সেদিন যা ঘটেছিল বাড্ডার স্কুলে
রোববার সকালের ঘটনা। উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাসলিমা বেগম রেনুকে। চার বছর বয়সী মেয়ের ভর্তির খবর নিতে গিয়ে চরম নির্মমতার শিকার হন এই নারী। তাকে পিটিয়ে হত্যার ছবি ও ভিডিও প্রকাশের পর তা নাড়া দিয়েছে গোটা দেশের মানুষের বিবেককে। নৃশংস, বর্বর এ হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছেন না কেউ। নিরীহ এ নারীকে শ’ শ’ মানুষ পিটিয়ে হত্যা করে রীতিমতো উল্লাস করেছে। তাকে রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি। আসলে সেদিন কি ঘটেছিল ওই স্কুলে। কেনইবা রেনুকে এভাবে হত্যা করা হলো। মানবজমিন এর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে কিছুটা বর্ণনা পাওয়া গেছে সেদিনের ঘটনার। সকাল পৌনে আটটা। উত্তর পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বলি চলছে। ওই সময় মহাখালীর বাসা থেকে সেখানে উপস্থিত হন ৪০ বছর বয়সী তাসলিমা বেগম রেনু। উদ্দেশ্য চার বয়সী মেয়ে আসনিম তুবাকে স্কুলে ভর্তির খোঁজ খবর নেয়া। অ্যাসেম্বলি শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যান। সকাল আটটায় ওই স্কুলের প্রথম ক্লাস শুরু হয়। স্কুলের নিচের মাঠে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এলোমেলোভাবে বসেছিলেন। আবার কেউ দাঁড়িয়ে ছিলেন। রেনু তখন ভেতরে প্রবেশ করে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলেন। নিচে থাকা স্কুলের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন। তখন এক অভিভাবক তাকে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি কে, কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন, তার বাসা কোথায়। রেনু জানান, তার বাসা মহাখালীতে, বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার খবর নিতে এসেছেন। রেনুকে জিজ্ঞেস করা হয় তার শিশুটি কোথায়? রেনু বলেন বাচ্চা বাসায়, এখন খোঁজ খবর নিতে আসছি। কথাবার্তার মাঝেই এক নারী অভিভাবক রেনুকে ছেলেধরা সন্দেহ করে কথা বলতে থাকেন। তার সঙ্গে সুর মেলান আরও অনেকে। তখন রেনু তাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে স্কুলের দপ্তরির কাছে জানতে চান ভর্তি করা যাবে কিনা। দপ্তরিও তাকে জানান এখন কোন শিশুকে ভর্তি করা হবে না। এই কথা শুনে তিনি সেখান থেকে ফের স্কুলের ফটকের দিকে রওয়ানা হন। তখন অভিভাবকরা আবার তাকে আটকে বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে থাকেন। অভিভাবকদের নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন রেনু। এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত অভিভাবকরা ছেলে ধরা বলে চিৎকার শুরু করলে বাইরে থেকে লোকজন আসতে থাকে। চিৎকার চেচামেচি শুনে একজন পুরুষ শিক্ষক ও কয়েকজন অভিভাবক রেনুকে নিয়ে যান প্রধান শিক্ষক শাহনাজ বেগমের দ্বিতীয় তলার কক্ষে। আর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অভিভাবকের চিৎকারে আশপাশ থেকে দলে দলে লোক আসতে থাকে। এদের মধ্যে কেউ হাতে লাঠি, লোহার রড নিয়ে আসেন। তারা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে যাবার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু স্কুলের দপ্তরি স্কুল ভবনের গেটে তালা দিয়ে রাখেন। উত্তেজিত মানুষ তখন ওই তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশ করে তারা সোজা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে যায়। ভেতরে কয়েকজন অভিভাবক ছাড়াও প্রধান শিক্ষক ও সহকারি একজন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। মানুষজন প্রধান শিক্ষকের সামনে থেকে রেনুকে মারধর করে টেনে হিঁচড়ে নিচে নেমে আসে। রেনুর ওপর চলে বেধড়ক মারধর। কেউ লাঠি দিয়ে, কেউ লোহার রড দিয়ে কেউবা পা দিয়ে লাথি, কিল-ঘুষি। টানা কয়েক মিনিট মারধরের পরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন রেনু। কিছুক্ষণ পর তিনি হাত-পা নাড়াছাড়া দিচ্ছিলেন। কিন্তু উপস্থিত হৃদয়হীন মানুষ রেনু বেঁচে আছেন ভেবে আবার পেটানো শুরু করে। উত্তর পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি জান্নাত বেগম মানবজমিনকে বলেন, ওই নারী আমাকে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করা যাবে কিনা। আমি তখন উনাকে বলেছি বছরের এই সময় বাচ্চা ভর্তি করা হয় না। এই কথা শুনে তিনি আবার চলে যান। এর কয়েক মিনিট পরে দেখলাম কয়েকজন লোক তাকে ধরে নিয়ে দ্বিতীয় তলার দিকে যাচ্ছে। ওই সময় স্কুল ভবনের দিকে শত শত লোক আসতে থাকে। আমি তখন গেটে তালা দেই। কিন্তু তারা উচ্চ শব্দে চিৎকার দিয়ে তালা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। আর প্রধান শিক্ষক তখন মাইকে বলছিলেন আপনারা শান্ত হন, ধৈর্য ধরেন। আমরা বিষয়টি দেখছি। ওই নারীর সঙ্গে কথা বলছি। জান্নাত বলেন, কে শুনে কার কথা। মানুষ ততক্ষণে তালা ভেঙ্গে দুতলায় চলে যায়। প্রধান শিক্ষক ও আরেক সহকারি শিক্ষককে ধাক্কা মেরে ওই নারীকে নিয়ে নিচে নেমে আসে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তাকে বাঁচানোর। কিন্তু অনেক মানুষ থাকায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। ওই স্কুলের প্রধান ফটকের সামনের পান সুপারি বিক্রেতা নূর ইসলাম বলেন, আমি সকাল সাতটায় দোকান খোলেছি। সকাল আটটার কিছু পরে ভেতর থেকে কিছু নারীর কন্ঠে ছেলেধরা-ছেলেধরা,গলাকাটা-গলাকাটা আওয়াজ আসছিল। এই আওয়াজ আসার সঙ্গে সঙ্গে ফটকের সঙ্গের শাক বিক্রেতা হৃদয় লাঠি নিয়ে আসে এবং আশেপাশের লোকজনকে জানিয়ে দেয় স্কুলে ছেলেধরা এক মহিলাকে আটকানো হয়েছে। এই খবরে মূহুর্তের মধ্যে শত শত লোক স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন পাশের হোটেলের জাফর, আরেক সবজি বিক্রেতা হাতে লাটিসোটা নিয়ে স্কুলের ভেতরে যায়। স্কুলের ফটকের সামনের আরেক ব্যবসায়ী জালাল বলেন, মারধর শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর আমি দোকানে এসেছিলাম। দেখি শতশত মানুষ স্কুলের ভেতরে বাইরে। ভেতরে গিয়ে দেখি এক নারীর মরদেহ পড়ে আছে। তিনি বলেন, শুনেছি ওই নারী বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য এখানে এসেছিলেন। স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নওরিন আক্তারের বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, বাচ্চাদের ক্লাসে দিয়ে নারী অভিভাবক নিচে বসে স্কুল ছুটির অপেক্ষা করেন। তখন ওই নারী ভেতরে প্রবেশ করেন। এসময় কয়েকজন অভিভাবক তাকে আটকে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলেন, এটি একটি জগণ্য কাজ। একটা মানুষকে কিভাবে তারা ছেলেধরা বলে গণপিটুনি দিল। বাড্ডা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছি। তাদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি হুজুগের কারণেই তারা মূলত গণপিটুনিতে অংশগ্রহণ করেছে। ক্লাসে ক্লাসে ছিল কান্নার সূর: ওই নারীকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের মাঠে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। সেখান থেকে কিছু লোক স্কুল ভবনের দ্বিতীয় তলায় যেতে চায়। যেখানে ওই নারীকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু গেটে তালা দেয়া থাকার জন্য তারা উপরে উঠতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে তালা ভেঙ্গে যখন তারা চিৎকার দিয়ে দিয়ে উপরে উঠছিল তখন প্রতিটা ক্লাসে শিক্ষকরা পড়াচ্ছিলেন। চিৎকার চেঁচামেচির কারনে শিক্ষকরা ক্লাস নিতে পারছিলেন না। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে মানুষের ভীড় দ্বিতীয় তলায়ও বাড়তে থাকে। তখন শিক্ষকরা ক্লাসরুমের দরজা বন্ধ করে দেন। অনেক শিক্ষার্থী ভয়ে কান্না শুরু দেয়। সহকারি শিক্ষক কামরুননাহার বেগম বলেন, ওই সময় আসলে কি হতে যাচ্ছে বা কি হচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারি নাই। চারদিকে শুধু মানুষের আওয়াজ-উচ্চ শব্দ। কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে এই টুকু মাথায় ছিল। এই ছোট ছোট বাচ্চাদের রেখে যাওয়া যাবে না। কারণ বাচ্চাগুলো কান্না করছিল ভয়ে। তাদের নিরাপত্তা আগে। একটা বাচ্চার যদি কিছু হয় তবে আমরা কি জবাব দিব। কানিজ ফাতেমা নামের আরেক শিক্ষক বলেন, একটা নারীকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে সেটা আমার মাথায় ছিল না। আমি শুধু বাচ্চাদের সাহস দিয়েছি। কারণ তারা সবাই আমার সন্তান। আমি তাদের শুধু দোয়া পড়তে বলেছি যাতে আমরা বিপদ থেকে রক্ষা পাই। নাজমিন সুলতানা নামের আরেক শিক্ষক বলেন, বাচ্চারা হাউমাউ করে কান্না করছিল। আমরা বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ এই ভীড়ের মধ্যে যদি তাদের ছেড়ে দেই তবে পিষ্ট হয়ে হয়তো কয়েকটা বাচ্চা মারা যেত। এদিকে রেনুকে হত্যার ঘটনার ছবি ও ভিডিও দেখে পুলিশ সাত জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের একজন স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তিনজনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি হৃদয় সন্দেহে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। যদিও রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
- ট্যাগ:
- অন্যান্য সংবাদ
- বিবরণ