ছবি সংগৃহীত

আশারায়ে মুবাশশিরিন-৭ : জীবদ্দশায় শহীদ খেতাবপ্রাপ্ত হজরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.)

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৩:২৬
আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৩:২৬

ইসলামের সূচনাকালে যাঁরা রাসুলে খোদা মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বীন কবুল করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, তাঁদেরই একজন হজরত আবু মুহাম্মদ তালহা (রা.)। তাঁর বাবার নাম ছিল উবাইদুল্লাহ এবং মায়ের নাম সা'বা। তিনি আরবের বিখ্যাত কোরাইশ গোত্রের তাইম শাখার লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর স্বগোত্রীয়। তিনি ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহ্যবাহী বনি তাইমের সন্তান হিসেবে ঐতিহ্যগত কৌলীন্য তাঁর শৈশবের সঙ্গী ছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে তাঁর ইসলাম-পূর্ব জীবন সম্পর্কে ইতিহাস খুব বেশি তথ্য ধারণ করতে পারেনি। কৈশোরের চপলতা যখন জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে পরিচালিত করে, ঠিক সে সময়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন। হজরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি ছিল বেশ ঐতিহ্যবাহী কোরাইশ গোত্রের তাইম পরিবারের সন্তান হজরত তালহা (রা.) তৎকালীন আভিজাত্যের প্রতীক ব্যবসার সঙ্গে ছোটবেলায়ই যুক্ত হয়ে পড়েন। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর বাড়িতে কুলীন কোরাইশদের যে নিয়মিত বৈঠক বসত, হজরত তালহা ছিলেন তার নিয়মিত সদস্য। একবার তিনি বাণিজ্য উপলক্ষে কোরাইশদের এক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া যান। বাজারে পেঁৗছে ব্যবসায়ীরা যে যার মতো পণ্য খরিদ করতে ছড়িয়ে পড়েন। হজরত তালহা তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি যখন বাজারে ঘোরাফেরা করছিলেন, তখন শুনতে পান জনৈক খ্রিস্টান পাদ্রি ঘোষণা করছেন, 'ওহে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে মক্কাবাসী কেউ আছে কি? তালহা নিকটবর্তী হওয়ায় দ্রুত পাদ্রির কাছে গিয়ে নিজেকে মক্কার অধিবাসী বলে পরিচয় দিলেন। তখন পাদ্রি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে 'আহমাদ' আত্মপ্রকাশ করেছেন কি? তাঁর আত্মপ্রকাশের প্রতিশ্রুতির মাস এটিই। তিনি হবেন শেষ নবী। মক্কায় আত্মপ্রকাশ করে কালো পাথর ও খেজুরের উদ্যানবিশিষ্ট জনপদের দিকে তিনি হিজরত করবেন। ওহে যুবক, খুব তাড়াতাড়ি তোমার তাঁর কাছে যাওয়া উচিত। হজরত তালহা (রা.) বলেন, পাদ্রির কথা আমার অন্তরে দারুণ প্রভাব সৃষ্টি করল। আমি আমার কাফেলা ছেড়ে একাকী বাহনে আরোহণ করলাম। কত দ্রুত মক্কায় পৌছে যায়, সেটাই ছিল তখন আমার একমাত্র চেষ্টা। আমি মক্কায় পেঁৗছলাম, পরিবারের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমার সিরিয়া যাওয়ার পর মক্কায় কোনো নতুন ঘটনা ঘটেছে কি? তারা আমাকে বলল, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নিজেকে নবী বলে দাবি করেছে। আর কুহাকার পুত্র আবু বকর তাঁর সমর্থন করেছে। ঘটনার বিবরণ শোনার পর তিনি হজরত আবু বকর (রা.)-এর বাড়িতে গেলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নিজেকে নবী দাবি করেছেন, আর আপনি নাকি তাঁর ওপর ইমান এনেছেন? আবু বকর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। তিনি সত্য নবী। আমি তাঁর দাওয়াত কবুল করে মুসলমান হয়ে গেছি। আমি তোমাকেও ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। হজরত তালহা বলেন, আমি আবু বকরকে খ্রিস্টান পাদ্রির কথাগুলো বললাম। অতঃপর তিনি আমাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গেলেন। আমি কালেমায়ে শাহাদাৎ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম। রাসুলে কারিম (সা.) সিরিয়ার পাদ্রির কথা শুনে খুবই খুশি হলেন। তালহা (রা.) বলেছেন, আবু বকর (রা.)-এর প্রেরণায় ইসলাম গ্রহণকারী চতুর্থ ব্যক্তি আমি। প্রথম পর্যায়ে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের সবাই মক্কার মোশরেকদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন। হজরত তালহার (রা.) ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর মায়ের বড় ইচ্ছা ছিল, ছেলে বড় হয়ে বংশের নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করে স্বগোত্রীয় লোকদের বিরাগভাজন হওয়ায় তাঁর মনোবাঞ্ছা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি নিজ পুত্রের ওপর সাংঘাতিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে নিজের আত্মীয় আর কোরাইশদের পক্ষ থেকে অত্যাচার-নির্যাতনের যে বিভীষিকা নেমে এসেছিল, তার বিপরীতে হজরত তালহা (রা.) ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। সর্বান্তঃকরণে চালিয়ে যেতে থাকেন ইসলামের তাবলিগের কাজ। অভ্যাগত বিদেশি, বেদুঈন পলি্ল আর মোশরেকদের তাঁবু ও ঘরে গিয়ে তিনি তাদের ইসলামের মর্যাদার কথা বোঝাতেন। দারুল আহকামে মুসলমানদের বৈঠকে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত। এভাবে কেটে যায় ১৩টি বছর। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে রাসুলে কারিম (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরতের পর হজরত তালহা (রা.) আবু বকরের পরিবারকে নিয়ে হিজরত করে নিরাপদে মদিনায় পেঁৗছান। মক্কায় থাকাকালে রাসুল (সা.) তালহা ও জুবাইয়ের মধ্যে ভ্রাতৃসম্পর্ক করে দিয়েছিলেন। মদিনায় পেঁৗছার পর আল্লাহর রাসুল হজরত তালহার সঙ্গে মদিনার বিখ্যাত আনসার সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারীর সঙ্গে ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন করে দেন। রাসুল (সা.) কর্তৃক কাফির ও মোশরেকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রায় সব যুদ্ধেই হজরত তালহা (রা.) অংশ নেন। বদর যুদ্ধে মদিনার নিরাপত্তায় রাসুল (সা.) কর্তৃক নিয়োজিত বিশেষ দায়িত্ব পালনের কারণে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও বদরি হিসেবে গণ্য করে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে গনিমতের অংশ প্রদান করেন। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত তিনি উহুদের যুদ্ধের সময় রেখেছিলেন, তার তুলনা বিরল। তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে যখন মুসলিম বাহিনী চরম বিপর্যয়ের মুখে, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ঘিরে ১১ জন আনসার আর মুহাজিরদের মধ্যে একমাত্র তালহা (রা.) রক্ষাবূ্যহ রচনা করেছিলেন। কাফিরদের মোকাবিলা করে একেক করে ১১ জন আনসার সাহাবাই শাহাদাৎ বরণ করেন। অতঃপর হজরত তালহা (রা.) রাসুলের নির্দেশে তাদের প্রতিহত করতে অগ্রসর হন। রাসুল (সা.) কাফিরদের আক্রমণে মারাত্মক আহত হন। তাঁর শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়। দান্দান মোবারক শহীদ হয়। হজরত তালহা বীরবিক্রমে আক্রমণ করে কাফিরদের কিছুদূর হটিয়ে দিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে ফিরে এসে তাঁকে কাঁধে করে পাহাড়ের ওপরে উঠছিলেন। আবার কাফিরের দল এগিয়ে এলে তিনি রাসুল (সা.)কে রেখে তাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। এভাবে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে একটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তিনি একসময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। ইতিমধ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুল (সা.)কে কেন্দ্র করে সমবেত হতে থাকেন। হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি ও আবু উবায়দা (রা.) রাসুলুল্লাহর কাছে এসে তাঁর সেবার জন্য গেলে তিনি বলেন, তোমরা আমাকে ছেড়ে তোমাদের ভাই তালহার খবর নাও। আবু বকর (রা.) বলেন, আমরা দেখি কিছু দূরে একটি গর্তের মধ্যে তালহা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীরে তরবারি, তীর ও বর্শার সত্তরটির বেশি আঘাত ছিল। উহুদের যুদ্ধের এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) তালহা (রা.) সম্পর্কে বলতেন, 'যদি কেউ কোনো মৃত ব্যক্তিকে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াতে দেখতে চায়, তাহলে সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে দেখে।' এ কারণেই তাঁকে বলা হয় জীবিত শহীদ। রাসুলে কারিম (সা.)-এর ইন্তেকালে হজরত তালহা (রা.) সাংঘাতিকভাবে মুষড়ে পড়েছিলেন। খলিফাতুর রাসুল হজরত আবু বকরের বিশেষ পরামর্শদাতা ছিলেন তিনি। রিদ্দার যুদ্ধের সময় হজরত ওমর (রা.)সহ অনেকেই যখন জাকাত অস্বীকারকারীদের সঙ্গে কোমলতার পক্ষে, তখন হজরত তালহা (রা.) স্পষ্ট করে বলে দেন, 'যে দ্বীনে জাকাত নেই, তা সত্য হতে পারে না।' দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.)-এর পরামর্শসভারও তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। হজরত উমর (রা.) ইন্তেকালের আগে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ভার যে ছয়জন মহান ব্যক্তির ওপর অর্পণ করে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। খলিফা নির্বাচনে চরম বাদানুবাদের একপর্যায়ে হজরত তালহা (রা.) নিজের খেলাফতের দাবি ত্যাগ করার কারণেই নির্বিঘ্নে হজরত উসমান (রা.) তৃতীয় খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। হজরত উসমান (রা.)-এর শাহাদতের পর একদল লোক হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। হজরত তালহা ও জুবাইর (রা.) মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর সঙ্গে ইসলামী খেলাফতের উদ্ভূত সমস্যাবলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় স্থির হয় ইসলামী খেলাফতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে উসমান হত্যাকারীদের বিচারের কোনো বিকল্প নেই। খলিফা আলীকে উসমান হত্যাকারীদের বিচারবিধানে বাধ্য করতে হজরত আয়েশা, তালহা ও জুবাইর (রা.) বিপুলসংখ্যক অনুগামীসহ বসরার দিকে যাত্রা করেন। হজরত আলী (রা.) তাঁদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীসহ অগ্রসর হলে 'মিকার' নামক স্থানে দুই দল মুখোমুখি হয়। চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে দূত মারফত সন্ধির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় উভয় পক্ষ এবং আলোচনা মীমাংসার খুব কাছাকাছি পেঁৗছায়। কিন্তু কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী, উসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডে প্রধান ইন্ধনদাতা ইবনে সাবার ষড়যন্ত্রে উভয় পক্ষ রাতের আঁধারে ভীষণ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। হজরত তালহা (রা.) মারাত্মক আহত হন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য বসরার 'দারুল ইলাজ' চিকিৎসালয়ে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে, ৩৬ হিজরী ১০ জমাদিউস সানি ৬৪ বছর বয়সে তাঁর ইন্তেকাল হয়। মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ