ছবি সংগৃহীত

কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কারক বাঙালি বিজ্ঞানী ড. উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

জুলকারনাইন মেহেদী
লেখক
প্রকাশিত: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩, ১১:৪৯
আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩, ১১:৪৯

অবিভক্ত ভারতে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী আমরা পেয়েছিলাম, যাঁরা নিজেদের যোগ্যতা আর মেধাবলে পুরো বিশ্বে নিজেদের ও দেশের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন। যদিও ব্রিটিশ রাজত্বে কোন ‘নেটিভ’ অর্থাৎ দেশীয়দের কোন কাজের কৃতিত্বের স্বীকৃতি পাওয়া ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ব্যপার। ইতিহাস এও সাক্ষ্য দেয়, অনেক দেশীয় বিজ্ঞানীর আবিষ্কার কিংবা উদ্ভাবন বেনামে চলে গিয়েছে ব্রিটিশ ভারতের কর্ণধারদের নামে। আজকের লেখা অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীকে নিয়ে। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম ১৮৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর, ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমানে। তাঁর বাবা নীলমণি ব্রহ্মচারী ছিলেন ভারতীয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের একজন চিকিৎসক। আর মায়ের নাম ছিল সৌরভ সুন্দরী দেবী। উপেন্দ্রনাথ ইস্টার্ন রেলওয়ে বয়’স হাইস্কুল থেকে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন। এরপর ১৮৯৩ সালে হুগলীর মহসিন কলেজ থেকে গণিত ও রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর উচ্চতর রসায়ন ও মেডিসিনের উপর ১৮৯৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে। ১৯০০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত মেডিসিন ও সার্জারি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে Goodeve and Macleod awards অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯০২ সালে তিনি ডক্টর অব মেডিসিন ও ১৯০৪ সালে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “Studies in Haemolysis”। উপেন্দ্রনাথ ১৮৯৯ সালে প্রাদেশিক স্বাস্থ্যসেবাতে যোগ দেন। ১৯০১ সালে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল স্কুল(বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ)-এ প্যাথলজি ও মেডিসিনের শিক্ষক ও চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলের চিকিৎসক ও মেডিসিনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানেই তিনি তাঁর যুগান্তকারী উদ্ভাবন কালাজ্বরের ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন সংক্রান্ত কাজগুলো সম্পাদন করেন। কালাজ্বর একটি ভয়াবহ রোগ । লিশম্যানিয়া গণভুক্ত এক প্রকার প্রোটোজোয়া পরজীবী এই রোগটি ঘটায়। পরজীবী-ঘটিত রোগগুলোর মধ্যে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাণঘাতী রোগ; ম্যালেরিয়ার পরেই এর স্থান। কালাজ্বরে প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯২০ সালে উপেন্দ্রনাথ তৈরি করেন কালাজ্বরের প্রতিষেধক ইউরিয়া স্টিবামাইন । ১৯২২ সালে Indian Journal Of Medical Research কয়েক জন কালাজ্বর রোগীকে সুস্থ করার বিবরণ সহ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করে। তিনি তাঁর গবেষণা পত্রে ওষুধটির কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করেন । কালাজ্বর ছাড়াও উপেন্দ্রনাথ ফাইলেরিয়া, ডায়াবেটিস, কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি নিয়েও গবেষণা করেছিলেন । চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে রচনাবলীর মধ্যে তাঁর ট্রিটিজ অন কালাজ্বর বিখ্যাত । উপেন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালে কলকাতায় বিশ্বের ২য় ব্লাড ব্যাঙ্ক স্থাপন করেন। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির বাংলা প্রদেশ কার্যালয়ের সভাপতি মনোনীত হন।

গবেষণা ও জনহিতকর কার্যের স্বীকৃতি হিসেবে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মাঝে আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Griffith Memorial Prize , কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এন্ড হাইজিন থেকে মিন্টো পদক, বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্যার উইলিয়াম জোনস পদক। ১৯২৪ সালে তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেয়া হয়। এরপরই তিনি তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটনের কাছ থেকে পান ‘কায়সার-ই-হিন্দ’ পদক। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইটহুড’ উপাধি প্রদান করে। ১৯২৯ সালে উপেন্দ্রনাথ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি আর নোবেল পান নি। তিনি লন্ডনের রয়াল সোসাইটি অব মেডিসিনের সম্মানিত ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু কালাজ্বরের মত জীবনঘাতী রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান তাঁকে সব সময়ই স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধার সাথে।