
ছবি সংগৃহীত
বন্ধুত্বের সমীকরণ- ভার্চুয়াল বনাম বাস্তব দুনিয়া!
আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৫, ০৩:০৮
( প্রিয়.কম ) বেশ কিছুদিন ধরে অরুপ নামের একটি ছেলের সাথে ফেসবুকে কথা হচ্ছে অহনার। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে অরুপ। দেখতেও বেশ ভালোই। প্রথমে যদিও কিছুদিন ঝুলিয়ে রেখেছিল ছেলেটার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা। পরে ওর প্রোফাইল চেক করে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েই ওকে নিজের বন্ধুদের তালিকায় যোগ করে অহনা। এখন বেশ ভালো একটা বন্ধুত্ব দাড়িয়ে গেছে ওদের দুজনের ভেতরে। কিন্তু সমস্যা কেবল একটাই। অনেক বলা সত্ত্বেও কেন যেন অহনার সাথে দেখা করতে চায়না অরুপ। সরাসরি না বলেনা। কিন্তু দেখা করবার কথা আসলেই কেমন যেন অন্যদিকে সেটার মোড় ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে ও। প্রথমে অহনা ভেবেছিল প্রথম প্রথম বন্ধুত্ব। ছেলেটা নাকি এমনিতেও খুব লাজুক। মেয়েদের সাথে কম মেশে। তাই হয়তো এমন করছে। কিন্তু এখন? বন্ধুত্বটা যখন বন্ধুত্বের খানিকটা উপরে অবস্থান করছে তখন কেন দেখা করায় এত অনীহা অরুপের? রাফি আর স্নেহার পরিচয় ফেসবুকের মাধ্যমে। মিউচুয়াল ফ্রেন্ড ছিল ওরা মিশু নামে একটি মেয়ের। খুব অদ্ভূত ব্যাপার হল এই মিশু মেয়েটিকেও কিন্তু ওদের দুজন কেউই সামনে থেকে দেখেনি। কেবল ফেসবুকেই হাই-হ্যালো সম্পর্ক। খুব কম কথা বলা মেয়েটিকে খুব একটা ভালো লাগেনি রাফি বা স্নেহা করোরই। এরকমই হয়তো চলতো। কিন্তু একদিন রাফি স্নেহার সাথে দেখা করতে চাইল। আর ভদ্রতা করে ডেকে নিল মিশু নামের ওই মিউচুয়াল ফ্রেন্ডকেও। এর একমাস পরের কথা। রাফিদের সোসাইটিতে একটা নতুন সার্কেল তৈরি হয়েছে। সবাই তাদেরকে ত্রিরত্ন বলে ডাকে। এই ত্রিরত্ন আর কেউ নয়। সেই রাফি, মিশু আর স্নেহা। ইট-কাঠ-পাথরের দেয়াল পার করে ওদেরকে খুব বেশী কাছাকাছি এনে দিয়েছে ফেসবুক। নাহলে হয়তো কোনদিন জানাও হতোনা কয়েক বাড়ি পরেই থাকে এমন ভালো কয়েকজন বন্ধু। আর মজার ব্যাপার হল, ফেসবুকে কম কথা বললেও এমনিতে কিন্তু মিশু খুবই বকবক করে। রাফিরাতো ওকে ইদানীং বাচাল বলেই ডাকে। কলেজ জীবন শেষ করার সাথে সাথেই অন্য শহরে বদলী হয়ে গেল রাতুলের বাবা। এদিক ওদিকে কেমন যেন ছড়িয়ে গেল এরপর কলেজের ভালো বন্ধুগুলো। কারো কারো নম্বর হারালো। কারো মোবাইল। হাতে গোনা দু-একজন বাদে আর কারো সাথেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। চেষ্টা করে করে একসময় হাল যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছির ও, এমন সময় হঠাত্ চোখে পড়ল একটা ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। ওর কলেজের একটা ছেলে পাঠিয়েছে। মিজান। ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু মিজান! শুধু তাই নয়, মিজানের প্রোফাইলে গিয়ে ও খুঁজে পেল ওর কলেজের সবগুলো বন্ধুকে। উপরের ঘটনাগুলো কারো না কারো জীবনেরই অংশ। শুধু এগুলোই নয়। ফেসবুককে ঘিরে সবার জীবনেই রয়েছে নানা ছোট-বড় হরেক রকমের স্মৃতি। এর মধ্যে কিছু স্মৃতি কষ্টে ভরা, আর কিছু আনন্দের। উন্নত প্রযুক্তির ফলাফল এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেকেরই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। কেউ সেই মোড়ে এসে পড়ে গেছে গর্তে। ভেসে গেছে অন্ধকারে। আবার কারো চারপাশটা ভরে গেছে আলোয়। অনেকেই এখন সমাজে সামাজিকতা বাড়াতে বাস্তব জীবনের চাইতে মনযোগ দেন ফেসবুকে বেশি। যেন এটাই হয়ে উঠেছে এখনকার সামাজিক জীব হওয়ার মাপকাঠি। বর্তমানে আধুনিক জীবনের একটা খুব বড় অংশ দখল করে নিয়েছে ফেসবুক। ভার্চুয়াল জালে জড়িয়ে বন্ধুত্ব নামক সেই চেনা পরিচিত মধুর সম্পর্কের একটা অন্যরুপ দিয়েছে ফেসবুক। এর সাহায্যে পৃথিবীর এক কোণ থেকে অন্য কোণে সবাই বাড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধুত্বের হাত। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার বদলে সবার, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে সে সময়টা ফেসবুকে হাজার হাজার বন্ধুদের সাথে গল্প করাটাই যেন অনেকটা আকর্ষণীয় হয়ে দাড়িয়েছে। অনেক প্রবীনতো নিজেদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে আক্ষেপ করে বলেই বসেন- ওরা কি বুঝবে বাস্তব জীবনের বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো কত মধুর! ওরা তো ফেসবুক প্রজন্ম! কিন্তু আসলেও কি তাই? চলুন দেখে নেওয়া যাক কয়েকজন নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের কাছ থেকে। বন্ধুত্ব নিয়ে তারা কে কী ভাবছেন শোনা যাক তাদের মুখে। কোন বন্ধুত্বের গুরুত্ব বেশী বর্তমান প্রজন্মের কাছে? ভার্চুয়াল নাকি বাস্তব- কাকে আগিয়ে রাখবেন এক্ষেত্রে জানতে চাওয়া হলে ভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পড়ুয়া সুব্রত ভক্ত শোভন জানান- অবশ্যই বাস্তবের বন্ধুকে! ফেসবুকে কেবল ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহন করে কারো বন্ধু তালিকায় নাম ঢোকানো যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনের বন্ধুদের মতন সত্যিকারের বন্ধু বলা যায়না তাদের। ঢাকা ভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত আরেক শিক্ষার্থী ইসমাত জাহান লিপি বলেন- ফেসবুক আর রিয়েল বন্ধুদের মধ্যে একটা ব্যাপারেরই পার্থক্য। আর সেটা হল বিশ্বাস। বাস্তব জীবনের বন্ধুকে আমি চিনি। তাকে কাছ থেকে দেখেছি আমি। আর তাই তাকে বিশ্বাস করে তার সাথে সব কথা শেয়ার করতে পারি। কিন্তু ফেসবুকে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু তাহলে কি ফেসবুকের বন্ধুত্বগুলো একেবারেই ঠুনকো? এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অন্য শিক্ষার্থী ইরফান বলেন- না। ফেসবুকের সব বন্ধুত্বই ঠুনকো নয়। এখানেও অনেককে পাওয়া যায় যাদের বন্ধুত্ব হয়তো আমার জীবনে বাস্তব জীবনের বন্ধুত্বের চাইতেও বেশী। তবে খুব রেয়ার এটা। লেখক জেসি মুহাম্মদ নাভিদের মতে ফেসবুকের বন্ধুগুলোকে বাস্তব জীবনে নিয়ে আসলেই তারা বাস্তব জীবনের বন্ধু হয়ে যায়। আর সেটা যদি না করা যায় তাহলে বন্ধুত্বটাকে ঠিক বন্ধুত্ব বলা চলে না। বন্ধুত্ব শব্দটি খুব গূঢ় অর্থ বহন করে। দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর নির্ভর করে বন্ধুত্ব। ফেসবুক শুধু একটি মাধ্যম। বলেন তিনি। বন্ধু হল সে, যে সবসময় আমার পাশে থাকে। বিপদে হাত বাড়িয়ে দেয়। যার সাথে কষ্ট-আনন্দ সব ভাগ করে নেওয়া যায়। এদিক দিয়ে আমার কাছে ফেসবুক আর বাস্তব জীবনের বন্ধুদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আ্যায়ারোটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষার্থী রাহুল হাসান জানান। চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম বর্ষে পড়া শিক্ষার্থী রেখা জানান- আমার সত্যিকার জীবনের বন্ধুগুলোকেই আমি সাধারণত ফেসবুকে বন্ধু বানাই। তাই আমার কাছে এ দুটোর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে রেখার মতে এই ফেসবুক বন্ধুত্ব অনেক সময় বাস্তব জীবনের বন্ধুত্বকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে ফেসবুকে যাদের সাথে বেশী কথা বলা হয়, তারাই বাস্তবেও জড়িয়ে থাকে অনেকটা বেশি। রেখা জানান। ফেসবুকে গড়ে ওঠা নতুন নতুন বন্ধুদের ভিড়ে অনেক সময় হারিয়ে যায় পুরোন কোন বন্ধু। আর যার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই সে তো অনেকটা দূরেই সরে যায়। জানান এ্যয়ারোটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে থাকা রাহুল হাসান। তবে ফেসবুকের মাধ্যমে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হওয়ার সুযোগ বেড়ে যায় বলে মনে করেন লিপি। আর সেটা শুধু ভার্চুয়াল বন্ধুই নয়। বাস্তব জীবনেও অনেকের চারপাশটা বন্ধুতে ভরিয়ে তুলেতে সাহায্য করে ফেসবুক। বাস্তব জীবনের একাকীত্ব অনেকটা দূর করতে সাহায্য করে ফেসবুক। জানান লেখক ও ছড়াকার এমরুল হোসাইন। তাহলে রিয়েল আর ভার্চুয়াল দুই ধরনের বন্ধুত্বের এই মিশেল কি তৈরি করছে নতুন একটা প্রজন্মের যেখানে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা কেবল বাস্তবকেন্দ্রিকই নয়, খানিকটা মানসিকও? হয়তো। কেউ হয়তো আমার পাশে বসে নেই। তার মুখ কোন কথা বলার সময় কেমন হয়ে যাচ্ছে, তার গলার আওয়াজ কতটা কমছে বাড়ছে সেটা হয়তো সেই আগের মতন দেখার সময় বা সুযোগ কোনটাই আমরা, এই বর্তমান প্রজন্মরা বের করতে পারছিনা। সম্ভব হচ্ছেনা। সেক্ষেত্রে এই ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের জগত্ ফেসবুকই হয়ে উঠছে দুদের সাধ ঘোলে মেটানোর মতন একটা ব্যবস্থা। আর এতে এখন অনেক বেশী অভ্যস্তও হয়ে উঠেছি আমরা। ভবিষ্যতে চারপাশের ব্যস্ততা হয়তো আরো বাড়বে। বেড়ে যাবে এই মানসিক যোগাযোগ আরো বেশি। লিপি জানান। হয়তো! হয়তো সত্যিই প্রবীনদের কাছ থেকে ফেসবুক প্রজন্ম উপাধিপ্রাপ্ত এখনকার ছেলেমেয়েরা বন্ধুত্বের পরিধিকে আমাদের চিরচেনা গন্ডি থেকে বের করে নিয়ে যাবে। বন্ধুত্বের মেলা বসবে তখন সবখানে। যুদ্ধ- সংঘাত নামে কিছু থাকবেই না। সবাই একে অন্যের বন্ধু হয়ে বন্ধুত্বের সজ্ঞাকে দেবে অন্য এক মাত্রা। আর সেটারই প্রথম পদক্ষেপ হয়তো বর্তমান এই ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের জাল।