ছবি সংগৃহীত
গ্রামের মানুষের কাছ থেকে আমি শিখেছি: বিবি রাসেল
আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:৫৬
ছবি: শামছুল হক রিপন ও সংগ্রহ
(প্রিয়.কম) বিবি রাসেল। বিশ্ব সেরা মডেলদের একজন। ফ্যাশনে কাজ করছেন তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে। ইন্ডিয়ার স্টেট গেস্ট তিনি। কাজ করছেন খাদি কাপড়কে রিভাইব করার জন্য। হয়েছেন ইউনেস্কোর শিল্পের দূত। ইউনেস্কোর আর্ট পেজেন্টেশনে যার কাজ শোভা পায় তিনি আমাদের বিবি রাসেল। আকাশের তারা হয়েও যিনি নিজেকে তারকা মনে করেন না। দেশে পেলেন বিরল সম্মাননা রোকেয়া পদক, আগেই পেয়েছেন বাংলা একাডেমীর ফেলোশীপ। তার ভাষায় নিজের এতদূর যাত্রা সব কিন্তু বাংলার ঐতিহ্যকে ভালবাসার কারণেই। গামছাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করেছেন তিনি। আজ প্রিয়.কমের মুখোমুখি হয়েছিলেন বিবি রাসেল। দেশের বর্তমান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বিষয়ে তার বিভিন্ন কথা উঠে এসেছে এই আলাপ চারিতায়।
প্রিয়.কম: এখন কি নিযে ব্যস্ত আছেন?
বিবি রাসেল: প্রথম থেকেই যে কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম এখনও সে কাজ নিয়েই আছি। আমার দ্বায়িত্ব কাজ করা। কাজ নিয়েই আছি। অনেক খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের ক্রাফটের। চঙ্গের প্রথম স্টেপেই নেই আমি। দ্বিতীয় স্টেপে উঠার চেষ্টায় আছি। মোবাইলের দোকান খুলবো না। দেশের ক্রাফট নিয়েই কাজ করতে চাই। যাদের জন্য দেশের তাতীদের জন্য আজকে আমি বিবি। তাদের স্বপ্ন বাস্তাবায়ন করার স্বপ্ন নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।
(বিবি’র ইউনেস্কোর কালাচারাল ইভেন্ট)
প্রিয়.কম: আপনার ক্যারিয়ার শুরুর সময়ের আপনার স্ট্রাগলের কথা যদি একটু বলেন...
বিবি রাসেল: বাইরের দেশে আপনি যত বড় ফ্যামিলি থেকেই আসেন না কেন, আপনি যেই হোন আপনাকে একটা কম্পিটিশনে থাকতে হয়। কেউ রেড কার্পেট পেতে দেবে না। ওটার জন্য ফাইট করতে হয়। খুব কম মানুষই আছে ইউরোপিয়ানদের হাতে তৈরি, আমি একজন। সেখানে একটা বড় কলেজে পড়তাম। অনেক ধরনের কম্পিটিশন ছিল। রাতে পোস্টার বিলি করতাম। উইকেন্ডে কাজ করতাম। ক্লান্ত হয়ে রাতে আরামে ঘুমাতাম। এখনো ক্লান্ত হয়েই ঘুমাই, ঘুমের ওষুধ লাগেনা। একেকজন একেকটা আইডোলজিতে থাকে। আমি চাইলে ওই দেশে লাক্সারী লাইফ লিড করতে পারতাম। তা না করে আমি চলে আসছি দেশে।
প্রিয়.কম: কাজের জন্য আপনার ইন্সপায়রেশন কি?
বিবি রাসেল: আসলে জানতে হয় প্রত্যেকটা দেশের কালচার, হেরিটেজ। আমি খুব লাকি। আমার শৈশব এক্সিল্যান্ট। যে কোন মানুষের বেড়ে উঠার পেছনে সবচেয়ে বড় পারিবারিক শিক্ষা। আমি এমন একটা পরিবারে বড় হয়েছি। যে সেখানে বাবা আমাকে নজরুল রবীন্দ্রনাথ পড়িয়েছেন। বড় বড় আর্টিস্ট জয়নুল ভাই, কামরুল ভাই নবী ভাই সবাইকে দেখে বড় হয়েছি। আমাদের বাসায় আসতেন মাওলানা ভাষানী থেকে সবাই। তাই একটা শিক্ষা ছিল। আমার শেকড় খুব স্ট্রং। দেশের গামছাকে বিদেশে পরিচিত করিয়েছি। নিজেও পরে থাকি দেশি জিনিস। ছোটবেলা থেকে এসব ঐতিহ্য, সংস্কৃতিই আমাকে শিখিয়েছে। গ্রামের মানুষ আমার চেয়ে সুন্দর কালার কম্বিনেশন করে। আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে আমার গ্রামের মানুষ। সেসবেই আমার শিক্ষা। আমি ট্রেডিশনাল ওয়ে, বুনন চ্যাঞ্জ করি না। আমি সিম্লিফাইড করি টেক্সচারে, কালারে। ক্যামিকাল না ইউজ করে। ডাইভারসিফাইড জিনিস করি। এগুলোই আমার ইন্সপায়রেশন।
(আন্তর্জাতিক মডেল বিবি রাসেল)
প্রিয়.কম: আপনারা কয়েকজন ব্যাতিত বাংলাদেশের মেয়েরা এখনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে পারছে না কেনো বলে আপনি মনে করেন?
বিবি রাসেল: বছর মাত্র শুরু হয়েছে, এখনই বাইরে থেকে আমার অনেকগুলো ইনভাইটেশন চলে আসছে। আমি অনেকগুলোতেই যেতে পারবো না। তো আমি বলবো আমাদের দেশের ডিমান্ড আছে বাইরে। তাহলেও কেন তারা সেই পর্যায়ে যেতে পারছে না এটাতো আমারও প্রশ্ন। এগুলোতো আপনারাই ভাল জানবেন।
প্রিয়.কম: আপনার কাজের আলাদা বৈশিষ্ট কি?
বিবি রাসেল: আমার সব কিছু হাতে তৈরি। আমি বিদেশে মেশিন মেইড নিউ টোকনোলজিতে থাকি। কিন্তু হাতে তৈরি কাজ করি এটাই আমার বিশেষত্ব। কালার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে আমি পোশাকে লাল আর সবুজ দিবো না। বাংলাদেশি ফ্ল্যাগ আমাকে ইন্সপায়ার করে। কিন্তু ফ্ল্যাগ দিয়ে কাপড় বানাই না। এগুলোই আমার বৈশিষ্ট।
(ডেসপেরাডো চলচ্চিত্রখ্যাত নায়ক আন্তনিও বান্দেরাসের সঙ্গে বিবি)
প্রিয়.কম: দেশে অনেক দিন কোন ফ্যাশন শো করছেন না, কেন?
বিবি রাসেল: বাইরে আমি শো করি। দেশে করিনা কারণ দেশে আমার কোন স্পন্সর নাই তাই। বাইরে আমার সব কিছুতে স্পন্সর আসে। আমি মডেলিং থেকে আসা মেয়ে। তাই আমার মডেলদেরকে আমি ভাল পে করি।
প্রিয়.কম: আপনার কাজের মধ্যে কোন ধরনের কাজ করতে আপনার ভাল লাগে।
বিবি রাসেল: আমাকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে খাদি রিভাইব করার জন্য। খাদিতে আমি অনেক কালার আনি। প্রিন্ট আমি করিই না বলতে গেলে। আমি চেক আনি, স্ট্রাইপ আনি। চেক্সচার করি। এম্ব্রোডায়েরির মধ্যে আমি কাঁথা করি। একজন জিজাইনার হলেও পুরো ওয়ার্ল্ডে আমার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চুড়ি। আমি দেশের জন্য শাড়িতে কাজ করি। সেলোয়ারে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি না। আমার পছন্দ টিউনিক্স করি।
(বিবি’র আন্তর্জাতিক ফাশন শো)
প্রিয়.কম: বর্তমান বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির এই খারাপ অবস্থা কেন বলে আপনি মনে করেন?
বিবি রাসেল: এটা মন্ত্রণালয়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন। ইন্ডিয়া না হয় বর্ডার দিয়ে আসলো। লাস্ট দু বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানী পোশাক কেন আসলো বলেন। ফ্রান্সেতো তাদের কাপড় বাদ দিয়ে বলবে না যে বিবি রাসেলের কাপড় নাও। তাহলে বাংলাদেশ কেন বাইরের কাপড় নিচ্ছে বলেন। সব জায়গাতেই একটা ফাইট থাকে। এখানে কেন ইজিতে ঢুকছে পাকিস্তান, ইন্ডিয়া। এটা মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞেস না করে আমাকে কেন করছেন?
প্রিয়.কম: আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অবস্থান এখন কোথায়?
বিবি রাসেল: আমি অনেক পজেটিভ মেয়ে। বাংলাদেশ একদিন উঠবে। সেটার জন্য অনেকের কাজ করতে হবে। একা সম্ভব না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। অনেক কাজ করতে হবে সবাইকে। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে আমি শিখেছি, সেখানে তারা কি জানে বুঝতেই পারছেন। এর জন্য পেট্রোনাইজ দরকার। আমাদের যা আছে তা নিয়েই চিন্তা করতে হবে। রাজনৈতিক সমস্যা থাকবেই। এগুলো নিয়েই এগুতে হবে।
প্রিয়.কম: আপনিতো অনেক সম্মাননায় ভূষিত।
বিবি রাসেল: আমি ইউনেস্কোর দুটি পোর্টফোলিও হোল্ড করি। একটা হলো ডিজাইন ফর ডেভেলপমেন্ট গুডউইল অ্যাম্বসিডার আর একটা হলো আর্ট ফর পিস। আমি সারা দুনিয়ারই আর্টের দূত। এগুলো নিয়ে তো কেউ কথা বলে না। ইউনেস্কোর শপে যেখানে ওয়ার্ল্ড লিডাররা যেখানে যায়, সেখানে আমার জিনিস। ইন্ডিয়ানরা বলে আামদের কিছু নেই কেনো সেখানে। ব্রিটিশ আর্কাইভে আমার কাজ আছে। আমি পুরো ওয়ার্ল্ডেরই স্পোক পারসন এই সেক্টরকে উঠানোর জন্য। আমাকে উঠিয়েছে মিডিয়া। ছকমার্কা বকমার্কা সিরিয়ালের ডিজাইন আনলে আপনারা দেখতেন।
প্রিয়.কম: আপনি অনেকদিন ধরে ইন্ডিয়ায় কাজ করছেন।
বিবি রাসেল: হ্যাঁ, আমি ইন্ডিয়ার স্টেট গেস্ট। বাইরে আপনি যাই করেন তার একটা পজেটিভ রিভিউ হয়। এখানে সেটা নাই। আমি অনেক ভুল করি, একটা রঙের জায়গায় অন্য রঙ দিয়ে দেই। এখন আমি এক্সপার্ট হচ্ছি। এখানে দশটা চিন্তা করলে দুইটা করতে পারি। কিন্তু বাইরে দশটা চিন্তা করলে বিশটা করতে পারি, সঙ্গে রিসার্চও করে আসি। দেশে ভাল জিনিস হলে অবশ্যই করবো, থাকবো।
প্রিয়.কম: বাংলাদেশের তাঁতীদের নিয়ে আপনি অনেক দিন কাজ করছেন। তাদের পিছিয়ে থাকার কারণ?
বিবি রাসেল: তারা যদি মহাজনদের কাছ থেকে লিখিত ওর্ডার নিতো তাহলো তাঁতীদের কেউ ঠকাতে পারতো না। আমাদের টেক্সটাইল ডিজানার, ফ্যাশন ডিজাইনার লাগবে। এতগুলো ডিজাইনিং স্কুল থেকে যারা বের হচ্ছে তারা গার্মেন্টসে চলে যাচ্ছে। এরকম হলে কি হবে? আমরা নিজেদের সংস্কৃতি, বাংলাকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করেছি, দেখেন পৃথিবীর সব মিউজিয়ামে আছে বাংলার এক টুকরা কাপড় ‘মসলিন। আমাদের সাহিত্য সঙ্গীত জানতে হবে। ডাইভারসিভাইড করতে পারেন কিন্তু তার আগে আসল জিনিসটা সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের বেঙ্গলের কি আছে তা জানতে হবে। ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে হবে।
প্রিয়.কম: ফ্যাশন হাউজ করতে হলে কোন বিষয়গুলো ভাবা জরুরি।
বিবি রাসেল: একজন ডিজাইনারের দশটা দোকান থাকে না। একটাই থাকে। আমি কি জায়গায় জায়গায় গিয়ে দোকান দেবো। শপ ওনার ভিন্ন বিষয়, ডিজাইনার ভিন্ন বিষয়। ডিজাইনার আর গার্মেন্ট মেকার ভিন্ন বিষয়। সবাই আমাক জিজ্ঞেস করে আমার দোকান একটা কেন? দোকানে প্রোডাক্ট কম কেন? আরে আমি কি হাজার হাজার ডিজাইন করবো। আর দোকান খুলবো না, যেটা আছে সেটাও বন্ধ করে দেব। এখন কি মোবাইলের দোকান খুলবো? আমি কি এই জন্য এসেছি?
প্রিয়.কম: নতুন যারা এই সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
বিবি রাসেল: নতুন প্রজন্মরাই দেশের ভবিষ্যত। বেঙ্গল বলতেই আমাদের মসলিন, তাঁত, খাদিকে বলা হয়। বাইরের সব দেশেই চায় বাংলাদেশের নতুন ডিজাইনাররা আসুক। ডিজাইনার হতে হলে জানতে হবে, মানুষকে রেসপেক্ট করতে হবে। বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে যান, শুধু তাকান একটুখানি। নিজেদের বৈশিষ্ট নিয়ে থাকলেই শুধু হবে। তাহলেই ভাল করা যাবে। ফ্যাশনে পড়তে হলে ফ্যাশনের গ্রামার জানতে হবে।
প্রিয়.কম: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বিবি রাসেল: আপনাকে ও প্রিয়.কমকেও ধন্যবাদ।
- ট্যাগ:
- ফ্যাশন
- বিবি রাসেল