ছবি সংগৃহীত

আরিফ খানের সংবিধান গবেষণা

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০১৪, ১৩:১০
আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৪, ১৩:১০

(সাপ্তাহিক ‘সাপ্তাহিক’) - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর.সি. মজুমদার অডিটরিয়াম। ছাত্র-ছাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। নির্দিষ্ট আসন সব ভরা। মাঝের সিঁড়িতেও বসে আছেন অনেকেই। এদের সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী। হল ভরে নামতা মুখস্থ চলছে, উচ্চস্বরে। হঠাৎ করে এই অডিটরিয়ামে ঢুকলে মনে হবে এটা কোনো প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর গণিতের ক্লাস। মাস্টার মশাইর সঙ্গে সুর মিলিয়ে নামতা পড়া হচ্ছে। তিন তিন তিন এক এক, তিন তিন তিন এক এক, ৩ ৩ ৩ ১ ১... এই নামতা পড়ছে সবাই উচ্চস্বরে। মাইক হাতে গোটা অডিটরিয়ামের এক মাথা থেকে অন্য মাথা ছুটে সেই নামতাকে উচ্চস্বর থেকে নিচুস্বর, নিচু থেকে উচ্চ করে উঠানামা করাচ্ছেন একজন। না, এটি গণিতের ক্লাস নয়। কোনো ধরনের অঙ্কও শেখানো হচ্ছে না। এটা সংবিধানের ক্লাস। মঞ্চের ব্যানারে লেখা আছে ‘বাংলাদেশের সংবিধান পরিচিতি’। এভাবেই সহজে, কম সময়ে বাংলাদেশের সংবিধান পরিচয়ের, মনে রাখার ক্লাস চলছে। স্বল্প সময়ে, গোটা সংবিধানকে কীভাবে মনে রাখা যায়, সংবিধানের পুরো কাঠামোর পরিচয় পাওয়া যায়, সংবিধানের নানা অনুচ্ছেদ প্রয়োজনমাফিক কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই কৌশল শেখানো হচ্ছে। সঙ্গে বলা হচ্ছে সংবিধান কীভাবে রচিত হলো, কী প্রক্রিয়ায়, কত দিনে, কতজনের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এ রাষ্ট্রিক দলিলটি তৈরি হলো তার পেছনকথা। শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন সেসব কথা। নামতার ঢঙে সংবিধানের প্রাথমিক ভাগ জানার পর চলছে প্রশ্ন-উত্তরের পালা। ২. আরিফ খান এভাবেই সংবিধান শিখিয়ে চলেছেন। এটা এখন তার মিশন, ভিশন এবং স্বপ্ন। তিনি নিজেকে একজন সুইসাইডার ভাবেন। আইন শাস্ত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠ সাঙ্গ করেছেন। সহপাঠীরা যখন সবাই আদালতের বিচারিক চাকরিতে ঢুকছেন, আরিফ খান তখন অন্য স্বপ্নে মগ্ন। ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে গেছেন। কিন্ত সেটা আর শেষ করা হয়নি। বরং আইন বিদ্যার নানান অলিগলি খুঁজেছেন। নিজের আয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে বলে যতটা সময় পেয়েছেন লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন। লাইব্রেরি তার কাছে তীর্থস্থানের মতো। দেশে, দেশের বাইরে যেখানেই গেছেন লাইব্রেরির ভেতরে ঠাঁই নিয়েছেন। আইন, সংবিধান এসব বিষয়ে গবেষণার জন্য তথ্য খুঁজেছেন। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে তার ভীষণ গর্ব। তার বিবেচনা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সংবিধানের এটি একটি। বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তুতির পুরো ইতিহাস অজানা বলে মানুষের কাছে এর ভুল পরিচিতি আছে। বাংলাদেশের সংবিধান, এর প্রণয়ন-পূর্বকাল, প্রণয়নকাল, প্রণয়ন-পরবর্তী সময় নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন তিনি। প্রায় এক দশক ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন এ বিষয়ে বৃহৎ কলেবরে সংকলন তৈরির। ইতোমধ্যে চলতি ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে বই লিখেছেন। আইন শাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের জন্য বহুল কাটতি হওয়া এই বই তাকে অনুপ্রাণিত করেছে সংবিধান নিয়ে সচেতন মানুষদের কাছে যাওয়ার জন্য। মানুষ যাতে সহজভাবে, সুখকর উপায়ে, আনন্দময়তার সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধান মনে রাখে, পড়ে, ভালোবাসে তার যত রকম পথ তৈরি করা দরকার সেটাই তার সার্বক্ষণিক ভাবনা। তিনি নিজে সংবিধান হাফেজ। পুরো সংবিধান তার মুখস্থ। আদালতে আইনজীবী হিসেবে সহকর্মীরা যখন বিভিন্ন মামলায় সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধারা, অনুচ্ছেদ, রেফারেন্স খুঁজতে গলদঘর্ম হন, বিচারক তখন আরিফ খানের দিকে ইঙ্গিত করেন। সংবিধান নিয়ে এই মগ্নতায় কাটছে আরিফ খানের সময়। তার বিশ্বাস, রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যকার বৈধ চুক্তির এই দলিল সম্পর্কে অজ্ঞতা যতদিন কাটবে না, ততদিন রাষ্ট্র দাঁড়াবে না। আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটও নৈতিক পথে, ন্যায্যতার উপায়ে কাটবে না। ৩. বাংলাদেশের সংবিধান তৈরি করতে সময় লেগেছিল ২০৯ দিন। ১০ এপ্রিল ১৯৭২ থেকে ৪ নভেম্বর ১৯৭২ পর্যন্ত। এজন্য ৩৪ জন গণপরিষদ সদস্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের সংবিধানের একটি খসড়া বা ড্রাফট তৈরি করার। এই ৩৪ জনের কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. কামাল হোসেন। কমিটি নিজেদের মধ্যে ৭৪টি বৈঠক করেছে। সংবিধানের প্রাথমিক কাঠামো দাঁড় করানোর জন্য ৩০০ ঘণ্টা সময়ব্যাপী কাজ করেছেন। এই কমিটির বাইরে ৪০৩ সদস্যের গণপরিষদ ২টি অধিবেশনে মোট ১৬টি বৈঠকে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির দলিলটি কেমন হবে, এ নিয়ে তারা বিপুল বিতর্ক ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। অবকাঠামোহীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও প্রায় নিঃস্ব একটি দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর এক বছরেরও কম সময়ে নিজেদের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করেছে। বিশ্বের কাছে এ উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ও বিজয় অর্জনের পরের সময়গুলোতে মহা উৎসাহ ও স্বপ্ন নিয়ে রচিত হয়েছে এদেশের মানুষের বহুদিনের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রের একেকটি আইনি দলিল। এগুলোই সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক দলিলপত্র। ৪. স্বাধীনতার পর যখন এই নতুন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও মৌলিক আইনি দলিল ‘সংবিধান’ তৈরির প্রশ্ন উঠল, তখন এই সর্বমান্য দলিলে এই জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবি রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের অঙ্গীকারগুলো অনায়াসে স্থান করে নিয়েছিল। ৯০ পৃষ্ঠার সেই দলিলে একটি জাতির ও জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকারসমূহ অনিন্দ্যসুন্দর ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু কেমন ছিল সংবিধান তৈরির সেই ২০৯ দিন? কারা জড়িত ছিলেন এই রাষ্ট্রের মৌলিক এই দলিল প্রণয়নে? কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে তারা জাতির এই শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দলিল প্রণয়ন করেছিলেন? মাত্র ৯০ পৃষ্ঠায় ১৬ হাজার ৪৬৪ শব্দের সেই সংবিধান তখন বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছিল। জানা যায় সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর একটি কপি ড. কামাল হোসেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তিসম বিচারপতি লর্ড ডেনিংয়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বিচারপতি লর্ড ডেনিং সংবিধানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং ধন্যবাদ জানিয়ে ড. কামাল হোসেনকে চিঠি লিখেছেন। বাংলাদেশের সংবিধান কেমন হবে এর নানা দিক আলোচনার জন্য দেশের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংটি হয়েছে ইংল্যান্ডের নাফিল্ড-এ। সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ কে. সি. হুইয়ার। এসব ঐতিহাসিক তথ্য আর দলিল আমাদের মহামূল্যবান সম্পদ। প্রায় এক দশক ধরে আরিফ খান নিজস্ব শ্রমে, চেষ্টায়, অর্থে এসব সংগ্রহ এবং সম্পাদনার কাজ করে চলেছেন। ১০ খণ্ডে প্রায় ২ হাজার ৬শ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের সাংবিধানিক দলিলপত্র বই আকারে প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ৫. ২৬ মার্চ ১৯৭১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এর মাত্র চৌদ্দ দিনের মাথায় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) জারি করা হয়। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। সাবলীল ভাষায় রচিত ৫০৭ শব্দের এই সংবিধান অনুসারেই নয় মাসব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এই সংবিধানের ম্যান্ডেট অনুসারেই মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। এই সংবিধানের বৈধতার গুণেই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ও অন্যরা মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তির পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে একটি 'অস্থায়ী সংবিধান আদেশ' (Provisional Constitutional Order) জারি করেন। এই সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তখনও স্বাধীন রাষ্ট্রের বয়স দেড় মাসও পূর্ণ হয়নি। এ সময় উদ্যোগ নেয়া হয় বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনার। ২৩ মার্চ ১৯৭২ গণপরিষদ আদেশ জারি করা হয়। এই গণপরিষদের সদস্য হন তারা, যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ভোটে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের ওপরই অর্পিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের সংবিধান’ রচনার গুরুদায়িত্ব। ১০ এপ্রিল ১৯৭২ গণপরিষদের প্রথম বৈঠক থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিন পর্যন্ত শত শত ঘণ্টা তারা পরিশ্রম করেছেন। বলা যায়, ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এই নয় মাস যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের কাল, তাহলে- ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ এই সাড়ে দশ মাস হল মুক্তিযুদ্ধের প্রতিতী, প্রজ্ঞা ও চেতনার লিখিত রূপদানের সংগ্রামের কাল। ফলে, দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সাড়ে দশ মাসও আমাদেরকে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক (intellectual) সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই সংগ্রাম ছিল রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য মূল দলিল অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়নের লড়াই। আরিফ খানের প্রত্যয় এই সংগ্রামের ইতিহাস জনগণকে না জানালে, আমাদের শক্তিমত্তার উৎস অজানাই থেকে যাবে। লোককথা, কানকথাতেই থেকে যাবে সংবিধান তৈরির গুজবময় অসত্য ইতিহাস। নতুন প্রজন্ম কোনো দিনই জানতে পারবে না আমাদের অগ্রজরা কী অসাধারণ কাজটিই না করে গেছেন আমাদের জন্য। ৬. আরিফ খানের বিবেচনায়, সংবিধান প্রণয়নের এই সাড়ে দশ মাস বাঙালি জাতির জীবনের এক অনন্য ও হীরন্ময় কাল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ও সংবিধান প্রণয়নের সাড়ে দশ মাস- এই সাড়ে উনিশ মাসে পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিয়ে জন্ম নিয়েছে একটি নতুন রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। সেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য এর জনগণ স্মরণকালের ইতিহাসে সফলতম এক জনযুদ্ধের সার্থকতম নেতৃত্ব প্রদান করেছে। এবং স্বাধীনতার পর মাত্র ২০৯ দিনের মধ্যে তারা সফলভাবে এই রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের ঘোষণা সম্বলিত সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। সাংবিধানিক দলিলপত্রের সবচেয়ে বড় প্রাসঙ্গিকতা হলো এগুলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বৈধতার দলিল। দেশীয় অনুচর, দালাল, রাজাকার, জবরদখলকারী পাকিস্তানি সেনা ও আন্তর্জাতিক সুপার পাওয়ারগুলোর অনৈক্য জর্জরিত কূটনৈতিক চাপ-এই প্রতিটি ফ্রন্টেই আমাদেরকে সমানতালে মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে। এই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভবকে অবশ্যম্ভাবী, অপরিহার্য ও সর্বোপরি একটি ন্যায্য দাবি হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদেরকে যারপরনাই কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আর এসবই সফলভাবে সম্ভব হয়েছে অভূতপূর্ব ভাষায় ও অনন্যসাধারণ দক্ষতায় তৈরি সাংবিধানিক দলিলপত্রসমূহের জন্য। অথচ এই গর্বের অধ্যায়, সাফল্যের দলিলপত্রকে কি অনায়াসেই না অবহেলা করেছি। আরিফ খান প্রশ্ন তোলেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় আইনজীবী ব্যারিস্টার সুব্রত রায়ের কথা আমরা কতটুকুই বা মনে রেখেছি? তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আন্তর্জাতিক আইনের নিরিখে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। স্বাধীনতার মাত্র দেড় বছরের মাথায় তিনি এ বিষয়ে বইও লিখেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও জনগণের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল ও অস্থায়ী সংবিধান- ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এর ড্রাফটিংয়ের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৭. জাতিরাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের হালহকিকত কী? একটি দৈনিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ‘সংবিধান প্রণয়নের প্রামাণিক দলিলসংক্রান্ত ঐতিহাসিক নথিপত্রের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আইন মন্ত্রণালয়ের মতে, নথিগুলোর দাপ্তরিক কর্তৃপক্ষ সংসদ সচিবালয়। সংসদ সচিবালয় বলছে, নথিগুলো আইন মন্ত্রণালয়েও থাকতে পারে। তবে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েও এর কোথাও নথিগুলোর হদিস মেলেনি। ন্যাশনাল আর্কাইভসেও নেই।’ রিপোর্টে আরও বলা হয়, ‘সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণী, প্রতিটি অনুচ্ছেদের খসড়া, সদস্যদের মতামত, বাংলা তর্জমা কমিটি, অলংকরণ কমিটি ও সংবিধান ছাপাসংক্রান্ত সব তথ্য ওই সব নথিতে ছিল।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ৫ নভেম্বর ২০১০) ভারত তাদের সাংবিধানিক দলিলপত্র সংকলন ও সংরক্ষণ করেছে ১৯১৬ সাল থেকে। পাকিস্তান তাদের সাংবিধানিক দলিলপত্র সংকলন ও সংগ্রহ করছে ১৯৬৪ সালে ৫ (+১) খণ্ডে। আমেরিকা তাদের সাংবিধানিক দলিলপত্র সংরক্ষণ করছে ১৭৯০ সাল থেকে। অথচ বাংলাদেশের জন্��লগ্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক দলিলপত্রের সংরক্ষণ আমরা করিনি, এমনকি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিনি। ৮. সে কারণেই সাংবিধানিক দলিলপত্র গ্রন্থ আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন আরিফ খান। এজন্য প্রকাশক খুঁজছেন। এই বিশাল আকারের গ্রন্থ প্রকাশের জন্য বেসরকারি প্রকাশকরা খুব একটা আগ্রহী নন খরচের কথা মাথায় রেখে। আবার সরকারের প্রকাশনা সংস্থার আগ্রহের টিকিটি খুঁজে পাওয়ায় খুব মুশকিল। এক দশক ধরে আরিফ খান সংবিধান রচনা সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যেখানে যে যেভাবে জড়িত ছিলেন, যার খোঁজ পেয়েছেন তার কাছেই ছুটে গেছেন। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তাকে সহযোগিতা করেছেন। প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান উৎসাহের তাগাদা অব্যাহত রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিভাগের শিক্ষকরা, আদালতে সিনিয়র আইনজীবীদের সহমর্মিতা এই একক যুদ্ধে আরিফ খানকে সচল রেখেছে। কিন্তু ১০ খণ্ডে আনুমানিক ২ হাজার ৬শ পৃষ্ঠার এই জাতীয় দলিল প্রকাশের জন্য সম্মানজনক শর্তে প্রকাশক পাওয়া ক্রমশ তার জন্য দুরূহ হয়ে উঠছে। আবার, এরকম একটি আইনি দলিল, গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় আকরগ্রন্থ একজন তরুণের হাত দিয়ে তৈরি হতে যাচ্ছে- এই প্রস্তুতি অনেককে তার বিষয়ে ঈর্ষান্বিতও করছে। কিন্তু আরিফ খান দমবার পাত্র নন। গত এক দশকের প্রতিটি ঘণ্টার শ্রমই তার শক্তি। তিনি ভাবেন, জাতির এই ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট বিষয়ে দেশে বিদ্ব্যৎ সমাজ, প্রকাশকদের কারও না কারও সুদৃষ্টি পড়বেই। তারাই হয়ত এগিয়ে আসবেন সাংবিধানিক দলিলপত্র প্রকাশে সহায়তার হাত বাড়িয়ে। তার প্রতীতি মুক্তিযুদ্ধের এই রক্তরাঙ্গা দলিল জাতির প্রয়োজনেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবেই। সেই আশায় তার প্রস্তাবিত ১০ খণ্ডের বইয়ের পরিকল্পনা, প্রস্তাবনা নিয়ে তিনি নিত্য ছুটছেন। তার বিশ্বাস, মানুষের স্বপ্নই হচ্ছে গন্তব্য। সেই গন্তব্যে তিনি পৌঁছবেন, আজ হোক কাল হোক। কোনগুলো সাংবিধানিক দলিলপত্র * স্বাধীনতার ঘোষণা (২৬ মার্চ, ১৯৭১) * স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (১০ এপ্রিল, ১৯৭১) * আইনের ধারাবাহিক বলবৎকরণ আদেশ (১০ এপ্রিল, ১৯৭১) * বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ * বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ * বাংলাদেশ গণপরিষদ (সংশোধন) আদেশ (একাধিক) * সংবিধান খসড়া প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট * সংবিধানের খসড়া বিষয়ক ৬টি নোট অব্ ডিসেন্ট (সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জন সদস্যের মধ্যে ৬জন প্রস্তাবিত সংবিধানের বিভিন্ন বিধান সম্পর্কে যেসব আপত্তি বা নোট অব্ ডিসেন্ট প্রদান করেছিলেন সেগুলোর সংকলন) * বাংলাদেশের গণপরিষদে উত্থাপিত খসড়া সংবিধানের কপি * গণপরিষদে উত্থাপিত খসড়া সংবিধানের গেজেটেড কপি * গণপরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধান (৪ নভেম্বর, ১৯৭২) * গণপরিষদ কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত সংবিধানের যে কপিতে স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করেছিলেন ইত্যাদি এই দলিলপত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার গণপরিষদ বিতর্কটি। সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার আগে ৪০৩ জন সদস্য জাতির এই মৌলিক রাজনৈতিক দলিলটি কেমন হবে, এতে কী কী থাকবে এসব বিষয়েও বিতর্ক করেছেন। তার পুরোটা থাকছে এখানে। সংবিধান বিষয়ক আরিফ খান রচিত বই * সহজ ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধান * বাংলাদেশের সংবিধান : একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠ * সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও তথ্যউপাত্তসহ বাংলাদেশের সংবিধান * বাংলাদেশের সংবিধান ও সাংবিধানিক আইন * জনগণের সংবিধান * সংবিধান বিষয়ক প্রবন্ধ * বাঙালির সংবিধান চর্চার ধারা * বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির ইতিহাস বাংলাদেশের সাংবিধানিক দলিলপত্র ॥ ১০ খণ্ডে সমাপ্ত (প্রস্তাবিত) (The Constitutional Documents of Bangladesh) ১০ খণ্ডের পরিকল্পনার ছক ১ম খণ্ড (আনুমানিক ১৫০ পৃষ্ঠা) ২য় খণ্ড (আনুমানিক ২৫০ পৃষ্ঠা) ৩য় খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ৪র্থ খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ৫ম খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ৬ষ্ঠ খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ৭ম খণ্ড (আনুমানিক ২০০ পৃষ্ঠা) ৮ম খণ্ড (আনুমানিক ২০০ পৃষ্ঠা) ৯ম খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ১০ম খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) দলিলপত্রের কোন খণ্ডে কী থাকবে ১ম খণ্ড (আনুমানিক ১৫০ পৃষ্ঠা) * স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র * আইনের ধারাবাহিক বলবৎকরণ আদেশ * বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ * বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ * বাংলাদেশ গণপরিষদ (সংশোধন) আদেশ * সংবিধান খসড়া প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট * সংবিধানের খসড়া বিষয়ক ৬টি নোট অব্ ডিসেন্ট (সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জন সদস্যের মধ্যে ৬জন প্রস্তাবিতব্য সংবিধানের বিভিন্ন বিধান সম্পর্কে যেসব আপত্তি বা নোট অব্ ডিসেন্ট প্রদান করেছিলেন সেগুলোর সংকলন ২য় খণ্ড (আনুমানিক ২৫০ পৃষ্ঠা) * বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান, গণপরিষদে উত্থাপিত * বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২, গণপরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত * গণপরিষদে উত্থাপিত খসড়া সংবিধানের গেজেটেড কপি ৩য় খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ৪র্থ খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ৫ম খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) ৬ষ্ঠ খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) * উল্লিখিত ৩য় থেকে ৬ষ্ঠ এই মোট চারটি খণ্ডে সম্পূর্ণ গণপরিষদ বিতর্কটি ছাপা হবে। ১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদ কর্তৃক মুদ্রিত, নেয়ামাল বাসির সম্পাদিত, মোট ১৯টি সংখ্যা, প্রায় সাড়ে সাতশত পৃষ্ঠা। ৭ম খণ্ড (আনুমানিক ২০০ পৃষ্ঠা) * বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির সঙ্গে যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তাদের পরিচিতি। * বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির সময় দেশের অভ্যন্তরে সংবিধান বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, দল ও সংগঠনের উদ্যোগ, উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া (ওই সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন, প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয়’র সংকলন)। * ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জেতার পর আওয়ামী লীগ কর্তৃক যে সংবিধান খসড়া আকারে পেশ করা হয়েছিল ৮ম খণ্ড (আনুমানিক ২০০ পৃষ্ঠা) * এ পর্যন্ত আনীত সংবিধানের ১৫টি সংশোধনী * সংবিধান সংশোধনীমূলক বিভিন্ন সামরিক ফরমান ৯ম খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) * বাংলাদেশে সংবিধান চর্চার ধারা (এ পর্যন্ত উচ্চ-আদালত কর্তৃক ঘোষিত সংবিধান বিষয়ক বিভিন্ন বিখ্যাত মামলা) ১০ম খণ্ড (আনুমানিক ৩০০ পৃষ্ঠা) * যা সংবিধান কোষ হিসেবে অভিহিত হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতিটি শব্দকে আলাদা আলাদা ভুক্তি আকারে সাজিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অভিধান। অভিধানটি প্রণীত হলে সংবিধানে বর্ণিত যেকোনো বিষয় ও যেকোনো অনুচ্ছেদ দ্রুততম সময়ে রেফারেন্স হিসেবে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। * সংবিধান সংক্রান্ত বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য ছবির সংকলন। বিক্স ও আরিফ খান আরিফ খান সংবিধান পরিচিতি, সংবিধান পাঠকে জনপ্রিয় করার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিক্স এর প্রতিষ্ঠা করেছেন। সংবিধান বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা ও সর্বস্তরের নাগরিকদের জন্য সংবিধান শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন। এ প্রতিষ্ঠানের আওতায় প্রতিমাসে সংবিধান বিষয়ক একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বিক্স-এর পরিকল্পনায় আছে দেশজুড়ে হাতে লেখা আদি সংবিধানের প্রদর্শনী করার। কথা চলছে অডিও সিডিতে সম্পূর্ণ সংবিধান প্রকাশের। চিন্তা কাজ করছে সহজ ভাষায় মোবাইল ও কম্পিউটার উপযোগী করে সংবিধান অ্যাপস তৈরির। সংবিধান বিষয়ে ডকুমেন্টারি তৈরির কথা ভাবছে বিক্স। অডিও, ভিডিও, কম্পিউটার অ্যাপস, বক্তৃতাসহ প্রচলিত সব মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান সহজলভ্য করতে কাজ করে চলেছে বিক্স।