
ছবি সংগৃহীত
নকশি কাঁথা : সুই সুতোর গল্প
আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬, ১০:১৬
গ্রাফিক্স: আকরাম হোসেন।
(প্রিয়.কম) আজ থেকে শুরু হলো নতুন বছর। ১৪২৩ সালের প্রথম দিনে প্রিয়.কম পাঠকদের সামনে তুলে ধরল নানা ঐতিহ্যের গল্প। বাংলার ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথা নিয়ে লিখেছেন সুদীপ্ত সাইদ খান।
নকশি কাঁথা
কাপড়ের উপর তৈরি নকশা করা কাঁথাই নকশি কাঁথা। বিশদভাবে এভাবে বলা যায়, সূক্ষ্ণ হাতে সুচ আর বিভিন্ন রঙের সুতায় গ্রামবাংলার বউ-ঝিয়েরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নান্দনিক রূপ-রস ও বৈচিত্রের যে কাঁথা বোনেন, তা-ই নকশি কাঁথা। জীবন ও জগতের নানা রূপ প্রতীকের মাধ্যমে ফুটে উঠে নকশি কাঁথায়। আবহমান কাল ধরে নকশি কাঁথায় যে শিল্পকর্ম ফুটে ওঠেছে তা বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি, সমাজ, প্রকৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য। নকশি কাঁথা সাধারণত দুই পাটের অথবা তিন পাটের হয়ে থাকে। চার-পাঁচ পাটের কাঁথা শীত নিবারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাতে কোন কারুকার্য থাকে না। কাঁথাকে মেঝের ওপর তুলে ধরে তার উপরে বসে কাঁথা সেলাই করতে হয়। সাধারণত পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা হাট হতে তাঁতিদের কাছ থেকে বাহারি সুতা কিনে যেমন: লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাঁথা সেলাই করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে ফোঁড়, পাড় ও নকশা অনুযায়ী নকশি কাঁথা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন: বরকা ফোঁড়, তেজবি ফোঁড়, বাঁশপাতা ফোঁড়, কইতা ও বিছা ফোঁড় ইত্যাদি। পাড়ের নামেও আছে বৈচিত্র্য। যেমন: তোলা পাড়, তাস পাড়, নয়নলতা, নারিকেল পাতা ও নৌকা বিলাসসহ বিভিন্ন নামের নকশি কাঁথা রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে নানা রকমের কাঁথা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নকশি কাঁথা, বিছানার চাদর, থ্রিপিস, ওয়াল ম্যাট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিস পাঞ্জাবি, ইয়র্ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাড়, ওড়না, ফ্লোর কুশন, মাথার ব্যান্ড, মানিব্যাগ, কলমদানি, মোবাইল ফোন ব্যাগ, শিকা, শাল ও চাদর প্রভৃতি। সুই-সুতার মাধ্যমে আপন মনের ইচ্ছায় পরিবেশের চারপাশের ফুল, পাতা, পাখি, পশু ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র কাঁথায় প্রতিফলিত হয়। কাঁথাশিল্পী নিজেই এর রূপকার ও কারিগর। অধিকাংশ সময় কাঁথার নকশা মোটেও না এঁকে সরাসরি সুই-সুতা চালিয়ে একেকটি কাঁথা তৈরি করেন তারা। বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁথাগুলো এফোঁড়-ওফোঁড় করে অনুপম রসের আবহ তৈরি করেন। এ ধরনের কাঁথা একটিই হয়। একটির সঙ্গে অন্যটির মিল কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানেই নকশি কাঁথার নিজস্বতা। নকশি কাঁথা বাঙালির নিজস্ব সম্পদ। এই ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করেই ১৯২৯ সালে জসীম উদ্দীন রচনা করেন তার নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থ। বলা যায় এরপর থেকেই সুধী মহলে নকশী কাঁথা শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
‘বহুদিন পর গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,
শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে।
প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,
রোগ পা-ুর একটি বিদেশি মরিয়া রয়েছে হায়!
শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙিন শাড়ি,
রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি।
সারা গায়ে তার জড়ায়ে রয়েছে সেই যে নকশী কাঁথা,
আজও গাঁয়ের লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা।
নকশী কাঁথার মাঠ যারা পড়েেেছন তারা রূপাই ও সাজুর প্রেম কাহিনির সাথে নকশি কাঁথার সম্পর্ক ভালভাবেই জানেন। বিরহিনী এক গ্রাম্য তরুনী সাজু তার স্বামীর পথপানে চেয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে বুনে চলে নকশি কাঁথা। সেখানে সে ফুটিয়ে তোলে তার মনের অব্যক্ত বেদনা। একদিন ঠিকই দেশান্তরী রূপাই ফিরে আসে তার গ্রামে, তার সাজুর কাছে। কিন্তু ততদিনে সাজু আর নেই। সাজুর বিরহে রূপাইও বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। সাজুর কবরের উপর পড়ে থাকে রূপাই। এমনি করুন কাহিনি ফুঠে উঠেছে জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে। জসীম উদ্দীন যে নকশি কাঁথার কথা তার কবিতায় তুলে ধরেছেন সে নকশি কাঁথা বাঙালির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নকশি কাঁথা শৌখিন মানুষের এক পরম সম্পদ। গ্রাম-নগর-শহর-বন্দর সর্বত্র নকশি কাঁথা পাওয়া যায়। বলা যায় বাঙালি বেড়েই ওঠে নকশি কাঁথা গায়ে দিয়ে। বাড়িতে নতুন জামাইকে নকশি কাঁথা, নকশি বালিশ, দস্তরখানা ও নকশি রুমাল উপহার দেওয়া হতো। মা সন্তানের জন্য, স্ত্রী স্বামীর জন্য এবং দাদিরা পৃথিবীতে নতুন অতিথির আগমনকে উপলক্ষ করে নকশি কাঁথা তৈরি করতেন। ব্যবহারের উপরই নির্ভর করে কাঁথার কি ধরনের নাম হবে। যেমন জায়নামাজ কাঁথা, আসন কাঁথা, দস্তরখানা (বসে খাবার খাওয়ার জন্য) লেপকাঁথা, বয়তন (বালিশে ব্যবহারের জন্য) কাঁথা, ইত্যাদি। নকশি কাঁথা তেরি হয় রেশমি সুতা ও সোনামুখী সুই দিয়ে। তবে বর্তমানে নানা ধরনের সুই দিয়েও নকশি কাঁথা তৈরি করা হয়ে থাকে।
ইতিহাস
কবে থেকে নকশি কাঁথার জন্ম তার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ আমরা জানি না। তবে নকশি কাঁথা গবেষক পারভীন আহমেদ মনে করেন, সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি নকশি কাঁথা সেলাই করে আসছে। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যলালিত আমাদের নকশি কাঁথা। তবে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের পর থেকে। কেননা তখন সহজিয়া ঋষিরা তাদের তত্ত্বকথা ব্যক্ত করার জন্য আশ্রয় নিতো প্রতীকের। এর ফলেই নকশি কাঁথায় প্রতীক বা ছবির ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়। মহাভারতের কথা যেমন আছে আছে তেমনি আছে বেদ উপনিষদের বানীও । নানা আকারে ধর্মীয় লোক কথা, জীবন ও জগতের নানা রহস্যাবৃত বিষয়াদী ফুটিয়ে তোলা হতো কাঁথায়। সময়ের পালাবদলে পরিবর্তন এসেছে নকশি কাঁথার নকশাতেও। কেননা নকশি কাঁথায় যেমন মহাভারতের কথা লিখা থাকতো থাকতো বেদ উপনিষদের বানীও। তারপর বৌদ্ধ ধর্মের নানা প্রতীক ব্যবহৃত হতো। জীবন ও জগতের ব্যাখ্যাও ফুটিয়ে তোলা হতো নকশি কাঁথায়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে মানুষের দুঃখ বেদনার গল্পও স্থান পেয়েছে নকশি কাঁথায়। ফলে সময়কে ধারণ করে নকশি কাঁথা এগিয়ে এসেছে আধুনিক মানুষের দোরগোড়ায়।
নকশি কাঁথার বাণিজ্যিক রূপ
নকশি কাঁথার বাণিজ্যিক ব্যবহার বেশি দিনের নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এসে নকশি কাঁথা তার বাণিজ্যিক রূপ লাভ করে। প্রথম দিকে মানুষ তার নিত নৈমিত্তিক প্রয়োজনেই কাঁথা সেলাই করত। আত্মীয় স্বজন বা বাড়ির মেহামানদের অতিরিক্ত সমাদর করার জন্য তারা নকশি কাঁথা বিছিয়ে দিতো। এছাড়া সাধারণ কাঁথা দিয়েই তারা তাদের প্রয়োজন মেটাত। বাংলার কৃষি সমাজে এটাই ছিল রীতি। বাড়িতে কেউ এলে তার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিছানায় বসানোই ছিল ভদ্রতার লক্ষণ। আর এই কারণেই তখনকার মেয়েরা নকশি কাঁথা সেলাই করতো। একটি নকশি কাঁথা সেলাই করতে তাদের বছরের পর বছর ব্যয় করতে হতো। ফলে তারা এই নকশি কাঁথা নিয়ে কোনো রকমের বানিজ্যিক চিন্তা করার অবসর পায় নি।
কালক্রমে, বলতে গেলে ব্রিটিশ আমলে যখন বিদেশিরা এদেশে আগমন করে তখন কিছু বিদেশি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এদেশের নকশি কাঁথার গুণে মুগ্ধ হয়ে অর্ডার দিয়ে নানা রকমের নকশি কাঁথা বনিয়ে নিতো। কিন্তু নকশি শিল্পীরা তা সহজেই বানিয়ে দিতে চাইতেন না। বাংলাদেশে এটি বাণিজ্যিক রূপ লাভ করে সত্তরের দশকে এসে। তখন কারিকা নামে একটি সংস্থা গ্রাম্য মহিলাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য তাদের যে হাজার বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান- নকশি কাঁথা বোনা, তা কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। আর এর ফলেই ১৯৭২ সালে প্রথম কারিকা বাণিজ্যিকভাবে নকশি কাঁথা উৎপাদন শুরু করে। এরপর ব্রাক তার নারী স্বাবলম্বী কার্যক্রমের অংশ হিসিবে নকশি কাঁথাকে গ্রহণ করে এবং ব্র্যাক আড়ংয়ের মাধ্যমে এটি বাজার জাত করে। বলা যায় ব্রাকই নকশি কাঁথার ব্যাপক বাণিজ্যিকায়ন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেই সাথে নকশি কাঁথার সেই ঐতিহ্যগত যে রূপ বা শৈল্পিক দিকটি অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। আজ নকশি কাঁথার বাণিজ্যিক ব্যবহার সর্বত্র দেখা যাচ্ছে।
দেশে নকশি কাঁথা সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- নকশি কাঁথা, বেড কভার, থ্রি-পিস, ওয়ালমেট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিস পাঞ্জাবি, ইয়ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাড়, ওড়না, ফ্লোর কুশন, মাথার ব্যান্ড, মানি ব্যাগ, কলমদানি, মোবাইল ব্যাগ, শিকা, শাল চাদর ইত্যাদি।
এ দেশের জামালপুরের বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ, যশোর, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা অঞ্চলে নকশি কাঁথা বেশি তৈরি হয়ে থাকে। তা ছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেটে নকশি কাঁথার বাজার ও ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে কেবল জামালপুরেই গড়ে উঠেছে রংধনু হস্তশিল্প, সৃজন মহিলা সংস্থা, সুপ্তি, ক্যাম্প, কারু নিলয়, জোসনা হস্তশিল্প, প্রত্যয় ক্রাফট, রওজা কারুশিল্প, কারুপল্লী, কারু নীড়, দোলন চাঁপা, ঝিনুক, সূচিকা, তরঙ্গ, দিপ্ত কুটির, বুনন, অণিকা, মিম, মামিম, শতদলসহ প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। তাই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নকশি কাঁথা তৈরি হয় জামালপুরে।
আন্তর্জাতিক বাজারে নকশি কাঁথা
সারাবিশ্বে এখন নকশি কাঁথার বিশেষ বাজার তৈরি হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন বাজারে এ শিল্প ইদানীং বেশ ভালো স্থান করে নিতে চলেছে। বাংলাদেশের নকশি কাঁথা গুণগতমানে উন্নত এবং দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় দেশ-বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের নকশি কাঁথার উন্নত গুণগত মান ও মূল্য তুলনামূলক কম হওয়ায় বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নকশি কাঁথার বিশেষ বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যেও নকশি কাঁথা রফতানি হচ্ছে।
সমস্যা ও সংকট
নকশি কাঁথাশিল্পের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করেন। তাদের মূল সমস্যা হলো- পুঁজি সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রম মজুরি বৃদ্ধি, পরিবহন সমস্যা, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, নিখুঁত পণ্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্য, বকেয়া টাকা পরিশোধ না করা, ডিজাইনে বৈচিত্রের অভাব, সরকারি আনুকূল্য না পাওয়া, ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সহজশর্তে ঋণ না পাওয়া, যথাযথ সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়া, সরাসরি বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার সুযোগ না পাওয়া ইত্যাদি। এসব কারণে তাদের পড়তে হয় নানা সমস্যায়। এ শিল্পের সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে এবং সরকারের হাত আরো প্রসারিত করলে এটিও হতে পারে অন্যতম একটি আয়ের উৎস। তবে পাঁচ বছর যাবৎ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। এ শিল্পের সমস্যাগুলো দূর করা হলে শিল্পটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগে গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। তাহলে গ্রামীণ নারীদের দারিদ্র্য দূর হবে; সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। নারীর ক্ষমতায়নও বাড়বে। টিকে থাকবে নকশি কাঁথার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় ঐতিহ্য। এ শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যাদি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। তাই নকশি কাঁথার সাথে জড়িত উদ্যোক্তাদেও অধিকহারে এসএমই ঋণ দেওয়া প্রয়োজন।
লোকজ ঐতিহ্য
নকশী কাঁথা নিয়ে এ পর্যন্ত প্রচুর গবেষণা ও বিস্তর বই লেখা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের মিউজিয়ামেও সংরক্ষিত রয়েছে বাংলার নকশী কাঁথা। লন্ডনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, সোনারগা কারুশিল্প জাদুঘর, কলকাতার গুরু সদরদত্ত মিউজিয়াম, আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়ামেও আমাদের নকশি কাঁথা রয়েছে। লোকশিল্পের গবেষণায় পাওয়া নকশি কাথাগুলো অথেনটিক নকশি কাথা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওয়েস্ট বেঙ্গলের কিছু সচেতন মানুষ কাথা সংগ্রহ করা শুরু করেন। ড. এনামুল হক ১৯৫৯-এ নকশি কাঁথা কালেকশন করেন। তিনি প্রায় তিনশর মতো কাথা কালেক্ট করেন।
নকশি কাঁথা গবেষকের কথা
পারভীন আহমেদ, নকশী কাঁথা গবেষক : আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে নকশি কাঁথা প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে আছে। তান্ত্রিক বৌদ্ধদের মাধ্যমেই আমাদের পুর্ব বাংলায় এই নকশার ব্যাপক প্রবর্তন হয় যদিও এটা আরও অনেক আগে থেকেই চলে আসছিল। নকশি কাঁথাকে আমি, আর্ট মনে করি। পেইন্টিংয়ের মতোই এটা একটা আর্ট। কিন্তু এটার কোনো মূল্যায়ন হচ্ছে না। একজন পেইন্টার একটা কাজের জন্য যেমন বিশ থেকে পচিশ হাজার টাকা নিচ্ছে তেমনি নকশী শিল্পীকেও এই পারিশ্রমিক দেওয়া উচিত। ১৯৯৯ সালে ভারত নকশি কাঁথা নিজেদের নামে নিবন্ধন করে ফেলে���ে। এটি আমাদের জন্য একটা দুঃখজনক ঘটনা। আমাদের সরকারের ভুলেই এটা হয়েছে। আমাদের সচেতন মানুষের ভুল তারা এটাতে গুুরুত্ব দেয় নি। জামদানির মতো নকশি কাঁথাও এই বাংলার কিন্তু ভারত সেটা পেটেন্ট করে ফেলেছে। কিন্তু ইতিহাসে সবাই জানে এটা বাঙালিদের। আমরা এতো জ্ঞান ছাড়া যে, আমাদের এত মূল্যবান সম্পদ আছে তা আমরা ভাবিও না।
বাণিজ্যিক নকশি কাঁথা ও ঐতিহাসিক নকশি কাঁথার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কেননা ঐতিহাসিক নকশি কাঁথায় ৭০ ধরনের ফোড় ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন তা নেই। বাণিজ্যিকিকরনের ফলে তা হারিয়ে যাচ্ছে। আর এই স্রোতটা বজায় রাখার জনন্য মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। কমার্শিয়ালি না করে বরং শিল্প হিসেবে এর ফোড়ের যে দক্ষতা তা বজায় রাখা উচিত। দামি জামদানির মতো যেমন দুটো বানানো হয় পুরো বছরে, তেমনি নকশি কাথাও সেভাবে বানানো প্রয়োজন। এখানে মোটা অংকের পেট্রোনাইজ করা দরকার। আর তার ফলে নকশি কাথা শিল্পটাও তার পুরনো ঐতিহ্য সমেত অক্ষুণ্ন থাকবে। বাংলার মেয়েদের নকশি কাথা বুনার যথেষ্ট দক্ষতা আছে। এখন যেটা দরকার সময় উপযোগী উদ্যোগ নেওয়া।
বাণিজ্যিকভাবে কারিকা এটি আনলেও ব্রাকের মাধ্যমেই তার বিস্তার। কিন্তু ব্রাক এক্ষেত্রে একটি ভুল করে। তারা নকশী কাঁথার ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে ট্রেসিং। ফলে এর শিল্পমানটা কমে গেছে। কেননা মেয়েরা আগে সুই সুতা দিয়ে ড্রইং করতো। আড়ং ম্যাস প্রোডাক্ট করতে গিয়ে এই ট্রেসিংয়ের প্রবর্তন করে। ফলে একটা ডিজাইনেই দুইশ পিস করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু শৈল্পিকভাবে এটি উপস্থাপন করতে হলে ডিজাইনে ডিসট্যান্স থাকতে হবে। এটা মন থেকে করতে হবে। কারণ নকশী কাথার মূল ¯িপ্রটটা ট্রেসিংয়ের সাথে যায় না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে নকশী কাথার বাজার ভালো থাকলেও কিন্তু মেয়েরা এখনো সেভাবে পয়সা পাচ্ছে না। এতবড় কাথা বানিয়েও তারা পাচ্ছে ৭০০-৮০০। কিন্তু সেটা বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার থেকে আরো বেশি দামে। ফলে এখানে নকশী কর্মীদের ন্যায্য মূল্যায়ন করতে হবে।
কোথায় পাবেন:
নকশিকাঁথা, চাদর কিংবা কুশন কভার সবকিছুর দাম নির্ভর করে নকশার ওপরে। ভারী নকশার কাজ করা যেকোনো নকশি পণ্যের দাম বেশি হবে। অন্যদিকে অনেক বড় একটি কাঁথায় হালকা কাজ থাকলে তার দাম হবে তুলনামূলকভাবে কম।সস্তায় নকশী কাঁথা কিনতে চাইলে ঢু মেরে আসতে পারেন নিউমার্কেট কিংবা চাঁদনি চক, গাউছিয়া ও পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে।একটু চোখ বুলালেই দেখবেন নিউমার্কেট সংলগ্ন ফুটপাতেও বসেছে নকশি পণ্যের পসরা।
- ট্যাগ:
- ফ্যাশন
- সাহিত্য
- নকশি কাঁথা