ছবি সংগৃহীত

দি অ্যামফিবিয়ান ম্যান- এক অনন্য মানবের দুঃখগাথা

Sabuj Wahid
লেখক
প্রকাশিত: ৩০ এপ্রিল ২০১৩, ১৭:৩২
আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৩, ১৭:৩২

যদি কখনো সমুদ্র তীরে বেড়াতে যান পাঠক লক্ষ্য করবেন, সাগরের বুকে সূর্য অস্ত যাবার পর থেকে রাত একটু ঘন হয়ে আসবার আগ পর্যন্ত অনেক অপূর্ব দৃশ্যই চোখে পড়ে এই সময়টায়- সাগরের তীর ঢেউয়ের প্রান্তে প্রান্তে পা ভিজিয়ে হেঁটে চললে। কিন্তু দেখবেন না পুত্র হারানোর বেদনায় নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধ লোককে; শুনবেন না সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাঁর ক্রমাগত ডেকে চলা- ‘ইকথিয়ান্ডর! ইকথিয়ান্ডর! পুত্র আমার!’ যদি আপনি দেখতে চান এই বৃদ্ধকে, শুনতে চান ছেলেকে কাছে পাবার জন্য তাঁর প্রবল আকুতি তাহলে সমুদ্র ভ্রমণে যাবার আগে আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে একটি বই-- নাম দি অ্যামফিবিয়ান ম্যান। রুশ কল্প বিজ্ঞানের পথিকৃৎ লেখক আলেক্সান্দর বেলায়েভ আমাদের জন্য শুনিয়েছেন নিজের অনিচ্ছায় হয়ে ওঠা এক উভচর মানুষের কথা, তাঁর হাসি-আনন্দ-বেদনার গাঁথা। বইটি বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন অনুবাদের জগতের কিংবদন্তী লেখক ননী ভৌমিক। প্রকাশ করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আমার জানা মতে আরেক সুলেখক ও অনুবাদক কাজী মায়মুর হোসেনের করা এই বইটির আর একটি অনুবাদ প্রকাশ পেয়েছে সেবা প্রকাশনী থেকে; সেটার নাম-- “দি অ্যামফিবিয়ান ম্যান”। বইয়ের মূল চরিত্র ইকথিয়ান্ডর বছর কুড়ির এক উভচর মানুষ; জলে এবং স্থলে তার অবাধ বিচরণ। আর্জেন্টিনার সমুদ্র উপকুলের তলদেশ জুড়ে তার রাজত্ব। কখনো জেলেদের জাল কেটে মুক্ত করে দেয় বন্দি মাছের ঝাক আবার কখনো দয়া পরবশ হয়ে বড় কোনো মাছ ধরে ছুড়ে দেয় জেলেদের নৌকায়-এমনি খেয়ালী সে। রাতের আঁধারে সমুদ্র তীর থেকে ছাগল ছানা ধরে সাগরের বুকে থাকা জেলেদের নৌকায় রেখে আসবার মতো মজাও সে করে। এই সব কীর্তির জন্য উপকূলের মানুষের কাছে সে পরিচিত “দরিয়ার দানো” হিসেবে। তার এ সকল কর্মকান্ডে সহায়তা করে বন্ধু ডলফিন লিডিঙ। লিডিঙয়ের পিঠে চড়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে ছুটে চলে ইকথিয়ান্ডর দিগন্তের পানে। জলের মধ্যে ইকথিয়ান্ডর আর লিডিঙয়ের দিন আনন্দেই কাটছিলো। কিন্তু সমস্যা বাধালো লোভী এক মানুষ; নাম তার পেদ্রো জুরিতা। ডুবুরির মাধ্যমে মুক্তো সংগ্রহ করা তার কাজ। খুব কম খরচে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় সে ইকথিয়ান্ডরকে বন্দি করবার জন্য ব্যস্ত হলো। সঙ্গী হিসেবে এই কাজে তার সাথে যোগ দিল বালতাজার এবং তার ভাই ক্রিস্টো। এই তিনজনের ছলচাতুরীতে বন্দি হবে ইকথিয়ান্ডর। কিন্তু তারো আগে ঘটবে আরো কিছু ঘটনা। একে একে পাঠকদের সামনে এসে উপস্থিত হবেন ইকথিয়ান্ডরকে ইকথিয়ান্ডর করে তোলার কারিগর অসম্ভব প্রতিভাবান শল্য চিকিৎসক ও গবেষক ডাক্তার সালভাতর, তাঁর গবেষণাগার এবং গবেষণার ফলে সৃষ্ঠ আজব সব প্রানী। আসবে ইকথিয়ান্ডরের চোখ দিয়ে দেখা সমুদ্রতলের অপুরূপ বর্ণনা এবং অক্টোপাসের সাথে লড়াইয়ের বিবরণ। আসবে বন্ধুরূপী অলসেনের কথা। কিন্তু তারও আগে ইকথিয়ান্ডরের দেখা হবে অপুরূপ রুপসী গুত্তিয়েরির সাথে; প্রেমে পড়বে তারা এক অন্যের। কী হবে এই উভচর ও স্থলচর মানব-মানবীর প্রেমের পরিণতি? ডাক্তার সালভাতর ইকথিয়ান্ডরের আসল বাবা নন। তাহলে সমুদ্রে ঝড়ের আভাস দেখা দিলে আকুল হয়ে কে ডাকবে তাকে ‘ইকথিয়ান্ডর! ইকথিয়ান্ডর! পুত্র আমার’ বলে? জানতে হলে উপায় একটাই- বইটা পড়া। সমুদ্রতলের সাথে উপরের পৃথিবীর একটি অমিল ইকথিয়ান্ডরের দৃষ্টি দিয়ে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক এভাবে-- ‘পাথরের দেয়ালের ওপর দিয়ে পাকা ফল ভরা পীচ আর কমলালেবু গাছের ডাল দেখা যাচ্ছিল। কিছুই এখানে সমুদ্রের মতো নয়। সবই অন্য কারো সম্পত্তি, সবই এখানে বাটোয়ারা করা, বেড়া ঘেরা, পাহারা বসানো। শুধু আকাশের পাখিগুলোর মালিক নেই কেউ, উড়ছে তারা, কলরব করছে পথ জুড়ে। কিন্তু ধরা ওদের অসম্ভব। তাছাড়া আদৌ ধরা চলবে কি? হয়ত কারো না কারো সম্পত্তি।’ এই বইয়ের আরেকটি দিক হলো, যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানকে প্রতিহত করবার উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে দিয়ে চলা ধর্ম ব্যবসায়ীদের যুক্তি এবং তার উত্তরে ডাক্তার সালভাতরের জবানীতে বিজ্ঞানের জবাব। একবার বইটা পড়ুন পাঠক-- তারপর আপনি যখনি সমুদ্র তীরে বেড়াতে যান না কেন অবশ্যই আপনার দৃষ্টি চলে যাবে দূর সাগরে, সে দৃষ্টি ব্যাকুল হয়ে খুঁজবে ডলফিনের পিঠে বসে শাঁখ বাজাতে বাজাতে ছুটে চলা এক দুঃখী উভচর মানবকে-- ইকথিয়ান্ডরকে। আলেক্সান্দর বেলায়েভঃ আলেক্সান্দর রোমানোভিচ বেলায়েভকে (যিনি আলেক্সান্দর বেলায়েভ নামেই অধিক পরিচিত) বলা হয় রুশ কল্প বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ১৮৮৪ সালে। তিনি একাধারে ছিলেন অর্কেস্ট্রার বাজনদার, রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যপট আঁকিয়ে, সাংবাদিক এবং আইনবিদ। বিখ্যাত এই লেখকের প্রথম কল্প-বৈজ্ঞানিক উপন্যাসের নাম “প্রফেসর ডোয়েলের মস্তক”। এই উপন্যাসটি প্রকাশের পরপর-ই তাঁর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাঁর সব থেকে বিখ্যাত লেখা হচ্ছে-- “উভচর মানুষ” নামক কল্প-বৈজ্ঞানিক উপন্যাসটি। “জাহাজ-ডুবির দ্বীপ” এবং “শূন্যে ঝাঁপ” তাঁর আরো দু’টি অসাধারণ লেখা। কল্প-বৈজ্ঞানিক উপন্যাস ছাড়াও তিনি চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, মহাকাশ অভিযান ও জীববিদ্যার নানান সমস্যা নিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক বই লিখেছেন-- যা সারা বিশ্বের বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী পাঠকদের কাছে আজও সমান গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে এই মহান লেখক পরলোক গমন করেন।