
ছবি সংগৃহীত
ঘষেটি বেগমের প্রাসাদ এখন কারখানা!
আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৫, ১৩:৫৫
(প্রিয়.কম) পুরান ঢাকার কেরানীগঞ্জে জিঞ্জিরা প্রাসাদ একটি ঐতিহাসিক প্রসাদ। এই প্রাসাদের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নাম। প্রাচীন জিঞ্জিরা প্রাসাদটি 'নওঘড়া' বলে কেরানীগঞ্জবাসীর কাছে চেনা। নওঘড়াটি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বহু স্মৃতিবিজড়িত এ প্রাসাদটি বেদখলে রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো সরকার এর রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগ নেয়নি।ঘসেটি বেগমের প্রাসাদে ফুচকা-মুড়ির কারখানা! পলাশীর যুদ্ধের পর জিঞ্জিরা গ্রামে সিরাজ-উদ-দৌলার মা আমেনা বেগম, সহধর্মিণী লুৎফা বেগম, (সন্তানসহ) ও খালা ঘসেটি বেগমকে বন্দি রাখা হয়। ওই সময় তাদের শিকল (জিঞ্জির) দিয়ে আটকে রাখার কারণেই ইউনিয়নটি 'জিঞ্জিরা' নামে পরিচিতি পায়। এই প্রাসাদটি পরে জিঞ্জিরা প্রাসাদ নামে পরিচিতি পায়। জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে প্রাসাদটি দখল শুরু হয়। এর মূল ফটক থেকে ৫০ গজ দূরে আরেকটি প্রাসাদ রয়েছে। প্রাসাদ দুটির একটিতে গেলে মনে হবে, হয়তো এটি ফাঁসির মঞ্চ ছিল। আরেকটি হয়তো প্রমোদাগার বা নৃত্যশালা। আজ ওই প্রাসাদে রয়েছে ফুচকা তৈরির কারখানা ও ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের আস্তানা। ফুচকা কারখানার মালিক মো. আরব আলী মাদবর জানান, তিনি ঘরটি ছয় হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন। তার মতো এমন ১০-১২টি ঘর আছে। এসব ঘরের বেশিরভাগই ভাড়া নিয়েছেন মুড়ি বিক্রেতারা। ঘসেটি বেগমকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানকার প্রাসাদটি পুরোই বেদখলে চলে গেছে। অনেকে বলেন, প্রাসাদের ভেতর কিছু মাটি খুঁড়লেই শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যায়। অনেক দিন আগে একবার মাটি খুঁড়ে একটি পিতলের ঢাকনা দেখতে পাওয়া যায়। পরে আওয়াজ পেয়ে সেটা তাড়াতাড়ি যথাস্থানে রেখে দেওয়া হয়। জিঞ্জিরার বাসিন্দা আহমেদ আলী নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, বুড়িগঙ্গার নিচ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লালবাগ কেল্লার সঙ্গে জিঞ্জিরা প্রাসাদের সুড়ঙ্গপথ ছিল। ওই প্রাসাদের পাশে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। নওঘড়া প্রাসাদের প্রাচীর ঘেঁষে ঢাকা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হাজি রেজাউল কবীর পলের বহুতল ভবন। মূল ফটকটি ভেঙে মো. লাজু মেম্বার বাড়ি নির্মাণ করেন। হাউলি গ্রামের মো. সাত্তার মাস্টার ও মো. শিমুল মিয়া ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ পুরো দখলে রেখেছেন। এ ব্যাপারে ছাত্রদল নেতা হাজি রেজাউল কবীর পল বলেন, ঘসেটি বেগমের প্রাসাদের কোল ঘেঁষে আমাদের বাড়ি। আমরা প্রাসাদটি দখল করিনি। এ ব্যাপারে মো. শিমুল মিয়া বলেন, আমাদের নামে রেকর্ড থাকায় আমরা ভোগদখলে আছি। উপজেলা প্রশাসন আমাদের অনেকবার নোটিশ দিয়েছে। আমরা তার জবাব দিয়েছি। এদিকে ওই এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, প্রাচীন জিঞ্জিরা প্রাসাদ নিয়ে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, সে স্থানটির আজ বিলুপ্তি ঘটছে। আফগান কররান বংশের কররানিদের কেরানীগঞ্জে কিছুকাল অবস্থানেই কেরানীগঞ্জ নামকরণ ঘটে। তবে কেরানীগঞ্জের চেয়ে জিঞ্জিরা বেশি পরিচিতি লাভ করে ভারতসহ সারা বাংলায়। জিঞ্জিরা প্রাসাদটি নির্মাণ করেন নবাব ইব্রাহীম খান। জিঞ্জিরা প্রাসাদের সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের এক বিষাদ স্মৃতি জড়িত। একসময় ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগমের অঙ্গুলি সঞ্চালনে শত শত অনুচর আদেশ পালনের জন্য ব্যস্ত থাকত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে উভয়ের কষ্টের দিন কাটে এ প্রাসাদে। সিরাজ-উদ-দৌলার মা, স্ত্রী ও শিশুকন্যা একসময় এই জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি ছিলেন। উমিচাঁদ, জগৎশেঠ ও রায় দুর্লভদের পরামর্শে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়ার ছল করে ঘসেটি বেগম, নবাব সিরাজের মা আমিনা বেগম, নওরাজিসের উত্তরাধিকারী একরামউদ্দৌলার শিশুপুত্র মুরাদউদ্দৌলা, নবাব বেগম এবং শিশুকন্যাকে জিঞ্জিরার প্রাসাদ থেকে বজরায় খরস্রোতা ধলেশ্বরীর বুকে ৭০ জন অনুচরসহ ডুবিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হুসেন কুলি ও সরফরাজের বংশধররা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে দেওয়ানি ভার অর্পিত হওয়ার পরও বন্দিদশায় জিঞ্জিরার প্রাসাদেই অবস্থান করছিলেন। ১৭৬৭ সালে লর্ড ক্লাইভ তাদের মুক্ত করেন। উপজেলা নির্বাচনের সময় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ঐতিহাসিক এ জিঞ্জিরা প্রাসাদটি উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী বুড়ি হয়ে আজ বেঁচে আছে জিঞ্জিরাকে বুকে নিয়ে। এই বুড়িগঙ্গার বুকের ওপর দিয়ে ভেসে জিঞ্জিরায় এসেছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সর্বশেষ স্বাধীন নবাবের পরিবার। জিঞ্জিরা প্রাসাদ আজ ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এর ধূলিকণায় জমে আছে আনন্দ-বেদনার নানা স্মৃতি। উপজেলা চেয়ারম্যান ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শাহীন আহমেদ বলেন, জিঞ্জিরায় ঘসেটি বেগমের প্রাসাদটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। সূত্র: সমকাল