আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি সংস্কৃতি (ইত্তেফাক)
আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০১৪, ২২:৪১
(ইত্তেফাক) হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। আধুনিকতার স্রোতে পরিবর্তন ঘটছে তাদের সাংস্কৃতিক ধারার। পোশাক পরিচ্ছদ, উত্সব অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ ঐতিহ্যবাহী অনেক সামাজিক রীতিনীতি পাহাড়ি সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ছোট সমপ্রদায়গুলোর বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বহু আগেই হারিয়ে গেছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এ তিনটি প্রধান উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মূল ঐতিহ্যবাহী জীবনধারাও আধুনিকতার স্রোতে অনেকটা পাল্টে গেছে। নিজেদের ঐতিহ্য,কৃষ্টি,সংস্কৃতি যেভাবে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তাতে অচিরেই যে এই ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর স্বকীয়তা হারিয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি কিংবা সামাজিকভাবে জোরালো কোন উদ্যোগ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ-সভাপতি ও রামগড় উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জনসংহতি সমিতির নেতা মংশাপ্রু কার্বারী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মারমা সমপ্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রথা, খেলাধুলা, পোশাক-পরিচ্ছদ, উত্সব অনুষ্ঠানে সমৃদ্ধশালী ছিল মারমারা। কিন্তু এখন অনেক ঐতিহ্যই সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। রূপার তৈরি নানা গহনায় সুসজ্জিত থাকতো মারমা রমণীরা। এখন আর মহিলাদের পায়ের সেই অলংকার 'কাখ্যাং' চোখে পড়ে না। বুড়াবুড়িদের মাথায় দেখা যায় না ঐতিহ্যবাহী 'ঘংবং' বা পাগড়ি। এক সময় বিভিন্ন উত্সব উপলক্ষে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে পাড়ায় পাড়ায় যুবক-যুবতীরা রাতভর 'দ' খেলায় মাতোয়ারা থাকতো। জুমের ফসল ঘরে উঠার পর নবান্ন উত্সবে আয়োজন করা হতো বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান 'পাংখং'।এ যাত্রাপালা অনুষ্ঠানে মারমা মহিলা-পুরুষ সম্মিলিতভাবে বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজের ভালমন্দ দিক তুলে ধরা হতো। একই ভাবে রামা মঃনং ওয়াসাইন্ডা, ককানু, মংচাইন্দা, থাম্রা প্রভৃতি পালা গান, লুংদি, ক্যাপা, রদু, মাখ্রাং ইত্যাদি লোকগীতির কথা এখন নতুন প্রজন্ম জানেও না। পুরোহিতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যবাহী সইং নৃত্য কিংবা জাইত নৃত্য আগের মত এখন দেখা যায় না। বাংলাদেশ মারমা উন্নয়ন সংসদের সহ-সভাপতি ও মংপ্রু চৌধুরী বলেন, মারমাদের নিজস্ব ভাষা ছাড়াও 'সামুসা' বা বর্ণমালাও রয়েছে। কিন্তু ব্যবহার বা চর্চা না থাকায় ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ নিজস্ব ভাষা হারিয়ে গেছে । 'লুংহলা আফুইক' নামে একটি সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুইসাউ মারমা বলেন, অন্যসব সংস্কৃতির মত মারমাদের বিয়ে এবং শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য রীতিনীতিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব অনুষ্ঠান সম্পাদনকারী 'বৈদ্য' সমপ্রদায় দিন দিন হারিয়ে যাওয়ার কারণে আগের মত এখন আর ঐতিহ্যবাহী রীতিগুলো পালন করা যাচ্ছে না। মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত ত্রিপুরা উপজাতি সমপ্রদায়েরও বর্ণিল কৃষ্টি, সংস্কৃতি কালের স্রোতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরারা নানা দেবদেবীর অসংখ্য পূজা-পার্বণে মশগুল থাকতো একসময়। পাড়া কিংবা সমাজে এখন সেসব পূজা-পার্বণ খুব কমই পালন হয়। নবান্নের উত্সবে এখন 'মাইলুমা' ও 'খুলুমা' দেবতার 'রন্দক' পূজা বা 'নকছুমতাই' দেবীর আরাধনা হয় না। ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গরিয়া দেবতার পূজাও আগের মত উত্সবমুখরভাবে অনুষ্ঠিত হয় না। চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে বৈশাখ মাসের সপ্তম দিবসব্যাপী জাঁকজমকভাবে পালিত হতো এ গরিয়া পূজা। এ উপলক্ষে ত্রিপুরা আবালবৃদ্ধবণিতা সকলে মিলে নাচগানে আমোদ-উল্লাসে বিভোর হয়ে উঠতো। পরিবার-পরিজনের মঙ্গলার্থে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত 'পরাকাইনাই' পূজাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পূজা-পার্বণের মত ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, লোকজ সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ,অলংকার ইত্যাদিও হারিয়ে যাচ্ছে। ত্রিপুরা রমণীদের এখন আগের মত কোমর তাঁতে নিজের ও পরিবার-পরিজনের পরিধানের জন্য রিনা, রিসা, ধুতি প্রভৃতি বস্ত্র তৈরি করতে তেমন দেখা যায় না। পুরুষরা তাদের হাঁটু পর্যন্ত ধুতি কিংবা মাথায় পাগড়ি পরে না। তেমনি রমণীদের গলায় অগণিত পুতির মালা, রাং মাতাং বা রূপার মুদ্রার মালা, রূপার হাঁসুলী, হাতে পেঁচানো কুঁচি, পায়ে বিচিওয়ালা বেংকি,কানে সানাইয়ের কানফুল আর নাকে উচ্চ নাকফুল পরতে দেখা যায় না। বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুরেশ মোহন ত্রিপুরা বলেন, ' ত্রিপুরা সমাজ অনেক ঐতিহ্যই হারিয়ে ফেলেছে। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় রাতব্যাপী ঘিলা খেলা হয় না। নিজস্ব রীতিনীতি পালন করে বিয়েও অনুষ্ঠিত হয় না। সবচেয়ে বড় উত্সব 'বৈসু' পালনেও ঐতিহ্য নেই। তিনি বলেন, 'ত্রিপুরাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালাও আজ তেমন একটা চর্চা হয় না। বিস্তারিতঃ http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDhfMDlfMTRfMV8yXzFfMTUxNTEz
- ট্যাগ:
- ইত্তেফাক
- মিডিয়া
- সংবাদপত্র
- দৈনিক ইত্তেফাক