
ছবি সংগৃহীত
আমি নিজেও তো একটা জীবন বিসর্জন দিয়ে দিলাম : রফিক আজাদ
আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৬, ১০:৫২
গ্রাফিক্স : আকরাম হোসেন।
(প্রিয়.কম) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি রফিক আজাদ। গত ১২ মার্চ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। কবির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে শেঁকড় গজিয়ে গেলেও আর কখনোই ফিরবেন না তিনি। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের লক্ষ্যে ২০১০ সালে নেওয়া কবির একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার প্রিয়.কম-এ প্রকাশিত হলো।
[২০১০ সালের ৩ সেপ্টম্বর। শুক্রবার। সকাল ১১: ৩০ মিনিটে কবি রফিক আজাদের ধাণমণ্ডির বাসার বারান্দায় বসে এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল কলকাতার লিটলম্যাগাজিন ‘কারুভাষ’ পত্রিকার জন্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে নেওয়া ঐ সাক্ষাৎকারে রফিক আজাদের কবিতা নিয়েও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেই প্রশ্নগুলোই এই সাক্ষাৎকারে স্থান পেল।-সুদীপ্ত।]
সুদীপ্ত সাইদ খান : ‘অসম্ভবের পায়ে’ বইটি দিয়েই আপনার শুরু হয়েছিল...
রফিক আজাদ : ‘অসম্ভবের পায়ে’ আমার প্রথম কবিতার বই। তবে আমার শুরুটা কিন্তু সেই শৈশবে। সে সময়ের বেশিরভাগ কবিতাই ছিল আনম্যাচিউরড। ‘অসম্ভবের পায়ে’ বইটি করার সময় প্রচুর কবিতা বাদ দিয়ে, কাট-ছাট করেই বইটি প্রকাশ করেছিলাম। বইটি করার পর চারদিক থেকে প্রচুর বাহবাও পেয়েছি।
সুদীপ্ত সাইদ খান : আপনার বেশ কিছু প্রেমের কবিতা মানুষের মুখে মুখে...
রফিক আজাদ : প্রেম তো আমার জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। নিজেকে তো আমি প্রেমের কবিই বলি।আর মধ্যবিত্ত পাঠকের মনেও প্রেমের কবিতা সহজেই জায়গা করে নেয়।
সুদীপ্ত সাইদ খান : তাহলে কি মধ্যবিত্তের দরজায় হানা দেওয়ার জন্যই প্রেমের কবিতা লিখেছেন?
রফিক আজাদ : না, প্রেম তো কাউকে হানা দেওয়ার জন্য তৈরি হয় না। প্রেম তো ভেতরের ব্যাপার। ভেতরের আবেগ থেকেই আমার প্রেমের কবিতার তৈরি।
সুদীপ্ত সাইদ খান : নিজের কবিতা নিয়ে নিজেকেই যদি মূল্যায়ন করতে বলি তো সেই মূল্যায়নটা কি হবে?
রফিক আজাদ : নিজের কবিতার মূল্যায়ন নিজে নিজে করা খুব কঠিন। আর সেটা করাটাও কতটুকু ভাল দেখাবে তা বলতে পারি না। এ ছাড়া নিজের কাছে নিজের সব লেখাই তো আপন। আজও যখন প্রথম দিককার কবিতাগুলো পড়ি তখন মাঝে মাঝে অবাক হই। তবে ইদানিং মানে এই ২০১০ সালে এসেও আমি যেমন প্রশংসা পাচ্ছি, পাঠকরা আমাকে যেভাবে পড়ছেন তাতে নিজের কবিতা সম্পর্কে নিজের মূল্যায়নটা ভাল। আর আমার অনেক কবি বন্ধুরাই আমার কবিতা নিয়ে নানান মন্তব্য করেছেন। সেগুলোও আমাকে উৎসাহিত করেছে প্রচুর।
সুদীপ্ত সাইদ খান : কবি কি তবে পাঠকের ভালোবাসার জন্যেই শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে?
রফিক আজাদ : কবি অপেক্ষা করে না, কবি প্রতীক্ষা করে। পাঠকের ভালোবাসার জন্য সে প্রতীক্ষা করে। কারণ কবিতা তো পাঠকের জন্যই। কবির প্রেমের সারাংসার তো পাঠকের কাছেই পৌঁছে দিতে চায়।
সুদীপ্ত সাইদ খান : আপনার প্রিয় কবিতা?
রফিক আজাদ : ‘বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে’ এই কবিতাটা আমার অত্যন্ত প্রিয়। এটা আমার ‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’ বইয়ের কবিতা। ১৯৮৫ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।
সুদীপ্ত সাইদ খান : কবিতাটি প্রিয় হওয়ার কারণ কী?
রফিক আজাদ : নানান কারণেই কবিতাটি আমার প্রিয়। সবচেয়ে বড় কথা এই কবিতাটি’তে যে বোধটুকু প্রকাশ করতে চেয়েছি সেটা দুর্দান্ত। আজও, এই সময়েও কবিতাটি সমান আবেদন রাখে।
(চলুন পড়ে নেই কবিতাটি)
বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
বালক জানে না তো পুষবে অনুরাগ
হৃদয়ে কতদিন, কার বা চলা-পথে
ছড়াবে মুঠো-মুঠো বকুল ফুলগুলো;
কোথায় যেতে হবে, যাবে না কোন দিকে,
ব্যাপক হাঁটাহাঁটি করবে কোন পথে!
বালক জানলো না—মানুষ ম্লানমুখে
কেন যে তারা গোনে; পায়ের নীচে কার
কেন যে ফুল ঝরে, কতটা ফুল ঝরে!
মানুষ ভুল পথে গিয়েছে কত দূর,
বেপথু কাকে বলে বালক জানে না তা!
বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই—থাকে না, নিরুপায়—
যে আসে সে-ই জানে—ভুলের দামে কিনে
আনে সে প্রিয় ম্যাপ—পথিক ম্রিয়মাণ,
উল্টোরথে চ’ড়ে চলেছে মূল পথ!
বালক জানে না তো অর্থনীতি আর
মৌল রাজনীতি—উল্টো ক’রে ধরে
সঠিক পতাকাটি—পতাকা দশদিশে
যেনবা কম্পাস স্বদেশ ঠিক রাখে।
বালক জানে না সে বানানে ভুল ক’রে
উল্টাসিধা বোঝে : সঠিক পথজুড়ে
পথের সবখানে কাঁটার ব্যাপকতা!
বালক ভুল ক’রে পড়েছে ভুল বই,
পড়ে নি ব্যাকরণ, পড়ে নি মূল বই!
বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল,
সাঁতার না শিখে সে সাগরে ঝাঁপ দ্যায়,
জলের চোরাস্রোত গোপনে ব’য়ে যায়,
বালক ভুল ক’রে নেমেছে ভুল জলে!
বালক জানে না তো জীবন থেকে তার
কতটা অপচয় শিল্পে প্রয়োজন।
পাথর বেশ ভারী, বহনে অপারগ
বালক বোঝে না তা—বালক সিসিফাস
পাহাড়ে উঠে যাবে, পাথর নেমে যাবে
পাথুরে পাদদেশে!—বিমূঢ়, বিস্মিত
বালক হতাশায় অর্তনাদ ক’রে
গড়িয়ে প’ড়ে যাবে অন্ধকার খাদে।
বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল,
ফুলের নামে কত কাঁটারা জেগে থাকে
পুরোটা পথজুড়ে, দীর্ঘ পথজুড়ে—
বালক জানে না তা, বালক জানে না তো!
বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
সুদীপ্ত সাইদ খান : আপনার বিখ্যাত ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটি লেখার পেছনের গল্পটা কি জানতে পারি?
রফিক আজাদ : কবিতাটি লিখেছিলাম চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। সে সময়ের মিডিয়ায় এসব প্রচুর ফলাও করা হতো। পত্রিকার পাতা খুললেই দুর্দশা, দারিদ্রের করুণ চিত্র দেখতে হতো। আমার কাছে এটাকে মিডিয়ার চক্রান্ত বলেই মনে হয়। সে যাইহোক, অনেকটা প্রতিবাদ স্বরূপই কবিতাটি লিখে ফেলেছিলাম।
(চলুন পড়ে নেই কবিতাটি)
ভাত দে হারামজাদা
ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি: উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে—প্রতিপলে—সর্বগ্রাসী ক্ষুধা!
অনাবৃষ্টি—যেমন চৈত্রের শস্যক্ষেত্রে—জ্বেলে দ্যায়
প্রভূত দাহন—তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ।
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনো দাবী,
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি—কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবী: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর—
ভাত চাই—এই চাওয়া সরাসরি—ঠাণ্ডা বা গরম,
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই—মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই;
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবী।
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি, নেই যৌনক্ষুধা—
চাই নি তো: নাভিনিম্নে-পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক—যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও—
জেনে রাখো: আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন—
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে:
থাকবে না কিছু বাকি—চলে যাবে হা-ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধরো, পেয়ে যাই—
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ ক’রে।
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী—
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি—
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
ভাত দে হারামজাদা, তা না-হ’লে মানচিত্র খাবো।
সুদীপ্ত সাইদ খান : ‘কবিকে খেয়েই কবিতার জন্ম হয়’-এই প্রবাদতুল্য কথাটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রফিক আজাদ : কবিতা লেখা খুব কঠিন ব্যাপার। খেলোয়াড়দের মতো দুই দিন প্র্যাকটিস করলাম আর লিখে ফেললাম সেটা কবির ক্ষেত্রে হয় না। জীবন বিসর্জন দিয়েই কবিতা লিখতে হয়। নিজেও তো একটা জীবন বিসর্জন দিয়ে দিলাম। সারা জীবনের জন্য পণ করেই কবিতা লিখতে আসতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। লেগে থাকতে হবে আজীবন। নিজের সুখময় জীবনের মায়া ত্যাগ করেই কবিতা লিখতে আসতে হবে। কারণ যারা কবিতা লেখেন তাদের বেশিরভাগই কিন্তু কষ্ট করে গেছেন। আমি ব্যক্তিগত জীবনেও প্রচুর কষ্ট পেয়েছি শুধু কবিতা লেখার জন্য। সেসব বলে শেষ করা যাবে না।
সুদীপ্ত সাইদ খান : আপনারা তো সাহিত্যে স্যাড জেনারেশন-নামে একটি আন্দোলনও করেছিলেন। কলকাতায় তখন সমীর রায়, ফাল্গুনী রায়, শক্তি, সুনীলরা মিলে ‘হাংরি জেনারেশন’ নামে একটি সাহিত্য আন্দোলন করছিলেন। তো এই ব্যাপারে আপনি ঠিক ঐ সময়ে কতটুকু জানতেন। আর এটি জানার পরেই কি তাঁদের মতো করে আপনারাও ‘স্যাড জেনারেশন’ নামে সাহিত্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরাই কি ছিল আপনাদের মূল অনুপ্রেরণা?
রফিক আজাদ : আসলে এখানে তথ্যগত ভুল আছে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনোই হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না; তবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রথম দিকে কিছুদিনের জন্য জড়িত ছিলেন। প্রশ্নের অপর অংশ- স্যাড জেনারেশন সম্পর্কিত, এ ব্যাপারে উত্তর হলো ‘না’। হাংরি নয়, আমেরিকার ‘বীট জেনারেশন’ ও ইংল্যান্ডের ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ মুভমেন্ট দ্বারা আমরা কিছুটা প্রভাবিত ছিলাম।
- ট্যাগ:
- সাহিত্য
- কবিতা
- কবি রফিক আজাদ
- সাক্ষাৎকার