
ছবি সংগৃহীত
এই বর্ষায় প্রথম কদম ফুল
আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬, ১১:৫৮
ছবি: প্রিয় ক্যাম্পাস
মো. আব্দুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
(প্রিয় ক্যাম্পাস) ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’ বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এ আবেগময়, প্রেমাসিক্ত গান শুধু বাঙালিদের জন্যই প্রযোজ্য। বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ ভাবাই যায় না। পুষ্পে পুষ্পে-বৃক্ষে বৃক্ষে নতুন প্রাণের নতুন গানের সুর নিয়ে ঋতু রানী বর্ষার সমাগত। গুরুগম্ভীর বৃষ্টির কথা। রোমান্টিক ঋতু বর্ষাকাল এবং এই ঋতু বাঙালির একান্ত নিজস্ব।
‘বর্ষণমুখর সন্ধ্যা বা বৃষ্টিভেজা রাত বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও মিলবে না। গ্রীষ্মের অগ্নিঝরা দিনগুলো যখন প্রকৃতিকে করে বিবর্ণ শুষ্ক এবং জনজীবনকে করে অসহনীয় তখনই বর্ষা রিমঝিম বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতিকে করে সজীব। বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দে, প্রেমিকের মনে সুর খেলে যায়।
প্রেমিক হৃদয় গেয়ে ওঠে, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানি নে জানি নে, কিছুতে কেন যে মন লাগে না।’ সুরহীন প্রাণকেও সুরের মূর্ছনায় ছুঁয়ে যায় এ বর্ষা।
আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল। পৃথিবীর আর কোনো দেশে ঋতু হিসেবে বর্ষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা নাম নেই। বর্ষা যেন শুধু বাঙালির ঋতু। কদম ফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ যুগে যুগে নগর কিংবা গ্রামবাসীকে মুগ্ধ করে এসেছে। তাই বর্ষা কবিদের ঋতু, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ঋতু। বর্ষা এলেই কদমের আনাগোনা, যার গন্ধ সুশোভিত করে তোলে দেহ-মন সারাক্ষণ। কদম ফুলের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় বৃষ্টি হয়ে উঠছে আরো বেশি কোমল। খাল-বিলে ভরাট পানিতে যেমন করে শাপলা সাজিয়ে তোলে, তেমনি চারপাশের পরিবেশকে মাতিয়ে এবং রঙিন করে দেয় কদম ফুল।
মেঘের ভেলায় ভেসে কদম ফুলের ডালি সাজিয়ে নবযৌবনা বর্ষার সতেজ আগমন ঘটে এদিনে। বৃষ্টি শুষ্ক মাটির বুককে ভিজিয়ে সতেজ করে দেয় তৃষ্ণার্ত গাছপালাকে। বৃষ্টির শীতল স্পর্শ জুড়িয়ে দেয় তপ্ত হূদয়। বৃষ্টির স্বচ্ছ পানি ভিজিয়ে দেয় আমাকে। আর আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েছি বৃষ্টিকে!
কদম গাছগুলো সাদা-হলুদের মিশ্র রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে। বর্ষা মানেই গুচ্ছ গুচ্ছ কদম ফুলের সুবাস। বর্ষা মানেই বৃষ্টির রিনিঝিনি কিংবা নূপুর-নিক্বণ ধ্বনি। কদম ফুলের মতো তুলতুলে নরম, রঙিন স্বপ্ন দু’ চোখের কোণায় ভেসে ওঠে ঠিক যেমন করে আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। কদমের সুঘ্রাণে তৃপ্ত করতে ইচ্ছে হয় কোনো তৃষিত হৃদয়।
কদম গাছের শাখে পাতার আড়ালে ফুটে থাকা অজস্র কদম ফুলের সুগন্ধ লোকালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। আর তাই তো কদম ফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত। কদম ফুলের আরেকটি নাম হচ্ছে নীপ। কদম ফুলের সৌন্দর্যের মতোই আরও কিছু চমৎকার নাম রয়েছে। বৃত্তপুষ্প, সর্ষপ, ললনাপ্রিয়, সুরভী, মেঘাগমপ্রিয়, মঞ্জুকেশিনী, কর্ণপূরক, পুলকি— এসবও কদম ফুলের নাম।
কদম নামটি এসেছে সংস্কৃত নাম কদম্ব থেকে। কদম্ব মানে হলো ‘যা বিরহীকে দুঃখী করে’। প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে কদম ফুলের আধিপত্য। মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যেও কদম ফুলের সৌরভমাখা রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাথা রয়েছে।
ভগবত গীতাতেও রয়েছে কদম ফুলের সরব উপস্থিতি। কদম ফুল শুধু বর্ষায় প্রকৃতির হাসি নয়, এর রয়েছে নানা উপকারিতা। কদম গাছের ছাল জ্বরের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে কদম ফুল তরকারি হিসেবে রান্না করেও খাওযা হয়। কদম গাছের কাঠ দিয়ে দিয়াশলাই তৈরি করা হয়ে থাকে।
বর্ষা ঋতু কাব্যময়, প্রেমময়। বর্ষা কবিতা-গানের ঋতু, আবেগের ঋতু, প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়ার আকাক্সক্ষার ঋতু। তাই তো বর্ষায় প্রবল বর্ষণে, নির্জনে ভালোবাসার সাধ জাগে, চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে যায়, ব্যথিত-বঞ্চিত-নিঃসঙ্গ জীবন প্রেমসুধায় ভরিয়ে দেয়ার সাধ জাগে। শত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ভিড়েও কোথায় যেন মিলে একচিলতে বিশুদ্ধ সুখ! গোধূলির পর অজস্র করুণার অমৃতধারার আবির্ভাব হয়। মেঘ-মাধুর্যে পরিপূর্ণ আকাশটাও সঙ্গীতের অপূর্ব সুর-মূর্ছনায় ঝঙ্কৃত হয় বৃষ্টি ঝরার তালে তালে। সেই রিনিঝিনি বৃষ্টির ধ্বনি মনের কিনারা ছুঁয়ে কী এক অজানা অনুভূতি স্বপ্ন জাগিয়ে তুলে! মনের আকাশটাও তাই মেঘ-মাধুর্যের সৌন্দর্যে কোমল ও সিক্ত হয়।