শাহবাজপুরে নতুন সেতু তৈরিতে ‘জাদুর ছোঁয়া’
শাহবাজপুরে তিতাস নদীর ওপর নতুন সেতুর নির্মাণ কাজে লেগেছে ‘জাদুর ছোঁয়া’। বিপদ এড়াতে দ্রুত এই সেতুর কাজ গুটাতে চাইছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেয়া হতে পারে এমন আভাসও দিয়েছেন সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। পুরাতন সেতু খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় নতুন সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে ‘ম্যাজিক’-ই দেখাচ্ছেন তারা। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সূত্র জানিয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে কাজ শেষ করার চাপ থাকায় সেতুর একটি অংশের স্ল্যাব ঢালাইয়ের পর তা জমাট করতে ৩ লাখ টাকার কেমিক্যালই ব্যবহার করতে হয়েছে। দেয়া হয়েছে দ্বিগুণ পরিমাণ সিমেন্ট। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শামীম আল মামুনও এই অংশের কাজ জরুরি ভিত্তিতে করার কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, ৩রা জুলাই সেতু চালু করার চেষ্টা করবেন তারা। তবে টেস্টের রেজাল্ট পাওয়ার পরই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সম্প্রতি পুরাতন সেতুর ফুটপাথ রেলিংসহ ভেঙে পড়লে এক সপ্তাহ সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকে। মেরামত শেষে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলেও চরম আতঙ্ক নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। গাড়ি পারাপারের সময় আগের মতোই দুলছে সেতু। পুরাতন সেতুর অবস্থা ভয়াবহ জানিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন বাসের চালক আর যাত্রীরা নিজেদের উদ্বেগ-আতঙ্ক প্রকাশ করেন। ঢাকা থেকে সিলেটগামী ইউনিক পরিবহনের একটি বাসের একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, এটি আমাদের জন্য আতঙ্কের জায়গা। সেতুতে উঠার আগেই মনের মধ্যে শঙ্কা থাকে কখন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। কত লোকজনের না ক্ষতি হয়। আরেক যাত্রী বলেন, এটি ভয়াবহ ব্রিজ। মারাত্মক এক্সিডেন্ট ঘটতে পারে যেকোনো সময়। সিলেটমুখী হানিফ, মামুন ও ইউনিক পরিবহনের তিনজন বাস চালকের সঙ্গেও কথা। হয় একজন বলেন, ‘গাড়ি নিয়া যখন ব্রিজে উঠি তখন পুরো ব্রিজ কাইপ্পা উঠে। মনে হয় এই বুঝি ভাইঙ্গা পড়লো।’ আরেকজন বলেন, ঢাকা বা সিলেট থেকে যাত্রা শুরু করার পরই আতঙ্কের মধ্যে থাকি শাহবাজপুর সেতু নিয়ে। সেখানে জ্যাম থাকবো না ক্লিয়ার থাকবো। বড় ধরনের বিপদ হতে পারে জেনেও প্রতিদিন এই সেতু পাড়ি দিচ্ছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের হাজারো যানবাহন। বিভিন্ন সময় এই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেতুর দুর্দশায়। সর্বশেষ ১৮ই জুন সেতুর ফুটপাথ রেলিংসহ ভেঙে পড়লে সিলেট বিভাগের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনি সময়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়লে টনক নড়ে সড়ক কর্তৃপক্ষের। রাতারাতি শাহবাজপুর সেতুতে বেইলি স্থাপনের কাজ শেষ করা হয়। হালকা যানবাহন পারাপারের জন্য খোলা রাখা পাশের বেইলী সেতুটিও একই সঙ্গে ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। নতুন বেইলি দিয়ে শুধু যাত্রী নামিয়ে বাস চলতে দেয়া হবে আর ট্রাক চলবে বিকল্প সড়কপথে; এর আগে সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা এমনটি জানালেও পরে তারা আর সেই কথা ঠিক রাখতে পারেননি। ওভারলোডেড ট্রাক-বাস চলতে শুরু করে সমানে। কিন্তু পুরাতন সেতু চরম ঝুঁকিতে থাকায় নতুন সেতুর কাজ দ্রুত করার দিকে নজর দেন সড়কের কর্মকর্তারা। প্রথমে জুলাই মাসের শেষদিকে নতুন সেতু খুলে দেয়ার কথা বলা হলেও এখন ৩রা জুলাই এই সেতু চালু করার কথা বলছেন তারা। সময় কমিয়ে কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে চমৎকারিত্বই দেখাচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সর্বশেষ ৪শ মিটারের একটি স্ল্যাব ঢালাইয়ের পর তা কয়েক ঘণ্টায় যাতে জমাট বাধে সে জন্য ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের ক্যামিকেল। এরসঙ্গে বেশি পরিমাণ সিমেন্টও দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সওজ নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শামীম আল মামুন জানান-, একটি স্ল্যাবের কাজ বাকি ছিল। সেটি জরুরি ভিত্তিতে করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সাধারণত ওভাবে কাজ করি না। কারণ কেমিক্যাল ব্যবহার করলে খরচ বেশি পড়ে। জরুরি হওয়ায় এই অংশটি সেভাবে করা হয়েছে। এখন টেস্ট রেজাল্ট পেলে ৩রা জুলাই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার চেষ্টা করবো। তিনি জানান, সেতুর স্ট্রাকচারের কাজ শেষ হয়েছে। তবে অন্যান্য কাজ শেষ হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে। নতুন এই সেতুর দৈর্ঘ্য ২৫৪ মিটার। আর প্রস্থ ১৬ মিটার। ২০১৭ সালে শুরু হয় এই সেতুর কাজ। যাতে ব্যয় হচ্ছে ৫৯ কোটি টাকা। এদিকে ১৯৬৩ সালে নির্মিত পুরাতন সেতুটির ৫৬ বছর বয়সের মধ্যে অর্ধশত বছর জোড়াতালির মধ্যেই চলেছে। এজন্যে সড়ক বিভাগের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেন শাহবাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান রাজিব আহমেদ রাজ্জি। তিনি বলেন, সেতুর এই অবস্থার জন্য সড়ক বিভাগের গাফিলতিই দায়ী। সেতুর ওপর দিয়ে প্রথমে ২২ টন, পরে ১৫ টন ওজনের যানবাহন চলাচল নিষেধ করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে তারা। কিন্তু সেটি নিরূপণ বা ওভারলোডেড গাড়ি চলাচল রোধে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ওছমান উদ্দিন খালেদ বলেন, ১৯৯২ সালে মুক্তিযোদ্ধের সময় ভেঙে পড়া অর্ধেকাংশ যখন পুনঃনির্মাণ করা হয় তখনই এতে ত্রুটি ছিল। আমরা স্থানীয় লোকজন এ ব্যাপারে আপত্তিও জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু সেতু উদ্বোধনে আসা তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী তা আমলে নেননি। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল সেতুটির দক্ষিণ প্রান্তের ৩টি স্পেন ডিনামাইট মেরে ভেঙে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। যাতে পাকবাহিনী এদিকে আর অগ্রসর হতে না পারে। যুদ্ধকালীন আরো কয়েক দফা আক্রমণ হয় সেতুতে। স্বাধীনতার পর ওই তিন স্পেনের ওপর বেইলি স্থাপন করা হয়। ২১ বছর চলে এই বেইলী দিয়েই। ১৯৯২ সালে এই অংশে পাকাসেতু করা হয়। এরপর আবার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে উত্তর প্রান্ত বা পুরাতন অংশ। পরে ওই পাশেও ৩০ মিটারের দুটি বেইলি বসানো হয়। যা প্রতিনিয়ত বড়ধরনের বিপদের হাতছানি। আর সে কারণেই নতুন সেতুর কাজ যাদুর স্পর্শে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
- ট্যাগ:
- অন্যান্য সংবাদ
- ধরাছোঁয়া
- ঢাকা
- সিলেট জেলা