পারিবারিক রাজনীতির সমাপ্তি ঘটছে ভারতীয় উপমহাদেশে
বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বেশিরভাগ দক্ষিণ এশীয় দেশই পারিবারিক নেতৃত্বের সাধ পেয়েছে। ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে নেহরু-গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পার্টিই ক্ষমতায় ছিল বেশিরভাগ সময় ধরে, পাকিস্তানে ভুট্টো/জারদারি ও শরিফ পরিবার পালাক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছে বহু বছর, শ্রীলংকায় প্রথমে বন্দেরনায়েক ও পরে রাজাপাকসারাই ছিল নেতৃত্বের শীর্ষে। বাংলাদেশেও বেশিরভাগ সময় শেখ মুজিবুর রহরমান ও জিয়া উর-রহমানের পরিবারের দখলেই থেকেছে রাজনৈতিক পটভুমি। পারিবারিক রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাধান্য পেলেও সবসময় তার পরিণতি গৌরবান্বিত হয় না। পাকিস্তানের জুলফিকার আলি ভুট্টো ও তার কন্যা বেনজির ভুট্টোর মৃত্যুর দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। অন্যদিকে, ভারতে ইন্দিরা গান্ধী ও তার ছেলে রাজীব গান্ধীর খুনও সেদিকটাই ফুটিয়ে তোলে। কখনো কখনো এক পরিবারের পতন থেকে শুরু হয় অন্যকোনো পরিবারের উত্থান। শ্রীলংকার পরিস্থিতির দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একসময় বন্দরনায়েকদের দখলে থাকা রাজনীতি এখন শাসন করছে রাজাপাকসারা। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসা তার ভাইদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন।ইমরান ও মোদির উত্থানদক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর রাজনীতিতে পারিবারিক নেতৃত্বের অবসানের সবচেয়ে বড় নজির স্থাপন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের ইমরান খান। একজন হচ্ছেন সমাজসেবক ও অন্যজন সাবেক ক্রিকেটার। এছাড়া, কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে রাহুল গান্ধীর পদত্যাগও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গত লোকসভা নির্বাচনে মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপির কাছে বিপুল ব্যবধানে হারে কংগ্রেস। এরপরই পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০০৪ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করা রাহুলকে নিয়ে অনেকের ধারণাই ছিল, ভারতের যুব সম্প্রদায়ের ওপর তার বেশ প্রভাব থাকবে। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে টানা হারান তিনি। এতে প্রমাণ হয় যে, নিজের দলে তরুণদের টানতে ব্যর্থ হয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, অন্যান্যদের মতো রাজনীতিতে দোষ চাপানোর খেলায় নামেননি রাহুল। সরাসরি নিজের কাঁধে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে পদত্যাগ করেছেন।আশা জাগিয়েছেন তিনিনির্বাচনে সাফল্য না পেলেও, পদত্যাগ করে নিজের দলের ভবিষ্যৎ নেতাদের জন্য আশা জাগিয়েছেন রাহুল। পারিবারিক নেতৃত্ব থেকে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে গেছে কংগ্রেস। এখন, দলের ভার নেয়ার সুযোগ হয়েছে শিক্ষিত, নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন কোনো নেতার। আর সে নেতা গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকেও আসতে পারে।নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে রাহুল নিজেকে আলাদা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার পদত্যাগপত্রে লেখা কথার মধ্য দিয়ে। লিখেছেন, ‘তারা যেখানে ভিন্নতা দেখে, আমি সেখানে সাদৃশ্য দেখি। তারা যেখানে ঘৃণা দেখে, আমি সেখানে ভালোবাসা দেখি। তারা যা ভয় পায়, আমি সেটাকে আলিঙ্গন করি।’ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে রাহুল সত্যিকারেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা একটি অভ্যাস হয়ে গেছে। কেউ ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। কিন্তু আমরা ক্ষমতার লোভ ত্যাগ না করে ও আরো নিগূড় কোনো মতাদর্শের যুদ্ধে না লড়ে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করতে পারবো না।অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, নেপালে কে পি শর্মা আলি, ভুটানে চিকিৎসক থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া লোটে শেরিং ও মালদ্বীপে ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর মতো নেতাদের উত্থান হচ্ছে। কিন্তু কেবল পারিবারিকভাবে রাজনীতিতে আসার কারণে কোনো নেতাকে অগ্রাহ্য করা উচিৎ হবে না ভোটারদের। এরকম নেতাদের মধ্যেও যোগ্যরা রয়েছেন। কেউ কেউ নিজের দক্ষতার কারণেই রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে এসেছেন। এখানে মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, সকলের জন্যই নেতৃত্ব দখলের সমান সুযোগ থাকা। সাধারন পরিবারে জন্মগ্রহণকারীরাও যাতে তাদের যোগ্য আসন পায় তা নিশ্চিত করা। বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত একটি মেধা-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। রাহুল গান্ধী সে দৃষ্টান্তই স্থাপন করে গেছেন। (ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত সম্পাদকীয়র অনুবাদ। মূল সম্পাদকীয়টি লিখেছেন ইন্সটিটিউট ফর পলিসি, অ্যাদভোকেসি অ্যান্ড গভার্নেন্স এর প্রধান সাইদ মুনির খসরু।)