
ছবি সংগৃহীত
কবিতা কেন জনপ্রিয় নয়? (প্রথম পর্ব)
আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৭:৩৯
ছবি: শামছুল হক রিপন।
(প্রিয়.কম) গল্প, নাটক, উপন্যাস, যে হারে জনপ্রিয় সে হারে জনপ্রিয় নয় কবিতা।বলতে গেলে জনসাধারণ এখন প্রায় কবিতাবিমুখ।কবিতার পাঠক খুব একটা নেই বললেই চলে। কিন্তু কেন?কবিতার জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে এক সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করে প্রিয়.কম।
কবিতা কেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে?পাঠক কেন কবিতা পড়ছেন না, কবিতা কেন দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে?কিভাবে কবিতাকে জনমানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়? এসব প্রশ্নই উপস্থাপিত হয় আড্ডায়।
সুদীপ্ত সাইদ খানের সঞ্চালনায় এই আড্ডায় অংশ নেন কবি মজিদ মাহমুদ, কবি শামীমুল হক শামীম, কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কবি কামরুজ্জামান কামু, কবি ফিরোজ এহতেশাম ও কবি হিজল জোবায়ের। প্রিয় পাঠকদের জন্য সে আড্ডার প্রথম পর্ব (‘কবিতা কেন জনপ্রিয় নয়?’)তুলে ধরা হলো।
প্রিয়.কম: কবিতা কেন জনপ্রিয় নয় বা কবিতা কেন জনমানুষের কাছে যাচ্ছে না?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবিতা জনপ্রিয় না সে বিষয়ে কোন গবেষণা আছে কি? যদি না থাকে তাহলে আমার মতো করে সেটা ব্যাখা করতে পারি।
শামীমুল হক শামীম: কবিতার বাজার চিন্তা করলে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কবিতা জনপ্রিয় না। সাহিত্যের বিশ্ব বাজার বলি আর বাংলাদেশের বাজারের কথাই বলি না কেন, গল্প-উপন্যাসের চেয়ে কবিতার বই কম বিক্রি হয়।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: বাজারের চিন্তা করে কিন্তু কবিতার জনপ্রিয়তা বিবেচনা করা যাবে না। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় বাজারের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ইউরোপে বিভিন্ন লবিস্ট গ্রুপ আছে যারা লেখকের কাছ থেকে লেখা নিয়ে প্রকাশকদের কাছে দেয়, প্রকাশকরা সম্পাদনা করে সেটা বাজারজাত করে। বাজারজাত করণের ক্ষেত্রেও তাদের পলিসি আছে। একটা বই প্রকাশের আগে প্রি-প্রোডাকশনেও তারা প্রচুর খরচ করে।যেমন আমাদের একজন বাঙালি লেখক পেঙ্গুইন প্রকাশনী থেকে একটা বই প্রকাশ করেছে, যার প্রি-প্রোডাকশনেই ১৮ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়েছে তাকে। অর্থাৎ ফেভারিট প্রকাশনী থেকে যখন বই বের করা হয় তখন বই প্রকাশের পূর্বেই শুধু বাজারজাতকরণের লক্ষ্যেই তারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে।যে কারণে তাদের বই বিশ্ব বাজার দখল করে।কিন্তু আমাদের এখানে সেরকম প্রফেশনাল প্রকাশক নেই। যদিও দুয়েকটি প্রকাশনীর উল্লম্ফন ঘটেছে।যেমন হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশকসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা আছে, যারা বইয়ের বাজাতকরণে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এগুলো কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র।ব্যাপক আকারে আমাদের এখানে তা নেই।
আজ যদি কবিতাকে প্রোডাক্ট হিসেবেও নিই, তার কি কোনো মূল্যায়ন আছে? আমাদের এখানে একজন প্রকাশক বিশজন কবির কবিতার বই প্রকাশ করছে। তাদের বাছ-বিচার থাকলে তারা এতো কবিতার বই প্রকাশ করতে পারতো না। ইউরোপে বা অন্যান্য দেশে বই প্রকাশের আগে তার লবিস্টরা বইয়ের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে। বিভিন্ন প্রফেসর, গবেষকদের দ্বারা সেগুলোর রিভিউ করে তা মিডিয়ায় প্রকাশ করছে।সেটার মূল্যমান বাড়ানো হচ্ছে।আমাদের এখানে এমন কোনো নজির আছে কি? নেই।
মজিদ মাহমুদ: আমরা বরং বাংলা কবিতার ঐতিহ্যগত জায়গাটাকে ধরে জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গে কথা বলতে পারি।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ : বাংলা কবিতার ঐতিহ্যগত জায়গা থেকে চিন্তা করলে কবিতার জনপ্রিয়তা যে নেই সেটার কোনো গবেষণা কিন্তু আমাদের নেই।
শামীমুল হক শামীম: আমার মনে হয় সুদীপ্ত সাইদ ঐ অর্থে জনপ্রিয়তার কথা বোঝাতে চায় নি। ‘কবিতার পাঠকপ্রিয়তা কম’ এটা সে বোঝাতে চাচ্ছে কিনা? কবিতার পাঠকপ্রিয়তা এক জিনিষ আর জনপ্রিয়তা আরেক জিনিষ। পাঠকপ্রিয়তা যদি কম বোঝানো হয় তাহলে আমি বলবো যে, কবিতার জন্মলগ্ন থেকেই কবিতার পাঠকপ্রিয়তা কম। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যে, এই সময়ে এসে কবিতার পাঠকপ্রিয়তা কম বা পাঠক কবিতা পড়ছে না তা কিন্তু নয়, শুরু থেকেই কবিতার পাঠক কম ছিলো। প্রতি যুগে যুগেই দেখা গেছে, কবিতার পাঠক প্রিয়তা কম।
কারণ কবিতা এমন একটি বিষয়, এমন একটি মাধ্যম, যেটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে। কবিতা বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় থাকে, আবার মানুষের আবেগকেও ধারণ করে। এই দুটি জায়গাকে ধারণ করেই কবিতা শিল্পের একটা উত্তুঙ্গ জায়গায় চলে যায়। এ কারণে গণমানুষের কাছে কবিতার গ্রহণযোগ্যতা কম।
সুদীপ্ত সাইদ খান: আমার করা প্রশ্ন নিয়েই যেহেতু অনেকে সন্দিহান পোষণ করছেন আবার এ সংক্রান্ত কোনো গবেষণা আছে কিনা সেটাও জানতে চেয়েছেন।বিষয়গুলো পরিস্কার করার জন্য আমি একটি তথ্য উপস্থাপন করে আমার প্রশ্নটি আবারো উপস্থাপন করছি।পূর্বে ম্যাগাজিন ও প্রিন্ট পত্রিকার সঙ্গে জড়িত থাকলেও ২০১৩ সাল থেকে আমি অনলাইন গণমাধ্যমে কাজ করছি।এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অনলাইনে চাকুরীর সুবাদে বিনোদন, সাহিত্যসহ নানা ধরনের লেখাই আমি পাবলিশড করে আসছি। প্রিয়.কমেও সম্প্রতি সাহিত্য বিষয়ক লেখা পাবলিশড করছি। অনলাইনে যেহেতু পাঠক লোকানোর কোনো উপায় নেই বা বেশি বলারও উপায় নেই। সেক্ষেত্রে গল্পের পাঠক বেশি না কবিতার পাঠক বেশি বা কতজন কবিতা পড়েন সেটা ভালোভাবেই বোঝা যায়। আমার অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে চাই যে, অনলাইনে একটা গল্প প্রকাশ করলে আমি যত পাঠক পাই, সে তুলনায় কবিতার পাঠক কম।আমি জানতে চাচ্ছি কবিতার পাঠক কম হওয়ার কারণ কি? একসময় তো কবিতাও জনপ্রিয় ছিলো। কিন্তু সম্প্রতি কেন কবিতা গণমানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে না? আমি একে একে সবার কাছে এই একটি প্রশ্নেরই উত্তর চাচ্ছি।
মজিদ মাহমুদ: আমাদের রিডার বাংলা কবিতাকেন্দ্রিক।আপনার আকাঙ্খাও বাঙলা কবিতা। সেক্ষেত্রে আমরা যদি প্রাচীণ দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো- কবিতা হচ্ছে গণের কবিতা, ম্যাসের কবিতা্। তার মানে হলো তখন মানুষ লেখাপড়া কম জানতো। তখন সমাজের যে সকল মানুষ লেখাপড়া জানতো তারা কবিতা চর্চা করতো এবং তারা এটা লিখে রাখতো বা মনে রাখতো। এরপর এটা গণমানুষের কাছে দৃশ্যকাব্য হিসেবে উপস্থাপন করতো। অর্থাৎ কবিতা সেসময়ে বিনোদনেরও একটা মাধ্যম ছিলো। এভাবেই চলেছে ফোর্ট উইলিয়ামের আগ পর্যন্ত। মানে উনিশ শতক পর্যন্ত মৌখিকভাবেই কবিতা মানুষের কাছে পৌছাত।
কিন্তু ত্রিশের দশক তথা আধুনিক সময়ে এসে কবিতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেল এবং কবিতায় গণমানুষের কথা উপেক্ষিত হলো। যেহেতু কবিতা আর গণমানুষের কথা বলছে না, কবি তার ব্যক্তিকেই উপস্থাপন করছেন কবিতায়।সে কারণে গণমানুষও কবিতাপাঠ থেকে সরে গেল।
এ কারণে ত্রিশের দশকে এসে কবিতার মতো জনপ্রিয় মাধ্যমটার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলো যে কবিতা গনবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। যা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু একটা গ্রন্থই লিখলেন ‘কবিতার শত্রুমিত্র’ নামে। বইতে বুদ্ধদেব বললেন, কবিতার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা উঠেছে যে কবিতা পাঠক পড়ছে না, এই রিডারটা কে? এই পাঠক আগেও কবিতা পড়েছে কিনা? আর যদি না পড়ে থাকে তাহলে সে এখনো পড়বে না। তখন বুদ্ধদেব বসু বিক্ষিপ্ত হয়ে বলেছেন, যে কবিতা বোঝে না বা পড়ে না সে আগেও কবিতা পড়ে নি।তিনি অভিযোগকারীকে নাকচ করে দিয়ে জবাব দিচ্ছেন যে, কবিতা পড়তে হলে পাঠকেরও একটি ঐতিহাসিক পটভূমি থাকতে হবে। পড়ার অভ্যাস থাকতে হবে এবং শুরু থেকে কবিতা পাঠের মাধ্যমে আজকের কবিতা পর্যন্ত আসতে হবে।
তো সুদীপ্ত যে পরিসংখ্যান দিলো সেখানে গল্পের তুলনায় কবিতা কম পড়া হচ্ছে সে তুলনাটা ঠিক নয়। আমরা তো দেখছি কবিতা ব্যাপক সংখ্যক লোক পড়ছে। সেক্ষেত্রে যদি দর্শনের লেখা ছাপেন সেটা আরও কম লোক পড়বে।
শামীমুল হক শামীম: সাহিত্যের অন্যান্য শাখার প্রেক্ষিতে বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে যদি বলি, তাহলে কবিতাই সাহিত্যের আদি নিদর্শন। মজিদ মাহমুদ-এর কথার সূত্র ধরেই বলছি, আগে কবিতা মুখে মুখে প্রচলিত ছিলো, কবির লড়াই হতো, স্বভাব কবি ছিলেন, পুঁথি পাঠ হতো। এভাবেই কবিতাচর্চা হতো।ফোর্ট উইলিয়ামের আগ পর্যন্ত কবিতার প্রসার এভাবেই হয়ে এসেছে।
কিন্তু ত্রিশের দশকে এসে বাংলা কবিতা আত্মগত বিষয় হয়ে গেছে।তার নিজস্ব কেন্দ্রের বলয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কারণে কবিতা তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছে এটা আমি মনে করি না। কারণ সাধারণ মানুষের সামনে যখন কোনো কবিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় যে উনি কবি, তখন কিন্তু সে সম্মানের সঙ্গেই মূল্যায়ন করেন। সাধারণ মানুষ এখনো সেই সম্মানটা করেন কবিদের।এর মানে সমাজে আমাদের সামাজিক মূল্যায়নটা কিন্তু এখনো অবমূল্যায়নের পর্যায়ে চলে যায় নি। আর কবিতা সর্বসাধারণের হবে বা পাঠকপ্রিয়তা পাবে-এটা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ যে কবিতা পড়ে না তার পক্ষে সাম্প্রতিক কবিতা বোঝা সম্ভব নয়, যে ফিজিক্স পড়ে নাই তাকে ফিজিক্স পড়তে দিলে সে বুঝবে না। কবিতাও এরকমই।
পাঠক তৈরি হওয়ারও একটা বিষয় থাকে। হুট করে একটা কবিতা পড়ে পাঠক বুঝে ফেলবে সেটা কিন্তু নয়। কারণ কবিতা হচ্ছে শিল্পের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। কবিতার পাঠক আগে যেমন ছিলো এখনো তেমনি আছে, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে।
কামরুজ্জমান কামু: আগে যেহেতু কবিতার জনপ্রিয়তা ছিলো-এমন বিবেচনায় এনে এটা বলা যায় যে আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে কবিতার পাঠক কমেছে। আগে কবিতার চর্চা বেশি ছিলো। তার মানে আগে কবিতা সার্বজনীন বিষয় নিয়ে রচিত হতো- যেমন ধর্ম নিয়ে। অর্থাৎ আগে কবিতা এমনসব বিষয় নিয়ে রচিত হতো যা পাঠককে এমনিতেও শুনতে হতো, পড়তে হতো। পরে যখন ব্যক্তির মন বড় হয়ে উঠলো তখন একেক জনের মনে একেক ধরনের কবিতা আসলো। একেকজন একেকভাবে কবিতা লিখলো। এভাবেই কবিতা অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে পড়লো। এই সব কারণে হয় তো কবিতার জনপ্রিয়তার জায়গাটা হারিয়ে গেছে।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: আমার কাছে এই প্রশ্নটাই বিদঘুটে মনে হয়েছে।কারণ আমি মনে করি জনপ্রিয়তা জিনিষটাই শিল্পের জন্য অশ্লিলতার সামিল।এটা একটা অশ্লিলতা।
সুদীপ্ত: অশ্লিলতা কেন?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কারণ শিল্পকে কেন জনপ্রিয় হতে হবে।শিল্পে একটা এলিটিসিজম থাকে। কবিতাকে বলা হয় ফিলোসফি অব দ্য অল রাইটিংস।সকল লেখার দর্শন হচ্ছে কবিতা।আদিতে সকল কিছুই কবিতায় লেখা হতো। এমনকি পদার্থবিদ্যাও লেখা হতো পোয়েটিক পদ্ধতিতে।এখন কবিতার মতো একটা সুপ্রিম ফর্ম অব আর্টকে যদি পারফর্মিং আর্টের মতো জনপ্রিয় করে তুলতে চাই তাহলে কবিতার পক্ষে সেটা সম্ভব না।সেভাবে কবিতা জনপ্রিয়তা পাবে না।
সুদীপ্ত: কিন্তু অনেক কবির কবিতাই তো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। জনপ্রিয় কবিতার অসংখ্য উদাহরণ তো দেওয়া যাবে। সর্বশেষ কবি হেলাল হাফিজের কবিতাও কিন্তু প্রচুর জনপ্রিয়…
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবিতারজনপ্রিয়তা যে একেবারে নেই তা না। জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে আমরা মধুসূদনকে টানতে পারি, নজরুলকে টানতে পারি, রবীন্দ্রনাথকে টানতে পারি। আমরা জসিম উদ্দীনের কবর কবিতার কথা বলতে পারি, আমরা যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কাজলা দিদি কবিতার কথা বলতে পারি।
‘দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান’ এই পঙতি কে না জানে? বা আধুনিক কবিতার কথায় যদি বলি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতা এখনো জনপ্রিয়।তাঁর ‘আকাশলীনা’ বা ‘আবার আসিবো ফিরে’ কবিতাটি গ্রাম বাংলার মানুষ কি জানে না? জানে। আর হেলাল হাফিজের ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কে না জানে? শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’, নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা শব্দটি যেভাবে আমাদের হলো’ কবিতাটির কথাও বলা যায়। কিন্তু এই কবিতাগুলোর একটাও ভালো কবিতা না। অধিকাংশ কবিতাই আর্ট হিসেবে খারাপ। কিন্তু জনপ্রিয়তায় ভাল। এখানে আর্টের ক্ষেত্রে জনমানুষের সম্পৃক্ততা আছে যেমন তেমনি একটা বিচ্ছন্নতাও আছে। তা যে অর্থে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি লেখা, আমি মনে করি আমাদের স্বাধীনতা যতদিন থাকবে ততদিন এই কবিতাটি যুগের পর যুগ ধরে পঠিত হবে।
কামরুজ্জামান কামু: অর্থাৎ সে একটি জনপ্রিয় ইস্যুকে নিয়ে কবিতা লিখেছে।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: হ্যাঁ, জনপ্রিয়তা ইস্যু নিয়ে লেখা কবিতা।শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা যদি বিবেচনা করি, তাহলে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার চেয়ে শামসুর রাহমানের অন্য অনেক কবিতা বেশি শিল্প সম্মত।যে সকল কবিতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে তাদের বেশিরভাগই আর্টের সুপ্রিম ফর্মকে ধারণ করে না।
জনপ্রিয়তাহীনতার প্রশ্নে যদি আসি তাহলে বলতে হয়, যুগ যখন আধুনিক হতে লাগলো, কনজুমার বাড়তে লাগলো, মানুষ যখন আরবান হতে লাগলো তখন তার ভ্যালু চেইনটা পুরোপুরি ভেঙ্গে গেল। অর্থাৎ বিশ শতকে যে ভ্যালুটা ছিলো সেটা ভেঙে গেল।এখন রাজনীতি কি জনপ্রিয় ইস্যু? অর্থনীতি কি জনপ্রিয় ইস্যু? না। আমরা যদি একের পর এক সমাজ রাজনীতির কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই সমাজ এখন ডিভাইডেড। আমার নামের আহমেদ একটা রূপ, স্বপন আরেকটা রূপ। করপোরেট এখানে ব্যক্তিটাকেই ডিভাইডেড করে দিলো।পুঁজিতন্ত্র কিন্তু ব্যক্তির মধ্যে লড়াই তৈরি করে দিয়েছে এবং ব্যক্তিকে ভেঙে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, যে সময়ে কবিতা জনপ্রিয় ছিলো, আমি যদি আদি যুগের কথা বলি, মধ্যযুগের কথা বলি, তাহলে তখন কিন্তু বাণীকেন্দ্রিক কবিতালেখা হতো।কিন্তু আধুনিক কবিতা এসে দেবদেবীর সেই বাণীকেন্দ্রিক কবিতাকে দূরে ঠেলে দিলো। সেখানে স্থান পেল সমুদ্র, জাহাজ, প্রকৃতি। সমুদ্রে জাহাজ ভেসে ভেসে দূরে হারিয়ে গেল-আধুনিক কবিতার জন্ম এমন ইমেজ দিয়েই।অর্থাৎ একাকীত্ম, নিঃসঙ্গতা এসে কবিতায় ভর করলো।এইটা তো সবসময় জনমানুষের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মিলবে না। যে অর্থে আমরা কবিতার জনপ্রিয়তা বোঝাতে চাচ্ছি সে অর্থে কবিতা জনপ্রিয়তা পেল না। শুধু কবিতা নয়, পেইন্টিং থেকে শুরু করে প্রায় সব শিল্পই সেভাবে জনপ্রিয়তা পায় নি।গান পারফর্মিং আর্ট হিসেবে জনপ্রিয় হতে পারে সে অর্থে কিন্তু গীতিকার জনপ্রিয় না।কিন্তু গান যিনি গাইতেছেন তিনি কিন্তু পপুলার।এইটা একটা ট্রাজিক ঘটনা বটে। আবার কবিতার ক্ষেত্রেও দেখা যায় আবৃত্তিযোগ্য কবিতাগুলো জনপ্রিয়তা পায় বেশি। এখানেই আর্টের সঙ্গে জনপ্রিয়তার একটা বিরোধ আছে। সে কারণেই আমি বলেছি, কবিতা কেন জনপ্রিয় না প্রশ্নটি বা কবিতার জনপ্রিয়তা একটা শিল্পীর কাছে অশ্লিলতার সামিল হয়ে পড়ে।
আর সমাজের বিচ্ছিন্নতার সাথে এই কবিতারও একটা যোগ আছে।এটা ঠিক, আর্টের একটা জায়গা হচ্ছে সর্বমানবীয় কল্যাণ। এমনকি কবিতাও। তার ফর্ম, কনটেন্ট যাই হোক না কেন?স্টাইল যাই হোক না কেন? যদি সে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার জায়গা ধারণ করতে না পারে তখন এতে একটা উল্লম্ফন ঘটে। যে উল্লম্ফনটা মূলত বাংলা কবিতায় ত্রিশ দশক ঘটিয়ে গেছে। অর্থাৎ আপনি বলতে পারেন যে, ত্রিশ দশক বাংলা কবিতায় একটা সর্বনাশও ঘটিয়ে গেছে।
সুদীপ্ত: কিভাবে?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কারণ আমরা এখন বাংলা কবিতা বলতে যেটা বোঝাচ্ছি সেটা হচ্ছে ইউরোপীয় কবিতার ভাবানুবাদ। খেয়াল রাখতে হবে। আমার বাংলা ছিলো অন্য। বাংলার মরমীবাদ, বাংলার যে সুফিইজম, বাংলার যে বাউলিয়াপনা-এইসব ভাব কবিতায় পাবেন না। ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডব কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত। ইংরেজি শিক্ষিত এই পঞ্চপাণ্ডব কবিতাকে নিয়ে যেতে চাইলো ইউরোপের ভাবধারায় এবং তারা প্রকাশ্যে কবিতার একটা এলিটরূপ দিয়ে দিলো।ফলে কবিতাকে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন করে দিলো তারা। জীবনানন্দ এদের মধ্যে একটু ব্যতিক্রম, কারণ সে গ্রাম বাংলার ভাবধারাকে ইউরোপীয় ভাবধারার সঙ্গে মিশ্রিত করতে পেরেছিলো এবং তার সেই শক্তিটা ছিলো। এই কারণে তাকে কিছুটা ছাড় দেওয়া যায়, এ ছাড়া বাকি যারা আছে তাদের কিন্তু ছাড় দেওযা যায় না। কারণ তারা পুরোপুরি কবিতার ঐতিহ্যকে ভেঙ্গেচুরে ছেড়ে দিলো। আমরাও পরবর্তীতে এটা ভেবে দেখলাম না। ব্যাপক কোনো আলোচনার ক্ষেত্রে বা গবেষণার ক্ষেত্রে গেলাম না। আমরাও তাদের ভাবধারাটা মেনে নিলাম। কারণ আমরাও এখন ইংরেজি জানি, আমরাও এখন ভ্রমণ করতে জানি।আমরা এখন করপোরেট স্টাইলে চলতে জানি।ফলে আমার মানসলোক ঐদিকে চলে গেল। ফলে আঠার উনিশ শতকে আমার বাংলার সীতালং শাহ যে গানটা গাইলো- ‘সূয়া উড়িল উড়িল জীবেরও জীবন’ ঐ মর্মার্থটা কিন্তু বাংলা কবিতায় পাওয়া যায় না।
‘আমি ওই চরণে দাসের যোগ্য নই’ এই যে দাসত্ব, এটা কিন্তু ইউরোপীয়ান স্লেভারি নয়, এই দাসত্ব হচ্ছে সমর্পণ-আমি সঁপে দিলাম পরমের আকাঙ্খায়। ‘মানুষ ধর, মানুষ ভজ, শুন বলি রে পাগল মন’ কেন এই ভাবধারার মতো কোনো কবিতা পাওয়া যায় না?এটা তো রীতিমত বিস্মিত হওয়ার মতো।
‘শিমুলের তুলা বাতাসে উড়ে রে/ দয়াল সেইমতন উড়াইলা আমার প্রাণ’, পরাণ ফকিরের এরকম গানের মতো বাংলা সাহিত্যে এখন কোনো কবিতা আছে? কবিতার জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে যদি বলি আমার জনসাধারণের জন্য ঐ রকম মরমী বা সুফি কবিতাও কিন্তু পাই না, বাউলিয়াপনাও না। লালনকে রবীন্দ্রনাথ ধারণ করলেন কিন্তু ঐ রকম আর কোনো মণীষা তো তাকে ধারণ করতে পারলেন না। ফলে আমাদের মনে হয়েছে এগুলো নিয়ে পুনর্ভাবনার বিষয় আছে। শুধু জনপ্রিয়তার ভাবনায় নয়, আমার ভাবধারার প্রশ্নেও।
আমরা আজ এখানে বসে যে জীবন যাপন করতেছি সে তুলনায় আমার নেত্রকোনার গ্রামের একজন মানুষের ভাবধারা কী? গ্রামের একজন নিরক্ষর মানুষের কাছে কিভাবে কবিতাকে পৌঁছে দেওযা যায়? যেখানে একজন জনপ্রিয় এমপিও এলাকা থেকে দূরে চলে গেলে তার জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, সেখানে গ্রামে গঞ্জের মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে কবিতাকে পৌছে দেওযা যায় না।তো এই ভাবধারার মধ্যেই তো আমরা নেই। এই ভাবধারা থেকেই তো আমরা সরে এসেছি।
কামরুজ্জমান কামু: মানে অভিমুখটাই পাল্টে গেছে। জনের কাছে কি করে যাবে, সেই ভাবনাটাই তো আমাদের নাই। আপনি তো জনের দিকে তাকাইয়া লিখতেছেন না। আপনার অভিমুখটাই তো পশ্চিম দিকে। এখনো যে আমরা ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শিখাইতেছি সেটাও একই রকমের।
হিজল জোবায়ের: সুদীপ্ত, আপনার প্রশ্নটা এত বড় পরিসরের যে স্বপন ভাইয়ের কত কত জায়গা থেকে ঘুরে এসে এই একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো। যে কিওয়ার্ডগুলো আপনার এখানে এলো, তা হচ্ছে-পাঠকপ্রিয়তা বা জনবিচ্ছিন্নতা।কিন্তু এসবের উত্তর দেওয়ার আগে জানা দরকার যে কবিতা পাঠকপ্রিয়তার দায়বোধ করে পাঠকপ্রিয় হবে কিনা? এই প্রশ্ন জানার আগে আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন যে, কবিতা কেন পাঠকপ্রিয় বা পাঠকপ্রিয় না?
মজিদ ভাই বা কামু ভাই কবিতার ওরালিটির কথা বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ওরালিটি থেকে কবিতা লেখ্যরূপে আসার পর তা ভিন্ন মাধ্যমে প্রবাহিত হবে।ধরেন, গণমানুষের কথাও যদি আমার কবিতায় এখন লেখি সেটা ততটা জনপ্রিয় হবে না যেভাবে ওরাল ট্রাডিশনের ভেতর দিয়ে কবিতা জনপ্রিয় হয়েছিল। তো এখানে লেখার ফর্মটা বা মিডিয়ামটা একটা ফ্যাক্ট।
সত্তুরে, আশিতে বা নব্বইয়ে আবৃত্তিযোগ্য অনেক কবিতা লেখা হয়েছে। সেগুলোতেও অনেক ঘরানা আছে। এখানে এই প্রশ্ন আসতে পারে, কোন ঘরানার কবি ফিল করে যে সে জনপ্রিয় হবে। ইন্ডিয়ায় এখনো সুবোধ ঘোষ বা সৃজিতরা যথেষ্ট পপুলার। কারণ মমতা ব্যানার্জি তাঁর রাজনৈতিক সভায় একজন কবি রাখতেছেন যিনি ঐ রকমের কবিতা রিসাইট করতেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা যত লোক শুনে সুবোধ সরকারের কবিতাও ততলোক শুনে। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র।
কবিতা আমজনতার না হওয়ার কারণ হচ্ছে কবিতা আর্টের গভীরতম একটা জায়গা। যেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারে না। প্লেটো অনেক আগেই কবিদের তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে বের করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের ডিসিপ্লিন থেকে তাকে বের করে দিয়ে জনগণের কাছ থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর একটা পৃথিবীতে কবি হচ্ছে সেই লোক যে হচ্ছে যেসাস।সারা পৃথিবী মিথ্যা হয়ে যেতে পারে কিন্তু একজন কবি একাই সত্য। পরবর্তীতে যেসাসের সত্যকে আবিষ্কার করে অনেকেই তার অনুসারী হয়েছে।কিন্তু তার সময়ে ঐতিহাসিক ভাবেই যেসাস জনবিচ্ছিন্নই ছিলো।
কবিতা এমন গুঢ়তরভাবে কথা বলে যে এটাকে আসলে সবাই ধারণ করতে পারে না। ফলে কবি বা কবিতাও ঐ দায় অনুভব করে না যে তাকে সবার ধারণক্ষম হতে হবে এবং পাঠকপ্রিয়তা পেতে হবে। এরপরেও সেই ধারণার মধ্যে থেকেও কবির কবিতা অনেক সময় জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রবেশ করে।
কবিতার ওরাল ঐতিহ্যের জনপ্রিয়তার সময়কার কথা বিবেচনা করে এখন যদি জনগণের কথা আমি কবিতায় বলিও; ঐ ধরনের পপুলারিটি এখন সম্ভব না। কামু ভাইয়ের কবিতার মধ্যে কিন্তু গণমানুষ আছে, তাঁর কবিতায় কিন্তু ঐ বিষয়টা আছে কিন্তু কামু ভাই বিখ্যাত হয়েছে তাঁর গানের মাধ্যমে।কারণ গানটা ওরাল ট্রাডিশন, ওটা পারফর্মিং আর্টে চলে গেছে। কিন্তু একই লেখা যদি তার বইয়ে থাকতো তাহলে তা ঐ লেভেলে পপুলার হতো না।কারণ এটা একটা ফর্ম।এই ফর্মটাই এই প্রশ্নটা ফেস করতে চায় না। এরপরের যে বিষয়টা আসলো ত্রিশের পরও কিন্তু মানুষ কবিতা পড়েছে। মুসলিম মিডল ক্লাস কবিতা পড়তো।
ডে বাই ডে কবিতার পাঠক আরও কমে যাচ্ছে। এই কমে যাওয়ার কারণগুলোর জন্য কবিতা এককভাবে দায়ী না।এটার জন্য আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা দায়ী, এটার জন্য আমাদের কালচার দায়ী।এটার জন্য ওয়ার্ল্ড দায়ী।
সেই সাথে আমাদের প্রত্যেকের রুচিগুলা যে পরিবর্তিত হচ্ছে- আমরা ভাবছি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এটা তো করানো হচ্ছে। সেসব বিষয়ে আমাদের সচেতনতা নাই বলে আমরা ক্রমাগত অন্যান্য ফর্মের দিকে চলে যাচ্ছি। আর ত্রিশের দশক থেকে একটা বড় অবরোহ শুরু হয়েছে এটা আমি নিজেও ফিল করি। যে একটা বড় অবরোহন তৈরি হয়েছে।শামসুর রাহমানের কবিতা যেভাবে আবৃত্তির মাধ্যমে জনপ্রিয়, আল মাহমুদের কবিতাগুলো কিন্তু সে উপায়ে জনপ্রিয় না। সে যেন আরেকটা কি উপায়ে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। বরং আবৃত্তিতে আল মাহমুদ-এর কবিতা তুলনামুলকভাবে কম। কেন জনপ্রিয় হলো? কারণ আল মাহমুদের মধ্যে আমাদের সোসাইটির যে রিফ্লেকশন পাওয়া গেছে আমরা সহসা অন্য কোন কবির মাঝে সে রিফ্লেকশন পাই নি।
তো ত্রিশ তাদের মতো করে কিছু কাজ করেছে। রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল থেকে ডিফরেন্ট হওয়ার জন্য তারা ঐ কাজ করছে। তারা সেসময়ে পার হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তীকালের যারা তারা ঐ ধারাকে ফলো করতে গিয়ে একটা গড্ডালিকা প্রবাহ তৈরি করে ফেলেছে।
এরপর সত্তরের দশকে এসে কিছু কবিতা জনপ্রিয় হলো। কি ধরনের কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে? সেগুলো হলো মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা। তারপরপর হয়তো কিছু রোমান্টিক তরল কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে। সেগুলোকে বেসিক কবিতার স্বীকৃতি আমি মানসিকভাবে দিতে চাই না।ওটা হয়তো অন্য ঘরানার কবিতা। কিন্তু ওটাকে আমি সেভাবে মূল্যায়ন করতে চাই না।
এরপর আশিতে এসে আরও একটা অবক্ষয় ঘটেছে বাংলা কবিতায়। মানে সত্তরের আগ পর্যন্ত সেটা বাংলা কবিতা ছিলো। কিন্তু সত্তরের পর আশির দশকে এসে ওটা বাংলাদেশের কবিতা হয়ে গেছে। সেইখানে অন্য বিবেচনা চলে আসে। কারণ আল মাহমুদ, হাসান, জীবনানন্দের কবিতায় আমরা যে বাংলাদেশকে দেখতে পেতাম সেটা কিন্তু বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলো কিন্তু সেখানে আব্দুল মান্নান সৈয়দ বা শিকদার আমিনুল হক যে ধরনের কবিতার চর্চা করতো সেগুলো আশিতে এসে আবার দানা বাঁধতে শুরু করলো। এগুলো এলো পশ্চিমবঙ্গ হয়ে। এর আগে ছিলো ইউরোপ পশ্চিম আর এবার হলো পশ্চিমবঙ্গ পশ্চিম। এই দুই পশ্চিম বাংলাদেশের কবিতায় প্রবেশ করার ফলে বাংলাদেশের কবিতা যে ধারাবাহিকতায় ফিরতে পারতো সেদিকে না এসে তার ধারাবাহিকতা অন্যদিকে চলে গেছে।
ওরাল ট্রাডিশনে আমরা যে লেখ্যরূপ গ্রহণ করবো সেটাতে অনেক বেশি পাঠকের কাছাকাছি থাকা যায়। ঠিক আছে, কিন্তু এই সময়ে এসে আমরা কি করেছি?অনেক টেকনিক ফেলে দিয়েছি।আমরা মনে করেছি ছন্দ, গীতলতা এই বিষয়গুলো ব্যাকডেটেড।মডার্নিজম, পোস্ট মডার্নিজম, সুররিয়ালিজম-এগুলো আমাদের ফিল করিয়েছে যে এগুলো স্মার্ট। ফলে আমরা কি করেছি? আমরা বাংলা কবিতার ঐতিহ্যগত ঐ টুলসগুলো ফেলে দিয়েছি। ফেলে দেওয়ার ফলে কি হয়েছে কবিতা অনেক অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে গেছে।
ফিরোজ এহতেশাম: আমার তো মনে হয় কবিতা আনুপাতিক হারে একই রকমের জনপ্রিয়তায় আছে। ঐ সময়ে জনপ্রিয় বেশি ছিলো ওরাল কবিতা।এটা ছাড়া কোনো উপায়ই ছিলো না। কারণ যা বলবেন তাই কবিতার মতো করে বলতে হবে। আর সেসময়ে দেব-দেবী ছিলো।সেগুলো নিয়ে কবিতা লেখা হতো। তো দেব-দেবী তো জনমানুষেরই একটি বিষয়।এরপর থেকে দেব-দেবীকে ফেলে দিয়ে যখন ব্যক্তির উত্থান ঘটলো তখন কবিতার জনপ্রিয়তা কমে গেল।এখন অবশ্য কবিতা প্রকাশের মাধ্যম চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। এখন ফেসবুকেও কবিতা দেওয়া যাচ্ছে। তো কবিতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়ার আগে যখন ধর্ম নিয়ে কবিতা লেখা হতো বা প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লেখা হতো তখন সবাই কমিউনিকেট করতে পারতো। সেসময়ে এটা কবিতা জনপ্রিয় হওয়ার এটা একটা বড় কারণ ছিলো। কিন্তু ব্যক্তির আগমন বা তার অ্যাবস্ট্রাক্ট ভাব প্রকাশের ফলেই কবিতা ক্রমান্বয়ে দূরে সরে গেছে জনমানুষের কাছ থেকে।
মজিদ মাহমুদ: আসলে সেসময়ে কবিতা দেবতাকেন্দ্রিকও নয়, নানামুখীই ছিলো। আবার একটা কবিতা কিন্তু তখন নাটকও ছিলো।যেমন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এটা কিন্তু একই সাথে কবিতা আকারে প্রকাশিত হচ্ছে, নাটক আকারে প্রদর্শিত হচ্ছে আবার একই সঙ্গে গল্প বা উপন্যাস আকারেও সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।
কামরুজ্জামান কামু: একই সঙ্গে গান আকারেও তা গাওয়া হচ্ছে।
হিজল জোবায়ের: মানে লেখ্যরূপের আগ পর্যন্ত সবগুলো কিন্তু একই ছিলো।
মজিদ মাহমুদ: মানে কবিতা সাহিত্যের সবগুলো শাখারই সুবিধা পাচ্ছিল। আরও একটি সুবিধা পাচ্ছিল সেটা হচ্ছে যারা নিরক্ষর যারা পড়তে বা লিখতে পারতো না তাদের কাছে সমাজের কেউ না কেউ একজন তা উপস্থাপন করতো। এর ফলে সমাজের সর্বস্তরে কবিতাটা পৌঁছে যেত। পরে যে মাধ্যমগুলোতে পরিবর্তীত হয়েছে যেমন কবিতার চেয়ে কিন্তু উপন্যাসের পাঠক বেশি। উপন্যাস পড়তো কিশোর কিশোরী বা তরুণ তরুণীরা। কিন্তু এই পাঠকরা কিন্তু এখন ভিজুয়াল মাধ্যমে শিফট করেছ। যার কারণে যদিও বলা হচ্ছে উপন্যাস একটি জনপ্রিয় শিল্প কিন্তু সেটা কিন্তু মুষ্টিমেয় কিশোর উপন্যাসের ক্ষেত্রে। তারপর রিডাররা নানা মাত্রায় বিভক্ত হয়ে গেছে।ব্যক্তি সমাজের নানা তাগিদেই এই বিভক্তি ঘটেছে। ধরেন আপনি যে রিডারদের কাছে এই আড্ডা ধারণ করতে চান, তারা কিন্তু সবগুলো মাধ্যমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেটা হয় তো সংখ্যায় কম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকেও যদি ইনক্লুড করতে চান তাহলে কবি বা পাঠকের একটা ব্যাপার থাকে।কিন্তু আমরা যে আলোচনাতেই যেতে চাই না কেন সব আলোচনায় জেনারাইলেজেশনে থেকে যায় অ্যাবসলিউডলি কোনো আলোচনায় আমরা করতে পারি না। এক্ষেত্রে ত্রিশ বা আশির দশক তথা যে দুই পশ্চিমের প্রভাবের কথা বলা হয়েছে এটা ঠিক নয়।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কিন্তু আশির দশকে এসে কবিতা এক ধরনের বাঁক নিলো। এখন তো ‘গরু হাওযায় উড়ে যাচ্ছে’ এমন ইমেজ হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণ পাঠকের সাথে এর সম্পর্ক কোথায়।এসব কারণে পাঠকের কাছে কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে উঠলো।কবিতার জনবিচ্ছিন্নতার প্রশ্নে হিজল যে দুই পশ্চিমের কথা বলেছে।ত্রিশ এবং আশির দশকে কবিতার যে উল্লম্ফন ঘটেছে সেই উল্লম্ফনের কারণেই কবিতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কবিতা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো এবং সেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা চলে এলো তখন পাঠক কবিতা পড়বে কেন? আগে যেমন ধর্মের কথা বলা হতো, সমাজের কথা বলা হতো তখন তো কবিতা জনপ্রিয় হয়েছেই।এখন তো সেসব নেই।
শামীমুল হক শামীম: তুমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছো যে ত্রিশের পর আবার আশিতে এসে যে শিফটিং ঘটেছে সেটা কিন্তু আশির ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই সেই উল্লম্ফনটা কিন্তু এখন পর্যন্ত বিস্তৃত।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: হ্যাঁ, এটা সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিস্তৃত।
হিজল জোবায়ের: সুদীপ্ত সাইদের প্রশ্নটা কিন্তু এখানেই।
শামীমুল হক শামীম: শেষ করার আগে বলে নেই, সুদীপ্ত সাইদ এখানে যে প্রশ্নটা উপস্থাপন করলো এটা কিন্তু সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আচ্ছা ইন্ডিভিজুয়ালি আমার একটা বই যদি এক’শ কপি বিক্রি হয় আমি কি চাইবো না যে আমার কবিতার বই এক হাজার কপি বিক্রি হোক।এই আকাঙ্খা তো সব লেখকের মধ্যে সব শিল্পীর মধ্যেই থাকে।যে আমার গানটা ৫ হাজার মানুষ শুনুক বা আমার কবিতার বইটা ৫০০ বা এক হাজার বা দুই হাজার কপি বিক্রি হোক।ঐ আকাঙ্খাটা আছে। আমি হিজলের প্রশ্নটা ধরেই জবাব দিতে চাই যে সে বলেছে ‘কবিরাই চায় না তাদের কবিতা জনপ্রিয় হোক’। আমার কথা হচ্ছে কেন চাইবে না, অবশ্যই চায়।
- ট্যাগ:
- সাহিত্য
- বৃহস্পতির আড্ডা
- সাহিত্য আড্ডা