
ছবি সংগৃহীত
আশারায়ে মুবাশশিরিন-৯ : মুস্তাজাবুদ্ দাওয়াত হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)
আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৩:১৫
রাসুলে করিম (সা.)-এর জবানে জীবদ্দশায় জান্নাতের শুভ সংবাদপ্রাপ্ত, সাবেকিনে আওয়ালিনের মর্যাদায় মহিমান্বিত হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ছিলেন কুরাইশ বংশের 'বনু যুহরা' গোত্রের সন্তান। তিনি সম্ভবত ৫৯১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। হজরত সাদ এদিক থেকেও সৌভাগ্যবান, তাঁর মা-বাবা দুজনই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। রাসুল (সা.)-এর এ প্রিয় সাহাবির নাম ছিল 'সাদ', উপনাম 'আবু ইসহাক', বাবার নাম 'আবু ওয়াক্কাস' আর মায়ের নাম 'হামনা'। তিনি ইতিহাসে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস নামেই খ্যাত। হজরত আবু বকর (রা.)-এর সঙ্গে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ছিল গভীর বন্ধুত্ব। তাই ইসলামের সূচনালগ্নে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর প্রেরণায় তিনি ও তাঁর ভাই উমাইর ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণকালে তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর। বুখারি শরিফে হজরত সা'দের ইসলাম গ্রহণ করা প্রসঙ্গে একটি হাদিস সংকলিত হয়েছে। হজরত আমের ইবনে সাদ পিতা সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাদ (রা.) বলেন, 'আমার ভালোভাবে স্মরণ আছে, আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি (পুরুষ), যারা ইসলামে দাখিল হয়েছিলেন।' হজরত সা'দের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাঁর মা পুত্রের মুসলমান হওয়ার খবর শুনে চিৎকার শুরু করে দেন। তাঁর চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। সাদ মায়ের কাণ্ড দেখে ঘরের এক কোণে নীরব অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর মা কিছুক্ষণ শোরগোল করার পর ছেলেকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য চরমপত্র ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, 'সে যতক্ষণ না মুহাম্মদের ধর্ম থেকে ফিরে আসবে, ততক্ষণ আমি কোনো কিছু খাব না, পান করব না এবং রোদ থেকে ছায়াতেও আসব না।' মায়ের ঘোষণা শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিন দিন কেটে গেল, সা'দের মা খাবার বা পানীয় কোনো কিছু স্পর্শ করলেন না, কারো সঙ্গে কথাও বললেন না, রোদ থেকে ছায়াতেও এলেন না। সাদ অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি রাসুল (সা.)-এর দরবারে হাজির হলেন। ঘটনা বিস্তারিত রাসুল (সা.)কে অবহিত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হলো, 'আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সঙ্গে এমন কিছুকে শরিক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি সে বিষয়ে তাদের আনুগত্য কোরো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এরপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব তোমাদের কর্মফল।' (সুরা আল-আনকাবুত, আয়াত ৮)। পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর হজরত সাদ (রা.)-এর মনের অশান্তি দূর হলো। ছেলের দৃঢ়তায় হামনার হৃদয়ে ভাবান্তর ঘটে। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত প্রায় সব যুদ্ধেই হজরত সাদ অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে হজরত সাদ ও তাঁর ভাই হজরত উমাইর (রা.) বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। এ যুদ্ধে উমাইর (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। উহুদ যুদ্ধে যখন কয়েকজন মুসলিম সৈনিকের ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনীর নিশ্চিত বিজয় পরাজয়ে পরিণত হয়, তখন মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন সাহাবি নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে রাসুল (সা.)-এর জীবন রক্ষার্থে বূ্যহ রচনা করেছিলেন, হজরত সাদ ছিলেন তাঁদেরই একজন। সেদিনকার ঘটনা বুখারি শরিফের এক হাদিসে হজরত সাদ (রা.) নিজেই এভাবে বর্ণনা করেছেন, উহুদের রণাঙ্গনে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় তীরদান হতে সব তীর আমার সামনে রেখে দিয়ে আমাকে বললেন, 'আমার মা-বাবা তোমার প্রতি উৎসর্গ হোক, তুমি যথাসাধ্য তীর ছুড়তে থাকে।' (বুখারি)। হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে হজরত আবু উবাদা ও মুসান্না (রা.)-এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী যখন পারস্য জয় করে ইরাকের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তখন ইয়াজদিগার্দ মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে সেনাপতি রুস্তমের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী গড়ে তোলে। খলিফা উমর (রা.) পারসিকদের যুদ্ধপ্রস্তুতির সংবাদ পেয়ে হজরত সাদকে ইরানি ফ্রন্টের সর্বাধিনায়ক করে অতিরিক্ত সেনাসহ প্রেরণ করেন। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে মহাবীর রুস্তমের নেতৃত্বাধীন এক লাখ ২০ হাজার সেনার পারসিক বাহিনীর সঙ্গে হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রুস্তম নিহত হয় এবং পারসিক বাহিনী চরমভাবে বিধ্বস্ত ও পরাজিত হয়। এরপর হজরত সা'দের কাছে সংবাদ আসে, ইয়াজিদগার্দ রাজধানী মাদায়েন থেকে সব মূল্যবান সম্পদসহ পলায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খলিফার অনুমতিক্রমে হজরত সাদ (রা.) ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের রাজধানী মাদায়েন আক্রমণ ও দখল করেন। সেখানে মুসলিম বাহিনী প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন। হজরত সাদ শ্বেত প্রাসাদে প্রবেশ করে আট রাকাত সালাতুল ফাতাহ্ আদায় করেন। এরপর তিনি ঘোষণা দেন, এ শাহি প্রাসাদে আজ জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মিম্বার তৈরি করে সেখানে সালাতুল জুমুয়া আদায় করা হয়। এটাই ছিল পারস্যে প্রথম জুমার নামাজ। হজরত উমর (রা.) সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)কে কুফার গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁকে কুফাবাসী কয়েকজনের মিথ্যা অভিযোগের কারণে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বুখারি শরিফের একটি হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, কুফাবাসী সাদ (রা.) সম্পর্কে হজরত উমর (রা.)-এর কাছে বিভিন্ন অভিযোগ করল। তারা এও বলল, তিনি ভালোভাবে নামাজও পড়ান না। হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ছিলেন আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর সমর্থনে পবিত্র কোরআনে একাধিক আয়াত নাজিল হয়েছে। বদর যুদ্ধে হজরত সাদ সাঈদ ইবনে আসকে হত্যা করে তার তলোয়ারটি রাসুল (সা.)-এর কাছে জমা দিয়ে সেটি তাঁকে দিয়ে দিতে আবেদন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেটি তাঁকে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, এটি না তোমার, না আমার। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জবাব শুনে হজরত সাদ কিছুদূর যেতে না-যেতেই সুরা আনফাল নাজিল হয়। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদকে ডেকে বলেন, 'তোমার তলোয়ারটি নিয়ে যাও।' হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন. 'একমাত্র সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় মাতা-পিতা উৎসর্গ বলে তাঁর সম্পর্কে উক্তি করেছেন। অন্য কারো সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)কে এ রকম উক্তি করতে আমি শুনিনি।' (বুখারি)। একবার হজরত সাদ কোথাও থেকে আসছিলেন। তিনি নিকটবর্তী হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'এই দেখো, আমার মামা; অন্য কেউ এ রকম মামা নিয়ে এসো দেখি।' (তিরমিজি)। হিজরতের দ্বিতীয় বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ৬০ জন উষ্ট্রারোহীর এক টহলদলকে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য মদিনার উপকণ্ঠে প্রেরণ করেন। টহলদলের সদস্য ছিলেন হজরত সাদ। ইকরামা ইবনে আবি জেহেলের নেতৃত্বে কুরাইশদের একটি দলকে তাঁরা দেখতে পান। কুরাইশদের কেউ হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে হজরত সাদ (রা.) তীর নিক্ষেপ করেন। এটাই হলো ইতিহাসে কাফিরদের বিরুদ্ধে কোনো মুসলমানের ছোড়া প্রথম তীর। দ্বিতীয় হিজরির রবিউসসানি মাসে রাসুল (সা.) ২০০ সাহাবির একটি দল নিয়ে মদিনার আশপাশে শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে এবং তাদের মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য জানান দিতে বের হন। এ দলের পতাকাবাহী ছিলেন হজরত সাদ (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় হজরত বেলাল (রা.)-এর অনুপস্থিতিতে হজরত সাদ তিনবার আজান দিয়েছেন। রাসুল (সা.) তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, 'আমার সঙ্গে বেলালকে না দেখলে তুমি আজান দেবে।' হজরত সাদ (রা.)-এর মধ্যে কাব্যপ্রতিভাও ছিল। ইবনে হাজার 'আল-ইসাবা' গ্রন্থে তাঁর কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করেছেন। হজরত সাদ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মধ্যে হজরত সা'দের একটি বিশেষ মর্যাদা ও অবস্থান ছিল। একবার হজরত সাদ (রা.) মোজার ওপর মাসাহ সংক্রান্ত একটি হাদিস বর্ণনা করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হাদিসটি যাচাই করার জন্য স্বীয় পিতা উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে গেলে তিনি বলেন, যখন সাদ তোমাদের কোনো হাদিস বর্ণনা করে, তখন সে সম্পর্কে অন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। খুলাফায়ে রাশেদিনের সবাই হজরত সা'দের মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করতেন। হজরত উসমান (রা.) শাহাদাৎ বরণ করলে ইসলামের ইতিহাস এক চরম ক্রান্তিকালে উপনীত হয়। তখন মুসলিম উম্মাহ তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষে ছিল উসমানের বিরুদ্ধবাদীরা, অন্যপক্ষে ছিল হজরত উসমানের হত্যাকারীদের বিচারপ্রার্থীরা। উভয় পক্ষেই ছিলেন বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম। এ দুই দলের মধ্যবর্তী আরো একটি নীরব শ্রেণীর লোক ছিলেন, যাঁরা কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধারণ করাকে বৈধ মনে করতেন না। হজরত সাদ ছিলেন এ নিরপেক্ষ লোকদের একজন। তিনি তখন মদিনার নিজ ঘরে অবস্থান করেন। দশম হিজরিতে হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বিদায় হজে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু হজের অনুষ্ঠানাদি পালনের আগেই মক্কায় তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবনের আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে এসে তাঁকে দেখে যেতেন। হজরত সাদ (রা.) বলেন, একদিন রাসুলে করিম (সা.) আমাকে দেখতে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আমার কপালে হাত রাখলেন। এরপর মুখমণ্ডলের ওপর দিয়ে হাতের স্পর্শ বুলিয়ে পেট পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তিনি আমার জন্য দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ, সাদকে শেফা দান করো, তার হিজরতকে পূর্ণতা দাও, আর হিজরতের স্থান মদিনাতেই তাঁর মৃত্যু দান করো।' তিনি এরপর আরো ৪৫ বছর জীবিত ছিলেন। হজরত সাদ বলতেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতের শীতল স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। ৫৫ হিজরি মোতাবেক ৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনা থেকে ১০ মাইল দূরে আকীক উপত্যকায় কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর হজরত সাদ (রা.) ৮৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা (রা.) ও আজওয়াজে মুতাহ্হারাতের অনুরোধে তাঁর লাশ মসজিদে নববীতে আনা হয় এবং রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীগণ তাঁর জানাজায় শরিক হন। হজরত সাদ (রা.) যে জুব্বাটি পরে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী সেটি দিয়ে তাঁর কাফন দেওয়া হয়। মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ