ছবি সংগৃহীত

কিতাবুল ইমান : প্রবন্ধ নং- ২৯ : শেষ দিবসের প্রতি ঈমানের দলিল ও অস্বীকারকারীদের সন্দেহের জবাব

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ০২ মার্চ ২০১৪, ০৯:২৮
আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৪, ০৯:২৮

শেষ দিবসের প্রতি ঈমানের দলিল ও অস্বীকারকারীদের সন্দেহের জবাব

মহাগ্রন্থ আল কোরান এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনার আহবান জানায়। আকল ও স্বচ্ছ মানবপ্রকৃতিও শেষ দিবসের প্রতি ঈমানের পক্ষে সাক্ষ্য দয়ে। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে শেষ দিবসের প্রতি ঈমানের কথা অধিক হারে উল্লেখ করেছেন। শেষ দিবস যে আসছে, সে ব্যাপারে আল কোরান বহু দলিল পেশ করেছে। যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে তাদের সংশয়-সন্দেহের যথোপযুক্ত জবাব দিয়েছে। শেষ দিবসে যা যা হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা আল-কোরানে এমনভাবে দেয়া হয়েছে যে, পূর্বের আসমানি কিতাবসমূহের কোনোটিতেই তার তুলনা খোঁজে পাওয়া যায় না। যদিও প্রত্যেক রাসুলই তাঁর কাওমকে এ দিবস সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়েছেন ও সতর্ক করেছেন। যারা এ দিবসকে অস্বীকার করে অথবা এ দিবস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে তাদের তারা কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَيَجْمَعَنَّكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে একত্র করবেন কিয়ামতের দিনে। এতে কোন সন্দেহ নেই’-(সূরা আন্-নিসা , ৮৭)। অন্যত্র এসেছে, لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ‘ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হলো যে ঈমান আনে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি..’- (সূরা আল বাকারা , ১৭৭)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন , وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا ‘আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসুলগণ এবং শেষ দিবসকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে’-(সূরা আন্-নিসা , ১৩৬)। নূহ আলাইহিস সালাম তাঁর জাতিকে যা বলেছেন, তা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, وَاللَّهُ أَنْبَتَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ نَبَاتًا . ثُمَّ يُعِيدُكُمْ فِيهَا وَيُخْرِجُكُمْ إِخْرَاجًا ‘আর আল্লাহ তোমাদেরকে উদগত করেছেন মাটি থেকে’। ‘তারপর তিনি তোমাদেরকে তাতে ফিরিয়ে নেবেন এবং নিশ্চিতভাবে তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন’- (সূরা নূহ , ১৭-১৮)। আর ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লামের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, وَالَّذِي أَطْمَعُ أَنْ يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ ‘আর যিনি আশা করি, বিচার দিবসে আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন’ - (আশ্শুয়ারা , ৮২)। আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেন , إِنَّ السَّاعَةَ آَتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى . فَلَا يَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَنْ لَا يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَى ‘নিশ্চয় কিয়ামত আসবে; আমি তা গোপন রাখতে চাই যাতে প্রত্যেককে স্বীয় চেষ্টা-সাধনা অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া যায়’। অতএব যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান রাখে না এবং স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে সে যেন কিছুতেই তাতে ঈমান আনয়নে তোমাকে বাধা দিতে না পারে; অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’ - (সূরা তাহা , ১৫-১৬)। শেষ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন তাঁর রবের নামে শপথ করে পুনরুত্থান বিষয়টি শক্তভাবে উপস্থাপন করেন। ইরশাদ হয়েছে, زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ لَنْ يُبْعَثُوا قُلْ بَلَى وَرَبِّي لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ ‘কাফেররা ধারণা করেছিল যে, তারা কখনোই পুনরুত্থিত হবে না। বল, ‘হ্যাঁ, আমার রবের কসম, তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা আমল করেছিলে তা অবশ্যই তোমাদের জানানো হবে। আর এটি আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ’ - (সূরা আত্-তাগাবুন , ৭)। অতএব যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করল, তারা সকল রাসুলকেই (আ.) অস্বীকার করল। আর রাসুলগণ যা বলেছেন তা সত্য হওয়ার ব্যাপারে বুদ্ধি ও অনুভূতিগত অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে। ফলে রাসুলগণের কথা মিথ্যা সাব্যস্ত করার অর্থ আকল-বুদ্ধিকে অপদস্থ করা, অস্বীকার করা এবং বুদ্ধির বিপক্ষে বিদ্রোহ করা। যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে, তাদের অস্বীকৃতির পক্ষে আদৌ কোনো দলিল নেই; কেননা পুনরুত্থান হলো এক অদৃশ্য বিষয় যার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তাআলাই রাখেন। আর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ এবং তা স্বীকার করার একমাত্র পথ হলো আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রদত্ত সংবাদ। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বাণী প্রাপ্তির দাবি করছেন, তাঁর দাবি অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এটাও নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে তিনি এ সব অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে যা বলেছেন তা অকাট্য সত্য। আর এ বিষয়টি কেবল সম্মানিত রাসুলগণের (আ.) জন্যই প্রতিষ্ঠিত; কেননা রাসুলগণ (আ.) যে সত্যবাদী, মুজিযা প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তিনি তাদের কিছু অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন। আর, ওপরে একথা গিয়েছে যে, সকল রাসুলই (আ.) পরকাল বিষয়ক সংবাদের ব্যাপারে অভিন্ন অবস্থানে ছিলেন। যারা পুনরুত্থান অস্বীকারকারী তারা এ দিবসের অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু সংশয়-সন্দেহ পেশ করে থাকে। যেমন মৃত্যুর পর হাড্ডি ও মাটিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর একজন মানুষ আবার কীভাবে পুনরুত্থিত হবে, সে বিষয়ে তারা সংশয় ব্যক্ত করেছে। তারা বলেছে , أَئِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا ذَلِكَ رَجْعٌ بَعِيدٌ ‘আমরা যখন মারা যাব এবং মাটিতে পরিণত হব তখনো কি (আমরা পুনরুত্থিত হব)? এ ফিরে যাওয়া সুদূরপরাহত’। আল্লাহ তাআলা তাদের কথা উল্লেখ করে আরও বলেন , وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ ‘আর তারা বলে, ‘দুনিয়ার জীবনই আমাদের একমাত্র জীবন। আমরা মরি ও বাঁচি এখানেই। আর কাল-ই কেবল আমাদের ধ্বংস করে।’ বস্ত্তত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা শুধু ধারণাই করে’-(সূরা আল জাছিয়া , ২৪)। পুনরুত্থান অস্বীকারকারীদের সংশয়-সন্দেহের দলিল হলো বিষয়টিকে আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর ও সুদূরপরাহত মনে করা। আল্লাহ তাআলা তাদের এ সন্দেহ রদ করেছেন এবং আল-কোরানের একাধিক জায়গায় এর অসারতা তুলে ধরেছেন। তিনি তাদের জন্য এ কথা স্পষ্ট করেছেন যে, পুনরুত্থান এমন কোনো বিষয় নয়, যা মানববুদ্ধি অস্বীকার করতে পারে। বরং মানববুদ্ধি তা সমর্থন করে। উপরন্তু মানবজীবনে এমন বহু ঘটনা রয়েছে যা পুনরুত্থানের সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য বহন করে। যেমন , ১ - আল্লাহ তাআলা বলেন, وَقَالُوا أَئِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا أَئِنَّا لَمَبْعُوثُونَ خَلْقًا جَدِيدًا . قُلْ كُونُوا حِجَارَةً أَوْ حَدِيدًا . أَوْ خَلْقًا مِمَّا يَكْبُرُ فِي صُدُورِكُمْ فَسَيَقُولُونَ مَنْ يُعِيدُنَا قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ فَسَيُنْغِضُونَ إِلَيْكَ رُءُوسَهُمْ وَيَقُولُونَ مَتَى هُوَ قُلْ عَسَى أَنْ يَكُونَ قَرِيبًا . يَوْمَ يَدْعُوكُمْ فَتَسْتَجِيبُونَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّونَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا. ‘আর তারা বলে,‘যখন আমরা হাড্ডিতে পরিণত হব ও ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাব, তখন কি আমরা নতুন সৃষ্টিরূপে পুনর্জ্জীবিত হব।? বল, ‘তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা, অথবা এমন কোনো সৃষ্টি, যা তোমাদের অন্তরে বড় মনে হয়।’ তবুও তারা বলবে, ‘কে আমাদের পুনরায় (সৃষ্টি) করবে?’ বল, ‘যিনি তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছে।’ অতঃপর তারা তোমার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, ‘কবে এটা?’ বল, আশা করা যায় যে, তা নিকটেই হবে।’ ‘যেদিন তিনি তোমাদের ডাকবেন, তখন তাঁর প্রশংসার সাথে তোমরা সাড়া দেবে। আর তোমরা ধারণা করবে, অল্প সময়ই তোমরা অবস্থান করেছিলে’ - (সূরা আল ইসরা, ৪৯-৫২)। পুনরুত্থান অস্বীকারকারীরা যেসব সন্দেহ উপস্থাপন করল এবং যুগযুগান্তরে যেসব সন্দেহ উপস্থাপন করে থাকে, তার খোলাসা হলো- হাড্ডি ও মাটিতে পরিণত হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা মানবশরীরকে নতুনভাবে কীভাবে জীবন্ত শরীরে রূপান্তরিত করবেন, যা ফিরে পাবে অনুভব অনুভূতিসহ সব কিছু? তারা বিষয়টিকে আল্লাহর ক্ষমতার চেয়েও বড় মনে করে। তারা এ কারণেও শেষ দিবসকে অস্বীকার করে যে, দিবসটি কখন সংঘটিত হবে, সে বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই। এ প্রকৃতির সংশয়-সন্দেহ জীবন-মৃত্যুর বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞানতা, আল্লাহর কুদরত বিষয়ে উদাসীনতা, অস্তিত্বহীনকে অস্তিত্বদানে আল্লাহ তাআলার যে অফুরান ক্ষমতা রয়েছে, তা দেখেও না দেখার ভান করা থেকে উদ্ভূত। তাদের জ্ঞানবুদ্ধি সজীব থাকলে এটা বোঝা কষ্টকর হত না যে, তাদের প্রথম সৃষ্টি আল্লাহ তাআলাই করেছেন, তাদের তিনি অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ববান করেছেন। অতএব আল্লাহ তাআলা পরকাল, হিসাবনিকাশ, আজাব ও ছাওয়াবের কথা যা বলেছেন, সে ব্যাপারেও যে তিনি সত্যবাদী তা তাদের বিশ্বাস করা আবশ্যক। বিষয়টি অত্যন্ত সহজ এবং এর যুক্তিও অকাট্য; কেননা মানুষ অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্বে এসেছে, যা প্রমাণ করে যে, এমন একজন ব্যবস্থাপক স্রষ্টা আছেন, যিনি তাকে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্ববান করেছেন। এরপর সে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। অতএব কে তার অবস্থার রূপান্তর ঘটাল? নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা, যিনি তাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। আর তাই যখন সৃষ্টিকর্তা সংবাদ দেবেন যে, তিনি তার সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন তখন সৃষ্টিকর্তার এ কর্মকে অস্বীকার করা ঔদ্ধত্য বই অন্য কিছু নয়। ২- ইরশাদ হয়েছে, قُلِ اللَّهُ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يَجْمَعُكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ‘বল, ‘আল্লাহই তোমাদের জীবন দেন তারপর তোমাদের মৃত্যু ঘটান। তারপর তিনি তোমাদেরকে কিয়ামতের দিনে একত্র করবেন, যাতে কোন সন্দেহ নেই; কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না’-(সূরা আল জাছিয়া , ২৭)। وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ . قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ . الَّذِي جَعَلَ لَكُمْ مِنَ الشَّجَرِ الْأَخْضَرِ نَارًا فَإِذَا أَنْتُمْ مِنْهُ تُوقِدُونَ. أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ بَلَى وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ . ‘আর সে আমার উদ্দেশে উপমা পেশ করে, অথচ সে তার নিজের সৃষ্টি ভুলে যায়। সে বলে, ‘হাড়গুলো জরাজীর্ণ হওয়া অবস্থায় কে সেগুলো জীবিত করবে’? বল, ‘যিনি প্রথমবার এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই সেগুলো পুনরায় জীবিত করবেন। আর তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কেই সর্বজ্ঞাতা। যিনি সবুজ বৃক্ষ থেকে তোমাদের জন্য আগুন তৈরি করেছেন। ফলে তা থেকে তোমরা আগুন জ্বালাও। যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? হ্যাঁ, তিনিই মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী’-(সূরা ইয়াসীন , ৭৮-৮১)। ‘আল আকীদা আত্-তাহাবিয়া’-র ব্যাখ্যাকার এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,‘যদি মানুষের মধ্যে সমধিক জ্ঞানী, সমধিক বিশুদ্ধভাষী ও সেরা সাহিত্যিক- সংক্ষিপ্ততা, স্পষ্টতা ও যুক্তির বিশুদ্ধতার বিচারে আল-কোরানের এই যুক্তির চেয়ে উত্তম অথবা সমপর্যায়ের কোনো যুক্তি নিয়ে আসার চেষ্টা করে, তবে সে নির্ঘাত ব্যর্থ হবে; কেননা আল্লাহ তাআলার উল্লিখিত যুক্তিটি এভাবে পেশ করেছেন যে, প্রথমে তিনি নাস্তিকের একটি প্রশ্ন উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি,‘অথচ সে তার নিজের সৃষ্টি ভুলে যায়’ উল্লেখ করে প্রাথমিকভাবে তার অকাট্য জবাব দিয়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি যুক্তিকে আরও সুসংহত করার জন্য বলেছেন,‘ বল, ‘যিনি প্রথমবার এগুলো সৃষ্টি করেছেন তিনিই সেগুলো পুনরায় জীবিত করবেন।’ অর্থাৎ এখানে তিনি প্রথম সৃষ্টিকে পুনরায় সৃষ্টির দলিল হিসেবে পেশ করেছেন; কারণ, বুদ্ধি-বিবেচনা রয়েছে এমন যে কোনো ব্যক্তিই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই জানে যে, যিনি প্রথমটি সঙ্ঘটিত করতে সক্ষম ছিলেন, তিনি দ্বিতীয়টি করতেও সক্ষম হবেন। আর যদি দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে অপারগ হন, তাহলে প্রথমটির ক্ষেত্রে আরও অধিক মাত্রায় অপারগ হওয়ার কথা ছিল। আর যেহেতু সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার একটি দাবি হলো, সৃষ্টিজীবের ওপর সীমাহীন ক্ষমতা থাকা, সৃষ্টি-প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা, অতএব তিনি বলেছেন যে, ‘তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কেই সর্বজ্ঞাতা’। অর্থাৎ তিনি প্রথম সৃষ্টির সকল অংশ, কাঁচামাল ও আকৃতি সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত। অতএব তাঁর জন্য পুনরায় সৃষ্টি একটি অতি সহজ ব্যাপার। উপরন্তু আল্লাহ তাআলা যেহেতু সর্বজ্ঞাতা, অফুরন্ত ক্ষমতার অধিকারী, তাই তার পক্ষে জরাজীর্ণ হাড্ডি জীবিত করা কী করে অসম্ভব হতে পারে? এরপর তিনি শক্তভাবে আরেক নাস্তিকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। প্রশ্নটি হলো এরকম যে, হাড্ডি যখন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে, তখন তা ঠান্ডা ও শুষ্ক হয়ে যায়। আর জীবনস্পন্দনের জন্য প্রয়োজন গরম ও তাজা পদার্থের। আল্লাহ তাআলা এ প্রশ্নের জবাবে বলেন,‘যিনি সবুজ বৃক্ষ থেকে তোমাদের জন্য আগুন তৈরি করেছেন। ফলে তা থেকে তোমরা আগুন জ্বালাও।’ আল্লাহ তাআলা এখানে যে বিষয়টি বলেছেন, তা হলো- তিনি একটি প্রচন্ড গরম ও শুকনো আগুন এমন একটি জিনিস থেকে বের করেন যা হলো আর্দ্রতায় ভরপুর ও ঠান্ডা। অতএব যিনি কোনো জিনিস থেকে ঠিক তার বিপরীতটি বের করতে পারেন এবং যার নির্দেশ মানতে সকল সৃষ্টিই বাধ্য, তিনিই তো পুনরুত্থান ঘটাবেন, যা নাস্তিক অস্বীকার করছে। দলিলটিকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে, এই বলে যে, যিনি অতি কঠিন ও সুবিশাল কাজ করতে পারেন, তিনি অতি সহজ কাজও করতে পারেন। যে ব্যক্তি পঞ্চাশ কেজি বহন করতে পারে, সে পাঁচ কেজি অবশ্যই বহন করতে পারবে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন,‘যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন?’ অতএব যিনি সুবিশাল আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করতে পেরেছেন, তিনি অবশ্যই, হাড্ডি জরাজীর্ণ হয়ে গেলে, তাকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম হবেন।’ [শারহুল আকীদা আত্-তাহাবিয়্যাহ পৃ. ৪৬০-৪৬১] ৩ - আল্লাহ তাআলা বলেছেন , يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ وَمِنْكُمْ مَنْ يُتَوَفَّى وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِنْ بَعْدِ عِلْمٍ شَيْئًا وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنْبَتَتْ مِنْ كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ . ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّهُ يُحْيِي الْمَوْتَى وَأَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ . وَأَنَّ السَّاعَةَ آَتِيَةٌ لَا رَيْبَ فِيهَا وَأَنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ مَنْ فِي الْقُبُورِ. ‘হে মানুষ! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহে থাক, তবে নিশ্চয়ই জেনে রেখো, আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর শুক্র থেকে, তারপর আলাকা [علقة মানে যুক্ত ও ঝুলন্ত বস্ত্ত। পূর্ববর্তী তাফসির কারকদের অনেকে এর অর্থ করেছেন রক্তপিন্ড। তবে আধুনিক জীববিজ্ঞানীদের মতে, পুরুষের শুক্র ও নারীর ডিম্বানু মিলিত হয়ে মাতৃগর্ভে যে ভ্রূণের সৃষ্টি হয় তা পরে জরায়ূ গাত্রে সংযুক্ত হয়ে পড়ে। এ জন্য ‘আলাকা শব্দের অনুবাদ এখন করা হয়, এমন কিছু যা যুক্ত হয়ে যাবে।] থেকে, তারপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট অথবা অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট গোশত থেকে। তোমাদের নিকট বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করার নিমিত্তে। আর আমি যা ইচ্ছা করি, তা একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত মাতৃগর্ভে অবস্থিত রাখি। অতঃপর আমি তোমাদের শিশুরূপে বের করি, পরে যাতে তোমরা যৌবনে উপনীত হও। তোমাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যু দেয়া হয় এ বয়সেই, আবার কাউকে কাউকে ফিরিয়ে নেয়া হয় হীনতম বয়সে, যাতে সে জ্ঞান লাভের পরও কিছু না জানে। তুমি জমিনকে দেখতে পাও শুষ্কাবস্থায়, অতঃপর যখনই আমি তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সকল প্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ। এটি এজন্য যে, আল্লাহই সত্য এবং তিনিই মৃতকে জীবন দান করেন এবং তিনিই সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আর কিয়ামত আসবেই, এতে কোন সন্দেহ নেই এবং যারা কবরে আছে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের পুনরুত্থিত করবেন’-(সূরা আল হাজ্জ , ৫-৭)। আয়াতগুলোতে পুনরুত্থানের দলিল এবং আল্লাহ তাআলা মৃতকে জীবিত করার যে সীমাহীন ক্ষমতা রাখেন, তার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, যা এ বিষয়ক সংশয়-সন্দেহ ও প্রশ্নের জবাব সরবরাহ করে। অতএব উল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে আমরা নিম্নবর্ণিত দলিল ও শিক্ষাসমূহ পাই- ক - আয়াতগুলোর শুরুতে আমরা যে দলিলটি পাই, তা হলো মানবসৃষ্টির আরম্ভ এবং মাটি দ্বারা তার সৃষ্টির শুরু বিষয়ক দলিল। আর মাটি হলো নির্জীব এক পদার্থ । খ- মানব সৃষ্টিতে আল্লাহর ক্ষমতার একটি নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি মানুষকে এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যান। এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত করেন, যা প্রথম অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি শুক্র থেকে মানুষকে আলাকায় রূপান্তরিত করেন। এরপর মাংসপিন্ডে রূপান্তরিত করেন। এরপর তা থেকে কান ও চোখ বের করেন। অনুভূতি, শক্তি, হাড্ডি, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি সংযুক্ত করেন। এরপর তিনি তার সৃষ্টিকে চূড়ান্তভাবে সুসংহত করেন। পরিশেষে তিনি তাকে অতি সুন্দর আকৃতি ও অবকাঠামোয় মাতৃগর্ভের বাইরে নিয়ে আসেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন , لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে’-(সূরা আত্-তীন , ৪)। যে সত্তা মানুষকে এভাবে সৃষ্টি করতে পেরেছেন, তিনি তাকে পুনরায় অস্তিত্ববান করতে কীভাবে অক্ষম হতে পারেন? এটা তো কেবলই এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত করা মাত্র। অস্বীকারকারীরা তো এর উদাহরণ নিজ অস্তিত্বে ও জমিনের সকল মানুষের মাঝেই দেখতে পাচ্ছে। সাইয়েদ কুতুব রা. উপরোক্ত আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করার পর একটি সূক্ষ্ণ অর্থের প্রতি ইশারা করেছেন। তিনি বলেছেন,‘মাতৃগর্ভে মানবশিশু যে পর্যায়গুলো একের পর এক পেরিয়ে যায় এবং পরিশেষে আলোর মুখ দেখে, বিষয়টি এ দিকে ইঙ্গিত করে যে, যিনি এ সব পর্যায় পার করালেন, তিনি মানুষকে আগত পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গতম অস্তিত্ব দান করবেন; কারণ মানুষ এ পৃথিবীর জীবনে পূর্ণাঙ্গ পর্যায়ে পৌঁছুতে সমর্থ নয়। সে কখনো দাঁড়ায়, কখনো পেছনে ফিরে যায়। এমনকি এক পর্যায়ে সে ইতোপূর্বে জ্ঞানী থাকার পরও জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। অতএব মানুষের প্রয়োজন অন্য একটি জগৎ যাতে তার অস্তিত্ব সর্বোচ্ছ পূর্ণতা পাবে। মানব সৃষ্টির উল্লিখিত পর্যায়সমূহ দু’ভাবে পুনরুত্থানকে নির্দেশ করে। প্রথমটি হলো- যিনি মানুষকে প্রথমবার সৃষ্টি করতে ক্ষমতাবান তিনি তাকে পুনরায় সৃষ্টি করতেও সক্ষম। আর তা পুনরুত্থানকেও নির্দেশ করে। কেননা যিনি মানবসৃষ্টির ব্যবস্থাকারী, তিনি মানব অস্তিত্বকে পূর্ণাঙ্গতম পর্যায়ে পৌঁছে দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর এভাবেই সৃষ্টি ও পুনর্সৃষ্টির ঐশী নীতি একত্র হয়। জীবন ও পুনরুত্থানের ঐশী নীতি একত্র হয়। হিসাব ও প্রতিদানের ঐশী নীতি একত্র হয়। আর এ সবই সর্বব্যবস্থাপক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য বহন করে, যার অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। [ফী যিলালিল কুরআন ৫/৫৮৩] মানব সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় এবং শুক্র থেকে আলাকা পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো- যারা পুনরুত্থান অস্বীকার করে তাদের দৃষ্টি এ দিকে আকৃষ্ট করা যে, এই ঐশী কাজটির প্রমাণ হিসেবে তাদের অস্তিত্ব ও অন্যান্য সকল মানুষের অস্তিত্বই যথেষ্ট; কারণ প্রতিটি মানুষই পূর্ণ আকৃতির মানুষ হিসেবে অস্তিত্ব লাভের পূর্বে নিকৃষ্ট ও গন্ধযুক্ত ঘন পানিতে থাকা শুক্র ছিল, যা মূল্যহীন। এরপর সে আলাক ও মাংসপিন্ডে রূপান্তরিত হয়েছে, যার কোনো মানবিক আকার ছিল না। আর এ সবই হলো নিকৃষ্ট পর্যায়, যেখানে তার অস্তিত্ব ছিল, বলা যায়, মৃতের মত। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাতে জীবনীশক্তি সঞ্চার করেন। তা আকৃতিসর্বস্ব করেন। তাতে জীবনের উপকরণ-প্রকরণ রাখেন। পরিশেষে মানুষ পূর্ণাঙ্গ আকৃতি ধারণ করে এমন এক অস্তিত্ব লাভ করে, যা চিন্তা করতে পারে, অনুভব করতে পারে, কথা বলতে পারে, ঝগড়া করতে পারে। আল্লাহ তাআলার এই সৃষ্টিকর্ম, মৃতকে জীবিত করার সঙ্গে কতই না সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন , أَلَمْ يَكُ نُطْفَةً مِنْ مَنِيٍّ يُمْنَى . ثُمَّ كَانَ عَلَقَةً فَخَلَقَ فَسَوَّى . فَجَعَلَ مِنْهُ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى . أَلَيْسَ ذَلِكَ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يُحْيِيَ الْمَوْتَى . ‘সে কি বীর্যের শুক্রবিন্দু ছিল না যা স্খলিত হয়? অতঃপর সে ‘আলাকায় পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ তাকে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। অতঃপর তিনি তা থেকে সৃষ্টি করেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী। তিনি কি মৃতদের জীবিত করতে সক্ষম নন?’ -( সূরা আল কিয়ামা , ৩৭-৪০)। গ - উল্লিখিত আয়াতসমূহে, পুনরুত্থান ও মৃতকে জীবিত করার আরেকটি দলিল হলো- এই বিরানভূমি, যাতে জীবনের কোনো লক্ষণ খোঁজে পাওয়া যায় না, যাতে কোনো কিছু উৎপন্ন হয় না, আল্লাহ তাআলা যখন তা বৃষ্টি দ্বারা সিক্ত করেন, তখন তাতে জীবনস্পন্দন শুরু হয়, শস্য ও রকমারি উদ্ভিদ উদ্গত হয়, যার একটি অন্যটি থেকে ভিন্ন। আর সেসব থেকে বের হয়ে আসে নানা আকৃতি-প্রকৃতি-স্বাদ-গন্ধযুক্ত শস্য ও ফলফলাদি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন , إِنَّ الَّذِي أَحْيَاهَا لَمُحْيِي الْمَوْتَى إِنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘নিশ্চয়ই যিনি জমিনকে জীবিত করেন তিনি মৃতদেরও জীবিতকারী। নিশ্চয় তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’- (সূরা ফুসসিলাত , ৩৯)। ঘ - ইরশাদ হয়েছে, أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ ‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে কেবল অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে না?’-(সূরা আল মুমিনুন , ১১৫)। তিনি আরও বলেন , أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ أَنْ يُتْرَكَ سُدًى ‘মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে?’- (সূরা আল কিয়ামা , ৩৬)। উল্লিখিত দুটি আয়াত এবং এ অর্থের অন্যান্য আয়াত যে বিষয়টিকে তাগিদ করে, তা হলো- পরকাল, হিসাব, প্রতিদান ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস মূলত আল্লাহ তাআলাকে তাঁর পূর্ণাঙ্গ গুণাবলি এবং আসমায়ে হুসনায় অদ্বিতীয় হিসেবে বিশ্বাস করা থেকে উদ্ভূত একটি বিশ্বাস । আর তাই, পরকালের প্রতি ঈমান-বিষয়ক রোকনটি প্রথম রোকনের একটি আবশ্যিক দাবি। অতএব যে ব্যক্তি এ রোকনটি অস্বীকার করবে, সে মুমিন থাকবে না। সে বরং আল্লাহর গুণাবলি - অর্থাৎ সৃষ্টি করার গুণ- বাতিল বলে জ্ঞান করায় আল্লাহর হেকমত ও ইনসাফের দাবি অনুযায়ী- কাফের হিসেবে পরিগণিত হবে। আর ঈমানের এ রোকনটির ক্ষেত্রে কুফরি করার একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ হলো মানুষ তার নিজকে তুচ্ছ করে দেয়া; কেননা পরকাল না-মানার অর্থ- সে এক নিরর্থক সৃষ্টি। তাকে সৃষ্টির পেছনে কোনো হেকমত অথবা উদ্দেশ্য নেই। মানব হিসেবে তার অস্তিত্বের সময়সীমা হলো কেবল ইহকালীন জীবনপর্ব, যা- কষ্ট-যাতনা, দুঃখ-বেদনা, অন্যায়-অত্যাচার, সীমালঙ্ঘন ইত্যাদিতে ভরপুর এবং মানুষকে হিসাবনিকাশ ও প্রতিদান ব্যতীতই ছেড়ে দেয়া হবে। অতএব যে জালেম, তাকে তার জুলুমের শাস্তি দেয়া হবে না। যে ন্যায়পরায়ণ, সে তার ন্যায়পরায়ণতার প্রতিদান পাবে না। যে সংস্কারক সে তার সংস্কারকর্মের প্রতিদান পাবে না। যে ফাসাদ ও দুষ্কৃতিকারী সে তার দুষ্কৃতির শাস্তি পাবে না। যে পাপী, সে তার পাপের শাস্তি পাবে না। অতএব শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাসই হলো আল্লাহ তাআলার মহিমা, ইনসাফ, হেকমতের সঙ্গে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা ও স্বচ্ছ প্রকৃতিও তাই দাবি করে। [আল ওয়াহী আল মুহাম্মাদী পৃ.১৭৯-১৭৮] মূল : ড. মুহাম্মাদ নাঈম ইয়াসিন বাংলা অনুবাদ : ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক