ছবি সংগৃহীত

দেহের মধ্যে কলবের অবস্থান : কী বলে ইসলাম

শাইখ মুহাম্মদ উছমান গণী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি এবং সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০১৬, ০৩:৪৩
আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০১৬, ০৩:৪৩

কলব মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে ১২৬টি আয়াত রয়েছে, যেসব আয়াতে কলবের কর্মকা- সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- ‘তাদের কলবগুলোতে রোগ আছে।’ (সূরা বাকারা : ১০)। ‘তাদের কলব আছে কিন্তু তারা তদ্বারা বুঝে না।’ (সূরা আরাফ : ১৭৯)। ‘তবে যদি তাদের কলব থাকত যা দ্বারা তারা বিবেচনা করবে।‘ (সূরা হজ : ৪৬)। হাদিস শরিফে এসেছে, জেনে রাখ! মানবদেহে এমন একটি ‘মুদগা’ রয়েছে, যা সুষ্ঠু হলে সমগ্র দেহ সুষ্ঠু হয়; আর তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমগ্র দেহই ক্ষতিগ্রস্ত হয়; জেনে রাখ! তা হলো ‘কলব’। (সহিহ বোখারি)। এখন প্রশ্ন হলো এ বিশেষ ‘মুদগা’ যাকে ‘কলব’ বলা হয়েছে তা শরীরের কোথায় অবস্থিত? এ সম্পর্কে তিনটি ধারণা প্রচলিত আছে- ক. কেউ কেউ বলেন, এটা হলো রুহ (আত্মা, প্রাণ বা জীবন), কিন্তু এটা সঠিক হতে পারে না। কারণ রুহের কোনো নির্ধারিত আকার নেই এবং শরীরের মধ্যে তার কোন সুনির্দিষ্ট স্থান বা অবস্থানও নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যদি আপনাকে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আপনি বলুন, রুহ আমার রবের নির্দেশ হতে; আর তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে।’ (সূরা বনি ইসরাঈল : ৮৫)। রুহ মূলত কম্পিউটারের সফটওয়্যার (কমান্ড নির্দেশ) এর মতো, যা হার্ডওয়্যার (শরীর) এর মধ্যে অবস্থান করে, কিন্তু তার নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান নেই, ইনস্টল করার পর তা পূর্ণ হার্ডওয়্যারে (শরীর) অবস্থান করে; তবে আলাদাভাবে কোনো অংশে নয়। খ. কেউ কেউ বলেন, এটা হলো নাফছ (রিপুগুলো), কিন্তু এটাও সঠিক হতে পারে না। কেননা নাফছেরও কোনো নির্ধারিত আকার নেই এবং শরীরের মধ্যে তার কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান বা অবস্থানও নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর আমি আমার নাফছকে নির্দোষ বলি না, নিশ্চয় নাফছ (রিপুগুলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা ও ঘৃণা) অবশ্যই মন্দ কাজের প্রতি নির্দেশ করে, আমার রব যাকে রহমত করেন তাকে ছাড়া; নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (সূরা ইউছুফ : ৮৫)। গ. কেউ কেউ বলেন, এটা হলো আকল (জ্ঞান, বিবেক বা বুদ্ধি), এটা অনেকটা কাছাকাছি। কিন্তু আমরা জানি জ্ঞান, বিবেক বা বুদ্ধি স্পর্শযোগ্য বস্তু নয়, আকলেরও কোনো নির্ধারিত আকার নেই, যদিও শরীরের মধ্যে তার নির্দিষ্ট স্থান বা অবস্থান রয়েছে এবং হাদিস শরিফে কলবকে মুদগাহ অর্থাৎ স্পর্শযোগ্য বস্তু বলা হয়েছে, সুতরাং মস্তিষ্ক বা মগজ যেখানে জ্ঞান, বিবেক বা বুদ্ধি থাকে তাকেই কলব বলা শ্রেয়তর হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বধির, বোবা ও অন্ধ, সুতরাং তারা বিবেচনা করে না।’ (সূরা বাকারা : ১৮)। যেহেতু হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘মুদগা’ ও ‘কলব’ শব্দ ব্যবহার করেছেন তাই আমরা দেখব এ শব্দ দুটি কোরআন, হাদিস ও অভিধানে কী কী অর্থে রয়েছে। কোরআনুল কারিমে ‘মুদগা’ শব্দের ব্যবহার- ১. অতঃপর আমি ‘আলাক’ কে ‘মুদগা’ পরিণত করলাম, তারপর ‘মুদগা’ কে ‘ইজাম’। (সূরা মোমিনুন : ১৪)। হাদিস শরিফে ‘মুদগা’ শব্দের ব্যবহার- ১. নিশ্চয় আদমসন্তানের মধ্যে একটি ‘মুদগা’ রয়েছে, যখন তা সুষ্ঠু থাকে তখন সমগ্র দেহ সুষ্ঠু থাকে; অর্থাৎ ‘কলব’। ২. সাবধান! আর নিশ্চয় শরীরের মধ্যে একটি অংশ আছে, যখন তা সুষ্ঠু হয় সব শরীর সুষ্ঠু হয়, আর যখন তা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সম্পূর্ণ শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়; সাবধান! আর সেটা হলো ‘কলব’)। (সহিহ বোখারি, মুসলিম ও তিরমিজি)। অভিধানে ‘মুদগা’ শব্দের অর্থ- ১. চিবানো, রস বের করা বা মজা বের করা। ২. লুকমা গ্রাস, উচ্ছিষ্টাংশ, খাওয়া হয়েছে যে বস্তু বা যা চিবানো হয়েছে, টুকরা অংশ। ৩. যুদ্ধ করা ও জগড়া করা । আর ‘মুদগা’ মাংস ছাড়াও হতে পারে। বলা হয়, মানুষের মধ্যে দুটি ‘মুদগা’ রয়েছে, যখন এ দুটি সুষ্ঠু থাকে শরীর সুষ্ঠু থাকে; ‘কলব’ ও জিহ্বা। (লিসানুল আরব)। কোরআনে ‘কলব’ শব্দের ব্যবহার- ১. পরিবর্তন। ২. গবেষণা করা, দৃষ্টিভঙ্গি, (আর পরিবর্তন হলো তোমার জন্য কর্মগুলো, তবে আপনাকে যেন বিভ্রান্ত না করে (তাদের বিচরণ বিভিন্ন দেশে)। ৩. দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং কর্মে সিদ্ধহস্ত (পরিবর্তিত হয়, উহাতে বিবেক ও দৃষ্টি, অবতীর্ণ হয়েছে তা নিয়ে রুহুল আমিন আপনার স্মৃতিতে)। হাদিসে ‘কলব’ শব্দের ব্যবহার- ১. এসেছে তোমাদের কাছে ইয়েমেনবাসী, তারা (কলব বা অত্যন্ত সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী)। ২. হে কলব- মন পরিবর্তনকারী! আমাদের কলব বা অন্তরগুলো তোমার দ্বীনের ওপর অবিচল রাখো, আর হে মন বিবর্তনকারী! আমাদের অন্তরগুলো তোমার আনুগত্যের দিকে পরিচালিত করো। ৩. নিশ্চয় প্রত্যেক বস্তুর ‘কলব’ আছে, আর কোরআনের ‘কলব’ হলো সূরা ইয়াসিন)। ৪. আলী ছিলেন কোরাইশি ও কলবি বা জ্ঞানী অর্থাৎ বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। (তাজরিদুস সিহাহ)। অভিধানে ‘কলব’ এর অর্থ- ১. আর অবশ্যই ‘কলব’ বলে ‘আকল’ বোঝানো হয়, ইমাম ফাররা (রহ.) বলেন, এ আয়াত প্রসঙ্গে- নিশ্চয় এর মধ্যে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে তাদের জন্য, যাদের ‘কলব’ আছে অর্থাৎ ‘আকল’। ২. ইমাম ফাররা (রহ.) আরও বলেন, আর আরবি ভাষায় এভাবে বলা যায়, তোমার ‘কলব’ নেই অর্থাৎ তোমার ‘আকল’ নেই বা তোমার ‘কলব’ তোমার সঙ্গে নেই, অর্থাৎ তোমার ‘আকল’ তোমার সঙ্গে নেই বা তোমার ‘কলব’ কোথায় গেল অর্থাৎ তোমার ‘আকল’ কোথায় গেল। ৩. অন্যরা বলেন, যার রয়েছে ‘কলব’ অর্থাৎ বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি, ৫. আর বিচলিত হয় তাদের কলব বা অন্তর ও দৃষ্টি। সুতরাং বলা যায়, কলব হলো আকল বা আকলের আধার মস্তিষ্ক। মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী সৌজন্যে : দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ