
ছবি সংগৃহীত
পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তির আড্ডা : শিকড়মুখী কবির শিকড় দেখা
আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০৮:৪৯
গ্রাফিক্স: আকরাম হোসেন।
(প্রিয়.কম) কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ প্রায় প্রতিদিনই আড্ডায় মগ্ন থাকেন। ওরকমই একটি নৈমিত্তিক আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন তাঁর সতীর্থ ও অনুজ কয়েকজন কবি। কবির পঞ্চাশ বর্ষপূর্তির কথা মাথায় রেখে ওই আড্ডায় উচ্চারিত কথাবার্তা তুলে ধরা হলো প্রিয়.কম এর পাঠকদের জন্য। অনুলিখন করেছেন সুদীপ্ত সাইদ খান।
সরোজ মোস্তফা : ২০১৫ সাল শেষ হতে যাচ্ছে, এমন একদিন আমরা বসেছি শ্যামলীতে। আহমেদ স্বপন মাহমুদ ৫০-এ পা দিয়েছেন। এই উপলক্ষে অগ্রজ বন্ধু মুজিব মেহদী, জুয়েল মোস্তাফিজ, ফেরদৌস মাহমুদ, মামুন খান এবং আমি সরোজ মোস্তফা তাঁর সঙ্গে আড্ডায় বসেছি।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ এ সময়ের একজন নিবেদিতপ্রাণ কবি। ইতোমধ্যে তাঁর ১২টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আজকে কথা বলার মাধ্যমে আহমেদ স্বপন মাহমুদের সৃৃজন জগতে প্রবেশ করার চেষ্টা করব। কেন তিনি লিখেন, কী তার সৃজন ভাবনা। সাম্প্রতিক সময়কে তিনি কীভাবে দেখেন, ভবিষ্যৎকেই-বা কীভাবে দেখেন।
৫০-এ পা রাখার প্রেক্ষিতে জানব ৫০ নিয়ে তাঁর ভাবনা কী বা ভবিষ্যৎ নিয়েই বা ভাবনা কী। সব মিলিয়ে একজন আহমেদ স্বপন মাহমুদকে আমরা জানার চেষ্টা করব। আমি কবি মুজিব মেহদীর প্রতি অনুরোধ করছি, তিনি আড্ডার পর্বটা শুরু করবেন।
মুজিব মেহদী : আহমেদ স্বপন মাহমুদকে যতটুকু চিনি-জানি তা কবি হিসেবেই। এ ছাড়া তাঁকে চেনার কোনো কারণ ঘটত না। ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে আসার পর তাঁকে হয়ত পেতাম, আবার নাও পারতাম; কারণ এই সেক্টরের অনেককেই আমি চিনি না। তারও বহু আগে যখন ময়মনসিংহে ছিলাম, তখন আমার চেয়ে এগিয়ে থাকা কবি হিসেবেই তাঁকে চিনতাম। তাঁর লেখা তখন নানা জায়গায় ছাপা হয়, নানা আড্ডায় তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। আমরা একই দশকের, একই সময়ের কিন্তু তিনি আমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বর্ষীয়ান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সারাউন্ডিংসের মধ্যে থাকতেন, সেখানে অনেক কবি-সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন আশির দশকের কবি অসীম কুমার দাস। তখন শাহবাগকেন্দ্রিক সাহিত্যিক আড্ডাতেও তিনি অংশ নিতেন। সেসব আড্ডার অনেকেই তাঁকে চিনতেন-জানতেন। সেই অবস্থা থেকেই আমি তাঁকে চিনি। সম্প্রতি আমরা অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। সুখে-দুঃখে নানাভাবে আমরা একত্রে সময় কাটাই। অন বোথ অব ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড নন-ক্রিয়েটিভ ওয়েজ। যৌথভাবে অনেক সময় অপচয়ও করি। এরকম অবস্থায় যখন তাঁর ৫০ বছর উদযাপনের কাল সমাগত হয়, যখন তাঁর পাঠক এবং অনুজ কবিরা তাঁকে আবিষ্কারের চেষ্টারত আছে দেখি, তখন সেটা সত্যিই আনন্দের ব্যাপার মনে হয়।
এ অবস্থায় সমসাময়িক একজন লেখক হিসেবে তাঁর সম্পর্কে যে বিষয়গুলো আমার জানতে ইচ্ছে হয় সেগুলো বরং বলি। বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি যে ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে অনেক লেখক তাঁদের মাস্টারপিস কাজগুলো শেষ করে ফেলেন। আমরা তো তার চেয়েও বেশি সময় পার করে ফেলেছি। আমরা পঞ্চাশ ছুঁতে যাচ্ছি বা ছুঁয়ে ফেলেছি। আমাদের যাঁর যাঁর অর্জন নিয়ে যদি ভাবি তো কী মনে হয়? দেশের যে অবস্থা তাতে হয়ত কালকেও আমরা না থাকতে পারি। তো, কাল থেকে যদি আর না লিখতে পারেন, এখানেই যদি আপনাকে থামতে হয়, আপনার পাঠক আপনার লেখা কতটা মনে রাখবে বলে মনে করেন? আপনি তা নিয়ে কতটা তৃপ্ত? যা যা করতে চেয়েছিলেন, তা কি এর মধ্যে করতে পেরেছেন?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ : ধন্যবাদ, মুজিব। সেই সঙ্গে সরোজ, জুয়েল, ফেরদৌস, মামুন বা বন্ধুজন যারা আছে, এরকম একটা আয়োজন আমার জন্য নিশ্চয় আনন্দের। যদিও আমার একটু লজ্জাও লাগছে। যাই হোক এ আয়োজনের জন্য আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা।
নানা চড়াই উৎরাইয়ের ভেতর দিয়েই একজনকে লেখককে এগোতে হয়। সমগ্র জীবন পাড়ি দিতে গিয়ে একজন লেখকের কাছে প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিজেকে একজন প্রফেশনাল (নিয়মিত অর্থে) লেখক মনে করি। আমি যেহেতু অন্য কাজ করি, তাই কাজটা প্রধান লেখাটা পরে, এইরকম কোনো চিন্তা আমার মাথায় কখনো কাজ করে নাই বা জাগে নাই। ফলে লেখার প্রতি আমার একান্ত নিবেদনটা থাকে। এবং এ কারণে লেখার প্রতি সংশ্লিষ্টতা বা অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা লেখালেখির যে লিংকগুলো, তার সঙ্গে থাকা হয়। এটা আমার নিজের নিবেদনের জায়গা থেকেই করি। মানসিকভাবেই এই জায়গাটা আমার ভেতর প্রবল। পাঠের ভেতরে থাকা, শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যে সম্পৃক্ততা সেটা আমার আছে। কিন্তু এটা ব্যক্তিগত জীবনে ট্রাবল তৈরি করে। কবিকে বিপদে ফেলে দেয়। এই সংযুক্তির ব্যাপারটা ব্যক্তি জীবনে আমাকে বিপদে ফেলে দেয়। কারণ যেকোনো ধরনের একাগ্রতা একটা ম্যাডনেসের দিকে নিয়ে যায়। যেকোনো প্রেমই কিন্তু মানুষকে ম্যাডনেসের দিকে নিয়ে যায়। আপনি দেখবেন যে আশির দশকের অনেক লেখক লেখালেখি করতে গিয়ে অনেকেই মূল রাস্তা থেকে সরে গেছে। কারণ তাদের মধ্যে লেখা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কারণ একজন কবি স্বপ্ন ও কল্পনার মধ্যে বাস করে। এটার ভেতরে বাস করতে গিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা টেকেল দেওয়া সম্ভব হয় না। আমার ব্যক্তিগত জীবনেও এরকম চ্যালেঞ্জ এসেছে। এটা কিন্তু রিস্কি। আমি সেই গ্রামের বাসিন্দা যে গ্রামে এখনো ইলেকট্রিসিটি আসে নাই। আমি ছোটবেলায় দশ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে আসতাম। এই হাঁটতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমি সূর্যোদয় দেখতাম। আপনি প্রতিদিন এই সূর্যোদয়ের জন্য যখন হাঁটতে থাকেন, তখন সেটা রক্তপাতও ঘটায়। কারণ যে প্রকৃতি মানুষের মধ্যে মায়া তৈরি করে, সেই মায়া অথবা কল্পনা থেকে সে সরতে পারে না। ফলে একটা স্থায়ী রূপ পায়। রাস্তাঘাট, নারী, প্রকৃতি এগুলো কবির সংবেদন তৈরি করে। আমার ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে।
আমার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রশ্ন এসেছে। আমার কাজের কথা যদি ধরি তাহলে বলব, আমি কাজ করতে পারি নি। আমি যদি বিবেচনা করতে যাই তাহলে আমার দশটা-বারোটা বই কোনো কাজই না। কারণ আমার বয়সে এসে জীবনানন্দ মারাই গেলেন। তিনি চুয়ান্ন বছর বয়সে মারা যান। অথচ এটুকু জীবনে তিনি কত কাজ করেছিলেন! কারণ বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আমার কাজটা কীভাবে তুলনা করতে পারি। আমি যদি বুদ্ধদেব বসুর কথাও ধরি, তিনি কিন্তু অনেক কাজ করেছেন। ষাট-সত্তরের দশকের কবি-লেখকদের ক্ষেত্রেও তাই। সে জায়গা থেকে আমি যদি ধরি তাহলে অমি জনসংস্কৃতির ভাষার প্রতিনিধিত্ব করি। আমি যদি সাহিত্যিক হই তাহলে জনপদের ও ভাষার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যে কাজ করার দরকার সেটা আমি করি নাই। প্রতিনিধিত্ব করার মতো কাজ আমার নাই। তবে কাজ করার জন্য যে ভাবনা-চিন্তা সেটা আমার মধ্যে আছে। এই সময়ে আমার মধ্যে যে রিয়ালাইজেশন আসছে, সেই রিয়ালাইজেশন যদি আরও দশ-পনেরো বছর আগে আসত, তাহলে ভালো হতো।
আমাদের যে মূলভাব, যে মূলচেতনা তার থেকে যেন একটু সরে গিয়ে আমরা কাজ করছি। ইউরোপের যে ভাবানুবাদ সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। যদিও এটা ত্রিশের গুরুরা শুরু করেছেন। কিন্তু সেটা নিয়েই আমরা কাজ করছি। আমার ধারণা, আমরা যেন আমাদের মূল ভিটামাটির কেন্দ্রটা ছেড়ে কাজ করছি। ফলে মূলকেন্দ্রে পৌঁছার যে বিষয়টা, সেটা আমার মধ্যে এখন কাজ করছে। আমাদের যে বাউল, আমাদের যে মরমিয়া-সহজিয়া ভাব, সেটা আমাদের কবিতায় অনুপস্থিত। ফলে আমি এ জায়গাটায় ব্যাপকভাবে কাজ করতে চাই। আমি দেখাতে চাই যে আমাদের সাহিত্যে এই ভাবটা তুলে ধরা সম্ভব। আমি চেষ্টা করেছি আমাদের কবি জালাল উদ্দীন খাঁ, হাসন রাজা, লালন সাঁই প্রমুখের ভাবটা কীভাবে রিপ্রেজেন্ট করা যায়। বরং ইংরেজি ভাব বা অন্য ভাব থেকে সরে এসে কীভাবে তাঁদের সেই টুইস্টটা তুলে ধরতে পারি। বাংলার ভাবটা কীভাবে আমি তুলে ধরতে পারি, সেটা নিয়েই কাজ করতে চাই। এটা বড়ো কাজ। বড়ো কাজ এককভাবে করা যায় না। ফলে আমি চাই আমার বন্ধুরাও সেই কাজটা করুক। একটা কবিতা যদি আপনি ভালো বলেন, তাহলেই সেটা জায়গা পায়। নচেৎ পায় না।
মুজিব : এখানে আপনাকে একটু থামাই, আমরা আমাদের জবাব পেয়েছি। সেই সঙ্গে বাড়তি জেনেছি যে, আপনি ভবিষ্যতে কী করতে যাচ্ছেন।
আমাদের এখানে একটা ক্রাইসিস কাজ করে। আমরা আমাদের কাজের মূল্যায়নটা জানতে পারি না। কী কবিতা, কী গল্প, কী উপন্যাস, সব মাধ্যমের ক্ষেত্রেই খুব কম লেখকই এই সৌভাগ্য অর্জন করেন যে, তারা জীবৎকালে জেনে যেতে পারেন তাঁরা যা করেছেন তা ভালো হয়েছে বা মন্দ। একজন কবি প্রায়শই বুঝতে পারেন না যে তিনি যা করছেন তা নিয়ে পাঠক সমাজ কীভাবে ভাবছে। এটা আমাদের এখানকার ঐতিহাসিক নীরবতার ফলে হয়। অর্থাৎ লেখালেখির যে মূল্যায়নটা হওয়া দরকার সেটা হয় না। আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আপনি যে মূল্যায়ন ডিজার্ভ করেন সেটা আপনি পান নি। আপনার ওপর সেই আলোটা পড়ে নি। বিপরীতপক্ষে, আমরা দেখেছি আপনি অন্যদের কম-বেশি ম্যূল্যায়ন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে আপনি আপনার ভূমিকাটি পালন করছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আপনার দায়বোধের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছি। আপনি ব্যাপারটা কীভাবে ভাবেন, অন্যরা আপনাকে নিয়ে আলোচনা না করলেও আপনার তা করার দায় আছে কি না?
সরোজ : মুজিব ভাইয়ের কথায় যুক্ত করতে চাই। তিনি প্রথমে যে প্রশ্নটা করছেন আমরা এখন এই সময়ে যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি অর্থাৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, এগুলো আপনার লেখায় তুলবেন কি না। বা আপনার বাড়ির পাশে উকিল মুন্সীর বাড়ি, সাত্তার পাগলার বাড়ি বা শাহ আব্দুল করিমের বাড়ি। আপনি তো সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। আজকের এই উপলব্ধির জন্ম হয়েছে। কিন্তু আপনি যখন অতিক্রমণের রেখা বা প্রথম কাব্যগ্রন্থ করেন তখন এই উপলব্ধিতে কেন পৌঁছুলেন না?
স্বপন : এটা লজ্জাজনক যে এখানে সমালোচনা সাহিত্য নেই। সমালোচনা সাহিত্য না থাকলে সেটা টিকে না। যেমন কোরান নিয়ে অলোচনা না হলে, পাঠ না করা হলে সেটা এতদূর আসতে পারত না। আমাদের এখানে সেটা নেই। সাহিত্য কী? একটা চিন্তা। নতুন চিন্তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা দেখা যায় না। আমার লেখালেখির শুরু থেকেই আমি চেষ্টা করেছি আলোচনা-সমালোচনা করার। গদ্য লেখার। আমার গদ্যগুলোর বেশিরভাগই ২০০০ সালের আগে লেখা। ২০০০ সালের আগেই আমি আশির দশকের কবিতা নিয়ে লিখেছি। আমি জীবনানন্দের ওপর, কবিতার ওপর, কবিতার নানা বাঁক নিয়ে লিখেছি। সে বইটির একটা মাত্র রিভিউ বেরিয়েছে। আর কোনো কাজ হয় নাই। কিন্তু সেই গদ্যগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন জায়গায় রিপ্রিন্ট করা হয়েছে অনেক বার। যদিও অনেকে ঘরোয়াভাবে বলেছে যে আমার গদ্যগুলো ভালো। আমি কবিতা বেশি লিখলেও সাথে গদ্য লিখেই যাই। পরে যে বইটি বের করলাম ‘কলমতালাশ : কবিতার ভাব ও বৈভব’ সেখানে আমি কবিতাকে কীভাবে দেখি, কীভাবে লেখি, সেটা বলা হয়েছে। আমি অবশ্যই এটাকে দায় মনে করি। সে কারণে আমি মনে করি এগুলো নিয়ে ভারী ও বড়ো কাজ করা প্রয়োজন।
আমাদের যে ভাব তা নিয়ে বাংলায় কোনো রেঁনেসা হয় নাই। আমার বাংলার কোনোকিছু নিয়ে পুনর্জাগরণের ঘটনা নাই। আমরা ইউরোপীয় রেঁনেসাকেই নিজেদের রেঁনেসা বলে চালিয়ে দিচ্ছি। ইউরোপের যে মিডল এজ সেটাকে আমরা অনুবাদ করলাম মধ্যযুগ, ইউরোপের যে মডার্ন এজ সেটাকে আমরা অনুবাদ করলাম আধুনিক যুগ, ইউরোপের যে পোস্ট মডার্ন এজ সেটাকে আমরা অনুবাদ করলাম উত্তরাধুনিক যুগ। পুরো জায়গাটাই একটা মিস ক্রিয়েটিং জায়গা। তো, যে কারণে আমি মনে করি আমাদের সাহিত্যে যে রত্ন লুকানো আছে, যে পরিমাণ ধনরত্ন আছে, সেটা সামনে আনা দরকোর। পাশাপাশি, সাম্প্রতিক যে সাহিত্য আছে সেটাও আনা দরকার। এখানে বলা হয়েছে যে, অনেকে বলছে না বলে আমি বলছি কেন? এখানে সবার মধ্যে একটা শাইনেস আছে। আমি দেখেছি, মুজিবের সঙ্গে কারো একটা ভালো সম্পর্ক, তখন অন্যরা তাকে কর্নার করার চেষ্টা করল। কিন্তু আমি এসব ধার ধারি না। আমি অনেকটাই মুক্ত। ফলে কে কী বলল, সেটা নিয়ে আমি ভাবি না। আমার যদি মনে হয় এটা যথাযথ না, তাহলে আমি সেটা বলি না। মনোযোগটা সবসময় লেখার দিকেই রাখতে চাই। অযথা এনার্জি অপচয় করতে চাই না।
এবারও দ্বিতীয় দশকের কবিদের নিয়ে প্রায় বিশ পৃষ্ঠার মতো একটা গদ্য লিখেছি। আমি প্রথম দশকের কবিদের নিয়েও কাজ করছি। ফলে আমি আমার কাজটা করে যেতে চাই। আর কবিতার যে চিত্রটার কথা বললাম, আমরা যে গাছটা দেখি তার শিকড়টা কিন্তু দেখা যায় না। গাছ সূর্য থেকে আলো নিয়ে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। আমার কাছে কবিতাকেও সেরকম মনে হয়। কবিতার একটা উপরিভাগ আছে। কিন্তু তার অন্তরালের জায়গাটা অনেক গভীর। সেখানে এটার রসটা থাকে। সাহিত্য তো শিল্পের একট রস-উপাদান। এই রসটা, মাটির গভীরে থাকে। উপরে না। সবসময়। সেই জায়গা থেকে দেখলে, সাম্প্রতিক বিষয়টা উপরিভাগের। আমার ‘দাহকাব্য’, ‘রাজার পোশাক’ কিন্তু রাজনৈতিক কবিতা। আমার বন্ধুরা কিন্তু এটা নিয়ে একটা টোঁ শব্দও করে নি। সমসাময়িক সময়কে ধরা আমি দায়িত্ব মনে করেছি। এই কবিতাগুলো ঐতিহাসিক সামাজিক দলিল আকারেও দেখা যেতে পারে ভবিষ্যতে। শিল্পসাহিত্য মানুষ ও প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে নয়।
সাধারণত প্রকাশ্য বিষয়গুলো কবিতায় আনা যায় না। যেমন কলাম লেখকের বিষয়টা কিন্তু কবিতায় আনা যায় না। কারণ কবিতা অনেক গভীর। আমি মনে করেছি বর্তমান হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক সংকটগুলো কবিতায় আনা দরকার। সেটা আমি আনার চেষ্টা করেছি। কবিতার ক্ষেত্রে দেখা না দেখা অনেক অভিজ্ঞতা জড়িত থাকে। তারপরও আমার মনে হয় কিছু ভালো কবিতা, সময়ের যে চিত্র তা কিছুমাত্র হলেও আমার কবিতায় আছে।
সরোজ : কবিতা দিয়ে সমাজের এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব কি না?
স্বপন : অনেকটাই সম্ভব। আপনি নজরুলে কবিতার কথা ধরেন বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জীবনানন্দের কবিতার কথা ধরেন। তখন তো ব্যাপকভাবে উদ্দীপনা তৈরি করেছে। সাধারণভাবে কবিতার দায় এই না যে তার সমাজকে পাল্টাতে হবে। সমাজ পাল্টে দেওয়ার দায় কবির না। কিন্তু সে কন্ট্রিবিউট করতে পারে। আপনি দেখেন, বাংলাদেশের এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার লাইন দুটি স্লোগান হিসেবে কাজ করে নাই।
সরোজ : এরকম তো শামসুর রহমানেরও আছে। কবিতা দিয়ে তো পরিবর্তন করাই যায়, ধরেন নব্বইয়ের আন্দোলনের সময় যে কবিতাগুলো তৈরি হয়েছে বা ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এর কথা। আপনি বলেছেন যে ‘দাহকাব্য’ বা রাজনৈতিক কবিতাগুলোর কথা, এ কাব্যগুলোর কবিতা দিয়ে আপনি ওই ধরনের সংকটের মোকাবেলা...
স্বপন : এটা মোকাবেলা না। এটা হচ্ছে নিজের সংকটকে তুলে ধরা। গত দু’বছর ধরে প্রচুর সংকট তৈরি হচ্ছে নিজের ভেতর। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রচণ্ড স্পিরিটের মানুষ। কিন্তু গত দুই বছর ধরে এগুলোকে আমি গ্রহণ করতে পারি নাই। অমনাবিকতাকে গ্রহণ করা যায় না। যে সংকটগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলো আপন সংকটই। আমার কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য ‘রাজার পোশাক’-এ নাই, সেটা কিন্তু অন্তরা, সেটা কিন্তু ইশারা, সেটা কিন্তু আত্মরস। তার থেকে কিন্তু ‘রাজার পোশাক’ বা ‘দাহকাব্য’কে আলাদা ধরতে হবে।
মুজিব : এই জায়গাটাকে যদি ধরি, তাহলে বলা যায় কবিতা অনেক রকমের হয়। মানে এইরকম উচ্চকণ্ঠের যেমন হয়, তেমনি নিম্নকণ্ঠের হয়, আবার আধ্যাত্মিকও হয়। অনেক রকমের কবিতা আছে, নানা উপায়ে বা পদ্ধতিতে কবিতা শিল্পোত্তীর্ণ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কবিতার যত রকমের ফর্ম আছে, একজন কবি তার সবটাই চর্চা করে যাবেন কি না, যদি সেটা তার স্ববৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নাও মিলে? আপনি অনেক কবিতা গভীর গোপন ও নিম্নস্বর মিশিয়ে তৈরি করেছেন। ‘দাহকাব্য’ যে ধারার কবিতা, সেটা খুব প্রকাশ্যে কথা বলতে চায়, রাজনৈতিক ভূমিকা রাখতে চায়। আবার আপনি মরমি কবিতার দিকে বা বাংলার মূলসুরে প্রবেশ করতে চাইছেন। এই প্রত্যেকটা স্টেশনে একজন কবিকে থামতে হয় কি না বা একজন কবিকে প্রতি বিন্দুতে আলো ফেলে যেতে হবে এরকম দায় আপনি বোধ করেন কি না?
স্বপন : নাহ, এই দায় আমি বোধ করি না। আমি কবিতা করি রকেট বা ঝড়ের মতো। কবিতা যখন কবির চিন্তায় আসে তখন সেটা ঝড়ের মতোই। এটা থেমে গেলে মূলটা কিন্তু থাকে না। একটা তাড়না ছাড়া কবিতা জন্ম নেয় না। যে বিষয়টা আপনাকে তাড়িত করবে সে বিষয়েই অপনি স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা লিখবেন। আমি কবিতা লিখতে বসি, কবিতা লেখি। কবিতা ভাববার একটা ব্যাপার। এটা অনেক সময় জাগতিক সংকটটা প্রকাশ করে ফেলে। যেমন রাজনৈতিক কবিতা। যেমন ছন্দে লেখা কবিতা। কী লিখবেন সেটা ম্যুড অব এক্সপ্রেশনের ব্যাপার।
কাজেই এক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়বোধ করি না। আমি মনে করি না যে একজন কবিকে প্রত্যেকটা ধাপে ধাপে কবিতা রচনা করতে হবে। সেটা চিন্তা করা ঠিক না। সম্ভবও হয় না। মানুষের জীবনে অসংখ্য স্টেজ আছে। শৈশব, যৌবন, নানা স্টেজে আপনি থাকেন। যেমন গত বছর একটা প্রেমের ভেতরে ছিলাম। এক ধরনের ঘোরের ব্যাপার আরকি। সংকটেরও ব্যাপার। তো, একদিন হুট করে রাত ১২টার দিকে ড্রাইভারকে বললাম কোথায় যাওয়া যায়। সে বলল, স্যার বগুড়ায় চলেন। সেখানে নীরবে কয়েক দিন কাটিয়ে এসেছি। এরপর সেখান থেকে ফিরে কিন্তু টানা এখানেই ছিলাম। এ সময়ে বন্ধুবান্ধব কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করি নাই। তখন আমি শূন্যতাবাদ, মায়াবাদ বা লালনের, জালালের দর্শনের ভেতরে ডুবে ছিলাম। সে ঘোরের মধ্যে থেকে তখন আমি লেখা শুরু করলাম। এটা হয়েছিল কিন্তু একটা সংকট থেকে। সংকট থেকেই আমি লেখা শুরু করলাম। একজন কবি কিন্তু পার্টিকুলারলি জানে না সংকট কীভাবে তার মধ্যে সম্ভাবনা তৈরি করে। কারণটা পরে জানা যায়। ওই ভ্রমণ থেকে আমি এদিকে মোড় নিলাম। এটাকে হিজরত বলা যায়!
পরে যেটা বলতে হবে, আমি, জুয়েল, মামুন, সরোজ, আমরা যখন আড্ডায় বসি তখন জালাল খাঁ শুনি, রাধারমণ শুনি বা জুয়েল গায়, বা আমি গাই। এগুলো আমার মাথার ভেতরে পরিবর্তন আনে। আমাকে চিনবার জায়গা তৈরি করে। আপনি বললেন যে আমার জন্মের যে জায়গাটা, সেটা আমার ভেতরে তো একটা আবহ তৈরি করেই। বিচ্ছেদ, আবহ। আমার গ্রামে যখন রোয়া লাগায় তখন তারা গানে টান দিলেই তো বিচ্ছেদের সুর তৈরি হয়। আমরা গ্রামের বিষয়টা ভুলেই যেতে বসেছিলাম। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে এটা নিয়ে বড়ো ধরনের কাজ করা যায়।
মুজিব বলেছেন কবির দৃষ্টি প্রসারিত। ফলে কখন কোথায় গিয়ে তার দৃষ্টির আলো পড়বে বা অন্তরের চোখটা গিয়ে পড়বে সেটা আপনি জানেন না। আমার ক্ষেত্রে যেটা ঘটল। আমার চোখটা গিয়ে ওই জায়গাটার উপর পড়ল। পরে যেটা হলো, আরেকটা পঠন-পাঠনের আবহ তৈরি হলো। বা ধরেন মামুনের কাছ থেকে জালাল খাঁর বই নিয়ে পড়লাম বা তাঁর গান শুনলাম। এটাও অন্তরের একটা আবহ তৈরি করে। এটা কোনো দায় না। তবে সাহিত্যের প্রশ্নে লালন বা জালাল খাঁরাই কিন্তু আমাদের সাহিত্যে মূল ভাব। মূলধারা কিন্তু এটাই। এখনো মানিকগঞ্জে যখন স্থানীয় বাউলরা গান গায়, তখন কিন্তু তারা শুরুতেই বলে যে, এখন কবি জালাল খাঁর গান গাওয়া হবে। যতীন সরকার যে কাজটা করলেন যে ভূমিকাটা লিখলেন সেটা কিন্তু অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা। তো তাঁর জায়গা থেকে আমি আরেকটু খুলতে চাই ভবিষ্যতে।
সরোজ : মুজিব ভাইয়ের প্রশ্নের সূত্র ধরে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই। রবীন্দ্রনাথ মানসী, পূরবী, সোনার তরী যাই লিখেছেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথই কিন্তু ছিলেন। জীবননান্দও কিন্তু সময়ের সংকট মোকাবেলা করেছেন নিজ ভাষাতে। শামসুর রাহমানও কিন্তু সেই ভাষাতেই লিখেছেন। সেই ভাষা কিন্তু মৃত হয় নাই। আপনি যদি মূল ভাষার কবিতাটাও লিখেন, আবার কাজী নজরুলের কণ্ঠস্বরও কিন্তু একটাই। কবিতার বিষয়গুলোও কিন্তু ওই রকমই। সেক্ষেত্রে আপনি যখন পঞ্চাশে পৌঁছেছেন তখন আপনি কি আহমেদ স্বপনীয় ভাষাতেই থাকবেন?
ফেরদৌস মাহমুদ : একজন কবি যখন কথা বলে তখন সে তার নিজস্ব স্বরেই কথা বলে। এখন আহমেদ স্বপন মাহমুদ যদি সেই মরমি গানটাও লিখতে চায়, তাহলেও তাকে এই ভাষাতেই, এই টোনেই কথা বলতে হবে। জালাল খাঁর টোনে না। স্বপন ভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন। আপনি জালাল খাঁ বা ওই আবহে থেকেছেন। কিন্তু আপনি যখন কবিতা লিখতে আসলেন তখন কেন ওই আবহে থাকলেন না বা আজকের একজন তরুণ যখন কবিতা লিখেন তখন তিনি তার সেই মূল আবহে থাকে না কেন?
স্বপন : এর কারণটা রাজনৈতিক। কারণ কী? এটা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতি। আমরা যখন জীবনযাপন করি, তখন কিন্তু আমরা করপোরেট ওয়ার্ল্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটা কিন্তু চকমকে। আপনি যখন রাস্তায় হাঁটেন তখন সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছেন বা আড্ডারত মানুষের দিকে তাকাচ্ছেন। এটা আপনাকে পরিবর্তন করে। ত্রিশের পরে যে পরিবর্তনটা ঘটল সেটা আমরা নিজ চোখে দেখলাম না? কলকাতাকেন্দ্রিক যে সাহিত্যচর্চা সেটা কিন্তু এখানে প্রভাব ফেলেছে। কলকাতার যে সম্প্রসারণবাদ, তার যে রাজনীতি সেটা কিন্তু আমরা চিন্তা করি না। এখনো কলকাতার কেউ যদি আপনাকে ভালো কবি বলে, তবে আপনি বড়ো কবি!
আমি প্রথম কবিতা লেখি ১৯৭৯ সালে। কিন্তু আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরেই সাহিত্যচর্চা করি, তারা কিন্তু অনেকেই বই করার সাহস পাই নাই। আমি প্রথম বই করার চিন্তা করলাম ১৯৮৯ সালে। একজন কবির জন্য সংশয়, ভয়, এগুলো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমার অতিক্রমণের রেখা বের হলো তখন কিন্তু প্রচুর রিভিউ বের হয়েছে। নানা টেলিভিশন চ্যানেলে কথা হয়েছে। তারপর আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল বের হলো। আমার অফিসের সামনের এই মাঠে রাতে ঘাসের ভেতর শুয়ে কবিতাগুলো লিখেছি।
চিন্তার ভেতরে যে প্রক্রিয়াগুলো কাজ করে সেগুলোই ভাষার মাধ্যমে কবিতায় প্রকাশ পায়। একটা কথা ভাবতে হবে, ভাষারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এ কারণেই দেখবেন অতীতের যে একট ভালো কবিতা সেটাও অনেক সময় ভালো লাগে না ভাষার দুর্বোধ্যতার কারণে। আবার এটাও হয়েছে। আমার একটা কবিতা একজনকে পড়তে দিয়েছি, সে পড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে। তখন ভাবলাম যে, কী এমন সর্বনাশের কাজ করে ফেলেছি যে একজন কেঁদে ফেলল!
জীবনানন্দের কবিতা পড়ে আমরা শান্তি পাই কেন? এটা কিন্তু প্রশান্তি আনে আবার একই সঙ্গে ক্লান্ত করেও দেয়। যেমন আমরা যখন ট্রাজেডি দেখি, তা বেদনা জাগায়। কবিতা কিন্তু এরকমই। কবিতা বেদনা জাগায়। আর টোন কিন্তু পরিবর্তনও হয়। রবীন্দ্রনাথ যে এত বড়ো কবি, পঞ্চাশের আগে তারও কোনো নাম ছিল না কোথাও। তাঁকেও কিন্তু যুদ্ধ করতে হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে দেখা যায়, ভাব বা ভাষাও কিন্তু বদলে যায়।
আমি যে আবহে বড়ো হয়েছি তার ছাপ কিন্তু আমার কবিতায় স্পষ্ট। এমনকি শুরু থেকেই। তবে এর গভীর মরম এখন যেভাবে বুঝতে পারছি সেটা তারুণ্যে পারি নি। আমাদের সমাজ ও শিক্ষাও আমাদের চোখগুলো নষ্ট করে দেয়। আপনাকে চেনা তখন কছিণ হয়ে পড়ে।
জুয়েল মোস্তাফিজ : আমরা এখানে বসেছি স্বপন ভাইয়ের পঞ্চাশ উপলক্ষে। এক্ষেত্রে কিন্তু একটা দাবিও তৈরি হয়। উনার বয়স পঞ্চাশ, কিন্তু লেখার জীবন অনুযায়ী? আমাদের প্রত্যাশা এমন যে, আজকে উনি যা যা বলবেন সেটা স্পেসিফিক করবেন। উনি যা যা করেন তাই বলছেন। আমি শুনতে চাই উনি যা যা করেন, কেন করেন এবং উনি যা যা করবেন, সেটা শুনতে চাই। আমরা আপনার অভিজ্ঞতা সামনের প্রজন্মের কাছে ম্যাসেজ আকারে পৌঁছে দিতে চাই। কবিতা ভালো মন্দ এগুলো না। কবিতা ভালোও না মন্দও না। কবিতা হচ্ছে পারস্পেক্টিভ। একটা সময়ের মধ্যে যখন কেউ কলম ধরে তখন সে প্রেম লিখুক, আর দুঃখ লেখুক, সেটা কিন্তু ওই সময়ের রাষ্ট্র সমাজকেই উপস্থাপন করে। এটার মধ্যে যদি প্রেম না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে ওই সময়ে প্রেম ছিল না। এটার মধ্যে যদি দ্রোহ না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে ওই সময়ে কোনো দ্রোহ ছিল না।
প্রথমেই মুজিব ভাই প্রশ্ন করেছেন যে কাজগুলো কেমন হয়েছে। স্বপন ভাই সেটার উত্তর দিয়েছেন। এটা কিন্তু বিনয় না। আমার মনে হয়, একজন বলিষ্ঠ কবির কণ্ঠস্বরের মতো করেই তিনি উত্তর দিয়েছেন। আর প্রশ্ন নয়। আজকের এই আড্ডাটা থেকে আপনার কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে চাই। যা আপনি পারেন নাই, কিন্তু এরকম হলে হতো। আমরা কাজগুলো স্পেসিফিক করতে চাই কবিতা আসলে কীরকম হবে। আমরা কথা বলতে গেলেই জীবনানন্দ বা নানা কিছু চলে আসে। এখন এই সময়ে এসে একটা ঘরানা তৈরি করতে চাচ্ছি। আমাদের সময়ে বোধ, শক্তি, সামর্থ্য, লেখা সবকিছু এলোমেলো। কোনোটার কোনো গন্তব্য নেই। জীবনানন্দের কিন্তু একটা গন্তব্য ছিল, রবীন্দ্রনাথের একটা গন্তব্য ছিল। লালন কিন্তু তাঁর গন্তব্যের ভেতরেই ছিলেন। কিন্তু আমাদের কোনো গন্তব্য নেই। আমার সবকিছুর পরে এসে একটা গন্তব্যের ভেতরে পৌঁছুতে চাচ্ছি। আমার এই কাজটাই করা উচিত। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আমাদের এই আড্ডাটা একটা মাইলফলক হিসেবে থাকুক। পূর্বের হিস্টোরি না বলি, অর্থাৎ পূর্বের কার কথা বলবেন? জীবনানন্দের কথা তো সবাই জানে। তাই সেটা না করে আমি বলতে চাইছি, এই মুহূর্তে আমরা প্রত্যেকে স্বপন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইব, ধরেন এত বছর যা লিখলেন, ধরলাম, ওগুলো কিছু হয় নাই। কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতাকে স্পেসিফিকেলি জানতে চাই। এটার মধ্য দিয়ে এখন কবি কোন দিকে যাবে। আপনি একটু আগে বলেছেন যে আপনি মরমিভাব নিয়ে কাজ করবেন। সেটা কিন্তু আমার কাছে সাবসিডিয়ারি মনে হয়। কারণ সেগুলো নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। এখন আপনি আপনারটা নিয়েই, ওইগুলো নিয়ে কাজ করতে পারেন। তারপরও তা কবিতা হবে কি?
স্বপন : মনে হয় কী, আপনি দেখেন, রোগীর রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ দরকার। কবির কবিতা কিন্তু কবির ওষুধ। আপনি ভাব বলেন, ইমেজের কথা বলেন, একজন কবি তার প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটা মুক্তি তৈরি করে। আসলে যন্ত্রণার রিলিজ একটা কবিতায় পাচ্ছেন। আমার কাছে জীবন হচ্ছে উৎসবের মতো। প্রত্যেকটা সময় একটা সেলিব্রেশন। কবিতাও সেলিব্রেশনের বিষয়। আপনি বাক্যকে গরিমা দেন, এই প্রকাশটা একটা গরিমা। এটা একটা পারস্পেকিটিভ তৈরি করে। আমার যে সময় এটা কিন্তু মুক্তি খুঁজে। ওই যে আমি বললাম, আমার যে সময় এটাতে কিন্তু পদে পদে রক্তপাত ঘটে, পদে পদে সূর্যোদয় হয়। কবিতায় আপনি যখন হাঁটেন, এটা কিন্তু পুলসেরাত। সূক্ষ্ণ সুতার ওপর দিয়ে হাঁটলে আপনি যখন তখন পড়ে যেতে পারেন। পড়ে গেলেই অনল। সব শেষ। ফলে কবিতা যে পারস্পেকটিভ তৈরি করতে চায়, তাতে প্রতিনিয়ত তাকে পুলসিরাতের উপর থাকতে হয়। এজন্য তাকে উৎসবের মধ্যে থাকতে হয়। উৎসব মানে চিন্তার উৎসব। ভাবের উৎসব। বেদনারও উৎসব বই কি!
জুয়েল : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমার কাছে কবি বলতে পৃথিবীর সকল সংবেদনশীল মানুষকেই মনে হয়। আপনার মাধ্যমে পেলাম যে কবিকে বা সংবেদনশীল মানুষকে একটা পুলসিরাতের মধ্য দিয়ে সর্বদা যেতে হয়। এর মধ্যে কবির আরেকটা কাজ করতে হয় তাকে বাক্যে ধারণ করতে হয় সেই সংবেদনশীলতাকে। এখন একটু পেছনে আসি। আপনি যখন অতিক্রমণের রেখা লিখলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেটা পড়ে আলোড়িত হই। আমি কবিতা পড়ার সময় একটা বিষয় লক্ষ করি। কবিতার বাক্যের মধ্যে জীবনের নানাকিছু থাকে। অতিক্রমণের রেখায় দেখা যায় যে, ইমেজ জীবন লাভ করছে। এই কারণেই এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইমেজ হচ্ছে জীবন এবং ইমেজ হচ্ছে একটা ক্যারেক্টার এবং আমি পরবর্তী বইগুলোতে এই বিষয়টা কী পাই? ইমেজ এজ এ ক্যারেক্টার। কিন্তু পরে গিয়ে অভ্যাগত বাক্য হিসেবে রয়ে যাচ্ছে। সেটার আলাদা গুরুত্ব হয়ত থাকতেও পারে। তাহলে আপনি প্রথম বইতে ইমেজকে একটি চরিত্র করলেন, কিন্তু পরবর্তী বইগুলোতে গিয়ে আপনার ইমেজকে আমার কাছে ক্যারেক্টার মনে হয় না।
স্বপন : ঠিক আছে, মানুষের যে জীবন, সেটা কিন্তু একটা সাইকেল। একটা শিশু জন্ম নেয়। আবার সে মৃত্যুবরণ করে, বৃদ্ধ সময়ে মানুষ আবার শিশুর মতো হয়। একটা ঘূর্ণিচক্রে আছি আমরা। সেটা ভাবে, অভাবে সবদিক দিয়েই। জগতে সবকিছুই ক্যারেক্টার ধারণ করতে পারে। শুধু ইমেজ না। গাছের পাতা নড়ে। এই নাড়াচাড়াটাও ক্যারেক্টর। দেখার চোখ, নির্ণয়ের চোখ চাই আমাদের।
জুয়েল : আপনি কিন্তু এটা বলে ফেলতে পারেন যে, ওই বইটা আপনি ছাড়াতে পারেন নি।
স্বপন : এটা হতে পারে। কিন্তু এই বইটির যে নামটা সেখানে কিন্তু একটা পরম আকাঙ্ক্ষা আছে। আবার আপনি ইমেজের ভেতর যে ক্যারেক্টার চাচ্ছেন, সেটা আপনি পাইতে পারেন, কারণ আপনি অতিক্রম করবেন। কিন্তু কী অতিক্রম করবেন? আপনার যে রেখাটা তা তো চক্রাধীন। আমি বলি যে, একজন কবি শুরু করেন যেখানে, সেখানেই আবার তাকে ফিরে আসতে হয়। শুরুটাই কবির গন্তব্য। আর মাঝখানে সে কিছু ফসল বোনে। আপনি দেখবেন, জুয়েল অনেক সময় আমাকে উদ্ধৃত করে বলে, লোভ সে তো সংবরণের নাম। বা যথাযোগ্য করি কলমতালাশ। এখানে কলমতালাশের একটা ব্যাপার আছে। তালাশ দরকারি।
তো কবিতার কাজ তো অন্বেষণের কাজ। অতিক্রমণের রেখা লেখার সময় আমার যে শৈশবের অভিজ্ঞতা সেগুলো অনেক কাজ করেছে। অতিক্রমণের রেখার রেখা যে কবিতাটা সেটা নিয়ে আমি লিখেছিলাম মাহমুদ শাওনের কাগজে। রেখা বিস্তীর্ণ হলে বর্ণ ক্রমাগত নীল হয়, সুদূরের যে পথে তুমি রেখা ক্রম সেই পথে ধায়, একটি ঘোড়া...। ফলে এই জায়গাটায় দেখবেন উত্তরণ, প্রারম্ভ বা ধ্বনি এগুলো কিন্তু একটা ভাব নিয়ে এসেছে। পরবর্তীতে যেটা হয়েছে সেটা অভিজ্ঞতা। আমি বলি অভিজ্ঞতা দুই প্রকারের। দেখা অভিজ্ঞতা ও না-দেখা অভিজ্ঞতা। কল্পনা হচ্ছে, না-দেখা অভিজ্ঞতা। আর কবিতা হচ্ছে দেখা আর না-দেখা অভিজ্ঞতার একটা সংশ্লেষ। আমি ওই সময়ে থাকতাম চরফ্যাশনে। কিছু কবিতা চরফ্যাশনে লেখা। কিছু কবিতা জামালপুরে লেখা। কিছু কবিতা ঢাকায় লেখা।
ভাবের একটা গুরুত্ব আছে। পরবর্তীতে যে বইটা, সকল বিকেল আমাদের অধিকারে আছে, সেটাও আলাদারকম। পুরো বইটা জুড়ে আছে শুধু প্রেম। আমি এখানে একটা ঐক্য দিতে চেয়েছি। ঠিক একইভাবে আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল পুরোটাই একটা ট্রাজেডি। আমরা কিন্তু বাংলা কবিতার ওই ট্রাজেডি উন্মোচন করি নাই বা উন্মোচন করতে যাই নাই। যে সমস্ত ট্রাজেডি বা বাস্তবে যে ট্রাজেডি ঘটে, সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আবার অবিচল ডানার উত্থান-এ তার টোটাল ফরমেটটাই কিন্তু আলাদা। ভিন্ন ফরমেট। আমি একটা অখ- ভাব নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি বেশি।
জুয়েল : তাহলে এখানে আসি। আপনি অনেক ধরনের কাজ করেছেন। অতিক্রমণের রেখার পরেও অনেক অনেক কাজ করেছেন। যেটা বলা দরকার। আপনার কবিতা পড়ে কিন্তু বোঝা যায়। শৈশবের বিষয়গুলো কিন্তু রিপিট করে। একজন যখন কবিতা লিখেন তখন ভিটেমাটি কিন্তু ছাড়তে পারেন না। আমি কিন্তু আপনার কবিতা পড়েই নেত্রকোনা চিনি। তার মানে আপনি কবিতার একটা মর্মের জায়গায় আছেন। যেমন ‘করিও কলমতালাশ’ সেটা কিন্তু চমৎকার। সেটাই কিন্তু মজার। আপনার থেকে শুনেছি, আপনার নানু বলতেন ‘যথাযোগ্য করিও কলমতালাশ’। এরপর নাতি বড়ো হয়েছে, কবিতায় কিন্তু সেটা আছে। আমি কিন্তু ছুঁড়ে ফেলব আমার ভিটেমাটি... নানা নাতিসমেত। এটা পজেটিভ একটা দিক। দুই নাম্বার হচ্ছে, আপনাকে পাঠ করার ক্ষেত্রে বা আপনার জাম্পিং লক্ষ করার ক্ষেত্রেও অতিক্রমণের পর আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল-এ তাকাতে হবে। সেখানে আমি দেখছি অখণ্ড অভিব্যক্তি বা ঘোর, সেটাও দারুণ। আমরা যখন খণ্ড খণ্ড কবিতা লেখি, তখন কিন্তু একটা কবিতার পর আরেকটা কবিতার ঐক্য রক্ষা করি না। আমি মনে করি, অখণ্ড যখন একটা জায়গা তৈরি হয়, সে জায়গাটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কবিতার একটা পারম্পর্য তৈরি হয়। আপনার আনন্দবাড়িতে তার ছাপ আছে। যেভাবে আপনি লাটিম ছুঁড়ে মারলেন, সেভাবে ইমেজ ছুড়ে মারলেন। আপনার বাড়ি আমার বাড়ি এক নয়। আপনি যে কাজগুলো করেছেন, সেখানে একটা ঐক্য আছে। সেগুলো কবি এবং কবিতার ঐক্য মনে হয়। আপনি বলেছেন, জীবন আনন্দময়; সেটা কিন্তু আপনার কবিতায় আছে। আপনার ভেতর তাৎক্ষণিক ব্যাপারটা আছে। সেটা কবিতাতেও আছে।
মুজিব : আপনি এতক্ষণ যে অভিব্যক্তির কথা বললেন, তার প্রেক্ষিতে শেষ দিককার বিষয়ের ওপর কয়েকটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন। আপনার ক্রাইসিসের বর্ণনা, ওর সাথে আপনার সম্পৃক্ততা আপনার কথাবার্তায় এসেছে। নানা ধাঁচের অসংখ্য কবিতা এক মলাটে করে চালিয়ে দেওয়া আপনি পছন্দ করেন না। আপনাতে এই অপছন্দটা প্রকট। স্বপন একটি অখণ্ডতা দিতে চান একটা থিমকে ঘিরে। একটা পরিবেশকে এক করে আপনি পাণ্ডুলিপিতে আনেন। একটা বিষয়কে ধরে একাধিক অখ- কবিতাকে একটা খণ্ডে হাজির করা লেখকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জুয়েল, আপনি যখন দুটি বইকে আলোচনায় আনলেন, তখন মনে হলো অন্য জায়গাগুলোতে তেমন আলো পড়ে নাই। যতটুকু আলো পড়লে ওটাকে একটা বৃহৎ বৃক্ষ মনে হতো, ততটুকু পড়ে নি বলে সেটাকে ছোটখাট একটা শ্যাওড়া গাছ মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা এরকম কি!
এই আলাপের ভেতর দিয়ে আমরা যেটা দেখছি, ওই সময়ে একটা তাড়না দ্বারা আপনি তাড়িত হচ্ছেন। ওই তাড়নাকে সুচিন্তিতভাবে যখন কাজে লাগাতে পারলেন, তখন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। শুরুর দিকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম যে, একজন লেখক সব দিকে নজর দিবে কি না। এসব আলাপের ভেতর দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, আমাদের ভাষা যেইদিকে মোড় নিচ্ছে সেটাকে যখন রেসপন্স করতে পারব, নিজের ভাষায় অনুভূতিকে যখন বাণীবদ্ধ করতে পারব, সফল হব, তখন তাকে বলতে পারব যে জীবনের প্রয়োজনে হাঁটা হয়েছে। যখন কৃত্রিম কবিতা লেখা হবে, তখন যত ভালো আর আনন্দময়ই তা হোক, সেই কবিতাকে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা গুরুত্ব দিয়ে যেতে পারব না। আবার কবিতাকে যখন দেখতে চাই তখন কবির জীবন দিয়েই দেখতে চাই। আমরা দীর্ঘ সময় পরে যখন বিশ্লেষণ করি তখন কবিকে তার জীবনের ভেতর দিয়েই দেখি। সেভাবেই আমরা তার মূল্যায়ন করি।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ ‘দাহকাব্য’ যখন লিখলেন তখন তাকে দেখেছি বিষয়গুলো দ্বারা তিনি কীভাবে তাড়িত হয়েছেন। ফলে অতিক্রমণের রেখা আর দাহকাব্য যখন একজন কবিই লিখেন, তখন বুঝতে হয় যে ওই জীবনের ভেতর দিয়ে তিনি গেছেন। অর্থাৎ এই প্রত্যেকটা পর্যায়ই তার জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এগুলো বোঝায় কখন কী দ্বারা কবি কীভাবে তাড়িত হচ্ছেন। এ পর্যায়ে প্রশ্ন করব যে, বানানো কবিতা লিখবার যে প্রবণতা চারপাশে বিরাজ করছে, সেসব কবিতার ভবিষ্যৎ কী বলে মনে করেন? বা এ ধরনের কবিতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
স্বপন : এটা খুবই অদ্ভুত বিষয়। আমার মাথায় কাজ করে না যে এটা কীভাবে সম্ভব। আমার সামনে খুন হলো একটা, অথচ আমার মধ্যে এটার কোনো প্রতিক্রিয়া কাজ করল না। তখন এটা অতিপ্রাকৃত একটা ব্যাপারের মতো মনে হয় আমার কাছে। ফলে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমাকে আলোড়িত করে। কবিতা হচ্ছে একজন কবির সৎ প্রকাশ। কোনোরকম অসততা একজন কবিকে মানায় না। কাব্যে কবির প্রেমকে এমন গভীরভাবে নিবেদন করতে হয়, যার একটু সামান্য এদিক ওদিক হলে কবিতার দেবী তাকে বিমুখ করে দেয়। আর একটা বিষয় হচ্ছে, ধ্যান থাকতে হয়। আমার দেখার বাইরে গিয়ে আমি কিছুই লিখতে চাই নি। অমি যা লিখেছি সেটা খারাপ হতে পারে, দুর্বোধ্য হতে পারে। আমার দেখার বাইরে কিছু লিখতে চাই না। দ্বিতীয়ত, কবিতা হচ্ছে সুপ্রীম ফর্ম অব আর্ট। বিশ্বসাহিত্যের সেরা কৃতিগুলো সরল এবং মজবুত। কবিতা যত সহজের দিকে যেতে পারে সেগুলোই বেশি কবিতা হয়ে পড়ে এবং টিকে যায়।
মুজিব যেটা বললেন, সেটা উদ্বেগর ব্যাপার। এ সাহিত্য গুরুপরম্পরা বিদ্যা। আগে এটা মানতাম না। কিন্তু বারী ভাই বলার পরে আমার আরও বোধোদয় হয়। কবিতা বিদ্যা আকারে গুরুপরম্পরা। আজকে যেটা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে যাচ্ছে। যেমন ইমেজ, চকচকে একটা কিছু লিখে দিলাম, সেটা একটা কবিতা হয়ে গেল! ধরেন একটা ঘোড়া কেশর উড়িয়ে প্রশ্রবনের দিকে চলে যাচ্ছে। এরকম একটা চর্চার ভেতর দিয়ে চমকের ভেতর দিয়ে এগুলো যাচ্ছে। একটা সময় কবি গিয়ে রিয়ালাইজ করবেন। দেখবেন তিনি যে অস্থিরতা তৈরি করেছেন, সেটা টিকে থাকছে না। কবি যখন বিশ বছর ত্রিশ বছর লিখবেন তখন এটা বুঝবেন। যেমন গরুর গাড়ি মহাকাশে চড়তে পারে না, কিন্তু আপনি বললেন মহাকাশে যাত্রা করলাম গরুর গাড়ি দিয়া। এটা কিছু মিন করে না। কারণ এটার কোনো পরম্পরা নেই।
কবিতার একটা ডিসিপ্লিন আছে। অ্যাবসার্ড পয়েম আছে। কিন্তু এটারও পরিমার্জনা আছে, পরম্পরা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে কবিতা তো শিল্প আকারেই টিকে থাকবে। একটা কবিতা এক হাজার বছর পরেও কেন পড়ি। এজন্যই পড়ি যে এটা পাঠের ফলে আমাদের ভেতরটা এলোমেলো করতে পারে। আমাকে এলোমেলো করে দেয় বলেই আমি কবিতা পড়ি। পাঠের ভেতর আপনি কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন সেটা অন্য সময় হন না।
সরোজ : মুজিব ভাই যেটা বলছেন, কৃত্রিম কবিতা ও বেদনার ভেতর থেকে উঠে আসা কবিতার কথা। তো এটা নিয়ে আপনি কী বলবেন? কবিতার ইতিহাস বা সমাজের ইতিহাস কিন্তু পরিবর্তনের ইতিহাস। আজকে কিন্তু বৈষ্ণব কবিতা কেউ লিখবে না। কারণ সে জীবন কেউ যাপন করছে না। এই মুহূর্তে কবিতা প্রাণের জায়গা থেকে আসে। আমাদের প্রস্তুতি কমে গেছে কবিতার ক্ষেত্রে।
স্বপন : কবিতা লেখার ক্ষেত্রে মনে হয় না যে প্রস্তুতির কোনো বিষয় আছে। আমি কিন্তু পাঁচ সপ্তাহ একটা টেবিল চেয়ারে বসে উপন্যাস লিখতে পারলেও কবিতা লিখতে পারি না।
মুজিব : স্বীকার না করলেও আপনার নিজেরও হয়ত একটা প্রস্তুতি আছে যে চেয়ার টেবিল একটু পরিষ্কার করে বসছেন। এটা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। একজনের হয়ত নেপথ্যে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সাপোর্ট দরকার ধ্যানে পৌঁছার জন্য। আপনি যখনই লিখতে যাবেন তার ইমেডিয়েট আগে আপনাকে ডিপ মেডিটেশনে পৌঁছাতে হয়। প্রত্যেক লেখকই সেই মেডিটেশনে পৌঁছান। কেবল পদ্ধতিটা ভিন্ন হয়। সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি দেখতে চাইব এই মেডিটেশন প্রক্রিয়াটা আহমেদ স্বপন মাহমুদ কীভাবে ঘটান।
সরোজ : আমি হয়ত প্রশ্নটা ভুলে যাব। জুয়েল বলছেন ইমেজের কথা। বেদনার ভেতর থেকে, মেডিটেশনের ভেতর থেকে কবিতা আসতে থাকে। যখন কাগজে কলমে আপনার শব্দগুলো নামতে থাকে। সেই শব্দগুলো যেভাবে আসে সেগুলোকে পরবর্তীতে আপনি ভাঙচুর করার প্রয়োজন মনে করেন কি না। ধরেন কোনো শব্দও ভাঙচুর করতে হয়, অভিজ্ঞতাটা খাতায় নামানোর পর এই ভাঙচুরটা কীভাবে করেন? মানে লিখবার পরের এডিটিংটা আপনি কীভাবে করেন?
স্বপন : আমি যেভাবে কবিতা লেখি। এক হলো মানুষের মেমোরি তো তার জন্মের আগের। কারণ সে তো ইতিহাসে হাঁটতে থাকে। এটা একটা বিষয়। আর নিমগ্নতা ছাড়া কবিতা সম্ভব হয় না। আমি মনে করি। একজন কবি সবসময় নিমগ্ন থাকে। আর সে হাঁটতে গেলে ভাত খাইতে গেলেও দেয়ালের ভেতর ইমেজ দেখে। আমিও এটা দেখি। এখনও আমার ভেতরে এটা আছে। এটা এক ধরনের নিমগ্নতা, নচেৎ বিল্ডিংয়ের ভেতর চৌচির হয়ে আছে মানুষের মুখ, এটা আমি কেন দেখি? এটা আমার নিমগ্নতাই। আর কবিতা কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে। ধরেন আড্ডা দিচ্ছি, এর ভেতরেই কিন্তু আমি কবিতা লিখতে পারি। আমি হয়ত আড্ডার মধ্যে আছি কিন্তু কবিতা লিখলাম। আমি হয়ত আড্ডার ভেতরেই নিমগ্ন হয়ে পড়লাম। শব্দের ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
একটা ঘটনা বলি, একবার সরোজের মেসে গেলাম। তখন হঠাৎ মাথার ভেতর কী যেন কাজ করল। তখন সরোজকে বললাম কাগজ দেন। তিনি দিলেন, আমি কবিতা লিখলাম কাঠালের রঙের মতো...। দেখা যায় যে, আপনাদের সঙ্গে হঠাৎ আড্ডা দিতে দিতে কবিতা লিখে ফেলি। এভাবেই লিখি আমি।
আমরা যখন মাঠে হাঁটি। তখন কিন্তু অসংখ্য লোকের মধ্যে বসে কবিতা লিখে ফেলি। আমি সাধারণত কবিতা খুব একটা এডিট করি না। যেমন লাইনটা বদলে দেওয়া, শব্দটা বদলে দেওয়া, এটা কিন্তু আমি মনে করি না। আমি যেটা ঠিক করেতে চাই সেটা হচ্ছে ভাষা। ভাষার গ্রামারটা। গরুর গাড়ি যেন আকাশে না উড়ে সেটার দিকে লক্ষ রাখি। ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করি না। কারণ আমি মনে করি এডিট করার সময় আমরা অন্য মুডে থাকি। আর লিখি অন্য মুডে। দুই মুডের মধ্যে পার্থক্য আছে।
মামুন খান : আমরা যারা লেখি তারা নিজেরাও বুঝি না যে কী লিখলাম। আমার বেশিরভাগ কবিতাই তাহাজ্জুতের সময় ছাড়া লিখতে পারি নাই। আমার মনে হয় আমার ঘোরটা তৈরি হতে হতে হয়ত ওই সময়টা চলে আসে। আমার মনে হয় না যিনি লিখলেন তিনি কী লিখলেন সেটা বলতে পারবে না। পরদিন আপনি যখন আবার কবিতাটা পড়লেন, তখন আপনি সচেতনভাবে মনে করলেন এটা আরেকটু মসৃণ হতে পারত। কারণ পাঠক কবিতা পড়ার সময়ে কবির মতো ঘোরগ্রস্তভাবে পড়েন না। কারণ আপনি যখন কবিতা পড়ছেন তখন আপনি সচেতন মানুষ। আপনার তখন উচিত আপনার লেখাটা মসৃণ করা। আমি যেটা জিজ্ঞাসা করতে চাই সেটা হচ্ছে, আপনি প্রচুর লিখছেন। আপনার আসতেছে আপনি লিখছেন। যে অনুভূতি আসছে সেটাকে সাথে সাথে মর্যাদা দিচ্ছেন। আপনার এই যে অবিরত লিখে যাওয়া এতে বাঁকও আছে। আমি আপনাকে অনুরোধ করব আপনি ৬ মাস লিখবেন না। তখন আপনি ভাবেন যে, আপনি কী লিখেছেন এবং আপনার কী লেখা দরকার। কারণ আমার মনে হয়, আপনার মতো যারা লিখেন, তারা মনে হয় তাদের লেখাকে বাঁক তৈরির স্কোপটা দিচ্ছেন না। এটা নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?
স্বপন : না। আমি এটা মনে করি না যে আমি যে জীবনযাপন করি, সেটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তা এই জীবনযাপন যেই করুক না কেন। আমার তো কাজের প্রেসার থাকে। পরিবারের প্রেসার থাকে। আমি নিজেকে প্রচণ্ডভাবে সুপ্রীম স্বাধীন মনে করি। এজন্য পরিবারের দায়িত্ব আমি নেই না, নিতে চাই না। আমি বাজারে যাই না। আর আমার যে কাজের প্রেসারটা সেটাও রাখতে চাই না।
আমার সংগঠনের প্রেসারটাও রাখতে চাই না। ফলে আমার পরিসরটা বড়ো। আমার মতো সময় পেলে যে কেউ লিখতে পারবে। মানুষ লেখা নিয়ে চিন্তা করার সময়ই পায় না। আর আমি সবসময় চিন্তা করি লেখা নিয়েই। লেখা ছাড়া আর কোনো চিন্তাই করি না। ফলে আমার লেখাটা দাঁড়িয়ে যায়।
মামুন যেটা বললেন। হ্যাঁ, আমি অনেকদিন লিখছি না। গদ্য লিখছি টুকটাক। আমি দেখছি নিজেকে। নিজেকে নিয়ে ভাবছি। আমি এই বছর তিনশোর মতো কবিতা লিখে ফেলেছি। তখন হয় কি এডিটিংটা আর করা হয় না। যেমন ইচক দুয়েন্দে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতেন কোনো দাগ না দিয়ে। কোনো পৃষ্ঠায় যদি দাগ পড়ল তো তিনি সেই পৃষ্ঠাটাই ফেলে দিচ্ছেন। তবে এডিটিংটা আমি মনে করি দরকার আছে। সেটা গ্রামার এবং পারম্পর্যের ক্ষেত্রে।
ফেরদৌস : ঠিক আছে, কিন্তু আপনি এত কবিতা লিখলেন এবং এক বছরে তিনটা কবিতার বই করলেন। এটা পাঠকের জন্য একটা বিড়োম্বনা। কারণ পাঠক কোনটা পড়বে আর কোনটা পড়বে না সেটা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়। আবার আপনি প্রায় বলেন যে বইমেলায় বই করা প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু একটা বইমেলায় আপনি কেন তিনটা বই করলেন?
স্বপন : তিনটা না। হা, হা, হা। একবার বইমেলায় দুইটা বই বের হইছিল। সেটা ২০১১ সালের বইমেলায়। আমি যখন নির্বাচিত কবিতার বই করলাম, সেবার আরেকটি বই বের হয়েছিল। আরও একবার একমেলায় দুটি বই বের হয়েছিল। আমি আাকাঙ্ক্ষা করি যে মেলাকেন্দ্রিক বই হওয়া ঠিক না। যদিও বাস্তবতা হলো মেলাকেন্দ্রিক বই। কারণ একজন লেখক তো সারাবছরই লেখালেখি করেন। আমাদের কালচারে এটা সার্বক্ষণিক হওয়া উচিত। আর আমার ‘ভাব ও বৈভব’ ও ‘রাজার পোশাক’ এক বছরেই হয়েছে।
সরোজ : আমরা কবিতার প্রসঙ্গে আবারো ফিরব। তার আগে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। স্বপন ভাই জামালপুরের একটা কলেজে কিছুদিন চাকুরি করেছেন। সেখানে তার একজন ফ্রেন্ড ছিলেন মুজাহিদ বিল্লা ফারুকী। তার সঙ্গে আমারও কিছুদিন কাজ করা হয়েছে। তিনি আমাকে বলতেছিলেন, আপনি কি স্বপনকে চিনেন? উনি বলেছেন যে, স্বপন তো সবসময় কবিতা নিয়েই থাকেন। আপনি আবার কাজে দেশের বাইরেও যান। এই যে আপনি চাকুরি করেছেন আবার নিজে প্রতিষ্ঠানও চালাচ্ছেন, আলাদা আলাদা জীবনযাপন। আবার আপনার সহকর্মীরা বলছেন, সবসময় আপনি কবিতা নিয়ে থাকেন। তো, আপনার জীবিকা বা কবিতা দুটোই ভিন্ন ভিন্ন জায়গা। আমি জানতে চাইছি, এই যে প্রতিনিয়ত নিজেকে চেঞ্জ করছেন সেটা কি লেখার জন্য?
স্বপন : আমি আসলে ফ্রিডম চাই। এমনকি বাড়াবাড়ি লেভেলের ফ্রিডম চাই। এটা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে যে বিড়োম্বনা ঘটে নাই তা নয়। ব্যক্তিগত জীবনেও বিড়োম্বনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তবু যেন ফ্রিডমের বিনিময়ে সে বিপদটা আমি মেনে নিয়েছি। কলেজে যখন পড়াতাম, তখন আমি ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলাম। আমার ক্লাস ছিল সপ্তাহে তিনটা। কলেজে যদি শিক্ষকতার সময় ৬ দিনে তিনটা ক্লাস থাকে, তাহলে বাকি সময়টা আমি ফ্রি। বাকি সময়টা আমি কী করতাম? আড্ডা দিতাম, প্রেসক্লাবে যাইতাম। তাস খেলতাম আর কবিতা লিখতাম। আর সামান্য সাংবাদিকতা করতাম। আমি ওই সময়ে টিউশনি করাই নি। তবে বিয়ের আগে টিউশনি করিয়েছি। ইয়ং মেয়েরা আসত পড়তে। তাদের প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। আমার কাছে সাধারণত মেয়েরা পড়ত। দেখা গেছে, একদিনে বিভিন্ন ব্যাচে ষাট-পয়ষট্টি জন ছাত্রী আমি পড়াচ্ছি। সেটা আমার জন্য ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। তো ওই অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে কবিতা হয়ে আসত। এটাও ঠিক, পড়াইতে পড়াইতে তো প্রেমে পড়ে বিয়েই করে ফেলেছি।
এ ছাড়া, আমি ভোলাতেও চাকুরি করেছি। খুব বেশিদিন না হলেও। আমার কবিতায় দেখবেন যে, রঙের ব্যাপকতা। ভোলোায় কী সুন্দর প্রকৃতি! চরফ্যাশন, ভোলোা, পুরো অঞ্চলটা এত সুন্দর ও এত প্রাকৃতিক যে, আপনাকে টানবেই সেটা। আর অফিস করতাম কেমন জানেন! আমার অফিসটা শুরু হতো পাঁচটার পরে। তো, আমি সেখানেও সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমার আন্ডারে দেড়শ জন মানুষ ছিল। সেখানেও মেয়েরা বেশি ছিল। আর এটা বলতে হয় যে, আমি কিন্তু মানুষের খুব আশীর্বাদ পেয়েছি। আমি সৌভাগ্যবান মানুষ। আমি ভোলোায় গিয়ে প্রথমে নিয়োগ দিলাম এগারজন কলেজপড়ুয়া মেয়েকে। আমি একটা বিভাগের প্রধান। ফলে মানুষের সংস্পর্শ, প্রকৃতির রূপ-রঙ, এগুলোর ভেতর দিয়েই কিন্তু কবিতা উঠে আসে। আবার এমন কিছু না যে, আপনারা পারছেন না, বা মুজিব পারছে না। আমার চাকুরিগুলো আমার ফেভারে ছিল। আমার কাজটাও ছিল গবেষণামূলক। আমি তো সবসময় মাঠেঘাটে গিয়ে কাজ করি না। আমার কাজ গবেষণাধর্মী। প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। আবার কাজেকর্মে দেশ-বিদেশেও যেতে হয়। এসব কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেখতে পেরেছি, শিখতে পেরেছি। নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি কিন্তু মানুষের মুখ দেখি। বিভিন্ন রঙের মানুষ দেখি। প্রত্যেকটা মানুষের মুখের অভিব্যক্তি স্বতন্ত্র। প্রকৃতি ও মানুষের মুখ, মুখের মায়া আমাকে কবিতার অভিব্যক্তি তৈরিতে সহায়তা করে।
মুজিব : আমি নিজে চাকরি করি, মানে আমি একজন চাকর। অন্যের নির্দেশে কাজ করি। অন্যকে খুশি রাখি। চাকরি ব্যাপারটাই এমন যে, আপনি সারাদিনে কী করলেন না করলেন সেটা আপনার একজন সুপারভাইজার দেখভাল করবেন। ধরা যাক, আপনার একটা অ্যাসাইনমেন্ট তিনদিনে সম্পন্ন করতে হবে, সেটা যখন পারছেন না, তখন আপনার সুপারভাইজার অখুশি হতে পারেন। তাতে প্রফেশনালি আপনার সমস্যা হবে। এরকম অবস্থায়ও আপনি যদি খানিক স্পেস পান তবে হয়ত সাহিত্য করবার কথা ভাবতে পারবেন, না পেলে পারবেন না। দায়িত্বে ফাঁকি দিলে সুপারভাইজার ভর্ৎসনা করবেন, যেটা গ্লানিকর ব্যাপার। একচুয়্যালি এরকম পরিস্থিতিতে শিল্প-সাহিত্য করা যায় না।
স্বপন ভাইও চাকরি করেছেন। তিনি যে নিজে চাকরি করেছেন, যে ধরনের পজিশন হোল্ড করেছেন, সেখানে হয়ত কিছু ফাঁকফোকর বের করা গেছে। কিন্তু এখন তিনি যে পর্যায়ে আছেন, সে ধরনের পজিশনে চাকরি করে লেখালেখি করবেন সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমি এখন অফিসে বসে সহিত্য করব, সেটা কল্পনাও করতে পারি না। ইভেন আমি অফিসে এফবিতে ঢোকার কথাও ভাবতে পারি না। ঢুকতে খারাপ লাগে। বিপরীতে স্বপন ভাই এখন যেভাবে লেখালেখি করেন অফিসে বসে, সেটা রীতিমতো ঈর্ষণীয় ব্যাপার। এটা তিনি পারেন, অন্যের আন্ডারে চাকরি করেন না বলে। তাঁর নিজের অফিস আছে। নির্ভরযোগ্য স্টাফ আছে। তারাই কাজটা করেন। তার কিছুটা গাইড করলেই চলে। তিনি একটু পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেন এবং নিজের মতো সারাদিন সাহিত্য করেন।
স্বপন ভাইয়ের প্রবণতাটাই এমন যে দেদার লিখতে পারেন। না লিখলে তার স্বস্তি নেই। শারীরিক-মানসিকভাবে তিনি স্বস্তি পান না। তার এই অখণ্ড অবসরটা বড়ো মাপের একটা সম্পদ। এই সম্পদটা তিনি ঠিকভাবে কাজে লাগাবেন সেটাই আমরা চাইব। এর মধ্যে ভালো লেখা যেমন আসবে, তেমনি খারাপ লেখাও আসবে। এই ভালো-মন্দ মিলিয়েই একজন সাহিত্যকর্মীর বেড়ে ওঠা।
স্বপন : আমি এখানে একটু যোগ করি। জুয়েলকে আমি দেখতাম। জুয়েলকে নিয়ে আমি লিখেছিও। আমি জুয়েলের চাকরির পেইন দেখেছি। কবির হৃদয় স্বাধীন ভূখ- আমি বলি। কবির হৃদয়ে যদি স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে সে লিখতে পারে না। মুজিবের যন্ত্রণাটাও দেখি, সে যে কাজ করে, আমরা যেহেতু একসঙ্গে আড্ডা দেই, তা জানি। সরোজেরও। এই যে কলেজের কাজটা, আমি সরোজকে অনেক সময় ফোনই দিই না। দেখা গেল যে সে ক্লাসে আছে। আমি তার পেইনটা বুঝি। মুজিবও অনেকদিন ধরে লিখতে পারছেন না তেমন। তার কাজের ব্যস্ততা, স্ত্রীর অসুস্থতা, পরিবার সামলানো ইত্যাদি কারণে। আবার জুয়েলের ব্যাপারটাও আমি বুঝি। সেই বসুন্ধরায় অফিস করে, সেখান থেকে বাসায় আসা, তারপর ক্লান্ত হয়ে লিখতে বসা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। লেখাটা নিয়ে সে কখন ভাববে, বইটা কখন পড়বে। সে সময়টা তো পাচ্ছে না।
মুজিব : পরিসর তৈরি হওয়ার যে কথাটা এল, সেক্ষেত্রে আমার ঘাটতিটা অতিসাম্প্রতিক ঘটনা। এখন আমার অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে হয়, ব্যস্ত থাকতে হয়। অফিসে ব্যস্ত থাকি বলে একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছিল গত কয়েক বছর ধরে। আফটার অফিস আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট স্বাধীন মানুষ হয়ে যেতাম। কোনো ফাঁকা জায়গায় চলে যেতাম। আমার একাধিক বইয়ের প্রতিটি শব্দ বাসার বাইরে ফাঁকা জায়গায় লিখিত। অনেক বইও পড়েছি আমি ঘরের বাইরে। কাছে-দূরের এরকম জায়গায় আমি চলে যেতাম। কিন্তু লাস্ট ওয়ান ইয়ার নিরাপত্তাজনিত হুমকির কারণে আমি সেসব জায়গায় গিয়ে বসতে পারি না। মনে হয় কে বা কারা যেন আমাকে অনুসরণ করছে।
২০১৫-এর ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমার ভেতরে এই সংকটটা তৈরি হয়েছে। বাইরের পরিবেশভিন্নতা মনের ভেতরের পরিবেশও নষ্ট করে দিয়েছে। গত এক বছর আমার লেখালেখির পরিমাণ কমে যাওয়ার এটা একটা বড়ো কারণ। এখন ভাবছি অন্য পরিবেশে, মানে বাসায়, লিখবার অভ্যাস গড়ে তুলব।
জুয়েল : আমরা এখানে সবাই জড়িত আছি অকাজের কাজ সর্বনাশা কবিতা লেখার মধ্যে। তার মানে একটা জিনিস দাঁড়াল যে মুজিব ভাই সময় বের করতে না পেরে কম লিখছেন। আমি যেমন গত দুই বছর ধরে কোনো কবিতা লিখি না। তারপরে সরোজ দা আছেন। স্বপন ভাই একটা বিষয় বোঝাচ্ছেন যে, যেকোনো সময় যেকোনো পরিবেশে তিনি লিখতে পারেন। তার আগে অবশ্য স্বপন ভাই বলছেন যে, আমার লেখাটা আমার কাছে আমার ব্যথা, আমার অমুক তমুক সবকিছু ওই লেখার মধ্যে থাকে।
একটা বিশাল চিন্তা এল সেটা আপনার সঙ্গে টুইস্ট করতে চাই। মানুষের যখন স্ট্রেস তৈরি হয় তখন সেটা তার রিলিজ করা দরকার। সেটা কারও লেখায়, কারও গানে। আপনি অবাক হবেন রাষ্টকেন্দ্রিক সমাজকেন্দ্রিক যে স্ট্রেস তৈরি হয় সেটা যায় কোথায়? মানুষের স্ট্রেস তার মাথায় যায়। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক স্ট্রেস কোথায় যায়? মানে এটার উত্তর পাওয়ার জন্য একটু গভীরভাবে চিন্তা করলাম। তখন দেখলাম যে, এই স্ট্রেসগুলো সংবেদনশীল মানুষের কাছে গিয়ে পড়ে। তখন সকল সংবেদনশীল মানুষ এটার মধ্যে পড়েন। এর মধ্যে কিছু আছেন যারা লিখেতে পারেন। এ জন্য দেখা যায় যে, ওই স্ট্রেসগুলো রিলিজ করতে গিয়ে এগুলো কবিদের কাছে ধরা পড়ে। এ কারণেই কবির কাছে রাষ্ট্রের দায় বা আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো এসে পৌঁছে। স্বপন ভাই যখন ‘দাহকাব্য’ লিখলেন তখন কিন্তু আমি বলেছি এই স্ট্রেসগুলো আপনার কাছে এসে পড়েছে। তো, আহমেদ স্বপন মাহমুদ এমন একজন কবি, যার কাছে সমাজের স্ট্রেসগুলো এসে পড়বে এবং তিনি লিখে তা রিলিজ করবেন। স্ট্রেসটা তার কাছে পৌঁছে গেছে। আপনি যখন ‘দাহকাব্য’ লিখেছেন , তখন আমি আপনার সঙ্গে আড্ডা-টাড্ডা দিতাম।
সেটা একটা বই হোক বা পাঁচটা বই হোক। আহমেদ স্বপন মাহমুদ এত বছর ধরে কাজ করছেন। সেখানে প্রকৃতির স্ট্রেস কিন্তু এসে পড়বে এবং আপনাকে তা লিখতে হবে। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওই বাকশালের সময়ে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন বিরোধী দল থাকবে কি না? তখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, না থাকবে না। কারণ বিরোধী দল যদি থাকে তাহলে তারা হারবে। মনে মনে রাজ্জাক একটা কথা বলেছিলেন, যেটা আহমেদ ছফা তার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইতে লিখছেন যে, ‘আমি মনে মনে বললাম যে, এই জাতির জনক এটা কিন্তু তার মিস হয়ে যাবে।’ সেটা হচ্ছে তিনি বিরোধী দল রাখলেও সমস্ত কিছু করতে পারতেন। ওই পর্যায়ে থেকেও তিনি একটা বিরাট কাজ করতে পারতেন যে বিরোধী দল থাকবে। তো, আমি সেই জায়গা থেকে আপনাকে প্রশ্ন করব। আপনি অনর্গল লিখতে পারেন একটু থেমে, যদি ব্রেক করে কিছু করতে পারেন, সেটা আপনার জন্য বেটার হতে পারে।
স্বপন : আমাদের যে বয়স, প্রত্যেকেরই তো খরচ হচ্ছে। ভাই রে, আমি তো একসময় লিখতে পারব না, পড়তে পারব না। আমার তো এখনি কাজ করতে ভালো লাগে না। ফলে আমি যে সময়টা পাচ্ছি লিখতে চাই। জীবনে স্পেস কিন্তু কম। বাকি জীবন তো বার্ধক্যজনিত কারণে নানা বিপদের মধ্যে যাবে। সময় থাকলেও কাজ হবে না। ফলে সময়টার ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করা উচিত। প্রচুর গদ্য পদ্য লেখা উচিত। গভীর কোনো কাজ করার প্লান করা উচিত।
আরেকটা জিনিস, এটা নির্ভর করে যদিও, জুয়েল। কারও কারও জীবনীশক্তির একটা ব্যাপার আছে। কারও শক্তি একটু বেশি কারও একটু কম। যেমন আমি প্রচুর মদ খেতে পারি। খেতে খেতে অনেক সময় পাগলও হয়ে পড়ি। এটা যদিও খারাপ অভ্যাস। আমি মনে করি যে, আমাদের মতো লেখকদের প্রতিটি সময় লেখা দরকার। প্রফেশনাল রাইটারদের প্রচুর লেখা থাকা দরকার। প্রচুর বই থাকা দরকার। চিন্তার স্ফূরণটা দরকার, যেটা আমাদের নেই। আমাদের কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ এগুলো প্রচুর লেখা দরকার। যেমন সচরাচর যে আড্ডাগুলো দেই সেই আড্ডাটাও আমার লেখা দরকার, মনে করি।
জুয়েল : সরোজ দা যখন আমাকে ডাকে তখন কিন্তু আমাকে আড্ডার কথা বলে নাই। সরোজ দার কথা শুনেই আমি চলে এসেছি। আমি কিছু কিছু ব্যাপার এখানে নোট করব। আমি দুই পক্ষেই কথা বলব। আপনার পক্ষে কথা বলব, সেগুলো আপনি নোট করবেন। আমি আপনার বিপক্ষেও কথা বলব সেগুলো আপনি ডিফাইন করবেন। প্রথম কথা হচ্ছে তিনটা বই ধরতে চাই ‘অতিক্রমণের রেখা’, ‘আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল’ এবং ‘দাহকাব্য’। এর মধ্যে দুটো বই লেখার সময় স্বপন ভাইয়ের সঙ্গে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার বিষয়গুলো লেখা ছিল। কিন্তু পরে কম্পিউটারে খুঁজে পাই নাই।
এক ধরনের মানসিক উপনিবেশ লক্ষ করা গেছে কবিতাগুলোর মধ্যে। কেন যেন মনে হয়েছে মুজিব বা মামুন আমাকে ডমিনেট করার চেষ্টা করছে। আরেকটা হচ্ছে, ‘দাহকাব্য’-এ যে রাজনৈতিক আচরণ আছে সেটা খুব বড়ো আকারের। আমি পড়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলাম। এটা পলিটিক্যাল দৃশ্য। কেন কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলাম। আমাদের সবাইকেই এক সময় আড্ডা শেষ করে চলে যেতে হবে। এটা একটা রাজনৈতিক ব্যাপার।
আমার স্পেসিফিক বক্তব্য হচ্ছে, ‘দাহকাব্য’তে রাজনৈতিক প্রতিবাদ মোলায়েম রূপ লাভ করেছে। উচ্চকিত নয়। এটা ব্যক্তিগত জীবনে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, বায়ান্ন, মুক্তিযুদ্ধ। তখন আমরা রাজপথে আন্দোলন করে বাসায় ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছি। এখন যে রাজনৈতিক আচরণগুলো হচ্ছে সেটা আমরা নানানভাবে উপলব্ধি করি। দাহকাব্য-এ দেখা গেছে শুধু একটা ঘরের মধ্যে জ্বালাও পোড়াও বিষয়টা আছে।
মামুন : বই পড়ার পর আমার নিজস্ব কিছু উপলব্ধিও তৈরি হয়েছে। সেগুলো ছিল বাইরের আচরণ। আর এখন এটা হচ্ছে ভেতরে। বাইরের লোকের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধলে সেটা ভিন্ন কথা আর ঘরের হলে আরেক কথা। ‘দাহকাব্য’র বিষয়টা হচ্ছে ঘরের কথা। কারণ যিনি পুড়াচ্ছেন তিনিও ঘরের লোক, আর যিনি পুড়ছেন তিনিও ঘরের লোক।
জুয়েল : ওই যে ‘আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল’, সেখানে সবকিছুর মধ্য দিয়ে প্রেম ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আহমেদ স্বপন মাহমুদের সামগ্রিক কাব্যের ভেতরেই প্রেম রয়েছে। ওইগুলো পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এটা আমার। পুরো আহমেদ স্বপন মাহমুদের প্রেম হচ্ছে আমি। তার কবিতাগুলোর মধ্যে যে মাটিসংলগ্ন ব্যাপার আছে সেটা বলেছি। সর্বোপরি আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতার ভেতরের একটা লাইন, সেটা হচ্ছে চিন্তা এবং আর্ট। তার পজেটিভ দিক বলা। এবং তার কিছু নেগেটিভ দিকও বলব। সেটা হচ্ছে, আপনি আহমেদ স্বপন মাহমুদের যেকোনো কবিতা বের করতে পারেন, অধিকাংশ কবিতার কম্পোজিশনেই দেখবেন যে টোটাল ব্যাপারটা নেই। কমপেক্টনেসের ঘাটতি মনে হয়। প্রাণভরে লেখার কারণে বা যেকোনো কারণে তার কবিতাগুলো প্রথমে উচ্চকিত, কিন্তু মাঝে কিছু নাই। তারপরে আরেকটা প্যারা আছে। মনে হয়, আরেকটা প্যারা দরকার। সেটা নেই। আবার একই শব্দ বারবার ব্যবহৃত হয় স্বপন ভাইয়ের কবিতায়। স্বপন ভাইয়ের একেবারে নিজস্ব ভাষাই সেটাকে উচ্চকিত করে। এটা একটা বড়ো ব্যাপার। স্বপন ভাইকে এই কারণে আমি বলি যে, তার কবিতার শিরোনাম অন্যরকমের। কবিতার শিরোনামগুলো অদ্ভুত। আপনারা আমাকে মাফ করবেন। তার কবিতার শিরোনাম যা, তার কবিতা কিন্তু তা না। প্রায়ই শিরোনামের সঙ্গে কবিতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। শিরোনামের ভাব কবিতায় অনুপস্থিত।
স্বপন : জুয়েল, আমি বলব যে, আমার কবিতা কখনোই উচ্চকিত নয়।
জুয়েল : আমি বলছি। কিছু কিছু শব্দ আপনার ভাষাকে উচ্চকিত করে। আবার কিছু কিছু শব্দ আমার কাছে বারবার ব্যবহৃত বলে মনে হয়।
স্বপন : আমার কবিতায় তথাপি, সমূহ, আর ইত্যাদি বেশি ব্যবহৃত বলতেই পারেন।
সরোজ : আমার মনে হয় শিল্পীরও আত্মরক্ষা আছে। আমরা যখন বক্তব্য দেই তখন ঔপনিবেশিকতাসহ নানা ধরনের শব্দ ব্যবহার করি। কিন্তু আমরা প্রাসঙ্গিকভাবে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে পারি না। কবিরও আত্মরক্ষা আছে। কবির সামনে পুলিশ আছে। কবির সামনে রাষ্ট্র আছে। কবিকে তা রক্ষা করবে। কবি স্বপ্নদ্রষ্টাও। যেটা ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে জহির রায়হান বলেছেন। ‘ক্রীতদাসের হাসিতে’ও শওকত ওসমান বলছেন।
জুয়েল : আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। সেটার উত্তর আপনাকে দিতেই হবে। এটা হচ্ছে, অতিক্রমণের রেখা, ‘আনন্দবাড়ি বা রাতের কঙ্কাল’ বা ‘দাহকাব্য’র হারমোনিটা যখন উল্লেখ করতে পারি তখন...
মামুন : জুয়েল অনেকগুলো পয়েন্ট উত্থাপন করেছে। সেখান থেকে একটা পয়েন্ট আমি উল্লেখ করি। সেটা হচ্ছে স্বপন ভাইয়ের কিছু কবিতা কবিতাময় মনে হয় আবার কিছু কবিতা মনে হয় একেবারে নিচে নেমে গেছে। আবার মনে হয় যে, এতগুলো কথা না বলে সংক্ষেপেও বলা যেত। এটা নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে কি না?
স্বপন : পাঠক হিসেবে আপনার নানা বিষয় মনে হতে পারে। কবিতা তো কত রকমের। কত ধরনের। পাঠকভেদে ভালো লাগা মন্দ লাগা আছে। সেটা মেনেই নিই বরং। জুয়েল বা মামুন বা আপনারা যা বলেছেন, সে নিয়ে আমার কোনো বিরোধ নেই। একজন কবি সবসময়ই ভালো লিখবেন এমন নয়। একজন খেলোয়াড় সবসময়ই ভালো খেলবেন এটা তো হয় না বাস্তবে। আমি কবিতায় অখণ্ড একটা ভাব হাজির করতে চাই। কবিতায় গল্প বলতে চাই। ন্যারেটিভ কবিতার কিছু কিছু দুর্বলতা পাঠকের কাছে ধরা পড়তেই পারে। তারপরও আমি মনে করি, অনেক অনেক ভালো কবিতা আছে আমার বইগুলোতে। পাঠকের আরো মনোযোগ দাবি করে সেগুলো।
স্বপন : বলার আছে। আপনি যখন কবিতা লিখেন তখন আপনি জানেন না যে শব্দটা কী হবে। আর সচেতনভাবে আপনি যখন জানতে চান তখন আমরা বলি যে, এটা এভাবে বা ওইভাবে হতো। সেটা ঠিকই আছে। আবার জুয়েল যখন পাঠক বা কবি হিসেবে বলে সেটারও একটা গুরুত্ব আছে। আমি তো দীর্ঘকবিতা লেখি না। আমি মনে করি না যে কবিতা যখন শেষ হয় তখন সেটার আরও একটা প্যারা দেওয়া বা বাদ দেওয়া দরকার। আমি মনে করি কবিতা হচ্ছে দর্শনের জায়গা, ভাবের জায়গা, চিন্তার জায়গা। দর্শনটা হচ্ছে ইশারা। আমার কাছে যেটা বেটার মনে হয় সেটাই রাখি। আমি যেহেতু একটানা লিখি, তখন সেটা স্বাভাবিকভাবেই একটা পরিণতি পায়।
আমার কবিতার বই ১২টা, নির্বাচিতসহ। এর মধ্যে চার ফর্মার, তিন ফর্মার কবিতার বইও আছে। আমার ‘অবিচল ডানার উত্থান’ ডিফরেন্ট। এই বইটা হয়ত পাঠক নজরই দেয় নি। হতে পারে এমন। কবিতার অখ- ভাব রাখার চেষ্টা করি। ‘প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম’-এ নায়ক নামে একটা কবিতা আছে। এটা ১৯ সংখ্যক কবিতা নিয়ে। আমার স্মৃতি আমার পেছনে এবং সামনে। আমি পেছনটা দেখে সামনেরটা পারসিভ করতে চাই।
মামুন : একটা সম্পূরক প্রশ্ন, ভাবের ঐক্যের একটা বড়ো ধরনের সমস্যা আছে। এখানে বিষয়ের বৈচিত্র্য হয় তো কম থাকে বা রিপিটেশন থাকে। ভাব ও ভাবের ঐক্য থেকে কবিতাগুলো যে মুক্ত তা না...
স্বপন : বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি রিপিটেশন যার মধ্যে তিনি জীবনানন্দ। এই রিপিটেশনটা আসে দক্ষতার ভেতর দিয়ে। আমরা জীবনানন্দের রিপিটেশনটা কিন্তু নাকচ করি না। সেটা আমরা গ্রহণ করে নিই। আমি মনে করি, এখানে ভাবের রিপিটেশনটা আমি চাচ্ছি। আমি শূন্যতাবাদ, মায়াবাদ, এই বাউলতত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছি। রিপিটেশনকে আমি মন্দ বলি না, কখনো কখনো এতে জোর তৈরি হয়, শক্তি তৈরি হয়। কথার শক্তি।
মুজিব : একজন যখন নিয়মিত লেখালেখি করেন, সবসময় ঘোরের মধ্যে থাকেন, তখন ওই বিষয়গুলো একের পর এক আসতে থাকে। এটা পাঠককে বিরক্ত করতে পারে। কিন্তু এই যেমন দুজন বলেছে যে একটু গ্যাপ দেন। স্বপন ভাই বলেছেন যে, কেন গ্যাপ দিব। এটা বলা যায় না যে, গ্যাপ দিয়ে লিখলেই সেটা ভালো হবে। দেখা যাবে ত্রিশ দিনে ত্রিশটি লিখলে সেখানে দুটো ভালো কবিতা পাওয়া যেতে পারে। আবার ত্রিশ দিনে একটি লিখলেও সেটা খারাপ হতে পারে। তবে লিখে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
ফেরদৌস : স্বপন ভাই একটা বই টিকটিকিকে উৎসর্গ করেছেন এটা কেন?
স্বপন : আমি যখন একা থাকি তখন খুব নিঃসঙ্গতায় পেয়ে বসে। আমি যখন জামালপুরে থাকি তখন কিন্তু আমার ব্যাপক দাপট। কারণ মফস্বল শহরের ইংরেজি টিচার, আবার সাংবাদিকতা করি। তো, যখন ঘুমাই তখন বিরক্ত লাগে। একা লাগে। কোনো শব্দ-টব্দ পাই না। এসময় দেখতাম টিকটিকি হেঁটে যাচ্ছে। যখন টিকটিকিকে শব্দ করতে দেখতাম, তখন ভালো লাগত। বছরের পর বছর ধরে আমি এটা উপভোগ করেছি। কারণ কেউ যখন নেই, তখন টিকটিকি আমার সঙ্গী ছিল। আরেকটা কারণ হচ্ছে ডাইনোসর হারিয়ে গেছে, কিন্তু টিকটিকি টিকে আছে। তার অভিযোজন ক্ষমতাটা অনেক বেশি। আর এই বইয়ের সময় আমার প্রেম ও বেদনা ছিল। এটা ২০০৮ সালের দিকের কথা। প্রেম ও অভিযোজনের যে ক্ষমতা তাকে স্মরণ করেই টিকটিকিকে উৎসর্গ করা।
মুজিব : আপনার বাইরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। তা ছাড়া, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। বাইরের প্রভাবটা কবিতায় কীভাবে কাজে লাগান?
স্বপন : প্রভাবটা খারাপ না। কিন্তু যদি সেটা সরাসরি আসে সেটা ভালো না। তবে চিন্তার প্রভাবটা যদি আসে সেটা ভালো। আমি ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবটা এড়াতে পেরেছি মনে করি।
মুজিব : বিশ্বসাহিত্যে আপনার আইডল কে কে?
স্বপন : আমি বলেছি। কবিতা গুরুপরম্পরাবিদ্যা। শেষ পর্যন্ত কবিতা হচ্ছে সর্বমানবীয় কল্যাণের বিষয়। আমার মানস গড়নটা সবচেয়ে বেশি গড়ে দিয়েছেন অসীম কুমার দাস, আমার শিক্ষক। তাঁর যে জীবনযাপন, চিন্তা, সেটা ছিল অন্যরকম।
মুজিব : কবিতা কেমন হওয়া উচিত? কার কবিতা পড়লে মনে হয় যে, ‘আমি যদি এমন লিখতে পারতাম?’
স্বপন : এটা বলা কঠিন। আমি এতটুকু বলব যে, আমার একটা ঘরানা আছে। আমার সবগুলো বই একত্র করে দেখবেন যে, আমার কিছু বিশেষ ধরন আছে। আমি মনে করি না যে সবাইকে জীবনানন্দের মতো বিশুদ্ধ হতে হবে। জীবনানন্দ ইউরোপের ভাব নিয়েছেন, কিন্তু ভাব নিয়ে মানুষটা দিয়েছেন আমার দেশকে। মিশাতে পেরেছেন। এজন্য জীবনানন্দ টিকে গেছেন। এক সময় মনে হয়েছে যে, জীবনানন্দ আমার কথা বলে ফেলেছেন। আমি কেন কবিতা লিখব? এ কারণে কলেজ লাইফে আমি মনে করেছি আমি আর কবিতা লিখব না। কারণ তিনি আমার কবিতা লিখে ফেলেছেন। আর বাংলা কবিতার জন্য বা কবিতার জন্য বিশ্বসাহিত্যের পাঠ জরুরি না। কিন্তু কবিতা পড়লে আপনার মোড অব এক্সপ্রেশন নানা রূপ নেয়। সেগুলো থেকে নানা ধরনের শিক্ষা পাই। কবিতার পাঠ আপনার চিন্তাকে আপনার ভাবনাকে এলোমেলো করে দেয়। আমার মতে, কবিতা হচ্ছে কবিতা। যেকোনো ভালো কবিতা অস্থির করে তোলে।
মুজিব : ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে বিশ্বসাহিত্যের সেরা কবিতাগুলো একাডেমিতেই পড়েছেন। এর বাইরে শুধু কবিতার স্বাদ আস্বাদনের জন্য কবিতা পড়ছেন, এরকম কার কার কবিতা পড়েন?
স্বপন : ধরুন জন বেরিম্যানের কবিতা। উনার একটা লাইন বলতেই হবে : ‘পয়েট্রি বোরস মি, লিটারেচার বোরস মি, ইস্পেশালি গ্রেট লিটারেচার...। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, কীটস, ইয়েটস, এলিয়ট, প্লাথ প্রমুখ। ইয়েটস ছিলেন অটোরাইটার। তাঁর সাথে কিছু মিল হয়ত আছে আমার।
মামুন : আপনার মানস গঠন, আপনার স্ট্যান্ডার্ড, কাদের কবিতা পড়েন, সেটা জানলাম। আপনি পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করলেন। এ যাবৎ ১২টা কবিতার বই আছে। আপনি এই সময়ে দাঁড়িয়ে গত পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যের মানদণ্ড আপনার লেখালেখিকে বাংলা কবিতার কোন জায়গায় রাখবেন?
স্বপন : এর আগে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। এটার উত্তরও দিয়েছি।
জুয়েল : বিনয়ের সঙ্গে আহমেদ স্বপন মাহমুদ যেটা বলছিলেন যে, আমার কোনো কাজ নেই। আমি তখন নিজেকে বললাম, তুমি যে স্বপন মাহমুদের কবিতা পড়েছ তোমার কী মনে হয়? তখন ভেতরের জুয়েল বলল, না তো। আমি পঞ্চাশ বছরের হিসেবে নয়, পুরো বাংলা সাহিত্যের বিবেচনায় বলব, আহমেদ স্বপন মাহমুদ তার প্রেমকে ‘তুমি’ থেকে ‘আমরা’তে নামাতে পেরেছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে যত ধরনের কবিতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকে, সমস্ত প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সে হচ্ছে জীবনের পাহারাদার।
ফেরদৌস : আপনি শুরুর দিকে বলেছিলেন যে আপনি উকিল মুন্সী, লালন, জালাল খাঁর দিকে যেতে চাচ্ছেন। পশ্চিমা সাহিত্যের দিক বিবেচনা করে তাদের সঙ্গে উকিল মুন্সী, জালাল খাঁর দ্বন্দ্বটা কোথায়?
স্বপন : আমরা যারা কবিতা লেখি তারা সাহিত্যেরই ছাত্র। আমি যে এক্সপ্রেশন দিতে চেয়েছি মানুষ বা প্রকৃতি নিয়ে, এতে করে কিছু ভালো কবিতা তো লিখেছি। আমি সত্যিই অনুধাবন করি আমার কিছু ভালো কবিতা আছে। দুর্বল কবিতাও আছে। বোধের বিভিন্ন পর্যায় আছে। পঞ্চাশের এক ধরনের বোধ, চল্লিশের এক বোধ। আমার এই মনে হয় এখন। মানুষের মুক্তি কোথায়? আমি মনে করি মানুষের মুক্তি তার অন্তরে। একজন কবি, মনে হয়, নেভার ননবিলিভার। সে কখনো আল্লায় বা প্রকৃতিতে বিশ্বাস করে। স্পিরিটে বিশ্বাস করে। কোথাও না কোথাও তার একটা বিশ্বাস থাকে। মাস্ট বি এ বিলিভার । দুই হচ্ছে, কবিতার জায়গায় চিন্তারও একটা পরিবর্তন ঘটে। আমি আসলে সহজ কবিতার দিকে যেতে চাই।
সরোজ : অতিক্রমণের রেখা, কিংবা আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল, আপনার কাব্যগুলোর অনেক অসাধারণ নাম। যেন একেকটা নাম দিয়ে একটা জগৎ তৈরি করা। স্বপন ভাই যে পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন সেটা নিয়ে তর্ক হয়। যেমন বশির খান মালজোড়া গানে একটা জগৎ তৈরি করেছেন। সেখানে কিন্তু জীবন নিয়ে তর্কবিতর্ক করে। এই যে যেমন অনেক উঁচুতে পানশালা। এই যে কবিতার ভাষাটা তৈরি করছেন। আমাদের রশিদ, জালালরা জীবন নিয়ে তর্ক করেছেন, আমরা কিন্তু জীবনযাপনের বাইরে ছিলাম না। এটা আধ্যাত্মবাদ না, জীবনযাপনের বেদনা ছিল। উকিল মুন্সী নামাজ পড়ান আর গান করে কান্না করেন, রাধারমণ কিন্তু তাঁর বিচ্ছেদের কথা বলেন। জীবন উপস্থিত না রেখে কোনো শিল্পই হয় না। আপনি যে বলেছেন, সুরেন্ড বিলের নায়কের যে ভাষাটা লিখেছেন, জুয়েলের ভাষায় আপনি একটা ইমেজ তৈরি করেছেন।
স্বপন : আমার শৈশবটা ওখানে উঠে এসেছে। আমি দশ-বারোটা বই জামার মধ্যে রেখে বিলটা পার হতাম। আমি তো ফিরতাম দেরি করে। সিক্স-সেভেনে পড়ার সময়ে আড্ডা দিতাম সুরেন্ড বিল পাড়ি দেবার সময়ে। আমি ভাষাটা আনতে চাই নাই, কিন্তু ভাবটা আনতে চেয়েছি। কবিতার নাম নায়ক। নায়ক বীজতলায় জালা তুলতেছে, আবার শ্যাওড়া গাছ পাড়ি দিচ্ছে, ওইসব দৃশ্য আমি নায়ক নামক একটা চরিত্রের বরাত দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছি।
মামুন : এখানে আমার একটা সংযোজন আছে। এটা স্বপন ভাইয়ের পক্ষে যাবে। আমরা প্রত্যেকে যে ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করছি, তিনি ওই ভাষাতেই লিখেছেন। সুরেন্ড বিল যখন লিখেছেন তখন এই ভাষাতেই লিখেছেন। এখন যা ভাবছেন তখন কিন্তু তা প্রবলভাবে কাজ করে নাই বা ভাবেন নাই। আজ লিখলে হয়ত অন্যভাবে লিখতেন। স্বপন ভাই কি আমার সঙ্গে একমত হবেন?
স্বপন : না, একটা মিনিট। আমি একটু পড়ে নিই, ‘শুধু ইশারামাত্র, তারপর তুমিও লুকালে কলাবীজে... আমি কিংবদন্তী, নায়ক সেজে এসেছি...
...কিছু গাছ আর কতিপয় মানুষের মুখ আমি হেঁটে গেছি রাত্রিকাল... তথাপি ছাড়ে না পুরাণ।
সরোজ : ল্যাটিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার কথা শোনা যায়। আমরা ছোটবেলায় কিন্তু জাদুবাস্তবতার ভেতর দিয়ে গেছি। এই ধরেন। বিল দখলের সময় রক্তারক্তি হয়। বিল দখলের সময় লাশও দখল হয়। আমি যে জায়গাটা ধরতে চাইছিলাম। অনেক উঁচুতে পানশালায় কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ যে ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেছেন, সেটা সুরেন্ড বিলে পারেন নি।
মুজিব : জুয়েল স্বপন ভাইয়ের তিনটি গ্রন্থ, অতিক্রমণের রেখা, আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল এবং দাহকাব্যকে চিহ্নিত করল ও পাসমার্ক দিলো, বাকিগুলোকে দিলো না। আপনি অনেক উঁচুতে পানশালাকে পাসমার্ক দিলেও তার সুরেন্ড বিলকে দিতে পারছেন না। ওর ভাষা যদি অনেক উঁচুতে পানশালার মতো হতো তাহলে আপনি তাকে পাসমার্ক দিতেন, সরোজ বোধহয় এটাই বলতে চাচ্ছেন, তাই না?
সরোজ : যে প্রশ্নটা খুঁজছিলাম তা আমি পেয়েছি। মাটি থেকে বিচ্ছেদ হয়ে কবি হওয়া যায় না বড়ো ভাই। স্বপন ভাই সুরেন্ড বিল নিয়ে লিখেছেন কিন্তু সে ভাষাটা, মাটির ভাষাটা দিতে পারেন নাই। এটাই আমি বুঝাতে চেয়েছি তখন।
স্বপন : আমি যখন অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে যেতাম তখন গায়ের লোমগুলা টান দিত। জুয়েল আর আমি যখন কথা বলি তখন সেটা এই ফর্মেটের না। আমার প্রশ্নের আগে উত্তর। প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়। কবিতাটা এরকমই। কবিতা শুরুই করে তার গন্তব্য দিয়ে। লালন বলেন, ‘আমি ঐ চরণে দাসের যোগ্য নই’। আমি যেটা বলতে চাই, মামুন তুই বিশ্বাস কর। আমি সে কবিতাটা লিখতে চাই না, যেটায় বিচ্ছেদ নেই। আমি বিচ্ছেদের কবিতা লিখতে চাই। আমার অন্তরটা যেন বেদনায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মুজিব : তুমি এই যে জীবনযাপন করছ, তোমার ইউরোপ-অমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা-কর্মশালা করতে হয়। তোমার বয়স পঞ্চাশ হবার অনেক আগে থেকে তুমি ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ো। সাধারণভাবে বাঙালি কবিরা যা করে না। এটা নিয়ে নানা কথা আছে। কবি কেন গাড়িতে চড়বে? কবির কেন নিজের অফিস থাকবে? কবি কেন প্রাচুর্যসম্পন্ন হবে? এরকম কথা আছে। কবি মানে তার ঝুলা থাকবে, তার দারিদ্র্য থাকবে। তো, তোমার এই জীবন ও চারপাশের গুনগুনানি নিয়ে তুমি কী বক্তব্য রাখবে।
স্বপন : একদিন আমার মা মানে আমার আম্মার সঙ্গে কথা বলছিলাম ফোনে। আমার গলাটা কেমন যেন শোনা যাচ্ছিল। তো, আম্মা প্রশ্ন করলেন তোর কি অসুখ? হ্যাঁ, আমার একটু টনসিল হইছিল। সে নিয়ে আমার কী উদ্বিগ্নতা!
আমি অনেক আশীর্বাদ পাওয়া ট্যালেন্ট ছাত্র ছিলাম। আমরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দেই তখন আমরা সাতজন বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছিলাম। এই যে একটা জীবন। এই যে গাড়িঘোড়া। এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তো? আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলব, বন্ধুরা অন্তরকে স্বাধীন করো। জীবনকে মুক্ত করো। আমি মনে করি একজন কবির কাজ লেখা। তাকে যে পেইনটা নিতে হয়, সে পেইন আমার আছে। আমি যদি না লিখতাম, তাহলে আত্মহত্যা করতাম।
মুজিব : তুমি অতি সম্প্রতি বগুড়া লেখকচক্র থেকে কবিতায় সম্মাননা পাইছ, শব্দগুচ্ছ সম্মাননা পেয়েছো- এগুলো তোমার স্বীকৃতি। এগুলো তোমার ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
স্বপন : একজন কবি যখন সারাবছর ধরে কবিতা লিখেন তখন পুরস্কার-সম্মাননা নিয়ে ভাবেন না। জগতে চল ও চালেরও পুরস্কার। আমি মনে করি পুরস্কারটা আনন্দদায়ক। পুরস্কারটা আমাকে আনন্দ দিয়েছে। তবে একটা প্রতিষ্ঠান অন্যকে পুরস্কার দিয়ে নিজের জন্যই স্বীকৃতি আদায় করে নেয়, আমি এভাবে দেখি।
মুজিব : বাংলা সাহিত্যে যে রাজনীতি ক্রিয়াশীল তুমি তার শিকার কি না? এটাকে তুমি কীভাবে মূল্যায়ন করো?
স্বপন : বাংলা কবিতায় যে রাজনীতি আছে এটা সুস্থ না। আমার দুঃখ একটাই, আমার সমসাময়িক বন্ধুরা, আমার নব্বইয়ের দশকের বন্ধুরা আমার কবিতা পড়ে নাই। আমি যেখানে অন্যদের কবিতা বেশি পড়ি। তবে আমার পরের প্রজন্মের কবিরা আমার কবিতা বেশি পড়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় দশক এবং প্রথম দশকের কবিরা যেভাবে আমার কবিতা পড়েছে, সেভাবে আমার দশক আমাকে পড়ে নাই।
সরোজ : একজন কবিকে আসলে পরের জেনারেশনই পাঠ করে এবং তার মাধ্যমেই আসলে বেঁচে থাকে। একজন কবি সংকটের মধ্য দিয়ে যান। আবার সংঘের ভেতর দিয়ে যান। আহমেদ স্বপন মাহমুদও এমন কিছু সংঘের কাছ দিয়ে যান, যারা আসলে তার জন্য ইতিবাচক না। স্বপন ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন আপনি কেন যান?
স্বপন : আমার একটা ব্যাপার আছে যে, প্রায় একশ দেশ ঘুরেছি। মানুষ দেখেছি। এটাকে আমার অভিজ্ঞতা বলি। আমার যারা শত্রু, যারা বন্ধু না, তাদেরও আমি গ্রহণ করতে পারি। ঢাকা শহরে আমি নব্বই-একানব্বই থেকে স্থায়ী। আজকে আপনি যেটা বললেন না সেটা আমি চাই না। একটা পরম্পরা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। তখন থেকে অনেকের সঙ্গে মিশি। অনেকের সঙ্গে মিশি যদি সে পজেটিভ হয়। আমার ব্যবহারের জন্য যদি সে পজেটিভ হয়। তবে আমি যেটা ভেবেছি আমার যে জায়গাটা খারাপ লাগবে, আমাকে যেটা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সেটার কাছ থেকে আমি দূরে থাকতে চাই।
মুজিব : স্বপন ভাইয়ের কাছে তার সংসার জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে চাইব। কারণ আমি মনে করি একজন কবির হয়ে ওঠা না ওঠার নেপথ্যে সংসার জীবন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
স্বপন : আমি সিঙ্গেল ইউনিট পরিবারে বিশ্বাসী নই। সবাই মিলেমিশে যে পরিবার, সে পরিবারের হারমোনির প্রতি আমার আস্থা আছে। সমাজ ও জীবন বাস্তবতায় প্রেম, যৌনতা, বিরহ-বিচ্ছেদ, আনন্দ-বিষাদ, শত্রু-মিত্র ইত্যাদি বিষয়গুলো জীবন ও মহাজীবনেরই অংশ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতির রং-রস, মানুষের মুখ, মুখের মায়ার সম্পর্কের প্রতি আমার তীব্র টান অনুভূত হয়। সেদিকে আমি হেলেও গেছি হয়ত অনেকবার।
দেশ ও সমাজের জন্য বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে যেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের পর���যাপ্ত সময় দিতে পারি নি। বলা যায়, তাদের বঞ্চিতই করেছি এবং নিজেও বঞ্চিত হয়েছি। এই বঞ্চনার কারণে আমার প্রতি তাদের মধ্যে ক্ষোভও হয়ত আছে। কিন্তু ক্ষোভের কারণ বুঝতে পেরেও আমি মানসিকভাবে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ থাকলেও বাস্তবিক অর্থে সংসারে সেভাবে সম্পৃক্ত হতে পারি নি। অর্থাৎ সংসারে আমার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এর ভেতর দিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছি। আমার স্ত্রী ও সন্তানরা কখনোই আমাকে বাধাগ্রস্ত করে নি। তবে এটা সত্য যে, তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কখনো অবহেলা করতে চাই নি।
আমার মনে হয়, সম্পর্ক একটা অদ্ভুত ব্যাপার। জগতে মানুষকে বুঝতে পারাই হয়ত সবচেয়ে কঠিন বা সহজ। মানুষের বোঝাবুঝির ধরন কত যে বিচিত্র রকমের তা কখনো বিনাশ আনে, কখনো আনন্দে ভরে দেয় জীবন। আমার পক্ষপাত হয়ত বৈরাগ্য ও বিনাশের দিকে।
মুজিব : চমৎকার আলোকপাত। এটা উঠে আসা দরকার ছিল। যাই হোক, অতিসম্প্রতি আমরা একটা প্ল্যানিংয়ের আওতায় এসেছি। আমরা সবাই নানাভাবে প্রচুর অপচয় করেছি; সময়, অর্থ, প্রাণশক্তি প্রভৃতির। এই প্রেক্ষিতে বলা দরকার যে, আহমেদ স্বপন মাহমুদের যেহেতু আরও অনেক কাজ বাকি আছে। তাই তাকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। তাকে অনেক কাম ত্যাগ করতে হবে; যেমন আমরা সিগারেট খাচ্ছি, মদ খাচ্ছি এগুলোও একেকটা কাম। লালন বলেছেন, ‘কামের ফাঁদে পড়ো না’। আমি স্বপন ভাইয়ের কাছে অনুরোধ করব, নতুন বছরে আমরা যেন কামের ফাঁদকে চিনে উঠি ও তাকে পরিহার করতে পারি।
মামুন : আজকে যেহেতু একটা আড্ডা দিলাম। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আড্ডা আমরা দিতে পারি নাই। যাই হোক। কবি অহমেদ স্বপন মাহমুদকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি বলেই আজকের আড্ডায় অংশগহণ করেছি। আমরা আমাদের নামের ভ্যালুরও প্রতিনিধিত্ব করি। আমরা স্বেচ্ছাচারিতাও করছি, আবার আড্ডাও করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।
জুয়েল : যেটা আমাকে বলতেই হবে, বিগত পৌনে দুই মাস ধরে আমি কথা বলি না। আজকে আমি কথা বলতে পারলাম। আজ আমি এখানে এসেছি সরোজ মোস্তফার কথায়। আমি সংক্ষেপে একটা কথা বলতে চাই। আমি আহমেদ স্বপন মাহমুদের অসংখ্য কবিতা পড়েছি। আমি মনে করি আহমেদ স্বপন মাহমুদ একজন শুদ্ধতম কবি। আমি তার কবিতা পড়তে চাই। তিনি মাটিছেঁড়া কবি। আমি এটা বলছি কারণ আমি বাংলা সাহিত্যের কেউ না। সাহিত্যের কেউ এটা বলে না। আমি বললাম একজন মাটিলগ্ন কবির কাছে।
ফেরদৌস : স্বপন ভাই বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন, এটা তার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা করপোরেট অভিজ্ঞতা। স্বপন ভাই এখন শিকড়ে পাড়ি দিতে চাচ্ছেন। ওই ধারার কাছে যাওয়া মানে সেটাকে আত্মস্থ করা। স্বপন ভাই সত্যি সত্যি শিকড়ের কাছে পৌঁছাতে পারবেন এবং মূলধারার কবিতার কাছে যেতে পারবেন সে আশাবাদ ব্যক্ত কওে শেষ করছি।
স্বপন : আমি কখনো করপোরেট কালচারে অভ্যস্ত ছিলাম না। জগৎজোড়া আমার খ্যাতি যে আমি করপোরেট সংস্কৃতির বিপরীতে কাজ করি। আমি কাউকে তেল দেই না। মামুন খান যদি আমার বড়োভাই না হতো তাহলে আমার জীবনে এত পরিবর্তন হতো না। আমি অসীম কুমার দাশের কথা বলি, মামুন খানের কথা বলি, আবার অরূপ রাহীর কথা বলি। রাহীর সঙ্গে যদি না মিশতাম, তাহলে আমার রাজনৈতিক চিন্তা আসত না। জুয়েল মোস্তাফিজকে আমি বলি আমার সন্তান। কারণ তোমরা ছাড়া পঞ্চম মানুষ পাবে না যে স্বপন মাহমুদের জন্য কথা বলার জন্য আসবে।
আমার জালাল খাঁর কথা বলো আর যাই বলো, আমাকে যে রাস্তা চিনাইছে সে লোকটার নাম মামুন খান। আমার যে প্রাণ আমার যে আবেগ সেটা এই জুয়েল মোস্তাফিজ না থাকলে সেটা হতো না। আরেকটা কথা বলি, এই যে জুয়েল যে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। আমি জানি সরোজ নায়েমের প্রোগ্রামে আসে নাই, কিন্তু আমার উপর সংখ্যা করতে হবে বলে সে চলে এসেছে। ফেরদৌস কিন্তু আমার সহকর্মী ছিল। তার সঙ্গে আড্ডা, কবিতা নানাকিছু হয়েছে। আর মুজিব, সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে আমরা এখন খুবই ঘনিষ্ঠ। আমার এখন কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
সরোজ : এটা স্বপন ভাইয়ের পঞ্চাশ উপলক্ষে আমাদের বসা না আসলে, আমরা আমাদের নিজেদের ভেতরের জগৎটাকে দেখতে চেয়েছি। আমরা স্বপন ভাইকে দেখতে গিয়ে নিজেদেরকেও দেখেছি। কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ আমাদের সময়ের একটি কণ্ঠস্বর। আমাদের সময়ের ভেতর থেকে এসেছেন, সময়ের ভেতরেই আছেন। তিনি মাটির মানুষ। ভয়েস নামের প্রতিষ্ঠান তৈরি করে জগৎব্যাপী ঘুরে বেড়োানো তার জীবিকার ব্যাপার। আর তার কবিতার ব্যাপারটা আত্মার।
তিনি তার পূর্বপুরুষদের কাছে যেতে চান। তার পূর্বপুরুষ হচ্ছেন জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী এরা। আমরা প্রত্যেকেই একেকটা ভূখ-ের মানুষ। কবিতায় যদি মাটির কান্না না থাকে, নিজের মাকে যদি না চেনা যায়, তাহলে কবিতা থাকে না, সেটা যারই হোক না কেন। কবিতায় মায়ের, মাটির ব্যাপারটা থাকতে হবে। আজকে স্বপন ভাই মাটির কাছে ফিরতে চাচ্ছেন। মায়ের কাছে ফিরতে চাচ্ছেন। আজকের আমাদের আড্ডাটা সার্থক হয়েছে এটা বুঝতে পেরে যে তিনি মাটির কাছে ফিরতে চাচ্ছেন।
স্বপন ভাইয়ের অনুজ বন্ধু হিসেবে, মুজিব ভাইয়ের অনুজ বন্ধু হিসেবে এই আড্ডায় এসে আমরা নিজেদের বুঝতে পারছি। সেটাই আমাদের সার্থকতা। স্বপন ভাইয়ের পঞ্চাশে আমরা নতুন স্বপন ভাইকে চাই। যে স্বপন ভাই মাটির কবিতা, গার্মেন্টস কর্মীর কবিতা লিখবে। সেই স্বপন ভাইয়ের জন্ম হোক।