কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ছবি সংগৃহীত

ইসলামি অর্থনীতির রূপরেখা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ০১ জানুয়ারি ২০১৪, ১০:১০
আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৪, ১০:১০

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদাতের জন্য, আনুগত্যের জন্য। তিনি বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ﴿الذاريات: ٥٦﴾ আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। (৫১:৫৬) ইবাদাত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। আর সুস্থভাবে বাঁচার জন্য প্রয়োজন পৃথিবীতে বসবাসের নানা উপায়-উপকরণ। প্রয়োজন আবাসস্থল, খাবার, পোষাক ইত্যাদির। আর এগুলো সংগ্রহ করার জন্য প্রয়োজন অর্থ-সম্পদের। এই অর্থ-সম্পদ উৎপাদন, সরবরাহ, বিনিময়, বিতরণ ও ভোগ নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে, তারই নাম ‘অর্থনীতি’। সম্পদ সীমিত কিন্তু চাহিদা অফুরন্ত– এই মৌলিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা আধুনিক অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য৷ কিন্তু ইসলাম এর সাথে একমত নয়। ইসলাম মনে করে, একজন মানুষের অফুরন্ত চাহিদা তাকে স্বার্থপর করে তোলে। চাহিদা সীমিত করে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করাই তাই ইসলামী অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও ইসলামী অর্থব্যবস্থা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও ইসলামী অর্থব্যবস্থার মাঝে পার্থক্য প্রথমত দর্শনগত। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল কথা হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিই হবে তার নিজের উপার্জিত সম্পদের মালিক; তার সম্পদে অন্য কারো কোনো অংশ থাকবে না; তার ওপর অন্য কারো কোনো অধিকারও স্বীকৃত হবে না। এ ব্যবস্থায় মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। তা যে কোনো উপায়ে হতে পারে, যে কোনো পরিমাণে হতে পারে। ঠিক তেমনি তা ব্যয় করারও কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। মানুষের তৈরি আইনের ভেতরে থেকে তা যে কোনো উপায়ে খরচ করা যেতে পারে। আবার চাইলে তা কুক্ষিগতও করে রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এক ব্যক্তি চাইলে মদ ও মৃত প্রাণীর গোশত বিক্রয় করে কোটিপতি হতে পারে। কিংবা সুদ আর ঘুষের সম্পদ মিলিয়ে গড়ে তুলতে পারে সম্পদের পাহাড়। আবার সে চাইলে তা মদ্যপান ও গর্হিত কাজে ব্যয়ও করতে পারে। এই অর্থব্যবস্থায় সম্পদ উপার্জনের কোনো নৈতিক আদর্শ যেমন নেই, তেমনি তা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নেই কোনো নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ। মানুষ এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার সম্পদের সম্পূর্ণ মালিকানা তার নিজের। এ ব্যবস্থা মানুষকে লোভী, স্বার্থপর ও হিংস্র করে তোলে। ভোগ-বিলাস ও সম্পদ উপার্জনকে জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করে দেয়। এ ব্যবস্থায় ধনী আরো ধনী হয়, আর দরিদ্র হয় আরো দরিদ্র। পক্ষান্তরে ইসলাম মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করে আল্লাহর আনুগত্যকে। ইসলাম বলে দেয় যে, সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ তায়ালা। আল-কুরআনের বাণী : يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ﴿البقرة: ١٧٢﴾ হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর। (২:১৭২) পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হিসেবে মানুষকে তা সাময়িক ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাই সম্পদের মালিকানা অর্জন করতে হবে আল্লাহর সন্তোষজনক উপায়ে। আবার তা ব্যয়ও করতে হবে তাঁর নির্দেশিত পথে। এভাবে নির্দিষ্ট সীমার মাঝে থেকে সে যে কোনো পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করতে পারে, আবার ব্যয়ও করতে পারে যে কোনো পরিমাণে। তবে তা কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না। বরং সমাজের মানুষের উপকারে তা ব্যয় করতে হবে, কিংবা তা কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হবে। তার সম্পদে অন্যের অধিকারও যথাযথভাবে স্বীকৃত হবে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা অবাধ ও উদার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিতি। এর কিছু মূলনীতি নিম্নরূপ : এক. ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার এই অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়াও উৎপাদনের নানা বিষয়ের ওপর মালিকানা লাভ করতে পারে। দুই. উপার্জনের অধিকারের স্বাধীনতা ব্যক্তি এখানে যে কোনো উপায়ে যে কোনো পরিমাণে উপার্জন করার স্বাধীনতা ভোগ করে। তিন. ব্যক্তিগত মুনাফাই কর্মপ্রেরণার উৎস এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত মুনাফার জন্যই সম্পদ উপার্জনে উৎসাহী হয়। সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের জন্য নয়। চার. প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দিতা এ ব্যবস্থায় পরস্পরের মধ্যে চরম প্রতিযোগতিা ও প্রতিদ্বন্দিতা হয়। মুনাফা অর্জনে সবাই সরব ভূমিকা পালন করে। পাঁচ. মালিক ও মজুরের পার্থক্য এ অর্থব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্টরা দুই ভাগে বিভক্ত থাকেন। মালিক ও মজুর। ব্যবসায় যতই লাভ হোক, মজুর শ্রেণী তাদের নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকই পাবে। আবার ব্যবসায় ক্ষতি হলে তা কেবল মালিক শ্রেণীকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ছয়. সুদী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা সুদী ব্যাংক এ অর্থব্যবস্থার প্রাণ। বড় বড় ব্যবসা ও প্রজেক্টের মূলধনের ব্যবস্থা করে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নামমাত্র সুদ দিয়ে বড় অংকের মুনাফা করে। সাত. সম্পদের সুষম বন্টন অনিশ্চিত এ ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বন্টনের কোনো কথা নেই। সম্পূর্ণ অর্থনৈতিন স্বাধীনতা ব্যক্তির থাকে বলে অন্য কাউকে সেখান থেকে ভাগ দিতে সে বাধ্য নয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি এক. অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য করা ইসলাম মনে করে সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে মানুষের অবাধ স্বাধীনতা নেই। বরং আল্লাহ যে উপায়ে উপার্জন করাকে হালাল করেছেন, কেবল সে উপায়েই উপার্জন করা যাবে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَن تَكُونَ تِجَارَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। (৪:২৯) দুই. সম্পদ কুক্ষিগত করতে নিষেধাজ্ঞা ইসলাম মানুষকে ইচ্ছে মতো সম্পদ সঞ্চয় করে রাখতে নিরুৎসাহিত করে। আল্লাহ বলেন, وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ﴿آل‌عمران: ١٨٠﴾ আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন। (৩:১৮০) তিনি আরো বলেন, وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ ﴿التوبة: ٣٤﴾ আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। (৯:৩৪) তিন. ব্যয়-বিনিয়োগের নির্দেশ সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার পরিবর্তে ইসলাম নির্দেশ দেয় তা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করার এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করার। আল্লাহ বলেন, يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلْ مَا أَنفَقْتُم مِّنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ ﴿البقرة: ٢١٥﴾ তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও-যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্যে, আত্নীয়-আপনজনের জন্যে, এতীম-অনাথদের জন্যে, অসহায়দের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে। আর তোমরা যে কোন সৎকাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে। (২:২১৫) তিনি আরো বলেন, وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ﴿الذاريات: ١٩﴾ এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক ছিল। (৫১:১৯) পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মনে করা হয়, সম্পদ সুদভিত্তিক বিনিয়োগ করলে অতিরিক্ত মুনাফা হবে। ইসলাম তা অস্বীকার করে। আল-কুরআন ঘোষণা দেয়, يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ ﴿البقرة: ٢٧٦﴾ আল্লাহ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে। (২:২৭৬) আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ ﴿الروم: ٣٩﴾ মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে। (৩০:৩৯) সুদভিত্তিক বিনিয়োগের কারণে সম্পদ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর হাতে চলে যায়। গরীবের হাতে সম্পদ থাকে না। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। যা বাজারের সামগ্রিক চাহিদা কমিয়ে দেয়। ফলে শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এক কথায়, পুরো অর্থব্যবস্থা থমকে দাঁড়ায়। চার. পরস্পরকে সহযোগিতা করা পরস্পরকে সহযোগিতা করা ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন, وَإِن كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَىٰ مَيْسَرَةٍ وَأَن تَصَدَّقُوا خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ ﴿البقرة: ٢٨٠﴾ যদি খাতক অভাবগ্রস্থ হয়, তবে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম যদি তোমরা উপলব্ধি কর। (২:২৮০) অনুরূপভাবে আল্লাহ তা’আলা নিভৃতে মানুষকে দান করতে উৎসাহিত করে বলেন, إِن تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِن تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ﴿البقرة: ٢٧١﴾ যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খুব খবর রাখেন। (২:২৭১) পাচ. যাকাত প্রয়োজনিতিরক্তি সম্পদ যদি থাকে, তাহলে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ অবশ্যই গরীবদের মাঝে বন্টন করে দেয়া। যাকাত নির্দেশ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا ﴿التوبة: ١٠٣ তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। (৯:১০৩) ছয়. মিরাস ধন-সম্পদ সুষম বন্টনের পরও যা অবশিষ্ট থাকে, মৃত্যুর পর তা বিক্ষিপ্ত করা ও ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইসলাম এ বিধান রেখেছে। ইসলামী লেনদেনের বৈশিষ্ট্য সকল ইসলামী লেনদেনে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অনিবার্য। ১. সুদমুক্ত হওয়া। ২. ক্ষতির অংশীদারিত্ব (Risk Sharing)। ৩. প্রকৃত সম্পদের ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থায়ন (Asset based Financing)। ৪. চুক্তিতে সবকিছু নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত করা; কোনো অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা না রাখা। ৫. হালাল সম্পদের লেনদেন করা। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় পুঁজি ও উদোক্তাদের মধ্যে সমন্বয় পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইসলামী অর্থব্যবস্থা সম্পদকে সংরক্ষণ করে রাখতে নিরুৎসাহিত করে। বরং তা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করে বাকীটা বিনিয়োগের পরামর্শ দেয়। মানুষের দুটো শ্রেণী। এক শ্রেণীর হাতে পুঁজি থাকে, কিন্তু তারা উদ্যোক্তা নন। আবার এক শ্রেণী ভালো উদ্যোক্তা, কিন্তু পুঁজি সংকটে ভুগেন। অবশ্য এমনও মানুষ আছেন যাদের পুঁজিও আছে আবার তারা উদ্যোগী, তবে পর্যাপ্ত পুঁজি নেই। এই সকল শ্রেণীকে সমন্বয় করার জন্য ইসলাম চমৎকার কিছু বিনিয়োগ পদ্ধতি আমাদের শিখিয়েছে। মুশারাকা ও মুদারাবা তন্মধ্যে অন্যতম। মুশারাকা : একাধিক ব্যক্তির পুঁজিকে একত্রিত করে যৌথ বিনিয়োগ করে ব্যবসা করাকে মুশারাকা বা অংশীদারিত্বের ব্যবসা বলা হয়। এই পদ্ধতিতে একাধিক ব্যক্তি মূলধন বিনিয়োগ করেন। সবার পুঁজি একত্রিত করে তা দিয়ে ব্যবসা করা হয়। লাভ হলে তা পূব নির্ধারিত হারে সবার মাঝে বন্টন করা হয়। আর ক্ষতি হলেও বিনিয়োগকৃত পুঁজির হার অনুপাতে তা বন্টিত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অংশীদারদের কেউ দায়িত্ব নিয়ে থাকলে তার মুনাফার হার সাধারণত অন্যদের চেয়ে বেশী হয়। মুদারাবা : মুদারাবাও এক প্রকার অংশীদারিত্বের ব্যবসা। তবে এখানে সবাই মূলধন বিনিয়োগ করেন না। বরং এক পক্ষ মূলধন বিনিয়োগ করেন, অপর পক্ষ শ্রম বিনিয়োগ করেন। ব্যবসায় লাভ হলে পূর্ব নির্ধারিত হারে তা বন্টন করা হয়। আর ক্ষতি হলে তা মূলধন বিনিয়োগকারী বহন করেন। অবশ্য ক্ষতির কারণ যদি শ্রম বিনিয়োগকারী বা মুদারিব হন, তাহলে তিনি তার ক্ষতিকারক কাজের ক্ষতির সমপরিমাণ ক্ষতি বহন করেন। রাসূল স. বিবাহের পূর্বে মুদারাবার ভিত্তিতে খাদীজা রা. এর ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। সীরাত গ্রন্থসমূহে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। মুশারাকা ও মুদারাবা ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সবচেয়ে আদর্শ দুটো বিনিয়োগ পদ্ধতি, যা পুঁজি ও উদ্যোক্তাকে সমন্বয় করে। এ পদ্ধতি দুটোতে লাভ ও ক্ষতির অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। মুযারা’আ ও মুসাকাত : মুদারাবার অনুসরণে ওলামায়ে কিরাম আরো দুটো পদ্ধতির কথা বলেছেন। মুযারা’আ হলো যেখানে জমির মালিক তার জমি ও বীজ কিংবা শুধু জমি বিনিয়োগ করেন। আর অপরজন শ্রম ব্যয় করে সেখানে ফসল ফলান। এরপর উৎপন্ন ফসল উভয়ের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত হারে বন্টিত হয়। ফসল না হলে কারো কিছু চাওয়ার থাকে না। আর মুসাকাত হলো যেখানে বাগানের মালিক তার গাছগুলোকে বিনিয়োগ করেন। আর অপরজন শ্রম দিয়ে সেখানে পানি দেন, গাছের দেখাশোনা করেন। এরপর যা ফল হয় তা উভয়ের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত হারে বন্টন করা হয়। ফল না হলে কেউ কিছু পায় না। এক কথায় লাভ ও ক্ষতির অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পুঁজি ও শ্রমের বিনিয়োগে ইসলাম আমাদের উৎসাহিত করে। আধুনিক ইসলামী অর্থনীতিতে অর্থ সংগ্রহ ও বিনিয়োগের পদ্ধতি মুশারাকা ও মুদারাবা যদিও ইসলামের আদর্শ দুটো অর্থ সংগ্রহ ও বিনিয়োগ পদ্ধতি, তথাপি সবসময় সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ফলে সুদী অর্থব্যবস্থাকে বর্জন করে ইসলামের গন্ডির ভেতর থেকে আরো কয়েকটি ক্রয়-বিক্রয়ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তন্মধ্যে বাই-মুরাবাহা, বাই-সালাম ও বাই-ইসতিসনা উল্লেখযোগ্য। বাই-মুরাবাহা: বাই মুরাবাহা এক প্রকার ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। অন্যসব ক্রয়-বিক্রয়ের ন্যায় এখানে প্রথম পূর্বশর্ত হলো, ক্রেতা-বিক্রেতার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তা’আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَن تَكُونَ تِجَارَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। (৪:২৯) অনুরূপভাবে, ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি বিনষ্ট করে ফেলে এমন যে কোনো বিষয় থেকেও মুক্ত থাকতে হয়। যেমন: ধোঁকা-প্রতারণা, হারাম সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়, অতি উচ্চমূল্যে বিক্রয়, জুঁয়া, মালিকানাহীন বস্তু বিক্রয়, দখলদারিত্ব ছাড়াই কোনো কিছু বিক্রয় ইত্যাদি। তবে অন্যসব ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে বাই-মুরাবাহার মূল পার্থক্য হলো, এতে বিক্রেতা তার ক্রয়মূল্য ও লাভের পরিমাণ ক্রেতার কাছে উল্লেখ করে। অনেক ক্রেতার কাছে বাজারমূল্য স্পষ্ট থাকে না। আবার অনেক বিক্রেতার কাছে লাভের অংক অস্পষ্ট থাকে। উভয় প্রকার ক্রেতা-বিক্রেতার উপকারিতার স্বার্থে বাই-মুরাবাহর অনুমতি দেয়া হয়েছে। আধুনিক ইসলামী অর্থনীতিতে বাই-মুরাবাহার সাথে বাই-মুয়াজ্জালকে মিলিয়ে একটি বিনিয়োগ পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাই-মুয়াজ্জাল হলো বাকীতে বিক্রয়। যেখানে ক্রেতা বিলম্বে মূল্য পরিশোধ করার সুযোগ লাভ করে। আর বিক্রেতা নগদে মূল পাচ্ছে না বলে চুক্তির সময়ই কিছুটা অতিরিক্ত মুনাফা সংযোজন করে মূল্য নির্ধারণ করে। বর্তমানে প্রচলিত বাই-মুরাবাহার পদ্ধতি হলো, ক্রেতা প্রথমে অর্থ সরবাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে তার প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করার আগ্রহ প্রকাশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি সেই পণ্যের বাজারমূল্য যাচাই করে। অত:পর ক্রেতার কাছ থেকে তা ক্রয়ের একটি অঙ্গীকারপত্র গ্রহণ করে। এরপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি বাজার থেকে পণ্যটি ক্রয় করে নিজের দখলে নেয়। অবশেষে পণ্যটি ক্রেতার কাছে বিক্রয় ও হস্তান্তর করে। এবং ক্রেতা তার মূল্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে কিস্তিতে পরিশোধ করে। বাই-সালাম : বাই-সালাম বাই-মুয়াজ্জালের ঠিক উল্টো। বাই-মুয়াজ্জালে মূল্য অপরিশোধিত থাকে, আর পণ্য নগদে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। আর বাই-সালামে মূল্য নগদে পরিশোধ করা হয়। আর পণ্য বিলম্বে নির্দিষ্ট তারিখে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। সাধারণত শস্য জাতীয় সম্পদে এই ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির ব্যবহার হয়ে থাকে। আধুনিক ইসলামী অর্থনীতিতে নানা রকম খাদ্য দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানী করার ক্ষেত্রে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাই-সালামের ব্যবহার করে থাকে। অন্য সব ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির ন্যায় বাই-সালামে পণ্যের গুনগত মান, পরিমাণ, পণ্য হস্তান্তরের তারিখ, জায়গা, মূল্য ইত্যাদি চুক্তির সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হয়। এছাড়াও পণ্যটি চুক্তির সময় থেকে হস্তান্তরের সময় পর্যন্ত বাজারে থাকাও বাঞ্চনীয়। যেন কোনো কারণে বিক্রেতা নিজের উৎপাদন থেকে পণ্য হস্তান্তর করতে না পারলে বাজার থেকে ক্রয় করে দিতে পারে; ফলে ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বাই-ইসতিসনা : বাই-ইসতিসনা অনেকটা বাই-সালামের মতোই। এ অর্থে যে, এখানেও সাধারণত মূল্য আগে পরিশোধ করা হয় আর পণ্য পরে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তবে বাই-ইসতিসনা এমন পণ্যের ক্ষেত্রে করা হয়, যা একটি নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলে আসে। যেমন, জেনারেটর, মটর, কাপড় ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বিক্রেতা পণ্যের কাঁচামাল সরবরাহ করে ও নির্মাণ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আধুনিক ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতিতে নানা রকম মেশিনারিজ ও মেশিনে তৈরী পণ্য আমদানীর ক্ষেত্রে বাই-ইসতিসনা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইসলামী ব্যবসায় লাভ ও ক্ষতির বন্টন পদ্ধতি পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মুদারাবায় একপক্ষ লাভের অধিকারী হয় মূলধন বিনিয়োগের কারণে। আর অপর পক্ষ লাভের অধিকারী হয় শ্রমের কারণে। শ্রম ও মূলধন ছাড়া তৃতীয় আরেকটি কারণে লাভের অধিকারী হওয়া যায়। তা হলো, দায় নেয়া। শ্রম, মূলধন ও দায় নেয়া ছাড়া চতুর্থ কোনো কারণে কেউ লাভের অধিকারী হয় না। অনুরূপভাবে ব্যবসায় অংশ না নিয়ে কেবল অর্থ ঋণ দিয়ে সময়ের বিপরীতে লাভের অধিকারী হওয়া যায় না। ইসলামে তা রিবা বলে পরিগণিত এবং সম্পূর্ণভাবে হারাম বলে বিবেচিত। মুদারাবা বা মুশারাকা যা-ই হোক না কেন, ব্যবসায় লাভ হলে তা পূর্ব নির্ধারিত হারে অংশীদারদের মাঝে বন্টন হবে। আর ক্ষতি হলে তা মূলধন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের অনুপাতে বহন করবে। উদাহরণস্বরূপ, খালেদ, রাশেদ ও আমের একটি যৌথ ব্যবসায় বিনিয়োগ করলো। খালেদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০,০০০/-, রাশেদের ৫০,০০০/- ও আমেরের ২০,০০০/-। মোট মূলধন ১,০০,০০০/-। বিনিয়োগের হার: খালেদ ৩০%, রাশেদ ৫০% আর আমের ২০%। এই ব্যবসায় পরিচলনার দায়িত্ব আমেরের। তাই মুনাফার হার তার জন্য বেশী। মুনাফার হার এই রূপ: খালেদ: ২০%, রাশেদ ৩০% আর আমের ৫০%। এক বছর পর হিসাব করে দেখা গেল যে, ব্যবসায় যাবতীয় খরচ বাদে লাভ হয়েছে ৫০,০০০/-। তাহলে তা বন্টন হবে এভাবে: খালেদ ১০,০০০/- (২০%), রাশেদ ১৫,০০০/- (৩০%) আর আমের ২৫,০০০/- (৫০%)। দ্বিতীয় বছর শেষে দেখা গেল যে, ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে ৫০,০০০/-। তাহলে তা বহন করতে হবে মূলধনের বিনিয়োগ হার অনুসারে এভাবে: খালেদ ১৫,০০০/-(৩০%), রাশেদ ২৫,০০০/- (৫০%) আর আমের ১০,০০০/- (২০%)। বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতি – সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধান ইসলাম আমাদের যে অর্থব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেয়, তা যে কোনো যুগে যে কোনো জায়গায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ইসলাম আমাদের নির্দিষ্ট আঙ্গিকের কোনো অর্থব্যবস্থার কথা বলে না। বরং ইসলাম আমাদের মৌলিক কিছু বিধিনিষেধের কথা বলে দেয়, যা মেনে চললে যে কোনো অর্থব্যবস্থাই ইসলামী অর্থব্যবস্থায় পরিণত হবে। বাংলাদেশে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক যে সব বিষয় অর্থব্যবস্থায় ঢুকে গিয়েছে তন্মধ্যে কয়েকটি হলো: ১. রিবা – সুদ আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁর প্রিয় রাসূল স. সুদকে প্রচন্ড ঘৃণার সাথে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন , وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا আল্লাহ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। (২:২৭৫) রাসূল স. সুদ গ্রহণকারী, সুদ দাতা, সুদের কারবারের লেখক ও সাক্ষী সবাইকে অভিশাপ দিয়েছেন। (সহিহ মুসলিম: ১৫৯৭) অথচ সুদ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ জুড়েই থাকে দেশীয় ব্যাংকগুলো থেকে সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ এবং বৈদেশিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণ সুদসহ পরিশোধ। প্রতি বছর আমাদের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়। ব্যাংক ও প্রায় সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল আয় হলো ঋণের বিনিময়ে সুদ গ্রহণ। যখন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এসব ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় এবং তার পণ্য উৎপাদন করে, তখন সেই পণ্যের মূল্যে পরিশোধব্য সুদের অংশ জুড়ে দেয়। সাধারণ জনগণকে তাই সুদসহ মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়। ফলে দেশের সবাই সরাসরি কিংবা মাধ্যম হয়ে সুদের সাথে জড়িত হয়। সুদকে আইন করে বাতিল করা ছাড়া সমাজ থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার আর কোনো উপায় নেই। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা সবাই যদি সুদ পরিহার করি, তাহলে সেই আইন হতে বেশীদিন দেরী হবে না। ২. প্রতারণা বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্যদিনের খাদ্য সামগ্রী থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসে ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়। অথচ রাসূল স. বলেন, যে আমাদের সাথে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (সহীহ মুসলিম: ১০১) পণ্যের প্রচার ও বিক্রয়ের জন্য অনেকেই মিথ্যা শপথ ও প্রতারণাপূর্ণ প্রচারনার আশ্রয় নেন। অথচ রাসূল স. বলেছেন, মিথ্যা শপথ পণ্যের প্রচারনা করে ঠিক, তবে তা বরকত নষ্ট করে দেয়। (সুনান আবু দাউদ) ৩. ঘুষ ও দুর্নীতি ছোট বড় প্রায় যে কোনো কাজ করা ও করানোর জন্য ঘুষের প্রয়োজন হয়। রাসূল স. ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়কে অভিশাপ দেন। (সুনান আবু দাউদ: ৩৫৮০) ৪. মজুদদারী, পাচার ও সিন্ডিকেট মানুষের প্রয়োজন উপেক্ষা করে খাদ্যদ্রব্য মজুদদারী করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা বর্তমানে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজার চলছে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের দেয়া ভুর্তুকির চাল-ডাল পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। এসবই ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাসূল স. বলেছেন, অপরাধী ছাড়া কেউ মজুদদারী করতে পারে না। (সুনান তিরমিযি: ১২৬৭) ৫. মিডল ম্যান বা মধ্যস্থতাকারীর আধিক্য পণ্য পোর্টে খালাস হওয়ার আগেই তা কয়েক হাত বদল হয়ে যাচ্ছে। অথচ ইসলাম পণ্যের পূর্ণ মালিকানা ও দখলদারিত্ব নেয়ার আগে তা বিক্রয় করতে নিষেধ করে। এ নির্দেশটি মানা হলে পণ্যের খুচরা মূল্য অনেক কমে যেত। ৫. পুঁজিবাদী স্বার্থপরতা ও অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ছাপ সমাজের সর্বত্র। এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনই মূল লক্ষ্য। তাই চুক্তির অপর পক্ষের সন্তুষ্টি কখনোই অন্বেষণ করা হয় না। অথচ যে কোনো লেনদেনে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি ইসলামে একটি মৌলিক শর্ত। ইসলাম চুক্তির উভয় পক্ষকে একে অপরের হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামী হতে উৎসাহিত করে। রাসূল স. একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। এক ব্যক্তি তার জমি অন্য ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করেন। ক্রেতা জমি ক্রয়ের পরে তার জমিতে একটি স্বর্ণের পাত্র পান। তিনি বিক্রেতাকে বলেন, ভাই আমি তো আপনার কাছ থেকে জমি কিনেছি, অন্য কিছু নয়। তাই এটা আপনি নিয়ে যান। আর বিক্রেতা বলেন, ভাই আমি তো আপনাকে জমি ও জমির সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু বিক্রয় করেছি। তাই এটা আপনার। উভয়ে যখন নিজ নিজ মতের ওপর অটল রইলেন, তখন একজন বিচারকের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিচারক উভয় পক্ষের কথা শোনার পর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কোনো ছেলে-মেয়ে আছে? একজন বললেন, আমার ছেলে আছে। আর অপরজন বললেন, আমার মেয়ে আছে। বিচারক বললেন, তোমার ছেলেকে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দাও। এরপর এই স্বর্ণ তাদের দিয়ে দাও। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) একবার ভাবুন, ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে তখন কেমন সৌহার্দ্য ছিল আর এখন কতটুকু আছে। সারকথা, বাংলাদেশে ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রতিকূল অনেক কিছু সমাজে প্রচলিত আছে। তবে ইসলামী অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব নয়। সবাই সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে অদূর ভবিষ্যতে সমাজের সর্বস্তরে তা প্রতিষ্ঠিত হবেই ইনশা’আল্লাহ। উপসংহার বাংলাদেশে ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অবাস্তব কিছু নয়। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ক্ষুদ্র কিছু প্রয়াস সম্মিলিতভাবে আমাদেরকে এ লক্ষ্যে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। আমরা সবাই আল্লাহর কাছে দুয়া করি, তিনি যেন আমাদের পথচলা সহজ করে দেন। আমীন। প্রবন্ধকার : মুফতী মাওলানা ইঊসুফ সুলতান নায়েবে মুফতী, ইফতা বিভাগ, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ