেকা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় ৩৯ বছর বয়সী এক লোকের সঙ্গে। যৌতুকের ভয়ে রেবেকাকে প্রবীণ ওই লোকটির হাতে তুলে দেয় তার মা-বাবা। স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু রেবেকার জীবনে সেই সুযোগ নেয়া হয়ে ওঠেনি। মুকুলিত হওয়ার আগেই সে অভিশপ্ত হয়ে পড়ে। বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক আগেই তার লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দেয়া হয়। এর পরের অধ্যায় আরো করুণ। মেয়েটি এখন স্বামীর কারণে গোপন ও জটিল রোগে আক্রান্ত। জরায়ুতে আলসারের জন্য তাকে দু’বার অপারেশন টেবিলে যেতে হয়েছে। রেবেকা বাংলাদেশের মেয়ে। কিন্তু তার জীবনের এই মর্মান্তিক কাহিনী ওয়াশিংটনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্র থেকে সংগৃহীত। 

কুমিল্লার চান্দিনায় বাল্যবিয়ে বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট স্কুলছাত্রীকে উপবৃত্তি দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন চৌধুরী। গত ৩১ জানুয়ারি বিকেলে চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে ইউএনও সুমন চৌধুরী প্রশাসনের তহবিল থেকে স্কুলছাত্রী লিজার হাতে নগদ ২ হাজার টাকা তুলে দেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে শ্বশুর বাড়িতে নয়, সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে লিজা। ২৮ জানুয়ারি উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের কামারখোলা গ্রামের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী লিজার বাল্যবিয়ের আয়োজন চলছিল। খবর পেয়ে ইউএনও নিজে বিয়ে বাড়িতে চলে যান। তিনি লিজাকে বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেন। একই সঙ্গে ‘আর বাল্যবিয়ে দেবে না’ এই মর্মে উভয় পক্ষই অঙ্গীকার করে। পরে এই দুষ্কর্মের জন্য অভিভাবকদের জরিমানা করা হয়। 

আমাদের দেশে অনেক রোজিনা আছে, যাদেরকে মাত্র ১০ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে।রেবেকাদের রোগ শোক শেষ জীবন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। শুধুমাত্র বাল্যবিয়ের কারণে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনের সহায়তায় তাদের মত মেয়েরা বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে বটে। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। বিষয়টি বড়োই উৎকণ্ঠার। 

বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ৭৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের হার মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ‘গেটিং দি এভিডেন্স: এশিয়া চাইল্ড ম্যারেজ ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। সম্প্রতি এ গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। 

গবেষণায় বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের বাল্যবিয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তবে, এটি একেকটি দেশের জাতীয় চিত্র নয় বলেও উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। 

বাল্যবিবাহের অন্তর্নিহিত কারণ ও প্রভাবক বিষয়ক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সে। ইন্দোনেশিয়ায় এ বয়সীদের হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ায় ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে ৩৮ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ছেলেদের বেলায় এ হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। পাকিস্তানে ১৮ বছর বয়সের আগে মাত্র ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এ হার ১৩ শতাংশ।

বেসরকারি সংস্থা ম্যাস-লাইন মিডিয়ার এক জরিপে ১ জানুয়ারি থেকে ১ মার্চ- ২০১৪ পর্যপ্ত সারা দেশে মোট ৩০৩টি বাল্যবিবাহের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১১২ জন শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এসব বিবাহের বিপরীতে মামলা হয়েছে মাত্র ৭টি, গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ জনকে এবং বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে ৩৭টি।

বর্তমান সরকার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অঙ্গীকারবদ্ধ। নারীর ক্ষমতায়ন বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। নারীদের উন্নয়নে জন্য এ সরকার নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিবাহের সংখ্যা শূন্যে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৮ বৎসরের নিচে বিয়ের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে।

দারিদ্র্যের কারণে বিদ্যমান সামাজিক অবস্থায় নারীকে বোঝা মনে করা হয়। তাই বাবা-মা ও অভিভাবকরা চান যত দ্রুত সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাবের ফলেই এমনটি হয়ে থাকে। বাল্যবিয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয় নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাবেই ঘটে থাকে এমনটি। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অধিকাংশ মেয়েই আর স্কুল যেতে পারে না। ফলে শিক্ষার আলোবঞ্চিত হয় তারা। সেই সাথে নারীর ভবিষ্যত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। বাল্যবিবাহের ফলে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যু, দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি নারীর স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা দেয়। বাল্য বিয়ে শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোরই নয়, এটা সারা বিশ্বের সমস্যা। ওয়াশিংটন ভিত্তিক সেন্টার ফর ল এন্ড সোশাল পলিসি’র এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বিয়েতে কনের বয়স থাকে ১৫ থেকে ১৭ বছরে মধ্যে। সবচেয়ে আতঙ্কের হলো ১৯৯০’র দশকের পর থেকে এই প্রবণতা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানায় দেশটির আদমশুমারি ব্যুরো। ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’-এর ২০০৪ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এক-পঞ্চমাংশের বিয়ে হয়েছিল কিশোরী অবস্থায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাল্যবিয়ের এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্যপীড়িত এবং স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রবণতা বেশি।

বর্তমান বিশ্বে শিশু মাতার সংখ্যা কত? এর কোনো সঠিক হিসেব পাওয়া সত্যিই কঠিন। তবে শুধু উন্নয়নশীল দেশে এই সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখের মতো বলে মনে করা হয়। এই পরিসংখ্যান আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্রের। নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রজনন স্বাস্থ্য সংস্থা অঙ্গ সংগঠন পপুলেশন কাউন্সিলের হিসাবে আগামী ১০ বছরে আরো ১০ কোটি কন্যা শিশু বাধ্য হবে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে।

আইন ও শাস্তি: ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বলতে বোঝায় শিশু বা নাবালক বয়সে ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিয়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন অনুযায়ী ছেলে-েেময়ে উভয়েরই বা একজনের বয়স (ছেলের ক্ষেত্রে ২১ বছর এবং মেয়ের ক্ষেত্রে ১৮ বছর) বয়সের চেয়ে কম হলে তা আইনত বাল্যবিবাহ বলে চিহ্নিত হবে। বাল্যবিবাহ তিন ধরনের হয়ে থাকে- প্রাপ্ত বয়স্কের সঙ্গে অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিবাহ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের বিবাহ এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কের মাতা-পিতা, অভিভাবক কর্তৃক বিবাহ নির্ধারণ অথবা এ রকম বিবাহে সম্মতি দান। যারা এ অপরাধে অপরাধী, তাদের মধ্যে ছেলে-মেয়ের অভিভাবক, ছেলে-মেয়ে (যদি ২১ বছরের নিচে হয় অথবা মেয়ে যদি ১৮ বছরের নিচে হয়), কাজী যিনি বিবাহ রেজিস্ট্রি করাবেন, মৌলভী যিনি বিবাহ পড়াবেন, তাদের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তবে, এ আইনে শাস্তির যে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তা বেশ কম। 

অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো ছেলে অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো মেয়ে শিশুর সঙ্গে বিয়ের চুক্তি সম্পাদন করলে এক মাস বিনাশ্রম কারাদ- বা ১ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকারের শাস্তি হতে পারে। যে ব্যক্তি নাবালকের বিয়ে দেবে, তার এক মাস বিনাশ্রম কারাদ- বা ১ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকারের শাস্তি হতে পারে। যেসব অভিভাবক নাবালকের বিয়ে দেবে, তাদের এক মাস বিনাশ্রম কারাদ- বা ১ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকারের সাজা হতে পারে। 

বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত নতুন আইন করার প্রাক্কালে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর একটি প্রস্তাব করা হচ্ছিল। এ নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় হয়। তবে সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরই থাকছে। তাই বর্তমান আইনে বিয়ের বয়সের কোনো হেরফের হচ্ছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব ও গতানুগতিক মানসিকতার জন্য বাল্যবিয়ের হার বেশি বলে মনে করা হয়। সচেতনতার অভাব এক্ষেত্রে বড় একটি নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এজন্য বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। 

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়ে যতই শিক্ষিত হয় তার বাল্যবিয়ের আশঙ্কা ততই কমে আসে। এ কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে কন্যাশিশুদের স্কুলে ধরে রাখার লক্ষ্যে অভিভাবকদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। 

নারীর ক্ষমতায়ন এ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। এটা করতে পারলে বাল্যবিবাহ অনেকাংশে কমে আসবে। একইসঙ্গে দারিদ্র্য কমে গেলেও বাল্যবিয়ে কমে যাবে।  

ইলিয়াছ হোসেন পাভেল, বাসস-ইউনিসেফ