ছবি সংগৃহীত

ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং শহিদের পরিচয়-নীতিমালা

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০১৪, ০২:৪১
আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪, ০২:৪১

মানুষ মরণশীল। সব মানুষকেই একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। মৃত্যুর ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এক. স্বাভাবিক মৃত্যু। দুই. অস্বাভাবিক মৃত্যু। দুর্ঘটনার কোনো হাত-পা নেই। যে কোনো মুহূর্তে বিপদ ও বিপর্যয় সংঘটিত হতে পারে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিপদে ধৈর্য ধারণ এবং খাদ্য, রক্ত, ওষুধ এবং বস্ত্র নিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্য। এতে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে। বিপদে পারস্পরিক সহমর্মিতা নাগরিক জীবনকে নিরাপদ করে এবং আল্লাহ তায়ালার রহমত প্রাপ্তিকে সহজ করে দেয়। দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যারা প্রাণ হারান, ইসলাম তাদের শহীদের মর্যাদা প্রদান করেছে। মৃত্যু মানবজীবনের একমাত্র পরিসমাপ্তি নয়, প্রত্যাগমন মাত্র। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে কিছু দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়ে থাকে। কেউ সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন আবার কেউ পালন করেন না। যারা যথাযথ দায়িত্ব পালন শেষে অত্যধিক মর্যাদার সাথে প্রত্যাগমন করেন, তাদের এরূপ প্রত্যাগমন করাকেই শহিদি মৃত্যু বলা হয়। কেননা শহিদি মৃত্যুর জন্য যে আত্মত্যাগ, ধৈর্য, মনোবল ও আল্লাহভীতি দরকার হয় তা সব মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। প্রত্যক্ষ জিহাদের মাঠে এ মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন-‘যারা আমার উদ্দেশে সংগ্রাম করে আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব; আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সাথে থাকেন’ [সূরা আনকাবুত : ৬৯]। সে জন্যই শহিদি মৃত্যু এত বেশি মর্যাদার দাবি রাখে। শহিদ কারা, শহিদের পরিচয় ‘শহিদ’ আরবি ভাষার শব্দ। এ শব্দটি গোড়ার দিকে অর্থাৎ কুরআন নাজিলের আগ পর্যন্ত ‘শোহাদা’ হিসেবে সাক্ষ্যদাতা অর্থে আরবি ভাষায় ব্যবহৃত হতো। কুরআন নাজিলের পর শব্দটি ব্যাপকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে ওঠে এবং এটি একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মৃত্যু, যার দাফনও সম্পন্ন হয়ে থাকে বিশেষ পরিপন্থার মধ্য দিয়ে। এ শব্দের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ,পরিধি-সীমানা, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য কেবল আল্লাহই নির্ণয় করেছেন। কে, কিভাবে মৃত্যুবরণ করলে শহিদ হয় এবং মৃত্যুর পর সে কিভাবে কতটুকু মর্যাদা ভোগ করবে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে। কাজেই শহীদের মর্যাদা পেতে হলে প্রথমে তাকে আল্লাহ, নবী-রাসূল, বেহেশত-দোজখ, ফেরেশতা, পুলসিরাত, আসমানি কিতাব, কিয়ামত ইত্যাদির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে পরিপূর্ণ মুসলিম হতে হবে। কেননা ‘শহিদ’ এর ধারণাটি দুনিয়ার কোনো সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আইনস্টাইন, লেলিন, কার্ল মার্কস, মাও সেতুং রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী কিংবা বিশেষ গুণসম্পন্ন বছরের শ্রেষ্ঠ কোনো বাঙালির কাছ থেকেও আসেনি। এটি এসেছে স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা ইমরানের ১৬৯ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন- ‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয় তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে কোরো না বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।’ সূরা মুহাম্মদের ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যারা আল্লাহর পথে শহিদ হয় আল্লাহ কখনোই তাদের কর্ম বিনষ্ট করেন না।’ আবার সূরা আলে ইমরানের ১৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘এভাবে আল্লাহ জানতে চান কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহিদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান। আল্লাহ অত্যাচারীকে ভালোবাসেন না।’ ইতিহাসের আলোকে শহিদ ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী ‘শহিদ’ শব্দটি ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে বদর ও ওহুদসহ হজরত মুহাম্মদ [সা.]-এর জীবদ্দশায় বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমানদের নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে। বুখারি শরিফের একটি হাদিসে এসেছে- নবী করিম [সা.] বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে যে শহিদ হলো সে জান্নাতে গেল’। ওমর [রা.] নবীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাদের শহিদ হলো জান্নাতি আর তাদের নিহতরা কি জাহান্নামি নয়?’ রাসূল [সা.] বললেন- ‘হ্যাঁ’। এ হাদিসের ব্যাখ্যানুযায়ী কোনো নাস্তিক-মুরতাদ, মুশরিকের সাথে ‘শহিদ’-এর কোনো প্রকার সম্পৃক্ততা থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করা হয়েছে। শহিদদের উদ্দেশে নির্মিত কোনো স্মৃতিচিহ্ন, স্মারক, স্তম্ভ কিংবা মিনারের সাথেও ‘মুসলিম শহিদদের’ কোনো প্রকার সম্পকের্র ধারণা ইসলামী শরিয়া অনুমোদন করে না। অর্থাৎ যে অর্থে শহিদস্মৃতি স্মারক, স্তম্ভ ও মিনারগুলো তৈরি করা হয়, সে অর্থেই এসব স্মারক ও স্মৃতিচিহ্নের ব্যবহারের অনুমোদন ইসলামে পাওয়া যায় না। ‘শহিদ’ শব্দটি একমাত্র কুরআন ও ইসলামের শব্দ। ইচ্ছে করলেই যে কেউ এর মর্যাদা ও সম্মান ভোগ করতে পারে না। এর সম্মান ভোগ করতে হলে বিশেষভাবে যোগ্যতা অর্জন করা বাধ্যতামূলক। আর সে যোগ্যতা হচ্ছে, আল্লাহর একত্ববাদ ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করা। তাই যদি হয়, তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে যে, যারা ইসলামের কুৎসা রচনায় নিজেকে সর্বদা ব্যস্ত রাখে; আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চরিত্র নিয়ে যে মশকারা করে এবং শেষ পর্যন্ত সেটার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে মৃত্যুবরণ করে; তাকে আবার ইসলাম প্রদত্ত শহীদের মর্যাদায় ভূষিত করা যায় কি না? না গেলেও হয়তো আমরা তা-ই করে থাকি। কী বিচিত্র আমাদের ইসলাম সম্পর্কে ধারণা। যারা ফেসবুকে, ব্লগে, পত্রপত্রিকায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চরিত্রকে তাচ্ছিল্যার্থে নিয়ে মন্তব্য প্রকাশ করে; তাদেরকে এক শ্রেণীর তথাকথিত মুসলিম পণ্ডিতেরা ফতুয়া দিয়ে শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কী অশুভ দৌরাত্ম্য। এভাবে ইসলামী বিধিবিধান নিয়ে তামাশা করা, আর যাকে-তাকে শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করে ইসলামী মূল্যবোধকে বিকৃত করা ইসলামী বিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য মারাত্মক অপরাধ, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে কারা শহিদ হিসেবে পরিগণিত হবেন মহামারী, ডায়রিয়া, পানিতে নিমজ্জন, অগ্নিদগ্ধ, পক্ষাঘাত, গর্ভাবস্থা ও চাপা পড়ে [ঘর, বৃক্ষ, গাড়ি ধ্বংসস্তূপ প্রভৃতি] যারা মৃত্যুবরণ করবেন, ইসলামের দৃষ্টিতে তারা শহিদ হিসেবে পরিগণিত হবেন। [বুখারি ও আবু দাউদ] যারা শহীদের মর্যাদা প্রাপ্ত হন, ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের কবর আজাব মাফ এবং জান্নাতে তারা অফুরন্ত নিয়ামত লাভ করবেন। রাসুল [সা.] আরো বলেন, আপনজনের মৃত্যুতে বিপদগ্রস্তদের যারা সান্ত্বনা দেয় ও সাহায্য করে, আল্লাহ তাদের কিয়ামতের দিন সম্মানের পোশাক পরিধান করাবেন এবং মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনে যারা শরীক হয়, উহুদ পর্বত পরিমাণ সওয়াব তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। [ইবনে মাজাহ] আমাদের সমাজে প্রতিনিয়তই এমন অনেক ঘটনা ঘটে এবং অনেক মানুষ নিহত হন। ইসলামের আলোকে এসব দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা শহীদের মর্যাদাপ্রাপ্ত হবেন। এটা অনেক বড় নিয়ামত। কিন্তু কথা হলো এমন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করাটা খুব কষ্টকর হয়। এ ব্যাপারে নবিজি [সা.] বলেছেন, যেসব ব্যক্তি বা যারা দুর্ঘটনায় আপনজন হারিয়েছেন, তারা ধৈর্য ধারণ করুন। এমন বিপদে ধৈর্য ধারণকারীদের জন্য জান্নাতে বায়তুল হামদ নামক একটি ঘর তৈরি রয়েছে। [তিরমিজি] এছাড়া মৃত ব্যক্তির শোকার্ত পরিবার-পরিজনের জন্য খাবার প্রেরণ করাকে সওয়াবের কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মহানবি [সা.] সাহাবি হজরত জাফরের [রা.] মৃত্যু সংবাদ শোনার পর খাবার প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন। মাওলানা মিরাজ রহমান