ছবি সংগৃহীত
কিতাবুল ইমান : প্রবন্ধ নং- ৯ : আল্লাহর নাম ও সিফাত-কেন্দ্রিক তাওহিদের দলিল
প্রকাশিত: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ১১:৪৪
আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ১১:৪৪
আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ১১:৪৪
আল্লাহর নাম ও সিফাত-কেন্দ্রিক তাওহিদের দলিল
কোরান-সুন্নাহয় এ প্রকার তাওহিদের দলিল প্রচুর। বরং আল-কোরানের এমন কোনো সুরা পাওয়া যাবে না, এমনকি কোনো পৃষ্ঠাও পাওয়া যাবে না, যেখানে আল্লাহর নাম ও সিফাতের উল্লেখ নেই। আল-কোরান চাই তাওহিদের কথা বলুক, অথবা ইবাদত ও বিধানের কথা বলুক, অথবা আদেশ-নিষেধ ওয়াদা ও হুঁশিয়ারির কথা বলুক, অথবা কাহিনী ও উপমা উল্লেখ করুক সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহর নাম ও সিফাত পাওয়া যাবে। আমি এখনে একটি সূরা উল্লেখ করব, যা তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাতকে একত্র করেছে। সূরাটি হলো সূরা আল ইখলাস, যা হাদিস অনুযায়ী আল-কোরানের এক-তৃতীয়াংশের সমান। [সহিহ বুখারিতে আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার হাতে আমার নফস তাঁর কসম, তা [সূরা ইখলাস] আল-কোরানের এক-তৃতীয়ংশের সমান।’ [বুখারি, আস-সহিহ ৯/৪৯] আল্লাহ তাআলা বলেন, قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ . اللَّهُ الصَّمَدُ . لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ . وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ . ‘বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই’-(সূরা ইখলাস)। এ মহৎ সূরাটি আল্লাহ তাআলার জন্য সকল কামাল ও পূর্ণতাকে সাব্যস্ত করছে। সকল অপূর্ণতা থেকে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ঘোষণা করছে। আল্লাহ তাআলা এ সূরায় আমাদের জানিয়েছেন যে তিনি অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি কারো থেকে জন্ম নেননি এবং তাঁর কোনো সমক্ষ নেই। ‘আহাদ’ শব্দের অর্থ- যার কোনো সাদৃশ্য ও তুলনা নেই। [শারহু মুল্লা আলী কারী আলাল ফিকহিল আকবার পৃ. ১৪ ] অতএব এ মহিমান্বিত নামটি স্পষ্টরূপে নির্দেশ করছে যে, আল্লাহ তাআলার জন্য সকল পূর্ণাঙ্গ গুণাবলি সুনির্দিষ্ট রয়েছে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো জিনিসের অস্তিত্ব নেই। আর ‘আস্সামাদ’ শব্দের অর্থ হলো এমন সরদার সকল বিষয়ে যার মুখাপেক্ষী হতে হয়, প্রয়োজন ও সমস্যায় যাকে ডাকতে হয়। [শারহু মুল্লা আলী কারী আলাল ফিকহিল আকবার পৃ .১৪ ] অতএব এ নামটি যা নির্দেশ করছে, তা হলো- একমাত্র আল্লাহ তাআলাই হলেন সেই সত্তা, যিনি প্রয়োজন ও সমস্যায় শরণাপন্ন হওয়ার উপযোগী। যদি কোনো ব্যক্তি সত্যচ্যুত হয়ে, পথহারা হয়ে- যে বিষয়ে কেবল আল্লাহরই শরণাপন্ন হতে হয়- সে বিষয়ে কোনো মাখলুকের শরণাপন্ন হয়, তাহলে আল্লাহর এ অধিকার চলে যায় না। কেননা যদি আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির সকল বিষয়ের মুদাবেবর-ব্যবস্থাপক হয়ে থাকেন, যিনি ছাড়া অন্যকোনো সৃষ্টিকর্তা ও ব্যবস্থাপক নেই, তাহলে আল্লাহ তাআলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং তাঁর শরণাপন্ন না-হওয়া চরম বোকামি ও মূর্খতা; কেননা সকল বিষয় একমাত্র আল্লাহর হাতে। [আল আসমা ওয়াস সিফাত পৃ. ৫৮ ] আর এ ভাবেই আল্লাহর ‘আহাদ’ নামটি আল্লাহ তাআলা থেকে সকল অপূর্ণতাকে ‘না’ করে দিচ্ছে এবং সকল পূর্ণতাকে প্রতিষ্ঠিত করছে। [ফাতহুল বারী ৯/৫০] বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, কেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সূরাটিকে আল-কোরানের এক-তৃতীয়াংশ বলে ঘোষণা করেছেন। সূরাটি ইসলামের সকল আকীদাকেই শামিল করছে, যা আল্লাহর জন্য সকল পূর্ণ গুণাবলিকে প্রমাণ করে এবং সকল অপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থেকে আল্লাহর তাআলার পবিত্রতার ঘোষণা দেয় এবং কেবল আল্লাহ তাআলাই যে ইবাদত ও শরণাপন্ন হওয়ার একমাত্র পাত্র তা নির্দেশ করে। আর আল কোরান সামগ্রিকভাবে একটি আকীদা যা- আল্লাহ, তাঁর নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রে বান্দাদের করণীয় কী তা বলে দেয়; আল কোরান একটি শরিয়ত যা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা দেয়, মানুষের পরস্পর আচরণবিধি কি তা বলে দেয়; আল কোরান সংবাদ ও কাহিনী, যা বান্দাদের বলে দেয় সৃষ্টিকুলের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা কী ধরনের আচরণ করেন। আল্লাহর ছাওয়াব ও শাস্তি, ওয়াদা ও হুঁশিয়ারি সব কিছুই আল কোরান বিস্তারিত বলে দেয়। ইমাম ইবনুল কাইয়েম এ সূরার হাকিকত বর্ণনা করে বলেন,‘সূরা ইখলাস যা শামিল করে তা হলো- বিশ্বাস ও জ্ঞানগত তাওহিদ; রব তাআলার অদ্বিতীয়ত্বে এমন বিশ্বাস যা সকল প্রকার অংশীদারিত্বকে প্রত্যাখ্যান করে দেয়; আল্লাহ তাআলার সামাদিয়ত- সকলকে তাঁর মুখাপেক্ষী হওয়া এবং তাঁর কারও মুখাপেক্ষী না হওয়া- আল্লাহ তাআলার কারও সন্তান হওয়া এবং কারও পিতা হওয়াকে অস্বীকার করা, যা আল্লাহর অমুখাপেক্ষীতার অবশ্যম্ভাবী একটি দাবি। আল্লাহর কোনো সমকক্ষ না থাকা, যা আল্লাহর কোনো সাদৃশ্য না থাকা, তুলনা ও উপমা না থাকাকে শামিল করে। অতএব এ সূরাটি আল্লাহর জন্য সকল পূর্ণতাকে প্রমাণ করছে, এবং সকল অপূর্ণতা থেকে তাঁর পবিত্র হওয়াকে ব্যক্ত করছে। আল্লাহর কোনো সদৃশ অথবা তুলনা নেই, তাঁর আদৌ কোনো শরীক নেই, সূরাটি তা ব্যক্ত করছে। এ মূলনীতিগুলি বিশ্বাস ও জ্ঞানগত তাওহিদকে একত্রকারী, যা সত্যিকার ঈমানদারকে সকল গোমরাহ ও শিরকপন্থী লোকদের থেকে আলাদা করে দেয়। [যাদুল মাআদ, ১/৮১-৮২] আল্লাহর নাম ও বিশেষণ সংবলিত যে আয়াতটি উল্লেখ করব, তা হলো আয়াতুল কুরসি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে এ আয়াতটি আল-কোরানের সমধিক মহিমান্বিত আয়াত। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন , اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক। তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। তাঁর জন্যই আসমানসমূহে যা রয়েছে তা এবং জমিনে যা আছে তা। কে সে, যে তাঁর নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া? তিনি জানেন যা আছে তাদের সামনে এবং যা আছে তাদের পেছনে। আর তারা তাঁর জ্ঞানের সামান্য পরিমাণও আয়ত্ত করতে পারে না, তবে তিনি যা চান তা ছাড়া। তাঁর কুরসি আসমানসমূহ ও জমিন পরিব্যাপ্ত করে আছে এবং এ দু’টোর সংরক্ষণ তাঁর জন্য বোঝা হয় না। আর তিনি সুউচ্চ, মহান’ - (সূরা আল বাকারা , ২৫৫)। মহিমান্বিত এ আয়াতটি তাওহিদের তিনটি ভিত্তিকেই শামিল করছে; কেননা আয়াতটি আল্লাহ তাআলার এমন নাম ও বিশেষণকে শামিল করে আছে, যার প্রত্যেকটি ইসলামী আকীদার একেকটি মূলনীতি বলে পরিগণিত। যেমন-‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই।’ এ বাণীটি উলুহিয়াতের মূলনীতিকে নির্দেশ করছে, যা তাওহিদের ভিত্তি এবং যা থেকে ইসলামের গোটা জীবন-পদ্ধতিই বের হয়ে আসে। অর্থাৎ-‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই’ এ কথার আবশ্যিক দাবি হলো সকল ইবাদত ও দাসত্ব একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশেই নিবেদন করা। অতঃপর মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও বান্দা হবে না। অন্য কারও উদ্দেশে ইবাদত-বন্দেগি নিবেদন করবে না। যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও আনুগত্য নিষিদ্ধ, সে সব ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ তাআলাকেই আনুগত্য করবে। দ্বীন-শরিয়ত-আইন-বিধান-মূল্যবোধ-মতাদর্শ সবকিছু আল্লাহর কাছ থেকেই নেবে ও তাঁর বিধান মুতাবেক নির্ধারণ করবে। ‘তিনি চিরঞ্জীব, সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক’ এ বাণীর দ্বারা আল্লাহ তাআলা তাঁর দুটি মহিমান্বিত নাম উল্লেখ করেছেন , একটি হলো চিরঞ্জীব- যার জন্য সার্বক্ষণিক প্রশংসা নির্ধারিত এবং যিনি অনাদি-অনন্তভাবে জীবিত। বলা প্রয়োজন যে আল্লাহর জীবন বলতে যা বুঝায় তা হলো আল্লাহর নিজ সত্তাগত জীবন। তা অন্য কোনো উৎস থেকে আসা জীবন নয়। সৃষ্টিকুলের জীবনের মতো নয়, যা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে হাদিয়া হিসেবে দেয়া। অনুরূপভাবে আল্লাহর জীবন আযালী-আবাদী, তথা অনাদি ও অনন্ত। [ফী যিলালিল কুরআন, ১/৪১৮-৪১৯] আল কাইয়ূম (সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক) : এ নামের অর্থ তিনি সৃষ্টিকুলের সকল বিষয়-আশয়ের ধারক এবং মহাবিশ্বের সকল অবস্থার ব্যবস্থাপক। তিনি সব কিছু দেখাশোনাকারী- তিনি তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেন, হিফাযত করেন, লালন-পালন করেন, তিনি তাঁর ইচ্ছা ও ইরাদা মুতাবেক তাদের পরিচালনা করেন। [আল আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ ৪৮] ‘আল হাইয়ুল কাইয়ূম’ আল্লাহ তাআলার সুনদরতম মহিমান্বিত নামসমূহের মধ্যে দুটি নাম, যা অন্যান্য নামসমূহের কেন্দ্রবিন্দু। কেননা ‘জীবন’ সকল পূর্ণাঙ্গ সিফাত-বিশেষণের উপস্থিতি দাবি করে। পূর্ণাঙ্গ সিফাতের কোনো একটির অনুপস্থিতির অর্থ হবে জীবনের কোনো দুর্বলতা। অতএব যেহেতু আল্লাহর তাআলা পূর্ণাঙ্গতম জীবনের মালিক, অতএব তিনি সকল পূর্ণাঙ্গ গুণেরও মালিক । আর আল্লাহর কাইয়ুমিয়াত তথা সুপ্রতিষ্ঠিত ধারকত্ব আল্লাহর পূর্ণাঙ্গতম ধনাঢ্য ও ক্ষমতাকে শামিল করে। অতএব তিনি নিজেই নিজের অস্তিত্বের ধারক, এ ক্ষেত্রে তিনি কোনোভাবেই অন্য কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি অন্য সকলের ধারক। অতএব অস্তিত্বশীল সব-কিছুই আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। [শারহুল আকীদা আত্-তাহাবিয়্যাহ, পৃ ১২৪-১২৫] এ দুটি নাম একজন মুসলমানের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলে। অতঃপর যে ব্যক্তি এ দু-নামের প্রতি ঈমান আনবে, এ দু-নামের যে বিশাল অর্থ রয়েছে তা অন্তরে হাজির করবে, তার অন্তরাত্মা ভালোবাসা, ইবাদত ও আনুগত্যের বাঁধনে আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে; কেননা সে জানে যে আল্লাহ হলেন তাঁর রব, যিনি তার ও মহাবিশ্বের সকল বিষয়-আশয় পরিচালনা করেন, তাঁর হিকমত ও ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী। অতএব সে তার জীবনে আল্লাহ তাআলার হিকমত ও ব্যবস্থাপনার ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবন-পদ্ধতিকে আপন করে নেয়। আল্লাহ তাআলার কাছ থেকেই সে মূল্যবোধ ও মানদন্ড সংগ্রহ করে। আল্লাহ তাআলা তার সকল অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন এ অনুভূতি সে হৃদয়ে সদা জাগ্রত রাখে। [ফী যিলালিল কুরআন, পৃ ৪১৯] ‘তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না।’ আল্লাহ তাআলাই যে সব-কিছুর ধারক এবং সব-কিছুর অস্তিত্ব যে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল, এ বাণীটি এ কথার প্রতিই তাগিদ করছে; কেননা তন্দ্রা ও নিদ্রা পূর্ণাঙ্গতম জীবন ও পূর্ণাঙ্গতম ধারকত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। [প্রাগুক্ত] ‘তাঁর জন্যই আসমানসমূহে যা রয়েছে তা এবং জমিনে যা আছে তা।’ এ বাণীটি আল্লাহ তাআলার পূর্ণ মালিকানাকে নির্দেশ করছে, যে মালিকানা নিঃশর্ত ও সকল প্রকার অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র। এই আকীদাটি কারও অন্তরে বসে গেলে তা সীমাহীন প্রভাব ফেলতে বাধ্য। সাইয়্যেদ কুতুব র. বলেন,‘যদি প্রকৃত মালিকানা কেবল আল্লাহরই হবে এবং মৌলিকভাবে কোনো কিছুর ওপরই মানুষের কোনো মালিকানা না থাকে বরং তারা মূল মালিকের পক্ষ থেকে কেবল খলীফা হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ওপর আবশ্যক হলো খেলাফতসূত্রে প্রাপ্ত মালিকানার ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল মালিকের শর্তানুযায়ী আমল করা। মূল মালিকের শর্ত কী, তাঁর বিধানেই তা বলা আছে। অতএব এ থেকে বিচ্যুত হওয়া তাদের অধিকারভুক্ত নয়। অন্যথায় খেলাফতের অঙ্গীকারসূত্রে-সৃষ্ট তাদের মালিকানা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তাদের আচরণ, লেনদেন অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। আর তাই -যদি কারো অন্তরে এ অনুভূতি শক্তভাবে বসে যায় যে, যা-কিছু আসমান ও জমিনে আছে, বাস্তবিক অর্থে তার প্রকৃত মালিক আল্লাহ। মানুষ যা- কিছুকে নিজের মালিকানাধীন মনে করে , প্রকৃত অর্থে সে তার মালিক নয়, বরং প্রকৃত মালিক হলেন আল্লাহ তাআলা, যিনি তাকে সীমিত সময়ের জন্য এসব কেবল ধার দিয়েছেন, যা সুনির্দিষ্ট সময় পেরুলেই মূল মালিকের কাছে চলে যাবে- যদি কেউ এই হাকীকত ও অনুভূতি হৃদয়ে হাজির করে, তাহলে অযাচিত ও লালসার প্রচন্ডতা থেকে, কৃপণতা ও লোভের প্রচন্ডতা থেকে, পাগলের মতো দুনিয়ার কোনো বিষয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়া থেকে তাকে তা রক্ষা করবে। এ অনুভূতি হৃদয়ে অল্পে তুষ্ট থাকা, রিযিক যা অর্জিত হয় তাতে রাজি থাকা, বদান্যতা, দানশীলতা ইত্যাদির ভাব সৃষ্টি করতে বাধ্য। এ অনুভূতি হৃদয়-মনকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি উভয় অবস্থায় সান্ত্বনা জোগায়। অতএব যা পাওয়া যায়নি তার প্রতি আফসোস এবং ভবিষ্যতে যা পাওয়ার ইচ্ছা করা হয় তা পাওয়ার জন্য অন্তর্দাহ সৃষ্টি হওয়া থেকে ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রাখে। [ফী যিলালিল কুরআন:১/৪২০-৪২১] ‘কে সে, যে তাঁর নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া?’ আল্লাহ তাআলার এ বাণীটি মাকামে উলুহিয়াত ও মাকামে উবুদিয়াতকে স্পষ্ট করে ব্যক্ত করছে। অর্থাৎ প্রতিটি সৃষ্টিজীবই আল্লাহর দাস, যে দাস তার দাসত্বের সীমানা অতিক্রম করে না, সীমার বাইরে যায় না। অতএব আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো মানুষই তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে না। বুঝাই যাচ্ছে যে, শাফাআত-বিষয়ক এ আকীদাটি হাকীকতে রুবুবিয়াত ও হাকীকতে উলুহিয়াতের মাঝে একটি স্পষ্ট সীমানা নির্ধারণকারী। অতএব এ দুটি কখনো মিশে না, একটি অপরটির সঙ্গে শরীক হয় না। কি গুণ কি বৈশিষ্ট্য কোনো ক্ষেত্রেই না। [প্রাগুক্ত] ‘তিনি জানেন যা আছে তাদের সামনে এবং যা আছে তাদের পেছনে। আর তারা তাঁর জ্ঞানের সামান্য পরিমাণও আয়ত্ত করতে পারে না, তবে তিনি যা চান তা ছাড়া।’ এ আয়াতাংশটি আল্লাহ তাআলার জ্ঞানের ব্যাপকতা, অসীমত্ব, স্থান-কাল-পাত্রকে পরিবেষ্টন করে থাকাকে বোঝাচ্ছে। অন্যদিকে তা সৃষ্টিজীবের অসহায়ত্ব ও তাদের জ্ঞানের অপূর্ণতাকে বোঝাচ্ছে। তারা কেবল সেইটুকু জ্ঞানই লাভ করতে পারে যেটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করেন। আল্লাহ তাআলার এ সিফাতের ওপর যখন একজন মুসলিম বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং অন্তরে তা হাজির করবে- আল্লাহকে সদাদ্রষ্টা হিসেবে জাগ্রত অনুভূতি রেখে, আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা সংরক্ষণ করে, ভুল করলে অতি দ্রুত তাওবা করে এবং নিজের হাকীকতকে জেনে ও বিভিন্ন বাস্তবতার জ্ঞানের আকারে আল্লাহ তাকে যে নিয়ামত দিয়েছেন তা অনুভূতিতে এনে-তাহলে বান্দার এ ঈমান ও অনুভূতি তাকে আল্লাহ তাআলার সীমাহীন শোকরগুজার বান্দায় পরিণত করবে এবং দম্ভ-গর্ব- উন্নাসিকতা থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দেবে। তাঁর কুরসি আসমানসমূহ ও জমিন পরিব্যাপ্ত করে আছে এবং এ দু’টোর সংরক্ষণ তাঁর জন্য বোঝা হয় না।’ আয়াতের এ অংশটি আল্লাহ তাআলার পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও কুদরতের একটি দলিল। এই মহিমান্বিত আয়াতটির শেষাংশে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেন, وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ ‘আর তিনি সুউচ্চ, মহান’ ‘ الْعَلِيُّ- সুউচ্চ’ অর্থ সৃষ্টিকুলের ঊর্ধ্বে, ওপরে। [তাবারী ৫/৪০৫] অতএব আল্লাহ তাআলার শীর্ষতা স্পর্শ করার ক্ষমতা কারও নেই। যদি কেউ অনুচিতভাবে এ ধরণের স্পর্ধা দেখায় এবং উলুহিয়াত দাবি করে বসে, আল্লাহ তাআলা তাকে পৃথিবীতেই হীন ও অপদস্থ করে ছাড়েন। আর আখিরাতের আজাব তো অবশ্যম্ভাবীরূপে আছেই। الْعَظِيم - (আল আজিম) মহামহিম। অর্থাৎ একমাত্র তিনিই মহামহিম, তাঁর চেয়ে মহামহিম অন্য কারও অস্তিত্ব নেই। যখন আল্লাহ তাআলার সুউচ্চ ও মহামহিম হওয়ার বিশ্বাস কারো হৃদয়ে প্রথিত হবে, তখন মানুষ তার নিজের মূল্য বুঝতে পারবে। এবং আল্লাহর সামনে দাসত্বের অবস্থান অর্জনের প্রতি লালায়িত হবে। অতঃপর সে দম্ভ-গর্ব থেকে বিরত থাকবে, ঔদ্ধত্য থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহকে সে ভয় করবে, আল্লাহর সঙ্গে ও তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আদবপূর্ণ আচরণ করবে। [ফী যিলালিল কুরআন, ১/৪২৪] এ হলো আয়াতুল কুরসির মহান কিছু দিক। অতএব সবার উচিত এ বিষয়গুলো গুরুত্বসহ নেয়া, তা সংরক্ষণ করা, এর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা, অন্তরে তা হাজির করা, এগুলোর যে হক রয়েছে তা যথার্থরূপে আদায় করা। আয়াতুল কুরসির ফজিলত সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রাযি.) এর বর্ণনায় ইমাম বুখারির র. উল্লিখিত একটি দীর্ঘ হাদিসের একাংশে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘তুমি যখন বিছানায় যাবে, আয়াতুল কুরসি পড়বে...; কেননা তা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার সুরক্ষক হিসেবে থাকবে, অতঃপর সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটবর্তী হবে না।’ [বুখারি : ২/৩৮৪ ] সহিহ মুসলিমে উবাই ইবনে কাআব (রাযি.) থেকে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘হে আবুল মুনযের, তুমি কি জান, তোমার সঙ্গে-থাকা আল-কোরানের কোন আয়াত সমধিক মহান? আমি বললাম , اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ অতঃপর তিনি আমার বুকে আঘাত করে বললেন , ইলম থাকার কারণে তোমাকে মোবারকবাদ হে আবুল মুনযের । [মুসলিম : ৬/৯৩] মূল : ড. মুহাম্মাদ নাঈম ইয়াসিন বাংলা অনুবাদ : ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক- ট্যাগ:
- পাঁচ স্তম্ভ
- ইসলাম
- কালিমা
- আল্লাহ
- কিতাবুল ইমান
- তাওহিদ
- দলিল
- নাম
- সিফাত
১০ ঘণ্টা, ২০ মিনিট আগে
১০ ঘণ্টা, ৩৪ মিনিট আগে
১০ ঘণ্টা, ৪৪ মিনিট আগে
১১ ঘণ্টা, ১৮ মিনিট আগে
১১ ঘণ্টা, ১৯ মিনিট আগে