বিশ্বকাপের অদ্ভুত পাঁচ ঘটনা
ফুটবল বা ক্রিকেট। বিশ্বকাপ মানেই উন্মাদনা। চার বছর পর পর মঞ্চস্থ হয় এমন মহাযজ্ঞের। আর প্রতিটি আসরেই রচিত হয় নতুন নতুন রেকর্ড, দর্শকরা সাক্ষী হন অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনার। ইতিহাসের পাতা উল্টে এমন পাঁচটি ঘটনা নিয়ে এই প্রতিবেদন-কপিল দেবের ‘মহত্ত্বের মূল্য’ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে খেলতে নেমেছিল ভারত। গ্রুপপর্বে ভারতের প্রথম ম্যাচ, প্রতিপক্ষ অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া। চেন্নাইয়ের এম চিদাম্বরম মাঠে বোলার মনিন্দর সিংকে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে এসে লং অন দিয়ে বল উড়িয়ে মারলেন ডিন জোন্স। লাফিয়েও বলটিকে সীমানাছাড়া হওয়া থেকে আটকাতে পারলেন না সীমানার কাছাকাছি থাকা ফিল্ডার রবি শাস্ত্রী। বল সীমানা ছাড়িয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না, কিন্তু বিপত্তি বাধলো অন্য জায়গায়। জোন্স নিশ্চিত, বল কম করে হলেও সীমানার এক মিটার বাইরে পড়েছে। কিন্তু আম্পায়ার ডিকি বার্ড নিশ্চিত ছিলেন না, শটটি আসলেই ছয় হয়েছে কিনা। উপায় না দেখে তাই ফিল্ডার রবি শাস্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন। শাস্ত্রী জানালেন, ছয় নয়, বরং চার হয়েছে। উইকেটরক্ষক কিরণ মোরেও বললেন, তার কাছে ছয় মনে হয়নি সেটিকে। শেষ পর্যন্ত ফিল্ডারের কথায় ভরসা করে আম্পায়ার বার্ড চারের সংকেত দিলেন। কিন্তু জোন্স এই সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারলেন না, আম্পায়ারের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গেলেন। ইনিংস বিরতিতে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলবেন, এমন আশ্বাস দিয়ে জোন্সকে ব্যাটিংয়ে ফেরত পাঠান আম্পায়ার। নির্ধারিত ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ালো ৬ উইকেটে ২৬৮।বিরতিতে আম্পায়ারদের সঙ্গে তুমুল বিতর্ক হলো অস্ট্রেলিয়ার। ম্যানেজার অ্যালান ক্রম্পটন সরাসরিই বলে বসলেন, তিনি এই সিদ্ধান্ত মানেন না। কোচ ববি সিম্পসনও বললেন, তিনি বাউন্ডারি লাইনের খুব কাছেই ছিলেন। এটা যে ছক্কা, তা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। মীমাংসায় আসতে না পেরে দুই আম্পায়ার ভারত অধিনায়ক কপিল দেবের শরণাপন্ন হলেন। সব শোনার পর দারুণ ক্রিকেটীয় চেতনা দেখিয়ে কপিল সেটিকে ছয় হিসেবে মানতে রাজি হলেন। ফলাফল, ইনিংস বিরতিতেই অস্ট্রেলিয়ার ২ রান বাড়িয়ে দেয়া হলো আর ভারতের লক্ষ্য গিয়ে দাঁড়ালো ২৭১ রানে। কিন্তু কপিল তো আর জানতেন না, শেষ পর্যন্ত বাড়তি ২ রানই গড়ে দেবে ম্যাচের পার্থক্য! যদিও ম্যাচে ফেভারিট দেখাচ্ছিল ভারতকেই। ১৫ ওভার বাকি থাকতে ভারতের দরকার ছিল মাত্র ৬৪ রানের। তখনও তাদের হাতে অক্ষত ৮ উইকেট। কিন্তু এরপর চমক দেখালো অজিরা। পেসার ক্রেগ ম্যাকডারমট ধসিয়ে দিলেন ভারতের মিডল অর্ডার। শেষ পর্যন্ত সমীকরণ নেমে এল ২ বলে ২ রানে, হাতে মাত্র এক উইকেট। স্টিভ ওয়াহর বলে বোল্ড হয়ে গেলেন শেষ ব্যাটসম্যান মনিন্দর সিং। ভারত অলআউট হলো ২৬৯ রানে, ম্যাচও হারলো ১ রানে! ইনিংস বিরতিতে কপিলের ‘বদান্যতা’য় অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে সেই ২ রান যোগ না হলে ভারতই ম্যাচটা জিততো ১ উইকেটে!ইডেন গার্ডেনে আগুন নিজেদের মাটিতে আরেকটি বিশ্বকাপ। শিরোপা জয়ই লক্ষ্য ছিল ভারতের। কিন্তু ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালেই থেমে গিয়েছিল অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারতের দৌড়। অবশ্য সে ম্যাচে জয়-পরাজয় ছাপিয়ে কলঙ্কিত এক ঘটনার সাক্ষী হয় ক্রিকেট দুনিয়া। শ্রীলঙ্কা-ভারত ম্যাচে কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আগুন ধরিয়ে দেয় অসহিষ্ণু সমর্থকরা!সে ম্যাচে ভারতের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। তুখোড় ফর্মে থাকা শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার রমেশ কালুভিতারানা আর সনৎ জয়সুরিয়াকে দ্রুতই সাজঘরে ফেরান ভারতীয় পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ। ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া লঙ্কানদের পথ দেখান অরবিন্দ ডি সিলভা ও রোশান মহানামা। এতে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ পৌঁছে ২৫১ রানে। ইডেনের লাখো দর্শকের সামনে টেন্ডুলকার-আজহারউদ্দিন-সিধু-মাঞ্জরেকাররা ২৫১ রান খুব সহজেই টপকে যাবেন- এমন প্রত্যাশাই ছিল সকলের। ব্যাট হাতে জবাবে ভারতের শুরুটাও দারুণ হয়েছিল। ওপেনার শচীন টেন্ডুলকার উইকেটের চারদিকে মেরে লক্ষ্যটাকে সহজ বানিয়ে ফেলছিলেন। তবে ‘লিটল মাস্টার’ সাজঘরে ফিরলেন দলীয় ৯০ রানে, স্টাম্পড হয়ে। ভারতের ভাগ্য বিপর্যয়ের শুরুটা এখান থেকেই। মাত্র ২২ রানের ব্যবধানে ৭ উইকেট খুইয়ে লড়াই থেকে ছিটকে যায় স্বাগতিক ভারত। ১ উইকেটে ৯৮ থেকে দ্রুতই ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১২০/৮এ! এটা মেনে নিতে পারেন নি ইডেনের দর্শকেরা। শুরু হয় বোতল ছোড়া, গ্যালারিতে লাগিয়ে দেয়া হয় আগুন। এমন পরিস্থিতিতে খেলা চালিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ দেখেন নি ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড। শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করেই ম্যাচের সমাপ্তি টানেন ম্যাচ রেফারি। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে দর্শক হাঙ্গামার কবলে পড়া একমাত্র ম্যাচ এটিই।প্রসাদের প্রতিশোধ, আমিরের আক্কেল সেলামি১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-পাকিস্তানের মহারণ। ম্যাচ ছিল বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে যায় ভারত। ম্যাচটিতে উত্তেজনা ছড়ায় পাকিস্তানি ওপেনার আমির সোহেল ও ভারতীয় পেসার ভেঙ্কটেশ প্রসাদের ‘লড়াই’। লড়াইয়ের শুরুটা করেন আমির। আর শেষে মধুর প্রতিশোধ নেন প্রসাদ। ঘটনাটি পাকিস্তানের ইনিংসের শুরুর দিকে। ভারতের বড় সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে পাকিস্তানের দুই ওপেনার আমির সোহেল ও সাঈদ আনোয়ার তখন দুর্দান্ত। ভারতের দুই পেসার শ্রীনাথ-প্রসাদকে তুলোধুনো করে একের পর এক বাউন্ডারি আদায় করছিলেন তারা। এমন সময় প্রসাদের বলে একটি বাউন্ডারি হাঁকান আমির সোহেল। এসময় ক্রিজে প্রসাদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বল খুঁজলে উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকা সোহেল তাকে কভার বাউন্ডারির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে স্লেজ করেন। ব্যাপারটা মাথা নিচু করে হজম করলেও ঠিক পরের বলেই সোহেলকে বোল্ড করেন প্রসাদ। মিয়াঁদাদের ‘লম্ফ’১৯৯২ বিশ্বকাপে সিডনিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। আগে ব্যাটিং শেষে ভারতের সংগ্রহটা খুব বড় ছিল না। ২১৬ রানে থামে ভারতের ইনিংস। সহজ লক্ষ্য পেয়েও পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের শুরুটা ছিল বাজে। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানোর পর পাকিস্তানকে ভরসা জোগাচ্ছিলেন আমির সোহেল ও জাভেদ মিয়াঁদাদ। কিন্তু উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে ব্যাটসম্যানদের বিরক্ত করছিলেন ভারতীয় উইকেটরক্ষক কিরণ মোরে। মিয়াঁদাদই বেশি বিরক্ত হচ্ছিলেন। প্যাডে লাগলেই এলবিডব্লিউর আবেদন, কট বিহাইন্ডের আবেদন; চেঁচিয়েই যাচ্ছিলেন মোরে। এমন সময় অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে পিচে। মোরের এক আবেদনে বিরক্ত মিয়াঁদাদ ভারতীয় উইকেটরক্ষককে ব্যঙ্গ করে হনুমানের মতো লাফাতে থাকেন। বিশ্বকাপের ‘আইকনিক’ দৃশ্যগুলোর একটি হচ্ছে মিয়াঁদাদের সেই লাফ।মিসেস কপিল দেবের ‘শপিং’১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের জয়টা ছিল অভাবনীয়ই। জয়ের আশাটা পুরোপুরি মিইয়ে গিয়েছিল আগে ব্যাটিং শেষে ভারত ১৮৩ রানে গুটিয়ে যাওয়ায়। এমনকি খেলা দেখা বাদ দিয়ে হতাশা নিয়ে শপিং করতে চলে গিয়েছিলেন স্বয়ং ভারত অধিনায়ক কপিল দেবের স্ত্রী রোমি ভাটিয়া। তবে শেষ পর্যন্ত চমক দেখায় কপিল বাহিনী। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফাইনালে হট ফেভারিট ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ভারত। কথিত আছে, এ ঘটনার পর কপিলের স্ত্রী রোমি ভাটিয়া অনেক দিন খেলা দেখতেন না। তিনি খেলা না দেখলে যদি ভারত ম্যাচ জেতে, তাহলে খেলা না দেখাই ভালো।
- ট্যাগ:
- খেলা
- অদ্ভুত ঘটনা