ছবি সংগৃহীত

প্রসঙ্গ: শব-ই বরাত এবং আমাদের ভ্রান্তচর্চা !

Md. Galib Mehdi Khan
লেখক
প্রকাশিত: ১০ জুন ২০১৪, ১৪:৪৪
আপডেট: ১০ জুন ২০১৪, ১৪:৪৪

প্রায় সপ্তাহ জুড়ে জোগাড় যন্তর। চালের গুড়া করা, শুকানো। নানা ধরনের হালুয়া তৈরির উপকরণের ব্যবস্থা করা। আর কাঙ্ক্ষিত দিনে এ সবের সদ্ব্যবহার। অর্থাৎ গৃহিণীদের নাওয়া-খাওয়া ভুলে রুটি-হালুয়া বানানো। বিকেল হতে না হতেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দিয়ে আত্বিয়-স্বজন প্রতিবেশীর বাড়িতে তা পৌঁছে দেয়া। ঘরের সামনে ভিখিরির লম্বা লাইন। তাদেরকে রুটি-হালুয়া বিলিয়ে দিতে দিতে আছর-মাগরিবের ফরয নামাজের কথাই ভুলে বসা। বাড়ীর পুরুষ সদস্যদের গোছল সেরে পাঞ্জাবী-টুপি তসবি হাতে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরা। যেন এক বিশাল আনন্দ যজ্ঞে মেতেছে সবাই। আড্ডা–গল্প গুজব, মাঝে ইমামের বয়ান শোনা আর অপেক্ষা মোনাজাত এর। লক্ষ একটাই পবিত্র এই রজনীর আত্মীয় সৌভাগ্যকে পাকা-পোক্ত করে নেয়া। সারা বসর গরহাজির থেকে এ রাত্রে হাজিরা দিতে সব উন্মুখ হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য সারা বৎসরের ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর জন্য পরিকল্পনা। হালুয়া রুটি বিলিয়ে আল্লাহকে খুশি করে এবার নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়ার এমন সুবর্ণ সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? তাইতো ইমামের মোনাজাতের সাথে শরিক হয়ে আমিন আমিন সুর তোলা। ইমাম সাহেব বলেছেন, এ রাতে আগামী বৎসরের হায়াত, মউত, ভাগ্য ইত্যাদি লিখা হয়। কাজেই এত সহজ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। শব এ বরাতের এই চালচিত্র সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি। যখন এ বিষয়ে জানতে চাইলাম তখনই খটকাটা লাগল। দেখলাম ঈদ এ মিলাদুন্নবীর মতই শবই বরাতও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের একটি আলাদা ধর্মীয় কৃষ্টি। বিশেষ করে হালুয়া-রুটি বণ্টন, দল বেধে কবর জেয়ারত ইত্যাদি। যার স্বপক্ষে নেই কোন শক্ত দলীল। আমরা যদি শব ই বরাত শব্দটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি তাহলে জানতে পারব, ফার্সি ভাষায় ‘শব’ শব্দটির অর্থ রাত আর ‘বরাত’ শব্দটি আরবি থেকে গৃহীত। বাংলায় ‘বরাত’ শব্দটি ‘ভাগ্য’ বা ‘সৌভাগ্য’ অর্থে ব্যবহৃত হলেও আরবি ভাষায় এর অর্থ তা নয়। আরবি ভাষায় ‘বাড়াত’ শব্দটির অর্থ বিমুক্ত, সম্পর্ক ছিন্নতা, মুক্ত হওয়া, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি। ফার্সি ‘শবে বরাত’ ও আরবি ‘লাইলাতুল বাড়াত’ অর্থাৎ ‘বিমুক্তির রজনী’ বলতে আরবি পঞ্জিকার ৮ম মাস, শাবান মাসের মধ্য রজনীকে বুঝানো হয়। কুরআন ও হাদিসে কোথাও ‘লাইলাতুল বাড়াত’ পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়নি। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগেও এ পরিভাষাটির ব্যবহার পাওয়া যায় না। এ রাতটিকে হাদিস শরীফে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘ মধ্য শাবানের রজনী’ বলা হয়েছে। একজন মুমিনের জন্য ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনার বাইরে কিছু করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। তাই একজন মুমিন কখনই কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনার বাইরে কোন কাজ করতে পারে না, করলে তা ইবাদত হিসেবে গ্রহণযোগ্য তো হয়ই না বরং বেদাত বলে গণ্য হয়। শব ই বরাতের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। কাড়ন কুরআন-হাদিসের নীতিমালা বহির্ভূত, রাসূলুল্লাহ সা. থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত কোন বিষয়ের ব্যতিক্রম কোন বিশ্বাসের ভিত্তিতে শরীয়তের মাঝে নব উদ্ভাবিত যে কোন আমলই হল বিদআত। আমাদের সমাজে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে নানা রকম বিদআত গড়ে উঠেছে, যা কুরআন-হাদিস সমর্থিত নয়। এই প্রেক্ষাপটে একজন মুমিন হিসেবে শবে বরাতের ফযিলত ও আমল সম্পর্কে কুরআন-হাদিসের নির্দেশনা জেনে আমল করা উচিত। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ঐ দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরে থাকবে, কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত। {মুয়াত্তা মালিক, হাদিস-১৩৯৫} এ ব্যাপারেও মুফাসসীর গণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, আল-কুরআনের কোথাও শবে বরাত সম্পর্কে বলা হয়নি। যদিও কেউ কেউ সূরা দুখানের একটি আয়াত শবে বরাতের সমর্থনে পেশ করে থাকেন, আয়াতটি হল- ‘আমি তো তা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, এক মুবারক (বরকতময়) রজনীতে এবং আমি তো সতর্ক কারী। এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুমোদিত হয়’। {সূরা ৪৪ দুখান, আয়াত-৩, ৪} এই আয়াতে যে বরকতময় রজনীর কথা বলা হয়েছে, তা মূলত ‘শবে কদর’ বা ‘লাইলাতুল কদর’। শবে বরাত নয়। কেননা, কুরআন নাযিল হয়েছে যে রাত্রিতে, তা হল শবে কদরের রাত্রি। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনে কিছুই বলা হয়নি। তবে, হাদিস শরীফে শবে বরাত সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। নিম্নে ঐ বর্ণনা সমূহের একটি সার সংক্ষেপ পেশ করা হল। হযরত আবু মুসা আশআরী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- ‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {শুনানে ইবনে মাযাহ, হাদিস-১৩৮০} অনুরূপভাবে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ তা'আলা মধ্য শা’বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, অতঃপর বিদ্বেষী ও আত্মহনন কারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {মুসনাদে আহমদ, হাদিস-৬৩৫৩} অনুরূপভাবে আবু সালাবাহ আল-খুশানী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তা'আলা তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুমিনদেরকে মার্জনা করে দেন। আর কাফেরদেরকে অবকাশ দেন এবং পরশ্রীকাতরতায় লিপ্তদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন, যতক্ষণ না তারা তাকে (আল্লাহকে) আহবান করে।’ {আল-মুজামুল কাবীর লিত তবরানী, হাদিস-১৮০৩৯} অনুরূপভাবে আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মহিমান্বিত মহান আল্লাহ তা'আলা মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। অতঃপর ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষ পালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।’ {তিরমিযী শরীফ, হাদিস-৬৭০} সম্ভবত তৎকালীন সময়ে ‘কালব’ সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি মেষ পালের মালিক ছিল। সে কারণেই ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষ পালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতিপালক মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং শিরকে লিপ্ত অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {বুগিইয়্যাতুল হারেছ, হাদিস-৩৩৫} অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি.-এর সূত্রে বর্ণিত যে, মধ্য শাবানের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে বললেন, তুমি কি জানো আজকের রাত্রিটি কোন রাত্রি? তিনি বললেন হে আল্লাহর রসূল, এ রাত্রে কি আছে? তখন তিনি বললেন, ‘এ রাত্রে চলতি বছরে জন্ম গ্রহণকারী আদম সন্তানের নাম এবং চলতি বছরে মৃত্যু বরণকারী আদম সন্তানের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানের আমল কবুল করা হয় এবং তাদেরকে রিজিক প্রদান করা হয়। অত:পর আয়েশা রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে? তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহর রহমত ছাড়া কেহই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এ কথা তিনি তিন বার বললেন। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, আপনিও কি আল্লাহর রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আয়েশার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আল্লাহর রহমত আমাকে ঢেকে না নিলে আমিও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো না। তিনি এ কথাটিও তিনবার বললেন।’ {মিশ কাত শরীফ, হাদিস-১৩০৫} অনেক হাদিস বিশারদগণ উক্ত হাদিসের সনদ বা বর্ণনা সূত্রকে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ইমাম নাসায়ী এই হাদিসের সনদকে চলন সই বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনুরূপভাবে উসমান ইবনু আবিল আস্ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আগমন করে তখন একজন আহ্বানকারী আহবান করতে থাকে, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন যাচনা কারী আছে কি? আমি তাকে দান করব। ব্যভিচারী ও শিরকে জড়িত ব্যতীত যত লোক যা কিছু চাইবে সকলকেই তা দেয়া হবে।’ {শুয়াবুল ঈমান লিল-বাইহাকী, হাদিস-৩৬৭৬} অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, ‘এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাক্বীতে (মদিনা শরীফের একটি কবরস্থানের নাম) আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে আছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশংকা করেছিলে যে, আল্লাহ ও রসূল সা. তোমার উপর অবিচার করবেন! আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল, আমি ধারনা করেছিলাম যে, আপনি আপনার অন্য স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। তখন তিনি বললেন, মহিমান্বিত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাত্রে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং ‘কালব’ গোত্রের মেষ পালের পশমের অধিক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করেন। {সুনানে ইবনু মাযাহ, হাদিস-১৩৭৯} অনুরূপভাবে হযরত আলী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে, তখন তোমরা রাতে (সালাতে-দুয়ায়) মশগুল থাক এবং দিবসে সিয়াম পালন কর। কারণ ঐ দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন রিজিক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোন দুর্দশা গ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।’ {সুনানে ইবনু মাযাহ, হাদিস-১৩৭৮} অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. একদা রাতে সালাত আদায় করছিলেন। তিনি সিজদায় গিয়ে দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকলেন। এমনকি আমার মনে হল যে, তাঁর ওফাত হয়ে গেছে। আমি যখন এমনটি দেখলাম, তখন শোয়া থেকে উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, ফলে তিনি নড়ে উঠলেন। তখন আমি (বিছানায়) ফিরে গেলাম। অতঃপর যখন তিনি সিজদা থেকে মস্তক উঠালেন এবং নামায শেষ করলেন তখন বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি মনে করেছিলে যে রাসূলুল্লাহ সা. তোমার সাথে প্রতারণা করছেন? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ, আমি এমনটি মনে করিনি। বরং আপনার দীর্ঘ সিজদার কারণে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার ওফাত হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন, তুমি কি জান এটি কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূল সা.ই সম্যক অবগত। তিনি বললেন এটি মধ্য শাবানের রাত। আল্লাহ তা'আলা এ রাতে তার বান্দাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করেন, যারা দয়া প্রার্থনা করে তাদেরকে দয়া করেন এবং যারা বিদ্বেষী তাদেরকে তাদের অবস্থাতেই রেখে দেন।’ {শু’য়াবুল ঈমান লিল-বাইহাক্বী, হাদিস-৩৬৭৫} উল্লেখিত হাদিস সমূহের কোন কোন বর্ণনাকারী জয়ীফ বা দুর্বল হিসেবে বিবেচিত হলেও একই অর্থবহ হাদিস (সামান্য কম বেশি ছাড়া) অন্য মুহাদ্দিসগণের নিকট চলনসই হিসেবে চি‎‎হ্নিত। তাছাড়াও এই সমস্ত হাদিস দ্বারা যেহেতু কোন আহকাম অর্থাৎ নির্দেশ প্রমাণিত করা হচ্ছে না, বরং ফযিলত ও আমল সংক্রান্ত বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে, বিধায় মুহাদ্দিসগণের নিকট উল্লেখিত হাদিসসমূহ গ্রহণযোগ্য। উল্লেখিত হাদিসসমূহে শবে বরাত সম্পর্কে বেশ কিছু ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে ফযিলতগুলো হল, এই রাতে ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষ পালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেয়া হয়। চলতি বছরে জন্মগ্রহণকারী ও মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানের আমল কবুল করা হয় এবং রিজিক প্রদান করা হয় ইত্যাদি। শবে বরাতের রাতে যে সকল লোকের আমল কবুল হয় না বলে বর্ণিত হয়েছে, এমন লোকের সংখ্যা প্রায় এগার। এক. মুশরিক অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে যে কোন প্রকারের শিরকে লিপ্ত হয়। আল্লাহর নাম ও গুণগত বিষয়ের শিরক হোক বা আল্লাহর প্রতিপালন গত বিষয়ের শিরক হোক অথবা আল্লাহর ইবাদত গত বিষয়ের শিরক হোক। দুই. যে ব্যক্তি কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী। তিন. আত্মহত্যার ইচ্ছা পোষণকারী। চার. যে ব্যক্তি অপরের ভাল দেখতে পারে না অর্থাৎ পরশ্রীকাতরতায় লিপ্ত। পাঁচ. যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, চাই তা নিকটতম আত্মীয় হোক বা দূরবর্তী আত্মীয় হোক। ছয়. যে ব্যক্তি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাছাড়াও অন্য হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সাত. যে ব্যক্তি মদ্যপানকারী অর্থাৎ নেশাকারী। আট. যে ব্যক্তি গণক গিরি করে বা গণকের কাছে গমন করে। নয়. যে ব্যক্তি জুয়া খেলে। দশ. যে ব্যক্তি মাতা-পিতার অবাধ্য হয়। এগার. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী পুরুষ ইত্যাদি ব্যক্তির দুয়াও তওবা না করা পর্যন্ত কবুল হয় না। তাই শবে বরাতের পূর্ণ ফযিলত ও শবে বরাতের রাতে দুয়া কবুল হওয়ার জন্য উল্লেখিত কবিরা গুনাহ সমূহ থেকে খাঁটি দিলে তওবা করা উচিত। অন্যথায় সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করেও কোন লাভের আশা করা যায় না।

শবে বরাতের আমল বা করনীয় সম্পর্কে উল্লেখিত হাদিসসমূহ থেকে যা জানা যায় তা হল:

এক. এই রাতে কবর যিয়ারত করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই দলবদ্ধ ও আড়ম্বরপূর্ণ না হয়ে একাকী হওয়া উচিত। দুই. শবে বরাতের রাত্রিতে নামায-দুয়া, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দরূদ শরীফ ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা ভাল। তিন. এই রাত্রিতে দীর্ঘ সিজদায় রত হওয়া উচিত। চার. শবে বরাতের পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই শাবান রোযা রাখা। তাছাড়া প্রত্যেক আরবি মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তম তারিখে রোযা রাখা অধিক মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে ‘রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, প্রত্যেক মাসে তিনটি রোযা এক বৎসরের রোযার ন্যায়। আর আইয়্যামুল বীজ (পূর্ণ ছন্দময় রজনীর দিবসসমূহ) হল, তের, চৌদ্দ ও পনের তম দিবস।’ {নাসাঈ শরীফ, হাদিস-২৩৭৭} তবে, শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে বেশ কিছু কুসংস্কার ও বিদআত চালু আছে। তম্মধ্যে অন্যতম বিদআত হল হালুয়া-রুটি তৈরি করার এক মহা ধুমধাম। যা নিঃসন্দেহে একটি কুসংস্কার ও বিদআত। তাই, এটি বর্জন করা উচিৎ। সেই সাথে বিভিন্ন কবরস্থানে বা মসজিদে আলোক সজ্জার ব্যবস্থা করাও অপচয়ের গুনাহসহ মস্তবড় একটি বিদআত। সারা রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত-বন্দেগীর চাইতে শুধু মসজিদে-মসজিদে ঘোরাঘুরি করা আর রাস্তায়-রাস্তায় গল্প-গুজবে মশগুল থাকা এই রাত্রির মর্যাদা পরিপন্থী কাজ। বরং, এই রাত্রিতে মসজিদে সমবেত না হয়ে বাড়িতে একাকী ইবাদত করাই উত্তম। মসজিদে তো দৈনিক পাঁচবার নামাযের ইবাদত হচ্ছেই। নিজেদের বাসা-বাড়িকেও ইবাদতের গৃহ হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। তাছাড়াও সকল নফল ইবাদত মসজিদের চাইতে বাড়িতে পালন করাই উত্তম। সারারাত নফল ইবাদত পালন করে যদি ফজরের নামায কাযা হয়ে যায়, এর চাইতে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? যদি কারো জীবনে কাযা নামায থেকে থাকে, তাহলে নফল নামায পড়ার চাইতে বিগত জীবনের কাযা নামায আদায় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ এবং জরুরী। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তার কুরআন ও হাদিস সম্মত পন্থায় ইবাদত পালনের তাওফিক দিন। [email protected] কৃতজ্ঞতায়-মাওলানা কাজী ফজলুল করিম। মুহাদ্দিস ও খতীব, কারবালা মাদরাসা, বগুড়া।