চিকিৎসায় কি আর্থ্রাইটিস বা বাতরোগ সারে?
ডা: মিজানুর রহমান কল্লোল আর্থ্রাইটিস রোগীর বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে যেমন- ওষুধপত্র, ব্যায়াম, অকুপেশনাল থেরাপি, মানসিক পরামর্শ, সার্জারি। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে কোনো চিকিৎসায় আর্থ্রাইটিস সম্পূর্ণ সারে না, বিশেষ করে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কিংবা অস্ট্রিও আর্থ্রাইটিস। ইনফেকশাস আর্থ্রাইটিস ভিন্ন কথা। এটি অ্যান্টিবায়োটিকে ভালো সাড়া দেয়। লিখেছেন ডা: মিজানুর রহমান কল্লোল আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আর্থ্রাইটিস যদি নাই সারে তাহলে আমি শুধু শুধু চিকিৎসা করাতে যাবো কেন। এর উত্তরে বলা যায়- মেডিক্যাল চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যথামুক্ত থাকা যায় ও প্রদাহ কমানো যায়। এ রোগের অগ্রসরণ মন্থর করে দেয়া যায় এবং অস্থিসন্ধিকে স্থায়ী ক্ষতিগ্রস্তের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, প্রয়োজনে সার্জারির মাধ্যমে অস্থিসন্ধির কাজকর্মের উন্নতি ঘটানো যায় এবং সারা জীবন রোগীকে ও রোগীর অস্থিসন্ধিগুলোকে সচল রাখা যায়। একজন রোগীর জন্য কোনো একক চিকিৎসা নেই। বেশির ভাগ রোগীর সমন্বিত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। দেখা গেছে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অ্যাসপিরিন, ব্যায়াম ও ভিটামিটই ভালো কাজ করে, অন্য অন্য রোগীর ক্ষেত্রে গোল্ড মল্ট, হট বাথ ও মাছের তেল ভালো কাজ করে; আবার অন্যদের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধই কোনো কাজ করে না। অস্থিসন্ধি বা মাংশপেশির ব্যথার ক্ষেত্রে কখন ডাক্তার দেখাবেন যদি আপনার ব্যথা তীব্র না হয় এবং তা কয়েক দিনের বেশি না থাকে তাহলে আপনার আর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যদি আপনার ব্যথা কয়েক দিনের চেয়ে বেশি থাকে, কয়েক সপ্তাহ পর আবার দেখা দেয় কিংবা ব্যথা এত তীব্র হয় যে তা আপনার স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায় তাহলে বুঝতে হবে চিকিৎসক দেখানোর সময় হয়েছে। এক বা একাধিক অস্থিসন্ধিতে ফোলা থাকলে বুঝতে হবে সেখানে কোনো সমস্যা আছে। একইভাবে শরীরের দুই পাশের অস্থিসন্ধিগুলোতে একই সময়ে ব্যথা হলে কিংবা অস্থিসন্ধির ব্যথার সাথে অবসন্নতা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যদি প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধগুলো যেমন অ্যাসপিরিন বা আইয়ুপ্রফেন খেয়ে আপনার অস্থিসন্ধির ব্যথা কমে যায় তাহলে দয়া করে আত্মতুষ্টিতে ভুগবেন না। যদি আপনি নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধ খান এবং ওষুধ বন্ধ করলে আবার ব্যথা ফিরে আসে, তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে ভুল করবেন না। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে দেরি করে গেলে আপনি কি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন হ্যাঁ, সময় মতো চিকিৎসা না করিয়ে চিকিৎসকের কাছে বিলম্বে গেলে আপনি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। যদি আপনার সেপটিক আর্থ্রাইটিস হয় তাহলে মারাত্মক ক্ষতি এড়াতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অস্থিসন্ধির ইনফেকশনের চিকিৎসা করতে হবে। সংক্রমিত অস্থিসন্ধি লাল হয় ও ফুলে যায় এবং এটার তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রেও যদি আপনি চিকিৎসা নিতে দেরি করেন তাহলে পঙ্গু হয়ে যাবেন। বর্তমানে বেশির ভাগ চিকিৎসক মনে করেন যদি আপনি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিতে দেরি করেন তাহলে আপনার অস্থিসন্ধিতে স্থায়ী বিকলাঙ্গতা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে এটা জানা গেছে যে অস্থিসন্ধির স্থায়ী ক্ষতি বেশ আগেই ঘটে, কখনো কখনো উপসর্গ দেখা দেয়ার কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে। বিস্তারিত সাইনোভিয়াল টিস্যু অস্থিসন্ধির মধ্যে কার্টিলেজকে আক্রমণ করে, এর ফলে কার্টিলেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। একবার এই ক্ষতিসাধন হলে তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। এ জন্য বর্তমানে অনেক চিকিৎসক বিশ্বাস করেন রোগের শুরুতেই চিকিৎসা করানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে রোগীকে পরবর্তীতে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় না। অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রেও কি প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করাতে হবে অবশ্য স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই যে প্রাথমিক চিকিৎসা করলে অস্টিও আর্থ্রাইটিস ভালো হবে; কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা করালে যে লাভটা হয় তাহলো আপনি আপনার অসুস্থ অস্থিসন্ধিকে রক্ষা করার জন্য এবং তাকে দীর্ঘ জীবনদানের জন্য কিছু শিখতে পারেন। সিঁড়ি দিয়ে নিয়মিত দৌড়ে ওঠানামা করলে আপনার ব্যথা চলে যাবে এবং আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন এমন উদ্ভট চিন্তা কখনোই মাথায় আনবেন না। এতে আপনার আরো ক্ষতি হবে এবং অস্থিসন্ধিতে যে ধরনের সমস্যাই হোক না কেন, দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসক দেখানো উত্তম। সঠিক চিকিৎসকের কাছে যান আপনি প্রথমে আপনার জেনারেল প্রাকটিশনারকে দেখাবেন। তিনি আপনাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার ব্যাপারে অভিজ্ঞ। তিনিই ঠিক করবেন আপনাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে কিনা। তিনি যদি দেখেন আপনার অসুস্থতা অনেক বেশি, তাহলে তিনি আপনাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। অবশ্য অনেক চিকিৎসক চালাকি করে রোগীকে নিজেদের কাছেই রাখতে চান, রোগীর রোগের ইতিহাস ভালো করে শোনেনও না। আরো দেখা গেছে কিছু জেনারেল প্রাকটিশনার রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ঠিকমতো নির্ণয় করতে পারেন না। আপনি যখনই অস্থিসন্ধিতে কোনো সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাবেন, তার দায়িত্ব হলো আপনার কাছ থেকে সমস্যার বর্ণনা ভালো করে শোনা, আপনার অস্থিসন্ধি সতর্কতার সাথে ভালো করে পরীক্ষা করা এবং কিছু পরীক্ষা আগেভাগে করিয়ে ফেলা। আপনার চিকিৎসক অবশ্যই আপনাকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করবেন যদি তিনি দেখেন যে আপনার অসুস্থতা মারাত্মক যা তিনি নিরূপণ করতে ও চিকিৎসা দিতে পারছেন না। আপনার জেনারেল প্রাকটিশনার আপনার রোগ নিরূপণের ব্যাপারে সন্ধিহান হলেও আপনাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করবেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখান যদি আপনার জেনারেল প্রাকটিশনার আপনাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করেন, তাহলে আপনি নিজেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসা ক্ষেত্রে আপনি আপনার উপসর্গগুলো ও তাদের উন্নতি পর্যবেক্ষণ করুন- আপনার চিকিৎসককে প্রশ্ন করুন : রোগটি কী? সত্যিকার অর্থে আমার কোন ধরনের আর্থ্রাইটিস হয়েছে? আপনি কিভাবে রোগটি নির্ণয় করলেন? আপনি কেন মনে করছেন রোগটি এই টাইপের এবং কেন অন্য টাইপের নয়? আপনার চিকিৎসকের উত্তরগুলো আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। যদি আপনার চিকিৎসক অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাকে দুই-তিন বার দেখানোর পরও স্পষ্টভাবে আপনার রোগ নিরূপণ করতে না পারেন, কিংবা যদি আপনার মনে হয় যে তিনি ভুল ডায়াগনসিস করছেন তাহলে আপনি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারেন। আবার আপনার চিকিৎসক সঠিক রোগ নিরূপণ করলেও আপনি যদি চিকিৎসা শুরু হওয়ার চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে ভালো বোধ না করেন, সে ক্ষেত্রেও আপনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। কোন ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাবেন একজন জেনারেল প্রাকটিশনাল আর্থ্রাইটিসের এক রোগীকে খুব সম্ভব একজন রিউমাটোলজিস্ট অথবা একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে থাকেন। কারো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস থাকলে অথবা বাতরোগের লক্ষণ থাকলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাকে প্রাথমিকভাবে রিউমাটোলজিস্টের কাছে পাঠানো হয়। রিউমাটোলজিস্ট যদি তাকে দেখে মনে করেন যে অস্থিসন্ধিতে অনেক সমস্যা রয়েছে এবং রোগী সার্জারির মাধ্যমে ভালো ফল পেতে পারেন, তাহলে তিনি তাকে একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেন। অস্টিও আর্থ্রাইটিসের রোগী যেকোনো ধরনের চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেনÑ তিনি হতে পারেন একজন জিপি একজন রিউমাটোলজিস্ট অথবা একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ। তবে অস্থিসন্ধিতে সার্জারির প্রয়োজন হলে অবশ্যই তাকে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে হবে, অবশ্য অস্টিও আর্থ্রাইটিসের অনেক রোগীর সার্জারির প্রয়োজন না হলেও অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞরা তাদের চিকিৎসা করে থাকেন। অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের আরেক নাম অর্থোপেডিক সার্জন, যিনি একজন যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক এবং যিনি অস্থি ও অস্থি রোগ, বিকলাঙ্গতা ও হাড় ভাঙা রোগের এবং অস্টিও আর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সব ধরনের সমস্যা শৈল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। রিউমাটোলজিস্টরা কিংবা ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা সার্জারি করতে পারেন না, কিন্তু অর্থোপেডিক সার্জনদের একটি বড় সময় কাটে অপারেশন থিয়েটারে। বিশেষ করে একজন অর্থোপেডিক সার্জন ভাঙা হাড়কে জোড়া দেন, কার্টিলেজ ছিঁড়ে গেলে তা জোড়া লাগান, মাংশপেশি ছিঁড়ে গেলে ঠিক করে দেন, টেনডন বা লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে তা মেরামত করেন এবং কিছু অস্থিসন্ধি সম্পৃক্ত নার্ভের সমস্যা হলে তার চিকিৎসা করেন। তার মানে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেই কি আপনাকে অপারেশনের টেবিলে শুতে হবে? ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞরা অপারেশনের চেয়েও বেশি কিছু করেন। যদি অস্থিসন্ধিতে সার্জারি করতে হয় তাহলে তারাই হলেন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। আর কোনো দ্বিতীয় মতামতের সুযোগ নেই। কিছু অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ আর্থ্রাইটিসের রোগীদের, বিশেষ করে অস্টিও আর্থ্রাইটিসের রোগীদের নন-সার্জিক্যাল মেথোডে চিকিৎসা করেন, অর্থাৎ কোনো অপারেশন নয়, শুধু ওষুধ ও ব্যায়াম। তবে দেখা গেছে অর্থোপেডিক সার্জনদের কাছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্থ্রাইটিসের রোগী আসেন আগে রিউমাটোলজিস্টকে দেখিয়ে। রিউমাটোলজিস্টরা সর্বদা অপারেশন ছাড়া চিকিৎসা করতে বেশি পছন্দ করেন, কিন্তু ওষুধ ও ব্যায়ামে কাজ না হলে অবশ্যই রোগীকে অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে পাঠাতে হবে। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিঃ, ২, ইংলিশ রোড, ঢাকা। ফোন: ০১৭১৬২৮৮৮৫৫