ছবি সংগৃহীত

তাবলীগি মুরব্বি-০২ : তাবলিগ জামাতের প্রাণপুরুষ মাওলানা ইলিয়াস কান্দলুভি (রহ.)

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৫:৫৪
আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৫:৫৪

মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর সহপাঠী ছিলেন মাওলানা রিয়াজুল ইসলাম কান্দলভি। ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি একদিন বলছিলেন, ‘মাওলানা ইলিয়াসের মাঝে ছোটবেলা থেকেই ইসলামি হুকুম-আহকামের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা ছিল। ও একদিন আমার কাছে এসে বললো, চলো, যারা নামাজ না পড়ে তাদের বিরুদ্ধে আমরা জিহাদ ঘোষণা করি।’ ১৮৮৫ সালে ভারতের কান্দালা নামক এক শহরের জন্ম গ্রহণ করেন মাওলানা ইলিয়াস রহ.। ছোটবেলা কেটেছে নানিবাড়ি মেওয়াতে। মাওলানা ইলিয়াস যখন একটু বড় হলেন, পড়াশুনা করার তাগিদে বাবার কাছে নিজামুদ্দিন চলেন এলেন। বাবা মাওলানা ইসমাইলের কাছেই ‘আলিফ-বা’র সবক শুরু করেন এবং খুব অল্পদিনের মাঝে পবিত্র কুরআনের হিফজ সমাপ্ত করেন। প্রখর মেধাবী ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সবার মুরুব্বী ‘আম্মিবি’র (মাওলানা ইলিয়াস রহ. -এর নানি) দোয়া ছিল তাঁর প্রতি। আম্মিবির আশা ছিল, ‘আমার নাতি যেন সাহাবা আজমাইনদের মতো দ্বীনের দায়ি হতে পারে। মানুষের দ্বারে দ্বারে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে পৌঁছার জন্য আল্লাহ যেন আমার নাতিকে কবুল করে।’ আম্মিবি আমাতুস সালামের এই দোয়া ও প্রার্থনাকে কানায় কানায় পূরণ করলেন আল্লাহ মহান। গোটা পৃথিবীজুড়ে দ্বীনি দাওয়াতের বর্তমান যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, তাবলিগী কার্যক্রমের যে পদ্ধতি চালু রয়েছে মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর চিন্তা-ফিকির, দোয়া-মোনাজাত ও চোখের পানি সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এক কথায় ইম্মতে মুহাম্মাদির নবীওয়ালা এই কাজের একমাত্র উদ্বাভক, বর্তমান তাবলিগ জামাতের প্রাণপুরুষ-রূপকার একমাত্র তিনিই। পবিত্র কোরান হিফজ করার পর বড় ভাইয়ের সঙ্গে পড়াশুনা করার জন্য গাঙ্গুহ চলে আসেন। এখানে এসেই তিনি মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির সোহবত লাভ করেন। ইলমে অহির সফর ধারক এই মহাপুরুষের সংর্স্পশ-শুভ্রতায় আলোকিত হয়ে ওঠে মাওলানা ইলিয়াসের জীবন-সাধনা। কিছুকাল অসুস্থ থাকার কারণে ভালোভাবে পড়াশুনায় অংশ গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। পুরাপুরি সুস্থতা লাভ করার পর পুনরায় মনোনিবেশ করেন এবং খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। পড়াশুনা চালানোর পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সাধনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির কাছে বায়আত গ্রহণ করেন তিনি। কোনো কোনো ইতিহাসবিদদের মতে মোট বিশ বছর মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির সোহবাতে ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস। মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির ইনতিকালের পর দেওবন্দে চলে আসেন এবং মাওলানা মাহমুদ হাসানের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মাওলানা মাহমুদ হাসানের কাছে পুনরায় তিরমিজি শরিফসহ বিভিন্ন হাদিসের গ্রন্থ পাঠ করেন বলে জানা যায়। ভারতের সাহরানপুরে অবস্থিত মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতা প্রাপ্তির মাধ্যমে মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। একাধারে মোট আট বছর শিক্ষকতা করেছেন সেখানে। মাদরাসায় শিক্ষক থাকাকালীন ১৯১২ সালের ১৭ অক্টোবর মামাতো বোনের সঙ্গে শুভ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাওলানা ইলিয়াস। এরপর তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টির আগমন ঘটে। যেখানে, যে অঞ্চলে থাকাকালীন এবং যে মানুষগুলোর পশ্চাৎপদতায় মনের গভীরে চিন্তার জোয়াড় উঠেছিল সেই এলাকায় যাওয়া হলো মাওলানার। পিতা ও বড় ভাইয়ের ইনতিকালের কারণে মেওয়াতি জনসাধারণ এবং পরিবারের বিশেষ অনুরোধে মাদরাসা ছেড়ে মেওয়াত চলে এলেন মাওলানা ইলিয়াস। মেওয়াতে এসে বাবার প্রতিষ্ঠিত মক্তব দেখাশুনা শুরু করলেন এবং একই ধারাবাহিকতায় নিজ খরচে আরো কয়েকটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। দ্বীনি এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে মেওয়াতবাসীর মানসিক জাহেলিপনা ও জ্ঞানগত অন্ধত্ব ভীষণভাবে চিন্তিত করে তোলে তাঁকে। গভীর ভাবনায় নিমগ্ন ইলিয়াস ভাবতে থাকেন, কীভাবে এবং কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে দ্বীনহীন এই মানুষগুলোকে আল্লাহর পথে আনা যায়! চিন্তা-ভাবনার এক শুভক্ষণে নবীওয়ালা দাওয়াতি চিন্তা-পদ্ধতির কথা স্মরণ করেন তিনি এবং নিজ কওমের লোকজনকে নবীদের আদলে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। তাদের বোঝোতে শুরু করেন যে, আমরা যেখানে আছি এটাই আমাদের চিরস্থায়ী নিবাস নয়; আমাদের চিরস্থায়ী নিবাস হলেঅ জান্নাত। পৃথিবীতে আমাদেরকে সেই চিরস্থায়ী নিবাসে বসবাস করার সামান জোগারের জন্য পাঠানো হয়েছে। একে একে দুই। দুইয়ে দুইয়ে চার। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো মাওলানা ইলিয়াসের দাওয়াত শোনা মানুষের সংখ্যা। আরো বেশি পরিমাণে মানুষের আগমন ঘটতে লাগলো তাঁর দ্বীনি হালকায়। মানুষ তাঁর কথা শুনে ফিলে এলো দ্বীনের পথে এবং ছেড়ে দিলো অতীত জীবনের নানান কুকর্ম। দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে বছরকে বছর পর এসে আজকেই এই সফলতার শীর্ষমিনারে স্থান দখল করেছে মাওলানা ইলিয়াস রহ. উদ্ভাবিত নবীওয়ালা দাওয়াতি মিশর- তাবলিগ। কাজ রয়ে গেছে, কাজের সফলতার ব্যাপ্তি ঘটছে, কিন্তু যিনি এই কাজটি শিখিয়েছিলেন তিনি আর রইলেন না। চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। নবীওয়ালা কাজের জিম্মাদরী কাঁধে চড়িয়ে বিদায় নিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালেল ১২ই জুলাই মাটির পৃথিবীর আলো-আধার আর হাসি-কান্নাকে বিদায় জানিয়ে প্রিয়তম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেলেন তিনি। লিখেছেন : মাওলানা মিরাজ রহমান ইমেইল : [email protected]