
ছবি সংগৃহীত
গার্মেন্টস শিল্পে চলমান সব সমস্যার সমাধান ইসলামে রয়েছে : নূরুল আমিন মাহ্দী
আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ০২:১৬
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী- চট্টগ্রামস্থ ফয়েজ লেক জামে মসজিদের সম্মানিত খতিব। একাধারে তিনি একজন আলেম, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, শিক্ষাবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং সুবক্তা। এমন আরো বেশকিছু অভিধায় নূরুল আমিন মাহ্দীর পরিচয় প্রদান করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ৬৮ হাজার বর্গমাইলের এই জমিনে যে ক’জন আলেম, দীনি খেদমত করার পাশাপাশি ব্যবসায় সফল হয়েছেন নূরুল আমিন মাহ্দী তাদের অন্যতম। ইমপ্রেস নিউটেক্স কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেড-এর একজন স্বনামধন্য পরিচালক তিনি। এছাড়া একজন প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা হিসেবে সম্পৃক্ত রয়েছেন চট্টগ্রাম সিতাকুন্ডস্থ মদীনাতুল উলূম মাদরাসার সঙ্গেও।
পিতা মরহুম আবদুল হাদী এবং মাতা মরহুম জিনাত নূরের সন্তান জনাব মাহ্দীর জন্ম ১৯৫৬ সালে সন্দ্বীপ উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। লেখাপড়ার হাতেখড়ি এবং প্রাথমিক সময় কেটেছে সন্দ্বীপেই। মাদরাসা ও জেনারেল- উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত একজন এই বিদগ্ধ আলেমে দীন আগাগোড়া একজন সমাজসেবী ও আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ মানুষ। সন্দ্বীপ ইসলামি সমাজ কল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য কল্যাণকর বিভিন্ন কাজ করছেন তিনি। পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নিরাপদ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাপনামূলক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন।
ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সাথেও কিছুটা জড়িত ছিলেন নূরুল আমিন মাহ্দী। বিভিন্ন মাসিক, পাক্ষিক ও দৈনিক পত্রিকা-ম্যাগাজিনের লিখেছেনও সিদ্ধহস্তে। দেশ ভ্রমণ করা জনাব মাহ্দীর একটি বিশেষ শখ- ব্যবসায়িক কাজ ও ব্যক্তিগত শখ পূরণের ডানায় ভর করে ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপ, ফিলিপাইন, থাইল্যাণ্ড ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ।
বিজিএমই-এর রিলেজিয়াস অ্যাফেয়ার্সের সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দীর এই সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা, গার্মেন্টস ব্যবসার নানা কথকতা এবং ইমপ্রেস নিউটেক্স কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের চমৎকার দীনি নানা আয়োজনসহ গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্টির অনেক তথ্য। প্রিয়.কমের পক্ষ থেকে তার মূল্যবান সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ মাওলানা মিরাজ রহমান ও কন্টেন্ট রাইটার মাওলানা মনযূরুল হক।প্রিয়.কম : আপনি লেখাপড়া করেছেন কোথায় কোথায়? এবং কী কী পড়েছেন ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আমি আমার এলাকায় সন্দ্বীপেই পড়ালেখার বেশিরভাগ শেষ করেছি। সন্দ্বীপের সন্তোষপুরে মেশকাত পর্যন্ত পড়ার পরে আমি আলিয়া মাদরাসায় চলে আসি। এবং রায়পুর আলিয়া থেকে কামিল পাশ করি। এছাড়া ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স কমপ্লিট করি।
প্রিয়.কম : আপনি একজন আলেম হয়েও এতো বড় একটা ব্যবসায় জড়িত হলেন, এর প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আমি দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলাম। সেখানে দেখেছি, সৌদির যারা বড় বড় ব্যবসায়ী তারা অধিকাংশ দীনদার। অনেক বড় বড় আলেম-উলামারা অনেক বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হোল্ড করেন। আমি দেখেছি, তারা ব্যবসাও করতেন আবার দীনের কাজও করতেন। আমি তাদের মধ্যে লক্ষ্য করেছি, সমাজসেবা করার ক্ষেত্রে অর্থাৎ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করার ক্ষেত্রে তারা বেশ আগ্রহী। বাংলাদেশে লেখাপড়া করার সময় ব্যবসা করবো এই ধরনের কোনো চিন্তা-ভাবনা যদিও আমার মাঝে ছিলো না। তবে সন্দ্বীপ বা রায়পুর যখন লেখাপড়া করেছি তখন থেকেই আমার মধ্যে ভিন্ন কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিলো।
সৌদিতে আমি যদিও চাকরি করার জন্যই গিয়েছিলাম তবে তারা আমার আচার-ব্যবহার দেখে আমাকে তাদের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। আমি ভাবতাম, আমি যদি শুধু চাকরিই করতে থাকি, তাহলে হয়তো আমার পরিবারটা আমি চালাতে পারবো ঠিক, কিন্তু আর কাউকে কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবো না। অথচ একটি সহিহ হাদিসে এসেছে, সেই- সর্বোত্তম মানুষ, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। এই হাদিস এবং সৌদি আলেম ও দীনদার মুসলিমদের খেদমতে খালকের নিয়তে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হওয়ার বিষয়গুলো আমার একজন দীনদার ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা যুগিয়েছে। প্রিয়.কম : আপনি গার্মেন্টস সেক্টরের ব্যবসা বেছে নিলেন কেনো ? অন্য ব্যবসাও তো করতে পারতেন?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এই বিষয়টি আসলে আমার ইচ্ছকৃত হয়নি। এই সেক্টরে আমার বন্ধু ও অাত্মীয়রা ছিলো এবং তারা বেশ ভালো অবস্থানেই ছিলো। এই সুবাদে তারাই আমাকে বললেন, দীনের খেদমতের পাশাপাশি তুমি যদি গার্মেন্টস সেক্টরে কিছু করো এবং ভালোভাবে করতে পারো, তাহলে আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে ভালো একটা অবস্থান তুমি গড়তে পারবে। তখন আমাদের কর্ণফুলি ফেব্রিক্স লিমিটেড নামে একটা গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের সরকারী অনুমোদন নেয়া ছিলো। আমরা সমমনা কয়েকজন মিলে সেখানেই মাত্র ৩৫টি মেশিন দিয়ে যাত্রা শুরু করি। সেটা ১৯৮৮-৮৯ সালের কথা, সে সময়টা ছিলো গার্মেন্টেস সেক্টরের সোনালী যুগ। আমাদের দেশ থেকে তখন শুধু সেলাই করে পাঠালেই ইউরোপিয়ানরা লুফে নিতো। এখন আমাদের যে কাজের বিনিময়ে ৫ ডলার দিতে চায় না, তখন আমাদের সেই কাজের বিনিময়ে ২৫ ডলার দিতো। যা হোক, এইভাবেই আমাদের শুরু। এরপরে গার্মেন্টস থেকে গেলাম টেক্সটাইলে। টাঙ্গাইলে আমরা একটা বড় কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল করি। সেখানে দেখলাম, আমাদের প্রতি মাসে ৩০ লাখ পিস কাপড়ের অর্ডার দরকার। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় এক লাখের উপরে। আমাদের নিউটেক্স গ্রুপের একার পক্ষে ৩ মিলিয়ন পিস মাসিক অর্ডারের মার্কেটিং এবং অপারেশন করার সামর্থ ছিলো না। যোগ্য বিশ্বস্ত অংশীদার খুঁজতে গিয়ে আল্লাহর অসীম রহমতে আমরা পেয়ে গেলাম, দেশের শীর্ষস্থানীয় মিডিয়া এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস গ্রুপকে। যার ক্ষ্যাতি আন্তর্জজাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর নেতৃত্বে আছেন অত্যন্ত আল্লাহভীরু সৎ যোগ্য ব্যক্তিত্ব জনাব আলহাজ রিয়াজ আহমেদ খান। নিউটেক্স থেকে হয়ে গেল ইমপ্রেস নিউটেক্স কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেড। রিয়াজ আহমেদ খান সাহেব আমাদের সম্মানিত চেয়ারম্যান এবং সিইও। তিনি এবং তার একটি দক্ষ টিম নিয়ে শুরু হলো আমাদের নতুন অগ্রযাত্রা। যে ফ্যাক্টরির প্রতিদিনের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিলো ২০-২৫ হাজার পিস, তা এখন এক লাখের উপরে এবং যে টেক্সটাইলের দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিলো ১০-১২ টন কাপড়, তা এখন ২৫ টনে উন্নিত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ এরপর আর আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এভাবেই পথ চলতে চলতে আল্লাহর রহমতে আজ এখানে।
প্রিয়.কম : ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যবসায়ী সম্পর্কে ইসলাম কী বলে এবং এই প্রেক্ষিতে আপনাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আলহামদুল্লিাহ নিয়মিতভাবে আমরা আমাদের কর্মীদের সাথে ব্যবসা সম্পর্কে ইসলাম কী বলে, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। বলি, তাদের উপর আমাদের হক কী এবং আমাদের ওপর তাদের হক কী। সবার মাঝেই সচেতনতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে আমরা এসব নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে থাকি। আমরা বিভিন্ন সহিহ হাদিস নিয়ে আলোচনা করি। যেমন- হালাল রিজিক হচ্ছে সর্বোত্তম রিজিক। আরো একটি হাদিসে আছে, হালাল পথে উপার্জনের জন্য শরীর থেকে ঘাম ঝরানোকে আল্লাহ পছন্দ করেন। ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে আছে, সৎ ব্যবসায়ীরা কিয়ামতের দিন নবী ও সত্যবাদিদের সাথে থাকবে। ব্যবসায়ীদেরকে আল্লাহ এতো মর্যাদা দিয়েছেন। কেননা, এখানে ঈমানের পরীক্ষা রয়েছে। আমাদের যারা কাপড় তৈরি করতে অর্ডার দিয়েছেন, আমরা তো তাদের নিম্মমানের কাপড় তৈরি করে দিয়ে দিতে পারি। যদি তা-ই করি, তাহলে কী নবীজির [সা.] হাদিসের এই মর্যাদা পাওয়া যাবে? এক হাদিসে আছে, কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। এই হাদিসগুলো যার মনে আছে, সে কখনো খেয়ানত করতে পারে না এবং শ্রমিকদের সাথেও অন্যায় করতে পারে না। এক হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি ক্ষমতার অপব্যবহার করলো, সে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
এই সব হাদিস নিয়ে আমরা আমাদের শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করি। এই প্রতিষ্ঠানে আমার একটা আলাদা অবস্থান আছে। আমি যদি ইসলামের কোন একটা বিষয়ে কথা বলি তাহলে প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত পরিচালকবৃন্দসহ অন্যান্য ব্যক্তিরা আমার কথাকে গুরুত্ব সহকারে নেন এবং সেটা তারা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। তবু কিছু প্রতিকূলতা তো থাকেই।
প্রিয়.কম : আপনার পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কতটা ইসলামের নির্দেশনা মান্য করা হয় ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আমরা তো যথাসম্ভব চেষ্টা করি। টাঙ্গাইলের কারখানায় আমাদের ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করে। আমরা সেখানে জোহরের নামাজের সময় তিনটা গ্রুপ করে দুপুরের খাবার ও নামাজের সময় দেই। যাতে করে সবাই নামাজ পড়তে পারে। সেখানে তিনটা আলাদা আলাদা জামাত হয়। কাউকে নামাজ পড়তে তো বাধ্য করতে পারি না। তবে এইটুকু বলা আছে যে, নামাজ চলাকালীন কেউ কাজ করতে পারবে না। এটা ছাড়াও প্রতি বছর আমরা কয়েকটা বিশেষ বিশেষ দীনি অনুষ্ঠান করে থাকি। এতে মূলত আলোচনা হয়, কাজের ক্ষেত্রে তাদের হক কী এবং তাদের ওপর আমাদের হক কী- এইসব বিষয় নিয়ে। আমরা বলি, দেখুন শুধু দুনিয়া উপার্জন করাই তো মানুষ হিসেবে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য না। আমাদের আখিরাতও উপার্জন করতে হবে।
এভাবে আমরা আমাদের অফিস-কারখানায় এবং ব্যবসা পরিচালনার প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইসলামি দিক-নির্দেশনা ও অনুশাসন মেনে চলার চেষ্ঠা করি এবং আমাদের ম্যানেজমেন্ট এ ব্যাপারে আন্তরিক। এছাড়া আমরা এমন একটা কাজের সাথে জড়িত হয়েছি, যার আর্থিক লেনদেনও সুদ ভিত্তিক না। আমরা ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে থাকি। একেবারে ১০০ ভাগ শরীয়ত মতো চলা এবং প্রতিষ্ঠান চালানো তো খুবই কঠিন। তার পরেও আমরা চেষ্টা করি।প্রিয়.কম : আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের ধারণা তো হচ্ছে এই যে, যারা মাদরাসায় লেখাপড়া করেছে তারা শুধু মাদরাসা আর মসজিদের মাঝেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে। তো আপনি ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার বিষয়টা আপনার পরিবার কিভাবে গ্রহণ করেছে?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আসলে ছাত্রজীবন থেকেই আমার মধ্যে এক প্রকার স্বাধীনতা কাজ করতো। পরিবারে আমার আট ভায়ের মধ্যে আমি হলাম পঞ্চম। এ ছাড়া আমি মাদরাসায় পড়ি। তবুও তাদের সবার কাছে আমার আলাদা একটা মর্যাদা ছিলো। আমি কী বলি বা কী করি, সে ব্যাপারে তাদের একটা আলাদা দৃষ্টি ছিলো। সুতরাং আমার কাজ নিয়ে দ্বিমতের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে নি। বরং সবার একটা বিশ্বাস ছিলো যে, আমি ভুল পথে পা বাড়াবো না। আমি বলবো, আমার ওপর আসলে আল্লাহর রহমত ও আমার মরহুম আব্বা-আম্মা এবং মানুষের দোআ ছিলো।
প্রিয়.কম : সমাজ, শিক্ষকমণ্ডলি বা আপনার বন্ধুমহলের পক্ষ থেকে কোনো বাধা বা কোনো ধরনের আপত্তিকর মন্তব্যের মুখে পড়েছেন কি না?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : হ্যাঁ, আমার অনেক বন্ধু মনে করেছিলো- ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে একসময় আমি পঞ্জাবি-পায়জামা তথা সুন্নাতি লেবাস ছেড়ে দিয়ে টি-শার্ট পরবো, প্যান্ট পরবো। আমার মুখে দাঁড়ি থাকবে না। তখন বেশির ভাগ লোকদের এমন ধারণা ছিলো। আগেরকার আলেমরা তো কেউ কেউ কিছুটা কট্টর ছিলেন। কওমি মাদরাসা থেকে কেউ আলিয়ায় গেলে মনে করা হতো সে গোমরা হয়ে গেছে। হজরত আল্লামা ইদরিস সন্দ্বীপি রহ. আমার উস্তাদ। হজরত অনেক বড় মনের আল্লাহর অলী ছিলেন, তাই তিনি আমাকে বুঝতে পেরেছিলেন। হজরতের কাছে আর কেউ ব্যবসা করার অনুমতি চাইলে তাদেরকে তিনি সরাসরি অনুমতি দিতেন না। আমাকে কিন্তু তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে অনুমতি দিয়েছিলেন এবং হজরত নিজে দোআ করে আমার অফিস উদ্বোধন করেছিলেন।
যারা সেদিন আমার পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন আলহামদুলিল্লাহ, এখন আমি তাদের জন্য কিছু করতে পারছি। অনেকেই আজ স্বীকার করে বলেন যে, আপনি ব্যবসার পথে এসেছেন বলেই দীনের এতো খেদমত করতে পারছেন। অনেকে আমাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাদরাসার সমস্যার কথা জানায়, আমিও আমার সাধ্য মতো তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। প্রতি রমজানে আমার বাড়িতে আমি তিন/চারশ’ আলেম নিয়ে একটি ইফতারি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি। সেখানে হাটহাজারি, পটিয়া, জিরি, উজানি মাদরাসাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন মাদরাসার উলামা হজরত অংশ গ্রহণ করেন এবং সাধ্য মতো তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু করার চেষ্টা করা হয়।
প্রিয়.কম : গার্মেন্টস সেক্টর হলো বাংলাদেশের সবচেয় বড় রপ্তানি খাত। অথচ আমাদের দেশের আলেমদের এই সেক্টরে তেমন দেখাই যায় না। এর কারণ নী বলে আপনার মনে হয় ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আগে তো একেবারেই ছিলেন না। এখন এই সেক্টরেও কিছু আলেমকে দেখা যায়। আমি বিজিএমইএ-এর রিলেজিয়াস অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান ছিলাম কয়েক বছর। আমার ধারণা ছিলো গার্মেন্টস সেক্টরে হয়তো আলেম-ওলামা তেমন নেই। কিন্তু বিজিএমইএ-এর প্রোগ্রাম যখন করতাম তখন অনেক আলেমদের দেখতাম। কিন্তু তাদেরকে কেউ চেনে না। কেননা, তারা নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখেন। তবে হ্যাঁ, বিষয়টি এমন না যে, এই ক্ষেত্রে বড় বড় অলেমরা আছেন। এটা ঠিক যে, এই ক্ষেত্রে বা ব্যবসা সেক্টরে আসার কারণে আমার জন্য দীনের সঠিক কথা বলা যতটা সহজ হয়েছে, আর কারো জন্য কিন্তু বিষয়টা ততটা সহজ না। এটাকেই আমি আমার নিজের জন্য বড় পাওয়া মনে করি।প্রিয়.কম : গার্মেন্টস সেক্টরে নারী পুরুষের সহ-কর্মস্থানের কারণে তো পর্দার বিধান চরমভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে। আবার অনেক নারী গার্মেন্টসকর্মীর কাছে এই কাজটা এমন যে, না করলে তার হয়তো না খেয়ে থাকতে হবে। তো এই ক্ষেত্রে তার এই চাকরি করা উত্তম নাকি চাকরি না করে পর্দার বিধান পালন করা উত্তম?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : প্রয়োজনের কারণে অনেক সময় অনেক বিষয়ে কিছুটা ছাড় দিয়ে চলতে হয়। একজন সরাসরি অবৈধ কাজ করছে আর একজন কিছু ক্রুটি-বিচ্যুতিসহ পরিবারের জন্য হালাল অর্থ উপার্জন করে পরিবার চালাচ্ছে, কোনটা উত্তম ? আমাদের এখানে যারা কাজ করছে, তারা যে অর্থ উপার্জন করছে তা তারা কোন পথে খরচ করছে, আমরা তা পর্যবেক্ষণ করি। খবর নিয়ে দেখি, তার যদি মা থাকে, তবে সে মায়ের খবর নিচ্ছে কি না। আমার অভিমত হলো, একটি বড় লক্ষ অর্জনের জন্য ছোট কোনো বিষয়কে পাশ কাটানো যেতে পারে। বৃহত্তম স্বার্থ অর্জনের জন্য ক্ষুদ্রতম স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া আরকি।
প্রিয়.কম : আপনাদের গার্মেন্টসেও তো প্রচুর নারী কর্মী কাজ করেন। আপনারা এ বিষয়টাকে কীভাবে ম্যানেজ করেন ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : হ্যাঁ, শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানের নয়, আমাদের এই সেক্টরে ৯৫ ভাগই হচ্ছে নারীকর্মী। তবে সাথে সাথে লাইনম্যান, সুপারভাইজারসহ অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ আছে। প্রশ্ন হতে পারে যে, তাহলে এই ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ ইসলাম কীভাবে পালন সম্ভব? আসলে প্রয়োজনের কারণে শরীয়তের মাসয়ালা-মাসায়েল অনেক শিথিল হয়ে যায়। এই মেয়েটার হয়তো জীবনের প্রয়োজনে কাজ করতে হচ্ছে। চিন্তা করতে হবে এখানে এই মেয়েটার কর্মসংস্থান না হলে- সে তো অন্য কোনো হারাম পথে উপার্জন করতে গিয়ে অন্ধকার গলিতে হারিয়েও যেতে পারতো। পর্দার কিছুটা শিথিলতা করে তার হালাল উপার্জনের একটা পথ সৃষ্টি করাকে আমরা মনে করি এই সেক্টরের একটি বিশাল সাফল্য। তবে আমাদের দেখানো পথ অনুযায়ী তারা বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ছে, আবার মা-বাবার খেদমত করছে। এইসবের পরেও যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করি তারা যেনো হিজাব পড়ে কাজে আসে। প্রত্যেক ফ্লোরে আমরা মেয়েদের জন্য আলাদা করে পর্দার সাথে নামাজের ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া আমরা প্রত্যেক বছর আমাদের শ্রমিকদের মধ্য থেকে দু-একজনকে হজে পাঠিয়ে থাকি। ঈদে-কোরবানিতে গার্মেন্টস সেক্টরে সরকারি ছুটি হলো তিনদিন, অথচ আমরা সে সময় তাদের অন্তত পাঁচ দিন ছুটি দিয়ে থাকি, আবার মাঝেমধ্যে দশ দিনও দেই।
প্রিয়.কম : গার্মেন্টস ব্যবসার তো অনেকগুলো দিক আছে, যেমন- কেউ সোয়েটার বা শীতের পোশাক বানায়, আবার কেউ গেঞ্জি তৈরি করে, কেউ বানায় পাঞ্জাবি। আপনার প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের প্রডাক্ট উৎপাদন বা বিপনন করা হয় ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : গার্মেন্টস বলতে মানুষ মনে করে, এখানে শুধু কাপড় তৈরি হয়। আসলে তা-না। গার্মেন্টস মূলত তিন ধরনের হয়। একটা হলো শীতের কাপড় বা সোয়েটার তৈরির গার্মেন্টস। দ্বিতীয় হলো, যেখানে শার্ট তৈরি করা হয়। যেটাকে ওবেন বলা হয়। আর একটা হলো যেখানে টি-শার্ট, বড় গেঞ্জি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এটাকে বলা হয়, নিট। এই সেক্টরটাই বেশি বড়। এই সেক্টরের ৯৫ ভাগ জিনিস আমাদের দেশে পাওয়া যায়। আর ৫ ভাগ জিনিস বাহির থেকে আনতে হয়। আর ওবেন যেটা, তার প্রায় ৮৮ ভাগ জিনিস আনতে হয় বাহির থেকে। আমাদেরটা হলো, নিট। আমরা বাহির থেকে শুধু সুতাটা কিনে থাকি। তাছাড়া সবই আমাদের নিজস্ব। প্রিয়.কম : গার্মেন্টস সেক্টরে কেউ যদি হারাম প্রডাক্ট তৈরি করে বাহিরে রপ্তানি করে, তাহলে তার ব্যবসা কি হালাল হবে?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আপনি এই সেক্টরে এমন একটা প্রডাক্ট বা পোশাক দেখান যেটা হারাম? আমরা এখানে কখনো কখনো মেয়েদের অর্ন্তবাসও তৈরি করি। আচ্ছা বলুন, এই পোশাকটা তৈরি করা কি হারাম? আমরা তো তৈরি করি যে, এটা সে অর্ন্তবাস হিসাবে ব্যবহার করবে। কিন্তু কেউ যদি শুধু অর্ন্তবাসই পরে, আর কিছু না পরে, তাহলে কি এ দায় আমাদের? আমরা মেয়েদের গেঞ্জিও তৈরি করি। এখন আমরা তো এই জন্য তৈরি করি না যে, সে শুধু গেঞ্জি পরবে। এই গেঞ্জি তৈরি করাকে আপনি হারাম বলতে পারবেন? অনেকে তো গেঞ্জি পরে তার উপর কাপড়ও পরছে। কিন্তু কেউ কেউ শুধু গেঞ্জি পরছে। এর জন্য কি এটা তৈরি করাকে হারাম বলা যাবে? একটা মৌলিক কথা হলো- পণ্য বা পোশাক হারাম হয় ব্যবহারের কারণে, উৎপাদনকরণের কারণে নয়।
প্রিয়.কম : কোনো প্রডাক্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে আপনাদের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি দুর্নীতি করে, তাহলে বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এসব ক্ষেত্রে আমাদের কোম্পানিতে আমরা কুরআন-হাদিসকে সামনে রেখে চলার চেষ্টা করি। প্রথম কথা হলো, আপনার ভেতরে আল্লাহর ভয় থাকতে হবে। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আজকাল গার্মেন্টস সেক্টরে দুর্নীতি করার সুযোগই তেমন একটা নেই বললেই চলে। আমরা মাল তৈরি করার পরে এখান থেকে নেয়ার সময় ক্লায়েন্ট বা বায়ার আমাদের মাল পরীক্ষা করে নেয়। যদি মাল তাদের চাহিদা মতো না হয়, তাহলে তো তারা আমাদের মাল গ্রহণ করবে না। কিংবা ধরুন, তারা এখানে পরীক্ষা করে ত্রুটি ধরতে পারে নি, কিন্তু মালটা তাদের দেশে চলে যাওয়ার পরে ত্রুটি ধরা পরেছে, তাহলেও তারা আমাদের মাল ফ��রিয়ে দেবে। এ জন্যেই আমাদের খুব সর্তকতার সাথে কাজ করতে হয় এবং এই বিষয়গুলো আমাদের সব কর্মীরা ভালোভাবেই জানে সুতরাং কেউ দূর্নীতি করা মানে নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দেওয়া।
প্রিয়.কম : অন্য ক্ষেত্রেও তো দুর্নীতি হতে পারে? যেমন- শ্রমিকদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তরা দুর্নীতি করলো?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : হ্যাঁ, বলছি...। এই গেলো, যাদের থেকে আমরা অর্ডার নিয়েছি তাদের বিষয়। আর শ্রমিকদের বিষয় হচ্ছে, আমরা কখনো চাইবো না যে, আমাদের কোনো শ্রমিক আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে চলে যাক। আজকাল তো গার্মেন্টসের জন্যে লোক পাওয়া খুবই কঠিন। অনেক গার্মেন্টস হয়েছে। তাই কর্মীদের চাহিদা বেশি। তাই তাদের সাথে আমাদের ভালো সর্ম্পক রাখতেই হয়। তাছাড়া এই ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও নিয়ম আছে যে শ্রমিকদের বেতন মাসের ৫ থেকে ১০ তারিখের মাঝে পরিশোধ করতে হবে। আমরা আলহামদুলিল্লাহ, ৫ তারিখের মাঝে বেতন দিয়ে থাকি। কখনো ৫ তারিখ পার হয় না। সঠিক সময় কর্মচারীদের বেতন এবং ওভারটাইম পরিশোধ করা আমাদের প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যে পরিণত হযেছে। কোম্পানি লাভ করুক বা লস করুক আমাদের এর ব্যতিক্রম হয় না।
প্রিয়.কম : আপনাদের ব্যবসার প্রসেসটা সম্পর্কে যদি আমাদেরকে একটু জানাতেন। অর্থাৎ যদি কোনো নতুন উদ্যোক্তা এই গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত হতে চায়, তাহলে সে কীভাবে অগ্রসর হবে ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এই সেক্টরে নতুন উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করা অনেক কঠিন। কেউ যদি মনে করে আমার কাছে অঢেল টাকা আছে, আমি সেই টাকা দিয়ে গার্মেন্টস সেক্টরে উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করবো- সেটা ভাবাটা খুবই কঠিন হবে। এখানে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন অনেক বেশি। যারা অনেক কিছু হারিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে কাজ করে, তারা কিছু করতে পারবে। অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু কাগজ কলমের হিসাব দিয়ে এই ক্ষেত্রে কাজ করা সম্ভব নয়। এরপরেও যদি কেউ করতে চায়, তাহলে তার সাথে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ পার্টনার রাখতে হবে। ১৯৮৮-৮৯ সালে আমরা যখন নিউটেক্স গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করি তখন আমাদের মাঝে এমন পার্টনারও ছিলেন যার কোনো ক্যাশ-ইনভেস্টমেন্ট ছিলো না। কর্মদক্ষতা আর অভিজ্ঞতার কারণে এখন তিনি প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় পদে অধিষ্ঠিত সুতরাং অভিজ্ঞ লোক একজন সাথে লাগবেই। শুধু টাকা দিয়ে এই ব্যবসা হবে না। আর যারা দীনি পরিমণ্ডলে থাকতে অভ্যস্ত, তাদের জন্য তো আরো কঠিন। কেননা, তারা অল্পতেই মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলেন। প্রিয়.কম : গার্মেন্টস-ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে আমরা নানা ধরনের বৈষম্যের কথা শুনি। একজন জিএম বা সুপারভাইজারের বেতন যেখানে হয় কয়েক লাখ টাকা, সেখানে একজন সাধারণ শ্রমিকের বেতনের পরিমাণ হয় এতো কম যে, তার থাকা-খাওয়ার জোগাড়টুকুও সম্ভব হয় না। আমাদের প্রশ্ন হলো, একজন শ্রমিক যদি দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে, তাহলে সে ন্যূনতম কী পরিমাণে মজুরি পেতে পারে বলে আপনার অভিমত? কিংবা এ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে ? এসব ক্ষেত্রে আপনার প্রতিষ্ঠানে আপনি কোন নীতি অবলম্বন করে থাকেন?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এটা খুবই আপেক্ষিক বিষয়। আপনি মাদরাসার ক্ষেত্রে দেখেন, একজন খাদেম, যে মাদরাসার সব কাজ করে, রান্না করে, পরিস্কার পরচ্ছিন্নতার কাজ থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজই করে থাকে। তার পরেও তার বেতন হচ্ছে মাত্র ৫-৬ হাজার টাকা। একজন প্রিন্সিপাল, তিনি এসি রুমে বসে বসে বেতন নিচ্ছেন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এটা কি বৈষম্য নয়? সুতরাং একজন সুপারভাইজার, যার দেখাশোনার উপরই আমার উৎপাদিত পণ্যের মান নির্ভর করে। তাকে তো একটু বেশি বেতন দিতেই হবে। আর গার্মেন্টস সেক্টরই একমাত্র কর্মক্ষেত্র, যেখানে অভিজ্ঞতা ছাড়াই লোক নিয়োগ হয়। এছাড়া অন্য কোনো কর্মক্ষেত্রে আপনি এমনটা পাবেন না। এমনকি চায়ের দোকানদারও লোক রাখার সময় অভিজ্ঞ লোক খোঁজে।
প্রিয়.কম : বিভিন্ন গার্মেন্টসগুলোতে শ্রমিকদের বেতন নিয়ে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, তার কারণ কী ? এই সমস্যার সমাধান কল্পে কী করণীয় বলে আপনি মনে করেন?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : মূলকথা হলো, মানুষের মাঝে যে তাকওয়া থাকার প্রয়োজন ছিলো তা নেই। মানুষ আল্লাহকে ভয় করে না। আল্লাহর ভয় না থাকার কারণেই এই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে। সমাজিক মূল্যবোধ এটাও অনেক মালিকের মাঝে নেই। যার কারণে তারা শুধু নিজেদের লাভের হিসাব করে এবং নিজেদের লাভ আরো কিসে বেশি হবে সেই চিন্তা করে। শ্রমিকদের কথা বাদ দিয়ে মালিক পক্ষ যখন শুধু নিজেদের চিন্তা করবে তখন এমন সমস্যা হবেই। শুধু বেতন-ভাতাকেন্দ্রিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়, গার্মেন্টস শিল্পে চলমান প্রায় সব সমস্যার সমাধান ইসলামের আলোকে সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা তো আল্লাহর দ্বীনকে শুধুমাত্র জায়নামাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি।
প্রিয়.কম : একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের সাথে মালিকের সর্ম্পকটা কেমন হওয়া প্রয়োজন মনে করেন?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এটাতো আল্লাহর রাসূলই [সা.] নির্ধারণ করে দিয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ক হাদিসগুলো আমি সবসময় কাছেই রাখি, মনে রাখি। হাদিসে এসেছে, যেই পরিমাণ তুমি তোমার অধীনস্ত কর্মচারীদের কাজকে হালকা করেদেবে সেই পরিমাণ তোমার মিজানের পাল্লা ভারি করে দেওয়া হবে। সুতরাং তুমি তোমার সন্তানদের যেভাবে সম্মান করো তাদেরকে সেই ভাবে সম্মান করো। এই হাদিস সামনে থাকলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। আমরা যখন কারখানার ভেতরে যাই, তখন মেয়েদেরকে আমরা ‘মা’ ছাড়া কথা বলি না। কাউকে কিছু বলতে হলে ‘মা’ বলে ডেকে তারপরই বলি। আমাদের পরিবারে যারা কাজ করে তারা যখন হাসে, তখন আমরা সত্যিকারের আত্মতৃপ্তি পাই এবং আল্লাহও খুশী হন। প্রিয়.কম : একজন আলেম ব্যবসায়ী হিসেবে আপনার সন্তানদের বিষয়ে আপনি কী ভাবেন? তারা কি আপনার মতো আলেম ব্যবসায়ী হবে? নাকি অন্য কোনো পথে থাকবে?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এটা তো সন্তানদের নিজস্ব বিষয় যে, তারা কোথায় যাবে, কী করবে। আমাদের মূল কাজ হলো- তাদের ব্যবসা শেখানো না বরং দীন শেখানো। এই দীন যদি শিক্ষা দেয়া যায়, তাহলে তারা যদি ব্যবসা করে, সেখানেও দীন থাকবে, কিংবা তারা যদি চাকরি করে, সেখানেও দীন থাকবে।
প্রিয়.কম : আমরা ইসলামের ইতিহাসে সাহাবিদের যুগ থেকে পরবর্তী সব যুগে দেখি, ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতরা আলেম হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, চিকিৎসাবিদ, ইতিহাসবিদ এবং ব্যবসায়ীও ছিলেন। এভাবে নানান সেক্টরে অভিজ্ঞ লোক তৈরি করা হতো। কিন্তু এখন আমরা ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে তেমনটা তৈরি হতে দেখি না। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এটা অনেকটা আমাদের শিক্ষারই দোষ। এক সময় তো আমাদের মাদরাসাতে পত্রিকা পড়া হারাম ছিলো। ফলে এখান থেকে যারা তৈরি হয় তাদের ধ্যান-ধারণা এমন করেই তৈরি করা হয় যে, মাদরাসার একজন শিক্ষার্থীর মূল কর্মক্ষেত্রই হচ্ছে মাদরাসা আর মসজিদ। এই পরিস্থিতিতে একজন ছাত্র যতই প্রতিভাবান হোক না কেনো, সে হারিয়ে যায়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের সংকুচিত করে রেখেছে বলেই, সবক্ষেত্রে আলেমদের পদচারণা দেখা যায় না। এই ক্ষেত্রগুলোতে আলেমদের পদচারণা থাকলে দীনের অনেক উপকার হতো। এখন অবশ্য পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে।
প্রিয়.কম : আমাদের নবী [সা.]-এর ব্যবসায়িক জীবন নিয়ে পাঠকের উদেশ্যে কিছু বলুন।
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আমাদের নবী [সা.] সরাসরি ব্যবসা তেমন একটা করেননি। কিন্তু একজন ব্যবসায়ী সম্পর্কে রাসূল [সা.]-এর এমন একটি উক্তি আছে, একজন ঘনিষ্ঠ সাহাবি সবসময় আল্লাহর নবীর দরবারে থাকতেন। কয়েকদিন তিনি অনুপস্থিত। নবী [সা.] খবর নিলেন কোথায় সে। বলা হলো, সে সিরিয়ায় গেছে মাল-পণ্য আনার জন্য। দেখা গেলো, সেই সাহাবি সিরিয়া থেকে মাল-পণ্য এনে তার কর্মচারীকে দিয়ে মাল-পণ্য বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর তিনি বাড়িতে না গিয়ে মসজিদে নববীতে নবী [সা.]-এর সাথে দেখা করতে এসেছেন। নবী [সা.] তাকে দেখে অনেক খুশি হলেন। এরপর এক পর্যায়ে যখন তিনি বললেন, আমার মাথায় মাল-পণ্য ছিলো এবং আমি কর্মচারীকে তা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। তখন নবী [সা.] বললেন, তোমার মাথায় যতক্ষণ মাল-পণ্য ছিলো, ততক্ষণ আমার দরবারে বসার চেয়ে আল্লাহর কাছে তোমার মর্যাদা বেশি ছিলো। কেননা, এই মাল-পণ্য বিক্রি করে তুমি তোমার পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেবে।
প্রিয়.কম : আমরা জানি ইলমে দীন যারা শিক্ষা দেন, তারা যেন শিক্ষার বিনিময়ে কোনো কিছু গ্রহণ না করেন। এখন অবশ্য এটাকে জায়েয বলা হয়েছে। তো আপনার দৃষ্টিতে একজন মাদরাসার শিক্ষকের আয় উত্তম না একজন ব্যবসায়ীর আয় উত্তম ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : সাধারণ দৃষ্টিতেই আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি। একজন মাদরাসার শিক্ষক বাধ্য হয়ে সেখান থেকে মজুরী-বিনিময় নিচ্ছেন। তাতে কোনো সাওয়াব নেই। তবে তিনি যে দীনের খেদমত করছেন, তার বিনিময় অবশ্যই আল্লাহ তাকে প্রদান করবেন। আর এই ব্যবসা সর্ম্পকে বলা হয়েছে যে, এটা তোমার জন্য শুধু ব্যবসা না ইবাদতও। এবং আমি ইচ্ছা করলে এটাকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু শিক্ষকতা বা ইমামতি করার মাঝে এমন ব্যাপার নেই। তবে কেউ হাদিয়া দিলে সেটা ভিন্ন কথা। তো একজনের হাদিয়া পেয়ে সম্পদশালী হওয়া আর নিজে কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে সম্পদের মালিক হওয়া কখনো এক কথা নয়।প্রিয়.কম : আমরা দেখে থাকি, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির পণ্যের বহুল বাজারজাতকরণের জন্যে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নারীদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নারীদের এমন অপব্যবহারের মাধ্যমে যে ব্যবসা পরিচালিত হয়, তা হালাল হবে কি না ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : নারীদেরকে এইভাবে ব্যবহার করা অবশ্যই হারাম। নারীরা ভেতরে কাজ করবে। এই ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ পর্দা করতে না পারলে সেটা ভিন্ন বিষয়। তখন অন্তত আল্লাহর কাছে জবাব দেয়ার একটা সুযোগ থাকবে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নারীকে অর্ধ উলঙ্গ বা বেপর্দা করা হলে তো আল্লাহর কাছে জবাব দেয়ার কোনো পথ থাকবে না। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের এখান থেকে যেই সব কাপড় যাচ্ছে, সেগুলো কিন্তু আমাদের ব্র্যান্ড না। আমাদের থেকে যারা কিনছে তাদের ব্র্যান্ড। তারা তাদের পণ্য প্রচারের জন্য কিভাবে অ্যাড তৈরি করবে, সেটা আমাদের দেখার বিষয় না এবং এর কোনো দায়ভার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের ওপর বর্তাবে না।
প্রিয়.কম : গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট ও ইমপোর্ট ব্যবসার ধরণ ও পথ-পদ্ধতির পরিচিতিমূলক কিছু কথা বলুন। একজন আলেম ও অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হিসেবে গার্মেন্টস পণ্য এক্সপোর্ট ও ইমপোর্টের ধরণ ও পথ-পদ্ধতিতে কোনো প্রকার ইসলাম পরিপন্থী বিষয় আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে কি না ?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এখানে দুইটা খাত আছে। একটা হচ্ছে ইমপোর্টের সাথে সরাসরি ব্যাংক জড়িত। ব্যাংকের মাধ্যমেই আমাদের ইমপোর্ট করতে হয়। শরীয়ত অনুযায়ী যারা ব্যবসা করে তারা ব্যাংক থেকে টাকা নেয় না বরং ব্যাংকই আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য বা ক্যাপিটাল মেশিনারীজ এনে দেয়। সেই টাকা পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত মেশিনটা আমাদের কাছে লোন বা ভাড়া হিসাবে থাকে। যখন টাকা পরিশোধ হয়ে যায় তখন আমাদের মেশিন আমাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। আর সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে বলতে হয়, আমার এতো টাকা লাগবে তখন ব্যাংকের লোকেরা বলে দেয় যে, এতো টাকায় এতো টাকা সুদ আসবে। সেভাবেই তাদের মেশিন আনতে হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের একটা স্বাধীনতা থাকে যে, আমরা কি হালাল পথে হাঁটবো না হারাম পথে?
আরেকটা হলো, এখানে ‘আনসিন মানি’ (অপ্রদর্শিত অর্থ)-এর একটা ব্যাপার আছে। ধরুন, যেই মালটা আমার কাস্টম থেকে রিলিজ করতে দশ হাজার টাকা লাগার কথা, কিন্তু আমরা যাদের মাধ্যমে সেটা আনাবো, তারা বলছে যে, এই কাজ ত্রিশ হাজারের কমে হবে না। আমরা যদি তাদের সে টাকাটা না দিয়ে নিজেরা যাই, তাহলে কাজটা কিছুতেই উদ্ধার করতে পারবো না। সুতরাং অপারগ হয়ে আমাদের টাকাটা দিয়ে দিতে হয়। আমরা ধরে নেই যে, এটাই আমাদের খরচ। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রেই আমরা পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ভারমুক্তভাবে কাজ করার চেষ্টা করি।
প্রিয়.কম : বৈধ ব্যবসা থেকে উপার্জিত হালাল অর্থ ইসলাম পরিপন্থী কোনো খাতে স্পন্সর বা সহযোগিতা হিসেবে ব্যয় করা যাবে কি না?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : আমি যদি মুমিন হয়ে থাকি কিংবা আমার মধ্যে যদি সমান্য ঈমান থেকে থাকে তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব? আমি আমার কষ্ট করে উপার্জিত অর্থ কেনো জেনে শুনে হারাম পথে ব্যয় করবো?
প্রিয়.কম : গার্মেন্টস সেক্টরে যারা বায়ার হন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা অমুসলিম। একজন মুসলিম হিসাবে অমুসলিমদের সাথে ব্যবসা করার বিষয়ে কোনো প্রকার বিধি নিষেধ আছে কিনা?
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : ব্যবসা তো যুগে যুগেই অমুসলিমদের সাথেই হয়ে এসেছে এবং সেখানে ধর্ম কোনো বাধা হয়নি। আমি ব্যবসা করছি, তো আমি আমার ব্যবসাটা কি হারামভাবে করছি, না হালালভাবে করছি- সেটাই হলো দেখার বিষয়। কার সাথে করছি, সেটা কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া আমরা যখন ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করছি, তখন অমুসলিমরা কিন্তু বলে না যে, আপনারা কেনো ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করছেন? ব্যবসা করার ক্ষেত্রে মানসিক উদারতা থাকা অতি জরুরি একটি বিষয়।
প্রিয়.কম : দীর্ঘসময় ধরে আমাদের সময় দেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
মাওলানা নূরুল আমিন মাহ্দী : এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্যে আপনাদেরকেও ধন্যবাদ এবং প্রিয়.কম পরিবারের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। ###
- ট্যাগ:
- ব্যবসা
- সাক্ষাৎকার
- ঢাকা