নুসরাত হত্যায় ১৬ আসামি হুকুমদাতা সিরাজ

মানবজমিন প্রকাশিত: ২৯ মে ২০১৯, ০০:০০

মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার চূড়ান্ত চার্জশিট তৈরি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চার্জশিটে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া এই ঘটনায় আরও ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে বুধবার আদালতে চার্জশিট জমা দেবে পিবিআই। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার কাজে পাঁচ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এছাড়া মাদরাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন এবং সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলমকে ওই হত্যাকাণ্ডে আর্থিক ও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার বলেন, নুসরাত হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার। আমাদের সব ধরনের তদন্ত ও চার্জশিট প্রস্তুতির কাজ শেষ হয়েছে। তদন্তে এখন পর্যন্ত ১৬ জনের সম্পৃক্ততা স্পষ্ট হয়েছে। তাদের মধ্যে এজাহারে আট জনের নাম ছিল। অভিযোগপত্রে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে (৫৭) হুকুমদাতা হিসাবে আখ্যায়িত করে তার নাম এক নম্বরে রাখা হয়েছে। অন্যরা হলো- নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০), রুহুল আমিন (৫৫) ও মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।পিবিআই প্রধান বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৪(১) ও ৩০ ধারায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা এবং হত্যার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ও হত্যাকান্ডে সহযোগিতা করার এই ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আছে কোনো ব্যক্তি দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে কোন শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। আর ধারা ৩০ এ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা এবং সেই প্ররোচনার ফলে উক্ত অপরাধ সংঘটিত হয় বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা করা হয় বা কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন তাহা হইলে এই অপরাধ সংঘটনের জন্য বা অপরাধ সংঘটনের চেষ্টার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে প্ররোচনাকারী বা সহয়তাকারী ব্যক্তিও দণ্ডিত হবেন। আমরা অভিযোগপত্রে এই ১৬ জন আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাইব। সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, নুসরাতকে মাদরাসার সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে ডেকে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় পাঁচজন। এই পাঁচজনের তিনজনই ছিলো পরীক্ষার্থী। তারা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে এসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেছিল। ঘটনার শেষে তারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কারণে তাদের সম্পৃক্ততা বোঝার কোন উপায় ছিল না। তদন্তের স্বার্থে গ্রেপ্তারকৃতদের একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের ১৬ জনের মধ্যে ১২ জন ১৬৪ ধারায় নুসরাত হত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা এবং জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ১৬ আসামির মধ্যে নুসরাতের তিন সহপাঠী কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন আগুন দেয়ার মিশনে অংশ নেন। এছাড়া তাদের সঙ্গে শাহাদাত হোসেন ও জোবায়ের আহমেদ ছিলেন। মোট চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে আসামিরা মিশন সম্পন্ন করেছে। যেভাবে মিশন বাস্তবায়ন করা হয়: বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আমাদের বিস্তর তদন্তে জানতে পেরেছি যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতের মামলা ও তাকে গ্রেপ্তার করার পর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে অধ্যক্ষের অনুগতরা। নুসরাতকে নানা রকম ভয়ভীতি দেখানো হয়। এমনকি তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য একাধিক বৈঠক করা হয়।  হুমকি, ভয়ভীতি দেখানোর পরও নুসরাত মামলা না তোলায় আসামিরা তার প্রতি আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়া আগে থেকে শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই তারও একটা ক্ষোভ ছিল নুসরাতের ওপর। একপর্যায়ে তারা সবাই নুসরাতকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। সেই মতে কাউন্সিলর মাকসুদ শাহাদাতকে ১০ হাজার টাকা দেয়। এই টাকা দিয়ে শাহাদাত তার দূর সম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুটি বোরখা ও চার জোড়া হাত মোজা কেনায়। ৩রা এপ্রিল শাহাদাত, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজন মিলে জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করে। সেখানে সিরাজ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হুকুম দেয়। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করে যেন আত্মহত্যা বলে চালানো হয়। পর দিন মাদরাসার পাশের টিনশেড কক্ষে শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও কামরুন্নাহারসহ আরও কয়েকজন নুসরাতকে হত্যার চুড়ান্ত পরিকল্পনা করে। পিবিআই প্রধান বলেন, শাহাদাত হোসেন পর দিন ভূঁইয়া বাজার থেকে এক লিটার কেরোসিন কিনে এনে রাখে। ৬ এপ্রিল সকাল ৭টা থেকে শাহাদাত, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদরাসায় এসে পরিকল্পনা মোতাবেক অবস্থান নেয়। শাহাদাত পলিথিনে করে নিয়ে আসা কেরোসিন ও একটি গ্লাস ছাদের বাথরুমের পাশে নিয়ে রেখে দেয়। আর কামরুন্নাহার মনির কেনা দুটিসহ মোট তিনটি বোরখা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে স্লাইকোন সেন্টারের তিন তলায় রাখা হয়।  এখান থেকে শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের বোরখা ও হাত মোজা পরে তৃতীয় তলায় অবস্থান নেয়। নুসরাত পরীক্ষা দিতে আসার পর উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে বলে তার বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে। এই কথা শুনে নুসরাত ছাদের দিকে দৌঁড়াতে থাকে। নুসরাত দ্বিতীয় তলায় পৌঁছানোর পর পপি নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখায়। কিন্তু নুসরাত মামলা তুলবে না বলে পপির সঙ্গে ছাদে উঠে। নুসরাত ছাদে উঠার পর তার পেছন পেছন কামরুন্নাহার মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ ছাদে উঠে। এসময় তারা প্রত্যকেই নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে বলে। নানা রকম ভয়ভীতি দেখায়। তারা নুসরাতকে কয়েকটি সাদা কাগজে সাক্ষর করতে বলে। তাদের এসব কথা নুসরাত মেনে না নেয়াতে শাহাদাত বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে তার হাত পেছনে নিয়ে আসে। আর পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দেয়। জোবায়ের ওড়নাকে দুই ভাগ করে এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের দুই হাত পিছনে বেঁধে ফেলে। অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের নুসরাতের দুই পা বেঁধে ফেলে। এবার সবাই মিলে তাকে ছাদে মেঝেতে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে ধরে। মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ বাথরুমে লোকানো আগে থেকে এনে রাখা কেরোসিন একটি গ্লাসে ঢেলে এনে নুসরাতের পুরো শরীরের ঢেলে দেয়।  পরে শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের নুসরাত্‌ের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর ছাদ থেকে জোবায়ের, উম্মে সুলতানা পপি নামতে থাকে। এসময় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মনি পপিকে কাম কাম চম্পা-শম্পা বলে ডেকে নিচে নেমে যায়। বনজ কুমার বলেন, মিশন সফল করে জাবেদ তার পড়নের বোরখা শাহাদাতকে দিয়ে এবং কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে। এর আগে তিন তলায় তারা প্রত্যকেই বোরখা খুলে। এরপর শাহাদাত নিচে নেমে মাদরাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে গিয়ে পুকুরে বোরখা ফেলে দিয়ে চলে যায়। জোবায়ের মাদরাসার মুল গেট দিয়ে বের হয়ে যায়। তার বোরখা ও হাত মোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়। বনজ কুমার বলেন, নুর উদ্দিন সাইক্লোন সেন্টারের নিচ থেকে পুরো ঘটনার তদারকি করেছিলেন। মহিউদ্দিন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন শেল্টারের দুই সিঁড়ির সামনে থেকে পাহারা দেয়। মাদরাসার মূল গেটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারা দেয়। পরে তারা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালায়। তিনি বলেন, অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় যখন নুসরাত নিচে নেমে আসে তখন তার শরীরে কোন কাপড় ছিল না। সব কাপড় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আগুনে পুড়ে শরীরের মাংসগুলো খসে পড়ছিল। পরে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য ও গার্ডরা নুসরাতের শরীরের আগুন নেভায়। আর নুর উদ্দিন ও হাফেজ আব্দুল কাদের নুসরাতের গায়ে পানি ঢেলে তার ভাই নোমানকে ফোনে ঘটনার বিষয়ে জানায়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত