ছবি সংগৃহীত

কোরান-হাদিসের আলোকে মুসলিম নারীর পর্দা : প্রবন্ধ :- ০১ : পর্দার বিধান কি এবং কেন

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ২২ মে ২০১৪, ১৪:৪৮
আপডেট: ২২ মে ২০১৪, ১৪:৪৮

পর্দার বিধান কি এবং কেন পর্দা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। কোরান মজিদের কয়েকটি সূরায় পর্দা-সংক্রান্ত বিধান দেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে রয়েছে অসংখ্য হাদিসে রাসুল।পর্দার বিষয়ে আল্লাহ তাআলা সকল শ্রেণীর ঈমানদার নারী-পুরুষকে সম্বোধন করেছেন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেছেন তিনি যেন তাঁর স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে এবং মুমিনদের নারীদেরকে চাদর দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত রাখার আদেশ দেন। কিছু আয়াতে উম্মুল মুমিনীনদেরকেও সম্বোধন করেছেন, কোনো কোনো আয়াতে সাহাবায়ে কেরামকেও সম্বোধন করা হয়েছে। মোটকথা, কোরান মজিদ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য পর্দার বিধান বিবৃত হয়েছে। পর্দা ইসলামি শরিয়তের একটি ফরজ বিধান। এ বিধানের প্রতি সমর্পিত থাকা ঈমানের দাবি। মুসলমানিত্বের পরিচয়। কিন্তু বেদনার বিষয় এই যে, পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের ‘মুসলিম-সমাজ’ এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছে যে, কোরান ও সুন্নাহর বিধানও তাদের কাছে অপরিচিত ও অপ্রয়োজনীয় আকার ধারণ করছে। পর্দা বিধানটি আজ নানাবিদ ষড়যন্ত্র এবং নানাবিদ সমস্যা জর্জরিত। খোদ মুসলিমদের দ্বারাই লঙ্ঘিত আজ পর্দার প্রকৃত বিধান। এই সব মুসলমানদের কে বোঝাবে যে এটা নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের শামিল। ইসলামের এই বিধানটি শুধু আমাদের আখেরাতে নাজাতেরই উপায় নয়, আমাদের দুনিয়ার জীবনের শান্তি, স্বস্থি ও পবিত্রতারও রক্ষাকবচ। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও বিভিন্ন অপপ্রচারকারীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আমরা নিজেদের আর্দশ ত্যাগ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। ইসলামি শরিয়তের মাধ্যমে নারীরা অনেক বড় নিয়ামত, দয়া, সহানুভূতি ও উপকার লাভ করেছে। যেমন- ইসলাম নারীদের ইজ্জত সম্মান ও পুত-পবিত্রতা রক্ষা করেছে এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছে। ইসলাম নারীদের উচ্চ মর্যাদার আসন দিয়েছে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু নারীদের জন্য ইসলাম লেবাস-পোশাক, সৌন্দর্য প্রদর্শন ও চলাফেরা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে সব বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তা শুধু সামাজিক অনিষ্টতা ও ফেতনা ফ্যাসাদ থেকে বাঁ‍চার যাবতীয় উপায় উপকরণের পথকে বন্ধ করার নিমিত্তে এবং মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যেই করেছে। নারীদের প্রতি অবিচার কিংবা কোন প্রকার বৈষম্য সৃষ্টির জন্য করেনি। ইসলাম তাদের জন্য বিধি-নিষেধ আরোপ করে তাদের স্বাধীনতা হরণ করা কিংবা তাদের গৃহবন্দী করার জন্য করেনি বরং, তারা যাতে তাদের জীবনে চলার পথে চরম অবনতি ও অপমানের খপ্পরে না পড়ে এবং তারা যাতে মানুষের দৃষ্টির লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত না হয়, তা থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলাম এই বিধি-নিষেধ ও পর্দার বিধান প্রদান করেন। সবার আগে ভালো ভাবে জানতে হবে প্রকৃতরুপে পর্দা কাকে বলে? কেননা এছাড়া পর্দার উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা এবং তার উপকারিতা-অপকারিতা সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে হবে। পর্দা আরবি ‘হিজাব’ শব্দের বাংলা ও উর্দূ তরজমা। কোরান মজিদের যে আয়াতে মুসলমানদের আল্লাহ তাআলা রাসূলে করিম [সা.] -এর ঘরে নিঃসংকোচে ও বেপরোয়াভাবে যাতায়াত করতে নিষেধ করেছেন, তাতে এ ‘হিজাব’ শব্দই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন যে, যদি ঘরের স্ত্রীলোকদের নিকট থেকে তোমাদের কোন জিনিস নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা হিজাবের আড়াল থেকে চেয়ো।(সূরা আহযাব-৫৩) মূলত আল-কোরানের এ নির্দেশ থেকেই ইসলামি সমাজে পর্দার সূচনা হয়। অতপর এ প্রসংগে আর যত আয়াতই নাজিল হয়েছে, তার সমষ্টিকে আহকামে ‘হিজাব’ বা পর্দার বিধান বলা হয়েছে। পবিত্র কোরানের সূরায়ে নূর ও সূরায়ে আহযাবে এ সম্পর্কিত নির্দেশাবলী বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। এ সব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহিলারা যেন তাদের মর্যাদা সহকারে আপন ঘরেই বসবাস করে এবং জাহেলি যুগের মেয়েদের মতো বাইরে নিজেদের রূপ সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে না বেড়ায়। একান্ত যদি তাদের ঘরের বাইরে যাবার প্রয়োজন হয়, তবে আগেই যেন চাদর (কাপড়) দ্বারা তারা নিজেদের দেহকে আবৃত করে নেয় এবং ঝংকারদায়ক অলংকারাদি পরিধান করে ঘরের বাইরে না যায়। ঘরের ভেতরেও যেন তারা মাহরাম (যার সংগে বিয়ে নিষিদ্ধ) পুরুষ ও গায়রে মাহরাম পুরুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং ঘরের চাকর ও মেয়েদের ব্যতীত অন্য কারো সামনে যেন জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে না বেরোয়। অতঃপর মাহরাম পুরুষদের সামনে বের হওয়া সম্পর্কেও এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, তারা বেরোবার পূর্বে যেন কাপড়ের আঁচল দ্বারা তাদের মাথাকে আবৃত করে নেয় এবং নিজেদের সতর লুকিয়ে রাখে। অনুরূপভাবে পুরুষদেরকেও তাদের মা-বোনদের নিকট যাবার পূর্বে অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন অসতর্ক মুহুর্তে মা-বোনদের দেহের গোপনীয় অংশের প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়তে না পারে। কোরান মজিদে উল্লেখিত এই সমস্ত নির্দেশকেই আমরা পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মহিলাদের সতর হচ্ছে মুখমন্ডল, হাতের কব্জা ও পায়ের পাতা ব্যতীত দেহের অবশিষ্টাংশ। এই সতরকে মাহরম (যাদের সাথে দেখা করা বৈধ) পুরুষ এমন কি পিতা, ভাই প্রভৃতির সামনেও ঢেকে রাখতে হবে। মেয়েরা এমন কোন মিহি কাপড় পরিধান করতে পারবে না যাতে তাদের দেহের গোপনীয় অংশ বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হতে পারে। তাছাড়া তাদেরকে মোহররম পুরুষ ছাড়া অন্য কারো সাথে ওঠা বসা কিংবা ভ্রমণ করতে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। কেবল তাই নয়, রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে সুগন্ধি মেখেও ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি মসজিদে জামায়াতের সাথে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য পৃথক স্থান পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। নারী ও পুরুষকে মিলিতভাবে একই কামরায় বা একই স্থানে সালাত আদায়ের তিনি কখনো অনুমতি প্রদান করেননি। এমন কি সালাত শেষে খোদ নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহাবাগণ মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে আগে বের হওয়ার সুযোগ দিতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মসজিদ থেকে সম্পূর্ণরূপে বের না হতেন ততক্ষণ পুরুষরা তাঁদের কামরার ভেতরেই অপেক্ষা করতেন। পর্দার এই সমস্ত বিধান সম্পর্কে যদি কারো মনে সংশয় থাকে, তাহলে তিনি কোরানের সূরায়ে নূর ও সূরায়ে আহযাব এবং হাদিসের বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন। বর্তমান সময়ে আমরা যাকে পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি, তার বাহ্যিক রূপে কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বটে, কিন্তু মূলনীতি ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার দিক দিয়ে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মদীনার ইসলামি সমাজে প্রবর্তিত পর্দা ব্যবস্থারই অনুরূপ রয়ে গেছে। বস্তুত পর্দা সম্পর্কে আমাদের মনে যদি কোনো প্রকার সন্দেহমূলক বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে থাকে, তাহলে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়ারইবা কি অধিকার আছে? পর্দা কোন মনগড়া জিনিস নয়- বরং এটি আল্লাহ এবং রাসূলেরই প্রদত্ত বিধান । এ বিষয়ে আরো বিস্তারিতরূপে কারো জানার আগ্রহ থাকলে তিনি কোরান-হাদিস থেকেই সরাসরি জ্ঞান লাভ করতে পারেন। আর হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে যদি কেউ পর্দার বিধান সম্পর্কে সংশয় পোষণ করতে চান, তাহলে তিনি কোরান মজিদ থেকেই তার সংশয় নিরসন করতে পারেন। কোরানে এ সম্পর্কে এত সুস্পষ্ট ও খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা হয়েছে যে, তাকে কূটতর্কের বেড়াজাল দিয়ে কোন প্রকারেই আড়াল করে রাখা সম্ভব নয়। গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান